রঞ্জু ও সঞ্জু; সুমিত নাগ

সুমিত নাগের আগের গল্প-ভিনগ্রহীদের হাতের পুতুল

golporanjuosanju

সুমিত নাগ

ভাড়াবাড়িতে এসে প্রথমদিনেই রঞ্জুর মেজাজটা একটু হলেও বিগড়ে গিয়েছিল। আবার ভালোও লেগেছিল জায়গাটা দেখে। কিন্তু তখনও সে জানত না এইসব কিছুই না, আসলে কী কী অপেক্ষা করছে তার জন্য। এই দেড়মাস হল সে সরকারি স্কুলে চাকরি পেয়েছে। স্কুলটা বাড়ি থেকে একটু দূরে, তাই প্রথম মাসটা যাতায়াত করেই ঠিক করেছিল স্কুলের কাছাকাছি কোথাও বাড়ি ভাড়া পেলে ভালো হয়। রোজ রোজ আর সাড়ে চার ঘণ্টার ট্রেন জার্নি পোষাচ্ছে না।

বরুণবাবু স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্কুলের কাছেপিঠে থাকেন। তিনিই এই বাড়িটা দেখে দিলেন। শোবার ঘর ছাড়াও একটা ছোটো বসার ঘর, ছোটোমতো রান্নাঘরও আছে, স্নানঘর নিজস্ব। তুলনায় ভাড়াও কম। আর সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। কারণ, কিপটে বলে একটা অখ্যাতি রঞ্জুর চিরকালই আছে আর সে নিজেও, বাইরে যতই অস্বীকার করুক, মনে মনে মানে যে, এটা একেবারেই ভুল না। সব মিলিয়ে বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছিল রঞ্জুর। দু’দিনের মধ্যেই, মানে আজ জিনিসপত্র নিয়ে চলে এসেছে। বাড়িওয়ালা গোরাবাবু সস্ত্রীক ওপরতলাতেই থাকেন। ভালো লাগল তাঁকেও। সে একা কমবয়সী ছেলে বলে নিজে থেকে  দায়িত্ব নিয়েই কিছুটা ঠিকঠাক করে দিলেন ঘরগুলো।

সবই হল, কিন্তু এরপরেও রঞ্জুর মেজাজটা একটু হলেও বিগড়ে গেল।

প্রথম ব্যাপারটা ঘটল যখন ঘরের গোছগাছ সব শেষ, সারাদিনের দৌড়ঝাঁপের পরে বিকেলের দিকে রঞ্জু একটু আরাম করছে, এমন সময়। কলিং বেল বাজল। রঞ্জুর ঘরটা নিচে, আর ঘরে ঢোকার রাস্তাও বাড়িওয়ালার থেকে আলাদা, নিজস্ব কলিং বেলও রয়েছে- রঞ্জু শব্দ শুনে উঠে গেল দরজার কাছে। ভাবল, হয়ত গোরাবাবুই এসেছেন বা বরুণবাবুও এসে থাকতে পারেন। কিন্তু দরজা খুলে দেখল, পরপর তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে। রঞ্জু অঙ্কের শিক্ষক। দেখেই মনে হল এ যেন ঊর্ধ্বক্রমে সাজিয়ে পাই। তিনটে ছেলে বয়েস মোটামুটি বারো থেকে আঠারোর মধ্যে, আর উচ্চতাও যথাযথ। ঠিক ছোটো থেকে বড়ো। রঞ্জু ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কী চাই?”

বড়ো ছেলেটি বলল, “আমরা এখানকার ক্লাব থেকে এসেছি। সামনে নববর্ষ উপলক্ষে আমরা কিছু অনুষ্ঠান করি, লিটিল ম্যাগাজিন করি, নাটক হয়, গানের অনুষ্ঠান… আরও কিছু। তাই এই…” বলে একটা চাঁদার স্লিপ বের করে দেখাল।

এখানেই প্রথমবার রঞ্জুর মেজাজটা বিগড়ে গেল। আজই প্রথম এসেছে ও। এর মানে হল প্রথমদিন থেকেই ওর থেকে টাকা আদায় করার চেষ্টা। ‘উঁহু,’ রঞ্জু মনে মনে বলল, ‘এত বোকা আমায় পাওনি। এসব বাজে খরচের কোনও প্রশ্নই নেই!’ রঞ্জু দেখল, বাকি ছেলে দু’টো ওর দিকে গোলগোল চোখে তাকিয়ে আছে। ও চাঁদার স্লিপটা হাতে নিল না। মুখে বলল যে এখনই কিছু ও দিতে পারবে না। ছেলেগুলো একটু হতাশ হল। বারবার বলতে লাগল ওদের অনুষ্ঠানে কত কী হয়, একটু সাহায্য দরকার। কিন্তু রঞ্জুর মন ভেজাতে পারল না। শেষে রঞ্জু শিক্ষকসুলভ ভারী গলায় বলল, “তোমরা বাচ্চা ছেলে সব, এসব করে টাইম নষ্ট না করে… যাও, পড়াশোনা করো। এইসব আজেবাজে জিনিসে মন কেন এখন থেকে! নাটক যে করবে, সেসবের বোঝো কী তোমরা, এই তো বয়স।”

কথাটা বোধহয় গায়ে লাগল ওদের। আর কোনও কথা না বলে চলে গেল ওরা। বোঝাই যাচ্ছিল, মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। আর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল রঞ্জুরও। কে জানে, এরকমভাবে মাঝে মাঝে বিরক্ত করলেই হয়েছে!

এরপরেই আরও একটা কাণ্ড ঘটল। সেইদিনই রাতের দিকে একটু বাইরে বেরিয়েছিল ও। কিছু না, দুয়েকটা জিনিস কেনা আর জায়গাটা একটু দেখে-টেখে নেওয়া। ফিরে এসে দেখে, টেবিলের ওপরে যে বিস্কুটের প্যাকেট রেখে গিয়েছিল তার র‍্যাপারটা ছেঁড়া আর সারা ঘরে বিস্কুট ছড়ানো। তাও ভাঙা ভাঙা। রঞ্জুর ভয় হল যদি কোনও চোর এসে থাকে বা ওরকম কিছু। সে তাড়াতাড়ি ওপরে গিয়ে গোরাবাবুকে জানাল। কিন্তু কথাটা শুনেও বাড়িওয়ালার তেমন কোনও হেলদোল দেখা দেখা গেল না। তিনি ধীরেসুস্থে নীচে নেমে দেখলেন সবটা। তারপর ‘ভুতো, ভুতো’ করে ডাক দিতেই একটা সাদা-খয়েরি ছোপ ছোপ বিড়াল ছুটে বেরিয়ে এল। আর তাকে দেখেই গোরাবাবু যে হাসিটা দিলেন তাতেই বোঝা গেল এই অবলার প্রতি তাঁর টান বড়োই বেশি। তিনি বললেন, “ব্যাটা নিশ্চয়ই কোনও সময় তোমার অজান্তে ঘরে ঢুকে বসে ছিল। আসলে এতদিন ঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকত তো তাই ঘাপটি মেরে এখানেই লুকিয়ে থাকত মাঝে মাঝে। ইঁদুর-টিদুরও ছিল তো ঘরে। যাক, একটু দরজাটা ভেজিয়ে রেখো। ভুতোর আবার এই দোষ, খালি খাই খাই,” বলে বিড়ালটাকে কোলে তুলে নিয়ে স্নেহের হাসি হাসলেন।

রঞ্জু হাড়ে হাড়ে বুঝল, এ বিড়াল আদরে বাঁদর হচ্ছে। একে আটকানোর ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে। এমনিতেই রঞ্জু পোষা বিড়াল-কুকুর একদম দেখতে পারে না। ছেলেবেলায় তাকে একটা বিড়াল আঁচড়ে দিয়েছিল পায়ে। সেই থেকে বিড়াল সে অত্যন্ত অপছন্দ করে এসেছে।

এরপর আর কোনও সমস্যা ঘটেনি। ভুতোকে টাইট দিতে সে ভুলেও ঘর না বন্ধ করে বের হয় না। ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরোবার সময় কখনও-সখনও দেখে, জুলুজুলু চোখে ভুতো দরজার সামনে শুয়ে আছে। মনে মনে ও বলে, ‘বাছাধন, আর ঘরে ঢুকতে হচ্ছে না তোমায়।’ আর চাঁদার জন্যও ঝামেলা করেনি কেউ। সব মিলিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই জায়গাটা ভালোই লেগে গেল রঞ্জুর। স্কুলটাও কাছাকাছি, হেঁটে যেতে সময় লাগে মিনিট পনেরো। কাছেই একটা সুন্দর ঝিলের ধারে পার্ক আছে, বিকেলের দিকে স্বচ্ছন্দে সময় কাটানো যায়। আছে একটা খেলার মাঠ, যে জিনিসটা ওর নিজের বাড়ির ওখানে প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে ফ্ল্যাটের দাপটে। সেখানে গিয়ে মাঝে মাঝে ফুটবলে লাথি মারাও দেখা যায়। আর আছে একটা দারুণ সিনেমা হল। এটা রঞ্জু আশাই করেনি। ও হিন্দি সিনেমার খুব ভক্ত, শাহরুখ খানের ফ্যান! এই একটা ব্যাপারে টাকা খরচ করতে ওর গায়ে লাগে না।

কিন্তু তখনও সে জানত না, এইসব কিছুই না!

আসল ঘটনার শুরু যেদিন, সেদিন শনিবার, হাফ স্কুল। শেষ-বসন্তের হাওয়া খেতে বিকেলের দিকে রঞ্জু পার্কের ওদিকটায় ঘুরতে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে আসছে এমন সময় একটা কেউ পিছন থেকে ডাকল, “শোনো।”

গলাটা খরখরে। রঞ্জু ঘুরে দেখল, এক বৃদ্ধ তাকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা আর এই শেষ-বসন্তেও একটা হাল্কা চাদর গায়ে জড়ানো, হাতে লাঠি। তিনি বললেন, “তুমি সঞ্জু না? কবে এলে, বাবা? সব ভালো তো?”

রঞ্জু অবাক হয়ে তাকাল। এই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই তাকে আর কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন।

“না, আপনি ভুল করছেন। আপনি যার কথা বললেন, আমি সে না,” সে উত্তর দিল।

ভদ্রলোক মনে হয় ওর চেয়েও অবাক হলেন। “কী বলছ তুমি, সঞ্জু না? রায়দের বাড়ির ছোটোছেলে? মানবের ছেলে? চেন্নাই না ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করো?”

রঞ্জু ভদ্রভাবে বলল, “নাহ্‌, আমি না। আপনি ভুল করছেন।”

শুনে ভদ্রলোক একটু আঘাত পেলেন মনে হল। বললেন, “এই বুড়ো বয়েসে কি এত খারাপ অবস্থা হল যে এরকম ভুল করলাম! চোখটা কি একেবারে গেল নাকি! যাক, কিছু মনে করবেন না, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি,” বলে চলে গেলেন।

এমন কিছুই ব্যাপার ছিল না, ঘটনাটাও রঞ্জু কিছুদিনের মধ্যেই ভুলে যেত যদি না সেদিন বাসের টিকিট কাটার সময় দেখত যে পার্সটা পকেটে নেই। ব্যাপারটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক জয়ন্তবাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল রঞ্জুর। তাঁর মেয়ের পাঁচবছরের জন্মদিন। রাতে নিমন্ত্রণ, ফেরার তাড়াও ছিল। ফেরার বাসে উঠে ভাড়া দিতে দেখে পার্স নেই। নিশ্চয়ই কোথাও পকেট থেকে পড়ে গেছে। কারণ, বাসে তেমন ভিড় নেই, পকেটমারির সম্ভবনাও কিছু ছিল না। অথচ অনেকটা চলে এসেছে, নেমে যেতেও পারবে না ভাড়া না দিয়ে এতটা চলে আসার পর, সঙ্গে কোনও সামান্য খুচরো পয়সাও নেই। বাসের লোকেরা কী ভাববে, বিশেষ করে কেতাদুরস্ত পোশাকে অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে ফিরছে আর বাসের ভাড়া নেই,  ব্যাপারটা যা তা। কন্ডাক্টার ভাড়া চাইছে। কী করবে, কী করবে ভেবে শেষে লোকটাকে বলেই ফেলল কথাটা সাহস করে। তা কন্ডাক্টার ছাড়বে কেন? একটু কথা কাটাকাটি আরম্ভ হয়েছে কী হয়নি, হয়ত রঞ্জুকে বেইজ্জত হতেই হত, একটি মেয়ে হঠাৎই তার ভাড়াটা কন্ডাক্টারকে কেটে নিতে বলল। রঞ্জু অবাক হয়ে গেল। পরনে সালোয়ার-কামিজ, দেখে মনে হয় কলেজ কি ইউনিভার্সিটির ছাত্রী, কে এই মেয়েটি যে তার টিকিট কেটে দিল। সে একটু আমতা-আমতা করে মেয়েটার দিকে তাকাতেই, মেয়েটি এক গাল হাসিমাখা মুখে বলল, ‘অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি,  “অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি, তুমিই কি না। অনেকদিন দেখা হয়নি তো, ভাবছিলাম ডাকব কি! তারপর বুঝতেই পারলাম তুমি ছাড়া আর কেউ না। তোমার মতো ভুলোমনের লোকই বাড়িতে আজও পার্স ফেলে আসে। কেমন আছ, সঞ্জুদা?”

হায়! রঞ্জু হায়! কী উত্তর দেবে ও? কোনও এক সঞ্জু, হতে পারে তার সঙ্গে মিল আছে দেখতে, হয়তো যেকোনও কারণে নামটাও একইরকম, সে হয়তো এক ভুলোমনের মানুষ, হয়তো যাকে এভাবেই আগেও বাসে পার্স না থাকায় অপ্রস্তুত হতে হয়েছে মেয়েটির সামনেই, তার কথা ভেবে মেয়েটি তার টিকিটের দামটা দিয়ে দিল। রঞ্জু এখনই সরাসরি মুখের ওপর বলতে পারল না যে সে সঞ্জু না কারণ কে জানে, তাতে হয়তো মেয়েটি টিকিটের দাম যদি এখনি ফেরত চায়। কিছু তো বলা যায় না! সে বাকি রাস্তাটা ‘হ্যাঁ’,’না’,  ‘হুম’ জাতীয় ছোটো ছোটো শব্দে নানা প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করল। আর ভিতরে ভিতরে কুলকুল করে ঘামতে লাগল। মেয়েটির কথা শুনে রঞ্জু আন্দাজ করল, সে সঞ্জুর সঙ্গে কোনও এক টিউশনে পড়ত। তবে ‘দাদা’ বলছে যখন নিশ্চয় ছোট তার থেকে- আর দেখেও তাই মনে হয়। তখনই ওর মনে পড়ল, সেই বৃদ্ধ বলেছিলেন যে সঞ্জু রায়বাড়ির ছেলে, চেন্নাই না ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করে। কিন্তু তার বাবার নামটা রঞ্জুর মনে পড়ল না। মেয়েটি কথার ফাঁকে ফাঁকে কবে এলে, যেখানে চাকরি করো কেমন জায়গাটা – ইত্যাদি টুকটাক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে যেতে লাগল।  রঞ্জুর একবারই চেন্নাই যাবার সুযোগ হয়েছিল, ওর মাসতুতো দাদার বিয়েতে। ওখানেই থাকে বড়োমাসিরা, ছিলও বেশ কয়েকদিন। সেই সবই বানিয়ে বানিয়ে বলল কিছুটা। যাক, দুটো স্টপেজ পরেই মেয়েটি নেমে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রঞ্জু। অন্তত তখনকার মতো।

কিন্তু এই প্রথম যেন একটা রহস্যের আন্দাজ পেল ও, যেন ব্যাপারটা গোলমেলে, ঠিক স্বাভাবিক না- কেমন একটা অস্বস্তি জন্মাল ভিতরে ভিতরে।

পরের দু’সপ্তাহের মধ্যে যদিও ঘটনাটা ভুলে যাওয়া গেল। এর মধ্যে সে বাড়ি গেল একবার, বন্ধুর দিদির বিয়েতে দল বেঁধে কনেযাত্রী যাওয়া হল, ওতেই কয়েকটা দিন কেটে গেল হই-হট্টগোলে। ফিরে এসে আবার স্কুলের পরীক্ষার চাপ, খাতা দেখা- সবের মধ্যে ‘সঞ্জু’ নামটা অবচেতন মনের বৃত্তের একেবারে এককোণে, পরিধিতে গিয়ে আশ্রয় নিল। কিন্তু তারপরই ঘটনাটা ঘটল সিনেমা হলের মধ্যে।

সদ্য শাহরুখ খানের একটা সিনেমা বেরিয়েছে। রবিবার ছুটির দিন দেখে রঞ্জু দুপুরের দিকে সিনেমা হলে গিয়েছিল। টিকিট কাটা শেষ, সিনেমা হলে ঢুকতে যাবে হঠাৎ একজন কেউ ‘সঞ্জুদা’ বলে ডাকল। প্রথমেই খেয়াল হল না ওর, মাথা থেকে একেবারে মুছেই যাচ্ছিল নামটা। কিন্তু তখনই অবচেতনের ‘সঞ্জু’ বৃত্তের পরিধি ছেড়ে একেবারে কেন্দ্রে চলে এল। যেহেতু এই ক’দিনে এই নামটার সঙ্গে রঞ্জু পরিচিত হয়ে গিয়েছিল, তাই ডাকটা যে তারই জন্য, সে বুঝতে পারল। সে একটু গম্ভীর মুখে ঘুরে তাকাল। চশমা পরা একটি ছেলে, সদ্য গোঁফ বেড়িয়েছে, তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। ছেলেটি এগিয়ে এলো ওর দিকে। রঞ্জু কিছু বলার আগেই সে বলল, ‘পিসি কেমন আছে? কবে এলে তুমি?’ এক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে রঞ্জু আর কথা বাড়তে দিল না। সে যে সঞ্জু নয়, ছেলেটির ভুল হচ্ছে, সোজাসুজি বলে দিল ও। বারবার একই ঘটনায় একটা বিরক্তি জাগছিল ওর, ওদিকে সিনেমাও শুরু হয়ে যাচ্ছে, আর সময় নষ্ট করতেও ইচ্ছে করছিল না রঞ্জুর। ছেলেটা অবাক হয়ে আরও কিছু হয়ত বলার চেষ্টা করত কিন্তু সে আগেই মুখ ঘুরিয়ে সিনেমা হলের মধ্যে ঢুকে পড়ল।  

কিন্তু সিনেমা দেখতে বসেও ঠিক যেন স্বস্তি পেল না রঞ্জু। প্রিয় নায়কের ছবি দেখতে দেখতেও রঞ্জুর মনে কেমন একটা কাঁটা বিঁধে রইল। উপভোগ করতে পারল না আদৌ। সিনেমা হল থেকে বেরোবার সময় হঠাৎই ছেলেটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল ওর। দেখল, সে এখনও অবাক হয়ে তাকে দেখছে।

রঞ্জুর একটা আবছা ধারণা মনের মধ্যে গেঁথে বসল যে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা এভাবে শেষ হবে না। যদি সত্যিই তার মতো দেখতে, সমবয়সি কেউ এখানে কোথাও থেকে থাকে বা থাকত তবে আরও অনেকবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে হতে হবে। কেন কে জানে, ব্যাপারটা রঞ্জুর মোটেই ভাল ঠেকল না। সে একটু খোঁজখবর করার জন্য গোরাবাবুর কাছে ওপরে দেখা করতে গেল। গিয়ে দেখল, তিনি ভুতোকে কোলে বসিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছেন। তাকে ঢুকতে দেখেই ভুতো ‘ম্যাও’ করে বিরক্তি প্রকাশ করল। তাকে যে ভুতো একদমই পছন্দ করে না সেটা রঞ্জু ভালো করেই বোঝে। আদুরে বিড়াল বলে কথা! সে একথা সেকথা জিজ্ঞেস করতে করতে বলল, “এখানে কাছেপিঠে রায়বাড়ি বলে কিছু আছে?”

গোরাবাবু কিছুটা অবাক হয়ে নিজের বিড়ালের দিক থেকে চোখ তুলে বললেন, “রায় তো অনেকে আছে। এই পাড়ার আদি বাসিন্দাদের অনেকেই তো রায়।মানে, আমিও তো রায়।”

রঞ্জু বলল, “সঞ্জু বলে কেউ? আমারই মতো বয়স হবে।”

“তোমার মতো বয়সের কাউকেই আমি চিনি না ভালো করে। বাবার নাম বললে মনে করে কিছু বলা যায়-টায়।”

রঞ্জু ছেলেটির বাবার নাম যেটা সেই বৃদ্ধ বলেছিলেন সেটা মনে রাখতে পারেনি প্রথমদিন থেকেই। তাই কিছু উত্তর করতে পারল না। মনে মনে আফসোস করল, কেন সেদিন সিনেমা হলে ছেলেটার থেকে কথা বলে আরও কিছু জেনে নেয়নি। এত ভালো সুযোগ ছিল তার কাছে।

কিন্তু সঞ্জুর পরিচয়ের খোঁজ সে এখানেই থামাল না। রাতের খাবারটা রঞ্জু নিয়মিত বাইরেই খেয়ে নিত। ফলে একটা রুটি-তরকারির দোকানে তার কিছুটা পরিচিতি হয়ে উঠেছিল। সে সেখানেও খোঁজ নিল। এমন কেউ যে চেন্নাই বা ব্যাঙ্গালোরে থাকে, যার নাম সঞ্জু রায় ইত্যাদি। কেউই কিছু বলতে পারল না। এরপরের ঘটনা দ্রুত ঘটতে লাগল।

রঞ্জুর ছোটো থেকেই ভোরে ওঠা অভ্যাস। পরদিন সকাল সাড়ে-পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে সবে দরজাটা খুলেছে, আকাশে রোদের প্রথম স্পর্শের স্নিগ্ধতা, কানে আসছে দু’একটা পাখির কিচিরমিচির, কারো বাড়ি থেকে মৃদু স্বরে ভেসে আসছে রেডিওর শ্যামাসঙ্গীত, তখনই ও ঘুম জড়ানো চোখে দেখল, পায়ের কাছে, দরজার সামনে একটা খামবন্ধ চিঠি। সে তাড়াতাড়ি করে খামটা খুলে দেখতেই, ওর গলাটা ভয়ানক রকমের শুকিয়ে গেল। এক মুহূর্তে উবে গেল চোখে জড়ানো ঘুম। চিঠিতে লেখা, “তাড়াতাড়ি আমার জিনিসটা ফেরত দে সঞ্জু…নাহলে, আমাকে ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

সেদিন আর রঞ্জুর স্কুল যাওয়া হল না। সারাদিন ঘরে বসে বসে এই কথাই ও ভাবতে লাগল, কী করবে সে এখন। কে সঞ্জু, কার থেকে সে কী জিনিস নিয়েছে, কারাই বা কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, খুঁজে পেলেই বা কী হবে! কী সর্বনাশ! রঞ্জুর মনে হল, অজান্তে সে কোনও এক গভীর জালে জড়িয়ে পড়ছে। বা এমনও হতে পারে যে তাকে এই জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। হয়তো ঐ নামে আসলে কেউ ছিল, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার বদলে তাকেই এর শিকার করা হচ্ছে। সে যত ভাবতে লাগল তার গলা তত শুকিয়ে যেতে লাগল।

হায়! কেন মরতে সে এখানে ভাড়া নিয়ে থাকতে এসেছিল! রঞ্জুর মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। ছোটো থেকেই কারো সাতেপাঁচে থাকতে ভালোবাসে না। নিজের মতো নিজেকে নিয়ে থাকাই ওর অভ্যাস। কাজের মধ্যে, অনেক খেটেখুটে এই আধা-মফস্বলে সরকারি স্কুলে চাকরিটা পেয়েছিল। অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল স্কুল-শিক্ষক হবে, একদম ওর মনের মতো চাকরি। পেয়েছিলও ভালো। কিন্তু কী যে ছাই দরকার ছিল এখানে ভাড়া নেবার! সাধারণ, মধ্যবিত্ত, বাঙালি পরিবারের শান্তশিষ্ট ছেলের বুকে যে কত অজানা ভয় জমে থাকে তা আজ আবার নতুন করে টের পেল রঞ্জু। চিরকাল জীবনটা ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছে। ছোটো থেকে বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে যে জিনিসটা ওর সঙ্গে থেকে গেছে তা হল ভয়। আসলে ভয় জিনিসটাই আস্ত একটা ভয়ের জিনিস। একবার ধরলে আর ছাড়ে না। আর সবচেয়ে বড়ো ভয়, যা ছোটো থেকেই সঙ্গে সঙ্গে থাকে তা হল কিছু না করেও কিছু মুশকিলে পড়ার ভয়। এই ভয়ের বাড়া ভয় আর নেই। নিজেই জানে না কেন ভয়, কীসে ভয়। কিন্তু আছে, ভয় আছে!

আজ সেই ভয়ই আরও একবার রঞ্জুকে চেপে ধরল। মনে হল, সে যতই কোনও অপরাধ না করে থাকুক, কিছু একটা ভয়ানক তার জন্য অপেক্ষা করে আছেই। ওর গলা বারবার শুকিয়ে যেতে লাগল। কুল কুল করে ঘাম হতে লাগল। পেটে গুড়গুড় শব্দ আরম্ভ হল। মনে হল, বাতাসে যেন অক্সিজেন কিছুটা কম পড়ছে, দমবন্ধ লাগছে তাই।

রঞ্জু কাউকে কিছু না বলে সোজা বাড়ি চলে এল ক’দিনের জন্য। সে ঠিক করেছিল, বাড়িতে এসে পুরো ঘটনাটা খুলে বলবে মা-বাবাকে। কিন্তু তাঁদের সামনে ব্যাপারটা বলা আরও অসম্ভব মনে হল। আসলে নিজের মনের ভয়টা নিজের মনে থাকলে যত না বেশি থাকে, সেটা যখন বাড়ির লোকের ভয় হয়ে দাঁড়ায় সেটা যে কী বিশাল আকার নেয় সেটা বলে বোঝানো কঠিন আর সেই ভয়কে পার করবার মতো শক্তিও ওর নেই। তাই অনেক ভেবেও এখনই মা-বাবাকে কিছু বলা ঠিক হবে বলে মনে করল না রঞ্জু। চারদিন বাড়িতে স্রেফ বসে কাটাল। মা জিজ্ঞেস করতে বলল, অনেকদিন বাড়ির বাইরে থাকায় মনখারাপ হয়ে গেছে, তাই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। শুনে মায়ের মন আরও বেশি উথলে উঠল ছেলের জন্য। যে থাকাটা চারদিনে শেষ হত সেটা শেষ হল এক সপ্তাহ পেরিয়ে।

পরের সপ্তাহে রঞ্জু সরাসরি স্কুল করে ভাড়াবাড়িতে এল। সে ঠিক করে এসেছিল যদি সঞ্জুর চিহ্নমাত্র কোথাও দেখে বা শোনে তো সে এখান থেকে পত্রপাঠ বিদায় নেবে। সাড়ে চার কেন, সাড়ে চোদ্দ ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করেও সে যাতায়াত করবে স্কুলে, কিন্তু এই ঝামেলায় আর থাকতে পারবে না।

সেদিন শনিবার। হাফ ছুটির পর স্কুল থেকে ভাড়াবাড়িতে ফিরে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল ও। পরশু পয়লা বৈশাখ। এখনই পাগল করে দিচ্ছে গরম। ফ্রেশ হয়ে ফ্যানের নিচে শুয়ে শরীরে একটু ঠাণ্ডা ভাব আসছিল ওর। সকালে ট্রেনজার্নি হয়েছে, চোখের পাতা লেগে গিয়েছিল কখন সে বুঝতেও পারেনি। এমন সময় ‘কলিং বেল’ বেজে উঠল টুংটাং।

রঞ্জু দরজা খুলল।  একজন বছর সাতাশ-আটাশের, মানে ওরই বয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে রোদচশমা, পায়ে চকচকে জুতো। জামাটা বিশ্রীভাবে ঘামে ভিজে গেছে, কিন্তু বেশ ফিটফাট। রঞ্জু বলল, “বলুন?”

“আপনি সঞ্জীব রায়?”

রঞ্জু থতমত খেয়ে বলল, “না তো।”

“আমার কাছে খবর আছে আপনিই সঞ্জীব রায় ওরফে সঞ্জু।”

রঞ্জুর গলাটা এত শুকিয়ে গেল যে সে প্রথমে নিজের গলার স্বর নিজেই শুনতে পেল না। চিঁ চিঁ করে বলল, “না, আমি সঞ্জু না, ও নামে কাউকেই চিনি না। আমার নাম রঞ্জন নাথ।”

প্রশ্নকর্তা ওর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, “প্রমাণ দেখাতে পারবেন?”

রঞ্জু তাড়াতাড়ি বলল, “নিশ্চয়। আসুন ঘরে।”

আগুন্তুক ঘরে ঢুকে চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “কোনও চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। আমি সিবিআই থেকে আসছি। পুলিশ চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।”

এটা শুনেই রঞ্জুর মাথাটা একেবারে ঘুরে গেল। সে নিজের আইডেন্টিটি কার্ড বের করার জন্য সবেমাত্র টেবিলের ড্রয়ারে হাত দিয়েছে, এই কথা শুনে সে আচমকাই লোকটার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে, “বিশ্বাস করুন স্যার, আমি রঞ্জন নাথ, বাবার নাম দীপক নাথ, এখানে আমি স্কুলমাস্টারি করি, সত্যি বলছি…” আরও কত কী বলে যেতে লাগল।

লোকটা এভাবে ওর পায়ে পড়া দেখে আঁতকে উঠে বলল, “কী করছেন! উঠুন, উঠুন।”

রঞ্জু পা’দুটো প্রায় জড়িয়ে ধরে, “বিশ্বাস করুন স্যার, বিশ্বাস করুন,” বলে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা।

লোকটা মারাত্মক বিপন্নভাবে কোনওমতে পা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “পা ছাড়ুন দাদা, কী, করছেন কী? আপনি তো মহাভিতু দেখছি। আমরা তো মজা করছিলাম। প্লিজ, পা ছাড়ুন। উঠুন।”

রঞ্জু অবাক চোখে ওপরে তাকিয়ে বলল, “মানে?”

লোকটা এবার আমতা আমতা করে বলল, “প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আপনি এত ঘাবড়ে যাবেন জানলে এসব মোটেই করতাম না।”

রঞ্জুর তখনও ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়নি। লোকটা বলল, “আমাদের ক্লাব থেকে একদিন আপনার কাছে চাঁদা চাইতে এসেছিল আর আপনি কীসব বলে ওদের ভাগিয়ে দিলেন। বলেছিলেন, আমরা কী নাটক করি, করতে পারি কি না। তাই একটু মশকরা করে আপনাকে আমাদের নাট্যপ্রতিভা দেখাচ্ছিলাম আর কী! অভিনয়, চিত্রনাট্য কীরকম করতে পারি এসব। সেই বুড়োলোকটা কিন্তু আমি ছিলাম। মেকআপটা বলুন! কিন্তু আপনি যেভাবে সিরিয়াস নিয়ে নিলেন।”

রঞ্জু লোকটার মুখটা একবার ভালো করে দেখল। নাহ্‌, সত্যি কোনও মিল নেই সেই বৃদ্ধের সঙ্গে। ধীরে ধীরে মেঝে থেকে বিছানায় উঠে বসল ও। তার মনে তখন কী চলছিল এটা বলা মুশকিল। একদিকে সে ভয়ানক রেগে উঠছিল তাকে এত মানসিক অশান্তি দেবার জন্য আবার একই সঙ্গে অনেকদিন পরে তার বিপদটা আসলে কিছুই নয় ভেবে শান্তিও পাচ্ছিল। হয়তো এদের এই অভিনয় ক্ষমতায় একটু অবাকও হয়ে গিয়ে থাকবে। সে প্রথমে কোনও কথা বলতে পারল না।

এতক্ষণে ছেলেটাও থতমত খেয়ে গিয়েছে। সে কাঁচুমাচু মুখে ওর সামনে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, “বুঝতেই পারছি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমাদের এরকম কোনও ইচ্ছে ছিল না। এখন এ নিয়ে প্লিজ যেন থানাপুলিশ করবেন না। বুদ্ধিটা আমারই ছিল। জানি অন্যায় হয়েছে, কিন্তু এতে বাচ্চাগুলো ঝামেলায় পড়ে যাবে।”

এবার ছদ্মবেশী সিবিআই থুড়ি শখের নাট্যকর্মী থুড়ি ছেলেটা ওর পাশে বিছানায় বসে বিষণ্ণ স্বরে বলল, “এখানকার কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে, যারা স্কুল-কলেজে পড়ে তাদের নিয়েই বছরে দু’বার, একবার নববর্ষ আর একবার পুজোতে এই নাটক, গান-নাচের অনুষ্ঠান, এসব করি। একটা লিটিল ম্যাগাজিনও বের করি। নিজেদের লেখা নিয়ে। যতটুকু হয় আর কী সামান্য পুঁজিতে। নিজে আমি একটা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করি, সামান্য মাইনে পাই। তার মধ্যে এইসব নিয়েই বেঁচে থাকা। বাচ্চারাও ভালোবাসে। কিছুই না, একটু ভালো লাগা একঘেয়ে জীবনের মধ্যে যারা আমরা একটু এসব চর্চা করি, ভালোবাসি। পাড়ার লোকেরা অল্পস্বল্প চাঁদা দেয়। অনেকেই আবার এসব আপনারই মতো ভালোবাসে না। তারা দেয়ও না। অথচ দেখুন মাল্টিপ্লেক্সে কত খরচ করে হাবিজাবি ছবি দেখতে যায়। সেদিন আপনি যেমন…” বলে একটু থামল, “আর কী বলুন। কেউ যদি এগুলোকে খারাপ বলে খুব গায়ে লাগে। আপনি বুঝবেন না। তাই আর কী, একটু সেন্টিমেন্টাল হয়ে এরকম করে ফেললাম। প্লিজ, থানাপুলিশ করবেন না। খুব মুশকিলে পড়ে যাব আমরা।”

দু’জনে কেউ কোনও কথা বলল না কিছুক্ষণ। রঞ্জু স্থির চোখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল। ছেলেটা একটু উসুখুসু করে নীরবতা ভেঙে বলল, “আসি তাহলে। গোটা ব্যাপারটার জন্য দয়া করে মাপ করে দেবেন। আমি এক্সট্রিমলি সরি।”

ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। সে বেরিয়ে যাবে, এমন সময় রঞ্জু হঠাৎ বলে উঠল, “দাঁড়ান।”

বিছানা থেকে উঠে সে ড্রয়ার থেকে পার্সটা বের করে একটা একশো টাকার নোট ছেলেটির হাতে দিল। ছেলেটি একটু অবাক হয়ে তাকাল প্রথমে, তারপর সামান্য হেসে ধন্যবাদ বলে চলে গেল।

ছেলেটা চলে যেতে রঞ্জু আবার বিছানার উপর স্থির হয়ে বসল। তার মাথায় অনেক কিছু ঘুরছিল। পৃথিবীতে কত মানুষ আছে যারা নিজেদের সামান্য পুঁজি, স্বল্প সামর্থ্য দিয়েও নিজেদের ভালো লাগা, ভালোবাসাটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে। কিছু করার চেষ্টা করে, কিছু না হোক, কিছুক্ষণের জন্যও মানুষকে একটু আনন্দ দিতে পারে, জাগাতে পারে। এদের এই বিশ্বাস আর ভালোবাসা না থাকলে দুনিয়াটা অনেক নিঃস্ব হয়ে যাবে। তাদের একটু সাহায্য করলে নিজেরই ভালো লাগে। রঞ্জু কথাটা জীবনে প্রথমবার বুঝল। হঠাৎই ওর চোখ পড়ল, ছেলেটা যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করা হয়নি আর দরজার সামনে ভুতো সেই জুলজুলে চোখে চেয়ে আছে। রঞ্জু এই প্রথমবার ওকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, “আয় আয়, ভেতরে আয়।”

কিছুক্ষণ পরে সেইদিনের ‘ঊর্ধ্বক্রমে সাজিয়ে পাই’ ছেলেগুলোর সবচেয়ে ছোটোটা হাসিমুখে ওকে চাঁদার স্লিপটা দিয়ে গেল। আর নববর্ষের অনুষ্ঠানে ওকে  অতি অবশ্যই যেতে অনুরোধ করা হয়েছে।

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s