সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি গল্প প্রতিযোগিতা সপ্তম স্থান মাখনলালের ম্যাজিক ডায়েরি অপর্ণা গাঙ্গুলী বসন্ত ২০১৯

অপর্ণা গাঙ্গুলী

পালকের কথা

কাল চুপিচুপি পায়ে উঠে গিয়েছিলুম দিম্মির বাড়ির চিলেকোঠায়। সে ভারী ঘুরঘুরি পথ। এক পা ওঠো তো দুই পা পিছিয়ে যাও। যেন স্বপ্নের সিঁড়ি। ওই সব সিঁড়ি বেয়ে আমি কিছুতেই গন্তব্যে পৌঁছোই না, জানো। কিন্তু আজ পৌঁছতেই হবে। সে সব সিঁড়িগুলো দিক পরিবর্তন করে। আর সিঁড়ির গায়ের দেয়ালে লাগানো ছবিরা যেন জীবন্ত। এই কথা বলে উঠলো বলে।

দাদুভাই বলেন, ছবি কখনো কথা বলে না। বড়োদের ভারী অদ্ভুত সব ব্যাপার কিনা। তবু, এই তো সেদিন মেজোমামা ঘনামামার তোলা ছবি দেখে বললো, আহা ঘন্টিটা যা ছবি তোলে না, ঠিক যেন কথা বলে। আমার কান খাড়া হয়ে ওঠে। সত্যি সত্যি। সবাই বলে, আমার কান বেজায় বড়ো, খরগোশদের মতো, আর তাই বোধহয় আমি বেশি বেশি শুনি। আমি বলি, কিন্তু দাদুভাই যে বলে, ছবি কথা বলে না? মেজোমামা আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, বলে – ‘পাগলু’। তা হবে। এ কথা বন্ধুরাও বলে হরবখত। আমি কি করে বোঝাই, আমি কাক, পাখি, ছুঁচো, ইঁদুর, কুকুর, বেড়াল সব্বার কথা শুনতে পাই। বুঝতে পারি। এমনকি খুব গভীর রাতে যখন মা অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে, দিম্মি আর দাদুভাই নাক ডাকে তখন আমি তারাদের সব গপ্পো শুনি। তারারা চোখের জল ফেলে আর সেই জল শিশির বিন্দু হয়ে টুপটুপ লেগে থাকে ফুলেদের গায়ে। তারারা কেন কাঁদে এ কথা আমি অনেকবার ভেবে দেখতে চেষ্টা করেছি। জানি আমি কেমন যেন – এলেঝেলো, অদ্ভুত!

সব্বাই ঘুমুচ্ছে। এমনকি ফুলমতি বেড়ালনীও। ওকে ডেকেছিলাম, ও আধচক্ষু বুজে আমাকে বলেছে ও যেতে পারবে না, ঘুমুবে । যা হোক, বহু কষ্টে চিলেকোঠাতে পৌঁছে চাবি ঘোরাতেই খুট করে খুলে গেছে দরজা। আর একরাশ চামচিকে – ‘কি মজা কি মজা’ বলতে বলতে উড়ে গেছে বাইরে। ওরা যেন ইস্কুলের হঠাৎ-ছুটি-পাওয়া ছেলে মেয়ে। মনটা খুব ভালো হয়ে উঠেছে আমার। যাক উড়ে বেড়াক, ঘুরে আসুক একটু। আসলে আমি খুঁজছি মাখনলালের ডায়রি। মাখনলাল হলেন আমার দাদুর দাদু। শুনেছি তিনি ম্যাজিক জানতেন আর সেই ডায়রিতে অনেক অমূল্য ম্যাজিকাল খবরাখবর লিখে গেছেন। জাদু আমিও একটুআধটু জানি আর তাই সেই সব কথাবার্তা বেশ করে জেনে নেওয়ার জন্য আমার সেই ডায়রি খুঁজে পাওয়া খুব প্রয়োজন।

চিলেকোঠার এক পাশে রাখা একটা ঝাঁটা দিয়ে আমি প্রথমে ধুলো, মাকড়শার জাল সরাতে থাকি। তার আগে আমার সহচর কচটতপকে ডেকে নিই। একটা মন্ত্র আছে, বললেই ও এসে দাঁড়ায়।

বলি – ‘যা তো কচটতপ, তোর জাদুদন্ড দিয়ে মায়াঘুম পাড়িয়ে আয় দিকি বাড়ির সক্কলকে।’ ফুলমতি এমনিতেই বড়ো বেশি ঘুমোয়। ওকে বেশি ঘুম পাড়িয়ে লাভ নেই। কচটতপ অমনি কাজে লেগে পড়ে।
সারা ঘর ভরে ওঠে,
‘ইনকা বিনকা ক্যাতাপুলু,
সব্বাইকে বাগিয়ে সুলু …
ঘুম-ঘুম-ঘুম-ঘুম-ঘুমুলুউউউউউ’  – এই সব মন্ত্রে।
মোটামুটি সব পরিষ্কার হয়ে গেছে, এবার এগোনো যাক। ওমা এগোতে গিয়েই ওই আশ্চর্য ঝুড়িটা চোখে পড়ে। তার মধ্যে কয়েকটি লাল-নীল ডিম্। এই মরেছে, নিশ্চয়ই কোনো পাখির ডিম্ হবে। মা-পাখিকে না বলে ডিম্ সরানো যাবে না বোধহয়। আমি আর কচটতপ পাখি খুঁজতে থাকি। আর তক্ষুনি ডানাওয়ালা একটা বিশ্রী মতো কী যেন ওই প্রকান্ড সিন্দুকটার নিচে থেকে বেরিয়ে আসে। প্রথম দেখায় তোমরা ভাবতে একটা ছোট মাপের উটপাখি। কিন্তু তা নয়। অনেক ভেবে মাথা থেকে বের করতে চেষ্টা করি, ওটা কী। আর ঝপ করে মনে এসে যায় একটা নাম – ড্র্যাগন  !

আরিব্বাস … একটু ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাই আমি কিন্তু ড্র্যাগন কিচ্ছু করে না, শুধু ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের কান্ডকারখানা দেখতে থাকে। আমি এটা টানি, ওটা ধরি, কিন্ত কোথাও হদিশ মেলে না মাখনলালের ম্যাজিক-ডায়রির। ওদিকে ড্র্যাগন মাঝে মাঝেই ফুট কাটে। ‘ওরে অতই যদি সহজ হতো তবে কবে তোমার চোদ্দ পুরুষ খুঁজে পড়ে নিতো সে ডায়রি।’ ভুল। আমি মেন্টাল ম্যাথ কষি ঝটপট, চোদ্দ পুরুষ নয়, পাঁচ পুরুষ।

ড্র্যাগন ভারী উৎসাহে মন্ত্র পড়তে শুরু করে।

‘সামনে ফেরো পেছনে ফেরো, মাখনলালের বড্ডো গেরো,
উলুক-ঝুলুক মগের মুলুক, ডায়রির ওই তত্ব তালুক,
সব রয়েছে সিন্দুকেতে, অন্দরের ওই সুরঙ্গতে,
পড়োতো সেই মায়া মন্তর, খুলে যাবে ঠিক যন্তর।’

‘তা তো হলো, তা ওই সিন্দুকের সুড়ঙ্গ খুঁজে পাবো কী করে ম্যাডাম ড্রাগন?’

ম্যাডাম বলতেই বোধহয়, ড্র্যাগন হঠাৎ ভয়ানক রকমের পুলকিত হয়ে ওঠে। এক পা এক পা করে এঁকে বেঁকে সে এগিয়ে আসে আমার দিকে। কেমন এক জান্তব গলাতে বলে ওঠে।

‘সিন্দুকের সুড়ঙ্গে কেমন করে ঢুকবে, তাও বুঝি বলে দিতে হবে?’ বলেই টিটিরটিইইইইইটিহি টিহিটিহিটিহি করে সে কী ল্যাগব্যাগে হাসি যে হাসতে থাকে, কী আর বলি তোমাদের।

হাসি থামলে, আমাকে একেবারে অবাক করে দিয়ে ড্র্যাগন বলে। ‘কোথাও ঢোকার সবথেকে স্পষ্ট রাস্তা হলো, সেখানে গিয়ে বেমালুম ঢুকে পড়া। তাই করো।’

‘সে কী, আমি কী বাতাস যে অমন পারবো?’

‘ঢুকেই দেখো না’ বলে ওঠে ড্রাগন ভারী রাগী রাগী গলায়।

আমি আর কী করি, কচটতপকে আমার পিছু পিছু আসতে বলে সোজা ওই সিন্দুকের দিকে এগিয়ে যাই। আর হঠাৎ দুম করে ঢুকে পড়ি সেই বন্ধ, ভারী, নিরেট লোহার সিন্দুকের ভেতরে। সত্যি তো। এই তো ঢুকে পড়েছি আমরা আর সামনে একটা ফিতে রাস্তা এগিয়ে গেছে জঙ্গলের মধ্যে।

 বাপ রে আমাদের চিলেকোঠার সিন্দুকের মধ্যে যে এতো কান্ড, কে কবে জানতো।

যত পথ চলি তত সেই বিশাল বন দূরে দূরে সরে যায়। কতটা পথ যে হেঁটেছি তা বলা কঠিন। খেয়াল পড়ে, হাতের ঘড়িতে। আমি চিলে কোঠাতে ঢুকেছিলাম, তখন দুটো বাজে হবে, কিন্তু এখন মাত্র দুটো দশ। কিন্তু তা কী করে হয়? এত্ত সব কান্ড ঘটে গেছে মাত্র দশ মিনিটে? বনের দিকের পথ ধরেও তো কম হাঁটিনি আমি। মাথায় একটা বেল বাজলো। এমন হয়। কিছু নতুন চিন্তা এলে, টিং লিং টিং লিং মাথার মধ্যে একটা পাগলা ঘন্টি যেন বাজতে থাকে। আমি কী তবে টাইম ট্রাভেল করছি? শুনেছি, টাইম ট্রাভেল করলে নাকি সময় থেমে থাকে আর তাই টাইম ট্রাভেলারদের নাকি বয়স বাড়ে না। উফ, এই আমার মাথাটা থেকে বেরোবার কী কোনো পথ নেই? সারাক্ষণ উদ্ভট আজগুবি চিন্তা। কচটতপ হাঁটছে আমার সাথে সাথে। ও আমার মন পড়তে পারে। বলে, ঠিক বলেছো তুমি, টাইম ট্রাভেল, টাইম ট্রাভেল, ইন্টারেষ্টিং। ওর কথার উত্তরে কিছু বলতে যাবো এমন সময় সামনে, কে ও ? জটবিছুটি এক বুড়ি না? ইয়া লম্বা, মাথায় একটা অদ্ভুত চোঙা টুপি আর পরনে এক কালো আলখাল্লা। আমি তো খুব বই পড়ি, দেখেই চিনেছি, আমার বইয়ে দেখা বাবায়াগা বুড়ি। আমাদের দেখে বুড়ি ঘাড় নাড়িয়ে হাসে। বলে, এদ্দিনে সময় হলো? এবার তো তোমাকে খাবো … বেশ নধরকান্তি দেহখানি। আমি সাহস করে এগিয়ে যাই। বলি, বেশ খাওয়া পরে, এখন বলো তো মাখনলালের ডায়রি কোথায় পাবো?

শুনেই বুড়ির সে কী তড়পানি। ‘কোন রাক্ষসী তোমাদের বলেছে, কোন হিংসুটে দৈত্য তোমাদের এ কথা বলেছে !’ বুড়ি লাফায় আর মাথার চুল ছেঁড়ে, দাড়ি ছেঁড়ে। বেশ আধা ঘন্টা ধরে চলে সেই প্রচন্ড লাফানি আর চেঁচানি কিন্তু ঘড়িতে সেই দুটো পনেরো। অথচ এতক্ষণ আমরা যা যা করেছি, সে কি ঐটুকু সময়ের কান্ড? কিন্তু আমি আর কী করবো, তোমাদের বলেছিলাম কিনা সময়ের গোলকধাঁধায় যদি একবার পড়েছো, তবে তা থেকে বেরোনো কঠিন।

বুড়ি তখন নাচতে নাচতে ঘুরতে ঘুরতে অদ্ভুত এক মন্ত্র বলতে থাকে –

‘হটিন টট হউন হুম
এবার বুঝি ভাঙলো ঘুম
যা ঘুচে যা ছুমন্তর
বেড়ালের লেজ শেয়ালের ধড়
দৈত্যের জাদু এবার শেষ 
হারিকিরির আন রে বেশ
আয় রে আয়, আন রে আন
মাখনলালের ডায়রি খান।’

কী আশ্চর্য। আমাদের সামনেই বুড়ির কী অপরূপ পরিবর্তন। যেন ফটোশপে মর্ফিং করা। আমি আর কচটতপ এক্কেবারে হ য ব র ল হয়ে যেতে যেতে কোনোমতে নিজেদের সামলে নিয়েছি। বাবায়াগা ভ্যানিশ। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ডলবি-ডল। আর তার থেকেও বড়ো বিস্ময়, তার হাতে সেই ‘মাখনলালের ম্যাজিক ডায়েরি’।

ডলবি-ডল রোবোটিক গলায়  বলে ওঠে – ‘ওগো মেয়ে,  তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে। এক দৈত্যের শাপে আমার ওই অবস্থা হয়েছিল। তবে শাপ থেকে বেরোনোর পথ ছিল এই, যে যদি কোনো অদ্ভুতগুণসম্পন্ন কেউ এসে আমার কথায় ভয় না পেয়ে আমার কাছে মাখনলালের ডায়রি খোঁজ করে তবেই কিনা আমি ওই বুড়ি বাবায়াগার দেহ থেকে মুক্তি পেতে পারি। তোমার জন্যেই এ সম্ভব হলো, এবার বলো তুমি কী চাও।’ আমি সটান বললাম, ‘ওই ডায়রি আমার হাতে দাও আর আমাকে আর কচটতপকে আমাদের সেই চিলেকোঠায় পৌঁছে দাও।’ ডলবি যারপরনাই খুশি হয়ে বললো, ‘বেশ, তাই হোক, তবে তার আগে তোমাকে বলে দিই এই ডায়রি খোলার মন্ত্রখানা। শোনো মেয়ে, আমার নাম মায়াদেবী হারিকিরি। জগতে যত কিছু মায়াময়, অদ্ভুত, জাদুময়, সবই আমার তৈরি। তাহলে এবার শিখে নাও দেখি মন্ত্রটা।

কুচকাম্বার বনস্থালী
গুগাবাম্বার পাখপাখালি
আজব মানুষ কে রে এলি
মাখনলালের ডায়েরি খুলি।।’

এই বলেই মায়াদেবী আমার আর কচটতপের হাতে হাতে তালি দিলেন যেই, ওমা আমরা এক্কেবারে সেই চিলে কোঠাতে। দেখি ‘ল্যাগব্যাগর্নিস’ সেই অদ্ভুত ড্র্যাগনটা ঘুমিয়ে নিচ্ছে আর নাক ডাকছে, সুরুৎ সুরুৎ সুরুৎ সুরুৎ।   

আমাদের আওয়াজ পেয়ে সে হাত পা ছুঁড়ে বেজায় চমকে উঠলো। তারপর সামলে নিয়ে, লজ্জা পেয়ে  বললো, ‘এই তো গেলে, চলে এলে এক মিনিটেই? কী কী হলো? ওমা ওই তো তোমার হাতে সেই ডায়রি, দেখি দেখি।’ কচটতপ হয়তো ওকে টাইম ট্রাভেল এর ব্যাপারখানা বলতে যাচ্ছিলো, আমি ওকে টিপে দিলাম। বললাম ‘হ্যাঁ, তোমার জন্যেই পেলাম মা ড্রাগন। তুমি না থাকলে কিচ্ছু হতো না।’ ম্যাডাম ড্র্যাগন  আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো ফিক করে। তখনই দেখলাম ওর জিভ থেকে কেমন এক ঝলক আগুন বেরোলো। তারপর মা ড্র্যাগনের থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চিলেকোঠা বন্ধ করে নিচে নেমে এলাম সেই ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে। তখনও দেখলাম দেয়ালে লাগানো ছবিগুলো নড়ে সরে যাচ্ছে, কথা বলছে।

আপাতত মাখনলালের ডায়রির বিষয়বস্তু তো উদ্ধার হোক। ঘড়িতে সাড়ে তিনটে – মানে পুরো মিশন শেষ করতে লেগেছে, পুরো আশি মিনিট। কেউ বিশ্বাস করবে? আশি মিনিটে এত্ত বড়ো একটা কাজ ? সে না করুক, আজ দুপুরের লসাগু আর গসাগুগুলো বিকেলবেলা কষে নেবো খনে। স্কুলের হোমওয়ার্ক।

মাখনলালের ডায়রির কথা

আমি মাখনলালের ডায়রি বলছি। হে হে হে, যাকে নিয়ে তোমাদের কাছে এই গপ্পোগাছা আর কি। তা পালক তো ডায়রিটি পেলো। পেতই, মানে ওরই তো পাবার কথা ছিল আর কি। মাখনলাল যখন এই ডায়রিটি লিখেছিলেন তখন উনি জাদুকরী হারিকিরির কাছে ম্যাজিক সম্পর্কে আলোকপ্রাপ্ত হচ্ছেন। খুব ছোটোবেলা থেকে মাখনলাল ছিলেন ভারী অদ্ভুত। সবার সাথে মিশতে পারতেন না, খুব অল্প সংখ্যক বন্ধু ছিল ওঁর, তবে বুদ্ধি ছিল খুব বেশি। সবার সাথে মিশে বুদ্ধির দৌড় দেখাতেন না বলেই হয়তো লোকে ওকে অন্যরকম ভাবতো। পালকদের এই বাড়িটা তো মাখনলালের বাবার সময়কার, অনেক পুরোনো। মাখনলাল ওই চিলেকোঠাতেই কাটাতেন বেশির ভাগ সময়। তখন হারিকিরির দেখা পাননি, কিন্তু ছোটখাটো জাদু তিনি রপ্ত করেছিলেন তখনই। কি ভাবে যে সেসব মাখনলালের কাছে আসতো, কেমন ভাবেই যে সে সব ম্যাজিক ভেলকি তিনি আয়ত্ত করতেন তা এই চিলেকোঠার চার দেয়াল ছাড়া কেউ জানতো না। তারপর একদিন ইস্কুল থেকে ফেরার পথে এক গাছের তলায় দেখা পেলেন সে মায়াবতী জাদুকরী হারিকিরির আর কি ভাবে যেন হারিকিরি ঠিক বুঝতে পারলেন, এই ছেলেটি পারবে। তা মাখনলাল তো জাদু শিখে শিখে আমার পাতায় পাতায় লিখে রাখতে লাগলেন সে সব জাদু কীর্তি। মা বাবা যদি বলেন, হ্যাঁ রে মাখন, বাবা তুই ওই চিলেকোঠায় কেবল বসে বসে করিস কি ? আমাদের সঙ্গে দু’একটা কথাও তো বলতে পারিস। মাখনলালের বাবা অর্থাৎ পালকের দাদুর দাদুর বাবা ছিলেন দুঁদে উকিল। ভয়ানক গেরেম্ভরী মানুষ। মাখনলালের ওপর তাঁর অপত্যস্নেহ ছিল প্রবল। কিন্তু মাখনলাল বাপ্ মা কে কিছু ভেঙে বললে তো? তিনি হাসতেন আর তাঁর ম্যাজিক চালিয়ে যেতেন। হারিকিরি বলে দিয়েছেন ম্যাজিক শুধু ভালো কাজে ব্যবহার করবে, যদি সিদ্ধাই পাও আর খারাপ কাজে মানুষের ক্ষতি করতে সে ম্যাজিক ব্যবহার করো তবে মুশকিল। মুশকিল হলো, তোমার কাছ থেকে যত্ত ম্যাজিক সারা জীবন ধরে শিখেছো, সব চলে যাবে। সব। তা মাখনলাল খুব বাধ্য ছাত্র। তিনি কথা দেন, হারিকিরি তাঁকে  যা শেখাচ্ছেন তার অপপ্রয়োগ কখনোই করবেন না। ম্যাজিক শেখানো হয়ে গেলে হারিকিরি যে কোথায় চলে যান, মাখনলাল আর তাঁর হদিশ পান না। গুরুরা অমনই আসে। কোত্থেকে উদয় হন আর ছাত্রের পূর্ণজ্ঞান হয়ে গেলেই তাঁকে ছেড়ে দিয়ে চলে যান, এ কথা জানে মাখনলাল। আমার পাতায় পাতায় ম্যাজিক লেখা হয়ে যায়। ওই চিলেকোঠার ঘরটিতে কিসের সাথে কি কি সব মিশিয়ে কী যে তৈরি করেন মাখনলাল দিবারাত্র। এ সব চলে পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে। কেউ টেরও পায় না। বড়ো হয়ে সে বাবার মতো উকিল হবে, এই তাঁর বাবা মায়ের ইচ্ছে। কিন্তু বড়ো হয়ে মাখনলাল খুলে বসেন এক জাদু শেখানোর ইশকুল – নাম হারিকিরি, তাঁর গুরুর নামে। সে ইস্কুল অনেক অনেক বছর চলে, কিন্তু তারপর মাখনলালএর এক মস্ত বড়ো ভুলের জন্যেই ইস্কুলও বন্ধ হয়ে যায় আর মাখনলালের জীবনে অদ্ভুত এক যবনিকা নেমে আসে। সে গপ্পো বড়ো নিদারুণ, গায়ে কাঁটা দেওয়া এক হিলহিলে শিরশিরে ভয়-পাওয়ানো গপ্পো। সে তোমাদের সময় সুযোগ বুঝে পরে বলবো ‘খন। এখন দেখা যাক, পালক আমাকে, মানে মাখনলালের ডায়রিকে পেয়ে ঠিক কি করলো।

পালকের কথা

ডায়রি নিয়ে চুপি চুপি নেমে এলাম নিচে। তখন দাদুভাই, দিম্মি, মা, ফুলমতি বেড়ালনী, মানদা পিসি সবাই ঘুমে অচেতন। বাবা অফিসে। আমি নেমে এসেই ডেমির ঘরে, আমার ছোট্ট খুপরিটাতে ঢুকে গেছি। ওখানেই আমার সংসার, ম্যাজিকের সাজসরঞ্জাম লুকোনো থাকে। ডায়রির একটা সত্যিকারের  চোখ আর একটা সত্যিকারের মুখ আছে, অনেকটা এই রকম। হয়তো কথা বলে উঠবে যে কোনো সময়ে।

ডায়রির প্রথম পাতায় লেখা –

‘ম্যাজিক ভালো ম্যাজিক খারাপ ম্যাজিক অনেক রকম
ম্যাজিক সোজা ম্যাজিক রাজা ম্যাজিক বকম বকম
ভালো কাজে লাগাও যদি তুমিই হবে প্রাইম
খারাপ কারো কল্লে পরে পড়বে ধরা ক্রাইম
বুঝে শুনে অঙ্ক কষে ম্যাজিক যদি হয়
দেশের ভালো দশের ভালো তোমার হবে জয়।’

ইতি মাখনলালের ম্যাজিক ডায়রি

আমি প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা অবধি দেখতে চেষ্টা করি। আশ্চর্য, যতই পাতা উল্টোই ডায়রি আর শেষ হয় না। কত যে মন্ত্র, কত যে স্পেল, কত যে কাগজ কেটে আটকানো, কত যে ছবি আঁকা, তার মাথামুন্ডু নেই। আদ্যন্ত একটি জার্নাল। মাখনলালকে মনে মনে প্রণাম জানাই আমি। আর ডায়রিটি  আমার হাতে এসে পড়ার জন্য নিজের ভাগ্যকে বাহবা দিই।

যাই হোক, এখন অনেক কাজ। ডায়রীটাকে আপাতত আলমারির মধ্যে সেঁধিয়ে, চাবি এঁটে, গসাগু, লসাগু করতে বসে যাই। কচটতপকে টাটা করে দিই। সে বেচারা এতোক্ষণ আমার ঘাড়ের ওপর বসে ডায়রিতে কি লেখা আছে বোঝার চেষ্টা করছিলো।

ওকে বলি,

‘এখন যাও আসবে পরে,
বইটি তখন পড়ব জোরে,
করব অনেক জাদু টোনা,
এখন ঘুমোও কচু সোনা।’ 

বলামাত্রই, কচটতপ আমার ছোট চৌকিটার তলায় কোথায় ঢুকে পড়ে, সাড়া দেয় না।

‘ওমা কি ভালো মেয়ে গো, অঙ্ক কষছিস?’

এই রে! মায়ের ঘুম ভেঙেছে।

আমি স্বপ্নালু চোখে মায়ের দিকে তাকাই। মা আমাকে আদর করে দিয়ে বলে, ‘আসছি, তোর জন্যে লুচি আর আলুর ছেঁচকি করছে দিম্মি, নিয়ে আসি।’ লুচি আর আলুর সাদা ছেঁচকি আমার খুব প্রিয় কিন্তু আজ কিনা মাথা ভর্তি ম্যাজিক, তাই খুশিতে নরা-মরা-হরা হয়ে যাই না।

রাতে ডায়রি খুলতেই একটা পাতায় চোখ আটকে যায়। ‘সত্যি বলানোর কেক রেসিপি’। বেশ তো, এ কেক খেলেই লোককে সত্যি কথা বলিয়াই ছাড়বে? বাহ্ রে।

কেক বানানোর জন্যে চাই –

  • ময়দা
  • ডিম্
  • মাখন
  • চিনি
  • বেকিং পাউডার
  • আর স্পেল, যা বইতেই লেখা আছে।

তবে রাত হতে হবে পূর্ণিমা। ওমা মনে পড়ে গেলো তো, মানদাপিসি সকালবেলা বলছিলো, ‘পুন্নিমে এলে বাতের ব্যথা বড্ডো বাড়ে গো।’ তা আজই তো পূর্ণিমা।

ব্যাস, মিশন : সত্যি-বলানো-কেক।

দাদু দিম্মি খুব তাড়াতাড়ি ঘুমোয়, মা বাবাও আজ কি জানি হয়তো ম্যাজিকের গুণেই, শুয়ে পড়েছেন। কচটতপ আমাকে দিম্মির ভাঁড়ারঘর থেকে জিনিসপত্র সব জোগাড় করে এনে দিয়েছে। আমি কেক বানাচ্ছি, সব মিশিয়ে, ফেটিয়ে নিয়ে, অনেকটা ফেলে ছড়িয়ে, যাচ্ছেতাই করে আর মুখে বলে চলেছি স্পেল –

‘আজ বানাবো কেক
মিথ্যে কথার ভেক
চলবে না আর কারও
এবার সবাই সত্যি বলবে
ঘুচবে যা সব fake  …’

মোট ১১০ বার বলতে হবে মন্ত্র আর ফেটাতে হবে কেকের সরঞ্জাম। বলেই চলেছি, বলেই চলেছি, আর কচটতপ গুনেই চলেছে। ফ্যাটানো হয়ে গেলে, কেকের ব্যাটার আভেনে দিয়ে ঠিক আধঘন্টার মধ্যে তৈরী হলো ব্রাউন, ফোলা-ফোলা সত্যি-বলানো-কেক। আমি দারুন খুশি, ফুলমতী বাতাস শুঁকছে, আর কচটতপের্ মুখটা হাসি হাসি। কেক বাক্সোতে পুরে, সব কিছু ধুয়ে-মুছে রেখে, আমি যখন শুতে যাবো, ঘড়িতে চারটে বাজে। সে যা হোক, একটা কাজ হলো বটে।

বলবো কি, সেই কেকের কিছুটা বাক্সে চুপিচুপি পুরে নিয়ে ইস্কুলে তো গেছি। আর সেদিনই সেই ম্যাজিকের গুনাগুন বোঝা গেলো। ক্লাসরুমে মন দিয়ে অঙ্ক কষছি, এমন সময় মিস হোমওয়ার্কের খাতা জমা দিতে ডাকছেন। আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে, কাল লসাগু, গসাগু করে আমি খাতা ব্যাগে পুরেছিলাম, আর এখন দেখি খাতা নেই। খোঁজ খোঁজ। পায়েল, সখী, চম্পাকলি কেউ যদি খুঁজে পায় ! খাতা লোপাট। কী আর করা, বকুনি জুটলো কপালে। পৃথিবীর ভালো করতে গেলে এমন অনেক কষ্ট-দুঃখ সইতে হয়, নিজেকে বোঝাই। তা টিফিনের সময়, বন্ধুদের সবাইকে আমার বানানো কেক খেতে দিলাম। ক্ষতি আর কি হবে? না হয় সবাই সত্যি কথাই বলবে। মিথ্যে বলা খারাপ। সত্যি বললে তো ভালোই। ওমা, বিনীতা দেখি, সেই কেক খাবার কিচ্ছুক্ষণ পরেই হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলছে – ‘ওরে আমি তোর হোম ওয়ার্কের খাতা লুকিয়েছিলাম রে, আমাকে ক্ষমা কর প্লিজ।’ সবাই ওকে খুব বকতে থাকে কিন্তু আমি বলি, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর কোনোদিন করিস না বিনীতা, দেখলি তো আমি বকুনি খেলাম।’ মনে মনে খুশি হই ভারী। মাখনলালের ম্যাজিক কাজ করেছে, কাজ করেছে, কাজ করেছে।

আর এরপর যেটা হলো সেটা আরো রোমহর্ষক। বাড়িতে ফিরে দেখি, সবার মুখ ভার। আমি তো ঠিক করেছি, এই সব ম্যাজিক ঘটনার কথা কাউকে বলবো না। আমার প্রিয় বন্ধু চম্পাকেও না। মানদাপিসি দেখি গলগল করে মা আর দিম্মির কাছে ওর ছোট ছেলের সম্পর্কে হাত পা নেড়ে কি সব বলছে। সব শুনে বুঝলাম ওর ছোট ছেলে পকাই খুব দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে। মায়ের বাক্স থেকে টাকা পয়সা নিয়ে প্রায়ই এটা ওটা করে। চিন্তার কথা। মানদাপিসিকে আমি চুপি চুপি রাতে বাড়ি যাওয়ার সময় এক পিস্ কেক দিয়ে বললাম, ‘এটা পকাইকে দিও, আমি বানিয়েছি।’ মানদাপিসি একটু অবাক হলো ঠিকই। কখন আবার কেক বানালাম। কিন্তু নিয়েও গেলো, আর তার পরদিন? ফল হাতে নাতে। খুব সক্কালসক্কাল এসেই মাকে, দিম্মিকে, দাদুকে ডেকে তুলে শুনি মানদাপিসি বলছে – ওগো তোমাদের ভুল বলেছিলুম গো, আমার পকাই সোনার ছেলে গো, আমার পকাই সব বলে দিয়েচে, ও টাকা নিয়েছিল আর নেবে নে বলেচে, ওগো আমার কি ভালো হলো গো।

আমি আমার ছোট্ট খুল্লির ভেতর থেকে হাসি। কিন্তু ভুলেও মানদাপিসি বুঝতে পারেনা ওই ম্যাজিকাল কেকের কারসাজি।

আমার মাথায় আসলে এখন দারুণ এক প্ল্যান আসছে। তোমাদের কাছেই বলি, পারলে মতামত দিও। ভাবছি এমন কেক অনেক অনেক বানালে কেমন হয়? সব্বাই যারা মিথ্যে বলে, কেক খেয়ে সত্যি বলতে থাকে? কেমন? পৃথিবীর কত্ত ভালো হতে পারে, নয়?

মাখনলালের ম্যাজিক ডায়রি আমার কাছেই আছে। তোমরা ছাড়া আর কেউ তার অস্তিত্ব জানে না, এটাই ভরসা। আসলে কি জানো, যতই বলো, এই জগতে অনেক কিছুই আছে, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। আর বিশ্বাস রাখলে সত্যি সত্যি ম্যাজিক হয়।

ছবিঃ লেখক

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s