সব লেখা একত্রে–উমা ভট্টাচার্য
বিস্মৃত স্বাধীনতাকর্মী দুর্গাভাবিজি
উমা ভট্টাচার্য
ভারতের স্বাধীনতার জন্য ভারতমাতা যে কত প্রাণ বলিদান নিয়েছেল তার কোন ইয়ত্তা নেই। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমবেত প্রচেষ্টার ফলে এসেছে ভারতের স্বাধীনতা। এই যুদ্ধে যতজন নারী পুরুষ প্রত্যক্ষে শহীদ হয়েছেন,তাঁদের থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় নারী সকলের চোখের আড়ালে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন।
তাঁরা নিজেদের স্বার্থের চিন্তা,পরিবারের চিন্তা কিছুই করেননি। বিপ্লবীদের আদর্শ বাস্তবায়িত করার কাজে সহযোগিতা করার জন্য, তাঁদের জীবন বাঁচাবার জন্য সেই নারীরা নির্দ্বিধায় নিজের জীবন বিপন্ন করেছেন। নীরবে কাজ করে যাওয়ার জন্যই হয়ত এঁদের অবদান ভারতের মানুষ সহজেই বিস্মৃত হয়েছে।
বাংলার বিপ্লবীদের মধ্যে যেমনটি ছিলেন ননীবালা দেবী, তেমনই পাঞ্জাবের এক বিপ্লবী নারী্ ছিলেন,যাঁর কথাই থাকছে এবারের সেই মেয়েরা বিভাগে।
১৯ ডিসেম্বর ১৯২৮সাল।
সকালের ‘দ্য ট্রিবিউন পত্রিকা’ মারফৎ সারা ভারতে খবরটি ছড়িয়ে গেছে যে, প্রকাশ্য দিবালোকে,লাহোরের রাস্তা্য় আততায়ীদের গুলিতে নৃসংশভাবে খুন হয়েছেন জন স্যান্ডার্স, পাঞ্জাবের সহকারী পুলিশ কমিশনার। আততায়ীদের পথরোধ করতে গিয়ে খুন হয়েছেন আরও একজন পুলিশ কনস্টেবল। সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষপাতী বিপ্লবীদের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে গোপনে। আততায়ীদের ধরা যায়নি।
এদিকে তখন কলকাতায় বসছে কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন। উপস্থিত থাকবেন লাহোর কলেজের অধ্যাপক ও ‘নওজওয়ান ভারতসভা’র প্রতিষ্ঠাতা ভগবতীচরণ ভোরা, সুভাষচন্দ্র বসু, মতিলাল নেহরু, গান্ধীজি প্রমুখ বিরাট মাপের নেতারা।
পাঞ্জাব পুলিশের অনুমান, আততায়ীদের পক্ষে কলকাতায় পালানোর সম্ভাবনাই বেশি। সেদিনের ‘লাহোর ক্যালকাটা মেইল’ ট্রেনের গন্তব্য হাওড়া স্টেশনে সেদিন থেকেই নিরাপত্তার কঠোরতা ছিল অভাবনীয়। চলছিল জোরদার তল্লাশি।
পাঞ্জাবের লাহোর স্টেশনে যখন সকল যাত্রীকেই তল্লাসি করে ট্রেনে ওঠানো হচ্ছে, সে সময় স্টেশনে এসে একটি টাঙা থামল। টাঙাটি এসেছিল লাহোরে অবস্থিত ভগবতীচরণ ভোরার বাড়ি, পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের এক নিরাপদ আস্তানা থেকে। সওয়ারি এক ইংরেজ দম্পতি আর তাদের শিশুসন্তান।
সেদিন লাহোরে চলছিল তীব্র শীতল বাতাস। প্রবল শীত আর জোরালো বাতাসের জন্য সাহেবের পরিধানে একটি ভারী কোট, মাথায় খানিকটা কাত করে বসানো ফেল্ট হ্যাট, তাতে মুখের খানিকটা অংশ ঢাকা পড়েছে। হাতে ছড়ি। বাচ্চা ছেলেটি আর মেমসাহেবেরও পরিধানে ইংরেজী পোশাক, কোট, টুপি।
তখন স্টেশনে টহল দিচ্ছে প্রায় ৫০০ সশস্ত্র পুলিশ। তারা বিপ্লবী ভগৎ সিং আর তাঁর সহযোগী বিপ্লবীদের খোঁজেই স্টেশনে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই সহজভাবেই দম্পতি নামলেন, সঙ্গে নামল তাদের পরিচারক।
পরিচারকের হাতের বাক্সে যাত্রাপথের সম্বল খাবারের পাত্র, জল, শিশুর দুধ, বোতল ইত্যাদি। সাহেব লক্ষ্ণৌ স্টেশন পর্যন্ত তিনটি টিকিট কাটলেন। দুটি ফার্স্ট ক্লাসের আর একটি অন্য ক্লাসে তাদের ভৃত্যের জন্য।
দম্পতি নির্বাধে উঠে বসলেন ট্রেনে। নির্বিঘ্নে ট্রেন ছেড়ে দিল। আওরঙজেবের কব্জা থেকে শিবাজি মহারাজের আশ্চর্য পলায়নের মতই ঘটে গেল ঘটনাটা। সাহেবরূপী ভগৎ সিং সপরিবারে পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই বেরিয়ে গেলেন লাহোর থেকে।
ট্রেনের ভিতরে দেখা গেল, সাহেব পুত্রসন্তানকে কোলে বসিয়ে চেপেচুপে ধরে আছেন, তার ছোট্ট ব্ল্যাঙ্কেটখানি দিয়ে জড়িয়ে রেখেছেন তাকে। সেদিন বাইরের প্রবল হিমেল বাতাস মাঝেমাঝেই এসে ধাক্কা দিচ্ছিল কামরার জানালায়। শিশুটির মুখটি শুধু বেরিয়ে আছে। ছোট ছোট দুটি নিস্পাপ চোখে তাকিয়ে দেখছে ট্রেনের মানুষজনকে।
ভৃত্যটি আছে পাশের কামরার যা হেল্পারদের জন্যই নির্দিষ্ট। সে মাঝেমাঝে সাহেবের কামরায় আসছে শিশুটির দুধ, জল দিয়ে যাওয়ার জন্য। শিশুর মা নীরব চাহনিতে কথা চালাচ্ছেন ভৃত্যের সঙ্গে, দুধের বোতলটি নিচ্ছেন। বাচ্চার খাওয়া শেষ হলে ভৃত্য সেটি নিয়ে চলে যাচ্ছে নিজের কামরায়। এরই ফাঁকে সকলের দৃষ্টির আড়ালে একটি কাগজ হস্তান্তর হল। তা নিলেন ভৃত্যরূপী রাজগুরু।
অন্যদিকে পাশের একটি কামরায় চলেছেন এক সাধু্রূপী চন্দ্রশেখর আজাদ। তাঁর পরিধানে গেরুয়া বসন, ঝোলায় একটি হিন্দি গীতা। গুনগুন করে গাইছেন তুলসীদাসের দোঁহা। তবে চারদিকে অবশ্যই নজর রাখছেন। মাঝে মাঝে টয়লেটে যাবার অছিলায় ঘুরে যাচ্ছেন অন্য কামরাটি। ভৃত্য আর তার ওপরেই তো সাহেবের আর তাঁর পরিবারের রক্ষার দায়িত্ব, যা তারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন ভাবিজির পরিকল্পনামত। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রয়েছে এক একটি গুলিভর্তি পিস্তল, একেবারে রেডি-টু-ইউজ। এই সাহেবের মেমসাহেবটি ছিলেন দুর্গাদেবী ভোরা। ভগবতীচরণ ভোরার যোগ্য স্ত্রী, আপাদমস্তক বিপ্লবচেতনাময়ী এক নারী। বিপ্লবীদের একান্ত ভরসাস্থল দুর্গাভাবি।
ভারতের ইতিহাসে শতাধিক বৎসরব্যাপী প্রত্যক্ষ স্বাধীনতাসংগ্রামের মহাকাশে এক তেজোময় ধুমকেতুর মতই আবির্ভাব হয়েছিল তাঁর। বিক্ষুব্ধ পাঞ্জাবের বিপ্লবী তরুণ যোদ্ধাদের ওপর তাঁর যেমন বিপুল প্রভাব ছিল, তেমনি ছিল অকৃপণ সহযোগিতা। ভগৎ সিং, আসফাকুল্লা, চন্দ্রশেখর আজাদ আর শুকদেব-এর মত বিপ্লবীরা ছিলেন তাঁর স্নেহধন্য। বিপদে এঁদের নিরাপদ আশ্রয় আর পরামর্শদার্ত্রী ছিলেন তিনি।
পাঞ্জাবের ‘নওজওয়ান ভারতসভা’র একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ হয়েছিল বিপ্লবী শহীদ কার্তার সিং সরভের মৃত্যুদিবস পালনের অনুষ্ঠানের সময়। সেই সময়ের পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে ছিল বিপ্লবী। এদের কাছে কোর্টের সমন আসা বা গ্রেপ্তার হওয়া ছিল আনন্দের বিষয়। এমন ঘটনা ঘটলে আনন্দে সকলের মধ্যে লাড্ডু বিতরণ করা হত। পুলিশ গ্রেপ্তার করতে এলে সবাই সোল্লাসে চীৎকার করে বলে উঠত, ‘হুররে, ওরা আমাদের ধরে নিয়ে যাবার জন্য এসে গেছে।
‘নওজওয়ান ভারতসভা’ স্থির করেছিল ১৯২৬ সালের ১৬ই নভেম্বর তারিখে লাহোর শহরে, ‘কার্তার সিং সরভে’র একাদশতম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবে। এগারো বছর আগে, ওই তারিখে উনিশ বছর বয়সী কার্তার সিংএর ফাঁসি হয়েছিল লাহোর সেন্ট্রাল জেলে। (কনিষ্ঠতম বিপ্লবী শহীদদের একজন, বাংলার বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছিল মাত্র আঠারো বয়স আট মাস বয়সে, ১১ই আগস্ট ১৯০৮ সালে)। উভয়েই প্রায় সমবয়সের ছিলেন নিজেদের ফাঁসির সময়।
কার্তার সিং সরভের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ভারতীয় সেনাদলের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন সঞ্চারিত করে, তাদের ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলার চেষ্টায় সক্রিয়। পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষ ইংরেজের এই অন্যায় কাজকে মন থেকে মেনে নেয়নি।
দুর্গাভাবি আর তাঁর ননদ সুশীলা দেবী, দুই বিপ্লবী কন্যা মিলে শহীদ দিবস পালনের দিনে ব্যবহারের জন্য কার্তার সিং-এর বিরাট মাপের একটি পোর্ট্রেট তৈরি করেছিলেন। ২১বছর বয়সী বিপ্লবী ভগৎ সিং, যেদিন ফিরিঙ্গিদের দেশছাড়া করবার জন্য জনতাকে উদ্বুদ্ধ করতে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে ফিরেছিলেন, সেদিন প্রকাশ্যে তাঁর কপালে ‘আশীষতিলক’ পড়িয়ে অভিনন্দিত করেছিলেন মাতৃসমা দুর্গাভাবি।
যে কোনও রাজনৈতিক অ্যাকশনের নিখুঁত পরিকল্পনা করার অদ্ভূত দক্ষতা ছিল বঙ্গতনয়া দুর্গাভাবির। তাঁর নিখুঁত পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করেই, জন স্যান্ডার্সকে হত্যা করার পরেও, পুলিসের কড়া ধরপাকড়ের মধ্যে দিয়েই নিরাপদে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন বিপ্লবীরা।
যদিও তাঁরাই স্যান্ডার্সের হত্যাকারী বলে তখনও সঠিকভাবে চিহ্নিত হয়নি, তবুও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে, ঘটনার নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত পাঞ্জাবের ডিএভি কলেজে আর হস্টেলে পুলিশ তল্লাসি চালিয়েছিল। পরদিন পুলিশের নির্দেশে কলেজের ছাত্রদের রোলকল করে জানা গিয়েছিল কিছু ছাত্র অনুপস্থিত, যাদের অনেকেই ছিল বিপ্লবী ছাপ্পামারা ছাত্র। কিছু সন্দেহভাজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ বুঝেছিল হত্যাকারী বিপ্লবীরা পাঞ্জাব ছেড়ে পালিয়েছে বা পালাবে। তাই সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল রাস্তায় রাস্তায় চেকিং, কড়া পাহারা। সন্দেহভাজন হলেই গ্রেপ্তার।
লাহোর স্টেশনেও সেদিন জোরদার চেকিং চলছিলই, পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। ১৮ই ডিসেম্বর, ১৯২৮ সাল, লাহোর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাবে এমন সমস্ত ট্রেনেই চলেছিল চিরুনি তল্লাসী। বিশেষ করে বিপ্লবীদের ‘বিশ্বস্ত আস্তানা’ কলকাতায় যাবার ট্রেনে। সেদিনের সেই ‘লাহোর ক্যালকাটা মেল’এর যাত্রাকে পরবর্তীকালে ‘ঐতিহাসিক ক্যালকাটা মেল’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ১৮ই ডিসেম্বর দিনটি ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে ‘রেড লেটার ডে’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল।
পরের ঘটনাস্থল লক্ষ্ণৌ স্টেশন। নির্ধারিত সময়ে ট্রেনটি লক্ষ্ণৌ পৌঁছুলো। একটু পরেই নেমে গেলেন সাহেব, কাছের চায়ের দোকানে গেলেন চা খেলেন। ইতিমধ্যে মেমসাহেব বাচ্চা কোলে নামলেন ট্রেন থেকে। ট্রেনের ভিতর মেমসাহেবের থেকে পাওয়া কাগজটি, যেটি আসলে একটি ‘টেলিগ্রাম’, সেটি পোস্ট করতে অন্যদিকে চলে গেল ভৃত্য, কারণ সেটি তাঁদের পৌঁছোবার আগেই কলকাতায় পৌঁছুতে হবে। সকলেই আলাদা আলাদা নেমেছেন। এই স্টেশনে তেমন তল্লাসি নেই। ভয়ও নেই। সাহেব টিকিট কাটলেন আবার, এবারের গন্তব্য কলকাতা স্টেশন। হাওড়াতে সব প্ল্যাটফর্মেই চলবে তল্লাসি, ‘লাহোর ক্যালকাটা মেইল’ এর কোন সন্দেহজনক যাত্রী যেন ভয়ঙ্কর সশস্ত্র বিপ্লবীদের আস্তানা, বোমাশিল্পের কারখানা কলকাতায় ঢুকতে না পারে তাই এই ব্যবস্থা। খবর আছে তাঁদের কাছে। তাই তাঁদের গন্তব্য হাওড়া নয়, কলকাতা।
পরদিন তাঁরা এসে পৌঁছুলেন কলকাতা। তাঁদের ভৃত্য রাজগুরু আর সাধুবাবা চন্দ্রশেখর আজাদ বেনারসে নেমে অন্য ট্রেন ধরে চলে এসেছেন কলকাতায়। ওদিকে তাঁদের কলকাতা পৌঁছুনোর আগেই লাহোর ক্যালকাটা মেলের ঐতিহাসিক যাত্রা শেষ হয়েছে। নির্বিঘ্নে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেছে সেটি, কোন সন্দেহভাজন বিপ্লবীকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, নিশ্চিন্তে ফিরে গেছে।
এদিকে টেলিগ্রামের নির্দেশমত কলকাতা স্টেশনে সাহেবদের নিতে এসেছেন স্বয়ং অধ্যাপক ভগবতীচরণ ভোরা আর তাঁর ভগ্নী সুশীলা দেবী-যিনি দাদার দেখভালের জন্যই কলকাতায় এসে রয়েছেন। কেউ জানে না যে তাঁরা উভয়েই সশস্ত্র বিপ্লবী।
লাহোর থেকে সান্ডার্স হত্যাকারী বিপ্লবীদের নিরাপদে কলকাতায় নিয়ে আসার পুরো পরিকল্পনা ছিল ভগবতীচরণ ভোরার স্ত্রী বিপ্লবী দুর্গাভাবির। ভ্রাতৃসম ভগৎ সিংকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদে কলকাতায় পৌঁছে দিতে নিজে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়েছেন। সাহেবরূপী ভগৎ সিং-এর মেমসাহেব সেজে সঙ্গী হয়েছিলেন নিজে। ব্যাপারটা অধিক বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে নিজের দু-বছরের শিশুপুত্রকেও সঙ্গে নিতে দ্বিধা করেননি। সাহেব দম্পতির পুত্র সাজিয়ে কোলে নিয়ে চলেছিলেন নিজের পুত্র শচীন্দ্রনাথ ভোরাকে।
কলকাতায় এসে প্রথম দিন অধ্যাপক ভোরার ব্যবস্থামত তাঁরা রইলেন একটি হোটেলে। পরের এক সপ্তাহ তাঁরা ছিলেন শেঠ ছজ্জুরাম নামে এক অবাঙালীর তিনতলা বাড়িতে। সেটি ঠিক করেছিলেন অধ্যাপক ভোরার বোন সুশীলা দেবী। কেউ সন্দেহ করেনি। এখানে থেকেই মুন্ডিতমস্তক টিকিধারী, এক বাঙালি ব্রাহ্মণের বেশে ভগৎ সিং গিয়েছিলেন কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে। আর পাঁচজন সাধারন কংগ্রেস সমর্থকের মত, পরিধানে খেটো বাঙালি ধুতি, গায়ে উত্তরীয়, গলায় পৈতে এক ব্রাহ্মণ। কেউ কিছু সন্দেহই করেনি। সবই হয়েছিল ভাবিজির পরিকল্পনামত।
স্যান্ডার্সকে হত্যা করার আগেই ভগৎ সিং চিরকালের মত নিজের বাড়ি ছেড়েছিলেন।বাড়ির লোকেদের বিপদে ফেলতে চাননি। শিখ পরিচয় ঘোচাতে দাড়ি কামিয়ে, মাথা নেড়া করে ফেলেছিলেন। ভাবিজির নির্দেশমত সব কাজ হয়েছিল, না হলে শিখচিহ্ন দাড়ি-পাগড়ি পরিহিত চেনা চেহারায় তাঁকে চিনে ফেলা সহজ হত। ট্রেনের ভিতরে দাড়িগোঁফহীন সাহেবের মাথায় ছিল টুপি, কেউ চিনতে পারেনি। ভগৎ সিংএর ফেল্ট হ্যাট মাথায় যে একমাত্র ছবিটি আমরা দেখি, সেটি এই সময়ে কলকাতাতেই তোলা হয়েছিল।
দুর্গাভাবি বিপ্লবীদের পলায়নের পরিকল্পনা দিয়েই শেষ করেননি, সেটিকে নিজ দায়িত্বে বাস্তবায়িত করেছিলেন এই দুঃসাহসী মহিলা। স্নেহভাজন বিপ্লবী ভগৎ সিং-কে নিরাপদে কলকাতায় পৌঁছে দেবার কয়েক দিন পরে শিশুপুত্রকে নিয়ে একলা ফিরে গিয়েছিলেন লাহোরে, নিজের বাড়িতে।
কলকাতায় অবস্থানের ক’দিনের মধ্যেই বাংলার মেয়ে, বাংলাভাষী দুর্গাভাবি অনেক বাঙালী বিপ্লবীর সাথে ভগৎ সিং এর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। বটুকেশ্বর দত্তর কাছে ভগৎ সিং বোমা বানানো আর বাংলা ভাষা দুটোই শিখেছিলেন।
দিল্লীর ‘সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি হল’এ বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনাও কলকাতায় বসেই তৈরি হয়েছিল। ভাবিজি পাঞ্জাবে ফিরে গেলেও বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলই, প্রয়োজনমত তাঁদের নির্দেশ পাঠাতেন।
ভগৎ সিং লাহোরে ফিরলেন বিপ্লবের ধারনায় আরো ঋদ্ধ হয়ে। ৮ই এপ্রিল ১৯২৯ দিল্লীর ‘অ্যাসেম্বলি হলে’ বোমা নিক্ষিপ্ত হল, কেউ হতাহত না হলেও, বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য মরীয়া বিপ্লবীদের বিলি করা লিফলেট থেকে জানা গেল বোমাকান্ডের নায়কদের নাম। শোনা যায় ভগৎ সিং আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া শুকদেব আর রাজগুরুর বিচারের প্রহসন হয়েছিল লাহোরে। ইংরেজ সরকারের বিচারে তিনজনেরই ফাঁসির হুকুম হয়েছিল।
এই হুকুমের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদে নামলেন দুর্গাভাবি। নিজের সমস্ত অলঙ্কার বিক্রি করে মুক্তিপনের (জামিনের) টাকা সংগ্রহ করলেন, যদি ভগৎ সিংদের ছাড়িয়ে আনা যায়। এই তিনটি তাজা প্রাণকে রক্ষা করার জন্য তিনি অহিংস বিপ্লবের প্রবক্তা গান্ধিজির কাছেও আবেদন করেছিলেন। যদিও গান্ধিজি সে আবেদনে কান দেননি। তিন বিপ্লবীর ফাঁসি হলে, বদলা নিতে পাঞ্জাবের পূর্বতন অত্যাচারী গভর্ণর হেইলিকে হত্যা করার পরিকল্পনাও ছকে ফেললেন তিনি।
ভাবিজি ছিলেন আদ্যন্ত একজন নির্ভীক বিপ্লবী। ১৯২৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর, ভারতের ইতিহাসে আর এক দুঃখের দিন। লাহোর জেলে ৬৩দিন অনশনে থেকে মৃত্যু বরণ করলেন বাংলার বিপ্লবী যতীন দাস। তাঁর মৃতদেহ নিয়ে বিশাল প্রতিবাদী শোকমিছিল বেরিয়েছিল লাহোরে, আর সেই মিছিলেও সঙ্গী হয়েছিলেন নির্ভীক বিপ্লবী দুর্গাভাবি।
ইতিমধ্যে ভাবিজির তত্ত্বাবধানে, দিল্লির বুকেই বোমা তৈরি হচ্ছিল। ক্রমে ক্রমে অধ্যাপক ভোরার স্থাপিত ‘হিন্দুস্থান স্যোসালিস্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর সক্রিয় ও অপরিহার্য কর্মী হয়ে উঠেছিলেন ভাবিজি। যথার্থ অর্থেই অধ্যাপক ভোরার যোগ্য সহধর্মিনী ও সহযোদ্ধা ছিলেন তিনি। এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে আসা বাংলার কিশোরী মেয়েটি, ক্রমে স্বামীর বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত ও শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন।
১৯২৮ সালে, কলকাতা থেকে ফেরার পর সাহসিনী এই নারী রাজধানী দিল্লীর বুকে, ‘হিমালয়ান টয়লেট’ নামে একটি প্রসাধন সামগ্রীর কারখানা স্থাপন করেছিলেন। সেই নামের আড়ালে সেটি ছিল বোমা তৈরির কারখানা। অ্যাসোসিয়েশনের এক সক্রিয় সদস্য বিমল প্রসাদ জৈনকে দিয়ে সেই বোমার কারখানা চালাতেন ভাবিজি।
‘প্রদীপের নীচেই থাকে বেশি অন্ধকার’, এই প্রবাদে দৃঢ় বিশ্বাস রেখে দিল্লির কুতুব রোডের পাশেই স্থাপন করেছিলেন বোমার কারখানা। রাজধানীর বুকে, জনবহুল প্রকাশ্য রাস্তার ধারে এমন কাণ্ডকারখানা চলতে পারে তেমনটি কেউ আন্দাজই করতে পারেনি। ইংরেজ শাসকরাও সন্দেহ করতে পারেনি। এমনই ছিল ভাবিজির পরিকল্পনা, কারখানার নাম ও স্থান নির্বাচন।
এদিকে শত আবেদন নিবেদনেও ভগৎ সিং-দের ফাঁসির হুকুম মকুব হল না। অধ্যাপক ভোরা আর চন্দ্রশেখর আজাদ মিলে স্থির করলেন জেলে বম্বিং করে ‘ফাঁসির আসামি’ বন্দি তিন বিপ্লবীকে ছিনিয়ে আনবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তাঁরা দিল্লির কারখানায় তৈরি বোমা নিয়ে গেলেন। প্রথমে সেটির কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য গেলেন রাভি নদীর তীরে এক নিরালা জায়গায়। সেখানে বোমাটি টেস্ট করতে গিয়ে, সামান্য ভুলের জন্য সেটি আচমকা ভোরার হাতেই ফেটে গেল, বিস্ফোরণে প্রাণ হারালেন অধ্যাপক ভোরা। বোমার সূত্রসন্ধান করতে করতেই পুলিশ খোঁজ পেল দিল্লির সেই কারখানার। সেই সূত্রে দুর্গাভাবি গ্রেপ্তার হলেন। তিন বছর রইলেন জেলে। শিশুসন্তান রইল আত্মীয়ের কাছে। ইতিমধ্যে ভারতের ইতিহাসে বিপ্লবের ধারাপথে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, অনেক বদল হয়েছে বিপ্লবীদের কাজের ধারায়।
তিনি যখন মুক্তি পেয়ে জেলের বাইরে এসেছিলেন তখন নিঃস্বার্থ এই বিপ্লবী সংগ্রামীর খোঁজ নেবার মত কেউ নেই। ঠিক এমনটিই হয়েছিল বাংলার সাহসিনী বিপ্লবী, ননীবালা দেবীর ক্ষেত্রে। তাঁকে দেখার, আশ্রয় দেবার, অন্ন জোগাবার কেউ ছিলনা। দুর্গাভাবির ক্ষেত্রেও তেমনটিই হল। ক্রমেই তিনি পরিচিতি হারাতে লাগলেন। ধীরে ধীরে কালের গতিতে, স্বাধীনতা উত্তর পাঞ্জাবে সর্বহারা এই মানবী চলে গেলেন বিস্মৃতির অতল আঁধারে।
দুর্গাভাবি চরম কষ্টের মধ্যে বেঁচেছিলেন কিছু শুভান্যুধ্যায়ীর কৃপায়। অবশেষে বিরানব্বই বছর বয়সে মৃত্যু এসে এই মানহারা মানবীর জীবনযন্ত্রণায় যতি টানল। তিনি তখন ছিলেন গাজিয়াবাদের একটি ছোট্ট বাসগৃহে। সময়টা ১৯৯৯ সাল।
বাহান্ন বছর বয়সী ‘স্বাধীন ভারত’ তাঁকে কোন মর্যাদা দিল না, দিল না কোন মহান বিপ্লবীর উপযুক্ত সম্মান। অবশ্য শাসক ইংরেজ তাঁর নাম দিয়েছিল ‘ভারতের অগ্নি’, শাসকের কাছে ছিলেন মূর্তিমান এক আতঙ্ক।
তাঁর কোন এক শুভাকাঙ্খী, এক সময়ের সহযোদ্ধার কলমে লেখা তাঁর জীবনকথা থেকে জানা গেছে তাঁর জীবনযুদ্ধের কাহিনী। তাঁকে স্মরণ করা আর তাঁর স্বার্থহীন বিপ্লবী জীবনের কথা ছোটদের জানানো ছাড়া আর কিছু তো করার নেই আমাদের। তাই এবারের জয়ঢাকের ‘সেই মেয়েরা’পর্বে তাঁকে জানালাম শ্রদ্ধার্ঘ্য।
সেই মেয়েরা–আগের পর্বগুলো