সমস্ত লেখা একত্রে উমা ভট্টাচার্য
স্মরণীয় যাঁরা
বাসুদেও বলবন্ত রাও ফাড়কে
উমা ভট্টাচার্য
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহে সারা ভারতে এক বিপর্যয় ঘটে গেছে,ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার গেছে মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে। ব্রিটিশ শাসকেরা অনেক সতর্ক হয়ে গেছে মহাবিদ্রোহের ভয়ংকর রূপ দেখে,কিন্তু দেশীয় জনগণের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর কোন পরিবর্তন হয়নি। শোষণ, অত্যাচার,নিপীড়ন,ধরপাকড় চলছেই। বিদ্রোহ সফল হয়নি,স্বাধীনতা আন্দোলন সেভাবে দানা বাঁধেনি ভারতে।এই সময়ে পুণা শহরের এক চিৎপাবন ব্রাহ্মণ পরিবারে ১২ বছরের এক কিশোর বেড়ে উঠছিল। লেখাপড়ার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ,ঘোড়ায় চড়া এসব খেলাতেই ছিল পরম উৎসাহ। কিন্তু আর্থিক কারণে লেখাপড়া শিখে পরিবারের জন্য উপার্জনের রাস্তা খোলাই তখন তাঁর প্রধান লক্ষ্য। দেশের অবস্থার কথা,মানুষের দুর্দশার কথা জানেন, কিন্তু দেশের জন্য কিছু করা দরকার সেই ভাবনার জন্ম হয়নি তখনও তাঁর মনে।
গাঁয়ের পাঠ শেষ করে শহরে চলে আসেন পরিবারের সঙ্গে।স্কুলের পাঠ শেষ করে ১৮৬২ সালে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছিলেন বলে জানা যায়। এরপর কয়েক জায়গায় ছোটখাটো চাকরিও করেছেন,শেষে পুণার মিলিটারি ফিনান্স অফিসে ক্লার্কের চাকরি জুটে গেল। সেখানে কাজ করতে করতেই উপলব্ধি করতে লাগলেন পরাধীনতার কারনে ভারতের মানুষ নিজের দেশেই কতটা অসহায়,অত্যাচারিত। প্রতিনিয়ত দেখেছেন ‘নেটিভ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া ভারতীয়দের প্রতি শ্বেতাঙ্গ শাসকদের দুর্ব্যবহার।নানা জায়গায় ভারতীয়দের ওপর নানাভাবে ইংরেজদের অত্যাচারের কথা কানে আসত।ধীরে ধীরে বিদেশী শাসকদের ওপর বিদ্বেষ জমছিলই,কিন্তু পারিবারিক ভরনপোষনের দায়িত্ব মাথায় থাকায় চাকরিটি বজায় রাখতে হচ্ছিল। ইতিমধ্যে একটি দুঃখকর ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
একদিন তাঁর মায়ের গুরুতর অসুস্থতার খবর নিয়ে তার এল। কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটি চাইলেন, অনেক কাকুতিমিনতিতেও ছুটি মিলল না। অনেক পরে যখন ছুটি মিলল,তখন সব শেষ। মায়ের মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টি দুটোই হয়ে গেছে। এই ঘটনায় চরম মানসিক আঘাত পেলেন। মানবিকতাহীন বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে তাঁর মন চরম বিষিয়ে গেল, সিদ্ধান্ত নিলেন মাকে দেখতে পারেননি,তাঁর মৃত্যুসময়ে পাশে থাকতে পারেননি তাই ভারতমাতার পাশে দাঁড়াবেন,পরাধীনতার শৃংখল মোচন করবেন তিনি। ইংরেজ সরকারের চাকরিটি ছেড়ে দিলেন।এরপর শুরু করলেন তাঁর আন্দোলনের প্রথম ধাপ।
প্রথমে প্রচারের মাধ্যমে বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে জনতার মধ্যে দেশপ্রেম জাগানোর চেষ্টা করলেন। এজন্য নানা স্থানে ঘুরে ইংরেজের বিরুদ্ধে, ভারতের আজাদির পক্ষে প্রচার করতে শুরু করলেন।এভাবে রাজনৈতিক প্রচারের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন প্রথা যাকে বলে ‘পলিটিক্যাল প্রোপাগান্ডা’ শুরু হল তাঁর হাত ধরে।
১৮৭০সালে পুণা শহরের নানা জায়গায় দেখা যেত তাঁকে,হাতে ধরা একটি থালিকে একটি হাতা দিয়ে বাজিয়ে বাজিয়ে পথ চলতে চলতে মানুষজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছেন। লোকজন ভিড় করে দাঁড়ালেই সকলকে জানাতেন দেশের অবস্থার কথা,মানুষের দুর্দশার কথা। জানাতেন সভা হবে,সেখানে এলেই সব কথা জানতে পারবে সবাই। কোনদিন কোথায় সভা হবে জানিয়ে দিতেন, সকলকে সেইসব সভায় জমায়েত হতে আহ্বান জানাতেন। সেইসব সভায় নির্ভয়ে, প্রকাশ্যে তিনি বিদেশী, জবরদখলকারী ইংরেজ শাসকদের অত্যাচার আর শোষণের কথা বলতেন, ইংরেজ শাসকদের ‘ভারতছাড়া’ করার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হ’তে আহ্বান জানাতেন। বলতেন দেশের মানুষের ভালোর জন্য স্বশাসন অর্থাৎ ‘স্বরাজ’ চাই। ‘ভারত ছাড়ো’ আর ‘স্বরাজ’-ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে অতি গুরুয়্বপূর্ণ শব্দ দুটির জন্ম হল তাঁর বক্তৃতায়।
শক্তিশালী জনমত গঠনের জন্য পুণা শহর ছাড়াও মহারাষ্ট্রের নানা জায়গায়-পানভেল, তাসগাঁও, নারসোবাচিওয়াদি, প্রভৃতি অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে তিনি বক্তৃতা দিতেন। গরিব মানুষদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবারটিতে কোন মাঠে বা ময়দানে তিনি প্রকাশ্যে সভা করতেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে সামান্য চেতনা জাগছিল, কিন্তু এগিয়ে এসে সরাসরি ইংরেজের বিরুদ্ধে যোগ দেবার মত সাহস বা শক্তি তাদের ছিল না। কাজেই বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষের সারা জাগাতে না পেরে তিনি অন্য পথ ধরলেন। গোপন বিপ্লবী দল তৈরির ভাবনা এল তাঁর মাথায়। এভাবেই ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের হাতিয়ার সশস্ত্র বিপ্লবী দল তৈরি হল তাঁর হাত ধরে।
যে সময়ে তিনি বলছেন ইংরেজকে ভারতছাড়া করতে হবে আর দেশে স্বরাজ আনতে হবে সে সময়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসই গঠিত হয়নি। গান্ধীজি, নেহেরু, তিলক, লালা লাজপত রায়ের জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেবার অনেক আগেই এই মানুষটির মাথায় এসেছিল স্বরাজের ভাবনা,ইংরেজকে ভারত ছাড়া করার ভাবনা। ক্রান্তিবীর লাহুজি ভাস্তব সালভে ছিলেন মারাঠী সমাজে অস্পৃশ্য ‘মঙ’ গোষ্ঠীর মানুষ, কিন্তু জ্ঞানে ও প্রখর রাজনৈতিক ধারণায় তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। ফাড়কের পথপ্রদর্শক ছিলেন এই মানুষটি। বৈপ্লবিক চিন্তার বীজ তাঁর মধ্যে বুনেছিলেন তিনি।
যখন এই অতি সাধারণ মানুষটি প্রকাশ্যে ইংরেজ বিরোধিতায় নেমে পড়েছেন তখন সমাজের উচ্চকোটির গুটিকয় ব্যক্তিত্বরা নিজেদের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। বম্বে প্রেসিডেন্সি অ্যাসোসিয়েশন, পুণা সার্বজনিক সভা প্রভৃতি সংগঠন ভারতের শাসনতন্ত্র কেমন হবে সে-সব আলোচনাতেই নিজেদের আবদ্ধ রাখত, ইংরেজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কোন পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারনের মধ্যে ছিল নানা পিছিয়ে পড়া জাতির মানুষেরা যারা সমাজে ছিলেন অস্পৃশ্য। এদের নিয়েই তিনি দল তৈরি করা শুরু করলেন। কোলি,ভীল,ধাঙর প্রভৃতি নিম্নজাতির মানুষদের নিয়ে তিনি যে দল তৈরি করলেন তাঁর নাম দিলেন রামোসি। শিবাজির মাওয়ালী সেনাদলের আদলে শহর থেকে প্রায় অনেক দূরে ‘গুলটেকড়ি হিল’ নামে এক পাহাড়ের ওপর দলের ক্যাম্প খুললেন।
তিনি বুঝেছিলেন প্রবল ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী সংগঠন আর শক্তিমান, সাহসী, ঐক্যবদ্ধ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিপ্লবী সেনাদল। দৈহিক শক্তির বিকাশের জন্য শরীরচর্চার জন্য দেশীয় ‘আখড়া’ খুললেন,সেখানে লাঠিখেলা,কুস্তি আর অস্ত্রচালনা শিক্ষার ব্যবস্থা করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। দেশীয় অস্ত্র লাঠি, বল্লম ছাড়া আর কিছুই তাদের সম্বল ছিল না।তাই প্রথমে বলবৃদ্ধির জন্য কুস্তি,আর লাঠিখেলা দিয়েই শুরু হল তাঁর সেনাদল তৈরি করা।
অসামান্য নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে চলত তাঁর সমিতির কাজ।দলের সদস্যদের চারটি গ্রুপে ভাগ করে তাদের প্রত্যেক গ্রুপের ওপর আলাদা আলাদা দায়িত্ব দিলেন। প্রথম গ্রুপের কাজ ছিল অভিভাবক ও স্কুলের শিক্ষকদের অগোচরে সাহসী, স্বাস্থ্যবান, মেধাবী ছাত্র সংগ্রহ করে, তাদের নিয়ে কোন গোপন জায়গায় মিটিং করা, তাদের বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করা, স্বাধীনতার চেতনা ও ইচ্ছা জাগানো। ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাদের দেহেমনে প্রস্তুত করে ধীরে ধীরে বিপ্লবী দলে আনা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘ছাত্রদের অংশগ্রহণ’এর কাজটিও শুরু হল এভাবে। পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ।
দ্বিতীয় গ্রুপের কাজ ছিল গ্রামগঞ্জের অলিতে গলিতে দেশপ্রেমের গান গেয়ে পথ চলা। যাতে সভা সমিতিতে না গিয়েও সাধারণ মানুষ দেশপ্রেমের মর্ম বুঝতে শেখে।মানুষের আবেগকে জাগিয়ে তুলে,তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের ধারনা জাগানোর জন্য এভাবেই বোধ হয় ‘গনসঙ্গীত’এর ধারার সূত্রপাত হল তাঁর হাত ধরে।
তৃতীয় দলের কাজ ছিল ভ্রাম্যমাণ ‘কয়্যার’ পরিচালনা করা, সেই কয়্যারের কাজ ছিল ইংরেজ শাসকদের উদ্দেশ্যে রচিত ব্যাঙ্গাত্মক গান গেয়ে গেয়ে পথ চলা আর গানের মধ্যে দিয়ে শাসকের অত্যাচারের কথা আর দেশের মানুষের দুর্দশার কাহিনী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
দলের শেষেরটি ছিল ‘কোরগ্রুপ’, বিপ্লবী কাজকর্মের পরিকল্পনা তৈরি করা আর তা পরিচালনার ছক তৈরি করাই ছিল এই গ্রুপের কাজ।
এই সমস্ত কাজের জন্যই অর্থের প্রয়োজন ছিল। সামনাসামনি লড়াই দিতে গেলে অস্ত্র প্রয়োজন, সে-সব কিনতেও অর্থ চাই। এইসময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ছদ্মবেশে। উদ্দেশ্য দেশের স্বাধীনতার জন্য নানা জায়গার মানুষের মন বোঝা,রাজা, জমিদার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের মন বুঝে সমর্থন আদায় করা। এছাড়া সচক্ষে দেখতেও চাইলেন সাধারণ মানুষদের অবস্থা। আর স্বাধীনতার সেনা জোগার করাও ছিল অপর উদ্দেশ্য।
সকলের সঙ্গে অবাধে মেলামেশার সুবিধার জন্য তিনি জটাজুটধারী সাধুর ছদ্মবেশে বেড়িয়ে পড়তেন। নাসিক,ইন্দোর,উজ্জ্বয়িনী,বেরার,কোলাপুর,মীরাট সর্বত্র ঘুরতেন সেই সাধু। লোকে নাম দিয়েছিল ‘কাশীকা বাবা’।এই পরিব্রাজনের সুযোগে গোপনে যোগাযোগ হল অনেক দেশীয় রাজা-মহারাজার সঙ্গে।অনেক রাজা ও জমিদার ইংরেজ শাসনে সম্পত্তি হারাচ্ছিলেন,নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলেন।তাঁদের অনেকে তাঁর উদ্দেশ্য জেনে তাঁকে গোপনে অর্থ দিলেন।অনেকে প্রয়োজনে আরও অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিলেন।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে শুরু হল অজন্মা। পরপর কয়েক বছরে দুর্ভিক্ষ, অনাহার আর মহামারীতে মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কাতারে কাতারে মানুষের মৃত্যু হল।কিন্তু খাজনা আদায়ের জুলুমের কমতি হলনা।ইংরেজের বশংবদ খাজনা আদায়কারী নায়েব,গোমস্তা,সাধারণ কর্মচারী আর পুলিশের জুলুমে মানুষের জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠল।বাসুদেব বলবন্তরাও ফাড়কে প্রচার শুরু করলেন ইংরেজের কুশাসনের জন্যই আজ দেশের এই অবস্থা। শাসক দেশের মানুষের কাছ থেকে জোর করে যে অর্থ আদায় করছে তার ওপর দেশের মানুষের অধিকার আছে। তিনি অর্থ সংগ্রহের জন্য লুঠ, প্রয়োজনে ডাকাতি করার পরিকল্পনা করলেন।
সংগঠনকে জোরদার করতে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ২০ শে ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে পুণা শহর থেকে ৮০ মাইল উত্তরে এক নির্জন জায়গায় অনুগামীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে গঠন করলেন, ‘২০০ স্ট্রং মিলিশিয়া’ নামে বিপ্লবী সংগঠন। পরাধীন ভারতে এইটিই বোধ করি প্রকৃত অর্থে গঠিত ‘প্রথম সশস্ত্র ভারতীয় বিপ্লবী সেনাদল।’
অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রথমে অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন বলে পরিচিত লোকেদের বাড়িতে লুন্ঠন শুরু করলেন । কিন্তু দেশের মানুষদের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে উচ্চবিত্ত বা সম্ভ্রান্ত বলে পরিচিত মানুষদের বাড়িতেও বিশেষ কাঁচা পয়সা থাকত না। তাঁর লেখা একটা ডায়েরী থেকে জানা গেছে সে সময়ে লুন্ঠিত টাকা,গয়নার পরিমান কত কম ছিল।কারণ অধিকাংশ অঞ্চলই ছিল দুর্ভিক্ষপীড়িত ও পরিত্যক্ত।লুঠ করে যেটুকু টাকাপয়সা পেতেন তার কিছুটা অস্ত্র কিনবার জন্য রেখে বাকি টাকাপয়সা গরিব দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।
দেশ গাঁয়ের মানুষের আর্থিক অবস্থা তখন কেমন ছিল তা জানা যায় তাঁর লেখা এক ডায়েরির পাতা থেকে-
২৩শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৯ সালে এক রাতে ৪৫ জন অনুচর নিয়ে তিনি ধামারী গ্রাম আক্রমণ করেন। গ্রামবাসীরা তাঁকে বাধা দেয়নি। কিন্তু লুন্ঠিত জিনিসের পরিমাণ হল মাত্র নগদ ৯৫টাকা, আর তিন সের মত রূপোর তৈরি পুরনো গয়নাগাটি। ৫ই মার্চ তিনি উয়াল্লা গ্রাম লুঠ করলেন এবং সংগ্রহ হল মাত্র নগদ ৩০০ টাকা আর একশ টাকার মত কাপড়চোপড়। ১৪ই মার্চ তিনি হারুই গ্রামের ওপর চড়াও হলেন, পেলেন মাত্র ৫০ টাকার মত জিনিসপত্র। পরের গ্রামে আর কিছুই জুটল না। কোন গ্রামে তিনি বাধা পাননি, কারণ লুটের উদ্দেশ্য জনগণকে আগেই জানিয়ে দিতেন। এই অবস্থায় তাঁর স্বপ্ন সার্থক হবে না দেখে তিনি সরকারী অর্থ লুঠের সিদ্ধান্ত নিলেন।
১৮৭৯ সালের ১০-১১ই মে তিনি ও রামোশি নেতা দৌলতরাও নায়েকের সঙ্গে পালাস্পে আর চিখালিতে ইংরেজ খাজাঞ্চিখানা লুট করে পেলেন দেড় লক্ষ টাকা। ফেরার পথে এক মেজরের গুলিতে মারা গেলেন নায়েক। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন তিনি।
পরপর কয়েকটি ছোটখাটো ডাকাতির পর তাঁর ওপর নজর পড়ল ইংরেজের। তিনি পুনা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। পালিয়ে দক্ষিণে গিয়ে আশ্রয় নিলেন শ্রীশৈলামল্লিকার্জুন মন্দিরে। সেখানে লুকিয়ে থাকতে থাকতেই ইংরেজবাহিনীর সঙ্গে টক্কর দিতে ৫০০ জন রোহিলা স্বাধীনচেতা যুবক নিয়ে এক শক্তিশালী সশস্ত্র সেনাদল তৈরি করলেন।
পরপর অনেকগুলি আক্রমণ হানলেন ইংরেজবাহিনীর ওপর। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকের ক্ষয়ক্ষতি ততটা হল না। ইংরেজরা তাঁকে বিদ্রোহী বলে ধরে নিয়ে তাঁর খোঁজে লোক লাগাল, তাঁকে ধরে দেবার জন্য আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করল। তিনিও পাল্টা ইউরোপীয়দের হত্যা করার জন্য প্রতিটি খুনপিছু আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করলেন। গোপনে চলে গেলেন হায়দ্রাবাদে। এখানে আরব আর রোহিলাদের নিয়ে নতুন বিপ্লবী সংগঠন গড়লেন, আবার নতুনভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে লাগলেন।
তাঁর বিরুদ্ধে পুরস্কারের অর্থ ঘোষণা করাই ছিল, সেটা আরও প্রচার করা হচ্ছিল। অর্থের লোভে তাঁর পিছনে লোক লেগে পড়েছিল। একদিন যখন তিনি গোপনে পান্ধারপুরের দিকে যাচ্ছিলেন, সেইপথে তিনি ধরা পড়লেন ইংরেজ পুলিশের হাতে। দিনটা ছিল ১৮৭৯ সালের ২৩ শে জুলাই।
বন্দী অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল পুণাতে। তাঁকে আর তাঁর অনুগামীদের রাখা হয়েছিল ডিস্ট্রিক্ট সেসন কোর্ট জেলে। তাঁর ডায়েরি থেকে জানা গেছে, তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে আন্দামানে না পাঠিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল ‘এডেন’ জেলে । ১৮৮৩ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি তিনি পালালেন সেখান থেকে। কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন। আবার কঠোর নিরাপত্তায় তাঁকে জেলে রাখা হয়েছিল। শেষে তিনি আমরণ অনশন শুরু করলেন মুক্তির দাবীতে। দুর্বল শরীরে অনশন চলল না বেশিদিন। অবশেষে মৃত্যু এসে তাঁকে চিরমুক্তি দিল। ১৮৮৩ সালের ১৭ই জুলাই তাঁর মৃত্যু হল। ভারতের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসের প্রথম নায়কের মৃত্যুতে সংগ্রামী ধারাটি কিছুদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।
ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য, স্বরাজ, ভারত ছাড়ো, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের ধারণা, বিপ্লবী দল তৈরি, রাজনৈতিক ডাকাতি,ও আমরণ অনশনের ধারণার জনক এই বিস্মৃত মানুষটি জীবনের শেষ নিশ্বাঃস ত্যাগ করলেন বীরের মত-জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে, সুদূর এডেনের জেলে।
আজ সারা ভারতের সবাই হয়ত ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানের কথা মনেই রাখেনি সেভাবে। ১৯৮৪ সালে ভারত সরকারের পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট তাঁর নামে ৫০ পয়সার ডাকটিকিট বের করেছেন। আর দক্ষিণ মুম্বাইতে একটি চক্ তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। এই পর্বের ‘স্মরণীয় যাঁরা’তে তাঁর উদ্দেশ্যে রইল সামান্য স্মৃতিতর্পণ।
স্মরণীয় যাঁরা সব পর্ব একত্রে