তখন সবে মাসদুয়েক হয়েছে আমার বইয়ের দোকানটা খুলেছি। একদিন দুপুরে রতনদা এসে বলল, “আমার ছেলের জন্য একটা বই দাও দেখি।”
আমাদের পাড়ার মোড়েই রতনদার চায়ের দোকান। সকাল বিকেল সেখানেই চা খাই। আমার দোকান খোলার আগে যখন মিস্তিরিরা তাক-টাক লাগাচ্ছে, তখনই রতনদা একবার ঘুরে গেছে, “বইয়ের দোকান দিচ্ছ? বাঃ বাঃ!”
তা বললাম, “কীরকম বই দেব?”
“একটা সস্তা মোটা বই দাও না, যাতে বেশ কিছুদিন চলে। ছেলেটা আমার বই পেলে আর কিছু চায় না। বই বই করে পাগল।”
“সে তো ভালো গো! বই পড়া তো ভালো নেশা। কোন ক্লাসে পড়ে তোমার ছেলে?”
(ওঃ, অবশেষে বউনি হবে মনে হচ্ছে!)
“ক্লাস কী গো! সবে তো পাঁচ বছর হল। পড়তেই পারে না।”
“তবে কি অ আ ক খ’র বই দেব? হাসিখুশি, বর্ণপরিচয়…?”
“না না, সেগুলো তো চটি বই! বেশ মোটা বই দাও যাতে ক’দিন চলে।”
“তুমি কি পড়ে শোনাবে?”
“আমার অত সময় কোথায়? সারাদিন দোকান নিয়ে থাকি। নিজে নিজেই খেয়ে ফ্যালে।”
“খেয়ে ফ্যালে মানে? বই খায় নাকি?”
“আর বোলো না! পিন্টুটা বই ছাড়া কিছু খেতেই চায় না। কোনও বই পেলেই মলাটটা ছাড়িয়ে কাগজগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে মুখে পুরতে থাকে। এত বই আমি পাই কোথায় বলো তো! তাও ভালো হয়েছে তুমি বইয়ের দোকান দিয়েছ।”
“অসুখ করবে যে! ডাক্তার দেখিয়েছ?”
“বই খেলেই বরং ও ভালো থাকে। নইলে নেতিয়ে পড়ে। প্রথম প্রথম ভয় পেয়ে চন্দ্র ডাক্তারকে দেখাতে গেছিলাম। ভিজিটই নিল দু’শো টাকা। তারপর পাঁচ-ছ’টা টেস্ট করাতে বলল। অমৃতা ক্লিনিকে বলল তিন হাজার টাকা লাগবে। অত টাকা কোথায় আমার? রণেনবাবু বললেন অন্য ডাক্তার দেখাও। শুনেই ছেলে বলে – ডাকাতের কাছে যাব না, ডাকাতের কাছে যাব না। শেষমেশ হোমিওপ্যাথেটিক ডাক্তার ব্রজেনবাবুকে একদিন বাড়ি ধরে আনলাম। তিনি দেখেশুনে বললেন – আহা, ছেলেমানুষ, বই খেতে চাইছে! দাও না বই, দাও। পেট ভরে খাক। কিচ্ছু হবে না।”
ব্যাপারস্যাপার শুনে আমি একটা সস্তা রদ্দি ‘একশো ভূতের গল্প’ রতনদাকে গছিয়ে দিলাম। আমার বই বিক্কিরি নিয়ে কথা। সে খরিদ্দার খাবার জন্য কিনছে, না উনুন ধরাচ্ছে, তা জেনে আমার কী হবে!
পরদিন দুপুরেই রতনদা ফের এসে হাজির।
“কী বই দিয়েছ তুমি?”
“কেন?”
“খাচ্ছে না তো! চার-পাঁচটা পাতা খেয়েই ওয়াক থু ওয়াক থু করে ফেলে দিল। প্রথমে তো খুব খুশি, মলাট-ফলাট ছাড়িয়ে পরিপাটি করে খেতে বসল। তারপরই এই! এখন বলছে অন্য বই দাও।”
কী করি কী করি ভেবে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ দিয়ে দিলাম। মোটা বই। দামও বেশ কম। অনেকে ছাপছে এখন।
তারপর তিনদিনের জন্য বর্ধমান গেলাম। তাই রতনদার সঙ্গে দেখা হয়নি। ফেরার পরদিন সকালে চা খেতে গিয়ে রতনদাকে বললাম, “কী গো, ছেলে কেমন আছে?”
রতনদা মিটি মিটি হেসে বলল, “ছেলে তো পদ্য বলছে! যাও না। গিয়ে দ্যাখো।”
দোকানের পেছনেই রতনদার বাড়ি। গিয়ে দেখি পিন্টু চিবুকে হাত দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বারান্দায় বসে আছে।
পিন্টুর মা বলল, “কী রে পিন্টু, কিছু খাবি বাবা? খিদে পেয়েছে? একটা আম কেটে দেব?”
পিন্টু বলল,
“জননী আমার
ভাণ্ডারে তোর কী আছে দেবার
কী আছে খাবার, কী বা হাতাবার!”
এর দু’তিনদিন পর রতনদা আবার এল দোকানে, “সে বইটা শেষ। ভালোই খেয়েছে। আরেকটা দাও।”
সঞ্চয়িতা সেদিন স্টকে ছিল না। বই বাঁধাই কর্মীদের ধর্মঘট চলছিল। দোকানের সামনের ডিসপ্লে উইন্ডোতে একটা ‘মধুসূদন সমগ্র’ ছিল। বৃষ্টিতে সেটার নিচটা ভিজে কেমন হয়ে গেছিল, রোদ লেগে মলাটের রঙটাও চটে গেছে। এমনিতে তো বিক্রি হত না, হাফ দামে তাই সেটা রতনদাকে গছিয়ে দিলাম।
পরদিন সকালে চা খেতে যেতেই রতনদা একেবারে হাঁই হাঁই করে উঠল, “ফের তুমি কী সব বই দিয়েছ! খাবার পরে বমি-টমি করে একাকার। এখনও খালি হিঁক হিঁক করে হেঁচকি তুলছে আর কী সব সংস্কৃত বলছে!”
তাড়াতাড়ি রতনদার সঙ্গে ওর বাড়ি গেলাম। আমাকে দেখেই পিন্টু বলতে শুরু করল,
“ওরে পাপিষ্ঠ কারো অনিষ্ট কেন চাস?
সেবি উচ্ছিষ্ট প্রাণ অতিষ্ঠ হাঁসফাঁস।”
বুঝলাম বদহজম হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি রতনদাকে নিয়ে দোকানে গিয়ে ‘পথের পাঁচালী’ আর ‘আরণ্যক’ পাঠিয়ে দিলাম। অভিজ্ঞতা থেকে জানি কুকুর-বেড়ালেরা বদহজম হলে পরে ঘাস খায়। তাই আমার ‘পাঁচন’ আর ‘আরক’-এ যে কাজ হবে তাতে সন্দেহ ছিল না।
হলও তাই। পরদিন থেকে পিন্টুর কথাবার্তা স্বাভাবিক। খালি মাঝেমাঝেই নাকি বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে ঘোষালদের পুকুরপাড়ে কচুবনে ঢুকে যাচ্ছে।
ব্যাপারটা এবার আমি একটু আধটু ধরতে পারছি। তাই সাহস করে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতে আরম্ভ করলাম। প্রথমত ছোটোদের বই ছাড়া ওকে আর কিছু দিচ্ছি না। একদিন ‘পাগলা দাশু’ দিয়ে পরদিন সকালে গিয়ে দেখি পিন্টু রতনদার একটা ঢোলা পাতলুন পরে একটা হাঁড়ি নিয়ে কী সব করছে। আরেকদিন ‘পদিপিসীর বর্মিবাক্স’ দিয়ে দেখি পাতার পর পাতা ছিঁড়ছে আর গোগ্রাসে খাচ্ছে। ‘রাজকাহিনী’ দিয়ে দেখলাম সজনেডাঁটার মতো বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে চুষে চুষে খাচ্ছে। রতনদাও খুশি, আমারও বেশ বিক্রি হচ্ছে।
একদিন সকালে রতনদা দোকানে এসে বলল, “টিমটিম আছে?”
“টিমটিম আবার কী?”
“কাল থেকে ছেলে খালি বলছে টিমটিম খাব। টিমটিম দাও।”
“ও, টিনটিন! কমিকস। বাংলায় আছে।”
“ওই হল, আমি কী আর জানি অত! দাও দেখি আজ।”
‘বিপ্লবীদের দঙ্গলে’ আর ‘তিব্বতে টিনটিন’ গছিয়ে দিলাম রতনদাকে। পরদিন সকালে রতনদা বলে, “ওফ, কী ঝামেলা! বই তো নিয়ে এলাম। এবার ছেলে বলে কাঁটাচামচ দাও, টিমটিম খাব। শেষে ঘোষালবাড়ি থেকে ধার করে কাঁটাচামচ আর ছুরি নিয়ে এলাম, তবে শান্তি। কেটে কেটে কাটলেটের মত খেলো। তারপর থেকেই মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে – গণ্ডমূর্খ গণ্ডারের দল, পিপীলিকাভুক, সহস্র কুজ্ঝ্বটিকা – এইসব বলে। আর একেকটা জলের বোতল খুলছে, দু’ঢোঁক খাচ্ছে আর ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।”
হালচাল দেখে মাথায় একটা আইডিয়া এল। আমার দোকানে পড়ার বই-টই নেই, তাই বুদ্ধিটা আগে আসেনি। পিন্টুকে যদি অঙ্কের বই, ব্যাকরণ, বিজ্ঞান এসব খাওয়াই তাহলে তো দু’দিনেই ওকে বেশ পণ্ডিত করে তোলা যাবে। তখন কাগজের রিপোর্টারদের ডেকে পিন্টুর ইন্টারভিউ ছেপে বেশ নাম করা যাবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। পড়ার বই জোগাড় করা শুরু করলাম। ‘মধুসূদন’ খাইয়ে যে বিপত্তি হয়েছিল সেটা মাথায় ছিল, তাই প্রথমেই ক্যালকুলাস বা অরগানিক কেমিস্ট্রি খাওয়ালাম না। শুরু করলাম বর্ণপরিচয়, আদর্শলিপি, ছবিতে ধারাপাত এসব দিয়ে। ভালোই এগোচ্ছিল। তিনদিনেই পিন্টু একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র গড়গড় করে বলতে লাগল।
ব্যাপারটা ভণ্ডুল করে দিল শৈলেন। আমি যখন বিকেলে কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে যাই, শৈলেন নামে একটা ছোকরা দোকানে থাকে। ওকে পইপই করে বলেছি – ‘রতনদাকে আমি বই দেব, তুমি দিও না, অনেক হিসেব করে দিতে হয়।’ কে শোনে কার কথা! একবার অনেকদিন যাবৎ পড়ে আছে দেখে ‘সাধক বামাখ্যাপা’ বলে একটা বই রতনদাকে বেচে দিল। ভাবল আমি খুব বাহবা দেব। পরদিন রতনদার বাড়ি গিয়ে দেখি পিন্টু সারাগায়ে উনুনের ছাই মেখে বসে আছে আর বলছে, “মা গো, মা, ছেলেটাকে খেতে দিবি নে মা?”
আর এবার যে শৈলেন কী করল, ভাবলেও আমার কান্না পাচ্ছে। আমার সমস্ত পরিকল্পনার তেরোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিল। আমি দোকানে নেই এমন অবস্থায় আবার রতনদা এসেছে, আবার শৈলেন ওকে বই বেচেছে, আবার বাহবা পাবার আশায় বহুদিন অবিক্রীত বই। আর তারপর থেকে রতনদার বই নেওয়াই একদম বন্ধ হয়ে গেল। এক হপ্তা গেল, দু’হপ্তা গেল। রতনদা আর বই নেয় না! পিন্টু তবে খাচ্ছে কী? রতনদাকে ধরলাম।
রতনদা বলল, “ওঃ, শৈলেন যে আমার কী উপকার করেছে! এমন একটা বই দিল যা খেয়ে খোকার বইয়ের নেশাই ঘুচে গেল। এখন কাছে বই দেখলেই দূর ছাই বলে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। ভালোই আছে পিন্টু। যাও না, গিয়ে দ্যাখো।”
গিয়ে দেখি পিন্টু বারান্দার মেঝেতে থেবড়ে বসে একটা ঘুড়ি জোড়া দিচ্ছে। বারান্দার এক কোণে রতনদার শেষ কেনা বই ‘নির্বাচিত আধুনিক কবিতা’-র ছাইরঙা মলাটটা এখনও পড়ে আছে।
পিন্টুর মা বলল, “খোকা, খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি বাবা?”
পিন্টু বলল, “মা, হলকিস খাব।”
ছবিঃ অংশুমান