অরিন্দম দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
তানজানিয়া, পরিবেশপ্রেমী বিশেষ করে যারা বন্যজন্তু দেখতে ভালোবাসেন তাঁদের স্বর্গরাজ্য। সেরেঙ্গাটি ন্যাশনাল পার্ক এর মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয়। হাতি, সিংহ, গণ্ডার, লেপার্ড, জিরাফ, জেব্রা আর বুনো মোষ—শয়ে শয়ে বন্যপ্রাণী এই জঙ্গলের আকর্ষণ। আফ্রিকার সবচাইতে উচ্চতম পর্বত কিলিমাঞ্জারো তানজানিয়ার অংশ।
কেনিয়ার সীমান্তে উত্তর তানজানিয়ার একটি খনিজ সমৃদ্ধ লেক হল লেক ন্যাট্রন। সোডায় পরিপূর্ণ এই হ্রদের জলের রঙ ঘন লাল। ওল ডোইনিও লেংগাই এই হ্রদের দক্ষিণে অবস্থিত। মাসাই ভাষা ‘ওল ডোইনিও লেংগাই’-এর অর্থ ‘ঈশ্বরের পর্বত’।
তানজানিয়ার আরুশা অঞ্চলের গ্রেগরি রিফটের ওল ডোইনিও লেংগাই একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি—নিয়মিতভাবে বিশেষ জাতের লাভা, সোডিয়াম আর পটাশিয়াম কার্বনেট মিশ্রিত ন্যাট্রো-কার্বোনাটাইট উদ্গিরন করে চলেছে। ন্যাট্রো-কার্বোনাটাইটকে সংক্ষেপে নেট্রনও বলা হয়। ন্যাট্রো-কার্বোনাটাইট গিয়ে মিশেছে লেকের জলে। তাই লেকের নাম নেট্রন।
তানজানিয়ার এই লেকটি অন্যান্য হ্রদের থেকে চরিত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। লেকের লাল, কমলা আর গোলাপি রঙের জলেও রঙের ঘনত্বের মধ্যে তারতম্য বিস্তর। প্রচুর পরিমাণে ক্ষার মিশে থাকায় লেকের জল মারাত্মক বিষাক্ত।
কতটা বিষাক্ত? লেকের জলে মিশে থাকা ক্ষারের (pH – যাকে potential of hydrogen-ও বলে) পরিমাণ ১০.৫। এতই বিষাক্ত (ক্ষারীয় বা আ্যলকালাইন) লেকের জল যে কোনও পাখি বা জন্তু পড়ে গেলে তার চামড়া বা চোখ মুহূর্তে জ্বলে যেতে পারে। লেকের জল ঈশ্বরের পর্বত থেকে নির্গত সোডিয়াম কার্বনেট আর কিছু লবণে পরিপূর্ণ। লেকের জলে কোনও প্রাণী বা পাখি পড়ে গেলে খানিক সময়ের মধ্যেই তার শরীরের ওপর নুন-সহ খনিজের আস্তরণ জমে ওঠে। পাথরের তৈরি বা ফসিলের মতো দেখতে হয়ে ওঠে মৃত প্রাণীগুলো।
এই লেকের জল অন্যান্য অনেক লেকের মতো নদী বা নালার আকারে বেরিয়ে যায় না। জমা হতে থাকে একই জায়গায়। অবশ্য এখানে বৃষ্টিপাত খুবই কম হয়। বলা ভালো প্রায় হয়ই না। লেকের জলের তাপমাত্রা কখনও ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। টগবগ করে ফুটতে থাকে লেকের জল। জল বাষ্পীভূত হয়ে যায় আর পড়ে থাকে লবণ-সহ অন্যান্য খনিজের ঘন মিশ্রণ। অনেকটা ডেড-সির মতো। জলে লবণের ঘনত্ব বেশি থাকায় তাতে হ্যালো-আর্কিয়া (haloarchaea) নামে একধরনের লবণ-প্রেমী অনুজীবী জন্মায়। এই হ্যালো-আর্কিয়ার রঙ লাল হওয়াতে এই লেকের জলতলকে লাল বলে মনে হয়।
লেকের আয়তন খুব একটা কম নয়, ১০৪০ বর্গ কিলোমিটার। ৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ৫৭ কিলোমিটার লম্বা আর ২২ কিলোমিটার চওড়া এই লেকে জল আসে মাউন্ট কেনিয়ার হিমবাহ পুষ্ট নদী ইওয়াসো এনগিরোর শাখানদী বেয়ে।
আগ্নেয়গিরির এত কাছের লেক ন্যাট্রন কিন্তু হাজার হাজার ফ্লেমিঙ্গোদের প্রজননক্ষেত্র। আবার এই লেকের জলে ডুবেই পাথরে পরিণত হয় হাজার হাজার পাখি। তা সত্ত্বেও এই লেকটি ফ্লেমিঙ্গোদের অন্যতম আশ্রয়স্থল। কিছুই হয় না এদের। ফ্লেমিঙ্গোদের মোটা শক্ত চামড়া আর আঁশযুক্ত পা লেকের বিষাক্ত নুন ও উত্তাপ থেকে এদের বাঁচিয়ে রাখে। এদের নাকের ভেতরে থাকা বিশেষ গ্রন্থি জল থেকে নুন সরিয়ে পানের জন্য শুদ্ধ জল পেতে সাহায্য করে। আবার প্রয়োজনে এরা আশেপাশের ঝরনা থেকেও জলপান করে আসে।
লেকের বিষাক্ত জলের জন্য শিকারিরা এই লেক থেকে অনেক দূরে থাকে। ফলে এটি হয়েছে উঠেছে ফ্লেমিঙ্গোদের নিরাপদ প্রজনন কেন্দ্র। বস্তুত এই লেকটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফ্লেমিঙ্গো আবাস। প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ফ্লেমিঙ্গোর বাস এখানে। এই ফ্লেমিঙ্গোগুলি এখানে জন্মানো এক জাতের নীল-সবুজ শৈবাল খেয়ে বেঁচে থাকে। কিছু অন্যান্য জলপ্রিয় পাখি, যেমন সারসও বেঁচে থাকে এই বিষাক্ত লেকের জলে। লেকের জলের উপরিভাগ অনেকটা আয়নার মতো স্বচ্ছ। ঠিক কাচের দরজা যেমন হয় তেমনি। দরজা যে আছে বুঝতে না পেরে অনেকেই কাচের দরজায় ধাক্কা খান। পাখিরা খাবারের সন্ধানে জলে ঝাঁপ দিয়ে খাবারের কাছে পৌঁছনোর আগেই বিষাক্ত নুনের মিশ্রণে জারিত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। মূলত পরিযায়ী পাখিরাই লেকের খাবারের ফাঁদে পা দেয়। লেকের আশেপাশে বসবাসকারী পাখিরা সাধারণত লেকের ধারেকাছে ঘেঁষে না। ২০০৭ সালে বন্যপ্রাণী ভিডিও তোলার ছোটো একটি দল হেলিকপ্টার নিয়ে উড়ছিল লেকের ওপর দিয়ে। লেকের কিনারায় কাছে উড়তে উড়তে জলতলের খুব কাছ থেকে ছবি তুলতে গিয়ে পাখিদের মতো ভুল করেন পাইলট। জলতলের স্বচ্ছতার ধোঁকায় উচ্চতার হিসেবে গোলমাল হয়ে যাওয়ায় আছড়ে পড়েন লেকের জলে। হেলিকপ্টারের পাইলটের পা ভেঙে গেছিল আর একজনের মেরুদণ্ড। আর একজন কোনোভাবে পাড়ে উঠে কাছের এক মাসাই গ্রামে পৌঁছতে সক্ষম হন। মাসাইরা এসে স্ট্রেচার বানিয়ে হেলিকপ্টার হতে আহতদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে স্থলভাগে। হেলিকপ্টারটিও লেকের জলের ক্ষার-লবণ-দ্রবণে ঝাঁঝরা হয়ে গেছিল অচিরে।
লেকের কিনারার কাছাকাছি কিছু প্রজাতির মাছ যেমন, অ্যালকোলাপিয়া ল্যাটিলাব্রিস আর কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণীও দিব্যি বেঁচে থাকে। কিন্তু সংখ্যায় এরা খুবই নগণ্য।
অধিকাংশ পাখি এই লেকের জলে ডুব দিলে তা ক্যালসিফাইড হয়ে যায়। পুরো হাড়ের মতো শক্ত হয়ে যায় শরীরটা। দেখতে মনে হয় যেন একটা পাথরের পাখি। সোডিয়াম কার্বনেট আর সোডিয়াম বাইকার্বনেট এই ঘটনার জন্য দায়ী। প্রাচীনকালে মিশরীয়রা মৃতদেহ মমি করার জন্য এই দুটো জিনিস ব্যবহার করত। বলতে গেলে এই লেকের বিশেষত্ব প্রথম বিশ্বের দরবারে হাজির করেন ব্রিটিশ ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার নিক ব্রান্ডেট ২০১৩ সালে। তাঁর তোলা এই লেকে পাথর হয়ে যাওয়া পশুপাখির ছবি বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল।
ব্র্যান্ডেট একটা নতুন ছবির বই তৈরি করার জন্য পূর্ব আফ্রিকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। মূলত লুপ্তপ্রায় প্রাণীর ছবি তোলার কাজই করছিলেন। এই ধরনের কাজ যেমন সময়সাপেক্ষ তেমনি বিপদজনক। বিশেষ করে আফ্রিকায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সূত্রের খবরের পেছনে ধাওয়া করে গিয়ে কিছু পাওয়া যায় না। তিনি লুপ্তপ্রায় প্রাণীর সন্ধান করতে করতে গিয়ে পৌঁছন ওল ডোইনিও লেংগাই আগ্নেয়গিরির কাছে। সেখান থেকে লেক ন্যাট্রন। প্রথমবার তিনি যখন লেকের ধারে পড়ে থাকা পাথরের মতো দেখতে পাখির অবিকল রূপ দেখেন, চমকে উঠেছিলেন। এত নিখুঁতভাবে পাথরের পাখি বানানো সম্ভব! দ্রুত ছবি তুলতে শুরু করেন তিনি। এরপর ছবি প্রকাশিত হবার পর চমকে ওঠে সারা দুনিয়া। গবেষণায় নানা তথ্য উঠে আসে।
কেমন পরিণামে প্রস্তরীভূত পাখি দেখা যায় এখানে? নিক ব্রান্ডেটের কথায়, “লেমিংএর মতো মৃত পাখির ঝাঁক একসঙ্গে দেখেছি লেকের তীরে। জমে পাথর হয়ে যাওয়া কয়েকশো ফিঞ্ছ পড়ে আছে ৫০ গজের মধ্যে। আমার কাছেও অবিশ্বাস্য লাগছিল দৃশ্যটা।”
কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে লেকের ধারে থেকে এই নুনে সংরক্ষিত পাখিদের নমুনা সংগ্রহ করা তথা কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করাটা ব্রান্ডেটের কাছে খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। স্থানীয় মাসাইরা ধরে নিয়েছিল, মরে যাওয়া পাখির নমুনা সংরক্ষণের নামে সাদা চামড়ার লোকটা আসলে লেকের চারধারে ঘুরে গুপ্তধনের সন্ধানে এসেছে। অনেক বুঝিয়ে আর মাসাইদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তবে ওদের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন উনি। মাসাইরা ওকে দেখিয়েছিল একের পর এক ফসিল হয়ে যাওয়া পাখি। তার মধ্যে একটা ছিল মাছধরা ঈগল। চমকে উঠেছিলেন উনি। মনে হয়েছিল নিখুঁত একটি পাথরের ভাস্কর্য দেখছেন।
ব্রান্ডেটের তোলা ছবিগুলো প্রথম প্রকাশিত হয় নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় ‘দ্যা ক্যালসিফাইড’ নাম দিয়ে। তিনি অনেকগুলো ফসিল হয়ে যাওয়া পাখিকে গাছের ডালে বসিয়ে ছবি তুলেছিলেন পাখির আকারগুলো বোঝানোর জন্য। এই নয় যে ব্র্যান্ডেনের আগে কেউ এই লেকের কথা জানতেন না। কিন্তু ঈশ্বর পর্বতের মৃত্যু হ্রদের কথা বিশ্বের অধিকাংশ লোক জেনেছিলেন মূলত ব্রান্ডেটের তোলা ছবি দেখে। ছবি যে হাজার কথা বলে!
ভিডিও লিঙ্ক
https://www.youtube.com/watch?v=Ut82bMaHwiM
ছবি – ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত