বৈজ্ঞানিকের দপ্তর-বিচিত্র জীবজগৎ-বোলতাদের গল্প-অমর কুমার নায়ক-শীত ২০২০

 

বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে

আমাদের চারপাশের সব পতঙ্গদের নামধাম আমরা জানি না। জানার কথাও নয়। কারো কারো নাম জানলেও ধাম জানবার উপায় সবসময় হয়ে ওঠে না। কিছু পতঙ্গদের সম্পর্কে জানার ইচ্ছে পূরণ করতে খোঁজ করেছিলাম বেশ কিছুদিন। খোঁজ করতে গিয়ে তাদের আচার-ব্যবহার জানার সুযোগ পেয়েছি। অনেক সময় ভাঙা বা ফেলে দেওয়া বাসা ঘেঁটে অনেক তথ্য পেয়েছি। আর সেসব কিছু গল্প তোমাদের বলা।
কিছু পতঙ্গদের প্রতি আমাদের মনে ভয় জন্মায়। আমাদের পরিবার কিছুটা দায়ী এই ভয়ের দানা বাঁধাতে। বোলতাদের প্রতি আমার ভয়ের কারণ ছিল এরা অত্যন্ত জ্বালাধরা কামড় দেয় বলে। পতঙ্গদের জীবনশৈলী অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওদের প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর পর থেকে ভয় কেটে যায়। বোলতাদের ছবি তুলে জেনেছি বহু প্রজাতির সম্পর্কে। আসলে ইংরাজিতে যাদের ওয়াস্প বলে তাদের সবাইকে সামগ্রিকভাবে বাংলায় বোলতা বলে ডাকা হয়।
আর যারা আকারে বড়ো তাদের ইংরাজিতে হরনেট এবং বাংলায় ভিমরুল বলে। এদের কামড়ে তীব্র জ্বালা হয় সত্যি, কিন্তু এরা অকারণে কামড় দেয় না বা হুল ফোটায় না।

বিভিন্ন ধরনের বোলতাদের প্রজাতিগুলির আচার-ব্যবহার, বাসা, খাওয়াদাওয়া বিভিন্ন রকমের। বিখ্যাত বাঙালি পতঙ্গ বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর বিভিন্ন গবেষণায় পতঙ্গদের আচার-আচরণ সম্পর্কে জেনেছেন আর সেসব লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর বইগুলিতে। সেখানে তিনি কুমোর পোকাদের কথা লিখেছেন। আসলে বোলতাদের বেশ কিছু প্রজাতি বাসা বানাতে সক্ষম আর তাদেরই কুমোর পোকা বলেছেন। কারণ, কুমোর যেমন মাটির পাত্র তৈরি করে তেমনি এরাও ভেজা মাটির ডেলা পাকিয়ে সুন্দর বাসা তৈরি করে। এমন কিছু প্রজাতির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে আমার। আবার কিছু প্রজাতির বাসা তৈরির ধরন অন্যরকম। আসলে সবাই বাসা বানায় না। গাছের পাতার আড়ালে থাকে এরা।

হাইমেনোপটেরা বর্গের অন্তর্গত পতঙ্গদের বৈশিষ্ট্য হল, এদের সবার একজোড়া স্বচ্ছ ঝিল্লিময় ডানা থাকে। এই বর্গে থাকে পিঁপড়ে, মৌমাছি, বোলতা প্রভৃতি পতঙ্গরা। বোলতাদের মানুষ ভয় করে। এরা গতিশীল, শিকারের সময় যথেষ্ট হিংস্রতার পরিচয় দেয়। বাস্তুতন্ত্রে এদের গুরুত্ব যথেষ্ট। এরা যেমন পতঙ্গদের সংখ্যা নির্ধারণ করে, তেমনি অনেক হাইমেনোপটেরা পলিনেশনে বা পরাগ মিলনে সাহায্য করে। এরা প্রায় ১৫০ প্রজাতির শস্যের পরাগ যোগে সাহায্য করে। পিঁপড়েরা মাটিতে পুষ্টিকর জৈব উপাদানগুলির সংমিশ্রণে এবং বায়বীয় পদার্থের আদানপ্রদানে সাহায্য করে। মৌমাছির অনেক গুরুত্ব যেমন আছে তেমন ওয়াস্পদেরও। এই বর্গের পতঙ্গদের দৈহিক গঠন এদের অন্য পতঙ্গদের থেকে আলাদা করে। শরীরের অন্যান্য অংশের থেকেও বেশি আকর্ষক এদের মুখের গড়ন। প্রজাতিভিত্তিক মুখের গঠন নির্বাচিত খাদ্য অনুযায়ী হয়। কারো চোয়াল চেবানোর জন্য, কারো কামড় দেওয়ার আবার কারো মুখে চোষকের সৃষ্টি হয়েছে মধু জাতীয় খাবার চুষে খাওয়ার জন্য।

কিছু ওয়াস্প ফুলের মধু ও রস খেয়ে থাকলেও বেশিরভাগ প্রজাতি মাংসাশী। ওয়াস্পদের ফসিল রেকর্ডের সন্ধান পাওয়া যায় জুরাসিক যুগ থেকে। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এদের পাওয়া যায় একমাত্র মেরু অঞ্চল ছাড়া। প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি প্রজাতি আছে এদের। আমাদের দেশে অনেক প্রজাতির ওয়াস্পের দেখা পাওয়া যায়। এদের আচার-ব্যবহার বেশ আকর্ষক। নকল করার ব্যাপারেও পটু। এরা ব্যাটেসিয়ান মিমিক্রি এবং মুলেরিয়ান মিমিক্রি পদ্ধতিতে নকল করে। কিছু প্রজাতি হভার-ফ্লাই, ওয়াস্প বিটলদের নকল করে আবার অনেকে বিভিন্ন মৌমাছিদের। এটা এদের আত্মরক্ষার পন্থা।

খাবারের সন্ধান করতে এরা ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন বাগানে। পেপার ওয়াস্পরা গাছের শুকনো ছাল, কাঠগুঁড়ি প্রভৃতি মুখে করে ছিঁড়ে স্যালাইভা মিশিয়ে একধরনের আঠালো পদার্থ তৈরি করে যা দিয়ে পাতার তলায় বা উপযুক্ত স্থানে বাসা বানায়। বাসায় অনেক প্রকোষ্ঠ থাকে। আবার কিছু প্রজাতি ভেজা নরম মাটি দিয়েও বাসা বানায় দেওয়ালে, জানালায় বা সেইরকম উপযুক্ত জায়গায় যেখানে বাসা বানানো সুবিধাজনক। বাসার মধ্যে দেখা গেছে ছোটো ছোটো পোকামাকড় আর বাগানের মাকড়সাদের। এরা সাধারণত শিকারের পা ও ডানাগুলো কেটে ফেলে। সন্তানদের জন্য খাবারের জোগান দিতে ডিম পাড়ার আগেই জোগাড় করে রাখে। বোলতাদের কিছু প্রজাতি যেমন সামাজিক হয় আবার কেউ কেউ একাকী জীবনে অভ্যস্ত। মৌমাছিদের মতো বোলতাদের সমাজেও সামাজিক প্রভেদ দেখা যায়। সাধারণত একটি বা দুটি রানি ও কয়েকটি প্রজননক্ষম পুরুষ ছাড়া থাকে প্রচুর সৈনিক, শ্রমিক আর প্রজননে অক্ষম স্ত্রীরা। রানি ও পুরুষরা শুধু প্রজননে অংশগ্রহণ করে। শ্রমিকরা খাবার যোগান দেয়। সৈনিকরা শত্রুদের থেকে রক্ষা করতে সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকে। আর বাকি স্ত্রীরা পরিচারিকা ও নার্সের কাজ করে। এ যেন এক বিশাল সাম্রাজ্য। এর উপর নির্ভর করে হলিউডের বেশ কিছু অ্যানিমেশন মুভি তৈরি করা হয়েছে। ডিম পাড়ার ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ জিনিস লক্ষ করা গেছে। কিছু প্রজাতি নিজের বাসায় ডিম পাড়লেও যারা বাসা বানাতে অক্ষম তারা অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে, যেমন কাক্কু ওয়াস্প প্রজাতিরা। এখানেও কাক-কোকিলের গল্প। অনেকেই খাবারের উৎসের কাছে ডিম পাড়ে। কিছু প্রজাতি ডিম পাড়ে ডুমুরের ফলের ভেতর আর এর জন্য প্রকৃতি এদের ডিম পাড়ার অঙ্গকে সূচালো করেছে। এই সূচের মতো অঙ্গ দিয়ে অনেক সময় দংশনও করে থাকে। বাচ্চারা ফলের মধ্যে বড়ো হয় আর ফল পাকার সঙ্গে সঙ্গে ফল ফেটে বেরিয়ে আসে। এইভাবে গাছটির পরাগ যোগও চলে। অবশ্য সবাই যে সাহায্য করে তা নয়। কেউ কেউ অনিষ্টও করে। অন্য পোকার লার্ভা বা শরীরে ডিম পেড়ে দেয়। আর ভেতরে বড়ো হতে থাকে। পূর্ণাঙ্গ হতে হতে পোষকের মৃত্যু হয়। বোলতাদের সামাজিকতা একে অপরের সাহায্য করার ঘটনা আমাদের আকর্ষণ করে। এরা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে ক্ষতিকর মনে হলেও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং বায়োলজিক্যাল পেস্ট কন্ট্রোলার হিসাবে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সবশেষে বলি, আমাদের এই দুনিয়ার যতসব রঙবাহারি বোলতারা বেঁচে থাক, সুখে থাক।

 জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s