বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে
ফ্রান্সে যেমন রয়েছে ‘স্লিপিং বিউটি’ তেমনি আমাদের দেশীয় রূপকথার ঝুলিতেও রয়েছে ‘সোনার কাঠি রূপোর কাঠি’-র গল্প। দুই গল্পের কেন্দ্রেই রয়েছে ঘুমিয়ে থাকা এক রাজকন্যে। ছোটবেলায় ফেয়ারি টেলসগুলি পড়তে গিয়ে মনে হত, আচ্ছা, এমনটা কি সত্যিই হতে পারে? মাসের পর মাস, বছরের পর বছর না জেগে, না খেয়ে, শুধুই ঘুমোতে পারে কেউ?
মনুষ্যকুলে এমন রাজকন্যারা শুধুই কল্পনার জগতে থাকলেও জীবজগতে কিন্তু এমন টানা ঘুমের ঘটনা আকছার ঘটছে। এমন ঘটনা সাধারণত শীতকালে ঘটে, তাই একে সোজা বাংলায় বলে শীতঘুম। বৈজ্ঞানিকভাবে দেখলে শীতঘুম ব্যাপারটা হয় দু-রকমের।
প্রথমটিকে বলা হয় হাইবারনেশন (Hibernation), যা দেখা যায় বেশ কিছু ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইউরোপিয়ান সজারু, মেঠো কাঠবিড়ালি, প্রেইরি ডগ (নামে ডগ হলেও উত্তর আমেরিকার এই প্রাণীগুলি আসলে একপ্রকারের মেঠো ইঁদুর),
উত্তর মাদাগাস্কারের লেমুর (Lepilemur Septentrionalis) এবং কিছু প্রজাতির বাদুড়।
দ্বিতীয় ধরনের শীতঘুমটির পোশাকি নাম হল ব্রুমেশন (Brumation) এবং এই পদ্ধতিতে ঘুমোয় শীতল রক্তের (Ectotherms) উভচর (Amphibians) এবং সরীসৃপেরা (Reptiles)।
যদিও আপাতভাবে মনে হতে পারে যে এই দুই ধরনের শীতঘুমের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নেই, কিন্তু একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় যে সে-কথা মোটেই ঠিক নয়। যেমন, মনে করো উষ্ণ রক্তের স্তন্যপায়ী প্রাণী অর্থাৎ ম্যামালদের ক্ষেত্রে হাইবারনেশন হল প্রকৃত অর্থেই প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে নির্বিবাদী ঘুম। তারা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় থেকেই পেট ভরে খেয়ে শরীরে মেদ সঞ্চয় করে। এরপর শীতের শুরুতে শুকনো পাতা এবং ঘাস দিয়ে উষ্ণ বাসা তৈরি করে নিরাপদে ঘুমিয়ে পড়ে। এইসময় শরীরে সঞ্চিত ফ্যাটের ওপর নির্ভর করেই তারা বেঁচে থাকে। তবে হাইবারনেশন চলাকালীন তাদের শারীরবৃত্তীয় সব প্রক্রিয়াই চলে অত্যন্ত ধীরে। হৃৎপিণ্ডের গতি, শ্বাসপ্রশ্বাস এবং পাচন প্রক্রিয়া সবকিছুই এইসময় কয়েকগুণ কমে যায়। শীতকাল শেষ হলে তবেই তাদের ঘুম ভাঙে এবং বসন্তের শুরুতে আবার তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু হয়।
অন্যদিকে ব্রুমেশন শীতঘুম হলেও প্রকৃত অর্থে তা ঘুম নয়। অ্যাম্ফিবিয়ান এবং রেপটাইল গোত্রের প্রাণীরা যেহেতু শীতল রক্তবিশিষ্ট, তাই নিজেদের শরীরের উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য তারা রৌদ্রের তাপের ওপর নির্ভর করে। বুঝতেই পারছ যে শীতকালে যেহেতু সুজ্জিমামার আলো ও তাপমাত্রা দুটোই কমে যায়, সেহেতু তাদের শরীরের তাপমাত্রাও বহুগুণে হ্রাস পায়। তাপমাত্রার অভাবে এই অবস্থায় তাদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলিও যারপরনাই কমে যায়। কাজেই অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জায়গায় নির্জীব হয়ে চুপচাপ পড়ে থাকা ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোনও উপায় থাকে না। শীতকাল চলাকালীন কখনও তাপমাত্রা একটু বৃদ্ধি পেলে এরা বাইরে বেরিয়ে আসে জল বা খাদ্যের সন্ধানে। তারপর নিরাপদ জায়গায় রোদ পোহানো হয়ে গেলে আবার ফিরে যায় তাদের শীতঘুমের ডেরায়।
খাবারের হজম প্রক্রিয়াও এদের বেলা অনেকটাই পৃথক। স্তন্যপায়ীরা নির্ভর করে শরীরে সঞ্চিত মেদের ওপর, কিন্তু ব্রুমেশনে অভ্যস্ত প্রাণীরা খাদ্যকে মেদ নয়, বরং গ্লাইকোজেন হিসেবে তাদের যকৃতের কোষে জমিয়ে রাখে। গ্লাইকোজেন হল একধরনের কার্বোহাইড্রেট যা ব্রুমেশন চলাকালীন সরীসৃপদের বাঁচিয়ে রাখে।
সবচাইতে বড়ো পার্থক্য হল ব্রুমেশন চলাকালীন সরীসৃপ বা উভচরেরা অত্যন্ত কম অক্সিজেন গ্রহণ করেও বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। তাদের ক্ষেত্রে সামান্য কম হলেও প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের মাত্রা থাকে নির্দিষ্ট।
এককথায় বোঝাতে গেলে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে হাইবারনেশন হল অ্যাক্টিভলি এবং রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে, নাকে তেল দিয়ে ঘুমোনো, অন্যদিকে সরীসৃপদের ব্রুমেশনের অর্থ হল শক্তির অভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় জবুথবু হয়ে পড়ে থাকা।
জলে বসবাসকারী প্রাণীদের অবশ্য শীতঘুমের প্রয়োজন পড়ে না। কারণখানা সোজা, বাতাস যত তাড়াতাড়ি ঠান্ডা বা গরম হয়, জলে তাপমাত্রার পরিবর্তন তত সহজে হয় না। তাই জলের প্রাণীরা ঠান্ডায় খুব বেশি কষ্ট পায় না। তীব্র শীতের সময় মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীরা নীচের জলস্তরে নেমে যায়। রুই, কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি মিঠে জলের মাছেরা শীতকালে জলের তলায় পাঁকের কাছাকাছি থাকে।
আরও একটা মজার ব্যাপার হল এই যে শীতঘুম চলাকালীন সব প্রাণীরাই বন্ধু। একই গর্তে খাদ্য-খাদক সম্পর্কের প্রাণীদের একসঙ্গে ঘুমোনো কিছুই আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। সম্ভবত পাশাপাশি ঘুমোলে শরীরের তাপ সংরক্ষণ করা অনেক বেশি সহজ তাই এমন ঘটে। গ্রামাঞ্চলে যারা থাকো তারা এমন ঘটনা হয়তো দেখেওছ। অস্ট্রেলিয়ার নোবেলজয়ী প্রকৃতি বিজ্ঞানী কনরাড লরেঞ্জ (Konrad Lorenz) এমন একটি ঘটনার ভারি সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন। উত্তর আমেরিকায় গবেষণা করার সময় তিনি ১২ ফুট লম্বা একটি গর্তে শীতের সময় অত্যন্ত বিষধর কয়েকটি র্যাটল সাপের সঙ্গে কয়েকটি ব্যাঙ, গিরগিটি, মেঠো কাঠবিড়ালি ও প্রেইরি কুকুরকে একসঙ্গে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছিলেন। জীবনরক্ষার প্রয়োজনেই শীতঘুম। এই সময় ঝগড়াঝাটির কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সব পশুপাখিরা এই নিয়ম বোঝে ও মেনেও চলে।
এখানে ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি যে কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে ঠিক উলটো ঘটনাও ঘটে। তাকে বলে গ্রীষ্মসুপ্তি বা এস্টিভেশন (Aestivation)। গরমকালে খুব রুক্ষ এবং শুষ্ক অবস্থায় নিজেদের শরীরে জল সংরক্ষণ করতে বেশ কিছু ধরনের শামুক, পোকামাকড় এবং ব্যাঙ ভেজা গর্ত বা কোটরে প্রবেশ করে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে। একেই বলে এস্টিভেশন।
গ্রীষ্মসুপ্তির ব্যাপারে সবচাইতে পারদর্শী প্রাণীটির নাম হল জলধর ব্যাঙ বা Water Holding Frog।
এদের বাড়ি অস্ট্রেলিয়ায়। এরা বর্ষাকালে নিজের ওজনের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ জল শোষণ করে নিজেদের মূত্রথলিতে ও ত্বকের নীচে জমিয়ে রাখে। এরপর তারা মাটির নীচে গর্তে প্রবেশ করে এবং নিজের ত্বককেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে শরীরের চারদিকে জলভরা, নরম একটি থলি তৈরি করে। অস্ট্রেলিয়ার তীব্র গরমের সময় এই ব্যাঙ মাটির নীচে নিজের ত্বক দিয়ে তৈরি থলের মধ্যে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বসে থেকে আত্মরক্ষা করে। এই অবস্থায় তারা দু-বছর অবধি বেঁচে থাকতে পারে। পরের বছর বর্ষাকালে এরা আবার বাইরে আসে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা অত্যধিক গরমের সময় জলের অভাবে এই ব্যাঙের শরীর নিঙড়ে জল বের করে পান করেন। এতে যদিও ব্যাঙটির জীবনহানি হয় না, তবে তাদের গড় আয়ু কমে যায় অনেকখানি।
শীতঘুমের কারণ মূলত দুটি। পারিপার্শ্বিকের তাপমাত্রা কমে যাওয়া এবং উপযুক্ত খাদ্যের অভাব। বুঝতেই পারছ যে শীতল রক্তের প্রাণীদের (Ectotherm) শীতঘুমের জন্য যেমন দায়ী প্রথম কারণটি, তেমনি উষ্ণ রক্তের প্রাণী (Endotherm) অর্থাৎ স্তন্যপায়ীদের হাইবারনেশনের জন্য দায়ী মূলত দ্বিতীয় কারণটি। পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশে শীতঘুম চলাকালীন ভিন্ন প্রজাতির ভালুকের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করে এ-ব্যাপারে আরও বিশদে জানা সম্ভব হয়েছে। যেমন, মনে করো উত্তরমেরুর দেশে যেখানে শীতকালে তাপমাত্রা হয় গড়পড়তা মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে গ্রিজলি ভালুকেরা বছরের প্রায় সাত মাস সময় ব্যয় করে ঘুমিয়ে।
আবার মোটামুটি ওই একই পরিবেশে বসবাসকারী মেরু ভালুক বা পোলার বেয়ারদের মধ্যে শীতঘুমের অভ্যাস তেমন জনপ্রিয় নয়। গর্ভবতী হলে বা সঙ্গে সদ্যোজাত শিশু থাকলে অবশ্য অন্য ব্যাপার। সেক্ষেত্রে শীতের গ্রাস থেকে শিশুকে সাবধানে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই ভালুক জননী শীতঘুমের সাহায্য নেন।
অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলগুলিতে দেখা যায় যে ভালুকেরা মাত্র দুই থেকে পাঁচ মাস সময় ঘুমিয়ে কাটায়। অন্যদিকে চিড়িয়াখানাগুলিতে যেহেতু সারাবছরই সমানভাবে খাদ্যের জোগান দেওয়া হয় এবং তাপমাত্রার তারতম্যও সেখানে তেমন মারাত্মক হয় না, তাই চিড়িয়াখানার বাসিন্দা ভালুকরাও পোলার বেয়ারদের মতোই শীতকালে খোশমেজাজে ঘোরাফেরা করে বেড়ায়। তবে বন্দিদশায় থাকাকালীন শীতঘুমের অভ্যাস হারানোর কুফলও রয়েছে অনেক। প্রাকৃতিকভাবে তারা শীতের আগে প্রচুর পরিমাণে খেয়ে শরীরে মেদের পরিমাণ বাড়ায়। শীতঘুম চলাকালীন এই মেদকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেই তারা বেঁচে থাকে। কাজেই শীতঘুমের শেষে সঞ্চিত মেদের পরিমাণ নিজে থেকেই কমে যায়। কৃত্রিম বন্দিদশার কারণে শীতঘুমের অভ্যাস নষ্ট হলে ভালুকদের মধ্যে তাই বেশি ওজন বৃদ্ধির ফলে অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
এইসব কারণে আজকাল চিড়িয়াখানার মানুষজন কৃত্রিম গুহা তৈরি করে ভালুকদের শীতঘুমে সাহায্য করছেন। যদিও এইজন্য চিড়িয়াখানার দর্শকেরা শীতকালে ভালুক দর্শন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তবে তাতে কোনও সমস্যা নেই। আমাদের ভালুক বন্ধুরা তাদের ছানাপোনা সমেত সুস্থ শরীরে, বহাল তবিয়তে বহুকাল বেঁচে থাকুক, এর থেকে বড়ো পাওনা আর কী হতে পারে!
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর