বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে
প্রথমেই জানিয়ে রাখি যে ড্রাগন নিয়ে গল্প বলব বলেছি বলে তোমরা যদি ভেবে নাও যে আমি এক্ষুনি বলব, ‘ড্রাগন অতি বুদ্ধিমান প্রাণী। উহার দুইটি ডানা, দুটি ঠ্যাং এবং একটি ল্যাজ রয়েছে। রাগিয়া গেলে তাহার মুখ থেকে আগুন বাহির হয়…’, তাহলে কিন্তু আমিও কাকেশ্বর কুচকুচের মতো মাথা নাড়িয়ে বলব, ‘হয়নি, হয়নি, ফেল।’
হ্যাঁ বাবা, মানছি যে ড্রাগন হলেন মাইথোলজিক্যাল পশুদের মধ্যে যাকে বলে গিয়ে ফার্স্ট গার্ল! কাল্পনিক হলে কী হবে, পৌরাণিক এই সরীসৃপটিকে ঘিরে আজও মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। প্রাচীন পৃথিবীর মেসোপোটেমিয়ান ভাস্কর্য থেকে শুরু করে হাল আমলের ‘হ্যারি পটার’ সিরিজে ড্রাগনের উপস্থিতি আজও নজর কাড়ে।
‘ড্রাগন’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে ল্যাটিন ‘ড্রাকোনেম’ (Draconem) বা প্রাচীন গ্রীক শব্দ ‘ড্রাকোনটোস’ (Drakontos) থেকে ‘ড্রাগন’ শব্দটির জন্ম হয়েছে। ওই দুটি শব্দেরই অর্থ কিন্তু এক, বিশালাকার সরীসৃপ। রাজকীয় এই সরীসৃপকে ঘিরে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব রূপকথা এবং পৌরাণিক গল্প রয়েছে। এদের মধ্যে নিঃসন্দেহে ইউরোপের ডানাওয়ালা ড্রাগন হল সবচাইতে বেশি জনপ্রিয়। তার পরেই রয়েছে ওরিয়েন্টের হিলহিলে সাপের মতো দেখতে, খুদে ঠ্যাংওয়ালা, ডানাবিহীন ড্রাগন। এমনকি আমাদের দেশ, ভারতবর্ষের পৌরাণিক গল্পেও কিন্তু ড্রাগনের উপস্থিতি স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
ও কী! ইন্ডিয়ান ড্রাগনের নাম শুনে হাসছ যে বড়ো! আমার কথা বিশ্বাস হল না বুঝি?
আচ্ছা বেশ, প্রমাণ দিচ্ছি, মিলিয়ে নাও। কৃষ্ণ ঠাকুরের সঙ্গে কালিয় নাগের যুদ্ধের গল্প ভেবে দেখো। অথবা বাসুকি নাগের সাহায্যে সমুদ্রমন্থন, শেষনাগের ওপর বিষ্ণুর অনন্ত শয্যাগ্রহণ—এ সবেরই কেন্দ্র চরিত্রে রয়েছে সেই বিশালাকায় সরীসৃপ, অর্থাৎ ড্রাগন। এভাবে দেখলে দেখবে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে, প্রত্যেকটি সভ্যতার সঙ্গে কোনও না কোনোভাবে ড্রাগনের গল্প জড়িয়ে আছে।
এসব তো গেল রূপকথা বা লোককথা। এখন প্রশ্নটা হল এই যে এমনধারা গপ্পোকথার বাইরেও আজকের পৃথিবীতে কি ড্রাগনের অস্তিত্ব রয়েছে? যদিও-বা থাকে তবে তারা দেখতে ঠিক কেমন এবং কল্পনার ড্রাগনের সঙ্গে তাদের কতখানি সাদৃশ্য রয়েছে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসেবে বলব মানুষের কল্পনা কিছুটা হলেও সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যের ওপর কল্পনার রঙ চড়িয়েই কাল্পনিক গল্পগুলি তৈরি হয়। ড্রাগনের বেলাতেও এই নিয়মের বিলকুল ব্যতিক্রম ঘটেনি। আফটার অল, যা রটে তার কিছুটা তো বটে।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সরীসৃপ কমোডো ড্রাগনের (Komodo Dragon) (শীর্ষচিত্র) কথাই বলি সবার প্রথমে। এদের বাড়ি ইন্দোনেশিয়ায়। গড়পড়তা সত্তর কেজি ওজন এবং তিন মিটার লম্বা এই সরীসৃপটিকে দেখলে ডরায় না এমন পশু এবং মানুষ বোধহয় খুব কমই আছে। অস্ত্র হিসেবে ধারালো দাঁতের সারি ও শক্ত আঁশে ঢাকা মজবুত লেজ তো আছেই, তার ওপর রয়েছে তাদের বিষাক্ত স্যালাইভা অর্থাৎ লালারস। শুধুমাত্র একটি কামড়ে পূর্ণবয়স্ক বুনো শূকর বা মহিষের মতো প্রাণীকেও মেরে ফেলার মতো ক্ষমতা রাখে এই ড্রাগন। মুখ থেকে আগুন হয়তো বের হয় না, কিন্তু কমোডো ড্রাগনের বিষাক্ত লালারসের প্রভাব আগুনের থেকে কিছু কম যন্ত্রণাদায়ক নয়।
এর পরের জন হলেন ব্ল্যাক ড্রাগন ফিশ।
ফিশ বলছি কারণ ইনি গভীর সমুদ্রের বাসিন্দা। নইলে কিন্তু সেই অর্থে মাছেদের সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে বড়োই কম। আকারে ইনি নিতান্তই ছোট্ট, মাত্র চল্লিশ সেন্টিমিটার লম্বা; কিন্তু তবুও বলব যে এদের দিকে ভালো করে দেখলে অতি বড়ো বীরেরও বুকের রক্ত হিম হয়ে যেতে বাধ্য। ব্ল্যাক ড্রাগন ফিশের স্বচ্ছ, বরফের ছুরির মতো সারে সারে সাজানো দাঁত আর পলকহীন নীলচে চোখ দেখলে গ্রহান্তরের হিংস্র জীব বলেই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। ভয়াল ভয়ংকর রূপ ছাড়াও আরও একখানা কেরামতি দেখাতে পারেন ইনি। কুমিরের মতো ব্ল্যাক ড্রাগনও ওপরের চোয়ালখানা ইচ্ছেমতো নাড়াচাড়া করতে পারেন। কাজেই এদের মুখের হাঁ-খানা হয় সত্যি দেখার মতো। নিজের চাইতে আকারে দুইগুণ বড়ো প্রাণীকেও অতি অনায়াসে পেটস্থ করা এদের কাছে জাস্ট পিস অফ কেক!
আমাদের তৃতীয় অতিথির পোশাকি নাম হল গিরগিটি কুলতিলক শ্রীমান শ্রীযুক্ত ড্রাকো ভোলানস (Draco Volans) বা সাদাসিধে ভাষায় কমন ফ্লাইং ড্রাগন।
রূপকথার ড্রাগনের সঙ্গে এই বেচারা খুদে গিরগিটির একটিই মিল রয়েছে। এরা দুজনেই ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে পারে। তাছাড়া বাকি সবকিছু সাদামাটা গিরগিটিদের মতোই। তবে সত্যি কথা বলতে কী, এদের ওড়াটাকে পাখিদের মতো ‘অ্যাক্টিভ ফ্লাইং’ বলা চলে না। বরং গ্লাইডিং বা প্যারাসুটের মতো বাতাসে ভেসে থাকা বললেই ঠিকঠাক ব্যাপারটাকে বোঝানো যায়। এদের ডানাও পাখিদের মতো অমন পরিপাটি পালক দিয়ে সাজানো নয়। পেটের দু-পাশের খানিকটা ঢিলেঢালা চামড়াকে ইচ্ছেমতো জাপানি পাখার মতো খুলে বা বন্ধ করে এরা ওড়ার কাজে ব্যবহার করেন। মানে মানে ওই ডানা দুটোর জন্যই তার এত নামডাক। ওটুকু না থাকলে ড্রাকো বাবাজীর ড্রাগনগিরি ঘুচে যেত।
চতুর্থজন অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ান পিঙ্ক ড্রাগনের গল্প বলে আজকের মতো ড্রাগন পর্ব শেষ করব।
পিঙ্ক ড্রাগন প্রাণীটির নাম এমন গালভরা হলেও কী হয়, আদতে উনি সরীসৃপই নন। ইনি আর্থোপোডা অর্থাৎ কীটপতঙ্গের বংশভুক্ত একধরনের তেঁতুল বিছে। গায়ের রঙখানা অবশ্য ঝলমলে বেনারসি শাড়ির মতোই জমকালো। তবে রঙ দেখে ভুল করেও যেন তাকে ধরতে যেও না বাপু। পিঙ্ক ড্রাগনের মতো ভয়াবহ বিষাক্ত প্রাণী পৃথিবীতে খুব কমই আছে। এরা নিজেদের শরীরে তৈরী হাইড্রোজেন সায়নাইড বা প্রুসিক অ্যাসিড ব্যবহার করে আত্মরক্ষা করে। যদি বলো যে হাইড্রোজেন সায়নাইড নামখানা কেমন যেন শোনা শোনা লাগছে, তাহলে মনে করিয়ে দিই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এই গ্যাসের ব্যবহারেই লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছিল।
তাহলে বুঝতেই পারছো যে ড্রাগন আছে কি নেই সেই প্রশ্নের উত্তর অত সহজে দেওয়া সম্ভব নয়। আসল কথাটা হল এই যে, মানুষের কৌতূহল ও কল্পনার কোনও শেষ নেই। প্রকৃতি মা রহস্যময়ী। তার রহস্যের কুলকিনারা করতে অক্ষম মানুষ কল্পনার সাহায্য নেয় এবং তারপর সত্যের ক্যানভাসের ওপর কল্পনার রঙ চড়িয়েই তৈরি হয় গ্রিসের নয় মাথাওয়ালা হাইড্রা, ভারতবর্ষের বাসুকি নাগ অথবা পাশ্চাত্যের ডানাওয়ালা বিরাট ড্রাগন। মাটির পৃথিবীতে যেমন কোমোডো ড্রাগন রয়েছে, ফ্লাইং ড্রাগন রয়েছে, বিষাক্ত গ্যাসের শ্বাস ফেলে এমন পিঙ্ক ড্রাগন রয়েছে, তেমনি কল্পনার পৃথিবীতে অগ্নিক্ষরা, উড়ন্ত ড্রাগন রয়েছে। দুটো পৃথিবীই থাক না, ক্ষতি কী? সত্যি বা মিথ্যে বলে হয়তো এর বিচার করা যাবে না। তাই ‘ড্রাগন কি সত্যিই আছে?’ প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, ড্রাগন যেমন আছে, তেমনি ড্রাগন নেইও।
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর
ভীষণ ভালো লাগল।
LikeLike