আগের পর্ব- বন্ধু বানরদল, ট্রেন চড়ল জাহাজে
দিঘা যাব বলে হাওড়া স্টেশন যাচ্ছি, পথে দেখা হল কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দিঘা যাচ্ছি শুনে শক্তিদা বললেন, “কাঁথি থেকে দিঘার দিকে না গিয়ে আরও কাছে জুনপুট চলে যেতে পারো। জনশূন্য সাগর-সৈকত।”
জুনপুটের সাগরে পরিচয় হল সন্তোষ মাঝির সঙ্গে। জুনপুটে বর্ষাকালে বঙ্গোপসাগরের উথালপাতাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া সন্তোষ মাঝি। তার নৌকো বাওয়া মনে হয় যেন এই সেদিনের কথা। আসলে প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। খুব ভোরে সন্তোষ মাঝির সঙ্গে সামান্য একটা জেলে নৌকোয় সাগরে ভেসে পড়েছিলাম।
ট্রেনে হাওড়া থেকে খড়্গপুর, সেখান থেকে বাসে কাঁথি পৌঁছতে বেলা শেষ হয়ে এল। কাঁথি থেকে রিকশায় ডানদিকের রাস্তায় ছ’কিলোমিটার গিয়ে জুনপুটে যখন পৌঁছলাম তখন চারদিকে সন্ধ্যা হব হব ভাব। রাস্তার ধারেই বহু পুরোনো একটা বাংলো দেখে তার পাহারাদারের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে ভেতরে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ। যেমন উঁচু, তেমনই বিরাট ঘর; কিন্তু তার দরজা-জানালায় পাল্লা নেই, জানালার গরাদও কেউ খুলে নিয়ে গেছে। রিকশাওলা তখনও আমার সঙ্গেই ছিল। আমার দুর্দশা দেখে তার ছেঁড়া শার্টের পকেট থেকে একটা চাবি বের করে বহু দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওই আমার বাড়ি। আপনি কষ্ট করে রাতটা আমার বাড়িতে থাকবেন? আরেকটা ট্রিপ দিয়েই আমি ফিরব।”
শেষ পর্যন্ত দরজা-জানালাহীন বিরাট সেই বাংলোতেই উঠলাম। কোথাও কোনও খাবারের দোকান নেই। পাহারাদারের কাছেও কিছু পাওয়া গেল না। ভোরবেলা জুনপুটের সমুদ্রে বিরাট সূর্যোদয় দেখবার কথা ভাবতে ভাবতে যতই ঘুমোবার চেষ্টা করি, একটু পর পর কাছেই কোথাও বিকট আওয়াজে তন্দ্রা কেটে যায়। কখনও ভূতের স্বপ্ন দেখি, কখনও মনে হয় ডাকাত পড়েছে। রাত একটা দুটো অবধি এইভাবে কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে বেলাভূমি পেরিয়ে সমুদ্রের দিকে এগোতে লাগলাম।
অনেক দূরে এক ঝাঁক জোনাকির আলো। সমুদ্রের কাছাকাছি হয়ে বুঝলাম, জোনাকি নয়, সাগরতীরে নোঙর করা কতগুলো নৌকোর আলোকে জোনাকি ভেবেছিলাম। সমুদ্রে জোনাকি আসে না সে-কথাও আমার মনে পড়েনি। নৌকোগুলো তীর-ছোঁয়া ঢেউয়ে দুলছিল।
সবই জেলে নৌকো। ভোরবেলা সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবে, এখন তারই প্রস্তুতি। এদেরই একজনের নৌকোর মাঝিকে শেষ পর্যন্ত রাজি করিয়ে নৌকোয় চড়ে বসলাম। আমি যাচ্ছি বলে একজন গিয়ে তীরের একমাত্র দোকান থেকে একটুখানি ডাল কিনে নিল। দোকানটা শুধু এই জেলেদের জন্যই রাতে খোলা থাকে। আমার মতো মান্যগণ্য অতিথিকে তো আর ওদের মতো শুধু মাছ খেতে দেওয়া যায় না। তাই ডাল কেনা। লাজুক হাসি নিয়ে কথাটা যে বলল, সে-ই সন্তোষ মাঝি।
সে-বার জুনপুটের সমুদ্রসৈকতে পুব আকাশে আগুন লাগানো সূর্যোদয় দেখে ভেবেছিলাম ঘোড়া ছুটিয়ে গেলে আমিই ওই অপরূপ আলোর উৎসব ছুঁয়ে দিতে পারি!
একটু পরেই সব ক’টা নৌকো যাত্রা শুরু করল। সমুদ্রের অনেকটা ভেতরে গিয়ে ভোরের কড়া আলোয় অনেকক্ষণ ধরে নৌকোগুলোকে কী একটা কৌশলে এক-একটা জায়গায় স্থিরভাবে দাঁড় করাল, তারপর শুরু হল সমুদ্রে জাল নামানো।
প্রথম দুয়েকবার জালে পার্শে মাছের মতো মাছ উঠতে লাগল। দুয়েকটা জেলিফিশও উঠল; সেগুলো কাঠি দিয়ে ধরে আবার সমুদ্রেই ফেলে দেওয়া হল। প্রথম ধরা পড়া মাছ দিয়ে নৌকোয় মধ্যাহ্নভোজনের নিয়ম। ভাত আর মাছ; তেলমশলা ছাড়া মাছের ঝোল। ভাজাও খুব সামান্য তেলে।
রান্না করছে সন্তোষ মাঝির শ্যালক। সে সারাবছর যাত্রাপালায় গান গায়। এ-বছর তার দিদি তাকে ভগ্নীপতির সঙ্গে সমুদ্রে পাঠিয়েছে কাজ শিখতে।
সন্তোষ ও অন্যান্য মাঝিরা যখন নৌকো সামলে জাল ফেলতে-তুলতে ব্যস্ত, তখন সন্তোষের এই শ্যালক রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে নানা পালার গান গেয়ে শোনায়। কী ভেবে মাঝে মাঝে বলে, “আপনার মতো বড়ো মানুষের এসব কি আর ভালো লাগবে? আমরা বাবু ক্ষুদ্র মনিষ্যি।”
এই ‘ক্ষুদ্র মনিষ্যি’ কথাটা অনেক বছর পর ‘হীরু ডাকাত’-এর গল্পে আমার কাজে লেগেছিল।
সন্তোষ মাঝির বীর যোদ্ধার রূপ দেখেছিলাম দিনের শেষে। সাগর জুড়ে তখন ঢালাও সূর্যাস্তের রং। সন্তোষ নৌকোর এক মাথায় সেনাপতির মতো দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো এক-একটা ঢেউকে ‘আয়! আয়!’ বলে যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছে আর দু-হাতের কব্জির জোরে হাল মুচড়ে মুচড়ে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। আগের রাতে ডাল কেনবার সময় মান্যগণ্য অতিথির জন্য তার লাজুক হাসি আর এখন দিনের শেষে এই বীরের হুংকার সাধারণ মানুষের মুখকেও কত অসাধারণ সৌন্দর্যে ভরিয়ে দেয়, জুনপুটের জেলে নৌকোয় সেই সাগর-যাত্রায় নিজের চোখে তা না দেখলে আমার কখনও জানা হত না।
সন্তোষ মাঝি আমাকে এই সাগরের বুকেই একটা দূর দ্বীপের কথা বলেছে। শীতকালে সেখানে হাজার হাজার পাখি আসে। সমুদ্রও তখন শান্ত। সামনের শীতেই সে আমাকে সেই দ্বীপে নিয়ে যাবে।
সেদিন চলে আসবার সময় বার বার বলেছে, “ঠিক আসবে তো তুমি? এই শীতেই তোমাকে পাখির দ্বীপে নিয়ে যাব। আসবে তো?”
“আসব।”
আর যাওয়া হয়নি ভেবে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। দূর দ্বীপে পাখি দেখা তো হলই না, এতদিনে ওর কথাটাও রাখতে পারলাম না।
অলঙ্করণ– যুধাজিৎ সেনগুপ্ত
“স্বর্ণাক্ষর” থেকে প্রকাশিত ‘চোখে দেখা গল্প’ বই থেকে নেয়া। লেখক ও প্রকাশকের অনুমতিক্রমে।
বইটি অর্ডার করতে কিংবা স্বর্ণাক্ষর-এর সম্পূর্ণ গ্রন্থতালিকার
যে-কোনো বই কিনতে