বৈজ্ঞানিকের দপ্তর-বিচিত্র জীবজগৎ-ক্লোরোফিল চোর-যূথিকা আচার্য্য-শীত২০২১

বিচিত্র জীবজগত- সব লেখা একত্রে

bigganchlorophil01

মাত্র আটাশ বছর আগের কথা। ১৯৯৩ সালে জাপানের কুরোশিমা দ্বীপের কাছাকাছি একটি অতি ক্ষুদ্র শামুক জাতীয় প্রাণীর ব্যাপারে জানতে পেরে প্রাণীবিজ্ঞানী মহল রীতিমতো নড়েচড়ে বসলেন।

বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার মতোই ঘটনা বটে। আমাদের খুদে শামুকটি যেমন দেখতে মিষ্টি, ঠিক তেমনি আজব কাণ্ডকারখানা তার। দেখা গেল যে প্রাণী এবং উদ্ভিদকুলের বেসিক পার্থক্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা রীতিমতো সালোকসংশ্লেষ করে চলেছে।

যদিও এককোষী বা ইউনিসেলুলার (Unicellular) প্রাণীদের ক্ষেত্রে ফটোসিন্থেসিস ব্যাপারখানা তেমন নতুন কিছু নয়। তবে উন্নত, বহুকোষী প্রাণীদের সালোকসংশ্লেষের ঘটনা রীতিমতো চমকপ্রদ তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

ব্যাপারটা আরে একটু গুছিয়ে বলি। দেখো, প্রাণী আর উদ্ভিদদের মধ্যে সবচাইতে বড়ো পার্থক্যটি হল তাদের খাদ্যগ্রহণের পদ্ধতি। প্রাণী বলতে আমি, তুমি, গোরু, উটপাখি, হাতি, পেঙ্গুইন—আমাদের সবাইকে খাদ্যের জন্য নির্ভর করতে হয় অন্যের ওপর। আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়েজনীয় খাদ্যের জোগান দেয় অন্য প্রাণী অথবা উদ্ভিদেরা।

অথচ উদ্ভিদেরা এই ব্যাপারে আত্মনির্ভরশীল। তাদের শরীরের সবুজ অংশে উপস্থিত ক্লোরোফিল রঞ্জকের মাধ্যমে সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে তারা নিজেদের খাদ্য তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াটির নাম সালোকসংশ্লেষ বা ফটোসিন্থেসিস।

এই অবধি তো আমরা সবাই জানি, কিন্তু প্রশ্নটা হল এই যে এমন কিছু প্রাণীর নাম শুনেছ কি যারা উদ্ভিদের মতোই ক্লোরোফিল ব্যবহার করে নিজেদের খাদ্য তৈরি করতে সক্ষম?

প্রশ্নখানা শুনে অবাক হলে বুঝি?

কী বললে, অমন আবার হয় নাকি? শরীরে ক্লোরোফিল থাকলে সে আবার প্রাণী হয় কী করে?

আলবাত হয়। কেন হবে না? উদ্ভিদের থেকে ক্লোরোফিল নিয়ে কেউ যদি নিজের গায়ে মেখে সালোকসংশ্লেষ করতে বসে, তাহলে তুমি আমি না বলবার কে!

ও মা! তোমরা হাসছ কেন? সত্যি কথা বলছি। সমুদ্র মেষ বা সি শিপের (Sea sheep) (শীর্ষচিত্র দেখো) নাম শোনোনি বুঝি! অবশ্য তোমাদের দোষ নেই। সি শিপের ব্যাপারে অনেকেই জানে না। এর পোশাকি নাম হল কস্টাসিয়েলা কুরোশিমি (Costasiella kuroshimae) এবং একে পাওয়া যাবে জাপান, ফিলিপিন্স এবং ইন্দোনেশিয়ার সামুদ্রিক অঞ্চলে।

সি শিপরা আসলে খোলস বিহীন শামুক জাতীয় প্রাণী। ইংরিজিতে এদের ‘স্লাগ’ (Slug) বলা হয় এবং আকারেও এরা নিতান্তই ছোট্ট। পূর্ণবয়স্ক সি শিপের দৈর্ঘ্য মোটে পাঁচ মিলিমিটার।

এখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে এতটুকুনি শামুক জাতীয় প্রাণীটির নাম ‘মেষ’ অর্থাৎ ভেড়া দেওয়া হল কেন? এদের ছবিখানা দেখলেই জলের মতো পরিষ্কার বুঝতে পারবে যে বিজ্ঞনীরা অমন মজার নাম কেন দিয়েছেন। এদের নরম তুলতুলে শরীরখানা ভেড়ার পশমের মতোই নরম রোঁয়া দিয়ে ঢাকা থাকে। মাথার দু-পাশে দুটি অ্যান্টেনাকে অতি সহজেই কান হিসেবে ধরে নেওয়া যায় এবং পুঁতির মতো কালো কালো মিষ্টি চোখ দুটিকে দেখলে কার্টুন ছবির ভেড়ার কথাই মনে পড়বে। এছাড়া ভেড়াদের খাদ্য যেমন ঘাস, সমুদ্র-মেষের খাদ্যও তেমনি সমুদ্রের তলদেশে জন্মানো শৈবাল।

আরও একখানা মজার ব্যাপার হল এই যে সি শিপদের শরীরের রঙ আসলে কাচের মতো স্বচ্ছ, কিন্তু এরা শৈবালের থেকে ক্লোরোফিল নিয়ে নিজেদের শরীরে জমা করতে থাকে বলে পূর্ণবয়স্ক সমুদ্র-মেষের রঙ হয় গাছের পাতার মতোই ঝলমলে সবুজ। শরীরে সঞ্চিত এই ক্লোরোফিল কণার সাহায্যে এরা উদ্ভিদের মতো ফটোসিন্থেসিস করে নিজেদের শরীরের মধ্যেই খাদ্য তৈরি করতে সক্ষম। ফলে এদের খাদ্য শৈবালের জোগান ফুরিয়ে গেলেও এরা দিব্যি খেয়ে পরে অনায়াসে প্রায় মাস দুয়েক অবধি বেঁচে থাকতে পারে। ঠিক এই কারণে এরা ‘সোলার পাওয়ারড স্লাগ’ নামেও পরিচিত।

জাপানের কুরোশিমা দ্বীপে সমুদ্র-মেষদের প্রথম পাওয়া যায় বলে এদের ল্যাটিন নামের সঙ্গে কুরোশিমি শব্দটি যোগ করা হয়। সমুদ্র-মেষের খাদ্য পরিপাকের পদ্ধতিটি একটু অন্যরকম। অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীদের মতো এরা উদ্ভিদের সবুজ রঞ্জক ক্লোরোফিলকে হজম করতে পারে না। তার পরিবর্তে এরা ক্লোরোফিল কণাগুলিকে সরাসরি নিজেদের কোষের ভেতর জমা করতে থাকে। এভাবে জীবিত কোষের মধ্যে বাইরের কোনও বস্তুকে ঢুকিয়ে নেওয়ার পদ্ধতিকে বলা হয় ফ্যাগোসাইটোসিস (Phagocytosis) এবং এভাবে চুপিচুপি ক্লোরোফিল চুরি করার ব্যাপারটির বৈজ্ঞানিক নাম হল ক্লেপ্টোপ্লাস্টি (Kleptoplasty)। গ্রিক ‘Klepto’ শব্দটির অর্থ হল চোর এবং ক্লোরোফিল কণিকার অপর নাম ‘ক্লোরোপ্লাস্ট’ থেকে ‘প্লাস্টি’ শব্দটি নেওয়া হয়েছে।

bigganchlorophil02

সমুদ্র-মেষ ছাড়াও আরও বেশ কিছু ক্লোরোফিল চোর স্লাগদের ব্যাপারে খোঁজ পাওয়া গেছে। এরা সবাই সারকোগ্লসা (Sarcoglossa) পরিবারের সদস্য।

এবার আরেকজনের কথা বলি। ইনি মেরুদণ্ডী এবং অমেরুদণ্ডী শামুক বংশের থেকে একটু উন্নত বলেই হয়তো এঁরা ক্লোরোফিল চুরির ব্যাপারটিকেও শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এঁর নাম শ্রীল শ্রীযুক্ত বুটিদার স্যালাম্যান্ডার (Spotted Salamander)। বিজ্ঞানসম্মত নাম Ambystoma maculatum।

bigganchlorophil03

স্পটেড স্যালাম্যান্ডাররাও স্লাগদের মতোই শৈবালদের ক্লোরোফিল ব্যবহার করে ফটোসিন্থেসিস করতে সক্ষম। তবে এক্ষেত্রে স্যালাম্যান্ডার ও এককোষী শৈবালের সম্পর্ক খাদ্য-খাদকের নয়। বরং তারা একে অপরের থেকে রীতিমতো চুক্তি করে নিজেদের পাওনাগণ্ডা বুঝে নেয়। একদম সোজা কথা। এক হাথ দো, এক হাথ লো। বুটিদার স্যালাম্যান্ডার নিজেদের শরীরের কোষে শৈবালদের জন্য অ্যাকোমোডেশনের ব্যবস্থা করে দেয় এবং তার পরিবর্তে শৈবাল দেয় তার নিজের তৈরি খাদ্য ও অক্সিজেনের কিছুটা অংশ। যাকে বলে পারফেক্ট পেয়িং গেস্ট!

এখানে আরেকখানা ইমপর্ট্যান্ট ব্যাপার হল এই যে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের কোষের ভেতরে এভাবে উদ্ভিদ কোষের আশ্রয় নেওয়া এবং বহাল তবিয়তে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার ঘটনা স্বাভাবিক অবস্থায় প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। এর কারণ হল, মেরুদণ্ডী প্রাণীদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বা ইমিউনিটি পাওয়ার অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত। তাই শরীরের ভেতরে বাইরে থেকে কোনও শান্তশিষ্ট, নিরীহ জীবিত কোষ প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হওয়া উচিত। অথচ স্পটেড স্যালাম্যান্ডারদের ক্ষেত্রে এমনটা মোটেই হয় না। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এরা জন্মসূত্রে মায়ের শরীর থেকেই শৈবাল কোষগুলি লাভ করে। শরীরের ইমিউনিটি ভালোভাবে গড়ে ওঠার আগেই এককোষী শৈবালগুলি এদের শরীরে প্রবেশ করে বলে শরীর রক্ষাকারী দারোয়ান কোষেরা এদের কোনও ক্ষতি করতে পারে না।

এসব জানার পর আমি ভাবতে বসলাম যে আচ্ছা, স্যালাম্যান্ডাররা যদি ফটোসিন্থেসিস করতে পারে তবে আমরা কেন পারব না! ভাবো দেখি, যদি কোনোরকমে আমরা সালোকসংশ্লেষ করতে পারি তবে পৃথিবী থেকে দুর্ভিক্ষ এবং দারিদ্র্য দুটো উঠে যাবে। কেউ কখনও খালি পেটে ঘুমোতে যাবে না। কী আনন্দের ব্যাপার হবে সেটা!

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত প্রফেসর লিন্ডসে টার্নবুল (Lindsay Turnbull) এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তবে তাঁর মতামত অনুযায়ী, মানব-শরীরের মধ্যে সালোকসংশ্লেষ ঘটানো সির্ফ মুশকিল হি নহি, না মুমকিন হ্যায়!

আর একটু খুলে বলি। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জন্য প্রতিদিন ১৬০০ থেকে ২৪০০ ক্যালোরি প্রয়োজন। আমাদের পরিপাকতন্ত্র খাদ্য হজম করে এই বিপুল পরিমাণ শক্তি সংগ্রহ করে। মনে করো, আমরা যদি ত্বকের দ্বারা সালোকসংশ্লেষ করতে সক্ষম হতাম তবে যে পরিমাণ শক্তি আমরা তৈরি করতে পারব তা হবে আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। এর কারণ হল আমাদের ত্বকের সারফেস এরিয়া বা ক্ষেত্রফল নিতান্তই কম। সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৬০০ ক্যালোরি শক্তি তৈরি করতে হলে আমাদের প্রয়োজন একটি টেনিস কোর্টের সমান সারফেসের সবুজ ত্বক। কাজেই বুঝতেই পারছ যে, ফটোসিন্থেসিস করতে জানলেও আমাদের তেমন কিচ্ছু লাভ হবে না।

বস্তুত জানিয়ে রাখি যে এই জন্যই গাছেদের ডালে ডালে এমন অসংখ্য পাতা থাকে। উদ্দেশ্য একটাই, সালোকসংশ্লেষের জন্য সারফেস এরিয়া বাড়িয়ে দেওয়া। যত বেশি পাতা, তত বেশি খাদ্য।

এছাড়া আরেকখানা অসুবিধে রয়েছে। তা এই যে আমাদের প্রাণ-বায়ু হল অক্সিজেন (O2)। অথচ ফটোসিন্থেসিসের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপকরণটির নাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2)। এই জন্যই যে-কোনো উদ্ভিদ কোষ প্রাণ-বায়ু হিসেবে প্রশ্বাসের সঙ্গে CO2 গ্রহণ করে এবং নিঃশ্বাসের সঙ্গে O2 ত্যাগ করে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয় ঠিক উলটো। আমরা অক্সিজেন গ্রহণ করি এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি। কাজই শুধুমাত্র ফটোসিন্থেসিসের ওপর নির্ভর করতে হলে আমাদের রেসপিরেটরি সিস্টেম অর্থাৎ শ্বসনতন্ত্রের খোলনলচে সবকিছুই বদলে ফেলতে হবে। তা কি আদৌ সম্ভব?

স্যালাম্যান্ডার বা স্লাগদের পক্ষে আংশিকভাবে সালোকসংশ্লেষ করে জীবনরক্ষা করা সম্ভব, কারণ তাদের শরীর ছোট্ট, আমাদের মতো তাদের প্রতিদিন স্কুল, কলেজ, অফিস যেতে হয় না। কাজেই তারা কম শক্তিতে অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের পক্ষে তো তা সম্ভব নয়। তাই অদূর বা দূর ভবিষ্যতেও ফটোসিন্থেসিস করতে পারব, এমন আশা করে লাভ নেই। তবে মনখারাপ করার দরকার নেই। উদ্ভিদের খাদ্য নাই-বা পেলাম। আমাদের কাছে চপ, কাটলেট, পোলাও, বিরিয়ানি তো রইলই—সেই-বা মন্দ কীসে!

 জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s