অতি ছোটো। ক্ষুদ্রতম এক মৌলিক পদার্থ (Element)। ভর সবচেয়ে কম। মানে সবার চাইতে হালকা। সাধারণ তাপমাত্রায় গ্যাস। তাপমাত্রা খুব কমালে (-240oC) তরল অবস্থায় পৌঁছে যায়। আরও নীচু তাপমাত্রায় হয়ে যায় কঠিন।
কঠিন, তরল বা গ্যাস তাপমাত্রা ভেদে একই জিনিসের ভিন্ন অবস্থা। জল যেমন। কখনও কঠিন, আবার তরল, বেশি তাপমাত্রায় গ্যাস। অনেক মৌলিক পদার্থ, সংক্ষেপে মৌল সাধারণ তাপমাত্রায় (37oC) হাইড্রোজেনেরই মতো গ্যাস অবস্থায় থাকে। বাতাসের উপাদান অক্সিজেন, নাইট্রোজেন সাধারণ তাপমাত্রায় গ্যাস। আবার কার্বন-ডাই-অক্সাইড কিংবা মিথেন সাধারণ তাপমাত্রায় গ্যাস হলেও মৌলিক পদার্থ নয়। যৌগিক পদার্থ (Compound)। একাধিক মৌল দিয়ে তৈরি।
মৌলিক বা যৌগিক যেমনই হোক, সাধারণ তাপমাত্রায় অনেক পদার্থই গ্যাস হিসাবে থাকতে পারে। আর গ্যাস যখন, রাসায়নিক ধর্ম, অণুর আকার বা গঠন আলাদা হলেও কিছু সাধারণ নিয়ম এরা মানতে বাধ্য। যেমন, গ্যাস অদৃশ্য। চোখে ধরা পড়ে না। তবে ঝাঁঝালো বা কটু গন্ধে, কখনও সুগন্ধ নাকে ভেসে এলে গ্যাসের উপস্থিতি বুঝতে পারি। বুঝবার কারণ? গ্যাস সহজেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, গ্যাস অণু (Molecule)-গুলো পরস্পরের সঙ্গে কম শক্তিতে লেগে থাকে। সোনা-রূপা-লোহার ক্ষেত্রে এরকম হয় না। ওদের পরমাণুগুলো (Atoms) একে অন্যের সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধনী তৈরি করে। বন্ধনীর শক্তি বস্তু ভেদে ভিন্নরকমের।
কঠিন, তরল এবং গ্যাসের মধ্যে গ্যাসের অণুগুলো সবচাইতে কম শক্তিতে একে অন্যকে ধরে থাকে।
আবার এই শক্তি, মানে পরস্পরের সঙ্গে লেগে থাকবার পরিমাপ কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অক্সিজেন কিংবা হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে আলাদা রকম। আলাদা এদের রাসায়নিক ধর্মও। তবুও গ্যাস হিসাবে এরা কয়েকটি নিয়মের অধীন। যেমন, গ্যাসের অণুগুলো খুব জোরে ছোটাছুটি করে। কোনও বদ্ধ জায়গায় ছুটতে ছুটতে একে অন্যকে ধাক্কা মারে। ধাক্কা খাওয়া অণুর গতিবেগ বেড়ে যায়। যে ধাক্কা মারে তার গতিবেগ মুহূর্তে কমে যায়। অসংখ্য অণুর মধ্যে ধাক্কাধাক্কি চলতেই থাকে। ফলে প্রতিক্ষণেই পালটে যায় অণুর গতিবেগ। এই জটিল অবস্থাতেও গ্যাস অণুর গতিবেগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।
ভর বেশি হলে গ্যাস অণু জোরে দৌড়াতে পারবে না। গড় গতিবেগ কমে যাবে। গ্যাসের অণু যত হালকা আর ছোটো হবে ততই বাড়বে তার গতি। এ কারণেই ভর কম এবং আকারে ছোটো হাইড্রোজেন সবচাইতে জোরে দৌড়াতে পারে। বেলুনের মধ্যে ভরে দিলে গ্যাস-বেলুনকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আবার তাপমাত্রা বেশি হলে ছোটার গতি আরও বাড়বে। হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রে এই গতি এতটাই যে বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল কাটিয়ে সে চলে গেছে অন্তরীক্ষে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে হালকা গ্যাস হাইড্রোজেন পাওয়া যায় না। তবে প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুতে যৌগ হিসাবে ছড়িয়ে আছে হাইড্রোজেন। আর পৃথিবীতে হাইড্রোজেনের বিশাল ভাণ্ডার হল জল। নদী-সমুদ্রের অগাধ জলরাশি থেকে তৈরি করা যায় হাইড্রোজেন। তৈরির অন্য উপায়ও আছে।
হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের মধ্যে ধাতুর টুকরো ফেলে দিলে ভুরভুর করে হাইড্রোজেন বেরিয়ে আসে। আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে তেমনই ঘটনা দেখে ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী, পঁয়ত্রিশ বছরের হেনরি ক্যাভেন্ডিস বললেন, ‘আমি একটা গ্যাস আবিষ্কার করেছি।’
গ্যাস আবিষ্কারের সময়ই (১৭৬৬ সাল) কিন্তু তার নামকরণ হয়নি। নামকরণ হল সতেরো বছর পর। ফ্রান্সের রসায়নবিদ অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়র গ্যাসটির নাম রাখলেন ‘হাইড্রোজেন’। নামের তো মানে থাকতে হবে। তিনি বললেন, হাইড্রো এবং জেন শব্দেই আছে গ্যাসের মানে। গ্রিক শব্দ ‘হাইড্রো’ মানে জল আর ‘জেন’ মানে তৈরি করে। অর্থাৎ হাইড্রোজেন গ্যাস জল তৈরি করতে পারে, ওয়াটার ফর্মিং।
আড়াইশো বছরে পৃথিবীর ইতিহাসে বহু বদল ঘটেছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসও লাফ দিয়ে দিয়ে এগিয়েছে। একক ভরের হাইড্রোজেন থেকে ২৩৮ ভরের ইউরেনিয়াম জানতে পেরেছি। পৃথিবীর যাবতীয় মৌলিক পদার্থের খবর মানুষের হাতে।
মৌলিক পদার্থ তৈরি হয় পরমাণু দিয়ে। আর পরমাণু তৈরি হয় প্রোটন-নিউট্রন-ইলেকট্রন দিয়ে। প্রোটন-নিউট্রন থাকে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আর ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরতে থাকে। সবচাইতে ছোটো ভরের হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন আর বাইরে একটা ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াসে কখনও প্রোটনের সঙ্গে একটা বা দুটো নিউট্রন থাকতে পারে। তখন ভর ২ কিংবা ৩-এ বদলে যায়, আর নাম পালটে হয়ে যায় ডয়টেরিয়াম (D) কিংবা তেজস্ক্রিয় ট্রিসিয়াম (T)। ক্ষুদ্রতম ভরের হাইড্রোজেনের অন্য রকমফেরও আছে। অর্থো হাইড্রেোজেন এবং প্যারা হাইড্রোজেন। এদের সম্বন্ধে না বলে ক্ষুদ্রতম মৌল হাইড্রোজেনের কথা বলা যাক।
মানুষের অনেক কাজে লাগে হাইড্রোজেন। উদ্ভিদ, জীবজন্তু, মানবদেহের বেশিরভাগ যৌগ হাইড্রোজেন আর কার্বন দিয়ে তৈরি। আর শরীরের ষাট শতাংশ জল। হাইড্রোজেন ছাড়া জল তৈরি হবেই না। হাইড্রোজেনের সঙ্গে চাপ দিয়ে নাইট্রোজেন যুক্ত করে তৈরি হয় অ্যামোনিয়া। অ্যামোনিয়ার যৌগ, অ্যামোনিয়াম সালফেট জমিতে সার হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
গুণের শেষ নেই হালকা গ্যাস হাইড্রোজেনের। ভবিষ্যতে যানবাহন চলবে হাইড্রোজেনের সাহায্যে। কেমন করে?
মহাকাশের রকেট তো হাইড্রোজেনকে ব্যবহার করে ছুটে চলে। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (NASA) পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে মহাকাশযানে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করছে হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন থেকে শক্তি উৎপাদন করে মহাকাশযান পৃথিবীর কক্ষপথ ডিঙিয়ে মাধ্যাকর্ষণ বল অতিক্রম করে ছুটছে অন্তরীক্ষে। ভারতের মহাকাশযান কয়েক বছর আগে (২০১৪ সাল) মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দিল। রকেট বা মহাকাশযানে পেট্রোল বা গ্যাসোলিন জ্বালানি ব্যবহৃত হয় না। ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেন। অর্থাৎ, রকেট বা মহাকাশযান চলে হাইড্রোজেনকে দহন করিয়ে। কেমন করে?
বদ্ধ জায়গায় হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের মধ্যে বিদ্যুৎ চালালে জল তৈরি হয়। আবার বিদ্যুৎ শক্তি জলের অণু ভেঙে তৈরি করে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। হাইড্রোজেনকে অক্সিজেনের সংস্পর্শে জ্বালিয়ে দেওয়া হলে তৈরি হয় দূষণমুক্ত শক্তি (উত্তাপ) আর জল। উৎপন্ন জল মহাকাশচারীরা পান করেন। আর হাইড্রোজেন দহনে নির্গত তাপশক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে মাহাকাশচারীরা বহু কাজ সমাধা করেন। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর বড়ো চাহিদা বিকল্প শক্তি। কয়লা বা পেট্রোলের মজুত ভাণ্ডার শেষ হয়ে যাচ্ছে।
হাইড্রোজেন ব্যবহার করে বিকল্প শক্তি তৈরি করা সম্ভব। হাইড্রোজেন দহনে তৈরি হবে তাপশক্তি। নির্গত হবে জলীয় বাষ্প। বাতাসে কোনও বিষাক্ত গ্যাস ছড়াবে না। ভবিষ্যতে গাড়ির জ্বালানি ট্যাঙ্কে থাকবে তরল হাইড্রোজেন। বাতাসের সংস্পর্শে দহনের ফলে উৎপন্ন তাপ থেকে তৈরি হবে বিদ্যুৎ। পরীক্ষামূলকভাবে হাইড্রজেন গাড়ি চালানো সম্ভব হয়েছে। গাড়ির জ্বালানি ট্যাঙ্কে হাইড্রোজেন মজুত রাখবার উন্নততর কৌশল তৈরি হচ্ছে। দুনিয়া জুড়ে এই বিষয়ে গবেষণা চলছে বিস্তর। ভারতও পিছিয়ে নেই।
ক্ষুদ্রতম হাইড্রোজেনের কেরামতি এখানেই শেষ নয়। হাইড্রোজেনকে কাজে লাগিয়ে সূর্যের অভ্যন্তরে তৈরি হয় ভয়ংকর তাপ। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রে চারটে হাইড্রোজেন পরমাণু যুক্ত হয়ে তৈরি করে এক পরমাণু হিলিয়াম। আর উৎপন্ন হয় প্রচণ্ড তাপ। হাইড্রোজেন বোমার ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া। হাইড্রোজেন পরমাণু জোড়া লেগে হিলিয়াম তৈরির বিক্রিয়ায় নির্গত নয় প্রচণ্ড শক্তি। এই প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে চিনদেশ ‘কৃত্রিম সূর্য’ তৈরি করেছে। নাম ‘এইচ.এল-২এম. টোকামাক’।
কৃত্রিম সূর্য আসলে নিউক্লিয়ার ফিউশন রি-অ্যাকটর। হাইড্রোজেন থেকে (ডয়টেরিয়াম, ট্রিসিয়াম) ফিউশন প্রক্রিয়ায় শক্তি তৈরির যান্ত্রিক কৌশল। এর সাহায্য প্রচণ্ড উত্তাপ তৈরি হবে (১৫ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস)। সূর্যের চাইতেও ১০ গুণ বেশি। বিদ্যুৎ শক্তির অভাব মেটাতে কাজে লাগবে এই যন্ত্র। অন্য দেশও চেষ্টা করছে হাইড্রোজেন ফিউশন করে শক্তি তৈরি করতে।
এই শক্তিকে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করা যায়, আবার প্রয়োজনীয় কাজেও। ধ্বংসাত্মক নয়, সৃষ্টিশীল কাজেই ব্যবহার করতে হবে ক্ষুদ্রতম মৌলের ভয়ংকর শক্তি।
হাইড্রোজেনের আইসোটোপ, ডয়টেরিয়াম (D) ও ট্রিসিয়াম (T) পরমাণু সংযুক্ত (fusion) হয়ে তৈরি করে হিলিয়াম (He), নিউট্রন (n)। পারমাণবিক বিক্রিয়ায় তৈরি হয় প্রচণ্ড তাপশক্তি (E)
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর