ছোটোবড়ো নির্বিশেষে গল্প শুনতে কমবেশি আমাদের সবারই ভালো লাগে। কিন্তু যদি সেই গল্প হয় দৈত্য, দানো, রাক্ষস-খোক্ষসদের তাহলে তো আর কথাই নেই! মুলোর মতো দাঁত, কুলোর মতো কান আর ভাঁটার মতন চোখের সেই বিশাল আকারের প্রাণীগুলোর কথা শুনলে যতই বুকের ভেতরটা ভয়ে দুরুদুরু করুক, আসলে কিন্তু তাদের একবার চাক্ষুষ দেখতেও খুব ইচ্ছে করে, তাই না? মনে মনে ভাবি, ইস্, এরা যদি সত্যি সত্যি থাকত তাহলে বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হত! যদিও বাস্তবে আমারা জানি যে দৈত্য বা রাক্ষস বলে আদতে কিছু নেই। তবে আমদের এই বিশাল বিচিত্র পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাণী আছে যাদের চেহারার সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে পুরাণে বর্ণিত রাক্ষসদের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে। আজকে তোমাদের তেমনই কয়েকটি আশ্চর্য প্রাণীর কথা বলব।
১) সমুদ্রের গোরু ডাগং (Dugong)
তিমি মাছের মতো বিশাল লেজ যুক্ত ও জলহস্তির মতো মাথা বিশিষ্ট এই প্রাণীটিকে দেখতে অনেকটা রূপকথার বইয়ে পড়া কিংবা সিনেমায় দেখা কোনও ভিনগ্রহী প্রাণীদের মতো। সমুদ্রের খুব গভীরে এরা বাস করে। যেহেতু এরা সমুদ্রের ভেতরে জন্মানো ঘাস আর শ্যাওলা খেয়ে জীবনধারণ করে তাই এদের ‘সমুদ্রের গোরু’ নামে ডাকা হয়। এরাই সম্ভবত একমাত্র তৃণভোজী, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। তবে খুবই দুঃখের কথা, এই আশ্চর্য সুন্দর প্রাণীগুলি এখন বিলুপ্তির পথে। একেই এদের প্রজনন ক্ষমতা খুব দুর্বল, তার ওপর সুস্বাদু মাংসের লোভে চোরা শিকারিদের আক্রমণের ফলে এই নিরীহ প্রাণীগুলি আজ অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে। প্রশাসন যদি এদের রক্ষায় এখনই তৎপর না হয় তাহলে আগামীদিনে কিন্তু সত্যি সতিই এদেরকে বাস্তব পৃথিবীর মাটি ছেড়ে কোনও রূপকথার বইয়ের পাতাতেই আশ্রয় নিতে হবে।
২) মকর
আমাদের ভারতীয় পুরাণে উল্লেখ আছে মা গঙ্গা, নর্মদা ও বরুণদেবের বাহন হিসাবে পরিচিত ‘মকর’ নামের এক ভয়ংকর জলচর প্রাণীর কথা। পুরাণ গ্রন্থে মকরের যে শারীরিক গঠনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে পাইলোসোরাস (Pliosaurus) নামক জুরাসিক যুগের এক জলচর ডাইনোসরের চেহারার সঙ্গে মিল লক্ষ করা যায়। অনেক কন্সপিরেসি থিয়োরিস্টরা মনে করেন, বিভিন্ন পুরাণে যেসব প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের কথা বলা হয়েছে তারা আসলে বিভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসর! তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তো জানি মানুষ আসার বহু যুগ আগেই পৃথিবী থেকে ডাইনোসররা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, তাহলে পৌরাণিক গ্রন্থে তাদের কথা এল কী করে? একি শুধুই কল্পনা, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনও রহস্য! ক্রিপ্টোলজিস্ট অর্থাৎ যারা বিভিন্নরকম সংকেত-লিপি নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের একাংশের মতে কয়েকশো কোটি বছর আগে শুধুমাত্র উল্কাপাতের ফলে পৃথিবী থেকে সমস্ত প্রজাতির ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটেনি। সম্প্রতি আমেরিকার ওক রিজ ল্যাবরেটরির (Oak Ridge National Laboratory) বিজ্ঞানীদের হাতে উঠে এসেছে এমনি কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাঁরা একটি ডাইনোসর-এর হাড় কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে পরীক্ষা করার সময় জানতে পারেন হাড়টির বয়স মাত্র কয়েক হাজার বছর! আবার অন্যদিকে ২০০০ সালে জুডিথ রিভার ইন্সটিটিউট (The Judith River National Institute)-এর বিজ্ঞানীরা টিরানোসরাস রেক্স-এর একটি কঙ্কাল হাতে পান। এই কঙ্কালের গায়ে আশ্চর্যজনকভাবে নরম মাংস, শুকনো রক্ত আর অল্প একটু চামড়া লেগে ছিল। বিজ্ঞানীরা বলেন, চামড়া আর মাংস এক হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তাহলে মানুষ আর ডাইনোসর কি কোনও এক সময় একসঙ্গে বসবাস করত? কিংবা এখনও লোকচক্ষুর আড়ালে বসবাস করে? রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি-র মতন পৌরাণিক গ্রন্থে তবে যে-সমস্ত রাক্ষস ও ভয়ংকর প্রাণীগুলির উল্লেখ আছে সেগুলি কি তবে ডাইনোসর? এ নিয়ে অবশ্য বিজ্ঞানী মহলে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। কেউই সঠিকভাবে কোনও সত্যতাকে তুলে ধরতে পারেননি।
৩) ইয়েতি ক্র্যাব (Yeti Crab)
হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের লোককথায় ‘ইয়েতি’ নামক এক অতিকায় প্রাণীর উল্লেখ আছে। তুষার-শুভ্র লোমে ঢাকা এই প্রাণীটির দর্শন অনেক স্থানীয় অধিবাসী থেকে শুরু করে পর্বত আরোহীরাও নাকি পেয়েছেন বলে শোনা যায়। তবে বৈজ্ঞানিক মহলে পাকাপাকিভাবে এই প্রাণীটির অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। ইয়েতি আছে কি নেই এই বিষয় নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও আমাদের আলোচ্য ইয়েতি ক্র্যাবের অস্তিত্ব নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তবে ২০০৫ সালের আগে পর্যন্ত এই প্রাণীটিকে পৌরাণিক যুগের কাল্পনিক প্রাণী হিসাবে মনে করা হত। ২০০৫ সালে একদল গবেষক দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ২০০০ মিটার গভীরে এই প্রাণীটির চাক্ষুষ দর্শন প্রথম পান। এই বিশেষ প্রজাতির কাঁকড়াটির সারা গা বরফের মতন ধবধবে সাদা লোমে ঢাকা। এর অবশ্য আলদা একটা ভালো নাম আছে Kiwa hirsuta। তবে কাল্পনিক ইয়েতির মতন এর চামড়াও সাদা লোমে ঢাকা, তাই লোকমুখে এর ডাকনাম ইয়েতি ক্র্যাব হিসাবেই বেশি পরিচিত। এই প্রাণীটির চোখ প্রায় নেই বললেই চলে। তাই প্রথমদিকে বৈজ্ঞানিকেরা একে অন্ধ বলেই মনে করতেন। তার পরে জানা গেল এই প্রাণীটি খুব সামান্য হলেও দেখতে পায়। বাইরের পৃথিবীর কাছে এই প্রাণীটির অস্তিত্ব সদ্য প্রমাণিত হলেও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলের স্থানীয় মানুষজনের কাছে এরা পূর্বপরিচিত।
পরিশেষে তাই বলা যেতে পারে আশ্চর্য এইসব প্রাণীর তালিকা এখানেই শেষ নয়। ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা / বিশ্ব ভরা প্রাণ’-এর কতটুকুই-বা আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জানাতে পেরেছে? যদিও স্থলভাগের তাও দু-চারটে জিনিস আবিষ্কার হয়েছে, কিন্তু জলভাগের প্রায় পুরোটাই অনাবিষ্কৃত। অতএব কোনোভাবেই আমরা আমাদের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে বর্ণিত অতিকায় প্রাণীগুলিকে নিছক কাল্পনিক বলতে পারি না। কে বলতে পারে আগামীদিনে হয়তো তোমাদের ভেতর থেকেই কেউ একজন এই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা পৌরাণিক প্রাণীকুলকে খুঁজে সারা পৃথিবীর সামনে বের করে আনবে।
তথ্যসূত্র- ইন্টারনেট
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর