সন্ধ্যা ভট্টাচার্য গল্প প্রতিযোগিতা ২০২০( প্রথম স্থান)
কন্ট্রোল সেন্টার, শ্রীহরিকোটা।
২৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০৬০, সকাল ৬.০০।
“হ্যালো, দিস ইজ আর্থ কলিং স্পেস শিপ পুষ্পকরথ ইলেভেন। হ্যাভন্ট হার্ড ফ্রম ইউ ইন লাস্ট সিক্স আওয়ারস। ইজ এভরিথিং ওকে?”
“হ্যালো, দিস ইজ আর্থ কলিং…”
নাছোড়বান্দা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ভয়েস সিমুলেশনের মাধ্যমে মেসেজ পাঠিয়েই চলে স্পেস শিপ পুষ্পকরথ-১১-র উদ্দেশে। ওদিক থেকে অবশ্য অখণ্ড নীরবতা ছাড়া আর কিছুই ভেসে আসে না। মনিটর ব্ল্যাঙ্ক, ভয়েস টার্মিনাল বোবা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
(১)
২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০৬০, ২৩.৫৬ ঘণ্টা।
পুষ্পকরথ-১১।
কমান্ডার বাসু মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। বাহ্যত অবশ্য টুঁ শব্দটিও বেরোল না তাঁর মুখ থেকে। কুড়ি বছর ধরে কোনো স্পেস শিপের ক্যাপ্টেনসি করতে গেলে ইমোশনে লাগাম দিতে হয়। আর নিজের ইমোশনকে কীভাবে লাগাম দিতে হয়, তা তাঁর থেকে আর ভালো কে-বা জানে!
আড়চোখে সহকারী কমান্ডার মৈত্রেয়ীর দিকে তাকালেন তিনি। মৈত্রেয়ীর দৃষ্টি মনিটরের পর্দায় থাকলেও তাঁর ভুরুতে একটা কুঞ্চন দেখতে পেলেন তিনি।
ততক্ষণে বিপ বিপ আওয়াজটা জোরালো হয়ে উঠেছে। রেডিয়েশন অ্যাসে মনিটর থেকে আসছে আওয়াজটা।
“কী ব্যাপার মৈত্রেয়ী, এখানে তো কোনো রেডিয়েশন ফিল্ড নেই। আমরা পৃথিবী থেকে এখনো প্রায় ২৫ লক্ষ কিমি দূরে আছি। এখানে রেডিও অ্যাক্টিভিটি এল কোথা থেকে?”
“জানিনা স্যার। আমি ফাইনাল স্পেস জাম্প দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, হঠাৎই সামনে মনিটরে দেখতে পাই একটা প্রবল আয়ন ঝড় শুরু হয়েছে। সবজান্তা জানাল, তেজষ্ক্রিয় কণারা চরম গতিতে চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।”
“হুঁ, মনে হচ্ছে সৌর ঝড়। এরকম তো মাঝেমধ্যে ঘটতেই পারে, তাই না?”
“হ্যাঁ স্যার, তা পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রথমত, সূর্য থেকে এতটা দূরে সৌর ঝড় এতটা মারাত্মক বা তেজষ্ক্রিয় হয় না। আর দ্বিতীয়ত, এই আয়ন ঝড়ের প্রকৃতিও একটু আলাদা। আপনি দেখুন স্যার, তেজষ্ক্রিয় কণাগুলো কীভাবে বলয়ের মতো ঘিরে রেখেছে পৃথিবীর কক্ষপথ! একদম ভ্যান অ্যালেন বেল্টের মতো! চওড়ায় প্রায় ২৫০০০ কিলোমিটার। কিন্তু এর মধ্যে প্রচুর অ্যাস্টারয়েডসের প্রতিচ্ছবিও আমি দেখতে পাচ্ছি।”
কমান্ডার বাসু রেডিয়েশন মনিটরের দিকে তাকালেন। কম্পিউটার সিম্যুলেশন দেখাচ্ছে আয়ন ঝড় সত্যি সত্যিই বলয়ের মতো ঘিরে রেখেছে পৃথিবীর কক্ষপথ।
“হাইলি আন-ইউজুয়াল!” বিড়বিড় করে বলেন বাসু। “কিন্তু এরকম কোনো তেজষ্ক্রিয় বলয়ের কোনো তথ্য তো আমাদের কাছে নেই! ভ্যান অ্যালেন বেল্টের দুটো ভাগ—আউটার, আর ইনার। সেগুলো স্থায়ী, আর পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করার সময়েই আমরা সে-দুটো পেরিয়ে এসেছিলাম। ম্যাক্সিমাম পঞ্চাশ হাজার কিমি অবধি তারা ছিল। এখন যখন ফিরে যাচ্ছি, তাদের আবার পাব সেখানে। কিন্তু এখানে, পৃথিবী থেকে প্রায় পঁচিশ লক্ষ কিমি দূরে, পৃথিবীর চারদিকে এই তেজষ্ক্রিয় বলয় কবে তৈরি হল?”
“স্যার, আমাদের ৩৬০ ডিগ্রি সেন্সর দেখাচ্ছে কোনো অজানা কারণে প্রচণ্ড সৌর ঝড় শুরু হয়েছে বুধ গ্রহের কাছে। এই তেজষ্ক্রিয় বলয় হয়তো সেই সৌর ঝড়েরই ফলশ্রুতিতে তৈরি হয়েছে। টেম্পোরারি ভ্যান অ্যালেন বলয়ের কথা তো আমাদের ইউজার ম্যানুয়ালেই আছে।”
“হ্যাঁ সেটা অবশ্য হতেই পারে। এখন দেখুন তো মৈত্রেয়ী, এই বলয়ের ফলে আমাদের অপারেশনাল কোনো অসুবিধে হবে নাকি।”
মৈত্রেয়ী ভুরু কুঁচকে ডুব দেন কম্পিউটার স্ক্রিনে। আপাতত স্পেস জাম্প দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ, স্পেস জার্নিতে সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটলেও তা বিবর্ধিত হয়ে বিপদ ঘটতে পারে। অর্থাৎ, মারফির ল অনুযায়ী, বিপদ ঘটার সামান্যতম সম্ভাবনা থাকলে তা ঘটবেই। সুতরাং খুবই সতর্ক থাকতে হবে এবং এর কার্যকারণ জানতে হবে যতদূর সম্ভব।
(২)
আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে পুষ্পকরথ-১১ পৃথিবী থেকে যখন রওনা দিয়েছিল, তখন তার লক্ষ্য ছিল শনি গ্রহ। আমাদের জানা সৌরজগতের শেষ সীমা তখন প্লুটোকে পেরিয়ে আরো প্রায় সমান দূরত্বে যে জোড়া বামন গ্রহ আছে, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে লব-কুশ, সেই অবধি পৌঁছে গেছে। পৃথিবী থেকে প্রায় ১০.৪ বিলিয়ন কিমি দূরে এই গ্রহ দুটো এতদিন অনাবিষ্কৃতই ছিল। অতীতে পৃথিবী থেকে পাঠানো ভয়েজার নামক মহাকাশযানটি নেপচুন পেরিয়ে প্লুটোর কাছে আসার পরই যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যায়। এরপরে মানবজাতি ম্যানড স্পেস শিপ পাঠানোতেই ব্যস্ত ছিল। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল শনি গ্রহ থেকে নতুন মৌল স্যাটার্নিয়াম সংগ্রহ করা, যা পৃথিবীর জ্বালানি সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারে। পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে স্যাটার্নিয়ামের উপস্থিতি নগণ্য, তাও ভূপৃষ্ঠের অন্তত তিনশো কিমি নীচে, যেখানে তাপমাত্রা সবসময় দুশো ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে এবং যেখান থেকে তা উত্তোলন করা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য। তাই শনি গ্রহে স্যাটার্নিয়ামের বহুল উপস্থিতি টের পাওয়ামাত্রই সব রাষ্ট্রই চেয়েছিল সেখান থেকে তা মাইনিং করে নিয়ে আসতে। কিন্তু ভিনগ্রহে গিয়ে সেখানকার প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে সেখান থেকে একটা তেজষ্ক্রিয় প্রচণ্ড ভারী ধাতু মাইনিং করে তা সেখান থেকে মহাকাশযানে করে নিরাপদভাবে পৃথিবীতে নিয়ে এসে সেখান থেকে এনার্জি তৈরি করার কৃৎকৌশল সকলের ছিল না। হাতে গোনা যে-ক’টা দেশ সেটা করতে পারত, তার মধ্যে একটা ছিল ভারত।
স্যাটার্নিয়াম থেকে প্রাপ্ত শক্তি প্রায় অবিনশ্বর, কারণ একটা স্যাটার্নিয়াম অণুর বিয়োজন থেকে পাওয়া যায় প্রায় ১১২-খানা ইউ-২৭২ অণু, যার হাফ লাইফ প্রায় ২৭২ বছর। অর্থাৎ, আজ ফিশন শুরু হলে তা চলবে আগামী ২৭২ বছর ধরে এবং শক্তি উৎপন্ন হবে। একটা মটরদানার মতো স্যাটার্নিয়াম মাস প্রায় দুশো বছর ধরে যে-কোনো বড়ো শহরের সমস্ত এনার্জি তৈরি করতে সক্ষম।
স্বাভাবিকভাবেই তাই যখন দেখা গেল, শনি গ্রহে স্যাটার্নিয়ামের প্রায় অফুরন্ত ভান্ডার রয়েছে, তখন যারা যারা মহাকাশ অভিযান করতে সক্ষম সব রাষ্ট্রই ঝাঁপিয়ে পড়ল শনি গ্রহে অভিযান করে তা দখল করার জন্য। আমেরিকা, চিন, রাশিয়া, ফ্রান্স শুরু করল স্পেস ওয়ার। ভারত প্রথমে কোনো পক্ষ নিল না। যখন যুযুধান চার দেশ নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে শক্তিক্ষয় হতে হতে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে, তখন ভারত পঞ্চম শক্তি হিসেবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হল এবং জয়ী হল। যুদ্ধ সমাপ্তির শর্ত হিসেবে একটা কনফেডারেশন তৈরি হল এই পাঁচ দেশ মিলিয়ে, যার গরিষ্ঠ নিয়ামক হল ভারতবর্ষ। এখন বাকি সব দেশকেই এনার্জির জন্য এই কনফেডারেশনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। মানে বিশ বছর আগে যখন পুষ্পকরথ-১১ পৃথিবী থেকে লঞ্চ হয়েছিল, তখন এরকমই দেখে এসেছিলেন মৈত্রেয়ী, বাসু আর অন্যান্য ক্রু মেম্বাররা। বিগত কুড়ি বছরেও এই সমীকরণের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে ওঁরা শোনেননি।
(৩)
২৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০৬০, ০০.৩০ ঘণ্টা।
এই বিমানের কার্গো হোল্ডে আছে প্রায় অফুরন্ত শক্তির ভান্ডার। একটা দশ ঘন ফুট কিউব বক্সের মধ্যে রাখা আছে সেই সাতরাজার ধন এক মানিক, স্যাটার্নিয়াম, যা গোটা পৃথিবীর আগামী এক সহস্র বছরের শক্তির চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এই স্যাটার্নিয়াম যে বাক্সের মধ্যে রাখা আছে, তার চাদর প্রায় সাত ফুট পুরু লেড দিয়ে তৈরি। হিসেব কষেই এই পুরুত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। এর থেকে কম পুরু হলে স্যাটার্নিয়ামের তেজষ্ক্রিয়তা বাইরে বেরিয়ে আসবে, আর বেশি পুরু হলে স্পেশ শিপের ওজন ক্রিটিকাল ওজনের চেয়ে বেশি হয়ে যাবে এবং তার গতি ব্যাহত হবে। স্পেস জাম্প দেওয়ার জন্য স্পেস শিপের ভর এবং গতি একটা বিশেষ অনুপাতে পৌঁছানো প্রয়োজন এবং সেই কারণে স্যাটার্নিয়াম রিকভারি লেড বক্সের ওজনের কথাও সর্বদাই মাথায় রাখা প্রয়োজন। পুষ্পকরথ-১১-র ভারবহন ক্ষমতা তিন ঘন ফুট স্যাটার্নিয়াম-এর বেশি বহন করার মান্যতা দেয় না। তবে এই অত্যন্ত দুরূহ এবং প্রায় কুড়ি বছর ব্যাপী কাজটা সুসম্পন্ন হলে প্রায় এক হাজার বছর গোটা পৃথিবীর এনার্জি সমস্যার সমাধান হবে।
কমান্ডার বাসু তাই গভীর চিন্তায় ডুব দেন। যাই ঘটুক না কেন, পুষ্পকরথ-১১-কে শ্রীহরিকোটায় অবতরণ করাতেই হবে। জীবনের সবচেয়ে জরুরি মিশনকে তিনি ব্যর্থ হতে দেবেন না, কিছুতেই না। সেই কারণেই হঠাৎ এই উটকো ঝামেলায় বাসু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সাময়িক ভ্যান অ্যালেন বেল্টের কথা শোনা যায় বটে, তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব, ওয়ান্স ইন আ মিলিয়ন ইয়ার্স। কিন্তু সেই ওয়ান্স ইন আ মিলিয়ন চান্স ফ্যাক্টরটা বাসুর জীবদ্দশাতেই হতে হল? তাও তাঁর জীবনের সবচেয়ে জরুরি মিশনের সমাপ্তির ঠিক আগে? অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বাসু মনিটরে নজর দেন। ঠিক সেই সময়ে নেভিগেশন অফিসার চন্দ্রশেখর জানালেন, “স্যার, আর্থ কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, উই আর অন আওয়ার ওন।”
(৪)
২৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০৬০, ০০.৪৫ ঘন্টা।
মৈত্রেয়ী তন্নতন্ন করে ডাটা বেস আর ইনফরমেশন পোর্টাল ঘাঁটতে থাকেন। নেভিগেশনের দায়িত্ব চন্দ্রশেখরের। স্পেস শিপে এই মুহূর্তে মোট তেত্রিশজন মহাকাশযাত্রী আছেন। এই তেত্রিশজনকে চারটে গ্রুপে ভাগ করা আছে। দুটি গ্রুপের মোট ষোলোজন সরাসরি স্যাটার্নিয়াম উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রযুক্তিবিদ অর্থাৎ, পে লোড স্পেশালিষ্ট। বাকি সতেরোজন মহাকাশযান চালানোর বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রযুক্তিবিদ ষোলোজন এবং আরো ন’জন, মোট পঁচিশজন মহাকাশচারী, তার মধ্যে মিশন স্পেশালিস্ট অফিসার শর্মাও আছেন, প্রোটোকল অনুযায়ী এখন রেস্ট রুমে। দু’মাস পরে তাঁদের প্রণোদিত ঘুম ভাঙার কথা। দূরপাল্লার মহাকাশযাত্রায় দ্রুতগতির কারণে এজিং প্রসেস দ্রুততর হয়। তাই শারীরবৃত্তীয় কাজকর্ম মন্দগতিতে চালানোর উদ্দেশ্যে ইনডিউসড ডিপ স্লিপের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে বয়স দ্রুতগতিতে বাড়ার প্রক্রিয়া খানিকটা শিথিল করা যায়। মহাকাশ যানের সব ক্রুরাই রোটেশন পদ্ধতিতে এই ইনডিউসড স্লিপ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যান। যেহেতু সম্পূর্ণ অটোমেটেড এই মহাকাশযান চালানোর জন্য সুপার-কম্প সবজান্তাই যথেষ্ট, তাই মাত্র দু’জন ক্রু আর ক্যাপ্টেন পালা করে কনসোলে থাকেন। বাকিরা হয় ইনডিউসড স্লিপ চেম্বারে, নয় রেস্ট রুমে।
মৈত্রেয়ী নানান কথা ভাবতে ভাবতে সার্চ করতে থাকেন। হঠাৎই ৪২ বছর আগেকার একটা ছোট্ট তথ্যে চোখ আটকে যায় তাঁর। তাঁর ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্টের ইন্টেলিজেন্ট লজিক একটা তথ্য তুলে এনেছে পেন্টিলিয়ন পেন্টিলিয়ন তথ্যের মধ্যে থেকে। ২০১৮ সালের একটি রিসার্চে দেখা যাচ্ছে প্রতিবছর গড়ে পৃথিবীর পোলারিটি ১২ থেকে ৪০ কিমি করে সরে যাচ্ছে, অর্থাৎ, পৃথিবীর দুই ম্যাগনেটিক পোল জায়গা বদল করছে। অতীতেও এই পোল রিভার্সাল ঘটেছে, কিন্তু খুব ধীরে। কিন্তু এখন সেই বিপরীতায়নের গতি অনেক বেশি। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র নির্ভর করে পৃথিবীর খোলের নীচে যে অন্তঃস্থল আছে সেখানে থাকা লৌহ খনিজের পরিমাণের উপর। এই ম্যাগমা পৃথিবীর কোর বা অভ্যন্তরীণ অত্যুচ্চ তাপমাত্রায় গলিত অবস্থায় থাকে এবং ফলত পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিকগতির প্রভাবে এতে স্রোতের সৃষ্টি হয়। এই ম্যাগমার স্রোতের ফলে যে তড়িচ্চুম্বক শক্তি উৎপন্ন হয় সেটাই পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে এবং সব চৌম্বক ক্ষেত্রে মতোই এরও দুটো অক্ষ আছে, সাউথ পোল আর নর্থ পোল। মনে রাখতে হবে যে, এই চুম্বকীয় অক্ষ দুটো কিন্তু ভৌগোলিক অক্ষের থেকে আলাদা জায়গায় অবস্থান করে। এখন খুব ধীরে ধীরে এই পোলারিটির বিপরীতায়ন ঘটলে কোনো সমস্যা হয় না সাধারণত, কিন্তু কোনো কারণে খুব দ্রুত ঘটলে যেমন, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে খনিজ জীবাশ্ম জ্বালানি সংগ্রহ করার জন্য অত্যাধিক গভীরতা অবধি খনন করার ফলে তরলীকৃত লৌহসমৃদ্ধ ম্যাগমার দ্রুত স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে উদ্ভূত তড়িচ্চুম্বকীয় বলের প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেও বিভিন্ন আয়নের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। আবার অপরদিকে সূর্যেরও নিজস্ব পোলারিটির বিপরীতায়ন ঘটে প্রতি বারো বছরে একবার এবং এর প্রভাবে সূর্য পৃষ্ঠে সর্বদাই সৌর ঝড় লেগেই থাকে। দৈবাৎ যদি পৃথিবীর এবং সূর্যের আক্ষিক বিপরীতায়ন একই সময়ে উলটোদিকে ঘটে, তাহলে তার সম্মিলিত প্রভাবে বিরাট মাপের সৌর ঝড় ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রিসার্চারদের মতে, অনুরূপ একটি মহাজাগতিক ঘটনায় প্রায় পাঁচ মিলিয়ন বছর আগে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পৃথিবীর চারদিকে যে ভ্যান অ্যালেন ম্যাগনেটিক বলয় আছে, তার অন্তর্গত তেজষ্ক্রিয় কণাগুলির গতিবেগ বৃদ্ধিও এই সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে এবং হিসেব করে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পরে এই তড়িচ্চুম্বকীয় প্রভাব চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছাবে। অর্থাৎ, ২০৬০ সাল।
মৈত্রেয়ী স্তব্ধ হয়ে যান। ফ্লাইট ট্রাজেকটরি এবং টাইম সিম্যুলেশন করে ফ্লাইট প্ল্যান তৈরি করার সময়ে কনফেডারেশন এই অত্যন্ত জরুরি তথ্যটা হিসেবের মধ্যে নিল না কেন তার বোধগম্য হয় না। যাত্রা শুরুর সময় মাত্রই একমাস এগিয়ে দিলে তো পুষ্পকরথ এগারোকে এই বাধার সম্মুখীন হতে হত না!
(৫)
২৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০৬০, ১.১৫ ঘণ্টা।
পুষ্পকরথ-১১-র মাস্টার কম্পিউটারের নাম সবজান্তা। মৈত্রেয়ী বাসুকে সব তথ্য খুঁটিয়ে বলার পরে বাসু সবজান্তাকে নির্দেশ দেন এই পোলারিটি বিপরীতায়নের ফলে উদ্ভূত সৌর ঝড়ের প্রভাবে মহাকাশযানে কী প্রভাব পড়তে পারে তা খতিয়ে দেখার এবং সে প্রভাব এড়ানোর জন্য কী করা উচিত তা নির্ণায়ন করার।
ততক্ষণে বাইরে তেজষ্ক্রিয় ঝড় খুব সাংঘাতিক আকার নিয়েছে। সাময়িক ভ্যান অ্যালেন বেল্ট আরো ঘন সংবদ্ধ হচ্ছে। এতটাই ঘন যে, ম্যানুয়াল কন্ট্রোল ছেড়ে চন্দ্রশেখর বাধ্য হলেন মাস্টার কম্পিউটারের হাতে নেভিগেশন ছেড়ে দিতে। এত তাড়াতাড়ি গতিপথ পরিবর্তন করতে হচ্ছে যে তা কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। পুষ্পকরথ এবারে ওই তেজষ্ক্রিয় বলয়ের মধ্যে প্রবেশ করল।
হঠাৎই মহাকাশযানের গতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। মৈত্রেয়ী, চন্দ্রশেখর আর বাসু নেভিগেশন মনিটরের দিকে তাকিয়ে দেখেন চারদিক থেকে বিভিন্ন সাইজের গ্রহাণু ছুটে আসছে তাঁদের যানের দিকে। সবচেয়ে বড়ো গ্রহাণু, যার আয়তন চাঁদের এক দশমাংশের একভাগ, তার সঙ্গে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী এবং হতে আর মাত্র বারো মিনিট লাগবে। বাসু দ্রুত টাইপ করলেন, সংঘর্ষ এড়ানোর কোনো উপায়? কম্পিউটার জানাল, যেহেতু কার্গো হোল্ডের ভর খুব বেশি, তাই তার মহাকর্ষ টানের পরিমাণও বেশি। তাই সংঘর্ষ এড়াতে গেলে এক্ষুনি কার্গো হোল্ড বিচ্ছিন্ন করতে হবে মূল মহাকাশযান থেকে। এর ফলে গ্রহাণুর গতিপথে যে সামান্য পরিবর্তন হবে, তার সঙ্গে মহাকাশযানের গতিপথের যে বদল ঘটবে, তাতে সংঘর্ষ এড়ানো গেলেও যেতে পারে।
বাসু মৈত্রেয়ীর দিকে তাকালেন মাত্র। আর কোনো উপায় নেই। মৈত্রেয়ী ঘাড় ঝোঁকালেন। বাসু কমান্ড টাইপ করলেন: ডিসএনগেজ কার্গো।
নিমেষের মধ্যে কার্গো হোল্ড ডিসএনগেজিং প্রক্রিয়া শুরু হল। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে অমূল্য স্যাটার্নিয়াম এবং বিশ বছরের কঠোর পরিশ্রম সমেত কার্গো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পুষ্পকরথ-১১ থেকে। ডেড ওয়েট বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে পুষ্পকরথ-১১ ম্যানুভার করাও একটু সোজা হল। ওদিকে কার্গো হোল্ড আরেকটি আলাদা পথে ভ্যান অ্যালেন বেল্টের মধ্যে জায়গা করে নিল সেটা দেখা গেল। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় দুশো কিলোমিটার গতিতে সেটা পুষ্পকরথ থেকে সরে যেতে লাগল। তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণের ফলে মহাকাশযানের দিকে এগিয়ে আসা গ্রহাণুপুঞ্জের গতিপথেও সামান্য হলে পরিবর্তন হল। সবজান্তা হিসেব কষে জানাল, পুষ্পকরথ মে বি সেফ, বাট জাস্ট।
(৬)
২৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০৬০, ০১.২৭ ঘণ্টা থেকে সময়হীনতা অবধি।
পুষ্পকরথ-১১-র অটো-পাইলট সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে এগিয়ে আসা গ্রহাণুর কক্ষপথ থেকে সরে যেতে। বুস্টার ইঞ্জিন ও রিজার্ভ ইঞ্জিন সমেত চারটে ইঞ্জিনই চলছে এখন। ফলশ্রুতি কার্গো হোল্ড, অ্যাস্টারয়েড আর পুষ্পকরথের পারস্পরিক দূরত্ব ধীরে হলেও বাড়তে থাকে। বাসু, চন্দ্রশেখর আর মৈত্রেয়ী দমবন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতিমধ্যেই বিশ্রামকক্ষ থেকে বাকি পাঁচজন এসে উপস্থিত হয়েছেন সেখানে এবং সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে বাসু বাকি পঁচিশজনের ইনডিউসড স্লিপ ভাঙানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং সবজান্তাকে নির্দেশ দেন। কে বলতে পারে, মহাকাশযান সংঘর্ষ এড়াতে পারবে কি না বা আগামী কয়েকটি মিনিট তাদের জীবনের শেষ কয়েকটা মিনিট হতে যাচ্ছে কি না! তাঁরাও ধীরে ধীরে এসে পৌঁছাচ্ছেন কনসোলের পিছনে বোর্ড রুমে। বাসুর নির্দেশে মিশন স্পেসালিস্ট শর্মা তাঁদের পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করার দায়িত্ব নিলেন।
অবশেষে আসে সেই চরম মুহূর্ত। পুষ্পকরথের প্রায় কান ঘেঁষে বেরিয়ে যায় গ্রহাণুগুলো এবং প্রায় আরো এক মিনিট পরে গিয়ে কলিশন করে ফেলে দেওয়া কার্গো হোল্ডের সঙ্গে। শব্দহীন বিস্ফোরণের ফলশ্রুতি বিশাল মহাজাগতিক কম্পনে কেঁপে ওঠে পুষ্পকরথ-১১। চরম তেজষ্ক্রিয় স্যাটার্নিয়াম-এর সঙ্গে গ্রহাণুর সংঘর্ষের ফলে যে বিস্ফোরণ হয় তাতে মহাকাশে যেন এক অত্যুজ্জ্বল দ্বিতীয় সূর্যের আবির্ভাব হল। কম্পনের অভিঘাতে মৈত্রেয়ীর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল এবং তিনি জ্ঞান হারালেন। ওদিকে বাসুও তখন চেয়ার ছেড়ে লুটিয়ে পড়েছেন নীচে। একই অবস্থা পুষ্পকরথ এগারোর তেত্রিশজন ক্রু মেম্বারেরই।
মহাকর্ষ বলের প্রভাবে যে মুহূর্তে চরম তেজষ্ক্রিয় স্যাটার্নিয়াম সমেত কার্গো হোল্ড ও গ্রহাণুটি পরস্পরকে স্পর্শ করল, শব্দহীন বিরাট বিস্ফোরণের ফলে অভাবনীয় রকম বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হল। এই বিপুল পরিমাণ শক্তি টেম্পোরারি ভ্যান অ্যালেন বেল্টকে প্রবল আকর্ষণে সঙ্কুচিত করল। এর ফলে যুগপৎ দুটি মহাজাগতিক ঘটনা ঘটল। প্রথমত, সময়মাত্রার চাদরে একটি ভাঁজ তৈরি হল মহাশূন্যের বুকে এবং, দ্বিতীয়ত, সেই ভাঁজের একটি প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবধি সূচের ফোঁড়ের মতো বিদ্ধ করে বেরিয়ে গেল সেই বিপুল পরিমাণ শক্তি, অর্থাৎ তৈরি হল একটি ওয়র্ম-হোল বা নলাকৃতি কাল-সুড়ঙ্গ।
এই ওয়র্ম-হোল প্রবল বেগে আকর্ষণ করে তার আশেপাশে থাকা সমস্ত মহাজাগতিক বস্তুকে। অন্যান্য গ্রহাণু এবং মহাজাগতিক কণার সঙ্গে পুষ্পকরথও প্রবেশ করল সেই ওয়র্ম-হোলে। ওয়র্ম-হোলের মধ্যে সময় স্থির হয়ে থাকে। তাই কম্পিউটার সহ সব মেশিনও বন্ধ হয়ে গেল। বলা চলে, পুষ্পকরথ তার সমস্ত যন্ত্রপাতি ও অভিযাত্রী সমেত সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশনে চলে গেল। ঠিক কতটা সময় পুষ্পকরথ ওয়র্ম-হোলের মধ্যে কাটাল, তা নির্ণয় করার কোনো উপায় আর রইল না।
কোনো এক অনির্দিষ্ট কাল পরে সময়-সুড়ঙ্গের অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে আসে পুষ্পকরথ-১১। প্রথমে পাওয়ার ফিরে আসে কম্পিউটার কনসোলে। সমস্ত যন্ত্রপাতি যা যা শাট ডাউন হয়ে গেছিল ধীরে ধীরে ফের চালু হয়। ইঞ্জিন ১ ও ২ চালু হয়। সবজান্তা মহাকাশযানের কন্ট্রোল নেয়। মেঝেতে পড়ে থাকা বাসু, চন্দ্রশেখর ও মৈত্রেয়ীও নড়াচড়া করতে থাকেন। বোর্ড রুমে থাকা বাকি তিরিশজন আরোহীর শরীরেও জেগে ওঠার লক্ষণ দেখা যেতে থাকে। পূর্বনির্ধারিত গন্তব্য অনুযায়ী সবজান্তা সবুজ পৃথিবীর দিকে যানের অভিমুখ স্থাপন করে।
পুষ্পকরথ এগারো এগিয়ে যায় এক সবুজ গ্রহের দিকে, মোটামুটি পঁচিশ লক্ষ কিলোমিটার দূরে। ততক্ষণে বাসু, মৈত্রেয়ী, চন্দ্রশেখর, শর্মা, নেহা, অজন্তা, রামানুজন ও নন্দিনী সহ পুষ্পকরথের মোট তেত্রিশজন অভিযাত্রীই জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন। বাসু আর মৈত্রেয়ী এসে বসেছেন কনসোলের সামনে। সব বাধাবিপত্তি কাটিয়ে তাঁরা অবশেষে পৃথিবীতে ফিরতে চলেছেন। যদিও যে-কাজে গেছিলেন তা সমাধা হয়নি সঠিকভাবে, তবুও, বেঁচে থাকলে আরেকবার চেষ্টা করতে পারবেন তাঁরা। একটাই সমস্যা, সেই মহাজাগতিক বিস্ফোরণের সময় থেকেই পৃথিবীর সঙ্গে যে রেডিও সংযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা এখনো পুনঃস্থাপিত হয়নি। সিগনাল যাচ্ছে, কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। পৃথিবীর অবস্থা জানার কোনো উপায় আর নেই।
প্রায় একমাস পরে সবজান্তা জানাল ল্যান্ডিংয়ের সময় আসন্ন। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো ল্যান্ডিং সাইট নজরে আসছে না। রাতের বেলাতেও পৃথিবী ঘন আঁধারে ঢেকে থাকে, শহরের ঝলমলে রূপও চোখে পড়ে না, আর টেলিস্কোপিক ক্যামেরা কোনো শহর তো দূরের কথা, কোনো ম্যানমেড স্ট্রাকচারেরও ছবি তুলতে পারছে না। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ, মাঝে মাঝে নীল জল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চারপাশে যে ধুলো আর ধোঁয়ার আবরণ ছিল, সেটাও যেন কোন জাদু মন্ত্রবলে সরে গেছে। এটা যে সত্যিই পৃথিবী, তা চাঁদ না থাকলে বিশ্বাস করা শক্ত হত।
সবজান্তা জানায়, এমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করতে হবে। ল্যান্ডিং সাইট না থাকায় পুষ্পকরথকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। যাত্রীদের প্রাণ রক্ষা করার জন্য সাবস্টিটিউট প্যারাস্যুট ক্যাপসুলের মধ্যে সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় সারভাইভাল কিট নিয়ে স্থানান্তরিত হওয়ার নির্দেশ দেয় সে। অবতরণের শেষমুহূর্তে মূল যান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্যাপসুলটি প্যারাস্যুটের সাহায্যে ল্যান্ডিং করার চেষ্টা করবে। বাকিটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
উপসংহার
খ্রিস্টপূর্ব পঁচিশ হাজার বছর, মকর সংক্রান্তির দিন।
গোগ্গুল ঘুমাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু একটা কান তার সবসময় খোলাই থাকে। রাতের বেলা গুহার মুখে গাছের গুঁড়ি রেখে আগুন জ্বেলে শুতে হয় পাছে শিকারি জন্তু বা অন্য কিছু ভিতরে ঢুকে পড়ে। এখন বাইরের আলো প্রায় ফুটি ফুটি করছে। আকাশ থেকে জল পড়ার একটানা আওয়াজ শুধু শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎই তাতে ছন্দপতন ঘটল। শোঁ শোঁ করে তীব্র একটা আওয়াজ কেটে কেটে আসতে লাগল তার কানে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির সময় আকাশ থেকে আগুনলাঠি নেমে আসে। বনে আগুন লেগে যায়। কিন্তু এই আওয়াজটা তো সেরকম নয়। সে সর্দার, তাকে তো ব্যাপারটা দেখতেই হবে, না-হলে কালই হয়তো কোনো অল্পবয়সী ছোকরা তাকে মেরে হঠিয়ে দেবে। পাশে শুয়ে থাকা নারীশরীরগুলোকে একবার অবহেলাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখে সে। ওরা ঘুমিয়েই আছে। বিপদের মুখে যাওয়া ওদের কাজ নয়।
লগুড়খানা হাতে নিয়ে পশুচর্মে নিজেকে আবৃত করে গুহামুখের বাধা সরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় গোগ্গুল।
যেদিকে আগুনের গোলাটা প্রথম দেখা যায় প্রতিদিন আলো ফোটার সময়ে, সেদিকেই আকাশ থেকে দ্রুত নেমে আসছে আরেকটা আগুনের গোলা। বনের মাথায় যখন এসে পৌঁছেছে আগুনের গোলাটা, তখন ওটা থেকে বেরিয়ে এল আরেকটা গোলা। সেটা পাখির মতো ভাসতে ভাসতে বনের দিকে নেমে আসতে থাকল। আর আগুনের গোলাটা বিকট আওয়াজ করে তিন রাত দূরে এ-পার ও-পার দেখা যায় না যে বিশাল নোনা জল আছে, সেদিকে চলে গেল। একটু পরেই কানফাটানো গগনবিদারী আওয়াজ শুনতে পেল গোগ্গুল।
আকাশ থেকে কি দেবতারা নেমে এলেন নাকি? ততক্ষণে আশেপাশের আড়ালগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে জোয়ান ছেলেছোকরারা। যেদিক থেকে আগুনের গোলাটা নেমে এসেছে সেদিকে তাকিয়ে ভয়ে ভক্তিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দু-চারজন। গোগ্গুল খেয়াল করে তাদের মধ্যে ওঝা সাম্পানও রয়েছে।
সারাদিন শিকারে না গিয়ে বনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে গোগ্গুলরা। তারপরে সূর্য যখন ডুবুডুবু, ঠিক সেই সময়ে বনের প্রান্তসীমা থেকে বেরিয়ে আসেন তেত্রিশজন অদ্ভুত পোশাক পরা মানুষ।
ওঝা সাম্পান সমেত গোগ্গুলদের পুরো গোষ্ঠী আভূমি নত হয়ে প্রণাম করে এই দেবতাদের। আকাশ থেকে আগুনগোলা চড়ে নেমে এসেছেন এঁরা। দেবতারা তো আকাশেই থাকেন, তাই না?
অলঙ্করণ- স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
বাঃ। চমৎকার। বুনোনে যত্ন ও নিপুণতার ছাপ। ভালো লাগল বেশ।
LikeLike
Osadharon..onno ekta jogote niye gelo
LikeLike