গল্প -ডাইনির প্রতিশোধ-ঋতা বসু শরৎ ২০২১

ঋতা বসুর আরো গল্পঃ শিকার ও শিকারীমিষ্টিবুড়ির কাণ্ড, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি, মৌটুসীর বাসা, বিজু যা দেখে, আলো ছায়ার খেলা , সুশোভন বাগচির এক্সপেরিমেন্ট

golpodainirprotishodh

মেদিনীপুরে বদলির অর্ডারটা পেয়ে অপূর্ব বেশ খুশি মনেই কলকাতার পাট চুকিয়ে ফেলল। তার কলকাতা কোনোদিনই ভালো লাগে না। বড্ড ভিড়, গোলমাল। অবসর মেলা মুশকিল। পাড়াপড়শি, ফেরিওলা, ক্যুরিয়ার—উৎপাত লেগেই আছে। ছুটির দিনেও রেহাই নেই। তার আবার একটু সাহিত্যচর্চার বাতিক আছে। নিরিবিলি গ্রাম্য পরিবেশে নিরুপদ্রবে সেটি করা যাবে ভেবেই অপূর্ব যাবার জন্য ব্যাস্ত হয়ে উঠল।

মেদিনীপুর-উড়িষ্যার বর্ডারে কৈবল্যপুর টাউনে অপূর্বর অফিস। জায়গাটা খারাপ নয়। কিন্তু অপূর্বর ভালো লাগে মস্ত মাঠ আর জলা পেরিয়ে বালিপাড়া গ্রামটা। হাতে সময় পেলেই সে বইপত্র নিয়ে চলে আসে এখানে। নিরিবিলি কোনও গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দেয়।

অপূর্বর সহকর্মী অবনীমোহন এখানকারই লোক। অবনীমোহনের কথাবার্তা এত অশিক্ষিত যে তাকে সে একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না। ছেলের পরীক্ষার আগে যাগযজ্ঞ, স্ত্রীর অসুখে ডক্তার না দেখিয়ে ওঝা-তাবিজ-কবচ অবনীমোহনের কাছে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ক্রমশ অপূর্ব লক্ষ করছে, এখানে কমবেশি অনেকেই ওই একই পথের পথিক। একদিন অফিসের পর অপূর্ব বালিপাড়ার রাস্তা ধরতেই অবনীমোহন এসে সেঁটে গেল। “আপনাকে প্রায়ই দেখি বালিপাড়ার দিকে যাচ্ছেন। কেন বলুন তো?”

অপূর্ব মনে মনে বিরক্ত হলেও ভদ্রতা বজায় রেখে উত্তর দিল, “এমনি। ভালো লাগে।”

“হাতে তো বইপত্তর দেখছি। ওখানে বসে কি পড়াশোনা করেন নাকি?”

অপূর্ব লোকটাকে তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলার জন্য একটা ছোট্ট হুঁ বলে পা চালাতে গিয়ে অবনীমোহনের কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অবনীমোহন বলছে, “ঠিক আমি যা ভেবেছি তাই। চোখটা মনটা বইয়ের দিকে থাকে তো তাই চারপাশে কী ঘটছে দেখতে পান না।”

অপূর্ব সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ঘটছে চারপাশে?”

অবনীমোহন উৎসাহের চোটে একেবারে অপূর্বর পাশে এসে গলা খাদে নামিয়ে বলল, “বালিপাড়া গ্রামটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। ওখানে গোলমাল আছে। গভীর গোলমাল।”

“গোলমাল মানে? আপনি কী বলতে চাইছেন?”

“আমি কিছুই বলব না। নিজে একটু চোখকান খোলা রাখবেন।”

অপূর্ব এবার ভারি বিরক্ত হল। “কিছুই যদি না বলবেন তো কেটে পড়ুন।”

অবনীমোহন এবার গলা আরও খাদে নামিয়ে বলল, “কখন কোথা দিয়ে যে কার ওপর কুদৃষ্টি পড়ে কে জানে।”

অপূর্ব অধৈর্য হয়ে বলে, “কী শুরু করেছেন তখন থেকে? খুলে বলবেন কি বলবেন না?”

অবনীমোহন এবার ভারি অবাক হয়। “এখনও বুঝতে পারেননি!”

“না।”

“ওই গ্রামে ডাইনি আছে।”

“ডাইনি মানে, ভূত? মানে পেত্নী? আপনি কি পাগল হয়েছেন?”

অবনীমোহন গম্ভীর হয়ে বলে, “আপনারা শহুরে লোক, কোনও কিছু মানেন না। বালিপাড়া গ্রামে যা ঘটছে তা যদি শোনেন তো বুঝবেন।”

অপূর্ব অবনীমোহনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলল, “তা ডাইনির সঙ্গে মোকাবিলার উপায় তো আপনাদের জানা। ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করলেই হয়।”

অবনীমোহন অবশ্য ঠাট্টাটা বুঝতে পারল না। হতাশ স্বরে বলল, “সেই তো হয়েছে মুশকিল। এ তো আর অশরীরী নয় যে ওঝা ডাকলেই হবে। এ আমার আপনার মতো মানুষ।”

অপূর্বর কেন জানি না গা-টা একটু শিরশির করে উঠল। এমন কথা সে কখনও শোনেনি। এরা কারা? কেমন করে বোঝা যায় কে ডাইনি?

অবনীমোহন বোধ হয় তার মনের কথা আন্দাজ করেই বলল, “জানা যাবে দু-একদিনের মধ্যে। কানাইয়ের ভালো গরুটা যখন ছটফট করে মরে গেল তখন সেখানে পাঁচ-ছ’জন ছিল। আবার সনাতনের পুকুরের সব মাছ যখন মরল আগের দিন পুকুরপাড়ে, দু-তিনজন ছিল ওরই মধ্যে।”

কথা বলতে বলতে তারা যে বালিপাড়া গ্রামেরই কাছাকাছি চলে এসেছে হঠাৎ তা লক্ষ করে অবনীমোহন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

“আমি আর এগোব না। আপনি যান। এমনিতেই যা মুখে বলার নয় বলে ফেলেছি। কপালে কী আছে কে জানে।” এই বলে অবনীমোহন লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল।

এর তিনদিন বাদে আবার বালিপাড়ায় সময় কাটাতে এসে অপূর্বর মনে হল সত্যি সত্যি এই জায়গাটা যেন কীরকম। যেমন কাঁকড়াবিছে যে সে আগে দেখেনি এমন নয়। কিন্তু সেদিন যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল তা একেবারে অভিনব। পাথরের ফাটল থেকে একটা কাঁকড়াবিছে বেরিয়ে এল। মাথার সামনের দাঁড়া দুটো ঠিক যেন মানুষের হাত। সে-দুটো কাজে লাগিয়ে একটা একটা করে অন্তত সাতটা ছানা পিঠের ওপর চাপিয়ে হেলেদুলে নাচল খানিকক্ষণ। তারপর কানখাড়া করে কী যেন শুনল না দেখল কে জানে, একটা পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। অপূর্ব এত অবাক হয়ে গেল যে লেখার দু-একটা পাতা এদিক ওদিক উড়ে গেল, ধরবার কথা মনেই পড়ল না। পরে খুঁজতে গিয়ে অবশ্য একটা পাতাও পেল না।

এর দু-দিন পর ওই বালিপাড়া গ্রামেই অপূর্বর সামনে ধপ করে এসে পড়ল দুটো টিকটিকি। পড়েই তারা এমন গজ-কচ্ছপের লড়াই লাগিয়ে দিল যে ওস্তাদ কুস্তিগির লজ্জা পেয়ে যাবে। অপূর্ব বেশ মন দিয়ে লড়াইটা দেখছিল। তারপর দুটো টিকটিকিই হঠাৎ কেন যে লড়াই থামিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। তারপর এমন দৌড় লাগাল যেন কেউ তাড়া করেছে ওদের। অথচ কোথাও কিছু নেই। অপূর্ব চারদিক তাকিয়ে ভয় পাবার কোনও কারণই খুঁজে পেল না। নাহ্‌, ওই তো গাছের আড়াল থেকে একজন মেঝেন জাতীয় স্ত্রীলোককে দেখা যাচ্ছে। নীচু হয়ে পাতা কুড়োচ্ছে। লাল শাড়ি পরা। মুখটা ঘোমটার আড়ালে। শুধু নাকটা দেখা যাচ্ছে। নাকের ওপর মস্ত একটা আঁচিল। বোঝা গেল এর পায়ের আওয়াজেই টিকটিকিগুলো পালিয়েছে। মেঝেনটিকে আচমকা দেখার ফলে সে নিজে এত চমকে গেছিল যে বুকটা অনেকক্ষণ  ধকধক করছিল। অবনীমোহনের সারাক্ষণ ‘জায়গাটা ভালো না’ কথাটা না চাইলেও কীভাবে তাকে বোকা বানিয়েছে ভেবে নিজের ওপরেই রাগ হল।

এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধের সঙ্গে ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র সমানভাবে চলেছে। অপূর্ব আর মাথা ঘামায় না। বলুক যে যা খুশি। তাছাড়া সে দু-দিনের অতিথি। বদলির অর্ডার এলেই পাততাড়ি গোটাতে হবে।

বর্ষা এসে গিয়েছে। সকাল থেকেই মেঘলা ভাব। আজ ছুটি। অপূর্ব আকাশের দিকে তাকিয়ে যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতেও রওনা দিল বালিপাড়ার দিকে। একটা নিরিবিলি জায়গায় গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে সে হাতের বইটা খুলে পড়তে শুরু করে দিল। ঠান্ডা বাদলা হাওয়ার জন্যই বোধ হয় অপূর্বর পড়ায় মন বসছিল না। কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কেবল মনে হচ্ছে কে যেন আড়াল থেকে তাকে লক্ষ করছে। অথচ মুখ তুলে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। অপূর্বর নিজের ওপরেই রাগ হল। অবনীমোহনের কথাগুলো নিশ্চয়ই মাথার মধ্যে ঘুরছে। নয়তো তার এমন মনে হবে কেন?

জোর করে বইয়ের দিকে মন দেবার চেষ্টা করল অপূর্ব। বড়ো একটা জলের ফোঁটা টপ করে ঠিক বইয়ের মাঝখানে এসে পড়ল। আকাশের দিকে তাকিয়ে অগত্যা সে উঠেই পড়ল। পায়ে চটি গলিয়ে এক পা এগোতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। গাছের আড়াল থাকায় এতক্ষণ সে দেখতে পায়নি। সেদিনের সেই পাতাকুড়ানি মেয়েটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আজও লাল শাড়ি পরা। তবে মাথায় ঘোমটা নেই বলে জট পাকানো চুলগুলো দেখা যাচ্ছে। মরা সাপের মতো ঝুলছে মাথার এদিক ওদিক। অতিরিক্ত লম্বা নাকটার ওপরে লাল মস্ত আঁচিলটাকে মনে হচ্ছে রক্তের ফোঁটা। মেয়েটা তার দিকে এমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে কেন? কিছু বলবে নাকি? অপূর্ব পালাতে চাইছে অথচ পা যেন জমে পাথর হয়ে আছে। মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে অপূর্ব সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। অবনীমোহন বলেছিল কারা যেন চোখ দিয়ে সম্মোহন করে। মেয়েটা কি একটু একটু করে এগিয়ে আসছে নাকি তার দিকে?

এইভাবে কতক্ষণ কেটেছে অপূর্বর হিসেব নেই। হঠাৎ বাজের কড়কড় আওয়াজে সে যেন জ্ঞান ফিরে পেল। সেই সঙ্গে মোটা মোটা বৃষ্টির ফোঁটাও পড়তে শুরু করে দিল। অপূর্ব আর কোনোদিকে না তাকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল নিজের বাড়ির দিকে।

বৃষ্টিতে ভিজে ভয়ে ক্লান্তিতে সে যখন বাড়ির দরজায় পৌঁছল তখন আর তার হুঁশ নেই। কোনোরকমে ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে ওইভাবেই শুয়ে পড়ল।

পরের তিনদিন ধুম জ্বরে আচ্ছন্ন অজ্ঞান হয়ে কেটে গেল। অবনীমোহনকে সে যতই অপছন্দ করুক না কেন, ডাক্তার-বদ্যি-ওষুধপত্র সব সেই ব্যবস্থা করল। তিনদিন বাদে জ্ঞান ফিরল বটে, কিন্তু শরীর খুব দুর্বল। অবনীমোহন বলল, “খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছেন। যা একটা ফাঁড়া গেল আপনার।”

অপূর্ব একটু অবাকই হল। এরা কি সবকথাই এরকম পেঁচিয়ে বলে নাকি? ফাঁড়া আবার কী? ওইরকম বৃষ্টিতে ভিজে অতখানি পথ এসে শুয়ে পড়েছিল বলে জ্বর হয়েছে। সদ্য সদ্য ডাক্তার-বদ্যি এনে উপকার করেছে বলে অপূর্ব আর তর্কাতর্কির মধ্যে গেল না। তাতে অবিশ্যি অবনীমোহনের উৎসাহে ভাটা পড়ল না। সে বলেই চলল, “কতবার আপনাকে বারণ করেছিলাম বালিপাড়ায় যাবেন না, জায়গাটা ভালো নয়। এখন আমার কথা বিশ্বাস হল তো? ডাইনির পাল্লায় পড়ে আর একটু হলেই বেঘোরে প্রাণটা দিচ্ছিলেন।”

এবার অপূর্বর পক্ষে আর চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। সে দুর্বল গলায় যথেষ্ট জোর এনে প্রতিবাদ করে বলল, “ডাইনির পাল্লায় পড়ে মানে?”

অবনীমোহন তার বিখ্যাত সবজান্তা হাসিটা হেসে বলল, “আপনি কষ্ট পেলেন বটে, কিন্তু ডাইনিটা কে সেটা জানা গেছে।”

অপূর্বর এক মুহূর্তে মনে পড়ে গেল বৃষ্টি আসার আগে লাল শাড়ি পরা মাথায় জট খাড়া  নাকের মেয়েটিকে। কী সর্বনাশ! অবনীমোহন তাকেই ডাইনি ভাবছে নাকি? মেয়েটি একটু পাগলাটে বটে, কিন্তু ডাইনি হবে কেন?

অবনীমোহন বেশ জোরের সঙ্গেই বলল, “এবার বেশ কয়েকজন সাক্ষী আছে। আপনি যে ডাইনির নজরে পড়েছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।”

প্রতিবাদের চেষ্টা বৃথা বুঝে অপূর্ব পাশ ফিরে শুল। কিন্তু অবনীমোহন চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে যে-কথাটা বলল তা শুনে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল।

“আগামীকাল বালিপাড়ায় ডাইনি পোড়ানো হবে। আপনার শরীরের অবস্থা কাহিল, নয়তো রগড়টা দেখতে যেতে বলতাম।”

এ বলে কী? রগড়? একজন জলজ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হবে, সেটা হল তামাশা? সে উত্তেজিত হয়ে দুর্বল শরীরে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলল, “দেখুন, বৃষ্টিতে ভিজলে আমার বরাবর জ্বর হয়। সেটা কিছু নতুন ব্যাপার নয়। আমারই অন্যায় হয়েছে সেটা জানা সত্ত্বেও ভিজে ভিজে আসা। সেইজন্য আপনারা একজন নির্দোষ মানুষকে ডাইনি ঠাওরে পুড়িয়ে মারবেন, এ হতে দেওয়া যায় না। আমি পুলিশ ডাকব।”

অবনীমোহন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “আপনি আটকাতে পারবেন না।”

সারারাত অপূর্ব ছটফট করল। এরকম ঘটনা তো মধ্যযুগে ঘটত বলে শুনেছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যেখানে কলকাতা শহরে পৌঁছনো যায়, সেই জায়গাতে এরকম অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটতে পারে তা অপূর্বর জানা ছিল না। সে মনস্থ করল যত দুর্বলই লাগুক সে পুলিশের কাছে যাবেই। দরকার হলে আরও বড়ো জায়গায়। উত্তেজনায় অপূর্বর ঘুম আসতে অনেক দেরি হল। ফলে ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। টেবিলের ওপর খাবার ঢাকা দেওয়া। ওষুধ, জল সবই গুছোন আছে। অবনীমোহনের ব্যবস্থাপনায় কোনও ত্রুটি নেই। অপূর্ব কাজকর্ম সব সেরে ভাবল গতকাল অবনীমোহন নিশ্চয়ই প্রলাপ বকছিল তবু এদের ব্যাপার কিছুই বলা যায় না। থানায় একটা খবর দিয়ে রাখা ভালো।

বেরোতে গিয়ে দরজাটা টানাটানি করে দেখল খুলছে না। কী হল? বেকায়দায় আটকে গিয়েছে নাকি? একটু বাদেই অপূর্ব আবিষ্কার করল দরজাটা কেউ বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। তার মানে অবনীমোহন যে কাল তাকে শাসিয়ে গিয়েছে সে কিছুই আটকাতে পারবে না সেটাই সত্যি হল।

অপূর্ব ঘরের মধ্যে ছটফট করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। নিজেকে কোনোদিন এত অসহায় লাগেনি। জানালা দিয়ে দেখতে পেল লোকের ঢল যাচ্ছে বালিপাড়া গ্রামের দিকে। রাগে হতাশায় ছটফট করতে করতে অপূর্ব একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল অবনীমোহনের ডাকে, “এ কী, অবেলায় ঘুমিয়ে আছেন কেন? শরীর ঠিক আছে তো?”

অপূর্ব রাগ চেপে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে বন্ধ করে রেখে গেছিলেন কেন?”

অবনীমোহন এ-কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল। “আমি তো সক্কালবেলা অফিসের কাজে ঝাড়গ্রাম চলে গেছিলাম। ফিরে এসে দেখি এদের কাজকম্ম সব সারা। ডাইনি পোড়াবে জানতাম। তবে এত তাড়াতাড়ি সেটা বুঝতে পারিনি। ভাবলাম আপনাকে খবরটা দিয়ে যাই। খুব যে তড়পাচ্ছিলেন পুলিশ ডাকব, কিছু করতে পারলেন? আপনিও তো এত হইচই কিচ্ছুটি টের পেলেন না। দলে দলে লোক গিয়ে দেখে এসেছে। আপনি তো মরার মতো ঘুমোচ্ছিলেন মশাই।”

অবনীমোহন বিদায় নিলে পর অপূর্ব দুর্বল শরীর নিয়েও কীসের একটা টানে রওনা দিল বালিপাড়া গ্রামের দিকে। গ্রামটার একধারে মস্ত মাঠটায় যে ভয়ংকর কাণ্ডটা ঘটেছে তার সাক্ষী এদিক ওদিক পোড়া ছাই। অপূর্বর সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল অজানা আতঙ্কে।

বিকেল শেষ হয়ে আসছে। তবু মাঠে লোকজনের মেলা। এমন জমজমাট কাণ্ড তো রোজ ঘটে না। বালিপাড়ার লোকজনেরা দিব্যি বাজারহাট করছে। সকালের বীভৎস ঘটনা কারও মনে রেখাপাত করেছে বলে মনে হয় না। কুড়ি-পঁচিশটা লোককে ঘিরে গুলতানি করছে সবাই। যেভাবে হাত-পা নেড়ে হত্যালীলা বর্ণনা করছে, মনে হয় এরাই আজকের ঘটনার নায়ক।

অপূর্ব একটু দূরে দাঁড়িয়ে সমস্ত দৃশ্যটা দেখছিল আর এদের নিষ্ঠুরতার কথা ভাবছিল। হঠাৎ লক্ষ করল এক জায়গায় একটা জটলা। ক্রমশ সেটা বড়ো হতে লাগল। তারপর স্রোতের মতো হাটের লোকেরা সেদিকে দৌড়তে লাগল। অপূর্ব কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে উঁকি মেরে দেখল একটি মেয়ে দেশি মদ বিক্রি করছে। পান্ডাগুলো একেকজন গেলাসের পর গেলাস খেয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি নাকি বাজারদরের থেকে অনেক সস্তায় বিক্রি করছে।

ভিড় একটু পাতলা হতে অপূর্ব আর একটু কাছে এগিয়ে এসে মেয়েটিকে লক্ষ করে ভয়ে শিউরে উঠল। মেয়েটির মুখ ঘোমটায় ঢাকা থাকলেও কুপির আলোয় ঘোমটার কাপড়ে খাড়া নাকের ছবিটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। নাকের ডগায় মস্ত আঁচিলটার জন্য নাকটা আরও লম্বা লাগছে। নেশার ঝোঁকে সবাই এতটাই অন্ধ যে ব্যাপারটা কেউ খেয়ালই করছে না।

অপূর্বর হঠাৎ বেজায় শীত করতে লাগল। আবার বোধ হয় জ্বর আসছে। সেদিন সে যে কীভাবে নিজের বাড়িতে ফিরেছে নিজেই জানে না। সেই রাতেই তার ধুম জ্বর এল আবার। সেইজন্য পরদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বালিপাড়া গ্রামের বত্রিশ জনের বিষাক্ত মদ খেয়ে মৃত্যুর কথা সে জানতেই পারল না।

 

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s