গল্প-AIRBNB (এয়ারবিএনবি)-র গল্প-মলয় সরকার-বর্ষা ২০২১

মলয় সরকারের আগের গল্প টুসকি, কালে

golpoair bnb. head piece

বর্তমান পৃথিবীতে ভ্রমণপিপাসু মানুষের তো আর কমতি নেই। দিনকে-দিন বেড়েই চলেছে। আর তরুণ বয়স তো দুর্দম, অনুসন্ধিৎসু, আবেগপ্রবণ আর অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। তারা সবাই এক-একজন কলম্বাস কিংবা লিভিংস্টোন। এরা সব ছুটে বেড়ায় পাহাড়ের মাথা থেকে সিংহের গুহা পর্যন্ত। অবশ্য সেটা হওয়াই উচিত। তা না হলে আর তারুণ্য কীসের!

তা এই তারুণ্যের উন্মাদনাকেই মূলধন করে তিনজন আমেরিকান তরুণ বানিয়ে ফেললেন নতুন এক ব্যবস্থা। নাম দিলেন এয়ারবিএনবি (AIRBNB)। এটি শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুতভাবে এবং মাত্র কিছুদিন আগেই।

২০০৭ সালের অক্টোবর মাস। মাত্র কিছুদিন আগেই ক্যালিফোর্নিয়ায় এসেছেন এক তরুণ, ব্রায়ান চেসকি (Brian Chesky) ও এক তরুণী জো গেবিয়া (Joe Gebbia)। তখন, শুধু তখন কেন, এখনো আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে বাড়িভাড়া অত্যধিক। আর হবে নাই-বা কেন? আমেরিকার বিখ্যাত সেই ‘গোল্ড রাশ’ তো এখানেই হয়েছিল। ফলে ঝাঁকে ঝাঁকে সুযোগসন্ধানী মানুষ সারা পৃথিবী থেকে তো দৌড়ে এসেছিল এখানেই, সোনা খুঁজে পাওয়ার নেশার হিড়িকে। ফলে ভিড় বেড়েছিল এখানে। আর হঠাৎ হাতে টাকা পেয়ে বড়োলোকও হয়েছিল অনেকে। ব্যাবসা-বাণিজ্য, পড়াশোনা সবকিছুরই এখানে অনেক সুযোগ। কাজেই এমন জায়গার থাকার দাম যে বাড়বে, এ আর নতুন কথা কী!

কাজেই সেই দুজন তরুণ-তরুণীর মাথায় খেলে গেল এক নতুন বুদ্ধি। এখানে আসা মানুষের তো আর কমতি নেই। ব্যাবসা-বাণিজ্য, পড়াশোনা, বেড়ানো সবকিছুই তো এখানেই বেশি সুবিধা। পাশেই প্রশান্ত মহাসাগর। কাজেই বাইরে থেকে আগত মানুষের ভিড় বেশি হবেই। তার ফলে থাকার হোটেলগুলোর ভাড়াও অস্বাভাবিক বেশি। সেটাকেই মূলধন করে আর একটু কারিগরি বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ওরা বানিয়ে ফেলল থাকা-খাওয়ার এক নতুন ব্যবস্থা। ওরা প্রথমে নিজেদের থাকার জায়গা থেকে একটু জায়গা ছেড়ে দিয়ে একটা বিছানা (air mattress) আর যে লোকগুলো আসবে তাদের খাওয়াদাওয়া (bread and breakfast) এই দুটো জিনিসের ব্যবস্থা করে ফেলল নিজেরাই। যেহেতু সেটাতে বেশি খরচ পড়েনি, ফলে আগত অতিথিদেরও ওরা অনেক কম দামে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারল। আর যারা আসছে, তারাও বাহুল্যতা বিলাস আরামের চেয়ে আগে নিরাপদ নির্ভরযোগ্য মাথা গোঁজার আর খাওয়ার একটা মোটামুটি সংস্থান এত কম টাকায় পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন ওরা যোগাযোগ করল চেসকির পুরোনো বন্ধু নাথান (Nathan Blecharczyk)-র সঙ্গে। সেও তো খুব খুশি শুনে। সে এসে এর কারিগরির দিকটা ধরল। সেটা ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ব্যস, আর ফিরে তাকাতে হয়নি পিছনে। ওরা বিজ্ঞাপন দিল, ‘যারা যারা এইভাবে ঘরভাড়া দিয়ে বাড়তি কিছু আয় করতে চাও, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করো।’ সারা পৃথিবী থেকে সমস্ত মানুষ এগিয়ে এল তাদের নিজেদের বাড়িকে অতিথিদের ভাড়া দিতে। কারোর বাড়িতে হয়তো কিছু বাড়তি ঘর আছে, বা অতিথিদের দেখাশোনা করার মতো একটু ব্যবস্থা। ব্যস, তার কাছে আয়ের একটা রাস্তা খুলে গেল। জায়গাটা হয়তো বড়ো রাস্তার উপর নয়, একটু গ্রামের দিকে, কি শহরের যে-কোনো জায়গায়, যেখানে হোটেল থাকা সম্ভব নয়, সেই নিজের ঘর ভাড়া দিয়ে দুটো লাভের মুখ দেখতে চাইল। এর জন্য বিশেষ কিছু আলাদা করে করার দরকার নেই। চেসকি এই যে ব্যবস্থা করল প্রথমে তার নাম দিয়েছিল, AirBedandBreakfast.com। পরে সেটাকেই ছোটো করা নাম রাখা হল airbnb। সেই তিন তরুণ-তরুণীও দেখল, বাহ্‌, বেশ মজা। নিজের কোনো হোটেল বাড়ি জায়গার দরকার নেই, বা সেগুলো তদারকির লোকজন রাখারও দরকার নেই। শুধু যারা এটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের ঘরবাড়ি ভাড়া দিয়ে আয় করতে চায় তাদের ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আর ওরা বসে বসে সেই অনুযায়ী দালালির পয়সা ভোগ করবে। এতে সবারই লাভ। ওদের লাভ, যে ঘর ভাড়া নিচ্ছে তার লাভ, আবার যে ভাড়া দিচ্ছে তারও লাভ। অবশ্য এর ভিতরে অনেক কিছু ব্যাপার আছে। আমি আর সে-সবে যাচ্ছি না। মোটামুটি যাঁরা ভ্রমণপিপাসু বা নানা কাজে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করে থাকেন, তাঁদের পক্ষে এ এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল।

সংক্ষেপে এই হল এয়ারবিএনবির গল্প। কিন্তু এটা আমার আসল কথা নয়। আসল কথা হল অন্য। কিন্তু সেটা বলতে গেলে এই এয়ারবিএনবির সম্বন্ধে যতটুকু না বললে নয়, ততটুকুই জানালাম।

আমি আবার একটু ঘোরা পাগল মানুষ। সময় সুযোগ পেলেই আর টাকাপয়সায় কুলোলেই বেরিয়ে পড়ি এখান ওখান। তবে এই কাজে আমি বিভিন্ন ট্যুর গ্রুপ বা ভ্রমণ দলের সঙ্গে কমই গেছি। সেই যখন এত অনলাইন হোটেল বুকিং, ট্রেন বুকিং, গাড়ি বুকিং ছিল না, সেই যুগেও আমি ‘রম্যানী বীক্ষ্য’র নায়কের মতো কী করে সস্তায় ঘোরা যায়, তা খুঁজে বের করতাম। আর এ-যুগে বিজ্ঞানের সুযোগ নিয়ে, সেই নিজে নিজে সস্তায় ঘোরার অভ্যাসটাই চালিয়ে যাচ্ছি। আমি দেখেছি, আমি একা নই, এরকম বহু মানুষই করেন।

যাক গে, আসলে আমি যা বলতে বসেছি, ঝেড়েই কাশি। আমার দু-একটা এরকম ঘুরতে গিয়ে এয়ারবিএনবিতে বাসের অভিজ্ঞতা। এভাবে আমি চিন থেকে শুরু করে ইটালি, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি অনেক দেশেই ঘুরেছি। এতে বেশ অনেক মানুষের সঙ্গে মেশা হয়, একটা ঘরোয়া পরিবেশ পাওয়া যায়, আবার যে-দেশে যাচ্ছি তার সংস্কৃতির সঙ্গেও একচিলতে সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়। আবার ঘরোয়া পরিবেশে নিজের মতো থাকা-খাওয়ার সুযোগের সঙ্গে খরচও অনেক কম। ফলে একই টাকায় বেশি দিন থাকা বা বেশি জায়গায় ঘোরা যায়। তবে এর আবার ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে, সেটা জানাও আরেক লাভ।

সেবার গেছি, চিনের বেজিংয়ে। সেখানে এয়ারপোর্ট থেকে নেমে গাড়ি নিয়ে ঘুরছি, ওখানকার যে এয়ারবিএনবিতে বুক করেছি তার খোঁজে। ওখানে তো আমার ফোন চলবে না, কারণ ওখানকার সিম তখনো আমার নেই। তাছাড়া ওরা একবিন্দুও ইংরাজি বোঝে না। অগত্যা ইশারায় গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম আমার ফোনে যে ঠিকানা আর ফোন নম্বর আছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়ে যেতে। সে প্রথমে আমার দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে ঠিক খুঁজে পেল না। তখন আবার ফোন করল আমার দেওয়া নম্বরে। এবার উত্তর এল। সে যেখানে যেতে বলল, সেখানে গিয়ে (ও ঠিক বুঝতে পারল নাকি জানি না) ও ঘুরপাক খেতে লাগল। কিছুই আর খুঁজে পায় না। আর আমার অবস্থা তো ‘ত্রাহি মাম’। না জানি রাস্তা, না জানি ভাষা। ভরসা একমাত্র ওই ড্রাইভার। তারও আমাকে দেখে বোধ হয় দয়া হয়েছিল। না পারে আমার মতো অসহায় এক বিদেশি টুরিস্টকে রাস্তায় ছেড়ে দিতে, আর না পারে খরচায় পোষাতে (ওরা তো গন্তব্য ঠিকানা দেখে আগেই ভাড়া নিয়ে নিয়েছে। এখন বাড়তি ঘোরা মানেই আমার চুক্তির বাইরে বাড়তি খরচা)। কিন্তু ও এক রাস্তায় ঘোরে, খুঁজে পায় না। আবার ফোন করে। আবার অন্য রাস্তায় যায়। শেষে বোধ হয় বুঝতে পারল, একজায়গায় বড়ো রাস্তার ধারে দেখি, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে, আমাদের গাড়ির নম্বর দেখে সম্ভবত হাত নাড়াচ্ছে। ড্রাইভার গাড়ি থামাল। ওমা, এখানে কেন? কোনো বাড়ির দরজায় না থামিয়ে রাস্তার ধারে! যাই হোক, গাড়ি থামতেই ছেলেটি মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ম্যালে সারকার?”

নিজের নামটাকে চিনা উচ্চারণেও চিনতে পারলাম। ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। ড্রাইভারও একমুখ হেসে বোঝাল যে, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। পরের বোঝা ঘাড় থেকে নামিয়ে যার জিনিস তার ঘাড়ে দিতে পারায় একটা অদ্ভুত তৃপ্তি পেয়েছে। আমরাও যেন সঠিক ঘাড়ে (বা ঘরে) পৌঁছতে পেরে হালে পানি পেলাম।

তারা তো দু-ভাইবোনে (দেখে তো তাই মনে হল) আমাদের সব মালপত্র নিজেরাই নিয়ে বড়ো রাস্তা পেরিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে উলটোদিকে এক অ্যাপার্টমেন্টে তুলল। আমি গিয়ে দেখি, বেশ ছোটো জায়গা, একটাই কিচেন, একটাই ওয়াশ রুম। তার আবার আমাকে নিয়ে তিন ঘর ভাড়াটে। একটাতে একটি অল্পবয়সী চিনা মেয়ে থাকে। সে কলেজে পড়ে, দূরের গ্রাম থেকে এসেছে। বেশ হাসিমুখো। আরেকটিতে এক মা ও মেয়ে থাকে। দুজনেই কিছু বাইরে কাজ-টাজ করে। আর আমার ঘরটিও বেশ ছোটো। আমার ছেলেটির উপর রাগ হল। তাকে বললাম, “তুমি নেটে যে ঘর দেখিয়েছ, তা তো দাওনি। এই ঘর তো আমার বুকিং ছিল না। শেয়ারিং কিচেন, ওয়াশ রুম তো আমার কন্ট্রাক্টে ছিল না।”

ছেলেটি তখন বিনয়ের অবতার, বলে, “না, ছিল না ঠিকই। কিন্তু হঠাৎ আমার ওই বাড়িতে জলের পাইপে কী গণ্ডগোল হয়ে পড়েছে, তাই বাধ্য হয়ে এখানে আনলাম। একটু কষ্ট করে নিন। এখানে সবাই ভালো। খুব কো-অপারেটিভ। ঠিক হয়ে গেলেই ওখানে পাঠিয়ে দেব।”

তারপর তো তার ‘জো হুজুর’ অবস্থা। বিনয়ের অবতার একেবারে! আমাকে নিজেই গাড়িতে করে পরিচিত দোকানে নিয়ে গিয়ে লোকাল সিমের জোগাড় করে দেওয়া থেকে শুরু করে ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে হাত-পা নেড়ে নানা কথা বোঝাতে লাগল। আমাদের জল, খাবার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি সবই করে দিতে লাগল।

পরে পাশের ঘরের ছাত্রীটির সঙ্গে আলাপ হল। বেশ মেয়েটি। ও ইংরাজি মোটামুটি বলতে পারে।  এই প্রজন্ম কিছু ইংরাজি জানে। সে বলল, “আমি দু-বছর আছি। কিন্তু আমার পড়া শেষ। দু-একদিনের মধ্যেই ফিরে যাব গ্রামে।”

ওর মন টানছে ক্যান্টনের কোন গ্রামে অপেক্ষা করে থাকা ওর মায়ের কাছে যাবার জন্য। ওকে যেই বললাম ছেলেটি ওর অন্য বাড়িতে জলের কী অসুবিধার জন্য আমাকে এখানে এনেছে, মেয়েটি বলল, “তাই বলেছে নাকি? এই নিয়ে আপনি তৃতীয়জন যাকে ও এই কথা বলল। এর আগে যে দুজন টুরিস্ট এসেছিল তাকেও এই কথা বলেছে। এ তো আমি শুনছি গত তিনমাস ধরে।”

আমার শুনে রাগ হয়ে গেল। বললাম, “ওর সঙ্গে ঝগড়া করতে হবে তো!”

গিন্নি বললেন, “ছাড়ো, বিদেশ-বিভূঁই জায়গা, ভাষাও বুঝি না। আছি তো চার-পাঁচদিনের জন্য, আর তা ছাড়া সারাদিন তো কাটবে বাইরে বাইরেই। ঘরে এসে শোয়াটুকু তো। কোনোরকমে চালিয়ে নেব। ঝগড়া করে আর লাভ নেই।”

এরা এইরকমই। কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করার সময় ভালো ঘর, পরিবেশ ইত্যাদি দেখিয়ে ছাড়পত্র নিয়ে চুক্তি করে। কিন্তু দেওয়ার সময় হয়তো ঠিকঠাক দেয় না। এতে কোম্পানির বদনাম হয়। অবশ্য কেউ ওদের নামে কমপ্লেন করলে তাকে ওরা ডিলিস্টিং করে দেবে।

***

আরেকবার একটা ঘটনা ঘটেছিল এই চিনেই। গিয়েছি সুজৌতে। আমি তো এয়ারপোর্ট থেকে প্রিপেড ট্যাক্সি নিয়ে ঠিকানা বলে দিতেই ও এসে সন্ধ্যা ৭.৩০টা নাগাদ এক রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি তো ঘাবড়ে গেলাম। এ কী রে বাবা! সন্ধ্যা হয়ে গেছে, রাস্তায় আধো আলো আধো অন্ধকার। বেশ একটা রহস্য রহস্য ভূতুড়ে ভাব। এখন কাকেই-বা জিজ্ঞাসা করব, কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পারছি না। সামনে কতকগুলো ছেলে আড্ডা মারছিল। তাদের ঠিকানাটা দেখালাম। সে ঠিকানাটাও তো এনেছি চিনা ভাষাতেই লেখা, যাতে ওখানে কারোর পড়ে বুঝতে অসুবিধা না হয়। আসলে আসার আগে এটাই জেনে এসেছিলাম যে, ঠিকানা লেখা ইংরাজিতে হলে আদৌ কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই চিনা ভাষাতেই ওই ঠিকানা লেখা ছিল।

ওরা তো দেখে, ভুরু কুঁচকে (ওহো, আদৌ ওদের তো ভুরুই নেই) এ ওকে জিজ্ঞাসা করে, সে আবার তাকে। শেষে হাত তুলে দিল। তখন বাধ্য হয়ে অগত্যা ফোন করলাম। যে ধরল, সে একটি মেয়ে, সে আবার ইংরাজি বোঝে না। ফোন দিল আরেকটি মেয়ের হাতে। তখন বলল, ‘আপনি যেখানে আছেন থাকুন, আমরা আসছি।’ একটু পরে দেখি দু-বোন নাচতে নাচতে (প্রায়) আসছে। দেখে আমার ঠিক ঠাকুমার ব্রতকথার গল্পের কথা মনে পড়ল, সেখানে যেমন ভক্ত বিপদে পড়ে দেব দেবীদের ডাকতেই তাঁরা এসে সটান ভক্তের কাছে হাজির হতেন,  তেমনই আর কি। দুজনে এসে আগেই এক মুখ হেসে আমাদের হাত থেকে সব সুটকেস ছিনিয়ে নিজেরাই নিয়ে নিল। শেষে ওদের পিছু পিছু যেতে বলল। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। পথ (থুড়ি গলি) আর শেষ হয় না। এদিকে ঘুরে ওদিকে বেঁকে, এর বাড়ির চাতাল দিয়ে, ওর খিড়কি দরজা ছুঁয়ে চলেছি। শেষে জিজ্ঞাসা করলাম, “আর কতদূর মা?”

পিছন ফিরে একগাল হেসে মেয়েটি বলল, “এই তো এসে গেছি।”

আবার একটু পরে জিজ্ঞাসা করলাম, “আর কতদূর?”

আবার বলে, “এই তো এসে গেছি।”

আমার তখন মনে হচ্ছে, মরুতীর্থ হিংলাজের সেই বিখ্যাত গান ‘পথের ক্লান্তি ভুলে… কতদূর আর কতদূর…’।

শেষে এসে ঢুকলাম বাড়িতে। বুঝলাম, এই জন্যই ট্যাক্সিকে দেওয়ার ঠিকানাটা বাড়ির নয়, রাস্তার। এই ঠিকানা ট্যাক্সিওয়ালার বাবাও খুঁজে পাবে না। পেলেও গাড়ি নিয়ে ঢুকতে পারবে না। এখানে ঢুকে একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বাড়িতে গেস্টদের থাকার ব্যবস্থা সবকিছু ওদের পরিবারের সঙ্গে। আমাদের থাকার ছোটো ঘরটাও ওদের ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায়। এইরকম ছিলাম চিনের পিয়ংইয়াং-এও। ওয়াশ রুম, ডাইনিং টেবল ইত্যাদি সব ওদের পরিবারের সঙ্গেই একসঙ্গে। এ আবার কী! গেস্টদের প্রাইভেসি বলে কিছু নেই? ওয়াশ রুমে ওদের ব্যবহৃত সব জিনিসই রয়েছে একসঙ্গে। শুধু তাই নয়, ওদের পরিবারের কেউ সেটা ব্যবহার করা কালীন আমাদের প্রয়োজনেও যেতে পারব না। ঘরটাতে শোয়ার ব্যবস্থা বাঙ্ক সিস্টেমে। বাড়িতে বাঙ্কে শোয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। তাও হল। মনটা খুব বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। কী রে বাবা, চিনে কি সবাই এরকম নাকি? তবে, একেবারে প্রথম থেকেই মেয়ে দুটি ও তাদের মা একেবারে নিজেদের পরিবারের মতো এমন ঘনিষ্ঠভাবে ব্যবহার করতে লাগল যে কিছু বলতে পারলাম না। প্রথমেই ওদের মা বললেন, “এই বিদেশে আমাদের বাড়িতে আপনি একেবারে নিশ্চিন্তে এবং নির্দ্বিধায় এটাকে নিজের বাড়ির মতো ব্যবহার করতে পারেন। আপনারা যখন আমাদের বাড়িতে আছেন, আপনারাও আমাদের পরিবারের লোক। সুবিধা অসুবিধা যা হবে সব বলবেন, আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব।”

আর মেয়ে দুটিও একেবারে নিজের দাদা-বৌদির মতো ব্যবহার করতে লাগল আমাদের সঙ্গে। আমরা আর কোনো কমপ্লেন করতে ভুলে গেলাম।

একটা কথা বলা হয়নি, চিনাদের পারিবারিক ব্যবস্থা কিন্তু একেবারে আমাদের এখানকার ঘরের পরিবারের মতো। পাশ্চাত্য ঢংয়ে নয়।

পরে জানলাম, মেয়ে দুটির বাবা নেই। এই ভাড়া থেকেই যা কিছু আয়। এটা বন্ধ হয়ে গেলে ওরা খেতেই পাবে না। ছোটো মেয়েটি কলেজে পড়ে, সে-ই একটু চটপটে, ইংরাজি জানে কিছু। সে-ই যোগাযোগ করে এই ব্যবস্থা করেছে। দিদিটা লেখাপড়া তেমন জানে না। বিয়ে হয়েছিল, ডিভোর্স হয়ে বাড়িতেই আছে। খুবই করুণ অবস্থা। এই ব্যবস্থার জোরেই বেঁচে আছে। আমাদের ওরা একেবারে বাড়ির ডাইনিং টেবলে একসঙ্গে বসিয়ে যত্ন করে ওদের নিজস্ব ঘরে তৈরি চিনা খাবার খাওয়াল। বোঝাল কী করে তৈরি করেছে। খেতে বসে নানান গল্প হল একেবারে আমাদের খাওয়ার টেবলে আড্ডার মতো। আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, যেন ভারতেরই কোনো পরিবারের মধ্যে আছি। আমার মা যেভাবে আদর করে কাছে বসে খাওয়াতেন, মেয়ে দুটির মাও ঠিক তেমন করেই করতে লাগলেন, একটিও ভাষা বুঝতে না পেরেও। আদরের যে কোনো ভাষা হয় না সেটা নতুন করে শিখলাম। আমার মৃত মায়ের কথা মনে পড়ল। ভুলে গেলাম এরা বিদেশি, ভুলে গেলাম এদের দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের শত্রুতা, যা এখনো চলছে। আন্তরিকতায়, ব্যবহারে এদের সঙ্গে আমাদের দেশের এক সাধারণ পরিবারের কোনো তফাত রেখা যেন আর রইল না। বরং মনে হল, এত আন্তরিকতা আমাদের দেশেই পাওয়া দুষ্কর।

পরদিন আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে টংলি যাওয়ার বাসে তুলে দেওয়া, বাজার নিয়ে যাওয়া থেকে আরম্ভ করে কিছুই ত্রুটি রাখেনি মেয়ে দুটি। রাস্তায় কোথাও অসুবিধায় পড়লে ওদের ফোন করে জানাতে হবে সেটাও বলতে ভুলল না। আমাদের সমস্ত অভিযোগ ওদের আন্তরিকতার কাছে কোথায় ভেসে গেল। এক বিধবা মা আর তার দুই মেয়ে আমাদের দুই দেশের ব্যবধান ভুলিয়ে দিল।

***

সেবার যখন আমরা সুইজারল্যান্ডে লেক জেনেভার ধারে মন্ত্রু (Montreux)-তে গেলাম, ট্রেন থেকে নেমে অনেক কষ্টে বাসে করে ঠিক জায়গায় নেমে হেঁটে বাড়ির সামনে পৌঁছলাম, আমাদের চিনে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য কেউ বসে নেই। গেট ইলেক্ট্রনিক লকে বন্ধ। ফোন করলাম মালিককে। সে ফোনে বলল, ‘এই নম্বর গেটে ডায়াল করুন।’ গেট খুলল। এবার দেখি এটা একটা বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। তারপরে পরপর ওই নম্বর দেওয়া মনুষ্যবিহীন গেট। এরকম তো সিনেমায় দু-একটা দেখলেও বাস্তবে দেখিনি। তা, আবার দ্বিতীয় গেটে আটকালাম। আবার ফোন, আবার ইন্সট্রাকশন। তারপর দেখি বারান্দায় স্বয়ংক্রিয় আলো—এগোলে জ্বলে, পেরিয়ে গেলেই নেভে। পরের আলোটা জ্বলে। তখনো এর পরিচয় আগে পাইনি। এছাড়া চারদিকে কোনো মানুষজন কি সাড়াশব্দ নেই। শেষে যখন ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছলাম, ভাবছি ঢুকি কী করে! আবার ফোন। আবার ইন্সট্রাকশন। দরজার পাশেই একটা ছোটো বাক্স আছে, তার এত নম্বর চাবি দিয়ে ডানদিকে ঘোরাতে হবে। ঢোকা গেল। বুঝলাম, কেন ওসব ইন্সট্রাকশন একসঙ্গে দেয়নি। এত নিয়ম একসঙ্গে সব গুলিয়ে যাবে।

ও বাবা, এ যে বিশাল ঘর! বিশাল ব্যালকনি। আবার আওয়াজ এল, ‘ঘরে যা যা আছে, সব তোমাদের ইচ্ছামতো নিজের মতো করে ব্যবহার কোরো। আমি আজ বন্ধুর বাড়ি আছি, কাল যাব বিকেলে ফ্লাইটে প্যারিস। ফিরতে তিন-চারদিন লাগবে। যাওয়ার সময় চাবি লাগিয়ে যেমন ছিল রেখে যেও।’

একটু ঘুরে দেখি ঘরটা। নেই হেন জিনিস নেই। চিজ, জ্যাম থেকে রান্নার জিনিসপত্র, গ্যাস, ডিস ওয়াশার, ওয়াশিং মেশিন, আর এছাড়া যা যা লাগে একটা পরিবার থাকতে সব আছে। আমরা তো খুব খুশি এত দিনের ঘোরাঘুরির পর এরকম একটা ঘর স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পেরে।

বিকালে একটু জেনেভা লেকের ধারে ঘুরে, এখান সেখান দেখে, টুকটাক বাজার করে ফিরলাম যখন, কী বিপদ যে অপেক্ষা করছে তখন বিন্দুমাত্র বুঝিনি। খুব ক্লান্ত, খিদে পেয়েছে বেশ, তার সঙ্গে ওয়াশ রুম যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাটাও খুব অনুভব করছি। তলপেটে বেশ চাপ, বাড়ি গিয়ে ঢুকতে পারলে হয়। বাড়ি এসে তো আবার সেইসব নম্বরের কারসাজি। নির্বোধ যন্ত্রের উপর নির্ভর। যাই হোক, সব বাধা পেরিয়ে দরজায় পৌঁছে চাবি ঘোরালাম। খুলল না। এদিক ওদিক, নড়ানো-চড়ানো টানাহ্যাঁচড়া করা গেল।  নাহ্‌, তালা অনড়। মনে মনে বললাম, হাতে পায়ে ধরছি, বাবা খোল তাড়াতাড়ি। আর পারছি না। নাহ্‌, ভবি ভোলবার নয়। ঠং ঠং করে তালা উত্তর দিল, হুকুম নেই। আগের বার তো খুলেছিল, কী রাগ হল বাবুর এবার কে জানে! আমি কী করি? এখানে তো সব নিরেট নিশ্চিদ্র দেওয়াল। কেউ কাউকে সাহায্য করতে আসবে এমন সম্ভাবনা বিন্দুমাত্রও নেই। ক্লান্ত, হতাশ অবসন্ন হয়ে বসে পড়লাম মাটিতে। বাধ্য হয়ে আশা ছেড়ে ফোন করলাম মালিককে, যে এই অবস্থা। সৌভাগ্য এই যে, ফোন পেলাম। মালিক হঠাৎ ভগবানের মতো সাড়া দিল, আর একটু হলেই এয়ারপোর্টের জন্য বেরিয়ে যেতাম। যাই হোক, আসছি। বলতে কী, দশ মিনিটের মধ্যেই ও এসে হাজির হল। চাবিটা নিয়ে বলল, “সরি, তোমাদের বলা হয়নি, চাবিটা একটু উঁচু দিকে চাপ দিয়ে খুলতে হয়, একটু ডিফেক্টিভ হয়ে গেছে।”

বা-ব্বা, ধড়ে প্রাণ এল। আমার তখন শরীরের ভেতরে চাপ যে, নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বমুখী হতে চলেছে, সেটা আর ওকে বোঝাই কী করে। চাবিরও যে ঊর্ধ্বমুখী চাপ তা তো বুঝতে পারিনি! সারা শরীরে ঘাম হচ্ছে দরদর করে। যাই হোক, ও বলতে লাগল, “থ্যাঙ্ক গড, আর একটু দেরি হলে খুব মুশকিল হয়ে যেত। আমি চলে গেলে তোমরা তো ঢুকতেই পারতে না।”

ও বলতে লাগল অনেক কিছু। কিন্তু আমি তখন ওকে না ভগবানকে, কাকে ধন্যবাদ দেব বুঝতে না পেরে আগে দৌড়ালাম ওয়াশ রুমের দিকে।

***

আর একটা ঘটনা বলে এই প্রসঙ্গ থেকে অব্যাহতি নেব। যাচ্ছি ইটালির স্ট্রেসাতে। এই ছোট্ট জায়গাটির স্মৃতি আমার মনে এক অনবদ্য জায়গা নিয়ে বসে আছে। তার কারণ, জায়গাটির সৌন্দর্য তো বটেই, এছাড়া যে বাড়িটাতে ছিলাম তার অন্য আকর্ষণীয়তা।

স্ট্রেসাতে যখন ট্রেন থেকে নামলাম, তার আগে বাড়ির মালিককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কীসে করে কীভাবে যাব আপনার বাড়িতে যদি জানান। উনি জানিয়েছিলেন, আপনার কোনো চিন্তা নেই, আমি আপনাকে নিয়ে আসব। কিছু বলিনি। তবে চিন্তা ছিল, স্টেশনে কোনখানটায় নামব, এত লোকের মধ্যে কী করে একজন মানুষ আমাদের চিনে নেবে, জিজ্ঞাসা তো করা হয়নি। যাই হোক, দেখা যাবে। ট্রেন থেকে তো নামলাম। নামতেই দেখি, প্ল্যাটফর্মেই বেশ ফর্সা, প্রায় আমার বড়দাদার বয়সী গোলগাল চেহারার, মাথায় চুল কম, ভদ্রভাবে শার্ট-প্যান্ট পরা, চেহারায় বেশ বনেদিয়ানার ছাপ, এক বয়স্ক ভদ্রলোক দু-হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। আমাদের চিনতে যে তাঁর কোনো অসুবিধা আদৌ হয়নি ভাবভঙ্গিতেই বোঝা গেল। যেন নিজের আত্মীয় কাউকে নিতে এসেছেন। ভাবলাম, কালো চামড়া দেখেই নিশ্চয় চিনেছেন। আমাদের মতো কালো চামড়া তো আর কেউ ট্রেন থেকে নামেনি। যাই হোক, আমাদের হাত থেকে জোর করে সুটকেস কেড়ে নিয়ে উনি এগোলেন। আমাদের পিছনে পিছনে আসতে বললেন। বাইরে বেরিয়ে দেখি ঢাউস এক দামি ঝাঁ-চকচকে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পিছনে মালপত্র তুলে, আমাদের সঙ্গে নিয়ে নিজেই স্টিয়ারিং-এ বসলেন। বসেই বললেন, “আপনারা খুব ক্লান্ত নন তো?”

বললাম, “না।”

উনি বললেন, “তাহলে চলুন, বাড়ি তো কাছেই, একটু শহরটা ঘুরিয়ে দিই। তারপর বাড়ি যাব।”

আমি ভাবলাম, বাহ্‌, বেশ তো। মন্দ কী? আগেভাগে বিনা পয়সা এবং বিনা পরিশ্রমে শহরটা ঘোরা হয়ে গেলে ক্ষতি কী? ওঁর নামটা আমার আজও মনে আছে, জি প্যারাচিনি। এরকম মানুষ তো দেখিনি।

উনি দেখাতে দেখাতে নিয়ে চললেন, এটা প্রমেনাদ, এটা লেক ম্যাগিওর, এটা বাজার, স্কুল, হাসপাতাল। শহরের একটা মোটামুটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কথায় কথায় বললেন, উনি একজন নামি আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার। রিটায়ার করেছেন বেশ কিছুদিন। এই শহরের অনেক নামিদামি বিল্ডিংই ওঁর করা নকশায় তৈরি। সেরকম বেশ কিছু বড়ো বড়ো সিনেমা হল, মল, বিল্ডিং দেখালেন, দেখলাম। সেগুলির গঠন সত্যই ভালো। ওঁর কথা শুনে সেগুলো মিথ্যে বলে মনে হল না। ওঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। উভয়েই প্রতিষ্ঠিত, বিবাহিত। এখন বাড়িতে বয়স্ক কর্তা আর গিন্নি। বিশাল বাড়ি পড়ে আছে, তাই তাকে এই কাজে লাগাচ্ছেন। বেশ গল্পবাজ মিশুকে মানুষ। তবে নিজের কথা, শহরের কথা ছাড়া অন্য কিছু বা আমার ব্যাপারে কোনো কৌতূহল, তা কিন্তু নেই। এই বাড়িভাড়া দিয়ে আয়ের চেয়েও বেশি যা প্রয়োজনীয়, তা হল, বিভিন্ন দেশের নানা মানুষজন আসে, তাদের সঙ্গে আলাপ করা, তাদের দেশের কথা জানা, এগুলো ওঁর বৃদ্ধ বয়সের আনন্দ। টাকার প্রয়োজনের থেকেও এটাই ওঁর বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন। প্রায় ঘণ্টা খানেক ঘুরে পৌঁছলাম বাড়ি।

ও বাবা! বাড়ি কোথা, প্রাসাদ তো! আমরা তিনজন থাকব এত বড়ো প্রাসাদে। যেমন নকশা করা, ডিজাইন করা সাজানো প্রাসাদের ঢোকার দরজা বা তারপরের বারান্দা, তেমনি তার ঘরের ভিতরের আসবাব। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। দেওয়াল জুড়ে তেমনি দামি দামি ছবি। ঝাড় লণ্ঠন, টেবিল-চেয়ার-খাট-পালঙ্ক, সব যেন এক-একটি অ্যান্টিক। কালো মেহগিনির চকচকে পালিশের আসবাব। ছেলেবেলা থেকে যে ইটালিয়ান স্থাপত্য, ইটালিয়ান মার্বেলের কথা শুনেছি, এ বাড়িতে তার ছড়াছড়ি। তখন মনে হল, ভদ্রলোক বোধ হয় যা বলেছেন, তার একবিন্দু মিথ্যে নয়। যিনি এত বড়ো আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার, শহরের এত বড়ো বড়ো বাড়ি বানিয়েছেন, তাঁর নিজের বাড়ি তো সবার থেকে আলাদা হবেই।

আমরা যেতেই ওঁর স্ত্রী নেমে এলেন। উনি ভালো ইংরাজি জানেন না। কিন্তু ভদ্রলোক ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে কাজ চালাতে পারেন। স্ত্রীর পরিধানে একদম চাকচিক্য নেই, বরং একেবারেই সাধারণ। কিন্তু একটা শিক্ষিত বনেদিয়ানার ছাপ আছে। হাসি মুখে নিয়ে গিয়ে দুজনেই আমাদের ঘর দেখিয়ে দিলেন। পুরো একতলায় বারান্দা সমেত অত বড়ো ঘর পুরোটাই আমরা ভোগ করতে পারি। সঙ্গে অ্যাটাচড কিচেন, ডাইনিং, অত্যাধুনিক ওয়াশ রুম। তাতেও যদি কোনোরকম অসুবিধা হয়, জানাতে বললেন। তার জন্য যথাসাধ্য করবেন।

আমরা তো খুব খুশি। এরকম বাড়ি নিজেদের পক্ষে তো কখনোই করা স্বপ্নেও সম্ভব নয়। যাক গে, যা পাওয়া গেছে ভোগ করে নিই। খাট-বিছানা, ঘরের চেয়ার-টেবিল দেখে মনে হল বোধ হয় ‘এক দিন কা বাদশা’ বনে গেছি। দরজা বন্ধ করে একপাক নেচে নিলাম ঘরের মধ্যে। কিচেনে সবই আছে দেখলাম, কিন্তু ওয়াশিং মেশিন চালাতে গিয়ে দেখলাম চলে না। ভালো করে যন্ত্রটাকে দেখলাম, কী করে চলবে। এ-পাশ ঘোরাই, এ-চাবি টিপি ও-চাবি টিপি, চলে না। শেষে হাল ছেড়ে ভদ্রলোককে বললাম। উনি তো প্রথমে আমার কথা কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। শেষে বললেন, “দাঁড়ান, আমি জামাইকে ডেকে আনছি।”

সে ইয়ং ম্যান। ইংরাজি বোঝে, দেখে টেখে বলল, “এটা খারাপ হয়েছে। মিস্ত্রিকে খবর দিতে হবে।”

আমাদের তো অনেক কাপড় জামা জমেছে। বেশি তো আনিনি। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছি, কাচছি আবার পরছি। এগুলো না কাচলে পরব কী? অনেকই জমেছে। সব বললাম। বললেন, “দেখছি।”

রাতে শোয়ার আগে ভদ্রলোক এলেন ঘরে, সঙ্গে মেয়ে। এসে অনেক দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “এটা যে খারাপ হয়ে গেছে জানা ছিল না। আর আজ মিস্ত্রিও পাওয়া যায়নি।”

মেয়ে তখন বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না। সব জামাকাপড় একটা ব্যাগে ভরে দিন। আমার বাড়ি কাছেই। নিয়ে যাব, কাল কেচে দিয়ে যাব।”

মেয়েটিও বেশ সুন্দরী, কমবয়সী। কথা বলার ধরন বেশ ভদ্র মার্জিত। আমি কিন্তু কিন্তু করছি। এরকম ভদ্র মেয়েকে আমাদের ছাড়া কাপড় জামা কাচতে দেব, কেমন সঙ্কোচ লাগছিল। মেয়েটি বুঝতে পেরে বলল, “একদম ভাববেন না। আমি তো আপনাদের মেয়ের মতো। একটা অসুবিধা হয়েছে, কেন অন্যরকম মনে করছেন।”

আমরা এই কথা শুনে তো একেবারে অভিভূত। বলতে বলতে সে একটি ব্যাগ এনে আমাদের দিয়ে বলল, “এতে ভর্তি করে রাখুন। আমি বাড়ি যাব একটু পরে, নিয়ে যাব।”

ওর এই বাপের বাড়ির কাছেই নিজের বাড়ি। মা-বাবার কাছে মাঝে মাঝেই আসে। কী আর করি, অগত্যা, কিছুটা বাধ্য হয়েই মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব ব্যাগে ভরে দিলাম। অবশ্য আর কিছু করার ছিলও না, আমাদের তো না কাচলে আর চলছিলও না। গত তিন-চারদিন ধরে জমেছে।

বাড়ি যাওয়ার সময় মেয়েটি ব্যাগ নিয়ে গেল।

পরদিন সকাল সকাল সে চলে এসেছে। সবে চা খাচ্ছি। দরজায় টোকা দিয়ে গুড মর্নিং করে মেয়ে হাজির। ব্যাগ ফেরত দিয়ে বলল, “আমি কেচে সব আয়রন করে দিয়েছি।”

আমরা বাক্যহীন। ভাবছিলাম, আমি যে দেশ থকে এসেছি, সেখানে এরকম তো কোথাও দেখিনি। হয়তো আছে, জানি না। তবে দেশ কাল অর্থ শিক্ষা ভাষা যে, যে-কোনো মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়াতে কোনো বাধা হয় না সেটা পরিষ্কার বুঝলাম। আসল প্রয়োজন একটা সহানুভূতিশীল, সংবেদনশীল অন্তর। আমার আজকাল নানা দেশে ঘুরে একটা জিনিস হয়েছে (এটা আমার নিজের অনুভূতি) যে, সব দেশই ভেতর থেকে একই। কেবল ভৌগোলিক সীমারেখাই মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা করে রেখেছে। আমি নিজে বেদুইনের তাঁবু থেকে কাশ্মীরের কি কেরালার নৌকা, তুরস্কের পাথরের গুহা থেকে রাজস্থানের মরুভূমি, আমেরিকার জঙ্গল থেকে মেক্সিকোর বহু জায়গায় ঘুরে দেখেছি, মানুষের হাসি কান্না ভালোবাসা সমবেদনা আর সহমর্মিতার কোনো দেশ, জাত, ধর্ম হয় না। সব এক। কোনো দেশে বা জায়গায় প্রথম দুটো দিন কাটানোর পর আমি ভুলেই যাই কোনো অন্য দেশে আছি বা এ দেশ আমার দেশের থেকে কত দূর। এরকমই এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল সুদূর উত্তরমেরুর কাছে আলাস্কায়। থাক, সে গল্প পরে কোনো সময় করা যাবে। আজ আমার নিজেকে আক্ষরিক অর্থেই মনে হয়, আমি বিশ্বনাগরিক।

এরপর ওঁদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই হয়েছিল অনেক কথা। সঙ্গে ছিল পিডমন্ট প্রদেশের মাত্র ৫০০০ মানুষের একটা ছবির মতো শহরে তিনটি সাজানো সুন্দর দ্বীপ (Isola Bella, Isola Madre, IsoladeiPescatori ) বুকে নিয়ে লেক ম্যাগিওরের গল্প। এগুলো আমরা অবশ্য নিজেরা ঘুরে দেখেছি, সব একেবারে ছবির মতো। কখনো সে-সব বলার সুযোগ হলে বলব।

দু-একদিন পর যখন চলে আসার সময় হল, জিজ্ঞাসা করলাম, “কাল সকালে তো ট্রেন। এখান থেকে স্টেশনে যাব কী করে?”

ভদ্রলোক উত্তর দেওয়ার আগেই মেয়েটি বলল, “আপনি সকালে ঠিক সময়ে রেডি থাকবেন। স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থার দায়িত্ব আমার।”

বুকে ভালো লাগার অনুভূতির বোধ হয় ক্ষমতার একটা সীমা আছে। সেখানে পিঠ ঠেকে গেলে তারপর আর কিছু বাকি থাকে না।

সকালে মেয়েটি ঠিক সময়ে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। নিজেই সব ব্যাগপত্তর নিয়ে গাড়িতে তুলল। দরজায় এসে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রী। সবারই চোখে জল। ভদ্রলোক গাড়িতে তুলে দিয়ে হঠাৎ পকেট থেকে একটা সিডি আমার হাতে দিয়ে বললেন, “আমার তো কিছু আপনাকে দেওয়ার নেই, এই সিডিটা নিয়ে যান। এতে সারা স্ট্রেসার দর্শনীয় যা আছে সব আছে। এটা দিয়েই মনে রাখবেন আমাদের।”

আমাদের চোখে বাঁধ ভাঙা জল নামল।

গাড়ি ছেড়ে দিল আমরা সজল চোখে হাত নাড়লাম। মেয়ে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে, শুভযাত্রা জানিয়ে, হাত মিলিয়ে জোর একটা ঝাঁকুনি দিল। ঠিক যেন আমাদের নিজের মেয়ে। রুমাল দিয়ে চোখের কোণটা মুছে, মুখ ফিরিয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসল। আমরাও স্টেশনের দিকে এগোলাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে, বুকে একটা মধুরতার ভার নিয়ে, একটা সুখস্মৃতিকে বুকে পুরে।

অলঙ্করণ- শ্রীময়ী (টিম বোম্বাগড়)

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s