শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরো গল্প শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত লেখা
১
“কী রে, আজ এত দেরি হল?”
“হ্যাঁ, মানে, ইয়ে…”
“উফ্, আবার ছেঁড়া ধুতিটা পরেছিস?”
“ইয়ে, আসলে, হাতের কাছে এটাই পেলাম…”
“আবার বাহানা? কতদিন বলেছি না ছেঁড়া ফাটা পরে… যাক গে, চাল এনেছিস?”
“হ্যাঁ, এই যে।” গোবিন্দ হাতের মুঠো খুলে দেখায়।
“শুকনো চাল খাওয়া খুব শক্ত জানিস তো, একটু নরম হলে… যাক গে, এনেছিস যখন… এখন খাবারের খুব অভাবও বটে, তুই আর কত করবি। আচ্ছা দিয়ে যা।” বিশ্বম্ভর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন। ওর পিছু পিছু জনার্দন এসে একটু দূরে বসে ছিলেন। তিনি কোনো কথা বলেননি এতক্ষণ। সাধারণত বলেন না, একটা দুটো শব্দ করেন বড়োজোর। উনি আসার আগে একবার গলা খাঁকারি দেন।
বিশ্বম্ভর এবং জনার্দন শুরু থেকেই আসেন। দু-চারদিন পর থেকে ওদের প্রায় পিছু-পিছুই সুধাময়, গোপীনাথ এবং ঘনশ্যাম আসা শুরু করে। ওরা বয়েসে একটু ছোটো। প্রগলভ। কথাটা বেশিই বলে, তবে কোনো অভিযোগ নেই। বিশ্বম্ভরের মতো রাশভারী নয় এরা কেউই। জনার্দন বিশ্বম্ভরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। অকুতোভয় দুজনেই। সুধাময়দের মধ্যে বরং কিছুটা দ্বিধা এখনো কাজ করে, তাই ওরা যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখে। গোবিন্দ কাছাকাছি থাকলে চট করে কাছে আসে না। ডিশ অ্যান্টেনার আড়ালে অপেক্ষা করে। গত মে মাসের ঝড়ে ডিশ অ্যান্টেনার তিনটে পায়ার একটা পাঁচিল থেকে উপড়ে গিয়ে একপাশে কাত হয়ে ছিল। ওটা অবশ্য কাজে লাগে না। পয়সা পায়নি বলে কানেকশন কবেই কেটে দিয়েছে কোম্পানি। তবু ওটা ওখানেই রয়ে গিয়েছিল। একটা অভ্যাসের মতো। গোবিন্দ খোলেনি। বরং ঠেলেটুলে ওটার ভাঙা পায়াটা কোনোমতে ছাতের পাঁচিলের ওপরে তুলে খাড়া করে রেখেছিল। পাঁচিলের ওপরে একটা মৃদু ছায়া জোগায় ওটা। সুধাময়রা এসে ওই ছায়ায় অপেক্ষা করে। কখনো অন্য কোথাও আড্ডা মারতে মারতে এদিকে নজর রাখে, গোবিন্দ এল কি না। গোবিন্দ আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বম্ভর চলে আসেন, সঙ্গে জনার্দন। ওঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে কাজ সেরে গোবিন্দ চলে গেলেই সুধাময়রা হৈ হৈ করে এ-পাশে চলে আসে।
গোবিন্দ অপেক্ষা করে না। ও জলের পাত্র পরিষ্কার করে জল ভরে রেখে দরজা বন্ধ করে নিঃশব্দে ফিরে আসে। পরে সন্ধেবেলা বা দুপুরের কোনো সময়ে গিয়ে দেখে খাবারের কণাও পড়ে নেই কোত্থাও। সকাল সাড়ে দশটা এগারটা এই-ই গোবিন্দের সময়। এক-আধ দিন দেরি হয় বটে, তবে সেটাও কখনো বারোটার ঘর পেরোয় না। আজই, কেবলমাত্র আজই বেলা দেড়টা পেরিয়ে গিয়েছে। আর তাতেই কপালে বিশ্বম্ভরের বকুনি। গোবিন্দ দরজা খুলে বেরোতে বেরোতেই আড়চোখে দেখে নিয়েছিল, জলের ট্যাঙ্কের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বম্ভর। মুখ থমথমে। জনার্দনও মাথা নামিয়ে বসে আছেন। তাঁর অবিশ্যি মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। যেন কিছুই হয়নি, যেহেতু বিশ্বম্ভর বিরক্ত হয়েছেন, তাই গলা বাড়িয়ে উঁচিয়ে থাকাটা অসভ্যতা, তাই মাথাটা ঝুঁকিয়ে রয়েছেন এই পর্যন্ত। আলসের কাছে আসতে আসতেই জনার্দন একবার গলা খাঁকারি দিলেন, আর বিশ্বম্ভর মুখ খুললেন।
শুকনো চাল মুখে নিয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখলেন বিশ্বম্ভর। আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই। চড়া রোদ। খুব কাছাকাছি শীতল ছায়া বলতে মণ্ডলদের পুরোনো বাড়ি ভেঙে যে ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে সেখানে পাঁচিলের গায়ে একেবারে হেলে পড়া দুটো জামগাছ আর একটা ইউক্যালিপটাস। শেষ ঝড়ে ওদের হাল খুব খারাপ। মণ্ডলরা ওগুলো কেটে ফেলার তোড়জোড় করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বিশ্বম্ভরের। কত স্মৃতি রয়েছে ওই জামগাছ দুটোকে ঘিরে। এছাড়া অনেকটা চওড়া ছায়া বলতে উত্তরদিকের প্রফেসর সেনগুপ্তদের বাড়ির পাঁচিল বরাবর দেবদারুগাছের সারি কিংবা রাস্তার উলটোদিকে চক্রবর্তীদের বাড়ির বাগান। অযত্নে সেখানে আগাছার ঢের, প্রায় তিন-সাড়ে তিন কাঠা জুড়ে জঙ্গল হয়ে আছে। বড়ো বড়ো ঘাস, আট-দশটা বড়ো বড়ো গাছ; নাম করে বললে দু-খানা সজনে, দু-খানা কদম, এক-একখানা কুল, আম, যজ্ঞিডুমুর, আর জামরুল, এছাড়াও দুটো নারকেলগাছ। খানিকটা চাল খুঁটে নেবার পর জনার্দনকে ইশারা করতেই তিনি এসে বাকিটা খুঁটে খুঁটে মুখে তুলতে লাগলেন। বিশ্বম্ভর ততক্ষণে জলের পাত্রে মুখ ডুবিয়ে দু-চুমুক জল খেয়ে মুখ তুলে তৃপ্তির একটা আহ্ শব্দ করে সরে গেলেন আলসে থেকে। এই অবধি দেখে গোবিন্দ সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে নেমে এল।
২
বিধুমুখীর বয়স হয়েছে। তিনি আর সেভাবে বাইরে বড়ো একটা বেরোন না। ছেলেকে বলে গোটা সাতেক টব আনিয়েছেন। তাতেই উনি বাগান করেন ছাতের একপাশে। একদম বাঁদিকে একটা রঙ্গনফুলের গাছ। ওটাই সবচে’ বড়ো। জানুয়ারির গোড়ায় ছেলেরা কী একটা চারাগাছ বিতরণ অনুষ্ঠান করেছিল, সেখান থেকে আনা। ওটা বেশ ডাগর হয়েছে অ্যাদ্দিনে। তার পাশে একটা ছোটো টবে তুলসি-চারা লাগিয়েছেন, সেটা এক কড় থেকে অ্যাদ্দিনে আধ-হাত মতো বড়ো হয়েছে। এছাড়া হলুদ পুঁতেছেন একটায়, সেটার কল বেরোয়নি এখনো। একটা ছোটো মাটির খুঁড়িতে দুব্বোঘাস। পুজোর কাজে লাগে। একটাতে নয়নতারা, আর কুমড়ো-বীজ আরেকটায়। শেষ একখানায় কীসের বীজ ছড়িয়েছিলেন ওঁর মনে ছিল না। আজকাল এই-ই হয়েছে। গত ক-মাস ধরেই কিছুতেই আর কিছু মনে রাখতে পারেন না। দু-সপ্তাহ আগে শেষ টবটায় ছোটো ছোটো কয়েকটা চারা বেরিয়েছে। মনে করতে পারেন না কী গাছ, দেখে চেনা চেনা লাগে; দিন যায়। এই সবে গতকাল, পাতাগুলো একটু বড়ো হওয়াতে খেয়াল করে দেখেন, ওহো, এগুলো তো কারিপাতা গাছ।
“দ্যাখ বাবু, কারিপাতা গাছ। কবে যে লাগিয়েছিলাম খেয়ালও নেই।” তৃপ্তির হাসি হাসেন বিধুমুখী। তুলসি-চারার পাশ দিয়ে ছোটো ছোটো কঞ্চি টুকরো করে টবের মাটিতে পুঁতে পুঁতে বেড়া দিয়েছেন।
“জানিস বাবু, বড্ড জ্বালাতন করে ছোকরাগুলো। এসে কেবল পাতা খেয়ে নষ্ট করে, আমার পুজোর তুলসি নষ্ট হয়।”
বিশ্বম্ভর বা জনার্দন তো অমন করে না, ভাবে গোবিন্দ, এ নিশ্চয়ই লুপু-ঝুপুদের দলের কাজ। বড্ড ছটফটে ওরা। ধূসর গা ঝেড়ে ঝেড়ে টবের চারপাশেই ওদের যত হুড়োহুড়ি। চাল মুখে নিয়ে দু-চারবার খুট খুট করার পরেই ওদের গন্তব্য ওই টবের আশপাশ। ওরাই হবে। কণাদ আর ববিতা আসে ঠিকই, কিন্তু জনার্দনরা চলে যাবার পর। সুধাময়রা ইতিমধ্যে এসে গেলে ওরা একটু দূরে অপেক্ষা করে। দুজনেই নির্ঝঞ্ঝাটে চাল খেতে পছন্দ করে। টবের কাছে ওরা ভুল করেও আসে না। কণাদের গলার কাছে নানান রঙের বাহার। লাল পুঁতির মতো চোখ। ববিতা ওর চেয়ে একটু খাটো, মখমলি নীল আভা শরীরে, খেতে খেতে গুরর গুরর করে শব্দ করে গলার ভেতরে। সবসময় নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। নিজেদের কথাবার্তা, নিজেদের খাদ্য-পানীয়, নিজেদের প্রসাধন, নিজেদের বাসস্থান, এইসব। গোবিন্দকে ওরা আপনার ভাবে বটে, কিন্তু কথা বলে না। সুধাময়রা ইদানীং গোবিন্দ এলেই খুব হাসি হাসি মুখ করে হৈ হৈ করে চলে আসে। তবে অবশ্যই বিশ্বম্ভর আর জনার্দন চলে যাবার পর। ওরা থাকলে কেউই খুব একটা হট্টগোলের সাহস পায় না। ববিতারা আগে সুধাময়দের এড়িয়ে বেশ খানিকটা তফাতে বসে থাকত, ইদানীং আর ততটা তফাতে থাকে না, বেশ কাছাকাছিই, তবে অপেক্ষা করে, সুধাময়দের কাজ শেষ হবার অপেক্ষা।
“কী হে, টোনা-টুনি, এসো, শুরু করে দাও।” গোপীনাথ একদিন হেঁকে বলেছিল, “ভয় নেই, কেউ তাড়াবে না। গোবিন্দদা, বলো গো তোমার পেয়ারের বকমদের এসে যোগ দিতে।”
“আমরা কি অচ্ছুৎ নাকি?” বলে ঘনশ্যাম কালো ডানা ঝাপটে খুব একচোট হেসে উঠেছিল।
ববিতা তার কোনো উত্তর করেনি। কণাদ এক পা সামনে এগিয়ে এসে ওকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল। গোবিন্দ কিছু বলেনি। গোবিন্দ কিছু বলে না। শুধু দেখে। কণাদ আর ববিতা ঘুরে ঘুরে বেড়ায় আর চাল খুঁটে খুঁটে তোলে, গোবিন্দকে কখনো কখনো ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে। ওদের ঘাড়ের কাছে নানান রঙ ঝিলিক তোলে সকালের সূর্যের তেরছা আলোয়। একেবারে শেষবেলায় আসে সিপাহি বুদ্ধিরাম, একলা। তার মাথায় চুড়ো করে ঝুঁটি বাঁধা। কুচকুচে কালো মাথা। গোল বিস্ফারিত তীক্ষ্ণ চোখ। গলার কাছে লাল রঙের পট্টি। সিপাহি হবার আদর্শ উদাহরণ। মেজাজ বেশ খানিকটা তিরিক্ষেই থাকে। খুব দ্রুত কাজকম্ম সেরে ফুড়ুৎ করে কোথায় যে যায়! এক-আধদিন বেশি বেলা অবধি থেকে গেলে, গোবিন্দ দেখেছে, পাশের সুপুরিগাছটার ওপরের দুটো পাতার তলায় অল্প কোটরমতো ছায়াছায়া জায়গাটায় বসে বুদ্ধিরাম চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর চালিয়ে দেখছে। কী দেখছে তা অবশ্য গোবিন্দ জানে না, জানার কথাও নয়। বুদ্ধিরামের পক্ষেও স্বাভাবিক নয়, তুলসির ছোটো পাতা খুঁটে খাওয়া। সুতরাং দুয়ে দুয়ে চার হবার মতো সব হিসেব লুপু-ঝুপুদের দিকেই নির্দেশ করছে।
অবশ্য এটাও ঠিক, ওরাও জানে ব্যাপারটা ওরা ঠিক করছে না। তবে কিনা, তুলসির ছোটো পাতাগুলো বড্ড মিঠে, আর কী সুগন্ধ! না খেয়ে থাকা যায় না। ফলে মা কিংবা গোবিন্দ আসবার আগেই ওদের চোখের আড়ালে কুটকুট করে খেয়ে নিলে মন্দ হয় না ভেবে, লুপু-ঝুপুরা একটু স্বাদ বদল করে নেয়। লুপু অবশ্য পই পই করে বলেছিল, “খাচ্ছিস খা, পাতা নষ্ট করিস না, টবের মাটি ছড়াস না। তাতে মা কিন্তু রাগ করবে।” ঝুপুদের তাই শুনে কী হাসি, চিক চিক করে হেসে কুটিপাটি সব। ঝুপুর বন্ধু কুরমা বলেছিল, “তুই ব্যাটা ডরপোক। জেনে রাখ যে-কোনো ভালো জিনিস আগে আমরা খাব, যতটুকু ইচ্ছা, যেখানে যখন যেমন ইচ্ছা। তারপর বাকিরা।”
লুপু মানতে পারেনি। “দেখিস, তোদের এই নষ্টামি বন্ধ হবে।”
আর তাই হল। বিধুমুখী এবারে বেড়া দিয়ে দিলেন। অমনি হুটোপাটি বন্ধ। জায়গা কই? অতটুকু টবে! বেড়ার বাইরে থেকে তো আর গলা বাড়িয়ে সর্বত্র পৌঁছানো যায় না। সে বড়ো ঝকমারি। গাছ তো অ্যাত্তটুকু, তার ওপরে চড়ে বসারও উপায় নেই। অগত্যা এক-দুটো পাতা যা ঝরে পড়ে তাই মুখে তুলে আনতে হয়। তবে তার স্বাদ কচি সবুজ ডালে লেগে থাকা পাতার মতো মোট্টেও নয়। লুপু অবশ্য সেটাই মুখে তুলে নেয়। ঝুপুরা খানিক ছড়ছড় করে ছড়ফড় করে বেড়ায় আশপাশ দিয়ে, তারপর আধখানা ডাঁটি, একটু মঞ্জরির ঝরে পড়া গুটি, এক-দুটো পাতা, ব্যস, তারপর আর উৎসাহ থাকে না। বিধুমুখী ওদের আগে যদি চলে আসেন তাহলে তো কথাই নেই। ঝাড়া একঘণ্টা টবের গাছগুলোকে আদর করা চলে। জল দেওয়া, মাটি খোঁচানো, সার দেওয়া। সব চলতে চলতে লুপু-ঝুপুদের আর অপেক্ষা করার ধৈর্য থাকে না, ওরা চলে যায়। আজকাল আর বাইরে বেরোনো হয় না বলে বিধুমুখী সারাদিনে প্রতিবার চা হবার পর যত্ন করে সেই ফেলে দেওয়া চা-পাতা আলাদা করে তুলে রাখেন। তারপর রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে টবের মাটিতে মিশিয়ে দেন। চমৎকার সার হয়।
“হ্যাঁ রে বাবু, আমায় একটু মাটি এনে দিস তো।” বিধুমুখী ছেলেকে ডেকে বলেন। মাঝে মাঝে মাটিও বদলাতে হয় বৈকি! মাটির ভেতর থেকেই তো শাঁসে জলে বড়ো হয়ে উঠবে তার বাছারা। কুমড়োগাছটার ঝুঁটিতে আলতো করে একটা ছেঁড়া শাড়ির পাড় বেঁধে দিয়েছেন। ওপরে দেয়ালের একটা হুক অবধি আকর্ষের সাহায্যে পাড়ের দড়ি বেয়ে বেয়ে দিব্যি উঠে যেতে পারবে সেটা। কুমড়োগাছের ডগায় একটা ছোট্ট কুঁড়ি হয়েছে। সদ্যোজাত সন্তানের মতো তাকে যত্ন করেন বিধুমুখী। মুখ বাড়িয়ে দেখেন। হলুদের কল গজাল কি না। নাহ্, এখনো নয়। পলিমাটি মিহি আর নরম হয়ে আছে, শুকনো। একটু জল ঢেলে দেন। আহা বাছা, কত তেষ্টা ওদের। আস্তে আস্তে টবের গায়ে হাত বুলিয়ে ওটাকে পাশে সরিয়ে রাখেন, যাতে সরাসরি দুপুরের রোদ না লাগে।
“মা, নীচে চলো, এত রোদ্দুরে থেকো না আর।” গোবিন্দের কথায় বিধুমুখীর তাল কেটে যায়।
“এই যাই বাবা। চল।” বিধুমুখী উঠে পড়েন। হাতে পেতলের ঝকঝকে একখানা সাজি। তাতে একখানি নয়নতারা ফুল, আর পাঁচখানা ছোটো তুলসি।
৩
আজ সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়েছে গোবিন্দ। ছাতের ডানদিকে পাঁচিলের ওপরে জলের পাত্রটা রাখা থাকে। সাদা রঙের ছোটো একটা প্লাস্টিকের বাটি। আজ ওটা তার জায়গায় নেই। কোথায় গেল? হন্যে হয়ে খুঁজেও বাটিটা পাওয়া গেল না। ফিকফিক করে একটা হাসির শব্দ শুনে গোবিন্দ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ঘনশ্যাম ওর দিকেই চেয়ে হাসছে।
“বাটিটা ফেলে দিয়েছে সৃষ্টিধর।”
সে আবার কে? মনে মনে ভাবল গোবিন্দ। সেটা যেন স্পষ্ট শুনতে পেল ঘনশ্যাম। আবারও ফ্যাক করে হেসে ফেলে বলল, “রং-রুট। নয়া ছোকরা। হালে এ-পাশে এসেছে।”
“ফেলে দিল কেন?” প্রশ্নটা করেই ফেলল গোবিন্দ।
“বলল, বাটিটা নাকি পুরোনো হয়ে গেছে। শ্যাওলা ধরেছে কোনায়। আর সস্তার প্লাস্টিকের বাটি থেকে মোটেও জল খাওয়া যায় না। বলে, খানিকটা জল মুখে নিয়ে ঠুকে ঠুকে বাটিটার কোণ ভেঙে ফেলে দিল। জলশূন্য হয়ে যাওয়াতে বাটিটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কোথায় যে দূরে পড়ে গেল, আমি আর ঠাহর করতে পারিনি।” এত বলে দম ছাড়ল ঘনশ্যাম।
একদমে কথা বলাটা ওর অভ্যেস। তবে এতখানি কথা একবারে কখনো আগে বলেনি। অন্তত গোবিন্দের সঙ্গে তো নয়ই। গোবিন্দ ফিরে গিয়ে আরেকটা প্লাস্টিকের বাটি নিয়ে এল। এটা বেশ শক্তপোক্ত। আগেরটার চেয়ে একটু মোটাও বটে। ছাতের কলতলায় ভালো করে ঘষে ঘষে মেজে জল ভরে রেখে এল আবার নির্দিষ্ট জায়গাতে। ঘনশ্যাম অমনি সাঁ করে নেমে মাথা নীচু করে জলে ঠোঁট ডুবিয়ে রাখল খানিকক্ষণ, তারপর মুখ তুলে একটা তৃপ্তির আহ্ শব্দ করল। গোবিন্দ ফিরে এল।
বেশ চলছিল। দিন তিনেক বাদে গিয়ে গোবিন্দ দেখল সেই নতুন জলের পাত্রটাও নেই। এদিক ওদিক দেখেও আবারও তার কোনো হদিশ পেল না সে। নিশ্চয়ই আবার সৃষ্টিধরেরই কাজ। আবার একটা বাটি আনবে মনে করে গোবিন্দ ফিরেছে, পেছন থেকে একটা গলা খাঁকারির আওয়াজ শুনে ফিরে দেখে জনার্দন। পাশে বিশ্বম্ভরও রয়েছেন।
“হয়রান হচ্ছিস তো?” বিশ্বম্ভর গম্ভীর গলায় শুধোলেন।
গোবিন্দ উত্তর না করে দাঁড়িয়ে রইল।
“শোন।” বিশ্বম্ভর নিজে থেকেই বললেন, “আলসের ওপরে না রেখে মেঝেতে রাখ পাত্রটা, আর একটা শক্ত ধাতব বা মাটির পাত্র জোগাড় করে আন।”
ঘাড় নেড়ে ঘরে এসে কথামতো একটা স্টেনলেস স্টিলের বাটি নিয়ে এল গোবিন্দ। এক্কেবারে নতুন বাটি। কাগজের গোল স্টিকারটা অবধি লেগে আছে। একটু খুঁটে ওটা তোলার চেষ্টা করল গোবিন্দ। আঠাটা খুব জব্বর। কোনা থেকে একচিলতে কাগজ উঠে গেল মাত্র। গোবিন্দ আর খোঁচাখুঁচি না করে কলের কাছে গিয়ে বাটিটাকে ধুয়ে জল ভরে রেখে দিল।
বিশ্বম্ভর একপাশে বসে মন দিয়ে গোবিন্দর কাজকর্ম লক্ষ করছিলেন। গোবিন্দ জল ভরে পুরোনো জায়গাতে আসতেই ক্কঃ করে একটা মৃদু শব্দ করলেন। গোবিন্দ শুনে দু-পা পিছিয়ে এসে পুবদিকে পাঁচিলের গায়ে মেঝের ওপর পাত্রটা নামিয়ে রাখল। হালকা হাওয়ায় ভেসে সেখানে নেমে এলেন জনার্দন এবং বিশ্বম্ভর। এখন আর কারো দেখা নেই। ওঁরা থাকলে কেউ আসেও না। বাটি থেকে দুজনেই জলপান করতে লাগলেন গোবিন্দর সামনেই। গোবিন্দর হঠাৎ খুব সুখ হল। বাবার কথা মনে পড়ল যেন। উনিও কি এরকম জলপান করাতেন? গোবিন্দ শুনেছে, কখনো দেখেনি। দেখার আগ্রহও বোধ করেনি। অথচ বাবা চলে যেতে, কেউ বলেনি গোবিন্দকে, সে নিজে নিজেই এই কাজটা শুরু করেছে। সম্ভবত, ঠিক জানে না গোবিন্দ, সঠিক বুঝতে পারে না, হয়তো কাজটা ও শুরু করেছে নিজের সুখের জন্যই।
এরপর থেকে ওটাই রইল। বাটি নিয়ে আর কারো কোনো অভিযোগ নেই। থাকলে সুধাময়রা কি আর জানাত না? দিব্যি চলছিল। গোবিন্দ আসে, বাটি ধুয়ে জল ভরে রাখে, চাল দেয়। শুকনো চাল খেতে অসুবিধে হয় বলে এখন গোবিন্দ খানিকটা চাল জলে ভিজিয়ে নরম করে একপাশে আলাদা করে রাখে। বিশ্বম্ভর এসে প্রথম যেদিন ভেজা চাল দেখলেন, খুব খুশি হয়েছিলেন, তৃপ্তি করে আলতো করে করে চাল মুখে তুলছিলেন নিপুণ ভঙ্গিতে। দেখে গোবিন্দরও খুব ভালো লেগেছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখের দৃষ্টি নরম করে ওর দিকে তাকিয়েছিলেন বিশ্বম্ভর। চোখাচোখি হতে অল্প মাথাও নাড়িয়েছিলেন।
একদিন দরজা খুলে গোবিন্দ সবে ঢুকেছে, রঙ্কিণী-ঝঙ্কিণী কোত্থেকে চলে এল। ওরা এদিকে আসেই না। দূর থেকেই ওদের দেখেছে গোবিন্দ। টানা টানা চোখ। গভীর, গাঢ় কালো। চোখের চারপাশে কালো কাজলের মতো দাগ। হলদে ঠোঁট, কালচে বাদামি গা, সাদাটে হলদে পা। একটু চেঁচিয়ে কথা বলে এই যা।
“গোবিন্দদা এসেচে।” রঙ্কিণীর গলা শোনা গেল। কথাটা ঝঙ্কিণীকে উদ্দেশ্য করে বলা।
ঝঙ্কিণী এবারে এগিয়ে আসে সামনে। “গোবিন্দদা!” গলা উঁচু করে বলে সে, “আকাশের রঙটা দেখেছ? কেমন সুন্দর নীল হয়ে আছে! তোমাকে বলতে এলাম, কাল অমনি একটা নীল ঘুড়ি উড়ছিল আকাশে। পাশের পাড়া থেকে কেউ ওড়াচ্ছিল। ঘুড়িটা একলাই মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছিল। তারপর খানিক পরে দুটো চাঁদিয়াল দু-পাশ থেকে এসে পড়ল কোত্থেকে আর খুব প্যাঁচ শুরু হয়ে গেল। দশ মিনিটের মধ্যেই নীল ঘুড়ি ভোকাট্টা। উড়তে উড়তে এসে তোমাদের জলের ট্যাঙ্কের ওই ওপাশটাতে আটকে আছে। সঙ্গে অনেকখানি মাঞ্জা দেওয়া সুতো। সুতোটা দেখা যায় না এমন মিহি। ওটা নামিয়ে নিয়ে এসো। তোমার এখানে অনেকে আসে তো। কার কখন গায়ে আঘাত লাগে, আহত হয়ে পড়বে বেচারারা। তুমি একটু নামিয়ে রেখো।”
গোবিন্দ সরে গিয়ে ট্যাঙ্কের দিকটা দেখার চেষ্টা করে। নাহ্, এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না ঘুড়িটা। ওপরে উঠতে হবে দেয়াল বেয়ে। ও সামনের দিক থেকে ধুতিটা গোছ করে গুটিয়ে ল্যাজের মতো করে ঘুরিয়ে পেছনে নিয়ে গুঁজে দেয়। পায়ে আটকাবে না আর। তারপর লাফ মেরে পাঁচিলের ওপরের অংশটা ধরে দেয়ালে পা রেখে উঠে পড়ে ট্যাঙ্কের পাশে। দক্ষিণের দিকে জলের একটা পাইপে লটকে ছিল ঘুড়িটা। হাতে নিতেই ওর সঙ্গে সুতোটা দেখতে পায়। ওখানে দাঁড়িয়েই বাঁহাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী টানটান করে চার অক্ষরের মতো করে সুতো প্যাঁচাতে থাকে। সেই কবেকার ছেলেবেলার অভ্যেস। ভোলেনি এখনো। তা সুতো নেহাত খারাপ ছিল না। হাতের পাঞ্জা ভরে উঠছিল গোটাতে গোটাতে। সুতো গোটানো শেষ হলে ট্যাঙ্কের ধার থেকে ছোট্ট লাফ মেরে নীচে নেমে আসে গোবিন্দ।
যতক্ষণ ও কাজটা করছিল রঙ্কিণী-ঝঙ্কিণী এক মনে দেখছিল। হয়ে যেতেই দুজনে একগাল করে হেসে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে চক্রবর্তীদের বাড়ির দিকে চলে গেল। ওইদিকেই ওদের বাসা বোধ হয়। রোজ সকালে ওদিক থেকেই ওদের দুজনের গলা শোনা যায়। গলা তুলে মুদারা তারায় আলাপ করে জোড়ায়। গোবিন্দ ওদের চ্যাঁচামেচি শুনে সবসময়েই ভেবেছে নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে নিশ্চয়ই। ওরাও যে সকলের কথা ভাবে আজ এ-কথা জেনে ভুল ভেঙে গেল গোবিন্দর। ভালোও লাগল।
৪
সকালবেলা একপ্রস্থ ঘুরে যাবার পর বিকেলবেলা সন্ধের মুখে মুখে গোবিন্দ আরেকবার আসে। তখন ঘরে ফেরার পালা। অনেক উঁচু দিয়ে সকলে ফিরতে থাকে বাসায়। পশ্চিমের ঝিলের পাড় থেকে গাছগাছালির ভিড় থেকে পুবের জলাজমিতে ফিরে যায় কেউ কেউ। তারা সব দূরপাল্লার যাত্রী। ভাবে গোবিন্দ। কেউ একলা, কেউ ঝাঁক বেঁধে। একদিন সন্ধে পেরিয়ে গেলে পাশের বাড়ির কার্নিশে এসে বসেছিলেন সুলক্ষণাদেবী। ওঁর নাম যে সুলক্ষণা, সে-কথা সুধাময় জানিয়েছিল। পরেরদিন সকালে দেখা হবার সময়ে।
“তুমি ভাগ্যবান গোবিন্দদা। আমরা তো বড়ো একটা দেখতে পাই না ওঁকে। উনি রাতের দিকেই বের হন। দিনের আলোয় ওর কষ্ট হয়। তোমরাও যে সচরাচর চাইলেও দেখতে পাও তা তো নয়। রাশভারী বনেদি বংশের মেয়ে। সে কী যে সে কথা! দেখলেই হল? আর দেখতে পেলেও দূর থেকে, কী, তাই তো?”
গোবিন্দ মাথা নেড়েছিল। সত্যিই তো। আঁধারের মাঝে আবছায়া হয়ে বসে ছিলেন উনি। সুলক্ষণাদেবী। চারপাশে যেন একটা আবরণ। চাইলেই ওঁকে ছোঁয়া যাবে না, ধরা যাবে না। টুঁ শব্দটি নেই মুখে। চুপ করে, হয়তো এদিকপানে চেয়েই বসে ছিলেন উনি। গোবিন্দ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওঁর দিকে চেয়ে ছিল। চারপাশের অন্ধকার ওঁর গায়ের রঙে খানিক ফিকে হয়ে গিয়ে আলো ছড়াচ্ছিল। মিনিট দশেক থাকার পর নিঃশব্দে পাখনা ছড়িয়ে আলো হয়ে উড়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণের আকাশে। ওই একবারই। তারপর আজ অবধি আর তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি।
***
ববিতার চেয়ে কণাদ দেখতে শুনতে বেশি সুন্দর। সুলক্ষণাদেবীর সঙ্গে দেখা হবার পরদিন গোবিন্দ একটু তাড়াতাড়ি ছাতে এসেছিল। কণাদ আর ববিতা ছাড়া আর কেউ ছিল না তখন। ওদেরও খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিল। মেঝেতে অনেকসময় পড়ে থাকা এটা সেটা বিস্কুটের গুঁড়ো, আধাখানা বীজ, পাতার অংশ এসব খুঁটে খুঁটে খায় ওরা। ববিতা খাচ্ছিল। কণাদ হঠাৎ করে গোবিন্দর বেশ খানিকটা কাছে চলে এল।
“তুমি ভারি ভালোমানুষ।” চোখ বড়ো করে ঘাড় বাঁকিয়ে গোবিন্দের দিকে চেয়ে কথাটা বলে ফেলল কণাদ।
গোবিন্দ ওর ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল। “তাই বুঝি! তা কীসে বোঝা গেল?”
“আমরা বুঝতে পারি। গুরু মহারাজ বলে দেন।”
“গুরু মহারাজ? কে সে?”
“তা তো জানি না, তবে বলে দেন।”
“জানো না অথচ বলেন কীভাবে?” গোবিন্দ হাঁটু মুড়ে নীচু হয়ে বসল, যাতে ঘাড় উঁচিয়ে কথা বলতে কণাদের কষ্ট না হয়।
কণাদ ঘাড় নামিয়ে বলে, “জানি না, মনের ভেতর থেকে কেউ বলে দেয়, সেই-ই আমাদের গুরু মহারাজ।”
গোবিন্দ চমৎকৃত হয়ে গেল। এমন কথা সে আগে কখনো কারো কাছে শোনেনি।
কণাদ কেমন ঘোর লাগা গলায় শরীর ফুলিয়ে উবু হয়ে বসে কথা বলে যাচ্ছিল। “জানো, অনেক উঁচুতে উড়তে উড়তে শরীরটা মুড়ে ফেলে শূন্যে ঝাঁপ দিই যখন ভেতর থেকে গুরু মহারাজ সাহস জোগান—ভয় নেই বাছা, ভয় নেই। সাহসী প্রাণের পাশেই আনন্দ উড়ে বেড়ায়। বুক ভরে বাতাস নিলে তা থেকে শক্তি তৈরি হয়।”
কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছিল কণাদ। গোবিন্দ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। ববিতাও গুটিগুটি কণাদের পাশে এসে চুপটি করে বসে কণাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে চোখের দৃষ্টিতে গভীর ভালোবাসা আর মায়া।
“আর ওই কথাটা বলো।”
ববিতার কথায় ঘোর কেটে যায় কণাদের, সে হেসে ফেলে।
“কী কথা?” গোবিন্দ জিজ্ঞেস করে।
“সে এক অন্য গল্প। আমাদের এক বন্ধু আছে। সে যেখানে থাকে সেখানে একটা ছোটো ছেলে নাকি তার পায়ে চিঠি বেঁধে ওড়ায়। সেও জানে চিঠি বেঁধে দিলে তাকে কোথায় যেতে হবে। যে বাড়িতে সে যায়, সেখানেও তার অনেক বন্ধুরা আছে। পৌঁছে যাবার পর সে-বাড়ির লোকেরা তাকে যত্ন করে দানা খাওয়ায়। পা থেকে চিঠি খুলে নেয়। কখনো আবার চিঠি বেঁধে দেয়। ও ফিরে আসে আগের বাড়িতে। সে শুনেছে অনেক আগে আমাদের দাদামশাই ঠাকুর্দামশাই, দিদিমা, ঠাকুমারা নাকি এমনিই চিঠি নিয়ে যাতায়াত করত। রাজা মহারাজাদের গুপ্ত চিঠি। যুদ্ধের সময়েও নাকি অসম সাহসী এক-একজনকে নির্বাচন করা হত শত্রুপক্ষের নজর এড়িয়ে খবর দেবার জন্য।”
কণাদ থামল একটু। গোবিন্দ জলের পাত্রটা এগিয়ে দেয় ওর দিকে। কণাদ একবার মুখ ডুবিয়ে নিয়ে ববিতার দিকে তাকায়। ববিতা কণাদের কথাটা এগিয়ে নিতে থাকে।
“আগুনের গোলার ওপর দিয়ে, সাঁই সাঁই করে কানফাটানো গুলির মধ্যে দিয়ে দুরন্ত বেগে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে সেই সমস্ত বীরপুরুষ বীরনারীদের প্রাণ এতটুকু কাঁপেনি। আমি যখন শূন্যে ডিগবাজি খাই, মনের মধ্যে কে যেন বলে ওঠে, সাবাশ বেটি, এই তো আমার যোগ্য উত্তরাধিকারী। আমি টানটান হয়ে ভেসে যাই হাওয়া কেটে সাঁ সাঁ করে অনেকখানি উত্তরে ওইই খোলা মাঠের দিকে।”
গোবিন্দের মনে হল সে যেন কোনো রূপকথার গল্প শুনছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। সাদা ধূসর নীল সবুজ বেগুনি নানারকম রঙের মিশেলে এক আশ্চর্য ছবি তৈরি হচ্ছে। গরমের দিনে খুব ঠান্ডা মিষ্টি শরবত খেলে যেমন শরীর জুড়িয়ে যায়, গোবিন্দর ঠিক তেমন লাগছিল। এই অবসরে দক্ষিণের বাতাসে কণাদ আর ববিতা দু-পাশে ডানা মেলে দিয়ে ভেসে গেল।
৫
জুলাইয়ের শুরু। বর্ষা এসে গেছে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহেই। আজকাল আবহাওয়ার খবরে মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়াই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বিবিসির তিন মিনিটের আবহাওয়ার খবরে প্রায় দেড় মিনিটের বেশি সময় ধরে সঞ্চালকের হাত আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর আর ভারতের ম্যাপের ওপরেই ঘোরাফেরা করে।
বৃষ্টি হলে খুব অসুবিধে হয় চাল-জল দিতে। জল তবু-বা দেয়া যায়। চাল দিলে বৃষ্টির ফোঁটায় ছিটকে ছিটকে যায় চতুর্দিকে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকে গোবিন্দ। ঝিরিঝিরি বা টিপটিপ বৃষ্টি পড়লে অবশ্য তার মধ্যেই চাল রেখে আসে। সুধাময়রা টুক করে চলেও আসে। লুপু-ঝুপুরাও এদিক সেদিক করে ঘুরে যায়। কেবল কণাদদের সমস্যা হয়। ওরা জানালার সানশেডের নীচে অপেক্ষা করে বা কোনো ঘুলঘুলির মধ্যে বা নিদেন এয়ার কন্ডিশনারের বাইরের বাক্সটার নীচে। বৃষ্টি পড়লে জনার্দন এবং বিশ্বম্ভর আসেন না। গোবিন্দর চিন্তা হয়, ওরা বুঝি সে-বেলা উপোসই দেন। কে জানে!
আজ ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে সক্কালবেলা থেকে। গোবিন্দর মনটা একটু খারাপই হয়ে আছে। দরজা খুলে বাইরে যাবার জো নেই। ছাতের দরজা খুলে সিঁড়ির গোড়ায় বসে থাকে সে। বাইরেটা সাদা হয়ে আছে। বৃষ্টির জল ছাতের একপাশ দিয়ে বয়ে পাইপ বেয়ে নীচে চলে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির ছাতের রেন পাইপটা ফাটা। সেখান থেকে ঝরঝর করে এত জোরে জল বেরিয়ে চাতালে পড়ে শব্দ তোলে যে কানে শুনে বিভ্রম হয়, যেন আরো জোরে বৃষ্টি নামল, আসলে হয়তো তত জোরে বৃষ্টি পড়ছে না। জমা জল একত্র হয়ে নীচে শান বাঁধানো অংশে সরাসরি ওপর থেকে পড়ছে বলে অমন আওয়াজ।
খুট করে একটা আওয়াজ শুনে বাঁদিকে তাকাল গোবিন্দ। চার ধাপ সিঁড়ির ওপরে বিশ্বম্ভর বসে আছেন। সিঁড়িঘরের ভেতরে, একলা। গোবিন্দ প্রথমটায় চমকে গেছিল। একটু ধাতস্থ হয়ে নজর করে দেখল। বিশ্বম্ভর ভেজেননি।
“আগেই ঢুকে পড়েছি, বুঝলি!”
“বৃষ্টির আগেই?”
“না, হালকা বৃষ্টি ছিল তখন।”
“কিন্তু ছাতের দরজা তো বন্ধ ছিল।” আমতা আমতা করে বলল গোবিন্দ।
এই প্রথম বিশ্বম্ভরকে হাসতে দেখল গোবিন্দ। মৃদু হাসি। পরিষ্কার বুঝতে পারল।
“মা এসেছিলেন সকালে। তুলসি নিতে।”
তার মানে প্রায় একঘণ্টা আগে। গোবিন্দ সাহস করে জনার্দনের খবর জিজ্ঞেস করতে পারল না। বেচারা! কোথায় আছেন তিনি কে জানে! ভাবতে ভাবতেই গোবিন্দ হাতে চাল ঢালছিল সিঁড়ির ওপরেই ছড়িয়ে দেবে বলে। তার আগেই বিশ্বম্ভর আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে এলেন। গোবিন্দ হাতের চেটোয় চাল নিয়ে তাতে একটু জল দিয়ে ভিজিয়ে দিতেই বিশ্বম্ভর এসে সরাসরি তাতে মুখ রাখলেন। আশ্চর্য হয়ে গেল গোবিন্দ। খুব সাবধানে মুখে করে এক-দুটো চাল খুঁটে খুঁটে নিচ্ছিলেন উনি। পাছে গোবিন্দর হাতে আঘাত লেগে যায়। অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় মন ভরে যাচ্ছিল গোবিন্দর। বৃষ্টির একটানা আওয়াজের মধ্যে ভেজা ভেজা হাওয়ায় সিঁড়ির প্রথম ধাপে এলিয়ে বসে হাত বাড়িয়ে রইল সে। বিশ্বম্ভর পরম মমতায় হাত থেকে চাল খুঁটে খুঁটে নিতে থাকলেন অনন্ত সময় ধরে।
শীর্ষচিত্র- রাহুল মজুমদার
গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে