নন্দিনী দাসচট্টোপাধ্যায়ের আগের গল্প- নেশা(আলগারনন ব্ল্যাকউড), পথিক, বন্ধু, শিঙা
বাসিনীর বর বিনোদবিহারী লোকটা নেহাত মন্দ নয়। তবে কথায় বলে, দোষে গুণে মানুষ। দোষ একটা ছিল বটে বিনোদের, আর বাসিনী তাই বিয়ের ব্যাপারে একেবারে বেঁকে বসেছিল—সে-কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু একদিন চুপিচুপি বিনোদ বাসিনীর সঙ্গে দেখা করে একেবারে মা কালীর লকেট ছুঁয়ে দিব্যি করল যে, সে আর ওই ‘দোষের’ পথে রোজগার করবে না। কাজে কাজেই বিয়েটা হয়ে গেল। আর বিনোদও আজ পর্যন্ত তার কথার খেলাপ করেনি।
বিনোদের হাতের কাজ ভালো। আগের কাজেও সবাই যেমন তার হাতের তারিফ করত, আবার এখনও তাই। এখন সে মূর্তি গড়ে। তার গড়া মূর্তির খুব কদর।
সবে কার্তিকপুজো কেটেছে। এখন দু-চারদিন তার বিশ্রাম। সেই চৈত্র-বৈশাখ থেকে একটার পর একটা কাজ—গণেশ-বিশ্বকর্মা-দুর্গা-কালী-কার্তিক—পরপর চলতেই থাকে। ক’দিন পরেই আবার সরস্বতীর কাজ শুরু করতে হবে। আর এই ফাঁকা সময়টাতেই বিনোদের ছেড়ে আশা জীবনটার জন্য মনটা হু হু করতে থাকে। আসলে সে জীবনটা তো বিনোদের একার নয়। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের কত পুরুষের ঐতিহ্য, জড়িয়ে আছে এক অজানা ইতিহাস।
তার পারিবারিক বিদ্যার হাতেখড়ি হয়েছিল ঠাকুরদা গোকুলবিহারীর হাতে। একেবারে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন এ-কাজের সমস্ত ঘাঁতঘোঁত। বিনোদও শিখে নিয়েছিল চটপট। গুণী মানুষ ছিলেন তিনি। গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে কতদূরে তাঁর নামডাক ছড়িয়েছিল! সেই ঠাকুরদা বিনোদের শেখার উৎসাহ দেখে গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘এলেম আছে ছোঁড়ার, কালে কালে আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে এ!’ কিন্ত শেষে বাসিনীর পাল্লায় পড়ে… যাক সে কথা। জাত ব্যাবসা ছাড়ার কথায় ঠাকুদ্দা গোকুলবিহারী আর বাপ নিত্যবিহারী, দুজনেই খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। বংশের অকল্যাণ হবে যে!
সেই কোন কালের কথা। গোকুলবিহারীর ঠাকুরদা শক্তিবিহারী তখন সদ্য যুবক। সেবার গ্রামের কালী মন্দিরে এক সন্ন্যাসী এসে আস্তানা গাড়লেন। পরনে টকটকে লাল কাপড়, চোখদুটোও তাই, কপালে ইয়াব্বড়ো সিঁদুরের টিপ, গলায় রুদ্রাক্ষ, মাথায় জটা—দেখলে ভয়-ভক্তি দুইই জাগে।
তো শক্তিবিহারী সেই সাধুর চ্যালা হয়ে উঠল, দিনরাত পড়ে থাকে সেখানে। তাতে করে অন্ন-প্রসাদ আর গাঁজা-প্রসাদ দুটোরই কোনও অভাব থাকে না। কাজে-কম্মে মন ছিল না বলে বাড়িতে তখন নিত্য অশান্তি। শক্তিবিহারী তাই মন্দিরে পড়ে থাকে আর প্রাণপাত করে সাধুর সেবা করে।
এভাবে ছ’মাস কেটে গেল। একদিন আধো তন্দ্রায় শক্তিবিহারী শুনতে পেল সন্ন্যাসী যেন বলছেন, “নে বেটা! এ হতেই তোর লক্ষ্মীলাভ হবে। এর স্পর্শে যে কোনও আবরণের অন্তরাল দূর হবে।” বলে আগুনরাঙা একটা শলাকা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “সাবধান! যতদিন একে আদরযত্ন করবি, কাজে লাগাবি, ততদিনই এ তোকে দেখবে।” বলতে বলতে তাঁর আওয়াজ যেন ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল আর শক্তিবিহারীরও তন্দ্রা ভেঙে গেল।
চোখ খুলে শক্তিবিহারী কাউকে দেখতে পেল না। সন্ন্যাসীর কোনও চিহ্নমাত্র নেই! শুধু পাশে পড়ে রয়েছে বিঘত দেড়েক লম্বা এক মামুলি লৌহশলাকা।
তবে শক্তিবিহারী ক্রমশ টের পেল, জিনিসটা মোটেই মামুলি নয়।
সেই থেকে এই শলাকা আজ পর্যন্ত বংশপরম্পরায় তাদের অন্ন জুগিয়ে এসেছে। আর আজ কোথাকার কোন বাসিনীর কথায় এই মন্ত্রপূতঃ শলাকার অসম্মান করবে বিনোদ!
এই উভয়সংকট থেকে বিনোদকে অবশ্য উদ্ধার করেছিল সেই বাসিনীই। সব শুনে বলেছিল, “ঠিক আছে, বছরে একবার ওই লোহার কাঠি নিয়ে জাত ব্যাবসায় নামতে পার, কিন্তু মনে রেখো স্রেফ ওই নিয়ম রক্ষেটুকুই।”
শেষপর্যন্ত সেই নিয়মই চলতে লাগল।
এখন এই ফাঁকে পুরোনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ভাবছিল বিনোদ, এমন সময় ফোনটা এল।
ফোন করেছে হরি। “এট্টা জাঁকালো কাজ আছে। পারলে আজকালের মধ্যে আমার এখানে চলে এস।”
হরি আর সে দুজনেই ঠাকুরদার প্রিয় ছাত্র। সে পারেনি, কিন্তু হরি আজও তারই ঠাকুরদার নাম উজ্জ্বল করে চলেছে। বিনোদের অন্তরাত্মাটা চনমন করে উঠল। এরকম একটা ডাকের অপেক্ষায় বিনোদ সারাবছর মুখটি বুজে কাজ করে যায়, কিন্তু এই একটিমাত্র কাজে সে প্রাণে শান্তি পায়। আরে বাবা, এ যে একেবারে রক্তের টান বলে কথা! আজ পাঁচপুরুষ ধরে, মানে যবে থেকে এই লৌহশলাকা তাদের কাছে আছে, তাদের বংশের কোনও কাজ অসফল হয়নি।
পরদিন একেবারে কাকডাকা ভোরে সে ট্রেনে উঠল।
চোরবাগানে এ-গলি, সে-গলি ঘুরে তস্য এক এঁদো গলিতে হরির আস্তানা। সারারাত খাটাখাটুনির পর সে তখন ঘুমোচ্ছিল। বিনোদের ডাকে চোখ কচলাতে কচলাতে বাইরে এসেই একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরল। “ঠিক জানতাম, যতই ভদ্দরলোক হও, শুনলে আর থাকতে পারবে না! তা সিঁদকাঠিটা সঙ্গে আছে তো?”
“তুমি ডেকেছ, আর সিঁদকাঠি আনব না! ওর তাগিদেই তো বেরোনো!”
খাওয়াদাওয়ার পর হরি বলল, “এ-বেলা এট্টু গড়িয়ে নাও। ও-বেলা আমি তোমাকে কাজের জায়গা দেখাতে নিয়ে যাব’খন।”
সেইমতো বিকেল বিকেল বেরোল দুই স্যাঙাত।
জায়গাটা একটু শহর ছাড়িয়ে। ট্রেন থেকে নেমে জোরে জোরে পা চালাল দুজনে।
কার্তিক পেরিয়ে অঘ্রাণ মাস পড়েছে। বাতাসে হিম হিম ভাব। দুজনে কালো মাফলারে মাথা-মুখ জড়িয়ে নিয়েছে বেশ ভালো করে। খালের ধার দিয়ে পথ। বাজার-দোকান পেরিয়ে রাস্তাটা খালের উপরের লোহার পুলে উঠেছে। তারপরে খাল পেরিয়ে ডাইনে বাঁয়ে বেশ ক’টা মোচড় মেরে একজায়গায় থামল হরি। সামনে একটা ছোটো মাঠের পর একটা তেতলা বাড়ি। কাজটা ওখানেই।
দেখে মনে হয় পাড়াটা নির্জন—না গ্রাম, না শহর। কাছাকাছি ফ্ল্যাট না থাকলেও দূরে দূরে দৈত্যাকার বাক্সবাড়িগুলোর অবয়ব বেশ বোঝা যাচ্ছে খোপে খোপে জ্বলা আলোর জন্য। রাস্তায় দু-চারজন যা দেখা যাচ্ছে, হাবেভাবে মনে হয় তারা স্থানীয় লোক। হরি আর বিনোদ গল্প করতে করতে বাড়িটার পাশ দিয়ে বার কয়েক যাতায়াত করল। ভাবটা এমন, যেন কোনও ঠিকানা খুঁজছে। আর সেই ফাঁকে যা দেখার দেখে নিয়েছে।
আসলে এই বাড়িটার একটা গল্প আছে।
হরিদের লাইনে একটা অলিখিত নিয়ম হল, প্রত্যেকের কাজের জায়গা ভাগ করা, কেউ বিনা অনুমতিতে অন্যের জায়গার কাজে নাক গলায় না। তবে বিনোদের ব্যাপারটা আলাদা। ও তো এখন পেশাদার নয়, একেবারেই অ্যামেচার। তবে এ-কথাটা এ লাইনের প্রত্যেকটা লোকই একবাক্যে স্বীকার করে যে, এমন এলেমদার লোকের বসে যাওয়াটা মস্ত বড়ো ক্ষতি।
এ তল্লাটের কাজটা দেখে গগন। এই বাড়ির সন্ধান গগনই দিয়েছিল। আজ পর্যন্ত এ-বাড়ির কুটোগাছটাও নাকি কেউ সরাতে পারেনি। আর তখনই কথায় কথায় বিনোদের কথা উঠেছিল।
এলাকায় গগন চোরকে সবাই চেনে। কাজেই সে কোনোমতেই ফিল্ডে থাকতে পারবে না। তাই হরি আর বিনোদ নিজেদের মতো করেই এলাকাটাকে মেপে নিচ্ছিল।
এ পর্যন্ত খবর যেটুকু পাওয়া গেছে তা হল, ওই বাড়ির বাসিন্দা হল এক বুড়ি আর তার পাঁচ ছেলে। চার ছেলের বিয়ে-থা হয়ে গেছে, ছেলেমেয়েও আছে। প্রত্যেকের সংসার আলাদা। শুধু ছোটো ছেলে এখনও বিয়ে করেনি, তাই সে বুড়ির সঙ্গেই থাকে। বাড়ির একতলায় একটা ছোটো গেঞ্জির কারখানা আছে। ব্যাবসাটা বুড়ি আর তার পাঁচ ছেলে মিলেই সামলায়। তবে বুড়িকে না জানিয়ে না ব্যাবসার, না সংসারের, একটি কাজও হয় না।
বাড়ি ঝাড়া-মোছার কাজের জন্য একজন লোক আছে, বাদবাকি কাজ যে যার নিজেরাই সামলায়। এই ঝাড়া-মোছার কাজটি করে গগনের মাসতুতো ভাই গণেশ ওরফে গণশার বৌ কলাবতী। এই কলাবতীই হল গগনের ইনফর্মার।
কলাবতীর আসল উদ্দেশ্যটা কেউ আন্দাজও করতে পারে না, সবার সঙ্গেই কলার ভাব। এমনকি ওই জাঁদরেল বুড়ি, সেও ‘কলা’ বলতে অজ্ঞান। হ্যাঁ, বলা হয়নি, কলাবতীর অত বড়ো নামটাকে ছোটো করে এরা সবাই ‘কলা’ বানিয়ে নিয়েছে। এই একটি ব্যাপারে সবাই একমত। কিন্তু আসলে বউয়ে বউয়ে, শাশুড়ি-বউয়ে, ভায়ে ভায়ে কোন্দল লেগেই রয়েছে। কলাবতীর সামনেই কত কথা হয়, তবে সে এমন ভাব দেখায় যেন একটি কথাও সে শোনেনি।
কলাবতীর কাছেই খবর পাওয়া গেছে, অন্য ভাইয়েরা সন্দেহ করে, বড়ো ভাই আর তার বউ চুপিচুপি বুড়ির ঘরের সিন্দুক থেকে টাকাকড়ি সরিয়ে ঘরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে রাখে। বুড়ির সিন্দুকেই থাকে ব্যাবসার টাকাপয়সা। ভাইয়েরা প্রত্যেকে বুড়ির থেকে মাসোহারা পায়। কলাবতী নিজেও অনেকবার বুড়ির ঘর থেকে বড়ো ভাই কিম্বা তার বউকে চুপিচুপি বেরোতে দেখেছে।
আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপারও দেখেছে কলাবতী। ঘরে অত সুন্দর খাট-বিছানা, কিন্তু বড়ো ভাইয়ের ঘরে সবাই মেঝেতে বিছানা করে শোয়। জিজ্ঞাসা করলে বলে, নাকি গুরুদেবের নিষেধ।
এছাড়া আরও খবর পাওয়া গেছে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানদার মন্টুর কাছে। ওই দোকানেই মন্টু থাকে। দিনের বেলায় সামনের ঝাঁপ খুললে দোকান, আর রাতে ঝাঁপ বন্ধ করলেই মন্টুর ঘর। মন্টু জানিয়েছে, ওই বাড়িতে সারাদিন চলে কারখানার ঘটাং ঘটাং আর রাত দশটা থেকে সারারাত তিনতলার ঘরে গাঁক গাঁক করে টিভি। তিনতলার ওই ঘরেই থাকে বড়ো ছেলের পরিবার। অন্য বউরা বলে, জেগে জেগে টিভি দেখে না হাতি! বাইরের ঘরে লাইট জ্বালিয়ে, টিভি চালিয়ে রাখে যাতে লোকে মনে করে ওরা জেগে আছে আর চোরছ্যাঁচড়ের উৎপাত না হয়।
বুড়ি ঘুমোয় সাত-তাড়াতাড়ি। সাড়ে সাতটার সিরিয়াল দেখতে দেখতে খেয়ে নেয়। কলাবতীকে সেইসময় থাকতে হয়। ঘুমোনোর আগে ঘর মোছা বুড়ির বাতিক। সাড়ে সাতটায় বুড়িও শুতে যায় আর কলাবতীও বাড়ি ফেরে।
***
বিনোদ ঠিক করল, কাজের দিন দুপুর পেরোলেই ও তল্লাটে চলে যাবে। বাপ-ঠাকুরদার সময়ে তাঁরা ল্যাঙট পরে, সারা গায়ে চুপচুপে করে সর্ষের তেল আর ভুষোকালি মেখে কাজে বেরোতেন। কিন্তু সেদিন আর নেই এখন। কাজের পোশাক বলে আলাদা কিছু আর হয় না। শুধু কালো পোশাকটা লাগে, গা-ঢাকা দিতে আর নিয়মরক্ষা করতে তেলকালির একটা ছোট্টো ফোঁটা লাগিয়ে নিতে হয় চুলের আড়ালে।
আজ বিনোদ পরেছে কালো টি-শার্ট, কালো ট্র্যাক-স্যুট। হরিও তাই। যে-কেউ দেখলে এখন তাদের বিনোদবাবু, হরিবাবুই বলবে।
কলাবতী বলেছে, সন্ধেবেলা যখন টিভি চলবে, তখন সুযোগ বুঝে বাড়ির পিছনের দিক দিয়ে ওদের ঢুকিয়ে দেবে। ওদিকের রাস্তার বাল্বটা দিনের বেলায়ই গণশা ফাটিয়ে রেখে এসেছে।
পাঁচিল পেরিয়েই একটা মস্ত ঝুপসি আমগাছ। হরি আর বিনোদ চুপিচুপি উঠে বসল আমগাছে। দুজনের পিঠেই আছে কালো পিঠ-ব্যাগ। তার মধ্যে আছে পাঁউরুটি, কলা, জল, সরু টর্চ, পাতলা ছুরি। আর বিনোদের পিঠের ব্যাগে আছে দুটো বিশেষ জিনিস। এক, ওই সন্ন্যাসীর লোহার কাঠি, আর দু-নম্বরটা হল একটা লম্বা দড়ি। সেটা যেমন হালকা, তেমনই শক্ত। এটা আসলে হরিই তাকে দিয়েছে। হাওড়া স্টেশনে একবার এক সাহেবের ব্যাগ থেকে পেয়েছিল।
একতলার একটা ঘরের আলো সাড়ে সাতটা নাগাদই নিভল। বোঝা গেল, ওটা বুড়ির ঘর। হরি আর বিনোদ অপেক্ষা করতে-করতেই দেখল, বাড়ির বাকি ঘরগুলোও আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এল। শুধু তিনতলার কোণের ঘরটা ক্রমে সরগরম হয়ে উঠল। জোরে জোরে টিভির আওয়াজ কানে আসতে লাগল।
হরি-বিনোদ এক ফাঁকে সঙ্গে আনা খাবারদাবার খেয়ে তৈরি। কিন্তু মুশকিল হল, আমগাছের মগডাল থেকে ছাদের দূরত্ব অনেকখানি। ছাদে একবার পৌঁছতে পারলে বিনোদ ঠিক যেভাবেই হোক ঘরে ঢোকার ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। কিন্তু ছাদে ওঠার কী বন্দোবস্ত করা যায়? পাইপগুলো ফাইবারের, তা দিনের বেলায়ই দেখে নিয়েছে। কলাবতীর কাছে আরেকটা খবর আগেই পাওয়া গেছে যে, বড়ো ভাইয়ের ঘর দুটো পাশাপাশি। ওদের টার্গেট ওই জানালা দুটোই।
ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্কভাবে হাতে পড়ল একটা খেলনার বাক্স। তাই তো! গতকালই এখান থেকে ফেরার পথে ছেলের জন্য একটা ছোটো রিমোট কন্ট্রোল ড্রোন কিনেছিল বিনোদ। তারপরে হরির আস্তানায় সবাই মিলে সেটা নিয়ে বিস্তর কসরত হয়েছে। সেই ড্রোনের সঙ্গে দড়িটা বেঁধে সূক্ষ্ম কসরতে বিনোদ সেটাকে ছাদে পাঠাল পাঁচিলের বড়ো বড়ো ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে। প্রথমবার গোঁত্তা খেলেও পরের বার আর ক্যালকুলেশনে ভুল হল না বিনোদের। ঘুলঘুলির ফাঁক গলে ছাদে ঢুকে, বিনোদের নির্দেশ মতো রেলিংয়ের উপর দিয়ে বেরিয়ে এল ড্রোন। ব্যস, দিব্যি দড়ির ফাঁস তৈরি!
এবার দড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এল দুই স্যাঙাত। হরি থাকল ছাদের উপরে, চারদিকে চোখকান খোলা রেখে পাহারা দিতে। আর দড়ি বেয়ে তড়তড়িয়ে নেমে এল বিনোদ সেই আলো ঝলমলানো ঘরের জানালায়।
কাঠের জানালার পাল্লার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে ঘরে কাউকে দেখতে পেল না, শুধু টিভিতে কোন জ্যোতিষী বসে গ্রহ-নক্ষত্রের কুদৃষ্টির সঙ্গে লড়াইয়ের পদ্ধতি সরল ভাষায় বুঝিয়ে যাচ্ছেন। দড়ির সামান্য ঝাঁকুনিতে দোল খেয়ে বিনোদ পৌঁছল পাশের ঘরের জানালায়। আবছা অন্ধকারে দৃষ্টি চালিয়ে দেখতে পেল ঘরের মধ্যিখানে রাজসিংহাসনের মতো খাটটা দাঁড়িয়ে আছে আপন গরিমায়, আর নীচে মেঝে জুড়ে বিছানা পাতা। ঘরের মধ্যে সরু-মোটা-মিহি নানারকমের নাকের এবং নিঃশ্বাসের আওয়াজে মালুম হল ঘরের অধিবাসীরা গভীর নিদ্রামগ্ন। অর্থাৎ, এক্কেবারে মাহেন্দ্রক্ষণ। আর শক্তিশালী লৌহশলাকা তো আছেই। অতএব এবার নিশ্চিন্তে কাজটি করে ফেলা যায়।
বিনোদ আবার ছাদে উঠল। কলাবতী আগেই ছাদের দরজার তালা খুলে, ছিটকিনি আলগা করে রেখেছিল। নাহ্, মেয়েটা খুবই কাজের। গগন কপাল করে এমন ভাই-বৌ পেয়েছে।
এবার পা টিপে টিপে নীচে নামল দুই মক্কেল। গোকুলবিহারীর শিক্ষায় দুজনেই বেড়ালের মতো নিঃশব্দ হাঁটাচলায় পটু। কাজেই নির্দিষ্ট দরজায় পৌঁছতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। সিঁদকাঠির সূক্ষ্ম খোঁচায় দরজা খুলে গেল; সামান্য ‘খুট’ আওয়াজটা টিভির আওয়াজে ঢেকে গেল। তাতে অবশ্য ভিতরের ঘরের সরু-মোটা-মিহি আওয়াজের বিন্দুমাত্র তারতম্য হল না। দরজা খুলেই টিভির ঘর। সুড়ুৎ করে সেটা পেরিয়ে দুজনে ঢুকল কাজের ঘরে। মনে মনে নিদ্রাকর্ষণী মন্ত্রটা আওড়ে যাচ্ছিল দুজনেই।
ঘরে ঢুকে বিনোদ যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেল, খাটের তোশকের মধ্যেই আছে সমস্ত গুপ্তধনের চাবিকাঠি। বিছানো চাদরটা সরিয়ে দিতে তোষকের গায়ের অসংখ্য সেলাইয়ের দাগ, তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত রহস্যের সন্ধান দিচ্ছিল সোৎসাহে।
বাকি কাজটা করতে আর খুব একটা বেগ পেতে হল না। লুকোনো সোনার কয়েনে পিঠের ব্যাগ বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে। এতক্ষণে খেয়াল হয়েছে একটা ভুল হয়ে গেছে। তাড়াহুড়োতে দড়িটা খুলে আনা হয়নি ছাদ থেকে। কাজের পর নামবে তো সিঁড়ি দিয়ে, এমনই কথা ছিল। অগত্যা আবার ছাদে উঠল বিনোদ, হরি নেমে গেছে নীচে। পাঁচিলে ঝুঁকে দড়িটা গোটাতে শুরু করেছে, হঠাৎ খেয়াল হল, ছাদটা যেন বেশ আলো আলো হয়ে উঠেছে। দু-একদিন বাদেই অমাবস্যা। তাই এতক্ষণে চাঁদ উঠেছে বোধ হয়। দড়িটা গুটিয়ে পিছনে ফিরতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল বিনোদবিহারী। ছাদের টিমটিমে বাল্ব্টাকে পিছনে রেখে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো ওটা কে? পরনে সাদা শাড়ি, সাদা চুলগুলো টানটান করে খোঁপায় জড়ানো, কোমরে হাত দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মানুষজনকে ডরায় না বিনোদ, কিন্তু ভূত-প্রেতের সঙ্গে তো লড়াই চলে না। বিনোদ প্রাণপণে ‘রাম রাম’ জপতে থাকে। আর তখনই ওদিক থেকে যেন ভাঙা কাঁসর ঝনঝনিয়ে ওঠে, “চোর! চোর!”
এতক্ষণে সম্বিৎ ফেরে তার। কিন্তু ছাদের পাঁচিল ডিঙোতে গিয়েই বাধা পেল বিনোদ। ভূত কিংবা মানুষ খনখন করে উঠল, “খবরদার! এক পা এগিয়েছিস, তো এমন হাঁক পাড়ব যে আমার পাঁচ ছেলে রামদা দিয়ে তোকে কুচি কুচি করে কাটবে। ইদিকে আয়।”
বিনোদ বুঝল, অবস্থা বেগতিক, সে ধরা পড়েছে। আমগাছের আড়াল থেকে তখনই একফালি চাঁদ তার হাসিমুখ বের করল। বিনোদের দুর্গতি দেখে হাসি তো পাবেই! পাঁচপুরুষে এই প্রথম কপাল পুড়ল তার। এ বুড়ি যে কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল!
শাড়ির খুঁটটা খামোখাই একবার নামিয়ে আবারও কাঁধে ফেলল বুড়ি। আঁচলে বাঁধা চাবির গোছাটা ঝনাৎ করে উঠল। সেই শব্দ ঘা দিল বিনোদের একেবারে বুকের খাঁচায়।
“ব্যাগ খোল!” আবার বাজখাঁই হাঁকার।
এতক্ষণে বাড়িতে অন্য লোকজনেরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। কে একজন চেঁচিয়ে বলল, “কী হল মা?” আর তারপরেই নীচ থেকে যেন বুড়িরই প্রতিধ্বনি উঠল, “চোর! চোর!”
মা! তার মানে এই বাড়ির যে বুড়ির কথা শুনেছিল, এই সে! কিন্তু এই নিশুত রাত্তিরে বুড়ি ছাদে কী করছে?
কার বাড়িতে সেকেলে ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে তিনটে ঘণ্টা বাজল।
ইতিমধ্যে লোক-মহিলা-কাচ্চা-বাচ্চা মিলে এক মস্ত পল্টন সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছে। সঙ্গে হরিও। তারা বিনোদ আর হরিকে এই মারে তো সেই মারে। তবে হরিকে দেখে মনে হল, এর মধ্যেই দু-চার ঘা তার পিঠে পড়েছে।
‘চোরের মার’ থেকে অবশ্য বিনোদদের বাঁচাল সেই বুড়িই। বলল, “গায়ে হাত তোলার দরকার নেই। শক্ত করে বেঁধে রাখ ও-দুটোকে, আলো ফুটুক আগে। ভাগ্যিস, ভোর ভোর মন্নিং ওয়াক করা আমার অভ্যেস!” তারপর একটু দম নিয়ে ওদের দিকে ফিরে বলল, “এই যে চোর বাছারা! ভালোমানুষের মতো থলেগুলো খোলো দিকিনি।”
ব্যাগ খুলবে যে, বুড়ির ছেলেপুলেরা কি সে উপায় রেখেছে? তাদেরই দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে দুজনকে, পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে। হাত নাড়ানোর সাধ্যি নেই। আর পা? সে তো আরও অসম্ভব। তার উপর ওই সাংঘাতিক কাচ্চা-বাচ্চার দল—কে চুল টানে, কে চিমটি কাটে আর বলে, ‘দেখ, দেখ, চোরটাকে ঠিক মানুষের মতো দেখতে!’
তাদের আর দোষ কোথায়? তারা কখনও এমন জলজ্যান্ত চোর দেখেনি।
ইতিমধ্যে ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন এসে ব্যাগ খুলে সব বের করে ফেলেছে। বিনোদের চোখের সামনেই বাচ্চার দল ড্রোনটার দখল নিল। গাদা গাদা সোনার কয়েন ঝলসে উঠল আবছা আলোয়। আর তাই দেখে সবার চোখ ছানাবড়া।
“কোত্থেকে সরিয়েছিস এত সোনা?”
বুড়ির জেরায় বিনোদ কোনোমতে তেতলার ঘরটাকে দেখাল। আর তখনই ম্যাজিকের মতো বুড়ির টার্গেট পালটে গেল। “বড়ো খোকা! এত সোনা তোর ঘরে কেন?”
বেশ মুশকো জোয়ান ‘বড়ো খোকা’ আমতা আমতা করতে লাগল, “না, মানে…”
“নিশ্চয়ই ব্যাবসার টাকা সরিয়েছিস! হতভাগা! তাই বলি, মাসে মাসে হিসেব মেলে না কেন?”
বিনোদের এত গর্বের সিঁদকাঠি তখল লজ্জায় মাটিতে পড়ে ছিল। কয়েনগুলো আঁচলে বেঁধে ট্যাঁকে গুঁজল বুড়ি, তারপর তার নজর পড়ল সেটার উপর।
“চুনো, সিঁদকাঠিটা দে দিকিনি।”
বুড়ি কোন এক নাতিকে হুকুম দেওয়ামাত্র চুনো নামধারী বাচ্চাটা তা তামিল করল। সেটাও ট্যাঁকে গুঁজে বুড়ি নিদান দিল, “তোরা আমার ঘরের চোর ধরেছিস, তাই ছেড়ে দিলুম। কিন্তু সাবধান! কোনোদিন এ তল্লাটে দেখলে আমার পাঁচ ছেলে তোদের কুচি কুচি করে কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়াবে।”
ছাড়া পেয়ে আর কে দাঁড়ায়! দুই স্যাঙাত সিধে দৌড় লাগাল। সে দৌড় থামল একেবারে স্টেশনে পৌঁছে। ফার্স্ট ট্রেন আসার প্রায় সময় হয়ে গেছে।
***
বাসিনী এখন খুব খুশি। বিনোদ আর ‘নিয়মরক্ষার’ কথা মুখেও আনে না। তবে তার এই সুমতির কারণটা অবশ্য সে জানে না, জানবেও না কোনোদিন।
সন্ন্যাসীর দেওয়া সিঁদকাঠিও যে হেরে যেতে পারে, সেটা মেনে নিতে আজও বিনোদের কষ্ট হয়।
ছবি-মৌসুমী
দারুন, দারুন, দারুন।
LikeLike