অনুবাদ গল্প-আকাশদীপ-জয়শঙ্কর প্রসাদ- রাজীবকুমার সাহা-শরৎ ২০২১

রাজীবকুমার সাহার অন্যান্য গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ 

golpoakashdeep

“বন্দি! অ্যাই বন্দি!”

“আহ্, ঘুমোতে দাও না!”

“মুক্তি চাও?”

“উম? এখন নয়। ঘুম থেকে উঠি, তারপর।”

“আর কিন্তু সুযোগ পাবে না। ভেবে দেখো।”

“উহুহু, বড্ড শীত পড়েছে গো। একটা কম্বল অন্তত যদি কেউ দিত তো…”

“ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে। এই সুযোগ। আজ আমার বাঁধন আলগা।”

“অ্যাঁ! তুমিও বন্দি নাকি?”

“হ্যাঁ। গলা তোলো না, আস্তে। এই নৌকোয় দশজন নাবিক ও প্রহরী রয়েছে কেবল।”

“অস্ত্র মিলবে কিছু?”

“পেয়ে যাবে। বন্দরে নোঙরের কাছি কেটে ফেলতে পারবে?”

“হুম।”

সমুদ্রে তখন উথালপাতাল ঢেউ। দুই বন্দি একে অপরের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছিল নৌকোর দুলুনিতে। প্রথম বন্দি কোনোরকমে নিজেকে মুক্ত করে নিতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় বন্দির বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে। নিকষ অন্ধকার। একসময় দুজনেই মুক্ত হয়ে আলিঙ্গনবদ্ধ হতেই মুহূর্তেই ছিটকে গেল প্রথম বন্দি। আশ্চর্য কণ্ঠে অনুচ্চ স্বরে বলে উঠল, “এ কি! তু-তুমি স্ত্রীলোক?”

শান্ত কণ্ঠে উত্তর এল, “কেন? স্ত্রীলোক হওয়া কি পাপ?”

“নাম কী তোমার?”

“চম্পা।”

কালো আকাশে সহস্র আলোকমালা জ্বলজ্বল করছে। বাতাস বইছে জোর। সমুদ্রের বুকে সুউচ্চ ঢেউয়ের আন্দোলন। মোচার খোলার মতো নৌকোখানা উঠছে, পড়ছে। চম্পা ঢেউয়ের ছন্দে দুলে চলেছে। আচমকা বেপরোয়া এক নাবিকের গায়ে ধাক্কা খেয়েই সামলে নিল নিজেকে। ততক্ষণে সে-নাবিকের তলোয়ারখানা হাতে চলে এসেছে তার। ফের দুলতে দুলতে বন্দির কাছে ফিরে গেল সে। সহসা বন্দর-তীর থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল একটা, “তুফান! তুফান উঠেছে!”

তূর্য বাজিয়ে বিপদসংকেত জানানো হচ্ছে। সবাই অতিমাত্রায় সতর্ক হয়ে উঠল এইবারে। বন্দি যুবক যেমনটা ছিল তেমনই পড়ে রইল নৌকোয়। আতঙ্কিত নাবিকেরা কেউ নৌকোর কাছি সামলাচ্ছে, কেউ-বা পাল নামিয়ে আনছে। একটা মোটা কাছি ততক্ষণে বন্দর-তীরে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে। বন্দি যুবক এই টালমাটাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে গড়াতে গড়াতে সেই কাছির কাছে গিয়ে উপস্থিত হল সন্তর্পণে।

আকাশের তারারা কালো মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে। একের পর এক উদ্বেল ঢেউ সমুদ্রের বুকে গর্জন তুলছে। কোন এক ভয়ংকর পিশাচী যেন অট্টহাস্যে সে-নৌকো হাতে তুলে নিয়ে খেলায় মেতেছে। দুই বন্দিও একে অপরের চোখে চোখ রেখে হেসে উঠল সশব্দে। প্রলয় ঝড়ের হাহাকারের মধ্যে সে শব্দ কারও কানে গেল না।

দুই

অনন্ত জলরাশির বুকে ঊষার মধুর আলো ফুটে উঠেছে। রুপোলী রশ্মি ভাঙা ঢেউয়ের মাথায় লেগে চিকচিক করছে। সমুদ্র শান্ত হয়েছে। নাবিকেরা বিভীষিকার ঘোর কাটিয়ে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল, বন্দরের চিহ্নমাত্র দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, বন্দিরা মুক্ত।

নাবিক সর্দার জিজ্ঞেস করল, “বুধগুপ্ত! তোমায় মুক্ত করল কে?”

তলোয়ার নির্দেশ করে বুধগুপ্ত উত্তর দিল, “সে।”

“বেশ। ফের বন্দি করা হল তোমায়।”

“কী কারণ, সর্দার? বন্দর অধ্যক্ষ মণিভদ্র উপস্থিত সমুদ্রের অতলে শায়িত। এই নৌকো এখন আমার অধীন।”

“তোমার? তোমার, জলদস্যু বুধগুপ্ত? অসম্ভব।” সর্দার নিজের তলোয়ারের সন্ধান করল।

চম্পা আগেই তা সরিয়েছে। নিষ্ফল আক্রোশে দাঁতে দাঁত পিষতে লাগল সর্দার।

“এবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হও সর্দার। যে জয়ী হবে সে-ই হবে এই নৌকোর মালিক।” এই বলে বুধগুপ্ত চোখে ইঙ্গিত করতেই চম্পা সর্দারের তলোয়ার ছুড়ে দিল তার দিকে।

বুধগুপ্ত সামান্য হেসে বলল, “এইবার বলো সর্দার, কী অভিপ্রায়।”

“বরুণদেবকে সাক্ষী রেখে আজ এই মুহূর্তে আপনার বশ্যতা স্বীকার করলাম।” চোখ নামিয়ে নিল সর্দার।

তৃপ্ত হেসে সরে এল বুধগুপ্ত। চম্পা টলটল চোখে সামনে দৌড়ে এসে বুধগুপ্তর ক্ষতস্থান পরীক্ষা করতে লাগল।

সামান্য বিশ্রাম শেষে বুধগুপ্ত প্রশ্ন করল, “উপস্থিত কোনদিকে রয়েছি আমরা বলতে পারো?”

“বালিদ্বীপ থেকে অনেকটা দূরে। সম্ভবত নতুন এক দ্বীপের কাছাকাছি। সিংহলের বণিকদেরই শুনেছি সে দ্বীপে আসাযাওয়া রয়েছে একমাত্র।”

“ক’দিন লাগবে সে-দ্বীপে পৌঁছতে?”

“বাতাস অনুকূল থাকলে দিন দুই। সে অবধি খাদ্যের অভাব হবে না।”

সর্দার নাবিকদের দাঁড় টানার নির্দেশ দিল তখুনি। আর হাল ধরে বসে পড়ল নিজে। বুধগুপ্তর প্রশ্নের উত্তরে জানাল, “এখানে এক ডুবোপাহাড় রয়েছে। সতর্ক না থাকলে নৌকো ধাক্কা মারার ভয় আছে।”

তিন

“আচ্ছা, এরা তোমায় বন্দি করল কেন?”

“বণিক মণিভদ্রের লালসায়।”

“থাকো কোথায় তুমি?”

“জাহ্নবীর তটে। চম্পা নগরীর এক ক্ষত্রিয় বংশে জন্ম আমার। বাবা এই মণিভদ্রের কাছে প্রহরীর চাকরি করত। জলে জলে কাজ। মার মৃত্যুর পর আমিও বাবার নৌকোয় উঠলাম এসে। আট বছর ধরে সমুদ্রই আমার ঘরবাড়ি। তুমি যখন আক্রমণ করলে তখন আমার বাবা তোমার দলের সাত দস্যুকে মেরে জল সমাধি নিল। একমাস হল আমি ওপরে এই নীল আকাশ আর নীচে নীল জলরাশির মাঝে অসহায় দিনযাপন করছি। মণিভদ্র আমাকে একদিন নোংরা প্রস্তাব দিল। প্রত্যুত্তরে যা মুখে আসে তাই গালাগাল দিলাম। আর সেদিন থেকেই বন্দি আমি।” আক্রোশে ফুঁসছিল চম্পা।

লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে বুধগুপ্ত জানাল, “আমিও তাম্রলিপ্তের এক ক্ষত্রিয়, চম্পা। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে জলদস্যু হয়ে জীবন কাটাচ্ছি। উপস্থিত কী করবে ভাবলে কিছু?”

“অদৃষ্টকে অনির্দিষ্টের পথেই ছেড়ে রেখেছি। সে যেদিকে নিয়ে যায় যাবে।”

চম্পার চোখে চোখ রেখে এই মৃত্যুদূত দস্যুরও অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। অজান্তেই একটা সম্ভ্রমপূর্ণ শ্রদ্ধা মনে জেগে উঠল চম্পার প্রতি। সমুদ্রের বুকে রাগ-রঞ্জিত সন্ধ্যা ধীরে ধীরে আঁচল বিছিয়ে দিচ্ছিল। চম্পার ঘন এলো চুল তার পিঠের ঢালে ছড়িয়ে আছে। দুর্দান্ত জলদস্যুর অপলক দৃষ্টি আটকে আছে কোমল অথচ অনমনীয় এক যুবতীর মুখমণ্ডলে। থির থির করে কেঁপে উঠছে তার অন্তরাত্মা।

এমনি সময় সর্দার জোর গলায় বলে উঠল, “আমরা সে দ্বীপের কাছে পৌঁছে গেছি।”

সৈকতে নৌকো ধাক্কা খেল। চম্পা লাফিয়ে নামল। নাবিকেরাও নেমে এল একে একে। বুধগুপ্ত পেছন থেকে হেঁকে বলল, “এ দ্বীপের যেহেতু কোনও নাম নেই, তাই আজ থেকে সে চম্পা-দ্বীপ।”

চম্পা তার হংসগ্রীবা ঘুরিয়ে ফিক করে হেসে উঠল।

চার

পাঁচ বছর পর।

শরতের রাতের আকাশে রুপোলী নক্ষত্রের আলোকসজ্জা। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। পুষ্পে পত্রে লতাকুঞ্জে শারদলক্ষ্মীর আশীর্বাদ ঝলমল করছে।

চম্পা দ্বীপের এক উচ্চ সৌধে বসে এক তরুণী দীপমালা রচনা করে চলেছে। অভ্রস্বচ্ছ বাতিদানে প্রদীপ জ্বালিয়ে তার সুকুমার আঙুল রশি টেনে ধরল। বাতিদান মাটি ছেড়ে আকাশে পাড়ি দিল। পুলকিত চোখদুটো সেদিকপানে দৃষ্টি ফেলে রেখেছে নির্নিমেষ। রশি ধীরে ধীরে টানছিল সে। তরুণীর আকাঙ্ক্ষা, তার আকাশদীপ যেন নক্ষত্ররাজিকে আলিঙ্গন করে। কিন্তু তা অসম্ভব। আশাহত চোখ সে ফিরিয়ে আনল নীচে।

সামনে দিগন্তপ্রসারী জলরাশিতে রজত চূর্ণ অনুপম খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় অজস্র হিরেকুচি ঝিকমিক করছে। দূর থেকে ভেসে আসা জেলেদের বাঁশির আলাপ চারদিক মুখরিত করে তুলেছে। ভাঙা ঢেউয়ে টুকরো হয়ে যাওয়া সে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে আনমনা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়াল। কাউকে কাছাকাছি দেখতে না পেয়ে ডাক দিল, “জয়া!”

শ্যামা এক যুবতী হাসিমুখে সামনে দাঁড়াল এসে। মেয়েটি আদিবাসী। নীল আকাশের মতো মুখে উজ্জ্বল নক্ষত্রের সারির মতো দাঁত। বুধগুপ্তর আদেশে সে এই তরুণীকে রানি বলে সম্বোধন করে।

তরুণী আদেশ করল, “মহানাবিক কখন ফিরবেন বাইরে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করে আয় তো।”

জয়া চলে গেল।

দূর থেকে ছুটে আসা বাতাস তরুণীর আঁচল নিয়ে খেলা করছিল। বড়ো উদাস আজ তার মন। এমনি সময় দীর্ঘকায় এক পুরুষ পিঠে হাত রেখে চমৎকৃত করে দিল তাকে। তরুণী সহসা ফিরে অস্ফুটে উচ্চারণ করল, “বুধগুপ্ত!”

“পাগল হয়ে গেলে নাকি? সেই কখন থেকে শুনলাম এখানে বসেই দীপ জ্বালিয়ে চলেছ! এসব কি তোমায় সাজে?”

বঙ্কিম হেসে তরুণী জবাব দিল, “এটুকুও কি দাসীদের দিয়ে করাতে বলো? আত্মতৃপ্তি বলতে কিছুই থাকতে নেই আমার?”

“আমার হাসি পায়, জানো? দীপ জ্বেলে তুমি কাকে পথ দেখাতে চাও? তোমার ঈশ্বরকে?”

মুখ ফিরিয়ে নিল তরুণী। বলল, “হ্যাঁ। তিনি ভুল পথে বিচরণ করছেন। নইলে পাষণ্ড জলদস্যু বুধগুপ্তকে এত ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দেবেন কেন?”

“তাতে ক্ষতিটা কী হল, দ্বীপ অধীশ্বরী চম্পারানি?”

অসহিষ্ণু কণ্ঠে উত্তর এল, “এই বন্দিগৃহ থেকে আমায় মুক্তি দাও বুধগুপ্ত! এখন তো বালি, জাভা, সুমাত্রার যাবতীয় বাণিজ্যে কেবল তোমারই অধিকার, মহানাবিক! তবে সেসব দিনগুলোর স্মৃতি এখনও আমার কাছে উজ্জ্বল যখন তোমার কাছে শুধু নৌকো ছিল একটা আর এই চম্পা দ্বীপের উপকূলে তাতে সওদা ওঠানামা করে আমাদের সুখের দিনগুলো কাটত। কতবার এই সওদা-ভর্তি আমাদের নৌকো প্রভাতের আলোয় সাগর পাড়ি দিয়েছে, বলো। মনে পড়ে বুধগুপ্ত, সেই অনন্ত নির্জনে জলের বুকে যখন মাঝি ঘুমিয়ে পড়ত, আলো নিভে যেত, রাতের আকাশের বুকে নক্ষত্রের সেই মধুর আলো…”

“চম্পা! তখন প্রায় নিঃস্ব ছিলাম। এখন চাইলে তার চেয়েও হাজার গুণ সুখে সুখী করতে পারি তোমায়। তুমি শুধু আমার প্রাণদাত্রীই নও, আমার সর্বস্ব।” মৃদু কম্পন উঠল বুধগুপ্তর কণ্ঠে।

চম্পার ঠোঁটে বিষাক্ত হাসি। “বুধগুপ্ত, তুমি দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করেছ বটে, তবে সেই তৃষ্ণা, হিংস্রতা রয়ে গেছে যেমনটা তেমনই। তুমি ঈশ্বর মানো না। আমার আকাশদীপকে নিয়েও ব্যঙ্গ করতে ছাড়ো না। ভেবে দেখো নাবিক, প্রচণ্ড ঝড়ে একটুকরো আলোর জন্যে একসময় কতটা ব্যাকুল ছিলাম দুজনে। মনে আছে, যখন ছোটো ছিলাম, বাবা প্রহরীর কাজে সমুদ্রে যেত আর মা বাঁশের ছোট্ট ঝাঁপিতে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাগীরথীর তীরে বাঁশের আগায় টাঙিয়ে রাখত। প্রার্থনা করে বলত, ‘হে ঈশ্বর! আমার পথভ্রষ্ট নাবিককে তুমি পথ দেখিও।’ আর বাবা যখন বছরভর পর ফিরে আসত, বলত, ‘সাধ্বী! তোমার প্রার্থনার জোরে ফিরে এসেছি আমি।’ সে তুমি বুঝবে না নাবিক, এ সেই পুণ্য স্মৃতিচারণ আমার। আমার বীর পিতার অকালমৃত্যুর কারণ তুমিই, জলদস্যু! পথ ছাড়ো।”

চম্পার সুকোমল মুখখানা সহসা ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। মহানাবিক চম্পার এই রূপ কখনও চাক্ষুষ করেনি। কোনোমতে, “চম্পা, আমি গেলাম।” বলে ফিরে যায় সে। চম্পা আক্রোশে দু-মুঠো শক্ত করে বিক্ষিপ্ত পদচারণা শুরু করে।

পাঁচ

নির্জন উপকূলে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে চলেছে সমুদ্র হিল্লোল। পশ্চিম দিগন্তের পথিক ক্লান্ত দেহে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্র জলে। জ্যোতি ম্লান। চম্পা আর জয়া ধীর পায়ে তটে এসে উপস্থিত হয়েছে। জল ছুঁয়ে উঠে আসা তীব্র বাতাস আন্দোলিত করে চলেছে তাদের পরিধেয়। জয়ার ইশারায় ছোট্ট একখানা পানসি এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। দুই নারী তাতে উঠে বসতেই মাঝি নেমে দাঁড়াল। জয়া নাও বাইতে শুরু করল। চম্পা আজ সমুদ্রের নির্লিপ্ত উদাস পরিবেশে নিজেকে বিলীন করে দিতে চাইছে। মনের অতলে জাগছে উত্তাল ঢেউ। সে থেকে কে যেন চিৎকার করে বলে চলেছে, ‘এই জল! এত শীতল! অথচ অন্তরে এত অগ্নিদাহ!’ কোন এক আরক্ত প্রতিবিম্ব যেন জ্বলতে জ্বলতে ধীরে ধীরে সিন্ধুজলে বিলীন হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে চম্পা। দেখে, মহানাবিকের বজরা কখন পানসির কাছে এসে ভিড়েছে। বুধগুপ্ত ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিল। চম্পা উঠে এল বজরায়।

“এত ছোটো নায়ে সাগরে ভেসেছ? ভয় নেই তোমার? সে বিপজ্জনক ডুবোপাহাড় কাছাকাছিই রয়েছে যে! যদি ওতে ধাক্কা খেত পানসি!”

নির্লিপ্ত কণ্ঠের উত্তর এল, “সে একদিকে ভালোই হত বুধগুপ্ত। জলের কঠিন দেওয়ালে বন্দি থাকার চেয়ে বরং…”

“আহ্, চম্পা! এতটা নির্দয় তো ছিলে না তুমি! বুধগুপ্তকে একবার আজ্ঞা দাও, দেখো সে কী না করতে পারে। যে তোমার জন্যে একটা নতুন দ্বীপ গড়ে তুলতে পারে, নতুন প্রজা জোগাড় করে নতুন রাজ্য স্থাপন করতে পারে, তার একটিবার পরীক্ষা নিয়েই দেখো না। কী চাও চম্পা? বুকে খঞ্জর বসিয়ে সে তার হৃদয়-পিণ্ড তুলে এনে এই মুহূর্তে জলে বিসর্জন দিক? বলো!”

মহানাবিক, যার নামে বালি, জাভা এবং চম্পা দ্বীপের আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে সে উপস্থিত হাঁটু গেড়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে চম্পার মুখে।

এই বিস্তীর্ণ জলদেশের পাহাড়শ্রেণির শিখরের সবুজ বন, নীল পিঙ্গল সন্ধ্যা যেন কোন এক মোহিনী সৃষ্ট মায়াবলের অভেদ্য কুহক। সে সারা অন্তরীক্ষ যেন মায়া মদিরায় সিক্ত করে তুলেছে। প্রস্ফুটিত নীল কমলে ভরে তুলেছে চতুর্দিক। তারই সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে চম্পা তড়িৎবেগে বুধগুপ্তর দুই হাত চেপে ধরেছে।

চেতনা ফিরতেই সহসা কোন গোপন স্থান থেকে এক খঞ্জর বের করে আনল চম্পা। কঠিন স্বরে জানাল, “বুধগুপ্ত, আজ আমি এই মুহূর্তে আমার প্রতিশোধের শস্ত্র সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। ছলনা করেছে এই মন, ধোঁকা দিয়েছে বারংবার।”

মুহূর্তে চম্পার খঞ্জর সমুদ্রের হৃদয় বিঁধে ডুবে গেল অতলে।

চমকে ওঠে কম্পিত কণ্ঠে বুধগুপ্ত প্রশ্ন করে, “তাহলে আজ থেকে বিশ্বাস করতে পারি আমায় তুমি ক্ষমা করলে, চম্পা?”

“বিশ্বাস! না, বুধগুপ্ত। নিজের মনকেই যখন বিশ্বাস করতে পারিনি, প্রতারিত হয়েছি, তখন সে আশ্বাস দিই কীভাবে, বলো? আমি তোমাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করি বুধগুপ্ত, অথচ দেখো, তোমার জন্যে মৃত্যুকেও জড়িয়ে ধরতে পারি। অন্ধকার করে দিলে জীবনটা আমার, অথচ দেখো, ভালোবাসি সেই তোমাকেই।” কান্নায় ভেঙে পড়ে চম্পা।

স্বপ্ন-রঙিন সে সন্ধ্যা সহসা থমকে গেল যেন। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বুধগুপ্ত বলল, “জীবনের এই পুণ্যতম ক্ষণের স্মৃতিরক্ষায় এক দীপস্তম্ভ তৈরি করব, চম্পা। ওই পাহাড়ের গায়ে। যদি আমার জীবনের কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যাগুলো আলোয় ভরে ওঠে তাতে।”

ছয়

চম্পা দ্বীপের অন্যদিকে মনোরম এক শৈলমালা রয়েছে। অনেক দূরে গিয়ে সিন্ধুজলে নেমে গিয়েছে সে। সমুদ্রের উচ্ছল চঞ্চল তরঙ্গ রাশি তার গায়ে আছড়ে পড়ে এক নিসর্গের সৃষ্টি করে চলে। সে শৈলমালার গায়ে আদিবাসীদের উৎসব চলেছে আজ। সবাই মিলে চম্পাকে এরা বনদেবীর সাজে সাজিয়েছে। তাম্রলিপ্তের বহুসংখ্যক সৈনিক নাবিক দ্বারা পরিবেষ্টিত বন-কুসুম বিভূষিত চম্পা সুসজ্জিত শিবিকায় চলেছে।

শৈলশ্রেণির সুউচ্চ এক শিখরে চম্পা দ্বীপের নাবিকদের পথনির্দেশের উদ্দেশ্যে সুদৃঢ় এক বাতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। আজ তারই উদঘাটন উৎসব। স্তম্ভের মূল দ্বারে দাঁড়িয়ে ছিল বুধগুপ্ত। চম্পার হাত ধরে শিবিকা থেকে নামিয়ে আনল সে তাকে। দুজনে ভেতরে পা রাখতেই বাঁশির সুরে ঢোলক বোল তুলেছে। নৃত্যশিল্পীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দুজনের মাথায় ফুল ছিটিয়ে নাচতে শুরু করেছে।

দীপস্তম্ভের সর্বোচ্চ বাতায়নে দাঁড়িয়ে চম্পা আশ্চর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “এ কী রে, জয়া! নীচে এত মেয়ে জড়ো হল কোত্থেকে?”

“বাহ্ রে, আজ আমাদের রানির বিয়ে না!” বলেই হাসতে লাগল জয়া।

বুধগুপ্ত পাশেই রয়েছে। চারদিকের বিস্তৃত জলরাশির শোভায় সে মগ্ন ছিল তখন। বিচলিত চম্পা আচমকা তাকে ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে উঠল, “এ কি সত্যি, বুধগুপ্ত? জবাব দাও!”

“তোমার সম্মতি থাকলে তা সত্যিও হতে পারে চম্পা। বছরের পর বছর ধরে অগ্নিকুণ্ড জ্বলে চলেছে বুকে চম্পা, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।” বুধগুপ্তের করুণ আর্তি প্রবেশ করল চম্পার কানে।

“চুপ করো! চুপ করো মহানাবিক! নিঃসহায় পেয়ে আমার ওপর প্রতিশোধের আয়োজন করেছ তুমি?”

“আমি তোমার পিতার হত্যাকারী নই চম্পা! অন্য এক দস্যুর হাতে প্রাণ গেছে তাঁর।”

“হা ঈশ্বর! আমি এ-কথা যদি বিশ্বাস করতে পারতাম বুধগুপ্ত, তবে ভেবে দেখো সেদিনটা কত উজ্জ্বল হত। এই নিষ্ঠুরতার মাঝেও কত মহান হতে তুমি।”

জয়া নীচে চলে গিয়েছিল আগেই। স্তম্ভের এই নির্জন সংকীর্ণ কক্ষে ওরা দুজন শুধু বসে ছিল একে অপরের মুখে দৃষ্টি রেখে।

সহসা বুধগুপ্ত উঠে এসে চম্পার পাদুটো জড়িয়ে ধরল। বলতে লাগল, “চম্পা, জন্মভূমি ভারতবর্ষ থেকে কত দূরে এই নিরীহ আদিবাসীদের কাছে ইন্দ্র আর শচী জ্ঞানে পূজিত হচ্ছি আমরা। অথচ কে জানে কোন অভিশাপে আমরা দুজনে আজও এক হতে পারিনি। জন্মভূমি নিরন্তর আকর্ষণ করে চলেছে আমাকে। অথচ এখান থেকে এক পাও নড়ার ক্ষমতা নেই আমার। চেয়ে দেখো, এতকিছু অর্জন-প্রাপ্তির পরেও আমার চেয়ে নিঃস্ব আর নেই কেউ। এই পাষাণ হৃদয় আজ তোমার স্পর্শে চন্দ্রকান্তমণির মতো দ্রবীভূত।

“চম্পা, আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, পাপপুণ্য মানি না, দয়ামায়ার ভাষা বুঝি না। পরলোকেও বিশ্বাস রাখি না। অথচ আজ দেখো, হৃদয়ের কোন দুর্বল অংশে যেন সেসব চোরের মতো নিঃশব্দে প্রবেশ করে তিলতিল করে গ্রাস করে নিচ্ছে আমাকে। কে জানে কেমন করে উজ্জ্বল এক তারার মতো তুমি আমার শূন্য হৃদয়ে উদিত হয়েছ। আলোকের এক কোমল রেখায় আজ উজ্জ্বল আমার হৃদয়। পশুবলি আর ধনের নিষ্ঠুর উপাসকের মনের গভীরে শান্ত অথচ একান্ত এক কামনা উঁকি দিয়ে চলেছে অহোরাত্র।

“যাবে চম্পা, ধনদৌলত সব এই সমুদ্র তটে বিসর্জন দিয়ে আমাদের সেই জন্মভূমির কোলে? আজ আমাদের চার হাত এক করে ফেলে কালই চলো না সুমহান ভারতবর্ষের পথে রওনা হই। মহানাবিকের আজ্ঞা সমুদ্রের প্রতিটা ঢেউ মেনে চলে। তারাই আমাদের পৌঁছে দেবে নিরাপদে। বলো, যাবে?”

বুধগুপ্তের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে এল চম্পা। কোন স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর সম্বিৎ ফিরে আসতেই বলে উঠল, “বুধগুপ্ত, আমার কাছে সব ভূমিই মাটি মাত্র। সব জল তরল মাত্র। সব বায়ুই শীতল। কোনও বিশেষ আকাঙ্ক্ষাও আজ আর বেঁচে নেই আমার। সবকিছু মিলে আমার জীবন উপস্থিত এক শূন্য বিশেষ, তার বেশি কিছু নয়।

“প্রিয় নাবিক! তুমি স্বদেশে ফিরে যাও। বৈভবের সুখ উপভোগ করো।”

“আর তুমি, চম্পা!” কেঁপে উঠল বুধগুপ্তের কণ্ঠস্বর।

দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর এল, “আমাকে রেখে যাও এই সহজসরল বন্য আদিবাসীদের সুখে দুঃখে সহানুভূতি নিয়ে সাধ্যমতো পাশে থাকার জন্যে।”

অল্পক্ষণের নিস্তব্ধতা। বুধগুপ্ত উক্তি করল, “বেশ। তাই হবে। আমি ফিরে যাব ভারতবর্ষে। এখানে বাস করলে কে জানে নিজের হৃদয় বশে রাখতে পারব কি না। পারলেও তা কতদিন? আহ্, ওই ভয়ংকর তরঙ্গ রাশি যদি টেনে নিত সেদিন আমাকে।”

ফের প্রশ্ন করল, “তুমি এখানে একা কী করবে, চম্পা?”

উত্তর এল, “প্রথমে ভেবেছিলাম এই দীপস্তম্ভে আলো জ্বেলে এই জলরাশিতে আমার বাবার সমাধি খুঁজে বেড়াব। তারপর ভেবে দেখলাম, কী লাভ তাতে? সেই তো একদিন আমাকেও এই আকাশদীপেই বিলীন হতে হবে।”

সাত

এক সোনালি প্রভাতে চম্পা তার দীপস্তম্ভে দাঁড়িয়ে ছিল বাতায়ন ধরে। সামুদ্রিক নৌকোর একটা দল দ্বীপের উপকূল ছাড়িয়ে পশ্চিম-উত্তরের পথ ধরে ভেসে চলেছে। চম্পার দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল গালে।

সেই কত শতাব্দী আগের এই আখ্যান। সেই দীপস্তম্ভে আজীবন আলোকমালা রচনা করে গিয়েছিল চম্পা। শত শত বছর ধরে দ্বীপবাসীরা দেবী জ্ঞানে পুজো করত চম্পাকে। তারপর একদিন কালের কঠোর হাত চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল সেই দীপস্তম্ভকেও।

ছবি- প্রদীপ গোস্বামী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

6 thoughts on “অনুবাদ গল্প-আকাশদীপ-জয়শঙ্কর প্রসাদ- রাজীবকুমার সাহা-শরৎ ২০২১

  1. এত ঝরঝরে অনুবাদ! এই রকম গল্পগুলোর জন্য যেমন করে বলা দরকার তেমনই বলা। খুব ভালো লাগল ।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s