যূথিকা আচার্য্যের আগের গল্প-শতবর্ষ পরে
বুড়ো লদিজকিনকে তিচকি গাঁয়ের সবাই ডাকে পাগলা দাদু বলে। আর সত্যি কথা বলতে কী, পাড়ার লোককেও বড়ো একটা দোষ দেওয়া যায় না। অমন খিটমিটে স্বভাবের বুড়ো পুরো তল্লাটে আর একখানাও নেই। লদিজকিন বুড়ো হাসতে জানে না, উলটে পাড়ার লোকজনকে কোনো কারণে আনন্দ করতে দেখলেই চিৎকার করে গালমন্দ করতে শুরু করে। লোকজন আগে বিরক্ত হত, কিন্তু এখন তারাও কিছু বলা ছেড়ে দিয়েছে। দূর, ওই খ্যাপা বুড়োকে কিছু বলতে যাওয়া বৃথা! উলটে পাড়ার দুষ্টু ছেলেমেয়েরা এখন সুযোগ পেলেই বুড়োর গায়ে জল ছিটিয়ে দেয়, বুটজুতোর মধ্যে ব্যাঙ ঢুকিয়ে রাখে। আর বুড়ো যখন দাঁত কিড়মিড় করে চেঁচায়, ‘জাহান্নামে যা সব খুদে শয়তান, ধরতে পেলে একটাকেও আস্ত রাখব না!’ বাচ্চারা তখন পাঁচিলের পেছনে লুকিয়ে হাততালি দিয়ে হি হি করে হাসে। বুড়ো অনেকক্ষণ ধরে চিল্লামিল্লি করে ক্লান্ত হয়ে গেলে শেষটায় লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে নিজের কুঁড়েঘরে ঢুকে জবুথবু বসে থাকে।
লদিজকিন বুড়োর অবস্থা কিন্তু মোটেই এমন ছিল না আগে। হ্যাঁ, মানছি ছেলে-মেয়ে-বৌ মানে পরিবার বলতে আমরা যা যা বুঝি সেসব তার কোনো কালেই ছিল না, কিন্তু তার পুষ্যি নেওয়া নাতি পেতিয়াকে নিয়ে বুড়ো বেশ খুশিই ছিল। পেতিয়া যখন এই এত্তটুকুনি ছোট্টো ছিল, বুড়ো তাকে কোথায় যেন কুড়িয়ে পেয়েছিল। অবশ্য বুড়োকে যদি তুমি এই ব্যাপারে কিছু শুধাও, তবে একেকবার একেকরকম উত্তর পাবে। কখনো শুনবে খুদে পেতিয়া নাকি চার্চের দোরে চুপটি করে বসে ছিল; বুড়োকে দেখেই ‘দাদু দাদু’ বলে বুড়োর হাঁটু জড়িয়ে ধরেছিল। আবার কখনো বুড়ো বলবে অনেক লড়াই করে তুষার নেকড়েদের থাবার নীচ থেকে পেতিয়াকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে সে।
কিন্তু পাড়ার লোকেরা বলে ওগুলো সব বাজে কথা। বছর দশেক আগে বহু দূর দেশ থেকে আসা একদল বেদুইন পরিবার নাকি জঙ্গলের সীমানায় ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। গাঁয়ের লোকজন বারণ করেছিল অনেক, কিন্তু মাথামোটা বেদুইনের দল ভালো কথা শুনলে তবে তো! তাই যা হবার তাই হল। একদিন রাতে যখন বেদুইন দলের সবাই নাচ-গান করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল, তুষার নেকড়ের দল সুযোগ বুঝে আক্রমণ করল তখন। লোকজন সবাই ঘুমোচ্ছিল, তাই কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে যতক্ষণে গাঁয়ের লোকজন লাঠিসোটা বন্দুক নিয়ে ছুটে এল, ততক্ষণে আর বাঁচানোর মতো বিশেষ কিছু ছিল না। খান ছয়েক শরীর নেকড়ের দল টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে, আর বাকি সাতজনার ছেঁড়াখোঁড়া দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল এদিক ওদিক।
গাঁয়ের লোক কী আর করবে, যে ক’টা শরীর পড়ে ছিল ওখানে, সেগুলো কাপড়ে জড়িয়ে গ্রামের কবরখানায় কবর দিয়ে দিয়েছিল। মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোও হল আবার নেকড়ের দল যাতে ওই শরীরগুলোর লোভে আবার ফিরে না আসে সেদিকটাও দেখা হল। কিন্তু লদিজকিন দাদুর কপাল ভালো ছিল সেদিন বলতে হবে। সবাই গাঁয়ে ফিরে আসার পর দেখল বুড়ো লদিজকিন বেদুইনদের ছোট্ট একখানা খোকাকে পুঁটুলির মতো বেঁধে বুকে জড়িয়ে নিয়ে এসেছে। খোকাটা কোথায় ছিল কে জানে, বোধ হয় অতটুকুনি মানুষ দেখে নেকড়েগুলোও দয়া করে ছেড়ে দিয়েছিল। বুড়োর শীত পোশাকের ওমে আরাম পেয়ে খোকাটা নড়েচড়ে উঠল, আর সেই থেকে বুড়োও বাঁধা পড়ে গেল নাতির মায়ায়। আদর করে নাম রাখল তার পেতিয়া। চামচে করে ভেড়ার গরম দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েও রাখল ঠিক তাকে। কিন্তু লদিজকিন বুড়োর কপাল মন্দ। বছর সাতেক হতে না হতেই নাতিটি একরাত্রে বেমালুম পালিয়ে গেল এক সার্কাসের দলের সঙ্গে। গাঁয়ের সবাই এসে সান্ত্বনা দিল বুড়োকে, ‘বেদুইনের ছেলে কি আর আপন হয় গো দাদু, ওরা যে যাযাবরের জাত। বাঁধন যে রক্তে নেই ওদের।’
লদিজকিন বুড়ো শুনল সবার কথা ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে গুমরে মরছিল। কী এমন অন্যায় করেছে সে যে তার কপালে এতটুকুও সুখ দিল না ভগবান? টাকাপয়সা, পরিবার-পরিজন কিছুই তো ছিল না বুড়োর। সে নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগও করেনি সে। থাকার মধ্যে ছিল ওই এক কুড়িয়ে পাওয়া নাতি। তাও সইল না বুড়োর কপালে। পোড়া কপাল নিয়ে বলবেই বা কাকে! কথা বলার মতো আরেকটা মানুষও তো নেই বুড়োর কুঁড়েঘরে।
প্রতিদিন রাত্রিবেলা যখন চাঁদের আলো বরফের উপর পড়ে গলানো রুপোর মতো ঝকঝক করে, তিচকি গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো সবাই যখন অঘোরে ঘুমোয়, সবার অজান্তে বুড়ো তখন চুপিচুপি বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। মোমবাতি জ্বালায় ঘরে। তারপর ধীরে ধীরে পেতিয়ার জামাকাপড়ের পুঁটুলিখানা খুলে বসে। এক এক করে টেনে বের করে ছোট্টো দু-খানা পশমের পেন্টুলুন, খরগোশের চামড়ায় বানানো কান ঢাকা টুপি, ক্যাম্বিসের তৈরি ছেঁড়াখোঁড়া বুটজুতো একপাটি। সব লদিজকিনের নিজের হাতে তৈরি। কাঁচা হাতের সেলাই, কিন্তু খুব ভালোবেসে বানানো। জামা-জুতোগুলো বুকে জড়িয়ে নাক ডুবিয়ে গন্ধ নেয় বুড়ো। তারপর ভাবে, সাতটা বছরের এত স্নেহ সব কী করে এককথায় ভুলে গেল পেতিয়া! প্রতি বড়দিনে নতুন গল্প শোনার বায়না করত সে, নতুন জুতো নেই বলে মুখভার করে বসে থাকত। বানিয়ে বানিয়ে গল্প শুনিয়ে তবে গিয়ে রাগ গলত বাবুর। ব্যাঙ রাজপুত্তুরের গপ্পো, বোকা ইভান আর তার বৌ-এর গপ্পো, নেকড়ে মানুষের গপ্পো আর পেতিয়ার সব থেকে পছন্দের ছিল শীত-বুড়োর গপ্পো। প্রতিবার বড়দিনের আগে তার শীত-বুড়োর গপ্পো শোনা চাই-ই চাই।
‘শীত-বুড়ো থাকে হুইইইই উত্তরদিকে, ধবধবে সাদা রেশমের মতো দাড়ি তার, সাদা তুলোর মতো চুল। মস্তো বড়ো স্লেজ গাড়িতে চড়ে সে পুরো পৃথিবীর সব খোকাখুকিদের উপহার দেয় বড়দিনের রাত্রে। কিন্তু খবরদার, তুমি যদি দুষ্টুমি করো তাহলেই হবে মুশকিল।’
সে গল্প বার বার শুনেও শান্তি নেই। গল্প বলা শেষ হলে লদিজকিন দাদুকে আবার বলতে হবে শীত-বুড়ো দেখতে কেমন, কত লম্বা দাড়ি তার, স্লেজগাড়িখানার পাখা নেই, তাহলে হুশ হুশ করে আকাশে ওড়ে কী করে, ক’খানা হরিণ মিলে টানে গাড়িটা—আরো কত কত প্রশ্ন ছিল তার।
লদিজকিনের বুকখানা হু হু করে ওঠে। এত আদর, এত সোহাগের কোনো মানেই নেই তাহলে। আবার ভাবে, কেনই-বা থাকবে সে গরিব দাদুর কাছে? থাকার মধ্যে তো আছে শুধু এই ভাঙা কুঁড়েখানা তার কাছে। তাও শীতে হি হি করে ঠান্ডা হাওয়া ঢোকে, বর্ষায় চাল ফুঁড়ে জল পড়ে এখানে ওখানে। বাচ্চাটাকে ভালোমন্দ দু-বেলা পেট ভরে কিছু খেতে অবধি দিতে পারেনি সে কোনোদিন। তার থেকে বরং সার্কাসের দলই ভালো। আর কিছু না হোক পেতিয়া দু-বেলা পেট ভরে দু-মুঠো খেতে তো পাবে। কে জানে সার্কাসের খেলা যদি তেমন ভালোভাবে শিখতে পারে তাহলে হয়তো মাসমাইনেও পাবে হাতে। বুড়োর দু-চোখ বেয়ে, দাড়ি ভিজিয়ে জল গড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায়। বিড়বিড় করে সে বলে, “ভালো থাকিস বাছা আমার, ভালো থাকিস!”
আগেই বলেছি খিটখিটে স্বভাবের জন্য লদিজকিন দাদুকে কেউ তেমন পছন্দ করত না গ্রামে। খেটে খাওয়া চাষাভুষো লোকেদের গ্রাম তিচকি। লোকজন সন্ধে হতে না হতেই রুটি, পনিরের টুকরো আর সেদ্ধ আলু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কালেভদ্রে কেউ হরিণ শিকার করলে ঝলসানো মাংস আর ভদকা খেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে গাঁয়ের সকলে। বুড়ো লদিজকিনের দুঃখ বোঝে না লোকজন তা নয়, কিন্তু কার ঘরে দুঃখ নেই? গাঁয়ের সবাই হা-ঘরে। নুন আনতে রুটি ফুরায় সবার সংসারে। সেখানে বুড়োর এই দুঃখবিলাস একটু বাড়াবাড়িই মনে হয় সবার।
আচ্ছা বাপু বুঝলাম, তোমার পেয়ারের নাতি পালিয়েছে। কিন্তু সেজন্য রেগে গিয়ে কথায় কথায় অকারণে তুমি গাঁয়ের লোকেদের শাপমন্যি করবে, এ কেমনধারা কথা! গাঁয়ের লোক তো মেরে-ধরে ভাগায়নি তোমার নাতিকে। আর তাছাড়া গরিবগুর্বোদের আস্তানায় ঘর থেকে পালানো, ঠান্ডায় জমে কাঠ হয়ে বা ধনুষ্টঙ্কার হয়ে মরা এসব তো লেগেই আছে। তাই বলে কি নেই-আঁকড়া হয়ে বসে থাকলে চলবে? গ্রামের বিজ্ঞ লোকেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, সেদিক থেকে বুড়ো লদিজকিনের তো ভাগ্য ভালো, নাতি তার মরে হেজে যায়নি, সার্কাসের দলের সঙ্গে চলে গেছে। মরে গেলেই বা বুড়ো কী করত? সবাই বলে, ঠিক কথা, ঠিক কথা। যে নেই তার জন্য কান্নাকাটি করে হবেটা কী!
পুরো গাঁয়ে লদিজকিন দাদুর কষ্টটা যদি বোঝার মতো কেউ বুঝত তবে সে ছিল একজনই, সারেঙ্গ মাৎভেইচের মা-মরা বোবা মেয়ে ত্রিল্লি। সারেঙ্গ মাৎভেইচ জাহাজি মানুষ। রোদে পোড়া, পাকানো শরীর তার। কিন্তু দেখতে যেমনই হোক, সে তিচকি গাঁয়ের বেশ হোমড়াচোমড়া মানুষ একজন। যদিও গাঁয়ে সে থাকে বছরে মাত্র তিনমাস। আর যেটুকু সময় সে থাকে, বেশিরভাগটাই বুঁদ হয়ে থাকে ভদকার নেশায়। তবুও তার মাসমাইনের চাকরি, নাই নাই করে কুড়িখানা দেশ ঘুরেছে লোকটা, কত কত মজার মজার গল্প বলতে জানে। এইসব গুণগুলোও তো বাপু ফেলে দেওয়ার নয়। কিন্তু চাকরিওয়ালা বাপ থাকা সত্ত্বেও মাৎভেইচের খুদে মেয়ে ত্রিল্লির অবস্থা দেখলে বুঝি পাথর গলে যায়। সৎ মায়ের অত্যাচারে আর না খেতে পেয়ে ত্রিল্লির অবস্থা হয়েছিল ঠিক বেড়ালে খাওয়া মাথাসুদ্ধু মাছের কাঁটার মতো। গায়ে মেদ-মাংস নেই কোথাও। খালি চামড়ার নীচে জিড়জিড়ে ক’খানা হাড় আর বিনুনি করা ডিগডিগে গোল একখানা মাথা।
লদিজকিন দাদুর প্রতি যে কীসের এত আকর্ষণ ছিল তার তা ত্রিল্লি বোধ হয় নিজেও জানত না। তার নিজের কপালখানাও অমনি পোড়া বলেই কিনা কে জানে, বুড়ো লদিজকিনের শেষ বয়সের অসহায় অবস্থায় গাঁয়ের লোক তাকে বিদ্রূপ করত দেখে ত্রিল্লির বুকে যেন শেল বিঁধত। বেচারার মুখে বুলি দেননি ভগবান, কিন্তু কথা বলতে পারলে সে নিশ্চয়ই বলত, ‘আহা রে, একটা দুঃখী মানুষ, তাকে নিয়ে অমন হাসিঠাট্টা করে কেউ!’
ত্রিল্লি খালি মনে মনে মা মেরিকে বলে, ‘লদিজকিন দাদুর সব কষ্ট ঠিক করে দাও মা!’
বড়দিনের আগের দিন রাত্রে লদিজকিন বুড়ো তার স্বভাবমতোই বিড়বিড় করে শাপমন্যি করছিল সবাইকে আর মাঝে মাঝে নিজেকে শুধোচ্ছিল, ‘অনেক তো হল বুড়ো ভাম, এখনো বেঁচে আছিস কেন, জীবনের নেশা এখনো কাটেনি বুঝি! বুঝবি বুড়ো, বুঝবি তুই। এতেও যদি তোর সাধ না মেটে, তবে আর কী বলার আছে তোকে! কাল বড়দিন, গাঁয়ের কুকুর-বেড়ালগুলো অবধি আনন্দ করবে। আর গাঁয়ের লোক আমাকে একবার ডাকতে অবধি এল না। একবার তো বললেও পারত, ও দাদু, তুমিও এসে বসো আমাদের সঙ্গে, আমি কি আর না করতুম! মাংস, কেক, ফরাসি রুটি, ভদকা সেসবও না-হয় না-ই দিল, কিন্তু একবার বসতেও বলল না কেউ আমায়!’
বুড়ো হু হু করে কাঁদে আর খালি বলে, ‘ও ভগবান, আজ যদি আমার পেতিয়া থাকত, তবে কি এমন দশা হত আমার! সবার ঘরে আলো জ্বলছে, এত আনন্দে নাচ-গান করছে সবাই। ঠাকুর গো, আমার পেতিয়াকে ভালো রেখো। আজ যদি ও থাকত তবে কত আনন্দ করত, কুঁড়েটাকে আমিও সাজাতুম সবার মতো। কিন্তু পোড়া কপাল আমার…’
হঠাৎ ভাঙা দরজায় খুট খুট আওয়াজ শুনে দাদু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। কানে ভুল শুনল না তো? মানুষজন কেউ কি তাকে ডাকতে এল তবে! আবার ভাবল বুড়ো, হুহ্, অত ভাগ্যি কি আমার আছে যে লোকে আদর করে ডাকতে আসবে? বোধ হয় ভুল শুনেছি আর না-হয় হাওয়ায় ধাক্কা দিচ্ছে।
আবার খুট খুট করে আওয়াজ হল। দাদু কান খাড়া করে শুনল এবার। নাহ্, খুব দুর্বল আওয়াজ যদিও, কিন্তু স্পষ্ট কড়া নাড়ছে কেউ, হাওয়ার আওয়াজ নয়। দাদুর বুকখানা ধুকপুকিয়ে উঠল আনন্দে। কেউ কি তবে ডাকতে এল? নাকি পেতিয়া ফিরে এল!
বহু কষ্টে নুয়ে পড়া শরীরখানা টানতে টানতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেঁটে গিয়ে দরজা খুলল দাদু। নাহ্, কেউ ডাকতে আসেনি, পেতিয়াও ফেরেনি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্টো মেয়ে। মেয়েটার লাল রঙের সোয়েটারের হাতার নীচ থেকে বেরিয়ে এসেছে সরু সরু, রোগা কাঠির মতো হাত দু-খানা। মেয়েটার হাতে দস্তানা নেই, পরনের টুপিখানা জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। ঠান্ডায় নীল হয়ে যাওয়া খুদে মুখখানা দেখে লদিজকিন দাদু চোখ দু-খানা সরু করে তাকাল। “অ্যাই খুকি, তুই সারেঙ্গ মাৎভেইচের মেয়ে ত্রিল্লি না?”
হাসি মুখে উপর-নীচে মাথা নাড়াল ত্রিল্লি।
লদিজকিন দাদু প্রথমে ভাবল, এও বুঝি পাড়ার ওই দুষ্টু ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যেই একজন হবে। দুষ্টুমি করতে এসেছে। এক্ষুনি গায়ে জল ছিটিয়ে পালাবে। কিন্তু স্বভাবমতো খিটমিট করতে গিয়েও কেন জানি না গলায় কথা আটকে গেল বুড়োর। আহা রে, কেউ তো এসেছে তার ভাঙা ঘরে।
ওদিকে ত্রিল্লি ততক্ষণে তার সোয়েটারের ভেতর থেকে কাগজে জড়ানো কিছু একটা বের করে দাদুর হাতে দিল। দাদু কাগজ খুলে দেখে একটুকরো ঝলসানো মাংস, আর বেশ বড়ো একখানা পনিরের টুকরো। তারপর সেই মাংস আর পনির খেতে খেতে কত গপ্পো, কত গান হল। ত্রিল্লি কথা বলতে পারে না, তাতে কী হয়েছে? সে খুদে খুদে হাত-পা নেড়ে দাদুর গানের সুরে সুরে নাচ করে দেখাল, দাদুও একখানা কাঠের টুকরোকে মিছিমিছি বেহালার মতো কাঁধে চেপে ধরে মুখ দিয়ে মজার সুর তুলল, প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ…
দুই অসমবয়সী বন্ধুর আনন্দে টিমটিমে মোমবাতির আলোয় ভরা ভাঙা কুঁড়েঘরে যেন স্বর্গ নেমে এল। লদিজকিন দাদু বহুবছর পর বড়ো আনন্দে মন খুলে হেসে ত্রিল্লির মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল, “আর আমি ভাবি কিনা মা মেরি বোধ হয় এই বুড়োর কথা ভুলেই গেছেন। বেশ করেছিস দিদিভাই, তোর দাদুর কাছে এসেছিস। ভালো করে বস দিকিনি। চল তোকে শীত-বুড়োর গপ্পো শোনাই।
“শীত-বুড়ো থাকে হুইইইই উত্তরদিকে, ধবধবে সাদা রেশমের মতো দাড়ি তার, সাদা তুলোর মতো চুল…”
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস