ক্যানিং স্টেশান থেকে বাইরে বেরোতেই একগাল হেসে এগিয়ে এলো আরবাত।
“আসেন ছ্যার, আপনি যে সত্যি সত্যি আসবেন একথা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“কেন বিশ্বাস হচ্ছে না কেন?”
“ছ্যার আমাদের ছবি তো কত সাংবাদিক তোলে, ওনাদের জন্য কত পোজ দি। বলে ছবি পাঠাব, ঠিকানা নেয়। তারপর আর ছবি পাঠায় না। কাল রাতে যখন ফোনে বললেন আপনি আসবেন। তখন খানিক বিশ্বাস হোল। আজ মাঠে যাইনি। আপনাকে নিতে চলে এলাম ইস্টিশানে।”
এক ইঞ্চি কাঠের ফ্রেমে কাচ বাঁধানো ছবিটা তুলে দিতেই আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরল আরাবত। বেগুনি রংএর গেঞ্জি পরে, গলায় জোয়াল দেওয়া জোড়া বলদের লেজ কামড়ে ছুটন্ত বলদের পিঠের ওপর প্রায় শুয়ে আছে আরাবত। দু’পাশ দিয়ে কাদা জলের ফোয়ারা।
“আমার বউ খুব খুশি হবে এছবি দেখলে।”
“তোমার বউ কি জানে যে বলদ দৌড়ের মাঠ থেকে তুমি আসল দৌড়ের মাঠে যাচ্ছ?”
“ছ্যার কথাটা কি সত্যি?” আরাবতের চোখ দুটো যেন জ্বলছে।
“একদম সত্যি আরাবাত।তোমাদের এখানে যেদিন দৌড় দেখতে এসেছিলাম সেদিন আমার সাথে আমার এক বন্ধু সাইয়ের অ্যাথলেট কোচ দেবদত্ত দত্তও এসেছিলেন। কাদা মাঠে তোমার দৌড়ের গতি মেপে ও তোমার খুব প্রশংসা করেছিল। ওরা তোমার সাথে যোগাযোগ করবে, যদি তুমি রাজি থাক ওরা তোমাকে ট্রায়ালে ডাকবে। ট্রায়ালে উৎরালে ওরা তোমাকে সল্টলেকে সাইয়ের ক্যাম্পে রেখে ট্রেনিং দেবে।সেখান থেকে তুমি রাজ্যস্তর, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে দৌড়নোর সুযোগ পাবে।”
“সত্যি ছ্যার, কিন্তু এসব টেরনিং করতে তো অনেক টাকা লাগবে। চাষা মানুষ পাব কোথায়?”
“আরে না না সব খরচ সরকারের। সাই একটা সরকারি সংস্থা।”
“তা হলে আসি আরাবাত! কলকাতা ফেরার ট্রেনের সময় হয়ে এল।”
“ছ্যার এখন যাওয়া হবিনি। আমার বউ আপনার জন্য মৌরলা মাছের টক আর ট্যাংরা মাছ রেঁধে রেখেছে। সব আমাদের পুকুরের। আপানার মুখ থেকে ছাইএর খবরটা শুনলে ও বিশ্বাস করবে। কাল নাকি খবরটা কাগজে বেইরেছিল। আমাদের গ্রামের একজন খবরটা দেয়েছিল। কিন্তু আমার বউ বিশ্বাস করেনি।”
“শোন আরাবাত কথাটা ‘ছাই’ না ‘সাই’। স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার প্রথম অক্ষরগুলো নিয়ে, সাই।এই সরাকারি সংস্থার অন্যতম কাজ হচ্ছে প্রতিভাধর ক্রীড়াবিদ খুঁজে বের করে তাদের ট্রেনিং দিয়ে উৎকর্ষতা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ানো। তা তোমার বাড়ি তো অনেক দূর যাব কী করে?”
“ছ্যার অটো আছে, আর যদি একটু কষ্ট করে আমার ছাইকেলের পেছনে বসতে পারেন… ছ্যার এই ছাইকেলটা গতবছর হেরোভাঙ্গার বলদ দৌড়ে ফাস্ট হয়ে পেয়েছিলাম। অটো থেকে জোরে ছোটে আমার ছাইকেল। আপনার কোন কষ্ট হবে না।” উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে ওঠে আরাবাতের চোখ।
খুব একটা ভুল বলেনি আরাবাত। রেল স্টেশান থেকে ক্যানিং থানার পাস দিয়ে পাকা রাস্তা ধরে হু হু করে ছুটে চলল সাইকেল। রাস্তাটাও খুব ভাল। ভাঙাচোরা, গর্তে ভর্তি নয়। একফোঁটা ঝাঁকুনি লাগছে না। দু’দুটো অটোকে পাস কাটিয়ে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পাস দিয়ে হালাপাড়া। আট কিলোমিটার রাস্তা যেতে আরাবাত নিল মাত্র আঠারো মিনিট।
পাকা রাস্তা ছেড়ে একটা মেঠো রাস্তা ধরে খানিক এগিয়ে একটা ছোট পাকা বাড়ির সামনে সাইকেল দাঁড় করালো আরাবাত। “এসে গেছি ছ্যার। নেমে পড়ুন। কষ্ট হয়নি তো?”
“আরে না না… তুমিতো দারুণ সাইকেল চালাও হে! অটোর আগে এলাম মনে হয়?”
“হ্যাঁ ছ্যার, অটোতে আসতে আধঘণ্টা লাগতো।”
বাড়িটার ঘিরে বাঁশের বেড়া। ঘরের ইটের দেয়ালে প্লাস্টার নেই। টালির চালে ফনফন করছে লাউ গাছ। বাড়ির পেছনে একটা পুকর। তার চারপাশে খান কতক নারকেল গাছ। বাড়ির সামনে একটা আম ভর্তি গাছ। একফালি উঠোন ছাড়িয়ে বেগুনের ক্ষেত। কালো বড় বড় বেগুন ফলে আছে তাতে।
সাইকেলের আওয়াজ পেয়ে সালোয়ার কামিজ পরা এক মহিলা বেড়িয়ে এলেন ঘর থেকে। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে একটি প্লাস্টিকের চেয়ার হাতে করে নিয়ে এসে উঠোনে আম গাছের তলায় রেখে আবার ঘরে ঢুকে গেল।
“বসেন ছ্যার, ঘরের থেকে বাইরে আরাম বেশি। কই গো ছ্যার আমার ছবি বাঁধায়ে নিয়ে এসেছে। তুমি বলছিলে না ঘরে টাঙ্গাবা। নাও নাও।”
“স্যারের জন্য একটু ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আসি আসছি।”
মাথার ওড়না টানতে টানতে পেতলের গ্লাস বাসানো ঝকঝকে পেতলের থালা আমার দিকে এগিয়ে দেয় আরাবাতের স্ত্রী, বছর বাইশ বয়স হবে।
গ্লাসের বাইরে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গ্লাসটা তুলে নিলাম। লেবুর দানাগুলো তখনও জলে ঘুরে চলছে। গ্লাসের পাশে নিপুণ করে টুকরো টুকরো করে কাটা আম। প্রায় সবকটা এক মাপের। প্লেটের পাশে রাখা একটা ছোট চামচ।
“ঠাণ্ডাতে এমনি পানি মেশাইনি স্যার। যা গরম পড়েছে।” মাথা নিচু করে বলে মেয়েটি।
“ছ্যার আমিনা আমার মতো মুখ্যু নয় ও দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে।” আরাবত বলে।
“ছ্যার আমার কাঁড়ার দৌড় দেখে মুগ্ধ হয়ে ও আমায় বে করে। গেল বছর ওদের গ্রাম টাটাপাড়ায় কাঁড়ার দৌড়ে ফাস্ট হয়ে একটা ফিরিজ পাই। সেই ফিরিজের পানি ছ্যার।”
দৌড়ের বলদকে বলে কাঁড়া, এটা আমার আগেই জানা ছিল।
“স্যার একটা কথা বলব? না না আপনি আগে পানি আর আমটা খেয়ে নিন। এই গাছের আম স্যার। খুব মিষ্টি। আপনাকে কয়েকটা দিয়ে দেব বাড়িতে নিয়ে যাবেন।” আমিনা বলে।
এক ঢোঁক জল খেয়ে, একটা আমের টুকরো মুখে পুড়তেই মুখটা মিষ্টি রসে ভরে গেল।
“বাহ দারুণ আম তো? কী জানতে চাও বলো।”
“স্যার কাল কাগজে যেই খবরটা বেড়িয়েছে সেটা কি সত্যি?”
“সাইয়ের খবরটার কথা বলছ কি?”
“হ্যাঁ স্যার, পাশের বাড়ির রহমত চাচা কাল কাগজটা হাতে করে এসেছিল…”
“একদম সত্যি।”
“আল্লা ওকে শক্তি দাও…” আমিনা আকাশের দিকে দু’হাত তোলে।
“তা তুমি যে এত ভাল দৌড়ও। প্রাকটিস কর কোথায় আরাবত?”
“ছ্যার আমি চাষা। মাঠেই প্রায় সারাক্ষণ থাকি। আমাদের এদিকে চাষাদের খেলাই বেশি হয়। বাপ, চাচাও বলদের পেছনে হাল বেঁধে দৌড়ত। আমিও দেখাদেখি দৌড়তাম। দশ বছর আগে হঠাৎ পেটের রোগে ভুগে আমার আব্বা আর চাচা দুজনেই মারা যায়, তারপর থেকে আমি বলদের পিছনে ছুটতে শুরু করি।”
“ছ্যার যাবেন নাকি বলদগুলারে দেখতে?” বলে আরাবত।
মনে মনে ভাবলাম খানিক মাঠে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। দারুণ কিছু স্টোরি পাওয়া যেতে পারে।
“ওই দেখুন মাঠে দড়ি বাঁধা বলদ দুটো সমানে ছুটে বেড়াচ্ছে। দড়িতে বাঁধা থাকার জন্য খুব বেশি দূর যেতে পারছে না তাই রাগে খানিক পর পর মাথা নিচু করে বিশালদুটো শিং দিয়ে মাটি খুঁড়ছে।
“চলো ঘুরে আসি।”
“স্যার ছাতা নিয়ে যান, বাইরে খুব রোদ্দুর” বলে ঘর থেকে একটি লেডিস ছাতা এনে খুলে আমার হাতে এগিয়ে দেয় আমিনা। আর একটা শিশি এগিয়ে দেয় আরাবতের দিকে। তারপর আমার দিকে ঘুরে বলে, “এতে সর্ষের তেল আছে স্যার, ওই বলদগুলোকে রোজ মাখাতে হয়।”
বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বলদগুলোর দিকে এগোতে এগোতে আমার প্রায় কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে ওঠে আরাবত “ছ্যার ‘ছাই’ থেকে যেন কোন ডাক না আসে তার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।”
চমকে উঠলাম। মাথা ঠিক আছে তো আরাবতএর? যে কোন অ্যাথলিটের স্বপ্ন সাইয়ের ডাক পাওয়া, আর এর কাছে যেচে সেখানে যোগ দেবার ডাক আসছে, আর সে কিনা সেটা বাতিল করতে চাইছে?
“কেন আরাবত? তুমি জান না তোমার মধ্যে কী শক্তি লুকিয়ে আছে। একজন প্রশিক্ষক নিজে যেচে তোমাকে সুযোগ দিতে চাইছে আর তুমি সেটা বাতিল করতে চাইছ?”
“না ছ্যার, আপনি বুঝবেন না। আমিনার আমাকে ঘিরে স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যাবে। তার থেকে আমি বলদ দৌড়েই ঠিক আছি।”
“কেন আমিনার স্বপ্ন ধ্বংস হবে কেন?”
“ছ্যার কাউকে বলবেন না। আসলে আমি বলদগুলোকে দৌড় করাই না, ওরাই আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।”
চমকে উঠি আমি। “কী বলতে চাইছ আরাবত?”
“ছ্যার আপনি আমাকে এই বলদগুলোর হাত থেকে বাঁচান। আমি ওদের হাত থেকে মুক্তি চাই।” থমকে দাঁড়াই আমি।
“হ্যাঁ ছ্যার, ওই বলদদুটো সাধারণ বলদ নয়। ওদের ওপর রাক্ষস ভর করে আছে। সেই রাক্ষসগুলো ওদের দিয়ে আমাকে খায়। আমাকে বাঁচান।” হাতজোর করে মিনতি করতে থাকে আরাবত।
“কী পাগলের প্রলাপ বকছ আরাবত।”
“হ্যাঁ ছ্যার আমার বউ জানে না। আমি ওকে খুব ভালবাসি। আমি ওঁর ক্ষতি করতে চাই না।“
“দৌড়ের সাথে তোমার বউয়ের লাভ ক্ষতির কী সম্পর্ক আরাবাত?”
“আছে ছ্যার! ওই বলদগুলো দৌড়ের সময় মানুষের রক্ত চায়। আর সেই রক্ত খেয়েই ওরা পাগলের মতো ছোটে।”
“রক্ত! মানুষের রক্ত?”
“হ্যাঁ ছ্যার, আমার এই সামনের দাঁতদুটো দেখুন, নেই।”
“আরবত তোমরা যতই লুকাও, আমরা অনেকেই জানি দৌড়ের সময় তোমরা বলদগুলোর লেজ কামড়ে ধর, তাতে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ওরা আরও জোরে ছোটার চেষ্টা করে।”
“হ্যাঁ ছ্যার। এটা প্রায় সবাই করে। আর এটা করতে গিয়েই সামনের দাঁতদুটো ভাঙ্গে। কিন্তু আমার বলদদুটোর লেজ আমাকে রোজ কামড়াতে হয়। কামড়াতে গিয়ে আমার দাঁতের ফাঁক থেকে আমার রক্ত যতক্ষণ না বেড়িয়ে ওদের শরীরে মিশছে ততক্ষণ ওরা আমাকে দৌড়ে নিয়ে বেড়ায়। কিন্তু…”
“কিন্তু কী আরাফত…” আমার আওয়াজ কেঁপে ওঠে।
“আমার রক্ত ওদের আর পছন্দ নয়। ওরা অন্য মানুষের রক্ত চাইছে। মাসখানেক আগে মাঠে কাজ করতে গিয়ে আমিনার হাত কেটে গেছিল। রক্ত বন্ধ করতে আমি মুখ দিয়ে কাটা জায়গা চুষেছিলাম, খানিক পরে আমার মুখে লেগে থাকা সেই অন্য রক্তের স্বাদ ওরা পেয়ে ওরা আরামে খানিক শান্ত ছিল কয়েকদিন। তারপর ওরা আবার ক্ষেপে গেছিল। আমার রক্ত আর ওদের পছন্দ নয়। সপ্তাহ খানেক আগে বলদদুটো মাঠে একটা লোককে তাড়া করে। ভয়ে দৌড়তে গিয়ে পড়ে গিয়ে লোকটার পা ছড়ে যায়। রক্ত ঝরতে থাকে। রক্ত দেখে বলদদুটো শান্ত হয়ে যায়। আমি ওই কাটা জায়গা খানিক চেপে ধরে রক্ত পড়া বন্ধ করি। লোকটা চলে যেতেই বলদদুটো দাপাদাপি করতে শুরু করে। আমি বলদদুটোর লেজ কামড়ে সেই রক্ত মাখা হাত কাটা জায়গায় চেপে ধরতেই শান্ত হয়ে যায় বলদদুটো। তার থেকেও আরও একটা বড় গুহ্য জিনিস ওই যেদিন আপনি দৌড় দেখতে এসেছিল সেদিন টের পেয়েছি। কাঁড়াদুটো আমার রক্ত ঝরতে থাকা ঠোঁটের পাশে আদরের নামে জিভ দিয়ে চেটে দিতেই ওদের লালা মেখে গেছিল কাটা জায়গায় আর আমার শক্তি বেড়ে গেছিল অনেক। এখন অন্য লোক দেখলেই… পালান ছ্যার একটা কাঁড়া দড়ি ছিঁড়ে আপনার দিকে তেড়ে আসছে।”