সেদিন সকাল থেকেই পিকলুদের বাড়িতে শুরু হয়েছে তুমুল অশান্তি। পিকলু একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ক্লাশ সিক্সে পড়ে। পিকলুর স্কুলে সেদিন রেজাল্ট বের হওয়ার কথা। স্কুল থেকে তার গার্জিয়ানকে নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। তাই নিয়ে পিকলুর বাবা প্রিয়ব্রত ও মা মহুয়ার মধ্যে শুরু হয়েছে তুমুল অশান্তি।
“সব তোমার জন্যে হয়েছে মহুয়া। খালি অফিস গেলে হবে? ছেলেকে দেখতে হবে না?”
“সব আমার দোষ? আর তুমি যে সারাবছর অফিসের ট্যুর করে বেড়িয়েছ! ছেলের দিকে একবার দেখেছ?”
ছেলে-বউমার ঝগড়া শুনে ব্রজগোপালবাবু এগিয়ে আসেন। তিনি মফস্বলের একটি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। সপ্তাহ খানেক আগে তিনি জলপাইগুড়ি থেকে এসেছেন কলকাতায় ছেলের কাছে। “কী হয়েছে রে খোকা? সকাল সকাল এত হইচই কীসের?”
“দেখো না বাবা, তোমার নাতির কাণ্ড?”
“কী করেছে রে পিকলু?”
“তোমার আদরের নাতি স্কুলে এত ভালো রেজাল্ট করেছে যে সোজা গার্জিয়ান কল হয়েছে।”
ব্রজগোপালবাবু অবাক হয়ে বলেন, “তাতে কী হয়েছে? একবার স্কুলে গিয়ে কথা বলে আয়!”
প্রিয়ব্রত জবাব দেয়, “না বাবা। ওর জন্যে আমি স্কুলে যেতে পারব না। লোকে ছি ছি করবে।”
পাশ থেকে মহুয়াও বলে ওঠে, “তাহলে আমিও যেতে পারব না। বাকি গার্জিয়ানরা কী বলবে!”
ছেলে ও বউমার কথাবার্তা শুনে ব্রজগোপালবাবু বুঝলেন, ঘটনা বেশ গুরুতর। আর এই দুইয়ের মাঝে পড়ে বকা খাবে তার আদরের নাতি পিকলু।
একটু ভেবে নিয়ে ব্রজগোপালবাবু বলেন, “ঠিক আছে। তোমাদের কাউকে যেতে হবে না। আমি যাব দাদুভাইয়ের স্কুলে।”
ব্রজগোপালবাবুর কথা শুনে প্রিয়ব্রত ও মহুয়া দুজনেই আশ্বস্ত হয়। তাদের আবার অফিসে যাওয়ার তাড়া রয়েছে।
এরপর ব্রজগোপালবাবু নাতিকে নিয়ে হাজির হন স্কুলে। তিনি দেখেন তখন স্কুলে ছেলেপেলে খুব একটা নেই। বেশিরভাগ হয়তো রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। তিনি দারোয়ানকে বলতেই সে তাঁদেরকে স্কুলের প্রিন্সিপালের ঘরের সামনে এসে বসিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে তাঁদের ডাক পড়ে। পিকলুর হাত ধরে তিনি ধীরেসুস্থে প্রবেশ করেন প্রিন্সিপালের ঘরে।
পিকলুকে দেখেই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চিনতে পারেন। তিনি বলেন, “আপনি কে? অনিন্দ্যর পেরেন্টস কোথায়?”
“আমি অনিন্দ্যর দাদু। আপনি আমাকে সব বলতে পারেন।”
“আপনি অনিন্দ্যর রেজাল্ট দেখেছেন? সবগুলো বিষয়ে বাজে মার্কস পেয়েছে।”
“হ্যাঁ, দেখেছি। রেজাল্ট ভালো হয়নি।”
“অনিন্দ্য ইজ আ ব্যাড বয়।”
কথাটা শুনতেই পিকলুর মুখটা কালো হয়ে যায়। দাদু সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, “কিন্তু ম্যাডাম, পিকলুর মধ্যে খারাপ ছেলের কোনো লক্ষণ তো আমি দেখিনি।”
“মেন সাবজেক্টের কথা ছেড়েই দিন। গেমসেও ও যথেষ্ট বাজে মার্কস পেয়েছে। অথচ ওর বাকি বন্ধুদের দেখুন!”
“আচ্ছা ম্যাডাম, ক্লাসে সারাদিন ও কী করে? ক্লাস টিচার কিছু জানাননি?”
“হ্যাঁ, ওরা কয়েকজন মিলে সারাদিন কম্পিউটার গেমস নিয়ে কথা বলে।”
ব্রজগোপালবাবু বুঝতে পারেন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তিনি বলেন, “তাহলে আপনারা কী মনে করেন?”
“দেখুন, আমাদের কাজ অ্যালার্ট করে দেওয়া। ফাইনাল এক্সামে এরকম রেজাল্ট হলে স্কুল থেকে কিন্তু ওকে বের করে দেওয়া হবে।”
এরপর ব্রজগোপালবাবু নাতিকে নিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে আসেন। বাইরে এসে পিকলু দেখে দাদুর মুখটা থমথমে। সে আস্তে আস্তে দাদুকে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা দাদু, হেড-মিস তো আমাকে ব্যাড বয় বলল। কী করলে আমি গুড বয় হব?”
“দাদুভাই, তুমি যদি আমার কথামতো চলো, তাহলেই দেখবে সব ভালো হয়ে যাবে।”
“সত্যি, দাদু?”
“একদম সত্যি।”
***
পরদিন রবিবার অর্থাৎ ছুটির দিন। সকালবেলা পিকলুর ঘুম ভাঙে দাদুর ডাকে।
“দাদুভাই, ও দাদুভাই।”
কোনোমতে চোখ খুলে পিকলু দেখে দাদু তার বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সে দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভোর পাঁচটা বাজে।
“দাদু, সবে তো এখন পাঁচটা। আর একটু ঘুমিয়ে নিই?”
“চটপট উঠে পড়ো দাদুভাই। এখন আমরা মর্নিং ওয়াকে বের হব।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিকলু বিছানা থেকে নেমে আসে। তারপর ব্রাশিং করেই দাদুর সঙ্গে সে বের হয়ে পড়ে মর্নিং ওয়াকে।
আবাসনের রাস্তায় দাদু ও নাতিকে দেখে অনেকেই গোল গোল করে তাকিয়ে থাকে। পিকলু ভাবে, এই সময় তার আবাসনের বন্ধুরা একবার তাকে দেখে ফেললে তার প্রেস্টিজের একেবারে বারোটা বেজে যাবে।
কিছুক্ষণ আবাসনের রাস্তায় হাঁটার পরে পিকলু দাদুর সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসে। এরপর এক গ্লাস দুধ ও দুটো বিস্কুট খেয়ে পড়তে বসে পিকলু। এই সময়টা নাতির পাশেই বসে থাকেন ব্রজগোপালবাবু। নাতি কোথাও আটকে গেলে তিনি পড়া দেখিয়ে দেবেন।
সকাল ন’টার সময় পিকলুর ব্রেকফাস্ট হয়ে যায়। তারপর সে বসে যায় বাবার ল্যাপটপ নিয়ে। পাশে বসে প্রিয়ব্রত খবরের কাগজ পড়তে থাকে।
“কী করছ, দাদুভাই?”
দাদুর কথা শুনে পিকলু বলে, “বন্ধুদের সঙ্গে কম্পিউটারে গেম খেলছি দাদু।”
“কম্পিউটার খেলার জন্য নয় দাদুভাই, কাজ করার জন্য লাগে।”
অগত্যা পিকলু বলে, “তাহলে কী করব, দাদু?”
“চলো দাদুভাই, তোমাকে আজ দাবা খেলা শেখাই। তাহলে তোমার মাথার ব্যায়ামও হবে।”
এরপর নাতিকে নিয়ে দাদু বসে যান দাবা খেলতে। কিছুক্ষণ পরে প্রিয়ব্রতও এসে হাজির হয় তাদের কাছে। তার মনে পরে যায় ছোটোবেলার কথা। কত সকাল যে বাবা ও ছেলে মিলে একসঙ্গে দাবা খেলে সময় কাটিয়েছে তার ঠিক নেই।
দুপুরে খাওয়ার পরে নাতিকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন ব্রজগোপালবাবু। এই করতে গিয়ে কখন যে তাঁর একটু চোখ লেগে গিয়েছিল তা তিনি বুঝতে পারেননি। কিছুক্ষণ পরে চোখ খুলতেই তিনি দেখেন নাতি বিছানায় নেই।
নাতিকে খুঁজতে গিয়ে ব্রজগোপালবাবু দেখেন সে রয়েছে টিভির ঘরে। ড্রয়িং-রুমে এসে তিনি দেখেন পিকলু মহানন্দে টিভিতে কার্টুন দেখছে।
“দাদুভাই, কী দেখছ?”
“থান্ডার ক্যাটস দেখছি দাদু।”
“তুমি বুঝি বিকেলে বাইরে খেলতে যাও না?”
“মা না করেছে। বলেছে, বিকেলে বাড়িতে বসে টিভি দেখতে।”
পিকলুর কথা শুনে ব্রজগোপালবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি বলেন, “চলো দাদুভাই, আজ আমরা সবাই মাঠে খেলতে যাব। তোমার অন্যান্য বন্ধুদেরও ডাকো।”
মাঠে খেলার কথা শুনে পিকলুর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। সে ফোন করে একে একে আবাসনের বন্ধুদের ডাকতে শুরু করে।
এরপর পিকলুকে ব্রজগোপালবাবু চলে আসেন আবাসনের মাঠে। তিনি দেখেন আবাসনের মাঠটা সম্পূর্ণ খালি। কেউ খেলছে না। তাঁর মনে হয়, আবাসনের অন্যান্য বাচ্চাগুলোও বোধহয় তাঁর নাতির মতো।
কিছুক্ষণের মধ্যে পিকলুর বাকি বন্ধুরাও চলে আসে মাঠে। তারপর শুরু হয় তাদের ফুটবল খেলা। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের খেলা দেখতে থাকেন ব্রজগোপালবাবু।
সন্ধ্যা নামার আগেই পিকলুদের খেলা শেষ হয়ে যায়। খেলা শেষে পিকলু দাদুকে নিয়ে ফিরে আসে ফ্ল্যাটে। তারপর ভালো করে হাত-পা ধুয়ে সে বসে যায় পড়তে। আর নাতির পাশে বসে থাকেন ব্রজগোপালবাবু।
***
প্রায় মাস খানেক ছেলের কাছে থাকার পরে ব্রজগোপালবাবু ফিরে যান উত্তরবঙ্গে। কলকাতা থেকে ফিরে তিনি ফিরে আসেন জলপাইগুড়িতে নিজের বাড়িতে। বাড়ি ফিরে আসলেও তাঁর মন পড়ে থাকে নাতির ওখানে।
ছেলে ও বউমার কাছ থেকেও তিনি মাঝেমধ্যেই পিকলুর খবর নেন। অবশ্য কখনো পিকলুও ফোন করে তার দাদুকে। তার পড়াশোনা ও খেলাধুলো কেমন চলছে সে দাদুকে জানায়। সঙ্গে এও জানতে চায় যে দাদু আবার কবে ফিরে যাবে তাদের কাছে।
দেখতে দেখতে কয়েক মাস কেটে যায়। এরই মধ্যে পিকলুর ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যায়। এরই মধ্যে একদিন সকালে ব্রজগোপালবাবুর মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে।
“হ্যালো, কে?”
“দাদু, আমি পিকলু বলছি।”
“কী হয়েছে, দাদুভাই?”
“দাদু জানো, আমি ফাইনাল এক্সামে ক্লাশে সেকেন্ড হয়েছি।”
“বল কী দাদুভাই? এ তো দারুণ খবর!”
“আর হেড-মিস কী বলেছেন জানো?”
“কী বলেছে, দাদুভাই?”
“আমি নাকি এখন গুড বয়।”
অলঙ্করণ-সায়ন মজুমদার
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস