দীপঙ্কর চৌধুরীর আগের গল্প- ফড়িং সাহেবের বাংলো
“এ গল্প যখনকার, তখন আমি সবে হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরব ধরব করছি, বুঝলি?” চায়ের কাপটি নামিয়ে রেখে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বিজুদার ঘোষণা। আজকের গল্পের আসরে।
ঘোষণা মোতাবেক আজ বিজুদার গল্পের আসর বসেছে অনেকদিন পরে। কারণ, সকল সদস্যের দাবি—বহুকাল আসেননি বিজুদা, বসেনি গল্পের আসর। অতএব আজ সন্ধ্যায় বসল বিজুদার গল্পের বিশেষ অধিবেশন। নৈশাহারে আজ রয়েছে বিজুদার অতি প্রিয় ধোঁকার ডালনা। তা, সে-সব ঢাকাঢুকি দিয়ে রাখা আছে, কারণ কচিকাঁচাদের সঙ্গে তাদের মায়েরাও বসে গেছেন যে বিজুদার গল্প শুনতে।
“কিন্তু বাপু হে, গপ্প কি আর তোমার ওই বোতাম-টেপা মেশিন, যে সুইচটি অন করবে, আর হুড় হুড় করে বেরোতে থাকবে তা?” বিজুদার সবিনয় নিবেদনটির মধ্যেও যেন একটু উস্কানির গন্ধ।
অধ্যাপক শ্যামল-বাবাজী পিছনে লাগতে ছাড়েন না। বলেন, “আপনি বানিয়ে-বানিয়েই বলুন না। ভালোই তো বলেন।”
“বানিয়ে বানিয়ে?” বিজুদার সহাস্য যোগ, “আর আপনারাও ছোটোদের আষাঢ়ে গল্পের আসরে…”
“জমিয়ে বসি।” আমার সুগৃহিণী সুমিত্রাদেবীর সংযোজন।
“জেঠু, তুমি বলো না গল্পটা! শুরু করো না! থামলে কেন?” একযোগে দাবি অয়ন-রূপা-গুগ্গুলদের।
“হ্যাঁ, তাহলে বলি শোনো।”
“ভূতের গল্প?” অয়নের প্রশ্ন।
“ভূত? উঁ-উঁ, না। ধরে নাও ভূত-পেত্নী-দ্যত্যি-দানা রাক্ষস-খোক্কসের গল্প।”
“মানে?”
“রাক্ষসের গল্প!”
“রাক্ষস বলে আবার কিছু হয় নাকি?”
“নাও! হওয়া-হওয়ির আবার আছেটা কী গো? রাক্ষস ইজ রাক্ষস!” বিজুদা।
“আদিকাল থেকে দক্ষিণ ভারতে পাশাপাশি দুই প্রজাতি বাস করত, রামায়ণে যাদের বানর আর রাক্ষস বলা হয়েছে, জানো তো?” বন্ধুবর সুদীপের সংযোজন, “চমৎকার একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখলাম সেদিন এর উপরে।”
“ওই শোনো তাহলে।” বিজুদা খুশি।
“আরে বাপু সুদীপ, রাক্ষসরা বিলেতেও থাকত, এটা জানিস?” অধ্যাপক শ্যামলকুমার জানালেন।
“বলিস কী! সুসভ্য ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে রাক্ষসরা থাকত!” অবাক হই।
“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। তারাই সে দ্বীপের আদি নিবাসী। সাহেবদের ইতিহাসে লিখেছে, সৌন্দর্যের গ্রিকদেবী এফ্রোডিটির পুত্র ইনিয়াস ট্রয়ের যুদ্ধে হেরে দেশ ছেড়ে পালান ও তাঁরই বংশধর ‘ব্রুটে অব ট্রয়’ ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে সে-দেশের আদি অধিবাসী রাক্ষসদের হারিয়ে রাজা হয়ে বসেন। তিনিই সে-দেশের প্রথম নৃপতি। তাঁর থেকেই ব্রিটেন নামটা এয়েচে।”
“ভাবো!”
“রাখো বাপু তোমাদের ওইসব ইতিহাস আর মিথোলজি কচকচি। আজকের গপ্পটা শোনো।”
শুরু হয়ে গেল বিজুদার আজকের গল্প।
“ক্লাস এইটে পড়ি তখন আমি।” বিজুদা শুরু করে দেন। “আমার রাঙামামা পেশায় ছিলেন এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। অকৃতদার মানুষ, শ্রী প্রমথনাথ ব্রহ্ম। সেই গ্রীষ্মে এক ভাইঝির বিয়েতে এসেছিলেন কলকাতায়। উনি চাকরি করতেন হুবলিতে।”
“হুগলী জেলা?”
“আজ্ঞে না স্যার। হুবলি হল কর্ণাটকের একটা বড়ো শহর, গোয়া থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার সোজা পুবে। জেনে পুলকিত হলাম যে উনি কিছুদিন আগেই তুঙ্গভদ্রা বাঁধ প্রকল্পে বদলি হয়ে এসেছেন।
“তুঙ্গভদ্রা! সদ্য শরদিন্দুর ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাস পড়ে মুগ্ধ হয়ে আছি তখন।” বিজুদা বলে চলেন, “বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী হাম্পি শহর ছিল তাঁর নিকটেই শুনলাম। বিজয়নগর! মহা পরাক্রমশালী নৃপতি কৃষ্ণদেব রায়! আমার রোমাঞ্চ হল। জায়গাটা এখন পড়ে কর্ণাটক রাজ্যে, শহরের নাম হসপেট, যেখানে রাঙামামা থাকেন।
“অতএব মন চনমন করে উঠল সে স্বপ্ন-সাম্রাজ্য দেখবার জন্যে। কিন্তু অতদূরে কি আর বেড়াতে যাওয়া হবে? এর আগে অত দূরে কোথাও যাইনি। কলকাতা থেকে বোম্বাই প্রায় দু-হাজার কিলোমিটার দূরে, সেখান থেকে গোয়া ছ’শো, গোয়া টু হসপেট তিনশো কিলোমিটার। তাহলেই বোঝো, টোটাল প্রায় তিন হাজার কিলোমিটারের ধাক্কা। চারটে দিন-রাত্তিরের ট্রেন জার্নি, দুইবার বদলে, তিনটি ট্রেনে। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে তখনও এয়ার ট্রাভেল মধ্যবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল হে, ট্রেন জার্নিও তথৈবচ।”
“ ‘চলুন দাদা, দেখে আসুন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কীর্তি।’ বাবাকে বলেন রাঙামামা।
“বাবারও হাম্পি দেখার খুব উৎসাহ। কিন্তু অফিসে অত লম্বা ছুটি পাওয়া মুশকিল। উপরন্তু হুট করে অত দীর্ঘ ট্রাভেল প্ল্যান বানানোও সোজা কথা নয়। শেষপর্যন্ত ঠিক হল এবার পুজোর ছুটিতে আমরা যাব।
“বাবা, মা, আমি আর আমার ছোটো বোন মিনি। দুই প্লাস এক—তিন দিনরাত্রি ধরে হাওড়া-বোম্বাই-গোয়া জার্নি করার পর গোয়া থেকে বেজওয়াড়াগামী এক ঢিকঢিকে এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়া গেল। ট্রেনে চড়ে লম্বা সফর করায় যদিও আমার বড্ড উৎসাহ, কিন্তু ততদিনে ত্রাহি ত্রাহি করছে মনটা। আর কাজ নেই বাপু ট্রেনে চড়ে। কখন পৌঁছব? কখন পৌঁছব?
“সেই সকালে গোয়া-টু-হসপেটের ট্রেনের বার্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে বসে আছি আমরা। ট্রেন চলেছে। অক্টোবর মাস। কিন্তু এখানে গরম খুব, বিশেষত দিনের বেলাটায়। কামরাতে লোকজন কম। হঠাৎ কোত্থেকে একটা বাচ্চা ছেলে দুষ্টুমি করে এসে আমার বোন মিনির চুলটা ধরে টানতে লাগল। মিনিরই বয়সি হবে বা তার থেকে কিছু ছোটো—বছর সাত-আটের ধবধবে ফর্সা এক বালক। নেড়া মাথা। লক্ষ্যণীয়, পরনের জামাটার তলা দিয়ে লম্বা পৈতে ঝুলে আছে!
“মিনি বিরক্ত হয়ে এক ঝটকায় তার হাতটা সরিয়ে দিতেই দৌড়ে পালিয়ে গেল সে পাশের কোন বার্থে। একটু পরেই সে ফিরে এল, সঙ্গে যমজ ভাই তার। হুবহু এক দেখতে, সেই একইরকম নেড়া মাথা ও জামার তলা দিয়ে পৈতে ঝুলে আছে। বেশ মজা পেয়ে গেছে তারা একটা বাচ্চা মেয়ের পিছনে লাগতে। দুজনে এসে টুকটুক করে মিনির চুল ধরে টানতে লাগল।
“ ‘ওয়ট ইজ ইওর নেম?’ বাবা শুধোন।
“ইংরিজি বোঝে না বোধ হয়। ভোঁ করে আবার পালিয়ে গেল ছেলেদুটো।
“ ‘সনৎ, সনৎ’ বলে বিজাতীয় ভাষায় পাশের বার্থ থেকে এক বাজখাঁই গলা ভেসে এল। ওদের বাবা বোধ হয় মানা করছেন ছেলেদের দুষ্টুমি করতে, কাছে ডাকছেন।
“এর পরে আমাদের মস্ত অবাক হওয়ার পালা।
“আমি একটা অরণ্যদেবের কমিকস পড়ছিলাম জানালার ধারে বসে, হঠাৎ চমকে তাকিয়ে দেখি একটা নয় দুটো নয়, চার-চারটে হুবহু এক দেখতে বালক এবার একসঙ্গে এসেছে দুষ্টুমি করতে! দুইজন যমজ ভাই বা বোন দেখা যায়। তিনজন, মানে, ট্রিপলেট—শুনেছি তা-ও হয়। চারজন, মানে জোড়া-যমজ যে মানুষের হতে পারে তা-ই কখনও শুনিনি, দেখা তো দূরের কথা—তার আগে বা পরে। পরে ডিকশনারি দেখে জেনেছিলাম যে ইংরিজিতে একে কোয়াড্রুপলেট বলে।
“এবার আমরা সপরিবার অবাক বিস্ময়ে সেই জোড়া-যমজ, মানে চার-চারটে হুবহু এক দেখতে বালককে দেখতে লাগলাম। চার ফুটের চেয়ে কমই হবে উচ্চতায়। পরনে প্যান্ট বা পাজামা নয়, ধুতি। গায়ে একটা পাতলা হাফ হাতা কামিজ যার তলা থেকে লম্বা পৈতে ঝুলে আছে। চকচকে নেড়া মাথা চারজনেরই। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা।
“কথা কী আর বলব, অবাক বিস্ময়ে তাদের দেখছি আমরা। ট্রেন ফাঁকাই ছিল। ঠিক আশেপাশে আর কোনও যাত্রী নেই। বাজখাঁই গলায় বিজাতীয় ভাষায় ধমকাতে ধমকাতে এবার সেই বালকদের ‘বাবা ভদ্রলোক’ উঠে এলেন। তাঁর অবয়ব দেখে বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম আমরা। সাড়ে ছয় ফিটের চেয়েও লম্বা আর তেমনি হৃষ্টপুষ্ট বিশাল বপু এক মানুষ! আবলুশ কাঠের মতো কালো রং গায়ের। সাদা বুশ শার্ট আর নীলচে রঙের ঢোলা ট্রাউজার্স পরনে। আলাপ হল। চমৎকার মানুষ এই মি. কে. কর্ণা। অতি অমায়িক। বাচ্চাদের দুরন্তপনার জন্যে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন আমার বাবা-মায়ের কাছে। আমরা সুদূর কলকাতা থেকে আসছি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। কিন্তু ওঁর দক্ষিণী ইংরিজি ভাষা বোঝে কার সাধ্যি! যদিও তারই মধ্যে আলাপচারিতা চলতে থাকল। দীর্ঘ রেল ভ্রমণে সময় কাটানোর আর কীই-বা উপায় আছে?
“জানা গেল যে এই বালক চারিটি ওঁর নিজের সন্তান নয়, উনি ওদের অভিভাবক, কোনো এক আশ্রমে তাদের ছেড়ে আসতে চলেছেন। চমৎকার মাউথ অর্গান বাজিয়ে গান শোনালেন আমাদের। একটু পরে লাঞ্চের থালি দিয়ে গেলে উনি নিজেই চারটে খেলেন, ছেলেদের চারটে আলাদা। ওঁর অবয়বের সঙ্গে মানানসই বটে। আর তার পরেই পাশের বার্থে উঠে প্রচণ্ড নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন উনি, আর ছেলে চারজন নিজেদের মধ্যে ‘ইকড়ি মিকড়ি’ জাতীয় অবোধ্য কোন ছড়া বলতে বলতে খেলা করতে লাগল।
“বিকাল হয়ে এসেছে। এই সময়েই ট্রেনটা পৌঁছানোর কথা হসপেট স্টেশনে। লেট করছে। সন্ধে হব হব। হঠাৎ ‘সনৎ! সনৎ!’ করে ডাকতে ডাকতে সেই বিশালবপু কর্ণা-বাবাজী ঘুম থেকে উঠে মহা হট্টগোল বাধিয়ে তুললেন। কম্পার্টমেন্টের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে গিয়ে শুধোচ্ছেন ছোটো ছেলেটাকে কেউ দেখেছে কি না। কী কাণ্ড!
“না, সেই চারটির একটি ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনজন রয়েছে, যারা বেচারি খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে নিচের বার্থে পরস্পর জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। চতুর্থ ছেলেটি নেই, যার নাম সনৎ।
“ট্রেন হসপেট স্টেশনে ঢুকছে ধীরে ধীরে। কোথায় গেল ছেলেটি? সে ট্রেন তো আর ভেস্টিবিউল ছিল না সেকালে, মানে এক কামরার মধ্যে দিয়ে পাশের কামরায় চলে যাওয়া যেত না। তবে গেল কোথায় বাচ্চাটা? কী করে?
“রাঙামামা এসেছিলেন স্টেশনে আমাদের রিসিভ করতে। খুব আনন্দ হৈ হৈ হতে লাগল। তারপর মস্ত এক হ্রদের তীরে তুঙ্গভদ্রা বাঁধ প্রকল্পর ঘেরা আবাসনের মধ্যে তাঁর কোয়ার্টার্সে গিয়ে ওঠা হল। রাঙামামা তো বিয়ে-থা করেননি। একাই থাকেন। এক কাজের লোক এসে দু-বেলা রান্না করে দিয়ে যায়। মা এসে রান্নাঘরের দায়িত্ব নিলেন।
“ওখানকার কর্মীদের চমৎকার একটা ক্লাব আছে সেখানে, সেটাই সকলের মিলনস্থল। ছোটো-বড়ো-মাঝারিদের জন্য আলাদা আলাদা অলিখিত গ্রুপ রয়েছে। আমি ও আমরাও শীগগিরই সেখানে মিশে গেলাম। সেখানে বাচ্চাদের নাচা-গানা নাটক এইসব হয়-টয় শুনলাম। পরেরদিন দেখলামও একটা ম্যাজিক শো। বাঙালি পরিবার রয়েছে কয়েকটি। শীগগিরই আমরা হাম্পির ঐতিহাসিক বিরূপাক্ষ মন্দির দেখতে যাব দল বেঁধে, এই ঠিক হল।
“এই হসপেট শহরটা থেকে হাম্পির কাছেই। হাম্পি ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী। তার প্রাসাদ-মন্দির-নগর দেখলে আজও স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়।
“ ‘জানো তো বাবা বিজু, মুঘল সাম্রাজ্যেরও দুশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল সারা দাক্ষিণাত্য জুড়ে, তিনশো বছর ধরে। ইতালিয়, পর্তুগিজ, পারসিক ও চৈনিক পর্যটকেরা রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন।’ ওই সাইটে ঘুরতে ঘুরতে বাবা বলেছিলেন আমায়।
“কিন্তু আমার মনটা কেন যেন খচখচ করছিল, করেই যাচ্ছিল সেই জোড়া-যমজের জন্য—তাদের একটা ছেলে, সনৎ, কোথায় গেল সে? মাও আমাকে ঠিক সেই কথা বলে উঠলেন দু-দিন পরে খেতে দিতে দিতে। ‘আমার মনটা কেমন কেমন করছে, জানিস বিজু।’
“আমি তাকালাম মায়ের মুখের দিকে। মা বললেন, ‘তুইও নিশ্চয়ই এটা ভাবছিস?’ আমাকে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে হল না। চুপ করে রইলাম।
“কিন্তু ট্রেনে হঠাৎ সেই বিশালবপু মি. কর্ণার সঙ্গে আলাপ, তাঁর সঙ্গী চারটি যমজ বালক এবং তাদের মধ্যে থেকে একজনের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়াটা—কেমন একটা অবাক করা ঘটনা বলে মনে হতে লাগল। কোন স্টেশনে শেষাবধি গিয়ে নেমেছিলেন ওঁরা? কে জানে।
“হসপেটেই একজন অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। এইরকম নাম কারোর শুনিনি। তাঁর কথা বলি। কুশাক্ষনাথ বালি। কে. এন. বালি। বেশ হাসিখুশি মানুষটি। দেখে মনেই হয় না যে বেশ কয়েক বছর আগেই রিটায়ার করে গেছেন উনি। কারণ পেটানো চেহারা তাঁর, বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা, অনেকটা কুস্তিগীরদের মতো। মনে হয় বয়স যেন খুব বেশি হলে পঞ্চান্ন হবে, কিন্তু আসলে ছেষট্টি। বলেছিলেন।
“ ‘আদতে আমরা হলাম গিয়ে পাঞ্জাবি, বুঝলেন। আদি নিবাস জলন্ধর। কিন্তু এই পম্পা-সাগর তীরে চাকুরি থেকে রিটায়ার করে শেষে আর দেশে ফিরে যাইনি, এখানেই থেকে গেছি।’ গল্প করতে করতে বলেছিলেন মি. বালি প্রথমদিন, “আমার ভাইও অবশ্য কাছেই থাকে। গোয়ায়।’ স্মিত হাসেন বালি-সাহেব। বলেন, ‘দীর্ঘদিন আমি বঙ্গালে ছিলাম, জানেন তো? কাঁকিনাড়ার দিকে। জুট মিলে ওয়েলফেয়ার অফিসার।’
“বালি-সাহেব আসতেন রাঙামামার সঙ্গে দাবা খেলতে। আমরা আসাতে ওঁর ভালোই হল। কারণ আমার বাবারও দাবা খেলায় প্রবল উৎসাহ, যদিও ওঁর সঙ্গে পেরে উঠতেন না। পাক্কা দাবাড়ু ছিলেন এই কে. এন. বালি মশাই।
“ ‘কী মি. বিজনবিহারী সরকার? কী করে সময় কাটছে এখানে এসে থেকে? হাম্পি যাচ্ছ তো? সুগ্রীব-গুহা দেখে এসো। রামায়ণ পড়েছ নিশ্চয়ই?’ দাবার ঘুঁটি সাজাতে সাজাতে আড়চোখে পাশে বসা আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়েছিলেন বালিজী।
“ ‘দেব সাহিত্য কুটীর-এর ‘ছোটদের রামায়ণ’ পড়া ছিল। খুব প্রিয়।’ বললাম।
“ ‘যেখানে আজ আমরা বসে আছি এখন, রামায়ণে কী নাম ছিল বলো তো এই জায়গাটার?’ ওঁর প্রশ্ন।
“ ‘বিজয়নগর।’
“ ‘সে তো মাত্তর আটশো বছর আগে। আমি বলছি আড়াই হাজার বছর আগের কথা। রামায়ণের কালে।’
“আমরা নিরুত্তর। সেই রবিবার সকালে প্রাতঃরাশ সেরে রাঙামামার সঙ্গে বৈঠকখানায় হাজির ছিলাম আমরা সপরিবার চারজনই। দাবা খেলা হবে। দেখব।
“ ‘হাম্পি?’ উল বুনতে বুনতে মা বললেন।
“ ‘হাম্পি শহর ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যেরই রাজধানী যেখানে পরশু ছুটির দিন বেড়াতে যাবেন আপনারা। এখান থেকে মাত্র সাত-আট মাইল দূরে।’ বললেন উনি। ‘রামায়ণের কালে এই স্থানটাই ছিল কিষ্কিন্ধ্যা, বানররাজ্যের রাজধানী!’ বালিজী বললেন।
“ ‘আচ্ছা! নতুন তথ্য। জানতাম না। তার মানে সীতার অন্বেষণে বেরিয়ে এখানেই রাম-লক্ষ্মণ প্রথম সুগ্রীব ও হনুমানের দেখা পান এবং ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে যায় সেতুবন্ধনের দিকে। বেশ।’
“ ‘রাবণের বড়ো শ্যালক ছিল দুন্দুভি রাক্ষস। মদমত্ত দুন্দুভি এসে বানররাজ বালিকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে করলে আহ্বান। মহা শক্তিধর বালি তাকে মাথায় তুলে দশটা পাক দিয়ে এক যোজন দূরে ছুড়ে ফেলে দিলে। সে সময়ে তার মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল ঋষ্যমূক পর্বতে মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে। কী! রাক্ষসের রক্ত ফেলে অপবিত্র করে দিলি আমার আশ্রম? এই পাহাড়ের চৌহুদ্দিতে এলে মাথা ফেটে মরে যাবি তুই—ঋষিমশাই অভিশাপ দিয়েছিলেন বানররাজকে। সেই থেকে ভয়ে বালি আর ও-মুখো হত না। দাদার কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে তাই সুগ্রীব-হনুমানাদি এই ঋষ্যমূক পাহাড়েই আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেখে আসবে সে-সব, দিদিমণি। ঋষ্যমূক পাহাড় আজও আছে।’ মিনির গাল টিপে বলেছিলেন বালিজী।
“ ‘এ কি সব সত্যি!’ অবাক বিস্ময়ে মিনির প্রশ্ন।
“ ‘মিথ্যে কী করে বলি, দিদিমণি? রামায়ণে লেখা আছে যে।’
“বেশ লাগছিল বালিজীর মুখে রামায়ণের গল্প শুনতে, বিশেষ করে আমরা যে এখন বসে আছি কিষ্কিন্ধ্যাতেই। কিন্তু হঠাৎই প্রসঙ্গ পালটে রাঙামামার দিকে তাকিয়ে বললেন উনি, ‘একটা খবর জানেন কি ব্রহ্ম-সাহেব? শুনলাম, পরশু রাতে নাকি পুলিশ আসিয়েছিল আমাদের এইখানে! সি.আই.ডি!’
“সি.আই.ডি মানে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট, এটা আমি জানতাম। রাজ্য পুলিশের এক অঙ্গ হয় সি.আই.ডি, যারা কঠিন অপরাধের তদন্ত করে থাকে।
“ ‘সে কি! কেন? কী হয়েছে?’ মামা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ‘কই, জানি না তো!’
“ ‘কোন এক মিসিং চাইল্ডের সন্ধানে।’
“মিসিং চাইল্ড? নিরুদ্দিষ্ট শিশু! কান খাড়া হয়ে উঠল আমার।
“ ‘হ্যাঁ। দিন চারেক আগে নাকি কৌন লড়কাকে কেহ গুম করে নিছে। এই অঞ্চলেই পুলিশ খুঁজছে তাকে।’
“ ‘ট্রেন থেকে?’ মায়ের জিজ্ঞাসা।
“ ‘যা-ই হউক, এখানে পুলিশ আসাটা আমাদের কাছে খুবই ইজ্জতের সওয়াল।’
“বালিজীর কথা শুনে বুক ধুকপুক করতে লাগল আমার। মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। দেখি মাও আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন।
“অসাধারণ এক জায়গা এই হাম্পি! বিশাল চত্বর জুড়ে মস্ত বিরূপাক্ষ মন্দির, বিঠঠল মন্দির, গরুড় রথমন্দির ইত্যাদি ছড়িয়ে রয়েছে।
“দুটি জিপ গাড়ি ভাড়া করে সেখানকার তিনটি পরিবার আমরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম এক ডে-পিকনিকে। চমৎকার বলিয়ে-কইয়ে ইয়ং এক গাইড পেয়েছিলাম। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সব দেখাল সে আমাদের। সারাদিন অনাবিল আনন্দ পাওয়া গেল। অসাধারণ এক স্থান দেখা হল, যা না দেখা হলে হয়তো অপূর্ণতা থেকে যেত জীবনে।
“কী অয়নবাবু আর রূপা-মা আর গুগ্গুল সোনা, তোমরা আবার বোরড হচ্ছ না তো আমার আজকের এই গল্প শুনে?” গলায় কুণ্ঠা বিজুদার।
“না না না না। বলো বলো জেঠু, তারপরে কী হল? রাক্ষস দেখতে পেয়েছিলে?” রূপার জিজ্ঞাসা।
“রাক্ষস? তোমরা দেখতে পাওনি?” চোখ মটকে বললেন বিজুদা।
“সেই হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা ছেলেটার কী হল? পাওয়া গেল কি তাকে?” আমাদের অধৈর্য প্রশ্ন।
“বলছি, বলছি। শোনোই না।”
বিজুদা বলে যেতে থাকেন।
“পরের দিন দুপুরে লাঞ্চ করতে এসে রাঙামামা বললেন, ‘কী কাণ্ড দেখো দেখি ছোড়দি! তোমরা দু-দিনের জন্যে বেড়াতে এলে এখানে আর এখনই এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল।’
“পাতে ডাল ঢালতে ঢালতে থমকে গেল মায়ের হাত। ‘কেন রে? কী হয়েছে?’
“আমাদের মুখের গ্রাস আটকে গেছে।
“ ‘শোনা গেল, কাল রাতে বালিজীকে নাকি গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে পুলিশে!’
“ ‘সে কি? বলো কী? কেন? তিনি তো এক সজ্জন বৃদ্ধ মানুষ।’ বাবাও হতবাক।
“ ‘রিটায়ার করে থেকে উনি কলোনির বাইরে শহরে একটা ছোটো বাসা নিয়ে থাকেন। কীসব আরকিওলজিক্যাল গবেষণা-টনা করেন হাম্পির চারদিকের পাহাড়ের গুহায় ঘুরে ঘুরে…. যা হোক, পাকা খবরটা নিচ্ছি।’ রাঙামামা বললেন।
“এই ছোট্ট কলোনিতে এটা একটা বিরাট খবর বটে। কিন্তু কারণটা কী?
“না, কারণটা তখনই কিছু জানা গেল না। কিন্তু আবহাওয়াটা কেমন মিইয়ে গেল, যদিও বালিজী আমাদের কেউ হতেন না। সামান্য পরিচিতি মাত্র।
“বাঁধ প্রকল্পের মধ্যে ওই আবাসিক ক্লাবখানিই ছিল সেখানকার প্রাণভোমরা। সারাটা দিনই প্রায় সেখানে ছোটোদের গ্রুপ, বড়োদের গ্রুপ, মাঝারিদের গ্রুপ—কেউ না কেউ দখল নিয়ে থাকে ভাগ ভাগ করে। আমিও প্রায় সারাদিনই সেখানে পড়ে থাকি। ক্যারম খেলা, টেবিল টেনিস খেলা, বিকালে লনে ব্যাডমিন্টন খেলা চলে পুরোদমে। ছোটো একটা লাইব্রেরিও আছে। না, তখনও ভারতে টেলিভিশন বস্তুটি আসেনি, তবে সন্ধেবেলা ক্লাবের লনে সাদা পর্দা খাটিয়ে সিনেমা দেখানো হত মাঝে মাঝে। মনোজকুমারের সিনেমা ‘উপকার’। সেখানে সমবয়সি কিছু বন্ধুও জুটতে দেরি হয়নি। নীহারদা, নীহাররঞ্জন বিশ্বাস ছিল সেখানকার পান্ডা। ক্লাসে টেনে পড়ে। তখনই মুখে বেশ দাড়িগোঁফ বেরিয়েছে। একটা সবজান্তা নেতা-নেতা ভাব। তার বাবা প্রজেক্টের ফোরম্যান।
“সেদিন সকালে ক্যারম খেলা চলছে। একটা ডিফিকাল্ট অ্যাঙ্গেল থেকে রেডটা পকেটস্থ করে স্ট্রাইকারটা প্যান্টে ঘষতে ঘষতে নীহারদা বিজ্ঞভাবে বলল, ‘বালিজীকে কেন পুলিশে গ্রেফতার করেছে তা কি তোমরা কেউ জানো?’
“ ‘শুনলাম নাকি গ্রেফতার করেনি?’ কেউ বলল।
“ ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে।’ পাশ থেকে রুমা বলে উঠল। কখন সে এসে দাঁড়িয়েছে পাশটিতে। রুমা হল নীহারের পিঠোপিঠি ছোটো বোন।
“ ‘কিন্তু কেন?’
“ ‘আসল সন্দেহের তির বালিজীর ভাইয়ের দিকে। তার গতিবিধি নাকি সন্দেহজনক।’ রুমা জানায়।
“ ‘সে কি? সে কি কোনও কালোবাজারি করে?’ আমার প্রশ্ন।
“ ‘আহা বিজন! হচ্ছে শিশু অপহরণের মতো চাঞ্চল্যকর কথা আর তুই কোত্থেকে কালোবাজারি-টারি কীসব বলছিস।’ নীহারদা ধমকে উঠল আমাকে।
“ ‘ব্রিজ বা বাঁধ তৈরির সময়ে নরবলি বা শিশুবলি দেবার কথা শোনা যায়’। ভারিক্কি চালে বলল রুমা।
“এই গল্পটা আমিও যেন কোথাও পড়েছিলাম। চুপ করে রইলাম। যদিও বুকের ভিতরটা ধুকপুক করছে আমার।
“ ‘কিন্তু হারিয়েছে কোন শিশু? কাদের ঘরের ছেলে? এই প্রজেক্ট এরিয়ার কারোর নয় তো?’ একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে ফের বলে উঠলাম আমি। বলে আবার ধমক খেলাম।
“ ‘কোন শিশু হারিয়েছে সেটা বড়ো কথা নয়। একটা শিশু নিরুদ্দেশ হয়েছে সেটাই মোক্ষম কথা। নইলে পুলিশ কি এমনি এমনি তোলপাড় করে খুঁজছে?’ গম্ভীর গলায় নীহারদা বলল।
“আমি চুপ মেরে গেলাম। কিন্তু আমার মনে ঘুরছে একটা ছবি। পৌনে চার-ফুটি এক বালক। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। মাথা নেড়া। গলায় ঝোলানো লম্বা পৈতেখানা জামা ছাড়িয়ে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে…
“একটা জরুরি কথা বলতে ভুলে গেছি। আমার আগেই বলা উচিত ছিল।” ক্ষমা চাওয়ার ঢঙে বললেন বিজুদা আজকের গল্পের আসরে।
“কী সেই কাহিনি? সেইদিন দাবা খেলার শেষে বালিজী বলেছিলেন আমায়, ‘তা বিজনবাবু, রামায়ণ তো পড়েছ, যেখানে আমাদের এই কিষ্কিন্ধ্যার কথা আছে…’
“ ‘রামের বন্ধু সুগ্রীব ছিলেন কিষ্কিন্ধ্যার রাজা!’ পাশ থেকে বলে উঠল মিনি। সেও জানে রামায়ণের গল্প।
“ ‘উঁহু। তার আগে আদতে তাঁর দাদা মহাবীর বালি ছিলেন কিষ্কিন্ধ্যা-নরেশ, বালি-সুগ্রীব মল্লযুদ্ধে রামচন্দ্র যাঁকে আড়াল থেকে অন্যায়ভাবে বাণ মেরে হত্যা করেন।’ বললেন বালিজী, ‘আমি অন্য কথা বলছি। বলি, নিকোলো কন্টির নাম শুনেছ তোমরা কেউ?’
“ ‘কী কন্টি? না, নাম শুনিনি ওঁর।’ বললাম।
“ ‘নিকোলো দ্য কন্টি। ইটালিয়ান পর্যটক। বহুভাষাবিদ। মার্কো পোলো ও ইবন বতুতার মতো জগদ্বিখ্যাত ভূ-পর্যটকের সঙ্গে একাসনেই বসাতে হয় যাঁকে, যিনি সেকালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত হয়ে চিন ও ইন্দোনেশিয়া ঘুরে আসেন।’ বালিজী বললেন।
“ ‘কন্টি যখন ভারতে আসেন তখনও কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেননি, বঙ্গদেশে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব হয় তারও অর্ধশতাব্দী পরে।’
“ ‘আর কন্টির শ্বশুরবাড়ি ছিল এই বিজয়নগরেই।’ পাশ থেকে রাঙামামার সহাস্য সংযোজন, ‘আপনার কাছ থেকেই শুনেছিলাম আগে একদিন।’
“ ‘জী। বিজয়নগরের এক কন্যাকেই বিবাহ করেছিলেন কন্টি। আর তারপর এখান থেকে বঙ্গালদেশ, মালয়, চিন, জাভা যেখানেই গেছেন সস্ত্রীক-সপুত্রই গেছেন নিকোলো! বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন উনি ওঁর পান্থলিপিতে।’
“ ‘কন্টির উপরেই তো আপনার গবেষণা, যে কারণে আপনি এই অঞ্চলেই থেকে গেছেন, রিটায়ার করে আর পাঞ্জাবে ফেরেননি!’ এও রাঙামামার সহাস্য সংযোজন।
“ ‘গবেষণা-টনা বলবেন না, ব্রহ্মজী। আমি সামান্য পড়ুয়া মাত্র, তবে কেতাবের চাইতে পত্থর আর গুহাকন্দর আর জমি-মাটি পাঠ করাতেই আমার বেশি উৎসাহ, যার জন্যে এখানে পড়ে থাকা। বিশেষ করে এক যুগান্তকারী ইটালিয়ান ম্যাপের উপরে তীব্র আকর্ষণ আছে আমার।’ বালিজী উত্তর দিলেন।
“ ‘ফ্রা মাউরো ম্যাপ!’ রাঙামামা বললেন।
“ ‘হ্যাঁ, ব্রহ্মজী। এর সম্বন্ধেও আগে আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করেছি আমি। দিস ইস মাই অবসেশন। বুড়োর পাগলামি বলতে পারেন।’ বললেন মি. কে.এন বালি, ‘এইটা হল এক যুগান্তকারী ম্যাপ! ভাস্কো-ডা-গামা ইউরোপ থেকে সটান ভারতে আসাবার সমুদ্রপথ আবিষ্কারের অনেক আগেই ফ্রা মাউরো তাঁর ম্যাপে সে পথের হদিশ এঁকে দিয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত ফরাসি ম্যাপ-মেকার জেরার্ডাস মার্কাটার সাহেবের অনেক আগেই। ইটালির এক পাদ্রি ছিলেন ফ্রা মাউরো। ভেনিস ছেড়ে জীবনে এক পাও বেরোননি। দেশভ্রমণ করে নিকোলো কন্টি ইটালির বাড়িতে ফিরে এলে মাউরো নাকি এই ম্যাপটা এঁকেছিলেন কন্টির মুখে গল্প শুনে শুনে। কিন্তু এর এক আদি কপি সম্ভবত ছিল কন্টির কাছে এবং…’
“ ‘এবং কী?’ আমাদের সমস্বর প্রশ্ন।
“ ‘এর এক আদি কপি ছিল নিকোলো কন্টির কাছে, যা তিনি বিজয়নগরেই ছেড়ে যান।’ বালিজী বললেন। ‘এটা খোঁজাই আমার মিশন।’
“ ‘সত্যি?’ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার।
“এহেন ইন্টারেস্টিং তথা বুজুর্গ মানুষ মি. কুশাক্ষনাথ বালিকে শিশু অপহরণের দায়ে পুলিশে ধরেছে, খবরটা হজম করা শক্ত। উপরন্তু, খবরটার সোর্স কী সেটাই কেউ বলতে পারছে না, যেমন বলতে পারছে না ঠিক কোন শিশুটি অপহৃত হয়েছে, যদিও সারা কলোনি জুড়ে এই গরমাগরম আলোচনা চলছে তুমুলভাবে।
“এই প্রশ্ন ফের উত্থাপন করে ধমক না খেয়ে পরেরদিন সকালে এক ডিসিশন নিয়ে ফেললাম, বুঝলি হরেরাম!” সুদীপের দিকে তাকিয়ে বললেন বিজুদা, আজকের গল্পের আসরে।
ওঁর স্বভাবোচিত উদ্ভট নামে ডাকা শুরু হতেই বুঝলাম যে বেশ মুডে এসে গেছেন বিজুদা, কারণ গল্পের মুডটা খোলতাই হলেই উনি আমাকে হয়তো ‘চণ্ডীপ্রকাশ’ বা নীতিনকে ‘হাতেমতাই’ বা সুদীপকে ‘রাধামাধব’ বলে ডাকেন। পরক্ষণেই হয়তো আমি হয়ে গেলাম ‘ড. জিভাগো’, সুদীপ ‘সত্যপ্রকাশ’ ও নীতিন ‘কাব্যবিশারদ’! সত্যি, বিজুদার এই নিত্যনতুন উদ্ভট উদ্ভট নামে ডাকাটা বড্ড উপভোগ করি আমরা। আমাদের কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না উনি কখন কাকে ডাকছেন। কেবল আমাদের মধ্যে শ্যামল অধ্যাপক মানুষ বলে সর্বদাই তাকে ‘পোরোফেসর সাআআব’ বলে ডাকেন বিজুদা।
“যাই হোক, গল্পে ফিরে আসি।” বলে যেতে থাকেন বিজুদা।
“পরদিন সকালে জলখাবার-টাবার খেয়ে ঘরের এককোণে পড়ে থাকা রাঙামামার লজঝড়ে সাইকেলখানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
“ ‘ওটা নিয়ে আবার কোথায় চললি, বিজু?’ মা জিজ্ঞেস করলেন।
“ ‘পাম্প দিইয়ে নোব আমি। দুপুরে খাওয়ার আগেই ফিরব।’ সাইকেলে চড়তে চড়তে বললাম।
“এই কে.এন. বালির গ্রেফতার-রহস্যটা উদ্ধার করতেই হবে আমায়। কাগে কান নিয়ে গেছে শুনে কাগের পিছনে দৌড়নোটা আমার স্বভাবে লেখা নেই, বুঝলি? নিজে হাত বুলিয়ে দেখে নেব আমার কানটা আছে কি না। তাই চললাম বালি-সাহেবের বাড়ি খুঁজতে, সরেজমিন তদন্তে। বালিজী মানুষটিকে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল আমার।
“কলোনির হাতার কিছুটা বাইরে একটা ছোটো কসবা আছে, সেখানে কয়েকটা দোকানপাট, কয়েকটা পাকাবাড়ি-টাড়ি রয়েছে। সকালের দিকে একটা ছোটো বাজারও বসে। বালিজী এখানেই থাকেন শুনেছিলাম। ওঁর নাম করতেই লোকে দেখিয়ে দিল।
“একটি ছোটো দোতলা বাড়ি। হলুদ রঙ। দরজা-জানালা সবুজ। সব টাইট করে বন্ধ করা রয়েছে। গেটে কিন্তু তালা দেওয়া নেই। অনেকবার কড়া নাড়বার পরে এক বুড়ি পরিচারিকা গোছের দক্ষিণী মহিলা বেরিয়ে এসে অবোধ্য ভাষায় কীসব বলে দড়াম করে মুখের উপরে দরজাটা বন্ধ করে দিল। পরনের নীল শাড়িটা তাঁর ধুতির মতো কাছা দিয়ে পরা।
“এত দূর এসেছি খুঁজে খুঁজে, চলে যাব খবরটা না নিয়েই? বালি-সাহেব কি সত্যিই গ্রেফতার হয়েছেন, না ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসে আছেন ঘরের ভিতরে, জানতে হবে না? কেন উনি গ্রেফতার হবেন? কী দোষ করেছেন উনি?
“আবার কড়া নাড়া। আবার। বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
“ফের সেই বুড়ি দরজা খুলতেই হাতজোড় করে নমস্কার করলাম। নিজের বুকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ‘বিজন। বিজন। কলকাত্তা।’ ইঙ্গিতে দেখালাম যে ভিতরে আসতে চাই। ভাষা না বুঝলেও বুড়ি যেন বুঝতে পারে যে গৃহকর্তাকে গিয়ে বলতে বলছি যে আমি বিজন। কলকাতা থেকে আসছি। ভিতরে আসতে চাই। ব্যক্তিত্ব বাড়াতে সেদিন ফুলপ্যান্ট পরে গিয়েছিলাম আমি।
“হাতের ভঙ্গিতে ‘ওয়েট’ দেখিয়ে বুড়ি অন্দরে চলে গেল। আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পরে ফিরে এসে ভেতরে ডাকল। ইঙ্গিতে উপরের তলায় উঠে যেতে বলল।
“অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর ডিঙিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকেই একটা ঘরের দরোজা খোলা। বেশ বড়ো ঘর একটা। তার অন্যসব দরজা-জানালা বন্ধ। বাইরের রোদ থেকে ঢুকে আরও ঠাহর পাচ্ছি না কিছু। ঘরের দেওয়াল জুড়ে কেবল বই আর বই, এইটা হালকা রকম দেখতে পেলাম।
“মস্ত বড়ো একটা টেবিলের ও-পারে চেয়ারে বসে আছেন খর্বকায় বালিজী, ওঁর বুক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সামনে টেবিলের উপরে রাখা অনেক কাগজপত্তর, ফিল্মের নেগেটিভ, কয়েকটা পাথরের ঢেলা ও এক ম্যাগনিফাইং গ্লাস সামনের টিমটিমে টেবিল ল্যাম্পটির আলোয় দেখা গেল। উনি এগুলি নিয়েই কাজ করছিলেন মনে হয়।
“ ‘আমি বিজন। আমাকে চিনতে পেরেছেন কি?’ বললাম।
“ ‘আসেন আসেন। বসতে আজ্ঞা হউক।’ হাসতে হাসতে উঠে বাইরের বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দিলেন উনি। রোদ্দুরে ভরে উঠল ঘরটা।
ঘরে ঢুকে বড়ো টেবিলটার পাশ দিয়ে গিয়ে ওঁর চেয়ারের কাছটায় দাঁড়ালাম আমি। উনি সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। অস্বস্তি হচ্ছে আমার। চিনতে পারছেন না নাকি? কিন্তু অভিবাদনে তো সেটা মনে হল না।
“ ‘আপনার নাম বিজন? কলকাত্তা থেকে এসেছেন? পি.এন. ব্রহ্ম-সাহেবের ভাগনে হন তো আপনি?’
“অবাক হলাম ওঁর এই কথা শুনে। দশদিন হয়ে গেল আমরা হসপেটে এসেছি। এর মধ্যে কতদিন উনি রাঙামামার কোয়ার্টার্সে এসেছেন, দাবা খেলেছেন, কত গল্প করেছেন আমার সঙ্গে, আর এখন এই কথা বলছেন? যেন চিনতেই পারছেন না! চূড়ান্ত অবাক হলাম।
“জলের জগটা এগিয়ে দিতে দিতে স্মিত হেসে বললেন তিনি, ‘বসেন, বসেন। এই লিন, পানি পীয়ে লিন। ঘাবড়াচ্ছেন কেন? কেলাস এইট পর্যন্ত আমিও বঙ্গালদেশে পড়াশোনা করেছি, কলকাত্তার কাছেই থাকতাম। দাদার মতো বঙ্গালীভাষাতে আমিও ভালো জানে।’ বললেন।
“ ‘দাদার মতো?’ অবাক হয়ে শুধোই আমি।
“ ‘মি. কুশাক্ষনাথ বালি। আপনি তাঁর সাথেই দেখা করতে এসেছেন তো? আমি তাঁরই ছোটো ভাই, সুখবীর। গোয়াতে থাকি। আমার বিজনেস আছে পত্থর আর সেরামিক টাইলসের। এই হাম্পি অঞ্চলে প্রায়ই আসি আমি, খাদান আছে।’ এবার বলেন, ‘হাউ ক্যান আই হেল্প ইয়ু? দাদা কিন্তু এখন এখানে নেই।’
“ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল পান করে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না আমার। হুবহু এক দেখতে দুই ভাইকে। কথা বলার ধরন, হাত নাড়ানো, ঘাড় ঘোরানো একই প্রকার। তাই প্রথম দর্শনে এঁকে বালিজী ভেবে ভুল করেছিলাম আমি। তবে একটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় এই ছোটো ভাইটির ঘাড়টা আর একটু যেন বেশি শক্তসামর্থ্য। চলতি কথায় বললে, এই ছোটো ভাইটি আর একটু যেন বেশি ঘাড়ে-গর্দানে। আর কোনও পার্থক্য নেই ভাইয়ে ভাইয়ে। ব্যবহার কিন্তু তেমনই অমায়িক।
“ ‘কোথায় গেছেন বালি-সাহেব? ওঁর সঙ্গে কেন দেখা হবে না? গত কয়েকদিন উনি দাবা খেলতে আমার মামার বাসায় আসেনওনি।’ কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে প্রশ্ন করি আমি। উনি কি তাহলে সত্যিই জেলে গেছেন? বাজারে চালু অপবাদটা কি তাহলে সত্যি?
“ ‘দেখা পাবেন না কারণ, দাদা এখন ওঁর স্টুডিওতে আছেন। ব্যস্ত।’
“ ‘স্টুডিও? মানে, উনি কি একজন শিল্পী?’ অবাক প্রশ্ন আমার।
“ ‘কার্টোগ্রাফার।’
“এর মানে যে ম্যাপ-মেকার, যাঁরা ম্যাপ আঁকে, এটা আমি জানতাম।
“বললেন সুখবীরজী, ‘আর ওঁর স্টুডিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই কিষ্কিন্ধ্যা অঞ্চলের পর্বতে কন্দরে গুহায় নদীতে হ্রদে, হাম্পির ভগ্নাবশেষের চৌভিতে। বর্তমানে উনি সুগ্রীব-গুহা অঞ্চলে গবেষণারত আছেন। দেখা তো হবে না ভাই এখন ওঁর সঙ্গে।’
“ ‘কিন্তু আমাদের কলোনিতে কী খবর রটেছে সেটা কি আপনি জানেন?’
“‘আলবাত। পুলিশ আসবার খবর তো? কিন্তু পুলিশ তো এসেছিল আমার কাছে, খাদানের লাইসেন্স রিনিউ করা নিয়ে এক ডিসপ্যুটে। দাদা ইন্টারভিন করেছিলেন সেই খাদানের গায়েই এক ঐতিহাসিক গুহা আছে, সেই ব্যাপারে। আরকিওলজিক্যাল সার্ভে এখনও সেটা অধিগ্রহণ করেনি, কথাবার্তা চলছে, সেই নিয়ে।’
“ ‘তাহলে এর সঙ্গে ট্রেন থেকে শিশু অপহরণের কোনও সম্পর্ক নেই বলছেন?’ আমি বলি।
“চমকে উঠলেন ভদ্রলোক। ‘শিশু অপহরণ? শিশু চুরি গেছে? সে কি? কবে হয়েছে? কার শিশু চুরি গেছে?’ সুখবীরজীর গলায় খাঁটি বিস্ময়।
“এবার ঢোঁক গেলার পালা আমার কারণ, এই ডিটেইলটা আমিও জানি না, আর এটা জানতে চেয়েই ক্লাবে নীহারদার কাছে ধমক খেয়েছিলাম। অন্যভাবে গুছিয়ে বললাম সেটা ওঁকে। চিন্তিত হয়ে উঠল ওঁর মুখ।
“ ‘তাহলে তো এখনই আপনাদের কলোনিতে যেতে হয় আমায়। ক্লাবে গিয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলে ভুল ভাঙাতে হয়। নইলে এক নিরপরাধ মানুষের নামে অযথা কলঙ্ক রটছে, এটা ঠিক নয়!’
“সেদিন বিকালে কিন্তু সুখবীরজী আসেননি আমাদের কলোনিতে, সান্ধ্য আড্ডাতেও না। যদিও উনি বলেছিলেন যে কলোনিতে ওঁর বহু যাতায়াত আছে, অনেক বন্ধু আছে সেখানে।
“বলা বাহুল্য, আমার সকালের অভিযানের কথা কাউকেই বলিনি। চেয়েছিলাম, বালিজীর ভাই নিজেই চলে আসুন, সকলের সঙ্গে কথা হয়ে যাক সামনাসামনি। কে.এন. বালি নিজে উপস্থিত হলে তো সবচেয়ে ভালো হত, কিন্তু কী যে গবেষণা করছেন উনি পাহাড়ি স্টুডিওতে বসে, খোদায় মালুম।’
“সুখবীরজী এসেছিলেন তার পরের দিন। দশটা নাগাদ আমি ক্লাবে ঢুকতে যাচ্ছি, এবার ক্যারমের আসর বসবে, দেখি ভট ভট করতে করতে এক ল্যাম্ব্রেটা স্কুটার চালিয়ে উনি আসছেন।
“ ‘আসেন, আসেন, চড়ে পড়ুন। বিস্তর কথা আছে আপনার সঙ্গে।’ বললেন উনি আমায়।
“একে তো স্কুটার চড়ার সুযোগ (১৯৬০-এর দশকে খুব রেয়ার ছিল), তার উপরে উনি ‘আপনি আপনি’ করে কথা বলছেন আমাকে! বেশ কেউকেটা লাগছিল নিজেকে। সাত-পাঁচ না ভেবেই উঠে বসলাম পিলিয়নে। সেদিনও গতকালের ওই ফুলপ্যান্টটা পরে ছিলাম কিনা!
“ ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে গঙ্গাবতী গ্রাম। তার পাশে আছে টিলা। পাত্থুরে জায়গা। স্কুটারে আধা ঘণ্টা লাগবে। আমি যাচ্ছি। উড ইউ লাইক টু গো?’
“মূলত স্কুটারে চড়তে পাবার আনন্দেই রাজি হয়ে গেলাম আমি। এখনই তো ফিরে আসব।
“ ‘গুহাটা সেখানেই।’ সুখবীরজী জানালেন।
“‘গুহা?’ শুধাই আমি।
“‘স্টুডিও!’ হাসেন সুখবীরজী ঘাড় ফিরিয়ে, ‘কাল রাতে ভূমিকম্প হয়েছিল, টের পেয়েছিলেন কি?’
“‘না তো।’
“ ‘সে কি! পরশুও তো হয়েছিল, আরও বেশি। বুঝতে পারেননি কি?’
“ ‘হ্যাঁ, সেটা নিয়ে বাড়িতে-ক্লাবে চর্চা হচ্ছিল বটে।’ বললাম।
“পথটা এখানে বেশ পাহাড়ি, উঁচুনীচু।
“ ‘ওই দেখেন পম্পা সরোবর। রামায়ণের কালে সীতা মাঈয়া স্নান করেছিলেন এখানে।’ আঙুল তুলে দূরে একটা হ্রদ দেখালেন সুখবীরজী। চমৎকার ফুল-ফলশোভিত গাছপালা দিয়ে ঘেরা সেই জায়গাটা।
“ ‘সামলিয়ে বসেন বিজনবাবু। পত্থর ভরা আছে রাস্তায়।’
“আমি ওঁর কোমরের বেল্টটা বেশ পাকড়ে ধরলাম।
“ ‘ওই যে দূরে দেখছেন বড়ো বড়ো পত্থর, ওইগুলি কিন্তু আসলে দুন্দুভি রাক্ষসের হাড়গোড়। বালি রাজা ছুড়ে ফেলেছিলেন। এখন সব শিলা হয়ে গিয়েছে।’
“বেশ মজা পেলাম ওঁর কথায়। উনি বোধ হয় সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন এসব গল্প।
“ ‘এসো এসো, বিজুবাবু, মি. বিজনবিহারী সরকার। আসতে আজ্ঞা হউক।’
“মস্ত মস্ত পাথরের বোল্ডার টপকে টপকে পাহাড় থেকে নেমে আসতে থাকেন মি. বালি, মিস্টার কুশাক্ষনাথ বালি। মাথায় তাঁর খনি-কর্মীদের মতো এক সার্চ লাইট বাঁধা রয়েছে, সেটা খুলতে খুলতে ওয়েলকাম জানালেন আমায়। হাসতে হাসতে বলেন, ‘সামলিয়ে সামলিয়ে উঠবেন ভাই বিজনবাবু।’
“পাশে ঘাসের উপর স্কুটারটা স্ট্যান্ড করিয়ে আমাকে নিয়ে টিলা বেয়ে উপরের দিকে উঠতে যাচ্ছিলেন ওঁর ভাই। প্রখর রৌদ্রে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। হাওয়াও দিচ্ছে। মাসটা কার্তিক। বেশ উপভোগ্য আবহাওয়া। সকাল দশটা-টশটা বাজে বোধ হয়।
“নীচে নেমে এসে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন বালিজী, আলিঙ্গনও করলেন। উচ্চতায় উনি আমার চেয়ে সামান্য বেশি হবেন মাত্র।
“ ‘বিজন, তোমার উৎসাহ আছে তাই বলি, আমার এতদিনের গবেষণা আজ সফল হয়েছে!’
“ওঁকে কথা শেষ করতে না দিয়েই শুধাই, ‘তার মানে আপনি নিকোলো কন্টির পান্থলিপি খুঁজে পেয়েছেন? আর সেই ম্যাপ? ফ্রা মাউরোর ম্যাপ?’
“ ‘ফ্রা মাউরোর অরিজিন্যাল ম্যাপখানি তো রাখা রয়েছে ভেনিসের এক জাদুঘরে। কিন্তু অন্য নানান সোর্স থেকে ও ট্রাভেলগ পড়ে আমার মনে হয়েছিল…’
“হঠাৎ গুড় গুড় করে শব্দ আর দুলে উঠল মাটিটা।
“ভূমিকম্প শুরু হয়েছে! ভূমিকম্প!
“তিনজনে আমরা দৌড়ে গিয়ে পাশের ফাঁকা মাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম। তীব্রতা বেশি নয় এই ভূ-কম্পের। কয়েক মিনিট পরেই মাটি কাঁপা থেমে গেল।
“ ‘বিজনবাবু কি দেখতে চান সেই ঐতিহাসিক ম্যাপ, ভাস্কোরও আগে ভারতে আসার সটান জলপথ আঁকা ছিল যেখানে?’ বালিজী জিজ্ঞেস করেন।
“ ‘আপনার কাছে আছে সে ম্যাপ?’
“ ‘বহু গুণের অধিকারী ছিলেন বটে এই কন্টি-সাহেব, কিন্তু উনি যে ম্যাপ আঁকাতেও দড় ছিলেন সেটা লেখে না কোনও প্রতিষ্ঠিত সোর্সে। তারই প্রমাণ সদ্য পেয়েছি গুহার দেওয়ালে!’
“ ‘দেওয়ালে?’
“ ‘জী। দেওয়ালের গায়ে আপন খেয়ালে এঁকে গিয়েছেলেন উনি গোলাকার পৃথিবীর ম্যাপ, যদিও আরব্য পরম্পরা মেনে ম্যাপের উপরদিকটা দক্ষিণ আর তলাটা উত্তরদিক। এই দেখুন।’
“নানান কথা বলতে বলতে আমরা টিলায় চড়ে গুহাটির মধ্যে ঢুকে এসেছিলাম ততক্ষণে। বিভিন্ন ছবি, রঙ ও জ্যামিতিক ফিগারে ভরা রয়েছে গুহার দেওয়াল।
“ ‘যদিও এই সবগুলিই যে কন্টির কাজ, তা নয়। তার বহু বহু আগেকার কালেরও কাজ থেকে থাকবে, কার্বন ডেটিং করলে বোঝা যাবে।’ বালিজীর গলা ভেসে এল পিছন থেকে।
“গুহার মধ্যে এক সরু সুড়ঙ্গ পথ ধরে এগোচ্ছি আমরা। প্রথমে বালিজী, তারপরে আমি, শেষে সুখবীরজী। সামান্য সামান্য আলো আসছে কোন ফাঁকফোকর দিয়ে কে জানে। কোনোখানে আবার সম্পূর্ণ অন্ধকার।
“ ‘এইবার দেখেন।’
“সার্চ লাইট অন করে দিতে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বাঁদিকের দেওয়াল জুড়ে মস্ত এক মানচিত্র আঁকা রয়েছে। নানান রঙে। অনেক অনেক স্থান-নাম লেখা তাতে। লাতিন ভাষা হবে। অক্ষরগুলোর মিল আছে ইংরিজির সঙ্গে। নীল রঙের সমুদ্র। হলদেটে স্থলাঞ্চল। উনি আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলতে লাগলেন আর অবাক বিস্ময়ে দেখি আমি, কলকেতার এক কিশোর, ক্লাস এইটে পড়ি তখন। ঐতিহাসিক এক মানচিত্রের সামনে কি দাঁড়িয়ে আছি আমি, ভাস্কো-ডা-গামার ভারতে আসাবারও আগে নাকি যেখানে সেই জলপথ অঙ্কিত ছিল!
“ ‘আর এইদিকে দেখেন।’ বালিজী বললেন।
“দেখি গুহাগাত্রে আঁকা নানান রঙিন চিত্র, বালি-সুগ্রীবের মল্লযুদ্ধের ছবি। বানর-রাক্ষসদের লড়াইয়ের ছবি। সেতুবন্ধনের ছবি। দশমুখের রাবণ।
“ ‘কার আঁকা ছবি এসব? নিকোলো কন্টির?’
“ ‘নিশ্চয়ই নয়। এর স্টাইল আরও প্রাচীন। এই গুহাটার কথাই আমি প্রাচীন এক টেক্সটে পড়েছিলাম, এ-অঞ্চলের ওরাল হিস্ট্রিতেও ঘোরে এসব গপ্প। এটাই ছিল আমার বিগত বিশ বছরের খোঁজ, বুঝলেন বিজনবাবু? পরশুদিনের ভূমিকম্পের ফলে এই গুহার সামনের কোন পত্থর সরে গিয়ে থাকবে, যাতে উন্মুক্ত হয়ে যায় এটি।’ বালিজী বললেন।
“পরের পর গুহাচিত্র দেখে চলেছি। হঠাৎ একটা ছবির উপর দিয়ে আলো ঘুরে যেতেই চমকে উঠলাম আমি। “ ‘দাঁড়ান দাঁড়ান। দেখি দেখি, এটা কার ছবি?’
“সেই ছবিতে দেখি চারটি হুবহু এক দেখতে বালক। মুণ্ডিত মস্তক। দীর্ঘ উপবীত। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আমার স্মৃতিতে চলে এল ট্রেনের কামরায় দেখা একটা ছবি।
“ ‘এরা কারা?’ শুধাই অবাক বিস্ময়ে।
“ ‘এ-ছবি তো দেখা যায়। আগে দেখেছি আমি কোথাও।’ বললেন বালিজী, ‘এঁরা হলেন সনকাদি বাল-চতুষ্টয়।’
“ ‘একটু ব্যাখ্যা করে বলুন প্লিজ।’ হাত-পা কাঁপছে আমার।
“ ‘পুরাণে আছে, ব্রহ্মার আদি পুত্র ছিলেন এই চারজন—সনক, সনন্দ, সনাতন আর সনৎ। তাই সনকাদি বলে পরিচিত। সনক আদি, মানে সনক প্রমুখ। চারজন।’
“ ‘সনৎ?’ অবাক প্রশ্ন আমার।
“ ‘হ্যাঁ, চতুর্থজন।’
“ ‘সনৎ কি হারিয়ে গেছে?’ আমার জিজ্ঞাসা।
“ ‘বৈকুন্ঠধামের দ্বারে প্রহরী ছিলেন জয় আর বিজয় দুইভাই। তাঁরা কাজে অবহেলা করায় শাপগ্রস্ত হয়ে ত্রেতাযুগে রাবণ আর কুম্ভকর্ণ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন।’
“ ‘কুম্ভকর্ণ? যে খুব ঘুমোত? আর খেত?’ আমার প্রশ্ন।
“ ‘মস্ত ধার্মিক আর মহাবীর ছিলেন কুম্ভকর্ণ। রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার জন্যে দাদা রাবণ তাঁকে জাগিয়ে তুললে প্রথমেই উনি সীতাকে ফেরত দিয়ে দেবার কথা বলেছিলেন। সনকাদির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ওঁদের নিয়ে সারা জগৎ-চরাচরে ঘুরে বেরিয়েছেন।’
“ ‘কে? মি. কর্ণা?’ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল আমার।
“ ‘আর দায়িত্ব অ-পালনের দোষে শাপভ্রষ্ট হয়েছেন।’ আমার প্রশ্ন গ্রাহ্য না করে বালিজী বললেন।
“কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি।
“ ‘সনৎ কি হারিয়ে গেছে?’ ফের প্রশ্ন রাখি।
“ ‘ওগো, সনৎকুমার হল নিত্যকুমার। তিনি সদাই সর্বত্র বিরাজমান আছেন, আজ এখানে কাল সেখানে। এই দেখা দেন, এই করেন অন্তর্ধান। তাঁকে খুঁজবে কে গো?’ বালিজী বললেন।
“ ‘তার মনে সনৎ কি হারায়নি?’ আমার জিজ্ঞাসার নিরসন হয়নি তখনও।
“আরও কত কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বালীজীর কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ গুড় গুড় করে উঠল মাটি! আবার ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। ভূমিকম্প। এবারে তেজটা অনেক বেশি। গুম গুম গুম গুম করে শব্দ আসছে মাটির তলা থেকে আর কেঁপে কেঁপে উঠছে মাটি।
“ক্রমে আরও বেড়ে উঠল কম্পন। দুম দুম করে উপর থেকে পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে এসে পড়ছে।
“ ‘কুইক! কুইক! পালাও পালাও এখান থেকে।’ আমার হাত ধরে গুহার বাইরের দিকে দৌড় লাগালেন বালিজী। পিছন পিছনে সুখবীরজী।
“ ‘আমাদের ভুল হয়ে গেছে। এই ভূমিকম্পের আবহে গুহাতে ঢোকা উচিত হয়নি।’ বললেন তিনি।
“এদিকে মহা সর্বনাশ! গুহার মুখটা খুঁজে পাচ্ছি না আমরা। পথ ভুল করলাম নাকি?
“তা নয়। মাটির কম্পনে কোনও এক বড়ো পাথর গড়িয়ে এসে ঢেকে দিয়েছে গুহামুখ। সর্বনাশ! এবার আমরা বেরোব কী করে?
“ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলাম। সার্চ লাইটের আলোও কমতে শুরু করেছে।
“বহু প্রচেষ্টায় শেষে এক পথ বেরোল।
“ ‘ওই দেখেন, সামান্য সূর্যালোক আসছে ওই ফোকর দিয়ে।’ বললেন বালিজী। ‘আপনি ছোটোখাটো আছেন বিজন, পাতলা শরীর। আপনি আগে এই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যান। তারপর আমাদের টেনে তুলবেন।’
“ডানদিকে এক উপ-সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে বালিজী ঠেলে তুলে দিলেন আমাকে। অনেক কষ্টে আমার মাথাটা বাইরে বেরোল, তারপর পুরো শরীরটা।
“বাইরে এসে প্রখর রৌদ্রালোকে ও হাওয়ায় মস্ত এক পাথরের চাঙড়ের উপরে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। হাঁফাচ্ছি। অসম্ভব ক্লান্ত আর ভীত হয়ে পড়েছিলাম। শরীর আর দিচ্ছে না। আর পারছি না।
“কিন্তু পারতে যে আমাকে হবেই।
“ভাই সুখবীরকে এবার ঠেলে তুলে বাইরে বার করতে চাইলেন বালিজী। বাইরে থেকে ওঁর হাত ধরে আমি টানছি। কিন্তু কিছুতেই বার করতে পারলাম না ওঁর ভারী শরীর।”
বিজুদা চুপ।
বিজুদার গল্প শেষ।
শেষ? আজকের গল্প শেষ?
“কী হল? শেষপর্যন্ত কী হলো ওঁদের? বলুন! থেমে গেলেন কেন?” সমস্বরে ডুকরে উঠলাম আমরা শ্রোতারা। “উদ্ধার করতে পেরেছিলেন ওঁদের?” আমাদের মিলিত প্রশ্ন।
“বহু কষ্টে অনেক পরে এক খাদানের লরি পেয়ে সন্ধ্যাবেলায় যখন কলোনিতে ফিরে এসেছিলাম, ততক্ষণে কান্নাকাটি পড়ে গেছে সেখানে—আগের সেই ‘অজ্ঞাত’ বালকের মতো আরও একটি ছেলে চুরি হয়ে গেল নাকি? গেটেই বহু লোকের ভিড়।
“এরপরের গল্প আর আমার কাছ থেকে আর শুনতে চেওনি বাপু। সুমিত্রা বোনটি, দাদাকে একটু চা দিবিনি? গলা যে শুকিয়ে গেল!” হাতজোড় বিনতি বিজুদার।
“শেষে শুধু জানাই, না, প্রস্তর-সমাধি হয়নি বালি-সুখবীরের। শহর থেকে লরি ভরে লোকলশকর শাবল-টাবল নিয়ে এসে গুহামুখের পাথর সরিয়ে ওঁদের উদ্ধার যখন করা গেল, রাত ভোর হয়ে গেছে ততক্ষণে।” চা-পান শেষে বিজুদার ঘোষণা।
বিজুদার আজকের গল্পের শেষে আমাদের কারও মুখে আর বাক্যি সরল না।
অনেকক্ষণ পরে সুমিত্রা নিম্ন স্বরে প্রশ্ন করল, “সনতের কী হল দাদা, শেষপর্যন্ত? তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি?”
কাষ্ঠ হেসে বললেন বিজুদা, “তুমিও তো আমার মায়ের মতোই আধো-বাস্তব আধো-কল্পনার জগতে থাকো, দিদিমণি!”
“তার মানে সনৎ কি আদপে হারায়ইনি?” আমাদের প্রশ্ন।
বিজুদার বললেন, “তার চেয়ে সেই গুহাচিত্র আর সনকাদি কুমার-চতুষ্টয়ের কাহিনি অনুযায়ী ভেবেই নাও না যে সত্যযুগ থেকেই সেই চার ভাই বিশ্ব পরিক্রমা করে বেড়াচ্ছে, আর…’
“কর্তব্যে গাফিলতির দায়ে কুম্ভকর্ণেরা শাপভোগ করছে।” বললাম।
“কুম্ভকর্ণ আবার কোত্থেকে এল?”
“ও, আচ্ছা। কর্ণা। মি. কে. কর্ণা।”
আমরা সকলে সমস্বরে হেসে উঠলাম।
“এবার ক্ষুধা লাগছে সবার। ডিনারের আয়োজন করো।”
সুদীপ এই ফাঁকে তাক থেকে বাংলা অভিধানখানা পেড়ে এনে একটা পৃষ্ঠা খুলে আঙুল দিয়ে দেখাল। বলল, “মানেটা জানতাম না। কুশাক্ষ মানে বানর। মাঙ্কি।”
“পদবিটাও মানানসই ছিল ওঁর। বালি।” বললাম।
“আর তাঁর ভাই? সুগ্রীব। না, সুখবীর।” হেসে মন্তব্য করল সুপুত্র আমার।
কিষ্কিন্ধ্যার কাহিনি আর কত শুনবে গো? আজকের মতো এখানেই গল্পের শেষ।
জয় বজরঙ্গবলী!
অলঙ্করণ- মৌসুমী
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস