গল্প-লোডশেডিং রহস্য-বৃন্দা মিত্র – বসন্ত ২০২১

“উফ্! কী মশা রে বাবা। এদিকে সারাক্ষণ লোডশেডিং হয়েই আছে। তার ওপর আবার গরমকাল।”

“চুপ কর কোকিল।” তার মা বলল, “আগেকার দিনে লোডশেডিং হলে মোমবাতির আলোয় পড়তাম আমরা। আর তুমি এত বড়ো একটা ব্যাটারি ল্যাম্প পেয়েও খুশি নও?”

কোকিল কিছু বলল না। তার মা বলল, “এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড় তো। কাল আবার ভোরবেলা স্কুল আছে।”

কোকিল আর তার দুই বোন রিমা আর ঝুমা খেতে বসল। আজ লোডশেডিং বলে বেশি কিছু হয়নি। শুধু একটু ভাত, ডাল, কালকের পনির, বেগুন ভাজা আর আলু ভাজা হয়েছে। কোকিল আর তার দুই বোন খেয়ে নিল। তারপর কোকিল যেই বাথরুম গেল, তখন জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল দুটো ছায়া দুজনের সঙ্গে গল্প করছে। কোকিলের খুব সন্দেহ হল। তখনই তার মা ডাকতে সে চলে গেল ঘুমাতে। কিন্তু মনে মনে সে ভাবল যে সে রোজ আসবে এদের কথা শুনতে। তারপর সে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন ভোরবেলা উঠে সে দেখে যে মা সুটকেস গোছাচ্ছে। কোকিল বলল, “কোথায় যাচ্ছ মা?”

মা বলল, “জামশেদপুরে যাচ্ছি তোর বাবার কাছে। দরকার আছে। তোর মামা আর তুই বাড়িতে থাকবি। মানুদিদি এসে রান্না করে দিয়ে যাবে। আর কাজল এসে ঘর মুছে দিয়ে যাবে। তুই একা থাকতে পারবি তো?”

কোকিল বলল, “হ্যাঁ মা, পারব।”

তার মামা বলল, “কাল যাচ্ছিস?”

মা বলল, “হ্যাঁ, অনিল।”

তারপর কোকিল তৈরি হয়ে স্কুলে গেল। গিয়ে প্রতিদিনের মতো ওর বন্ধু মধুর পাশে বসল।

কোকিলের ভালো নাম শুভমিতা ঘোষাল। সে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ফোর্থ পিরিয়ডের সময় মধু পড়তে পড়তে কোকিলকে ডেকে বলল, “জানিস শুভমিতা, আমাদের বাড়িতে রোজ লোডশেডিং হচ্ছে। তোদের বাড়িতেও হচ্ছে?”

কোকিল ‘হ্যাঁ’ বলল। তারপরেই হেড-স্যার ক্লাসে এসে বললেন, “কয়েকদিন পরেই তো সামার ভ্যাকেশন শুরু। তোমরা ঠিক করে পড়া করো, কেমন? সামনেই তো ইউনিট টেস্ট।” বলে তিনি চলে গেলেন।

তারপর ইংরেজি-স্যার বললেন, “শুনলে তো সবাই?”

সবাই বলল, “হ্যাঁ, স্যার।”

তারপরেই টিফিনের বেল বাজল। স্যার তখন ক্লাস থেকে চলে গেলেন। কোকিল টিফিনে পরোটা আর আলু-মরিচ এনেছে আর মধু চারটে কলা এনেছে। মধু খেতে খেতে বলল, “নবীনপুর এলাকায় ভীষণ লোডশেডিং হচ্ছে।”

কোকিল বলল, “হ্যাঁ, আর পারা যায় না।”

তারপর টিফিন শেষ হতে সবাই তাড়াতাড়ি ক্লাসে ঢুকে পড়ল। ভূগোল-স্যার ক্লাসে এসে বললেন, “কালকে যে লেসনগুলো লিখতে দিয়েছিলাম সেগুলো পড়ো। আমি পড়া নেব।”

সবাই পড়তে লাগল।

দেখতে দেখতে ছুটির সময় হয়ে গেল। কোকিল বাড়ি ফিরছিল। তখন হঠাৎ একজন লোক পেছন থেকে কোকিলকে দেখে বলল, “খুকি, তুমি কি এই অ্যাড্রেসটা জানো?”

কোকিল পেছন ফিরে চমকে গেল। একটা দৈত্যের মতো দেখতে লোক। মাথায় টাক, গায়ে ধুতি-পাঞ্জাবি আর হাতে ঘড়ি। কোকিল ভয়ে ভয়ে বলল, “কোন অ্যাড্রেস?”

দৈত্যের মতো লোকটা তার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল, “এই অ্যাড্রেসটা চেন?”

কোকিল কাগজটা হাতে ধরে অ্যাড্রেস দেখল। তাতে লেখা আছে ১/২ নবীন বাগান রোড, নবীনপুর-৩।

কোকিল তার নিজের বাড়ির অ্যাড্রেসটা দেখে চমকে গেল। সে একটা ঢোঁক গিলে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন।”

কোকিল সেই লোকটাকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে বলল, “এটাই সেই বাড়ি।”

লোকটা কোকিলকে ধন্যবাদ বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। কোকিলের ভীষণ ভয় করছিল। পাঁচ মিনিট বাদে লোকটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কোকিল তক্ষুনি ছুটে বাড়ি ঢুকে গিয়ে দেখল যে সব ঠিক আছে। একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলল সে। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে হাত, পা, মুখ ধুয়ে নিল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ডিশ নিয়ে মানুপিসির রান্না করা ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা আর দই পোনা নিয়ে খেতে বসল। দই পোনা কোকিলের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। তার মামাও চা খাচ্ছিল। কোকিল খেতে খেতে তার মামাকে বলল, “উফ্! বা বা, কালকে একটু ঘুমোতে পাব। মে ডের ছুটি।”

তার মামা বলল, “যা বলেছিস।”

কোকিল বলল, “আচ্ছা মামা, আমাদের বাড়িতে একটু আগে কে এসেছিল?”

তার মামা বলল, “তাতে তোর কী?”

কোকিল আর কিছু বলল না। কোকিল তার খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে পড়তে বসে গেল। পড়তে পড়তে হঠাৎ তার কী মনে হল, সে দৌড়ে নীচে চলে গিয়ে তাদের বাড়ির পাশের গলিতে গিয়ে কিছু দেখল।

ওদিকে তার মা আর রিমা-ঝুমা তো জামশেদপুরে কোকিলের বাবার সঙ্গে। তারা এখন গল্প করছে। কোকিলের মা বলল, “আমার কোকিলকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে।”

কোকিলের বাবা বলল, “চিন্তা কোরো না। কালই তো বাড়ি যাচ্ছি।”

এদিকে কোকিল দেখল, ওই যে লোকটা কোকিলকে অ্যাড্রেস জিজ্ঞেস করছিল, সে গলিতে। কোকিলের খুব চিন্তা হল। কোকিল ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তার খুব ভয় করছিল। সে তাড়াতাড়ি পড়ে নিল। তারপর ঘড়ি দেখল। একঘণ্টার মধ্যে পড়া ও হোম-ওয়ার্ক শেষ। ভয়টাও অনেকটা কেটে গেছে। কোকিল দেখল যে সাতটা বাজে, এখন অনেক সময় আছে। ও তো ঘুমাবে দশটায়। তাই সে ভাবল যে একটু লজেন্স কিনে আনি। ও মামাকে বলল, “মামা, আমি একটু আসছি লজেন্স কিনে।”

ওর মামা বলল, “ঠিক আছে, কিন্তু তোর পড়া হয়ে গেছে?”

কোকিল বলল, “হ্যাঁ, মামা।”

মামা বলল, “ঠিক আছে, যা। কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবি।”

কোকিল বলল, “হ্যাঁ।”

তারপর সে বেরিয়ে গেল।

রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সে একটা বেড়াল দেখতে পেল। তাকে অনেকটা কোকিলের পোষা বেড়াল লুই-এর মতো দেখতে। কোকিল বেড়ালটাকে একটু আদর করে দিল। তারপর চলতে লাগল। রতনদার দোকানে গিয়ে কোকিল বলল, “রতনদা, লজেন্স আছে?”

রতনদা বলল, “কী রে কোকিল, লজেন্স কিনবি?”

কোকিল রতনদার হাতে দশ টাকা দিয়ে বলল, “দুই টাকার পাঁচটা লজেন্স দিন।”

রতনদা ওকে লজেন্স দিল। কোকিল একটা লজেন্স মুখে পুরে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে গেল। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই লোডশেডিং। কোকিল চমকে উঠল। তার মামা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘরে ঢুকল। বলল, “মোমবাতি রেখে গেলাম। ব্যাটারি ল্যাম্পে চার্জ নেই। হাতপাখা আছে তো?”

কোকিল বলল, “হ্যাঁ। বাবা-মা কবে আসবে?”

“কাল।” বলে মামা চলে গেল।

কোকিল দরজা বন্ধ করে বসল। মনে মনে ভাবল, ওই লোকটাই তার কেটে লোডশেডিং করল না তো? যাক গে। এখন একটু হাতপাখা করি। কী মনে হতে কোকিল ছুট্টে বাথরুমে চলে গেল। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। সেই লোকটা আর আরেকজনের গলা পাওয়া যাচ্ছে বাথরুমের পেছনের গলিতে। তার গলাটা কোকিলের খুব চেনা। লোকটা বলছিল, “কাল সবক’টাকে মেরে দেব।”

অ্যাড্রেস জিজ্ঞেস করা লোকটা বলছিল, “ঠিক আছে। আমি কাল এসে নিয়ে যাব।”

অন্য লোকটা বলল, “ঠিক আছে। কাল দশটার সময়ে এইখানে আসবেন।”

কোকিল মেরে ফেলার কথা শুনে চমকে উঠল। সে ঠিক করল যে কাল সে পুলিশ ডেকে আনবে।

দেখতে দেখতে রাত দশটা বেজে গেল। কিন্তু আলো এল না। সে আর তার মামা খেয়ে নিল। রাত বারোটার পর আলো এল। তখন তারা ঘুমাল।

কোকিলের ভোরে ওঠা অভ্যাস। আজ ছুটি তাই একটু দেরিতে উঠে সে ব্রাশ করে নিল। তখন সাতটা বাজে। কোকিল ড্রেস চেঞ্জ করে বিস্কুট খেয়ে নিল। দরজায় বেল বাজল। কোকিল খুলে দেখল মানুপিসি আর কাজলদি এসেছে। কোকিল বলল, “ভেতরে এসো।”

তারা ভেতরে এল। কোকিল মানুপিসিকে বলল, “মানুপিসি, একটু দুধ বানিয়ে দাও না।”

মানুপিসি বলল, “হ্যাঁ দিচ্ছি, তুই বস।”

ওদিকে কোকিলের মামা উঠে পড়েছে। কোকিল বলল, “গুড মর্নিং।”

তার মামাও বলল। তারপর মানুপিসি দুধ নিয়ে আসতে কোকিল দুধ খেয়ে পড়তে বসল। অঙ্ক হোম-ওয়ার্কটা শেষ করতে হবে। খুব শক্ত।

হোম-ওয়ার্ক শেষ হয়ে যেতে ঘড়ির দিকে সে তাকিয়ে দেখে সাড়ে ন’টা বাজে। তাড়াতাড়ি কোকিল মামার কাছে গিয়ে বলল, “মামা, আমি একটু মধুর বাড়ি থেকে আসছি।”

তার মামা বলল, “ঠিক আছে, যা। কিন্তু বেশি দেরি করিস না।”

কোকিল মনে মনে ভাবল যে সে পুলিশ ডাকতে যাবে। সে সাইকেলটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে থানায় গেল। পুলিশ অফিসারকে গিয়ে বলল, “স্যার, তাড়াতাড়ি আসুন। না-হলে বিপদ হয়ে যাবে।” এই বলে কোকিল পুলিশ অফিসারকে সব ঘটনা বলল। লোকগুলো মেরে ফেলার কথা বলছিল, সেটাও বলল।

অফিসার বললেন, “চলো তো।”

কোকিল সাইকেলে গেল। আর পুলিশরা জিপে।

পৌঁছতে পৌঁছতে দশটা বেজে গেল। কোকিল তাড়াতাড়ি গলিতে উঁকি মেরে দেখল লোকগুলো আছে। তখন সে আড়াল থেকে পুলিশকে সেই গলিতে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখিয়ে বলল, “এই সেই লোক।”

লোকটা তখন বলছিল, “সবগুলোকেই মেরে দিয়েছি। আপনি একটু দাঁড়ান। আমি নিয়ে আসছি।”

তারা চলে যাচ্ছিল, কিন্তু পুলিশরা আটকে দিল। পুলিশ অফিসার বললেন, “কী করেছিস বল। না-হলে হাজতে পুরব।”

লোকটা বলল, “আমি? আমি আবার কী করলাম?”

পুলিশ কোকিলকে বলল, “চলো তোমার ঘরে যাই। তারপর এর পেট থেকে কথা বের করছি।”

কোকিল ঘরে ঢুকে দেখে বাবা, মা, রিমা, ঝুমা এসে গেছে। মামাও বসে আছে। কোকিলকে দেখে সবাই বলল, “হ্যাপি বার্থডে।”

হ্যাঁ, কোকিল তো ভুলেই গেছিল আজ তার জন্মদিন।

তার বাবা পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে বলল, “কী হয়েছে স্যার?”

পুলিশ অফিসার বললেন, “আপনার মেয়ে আমাদের ডেকে এনে বলল যে এই লোকটা কিনা কাদের মেরে ফেলেছে।”

বাবা ওই লোকটাকে বলল, “আমি তো তোমার থেকে মাংস কিনি। তুমি আবার কী করলে?”

ওই লোকটা বলল, “না না, ওটা তো আমরা মুরগি মেরে ফেলার কথা বলছিলাম।”

পুলিশ অফিসার চমকে উঠে হেসে ফেললেন। বাবাকে বললেন, “আপনার মেয়ে বড়ো হয়ে ঠিক গোয়েন্দা হবে।”

সবাই খুব হাসল।

তারপর মা কোকিলকে আদর করে একটা নতুন জামা দিয়ে সেটা পরে আসতে বলল। বাবা পুলিশদের মিষ্টি আর পায়েস খাইয়ে দিল।

সবাই চলে যেতে কোকিলের বাবা বলল, “উফ্ বাবা, সত্যি। কোকিল এরকম করবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।”

শুনে কোকিল একটু হাসল।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s