“কী নাম তোমার, খুকি?”
ছোট্ট লাল পাপড়ির মতো ঠোঁটগুলো উলটে খুশি বলল, “আমার নাম খুকি নয়, খুশি, আর আমার ভালো নাম আরাত্রিকা রায়, যদিও মা আমাকে আদর করে আরা বলে ডাকে।”
“ও মা, খুশি আবার আরাত্রিকা? তোমার দু-দুটো নাম?”
“হ্যাঁ, দুটো নাম আমার। কেন, তোমার কি একটাই নাম?” খুশি জিজ্ঞাসা করে।
“হ্যাঁ, আমার তো একটাই নাম।”
“কী নাম তোমার?”
“আমার নাম মিষ্টিদাদু। আমি তো সব্বার মিষ্টিদাদু, আর এই নাও তোমার লজেন্স।” বলে খুশির হাতে দুটো লজেন্স তুলে দেয় দোকানদার।
“দাদুকে থ্যাঙ্ক ইউ বলো।” বলল খুশির বাবা।
“থ্যাঙ্ক ইউ দাদু, তুমি খুব ভালো।” ততক্ষণে একটা লজেন্স গালে পুরে ফেলেছে খুশি।
“তুমিও খুব ভালো আমার ছোট্ট লাল পরি।” উত্তর দেয় দোকানদার।
“এবার চলো যাওয়া যাক।” খুশির ছোট্ট হাতটা ধরে টান দেয় বাবা।
রাস্তায় যেতে যেতে খুশি বাবার কাছে জানতে চায় এটা কী গাছ, ওটা কী গাড়ি, আর খুশির বাবা স্বপনবাবু হাসি মুখে বলতে থাকেন, ‘এটা হল ছাতিমগাছ, এটা ব্যাটারি দেওয়া গাড়ি’ ইত্যাদি।
রবিবার সকালটা খুশির কাছে খুব আনন্দের। আজ স্কুল নেই, মা পড়ার জন্য তাড়া দেয় না, বাবা বাড়ি থাকে, তাই বেশি বকা দিতেও পারে না মা। সকালবেলা সে বাবার সঙ্গে বাজারে যায়, বাবা নানারকম সবজি, মাছ, মাংস কিনে আনে, আর সারা রাস্তা লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকলে ফেরার পথে লজেন্স কিনে দেয় খুশিকে।
রবিবার সারাটা দিন নিজের মতো করে কাটায় খুশি। টিভিতে কার্টুন দেখে, দাদুর সঙ্গে ছাদে খেলা করে, দুপুরবেলা মা গরম গরম মাংস-ভাত যখন খাবার টেবিলে আনে, খুশির থেকে বেশি খুশি আর কেউ হয় না। শুধু রবিবারেই মা, বাবা, দাদু আর খুশি একসঙ্গে খেতে বসে। কত আনন্দ লাগে তার! শুধুই মনে হয়, রবিবারটা কেন এত ছোটো হয়! বাকি দিনগুলো তো কত সময় ধরে চলতে থাকে, শেষ যেন হতেই চায় না, আর রবিবারটা হুট করে কেটে যায়।
***
“রোল নম্বর নাইন…”
“প্রেসেন্ট মিস।” উত্তর দেয় খুশি। সে শিবানী স্মৃতিমন্দির স্কুলের ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী।
সকালের ঘুমটা এখনো কাটেনি খুশির, সেই কোন ভোর পাঁচটাতে উঠেছে সে। তারপর নিজে নিজে রেডি হয়েছে, মা শুধু দুধটা খাইয়ে দিয়েছে। আজ আবার ইংলিশ টেস্ট আছে, তাই কাল অনেক রাত পর্যন্ত পড়তে হয়েছে তাকে। খুশির বাবা স্বপনবাবু একটি বেসরকারি কোম্পানির অনেক বড়ো পোস্টে আছেন, সারাদিন ব্যস্ত থাকেন, মেয়ের ওপর কোনোদিনই সেভাবে পড়াশোনার চাপ দেন না। উনি মনে করেন, একজন শিশু মনের আনন্দে যা শিখতে চায়, সেটাই তাকে শিখতে দেওয়া উচিত। বড়ো হলে ও একদিন নিজেই বুঝতে পারবে ও কী হতে চায়। আজকালকার মা-বাবার মতো স্বপনবাবু খুশিকে পড় পড় বলে বকা দেন না।
তবে খুশির মা খুব রাগী। একদম রুটিন করে পড়াতে বসান খুশিকে। আজ টেস্ট ছিল তাই মা কাল অনেকটা সময় ধরে খুশিকে পড়িয়েছেন ইংলিশ গ্রামার। সন্ধেবেলা ইংলিশ মিস পড়িয়ে যাবার পরেও সেই পড়াগুলো আবার একবার ঝালিয়ে দিচ্ছিলেন খুশির মা, তাই ডিনার করে শুতে শুতে দেরি হয়ে গেছিল।
ফার্স্ট পিরিয়ডটা কেটে গেল, এবার সায়েন্স ক্লাস। সায়েন্সের ক্লাসটা খুশি খুব ভালোবাসে, সায়েন্স মিস কী সুন্দর করে কত গল্প করেন, কতরকমের গাছ, কতরকম পাখির কথা বলেন। আফ্রিকাতে এমনসব পাখি আছে যা নাকি মানুষকেও খেয়ে ফেলে, আবার এমন মাছের কথা মিস বলেন, যা নাকি উড়তে পারে। আগের সপ্তাহে, খুশি তো উড়ন্ত মাছের কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেছিল। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, একটা উড়ন্ত মাছের পিঠে চেপে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরো সমুদ্র। তারপর মিস যে হাঙর মাছের কথা বলেছিলেন, তার থেকেও অনেক বড়ো হাঙর মাছ খুশিদের তাড়া করল। কিন্তু সে পারবে কেন? খুশি আর ওর বন্ধু উড়ুক্কু মাছ শোঁ শোঁ করে উড়ে চলে গেল কত দূরে। অনেক উঁচুতে মাছটা ওকে নিয়ে উড়ে গিয়ে সেই বড়ো বরফের পাহাড়ের ওপর এসে বসল। পাহাড়টা প্রথমে খুশি বুঝতে পারেনি। পরে খুশির মনে হল, এটা নিশ্চয়ই নর্থ পোলে এসে পড়েছে ওরা। জি.কে মিস এটার কথাই বলেছিলেন, কত্ত বরফ চারদিকে, আর ইগলু। মানে ওই ছোট্ট ছোট্ট বরফের বাড়ি। উফ্, সব দেখে শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল খুশি আর উড়ুক্ক মাছ। কী তাড়াই না করেছিল হাঙরটা! সাদা বরফের ওপরে শুয়ে পড়েছিল খুশি। হঠাৎ দেখল, একটা বরফের কুকুর ওকে হাত ধরে ডাকছে। কী সুন্দর দেখতে, সারা গায়ে বড়ো বড়ো লোম, চোখ দুটো নীল নীল, ও মনে হয় খেলতে ডাকছিল।
“খুশি! খুশি!”
ব্যস, ঘুমটা ভেঙে গেল। সায়েন্স মিস হাত ধরে টানছেন তার।
“সরি মিস।”
সায়েন্স মিস খুব ভালো। একটুও বকেননি খুশিকে। হেসে ওর গালটা টিপে দিয়ে বললেন, “যাও, বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে এস, নটি গার্ল।”
স্কুলের সবথেকে ভালো সময় হল টিফিন। প্রিয়াঙ্কা, রাইমা, শিবানী, খুশি একসঙ্গে দল বেঁধে খেলে। ওয়ান আওয়ার্স টিফিন আর টাইম আছে বলে বটে, কিন্তু খুশির মনে হয়, যে দারোয়ানকাকু ঘণ্টা বাজান, তাঁর ঘড়িটা একটু বেশি জোরে চলে। না-হলে হয়তো ঘড়িটা খারাপ আছে, টিফিন শুরু হবার একটু পরেই শেষ হয়ে যায়।
দারোয়ানকাকুর ছেলে বিলু ওদের সঙ্গে খেলে। বিলু খুব মিষ্টি ছেলে, ও সবসময় ধরাধরি খেলায় চোর হয় আর খুব জোরে দৌড়োতে পারে বিলু। সব্বাইকে ছুটে ধরে ফেলে বিলু। ঠিক টিফিন হলেই, বিলু স্কুলের ভিতরে দারোয়ানকাকুর ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে ওদের সঙ্গে খেলে। বিলু এখানে সবসময় থাকে না, ও মায়ের কাছে থাকে। সেটা কোথায় খুশি জানে না। তবে মাঝে মাঝে দারোয়ানকাকুর কাছে মানে বাবার কাছে এসে থাকে বিলু, আর তখন ও খুশিদের সঙ্গেই খেলা করে।
খুশি সেদিন আইসক্রিম খাচ্ছিল। টিফিন খাওয়া আর খেলা দুই-ই হয়ে গেছে আজ তার। আর বিলু বসে ছিল সোন পাপড়ির যে বড়ো হাঁড়িটা নিয়ে কাকুটা স্কুল গেটের সামনে বসে থাকে, ওর দিকে চেয়ে।
“কী রে বিলু, কী দেখছিস?” বলে খুশি।
“কিছু না।” বলল বিলু।
তারপর প্রিয়াঙ্কা আর রাইমার সঙ্গে কাটাকুটি খেলায় মেতে গেছিল খুশি। হঠাৎ করে চোখে পড়ল, বিলু সোন পাপড়ির কাকুর কাছে গিয়ে কী যেন বলছে। কাকুটা বলছে, “দশ টাকা দাম। আগে টাকা দে।”
বিলু বলছে, “তুমি দাও না। আমি আজ পাঁচ টাকা দিচ্ছি, কাল আবার পাঁচ টাকা দিয়ে দেব।”
“না। পুরো দশ টাকা দাম। চেয়ে নিয়ে আয় আগে, তারপর দেব।” কঠিন স্বরে সোন পাপড়িয়ালা বলে।
বিলুর চোখ দুটো ছলছল করছে। আশেপাশে আরো ছোটো ছোটো বাচ্চারা ঘিরে ধরে আছে সোন পাপড়িয়ালাকে।
খুশির দেখে খুব কষ্ট লাগে। কিন্তু খুশির কাছে আর টাকা নেই। দশ টাকাই ছিল তার কাছে, সেটা দিয়ে সে আইসক্রিম কিনে খাচ্ছে।
“এই বিলু, এই বিলু!” ডাকতে থাকে খুশি।
বিলু কিছু না শুনে চলে যায়।
রাইমা বলে, “বিলুর আবার কী হল রে?”
“কী জানি।” বলে বিলুর চলে যাওয়া রাস্তার দিকে চেয়ে ছিল খুশি। শেষ বিকালের পড়ন্ত সূর্যের আলোতে বালি আর ধুলোওড়া খেলার মাঠটা চিকচিক করছে।
***
ইংলিশ টেস্ট খুব ভালো হয়েছে খুশির। সে একাই শুধু ক্লাসে কুড়িতে কুড়ি পেয়েছে। বেঙ্গলি মিসের সবক’টা পড়া পেরেছে। মিস তার ডায়েরিতে ‘গুড গার্ল’ লিখে দিয়েছেন, কিন্তু মনটা তাও আজ ভালো নেই।
স্কুল থেকে ফিরেই মাকে জড়িয়ে ধরে খুশি; মা আদর করে দুই গালে চুমু খায় তার।
“ইংলিশ টেস্ট কেমন হয়েছে আরা?” জানতে চায় মা।
ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে পড়তে থাকে মা। “বাহ্ বাহ্, সব কারেক্ট! আর বাংলাতে ভালো করেছ তো আজ। লক্ষ্মী মেয়ে আমার, যাও যাও, জামাকাপড় চেঞ্জ করে হাত-পা ধুয়ে খেতে এস টেবিলে।”
খুশিকে ওর ফেভারিট চাওমিন করে দিয়েছে মা। তাই খেতে খেতে আজ সারাদিন স্কুলে কী কী করেছে, খুশি তাই বলছিল। গেম টিচার বলেছেন, আগামী বছর স্কুল লেভেল চেস কম্পিটিশনে নিয়ে যাবেন খুশিকে। সারা স্কুলে খুশির সঙ্গে কেউ জিততে পারে না চেস খেলায়।
সন্ধেবেলা খুশি দাদুর সঙ্গে বসে লুডো খেলছিল। মা গরম গরম শিঙাড়া করে দিয়েছে, ফু ফু করে ছোট্ট ছোট্ট কামড় দিয়ে সেটা খাচ্ছিল খুশি। হঠাৎ করেই দাদু বললেন, “কী খুশিরানি, মনটা আজ ভালো নেই কেন?”
খুশি দাদুর দিকে অবাক হয়ে বলে, “তুমি কী করে বুঝলে দাদু?”
দাদু বলেন, “আমি তো ম্যাজিক জানি দিদিমণি। মা বকেছে নাকি?”
“নাহ্।” ঘাড়টা দুইদিকে এদিক ওদিক করে নাড়ায় খুশি।
“তবে কি স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?”
“নাহ্, তাও নয়।”
“তবে কী? মার্কস হয়নি বেশি এগজামে?”
“না দাদু, আমি হাইয়েস্ট পেয়েছি তো ইংলিশ টেস্টে, কিন্তু তাও মনটা ভালো নেই।”
আদর করে কাছে টেনে নেন দাদু। বলেন, “কী হয়েছে আমাকে বল তো দিদিমণি, দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না।”
খুশি এবার সকালের স্কুলের সব কথা দাদুকে বলতে থাকে। আর এটাও বলে বিলু কাঁদতে কাঁদতে খেলা ছেড়ে চলে গেছে, আর এটাই ওর কাছে খুব দুঃখের।
“দাদু, আমি বিলুকে টিফিনের টাকা থেকে সোন পাপড়ি কিনে দিলে অন্যায় হবে?” জিজ্ঞাসা করে খুশি।
দাদুরও চোখের একপাশে চিকচিক করছে জল। খুশিকে জড়িয়ে ধরেন দাদু। “তুমি এত বড়ো মনের মানুষ হয়েছ দিদিভাই? কিছু অন্যায় হবে না। তুমি একটু বসো।” বলেই দাদু বেরিয়ে গেলেন।
কিছু পরেই ফিরলেন বাড়ি, আর সঙ্গে কিনে এনেছেন দুটো বড়ো প্যাকেট সোন পাপড়ি। খুশির হাতে দিয়ে বললেন, “দিদিভাই একটা তোমার আর একটা তোমার বন্ধুর।”
খুশির মা তাকিয়ে দেখছিলেন সব। বললেন, “কী হয়েছে বাবা? এটা কি খুশির এগজামে ভালো ফল করার পুরস্কার?”
দাদু বলেন, “না বৌমা, আমাদের খুশি পরীক্ষার মার্কসের থেকে অনেক বড়ো কিছু হতে পেরেছে। আমাদের খুশি একজন মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠছে বৌমা, নাউ আই ক্যান সে আই অ্যাম আ প্রাউড গ্র্যান্ডফাদার। পরীক্ষায় মার্কস তো অনেকেই পায় দিদিভাই, আর তুমিও কত পাবে ভবিষ্যতে, কিন্তু স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্য মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠা, আর তোমার শিক্ষা যে সঠিক পথে হচ্ছে, এটাই আমার কাছে সব থেকে বড়ো কথা।”
মা এগিয়ে এসে খুশির মাথায় হাত বোলাতে থাকে, আর দাদু বলে চলেন খুশি কী কারণে দুঃখী ছিল সন্ধে থেকে।
পরেরদিন টিফিন আওয়ার পিরিয়ডের জন্য খুশি অপেক্ষা করছিল। আজও বিলু এসেছে খেলতে। ধরাধরি খেলা চলছিল। খুশি বলল, “তোরা একটু বস, আমি আসছি।”
ছুটে চলে গেল ক্লাসরুমে। আর নিয়ে এল দাদুর দেওয়া রংচঙে সোন পাপড়ির প্যাকেট। বিলুর দুটো চোখ চকচক করছে, কিন্তু সে কিছুতেই নেবে না। বলছে, “না, বাবা বকবে।”
খুশি জোর করে একটা প্যাকেট তার হাতে দিয়ে বলল, “কাকুকে বলিস, তোর বন্ধু খুশি এটা তোকে দিয়েছে। আর এই একটা প্যাকেট, আমরা সবাই মিলে চল খাই আজ টিফিনে।”
সুন্দর রংচং করা প্যাকেট খুলে খুশি, প্রিয়াঙ্কা, পিয়ালী, রাইমা, সুশ্রিত সবাই মিলে খেতে লাগল সোন পাপড়ি। বিলু হঠাৎ করে ছুটে ঘরে চলে গেল আর সবাইকে অবাক করে নিয়ে এল চারটে ডাঁশা পেয়ারা, সঙ্গে অনেকটা নুন, তাতে আবার অল্প লাল লঙ্কা মেশানো। মিষ্টি সোন পাপড়ির সঙ্গে ঝাল-নুন আর টকটক পেয়ারায় আজকের টিফিনটাই জমে গেল সব্বার।
অলঙ্করণ- অংশুমান