“কীসের গল্প শুনবি বল।” বলল ছাতুমামা।
“যা খুশি। তোমার যা ইচ্ছে হয় বলো।” আমরা বললাম।
ছোট্ট করে একটা ‘হুম’ বলে পিছনের দিকে হাত মুড়ে পায়চারি করতে লাগল ছাতুমামা। তারপর আমাদের ঘরের শো-কেসটার দিকে এগিয়ে গিয়ে, “এটা কীসের গেম রে মুনাই?” বলে দিদির গত জন্মদিনে গিফট পাওয়া ডমিনোজের সেটটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল ছাতুমামা।
“ও, ওটা? ওটা একটা বোর্ড গেম, ডমিনোজ। বাবার এক কলিগ আমায় জন্মদিনে গিফট করেছেন।” বলল দিদি।
“কীভাবে খেলে?”
“সেটা জানি না গো। তবে খেলার ইনস্ট্রাকশনস দেওয়া আছে। পড়ে উদ্ধার করা হয়নি এখনো। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাত দেওয়া বারণ। বাবার হুকুম।”
“বুঝলাম। তাহলে শোন, একটা খেলার গল্পই তাহলে তোদের বলি। একসময় এই খেলাটা খুব পপুলার ছিল, বুঝলি? মিশরের রয়াল ফ্যামিলির লোকেরা খেলতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখন এই খেলার অস্তিত্ব আর নেই, কীভাবে খেলে তাও কেউ জানে না। তবে খেলাটার বোর্ড, ঘুঁটি এসব মজুদ আছে এখনো। কীভাবে খেলে, সেটা জানতে গিয়েই যত বিপত্তি…”
“কী খেলা গো? নাম কী?”
“এর নাম ‘সেনাত’ বা ‘সেনেত’, প্রাচীন মিশরের খেলা। পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো বোর্ড গেম। তবে আমার গল্পে যে সেনাতের কথা বলছি সেটা কিন্তু কোনো মামুলি লোকের নয়। স্বয়ং তুতেনখামুনের সেনাত!”
***
খুব ছোটোবেলার কথা যখন মনে করি, তখন বার বার ছাতুমামার কথাই মনে পড়ে। কারণ ছোটোবেলার স্মৃতির বেশিরভাগটা জুড়েই ছিল ছাতুমামা। অথচ ছাতুমামাকে আমরা কতটুকুই-বা পেয়েছি? নিজের মামা ছিল না, রক্তের সম্পর্ক বা আত্মীয়তাও ছিল না। কিন্তু কী অদ্ভুতভাবে আমার আর দিদির শৈশব জুড়ে শুধুই ছাতুমামা।
ছাতুমামার আসল নাম সত্যরঞ্জন বাচস্পতি। ‘সত্য’ থেকে ‘ছাতু’। তবে বাবার ভাষায় মামা ছিলেন ‘মিথ্যারঞ্জন বাচস্পতি’, কারণ ওঁর সব গল্পই নাকি গুল, বুজরুকি! বাবার উপর খুব রাগ হত এসব শুনলে। মনে মনে ভাবতাম, উফ্, বাবাটা না, খুব বাজে। ছাতুমামার প্রতি মিছিমিছি একটা ভুল ধারণা করে বসে আছে বাবা। আসলে ছাতুমামার এত জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার ঝুলি, তাতে বাবার হিংসে হয়।
এখানে বলে রাখা ভালো, মায়ের নিজের কোনো ভাইবোন নেই। ছাতুমামা আসলে ছিল, যাকে বলে ‘পাড়াতুতো’ ভাই। পাড়ায়, ক্লাবে, বিপদে-আপদে যে মানুষটিকে সর্বদা, সর্বক্ষণ পাওয়া যেত, সে ছিল আমাদের ছাতুমামা। বাগবাজারের মহেন্দ্র বোস লেন থেকে বিয়ে হয়ে মা আমাদের বাড়ি, মানে এই কাঁকুড়গাছিতে আসে। তারপর থেকে পারিবারিক আতিথেয়তায় ছাতুমামারও অবাধ বিচরণ শুরু হয় আমাদের বাড়িতে। ঠাকুমা তো ‘ছাতু’-অন্ত প্রাণ। ভীষণ মজলিশে মানুষ ছিল ছাতুমামা। দারুণ মিশুকে ছিল বলেই বোধ হয়। সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পারত, যে-কোনো আসরে ছাতুমামা ছিল একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। স্বভাবতই যেদিন ছাতুমামা আসত, সারা বাড়ি গমগম করত। বিনা নোটিসে দুম করে হাজির হত ছাতুমামা, আর আমাদের সে কী আনন্দ! তবে আমাদের আকর্ষণ ছিল অন্য। ছাতুমামা কবে এসে আমাদের গল্প শোনাবে, তার জন্য আমি আর দিদি মুখিয়ে থাকতুম।
যাই হোক, সেই ছাতুমামা শৈশবে আমাদের যা মূল্যবান কিছু স্মৃতি দিয়েছেন, তা এইবেলা বলে রাখি। ছোটোবেলায় আমরা ছাতুমামার কাছ থেকে অগুনতি গল্প শুনেছি। সেসব গল্প বর্তমান সময়ে শুনলে কতটা বিশ্বাস করতাম জানি না, কিন্তু তখন, ওই কচি বয়সে আমার কিন্তু বেশ লাগত শুনতে। ছাতুমামার কথায়, “আমি যা বলব, তা তোদের বিশ্বাস না হলে আমার কিছুই যায় আসে না রে গুবলু, কারণ আর কেউ না হোক, আমি তো জানি, সেটার একবর্ণও মিথ্যে নয়। চ্যালেঞ্জ করলে কর, প্রুফ দেখাতে পারি।”
অবশ্য আমি গল্পগুলো গোগ্রাসে গিলতুম। সেই সময় আমাদের কাছে ইন্টারনেট ছিল না। ফলে সত্য-মিথ্যা যাচাই করার মতো কোনো উপায় আমাদের ছিল না। একটু আধটু প্রতিবাদ যা আসত, তা দিদির কিংবা বাবার মুখ থেকে। কিন্তু সবচেয়ে মজা পেতাম যখন মোক্ষম সময়ে ছাতুমামা সেই গল্পের প্রমাণ দেখাত। উফ্, দিদি আর বাবাকে পুরো জব্দ করে দিত মামা। গল্পের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও দিদিও যে গল্পগুলো উপভোগ করতে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এমনই একদিন আমি আর দিদি স্কুল থেকে সবে বাড়ি ফিরেছি। ঢুকেই দেখি মা মিটিমিটি হাসছে। তখন বুঝিনি ব্যাপারটা কী, ঘরে আমরা দুজনে ঢুকতেই দেখি আমাদের বিছানায় চকলেটের ছড়াছড়ি। আর ছাতুমামা টানটান হয়ে শুয়ে একটা পায়ের উপর অন্য পা তুলে গুনগুন করছে। আমাদের সে কী উচ্ছ্বাস তখন! ছাতুমামা এসেছে! এবার গল্প শুনব।
“আরে আরে, আগে হাত-পা তো ধুয়ে আয়, গল্প কি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি?” বলল ছাতুমামা, “রাতে গল্প বলব, তোদের না টিউশন আছে শুনলাম…”
সেদিন টিউশন ডুব। সন্ধেবেলায় বাবা ফিরলে বাবার রক্তচক্ষুকেও তোয়াক্কা করিনি সেদিন, খুব মনে আছে। যে যাই বলুক, ছাতুমামা আমাদের ঘরে আছে মানে নো ডিস্টারবান্স, নো বকাঝকা, অনলি গল্প। ছাতুমামাও সামলে দিত ব্যাপারটা।
***
“প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে রহস্যময় সম্রাট ছিলেন তুতেনখামুন, তা তো তোরা জানিসই। ১৯২২ সালে হাওয়ার্ড কার্টার তুতেনখামুনের সমাধি আবিষ্কার করেন। সেটা একটা ইন্টারেস্টিং গল্প। লর্ড কার্নার্ভন তখন মিশরের পুরাতাত্ত্বিক খননকার্যের জন্য টাকা ঢালছিলেন ‘ভ্যালি অফ দ্য কিংস’-এ আর এই হাওয়ার্ড কার্টার ছিলেন সেই কাজের পুরোধা। কিন্তু সেরকম কোনো সাফল্য আসছিল না কার্টারের। বিশাল অঙ্কের টাকা ইনভেস্ট করে কার্নার্ভনও তখন বিরক্ত। কার্টার প্রায় হাতে-পায়ে ধরে ওঁকে আরেকটা সুযোগের দেওয়ার জন্য রাজি করালেন। ভাগ্য সুপ্রসন্নও হল, বুঝলি। ঠিক ওই বছরেই কার্টার তুতেনখামুনের সমাধি আবিষ্কার করলেন, প্রায় আকস্মিকভাবেই। সে গল্প পরে না হয় একদিন বলব।
“ইতিহাস চির-ঋণী হয়ে থাকবে কার্টারের কাছে। কিন্তু মিশরের মানুষ ছিল খাপ্পা। ‘ভ্যালি অফ দ্য কিংস’-এ শায়িত সমাধিগুলো একে একে খুঁড়ে বের করাটা তারা ভালোভাবে নেয়নি। তারা বলত ফ্যারাওয়ের অভিশাপ আছে। সমাধি আবিষ্কারের কয়েক সপ্তাহ পর খোদ কার্নার্ভনই অদ্ভুত কারণে মারা গেছিলেন। গালে মশা কামড়ে ছিল, শেভ করতে গিয়ে সেই জায়গাতে কেটে ফেললেন, ইনফেকশন হয়ে মৃত্যু—বলা হয়, তুতেনখামুনের অভিশাপেই নাকি খননকার্যে জড়িতরা কেউ কেউ অদ্ভুত কারণে মারা গেছিলেন। শুধু তাঁরাই নন, তুতের সমাধি যাঁরা কায়রোর মিউজিয়ামে বয়ে নিয়ে গেছিলেন তাঁদেরও নাকি একই দশা হয়েছিল।
“তো এ-হেন মমির কক্ষ যখন আবিষ্কৃত হল, ওই কক্ষে প্রায় পাঁচ হাজারটা ছোটোবড়ো বিভিন্ন মাপের আর্টিফ্যাক্টস পাওয়া গেছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, ফ্যারাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা একটা অন্য জগতে বাস করত। তাই তাঁদের ফ্যারাও যাতে মৃত্যুর পরেও সবরকম স্বাচ্ছন্দ, বিলাসবহুলতা ভোগ করতে পারেন, তার জন্য তারা সর্বসম্মতভাবে ব্যবস্থা করত। সেজন্য ফ্যারাওয়ের সমস্ত প্রিয় জিনিস, এমনকি পোষা জীবজন্তুকেও ওই কক্ষে সমাহিত করা হত। তুতেনখামুনের সমাধিকক্ষে যা আড়ম্বর ছিল তা ছিল অকল্পনীয়। তারই মধ্যে দুটি জিনিসের গল্প বলব তোদের। প্রথমটা অনেকেই জানে, কিন্তু পরেরটা… উঁহু, পরেরটা খুব বেশি কেউ জানে বলে আমার মনে হয় না; আর আমি গল্পটা জেনেছি স্বয়ং প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে, তাঁর লেখা পড়ে। তবে তাঁর নামধাম জিজ্ঞেস করবি না, নাম বলা বারণ। কী, বুঝলি?” একটানা কতগুলো বলে মায়ের সদ্য দিয়ে যাওয়া গরম গরম পেঁয়াজিতে কামড় দিল ছাতুমামা।
আমরা অবাক হয়ে শুনছিলাম মামার কথা। মিশরের গল্প কার না শুনতে ইচ্ছে করে? আর সেটা যদি হয় তুতেনখামুনের, তাহলে তো জমে ক্ষীর!
“তারপর? প্রথম গল্পটা শুনি।” বললাম আমি।
“হুম, শোন তাহলে। তুতের সমাধিকক্ষে, ওই পাঁচ হাজারটা আইটেমের মধ্যে ছিল কয়েকটা শিঙা, মানে ইংরাজিতে যাদের বলে ‘trumpets’—রুপো আর ব্রোঞ্জের তৈরি, অসামান্য কারুকার্য করা। কিন্তু সেগুলো এতবছর পরে বাজবে কি না, কিংবা আদৌ কখনো বাজত কি না সেটা কেউ জানে না। তাহলে জানার উপায়ও-বা কী?”
“বাজিয়ে দেখলেই হয়!”
“ঠিক বলেছিস। কিন্তু তুতেনখামুনের রণভেরী বলে কথা! ও-জিনিস বাজিয়ে দেখবে, এমন বুকের পাটা তখন কার ছিল? ফ্যারাওয়ের অভিশাপ আছে না?”
“অভিশাপটা কীরকম?”
“মিশরীয়দের ধারণা ছিল যে ওই শিঙা বাজালেই দেশজুড়ে মহামারী, দুর্যোগ, যুদ্ধ এইসব লেগে যাবে।”
“আচ্ছা। তারপর? সেটা কি বাজানো হয়েছিল?”
“রোসো বত্স, রোসো। সব বলছি। সাহেবরা তো ডাকাবুকো শ্রেণির মানুষ জানিসই। কোনো অভিশাপের তোয়াক্কা করে না। ফলে বিবিসি রেডিও কর্তৃপক্ষ ঠিক করল যে তারা তাদের শ্রোতাদের ওই শিঙা বাজিয়ে শোনাবে। সেগুলো বাজানোর দায়িত্ব দেওয়া হল জেমস ট্যাপ্পার্ন বলে একজন ব্রিটিশ রেজিমেন্টের বাজিয়েকে। সারা বিশ্বে তখন হই হই পড়ে গেল! একদল রে রে করে উঠল সেটা থামানোর জন্য, তো আরেক দল ওই বাজনা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে রইল। শেষে বিবিসির উদ্যোগে পৃথিবী জুড়ে সমস্ত শ্রোতাদের সেই অভিশপ্ত বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শোনানো হল। ব্যস, আর দেখে কে? তারপর…”
“তারপর?”
“তারিখটা ছিল খুব সম্ভবত ১৬ই এপ্রিল, আর সালটা ১৯৩৯। এবার বল তো দেখি ১৯৩৯ সালে কী হয়েছিল? ১৯৩৯ সাল বললেই প্রথমে কী মনে পড়ে?”
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ!” ছিটকে পড়ে বলল দিদি।
“একদম ঠিক। ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯-এ জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করল। তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। কী রে?”
“এটাই ছিল সেই অভিশাপ?”
“হ্যাঁ। এটাই ছিল সেই অভিশাপ। ওই শিঙা কোনোপ্রকারে বাজলে যে ঘোর বিপদ ঘনিয়ে আসবে তা তো বলাই ছিল। তাই অনেকের ধারণা, সেদিন বিবিসিতে ওই শিঙার সুর সম্প্রচার করার ফলেই ওই একই বছরে দ্বিতীয়বারের জন্য আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেছিল। যার ফলে ক্ষয়ক্ষতি হয়ছিল ভয়াবহ! পরে নাকি আরো বেশ কয়েকবার সেই শিঙাগুলো বাজানো হয়েছিল, কায়রোতে। একবার ১৯৬৭-এর ছ’দিনের ইজরায়েল-আরব যুদ্ধের কিছু আগে, আরেকবার এই তো সেদিন, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের ঠিক আগেভাগে।”
“বাহ্! ইন্টারেস্টিং তো! এবার দ্বিতীয় গল্পটা বলো।” দিদি বলল।
“দাঁড়া, দাঁড়া। একটু সবুর কর। এতক্ষণ ধরে গল্প বললাম, একটু রেস্ট নিয়ে নিই এবার।” বলল ছাতুমামা।
“না না, কোনো রেস্ট নয়। আগে বলো। পরের গল্পটা বললে, তবে তোমার ছুটি।”
“দেখ মেয়ের কাণ্ড! আরে আমি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি? কালকে বলব সে গল্প। প্রমিস।”
“না, না, না। আজকেই বলবে আর এখনই। না বলা পর্যন্ত আমরা তোমাকে ছাড়ছি না।”
“হুম। সে তো বুঝলাম। কিন্তু গল্পটা বললেও কি আমায় তোরা ছাড়বি? আমার তো মনে হয় না।”
“কেন? ছাড়ব না কেন?”
“না মানে, তুই, তোর বাবা… খুব সন্দেহবাতিক তো, তাই বললুম।”
আমি তক্ষুনি বুঝে গেলাম কেসটা কী। ছাতুমামার যে গল্পটা শোনার জন্য আমরা মুখিয়ে ছিলাম তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে দিদি। দিদি না তুলুক, বাবা শুনলে তো তুলবেই। এমনিতেই বাবা ছাতুমামার গল্পকে তাচ্ছিল্য করে সবসময়। ফলে আমাকেই রণভূমিতে অবর্তীর্ণ হতে হল।
“বলো না মামা। দোহাই তোমার। আজকে টিউশন কামাই করেছি। মাকে ম্যানেজ করে গল্প শুনতে বসতে পেরেছি। সামনেই তো পরীক্ষা। আরেকদিন গল্প শোনাবে বলে অপেক্ষা করতে হলে বড়ো বিপদ। প্লিজ বলো না এখন।”
“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। বলছি বাবা, বলছি।” খাট থেকে দেহটা তুলে টানটান করে বসল ছাতুমামা। তারপর আবার বলতে শুরু করল, “তো, এ তো গেল শিঙার ঘটনা। এই গল্প তুই ইতিহাসের বই ঘাঁটলেই পাবি। আসল গল্প হচ্ছে পরেরটা।”
“সেই সেনাত?”
“হ্যাঁ। তুতেনখামুনের সেনাত। এই সেনাত খেলাটা বুঝলি, একটা লম্বাটে বিলিয়ার্ড খেলার বোর্ডের মতো, হাতির দাঁতের তৈরি চারটে পায়া, তবে ছোটো সাইজের, দুজন বসে সামনে পেতে খেলতে পারবে এরকম। মাঝখানে ৩ বাই ১০, সব মিলিয়ে ৩০টা খোপ কাটা। প্রস্থের দু-দিকে দুটো করে ড্রয়ার, যার মধ্যে কতকগুলো ঘুঁটি। ঘুঁটিগুলি আবার দু-রকমের—কয়েকটা চ্যাপ্টা, মোটা কয়েনের মতো, বাকিগুলো দাবা খেলার বোড়ের মতো। এ-হেন খেলার নিয়ম এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছু কিছু ব্যক্তি নিজেদের মতো করে নিয়ম বানিয়েছেন বটে, তবে সেগুলি ইতিহাস-স্বীকৃত নয়। তো ফ্যারাও তুতেনখামুন শায়িত ছিলেন কায়রো মিউজিয়ামে। ১৯৬১ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ফ্যারাওকে বিশ্বভ্রমণ করানো হবে। উদ্দেশ্য ছিল আসওয়ান বাঁধ থেকে আবু সিম্বেলের মন্দিরকে বাঁচানোর জন্য ফান্ড জোগাড় করা। মার্কিন সরকার আবু সিম্বেলের মন্দির সংস্কার করার জন্য উদ্যোগী হয়েছিল। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনকে দায়িত্ব দেওয়া হল। প্রাথমিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঠারোটা আর কানাডার ছ’টা শহরে তুতেনখামুনের সমাধিসহ বেশ কিছু আর্টি-ফ্যাক্টস প্রদর্শিত করা হবে বলে ঠিক হল। আর ওই আর্টি-ফ্যাক্টসগুলোর মধ্যে ছিল…”
“তুতেনখামুনের সেনাত?”
“ইয়েস। তুতেনখামুনের সেনাত। যাই হোক, প্রদর্শনী চলাকালিন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, যতদিন না সেগুলোকে ওহাইও শহরে নিয়ে আসা হল আর ওহাইওর ‘টোলেডো মিউজিয়াম অফ আর্ট’-এ সেগুলো প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা হল। কিউরেটর ছিলেন ড. রিচার্ড উডস, এক আদ্যোপান্ত মিশরানুরাগী। ঠিক এই সময়, ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী মিলে তুতেনখামুনের সেনাত নিয়ে গবেষণা করবে বলে অনুমতি চাইল তাঁর কাছে। উডস অনুমতিও দিলেন, তবে শর্ত ছিল যে যা কিছু করার তাঁর সামনে করতে হবে, তাঁর অলক্ষ্যে নয়। ফলে প্রদর্শনী চলাকালিনই তাঁরা গবেষণা শুরু করলেন, উদ্দেশ্য ছিল খেলার খুঁটিনাটি আর খেলার পদ্ধতি জানা। কিন্তু বাস্তবে গবেষণা কম, সেনাতকে নিয়ে ছেলেখেলা বেশি হল। যে যার মতো করে ঘুঁটি সাজিয়ে চালতে শুরু করল। ঠিক ওই সময়ে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ড. উডস সহ গবেষণা দলের ছাত্রছাত্রীরা খেয়াল করলেন সেনাতটি অল্প অল্প গরম হয়ে উঠছে আর কিছুক্ষণ অন্তরই মৃদু মৃদু দুলছে। ব্যস, আর দেখে কে? বেগতিক দেখে সঙ্গে সঙ্গে গবেষণা বন্ধ করা হল এবং লোক জানাজানির ভয়ে এই ঘটনাকে বেমালুম চেপে দেওয়া হল, কারণ ড. উডসের মনে ভয় ছিল ওই আর্টি-ফ্যাক্টসগুলো স্টাডি করার অনুমতি দেওয়া ওঁর এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। স্বভাবিকভাবেই ঘটনাটা যাতে বেশি জানাজানি না হয়, তাই কিছু প্রত্যক্ষদর্শীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়া হল।”
“কোনো ক্ষতি হয়নি এতে?” দিদি অবাক চোখে জিজ্ঞাসা করল।
“ক্ষতি আবার হয়নি? সে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তুমি ফ্যারাওয়ের খেলার জিনিস নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে আর ফ্যারাও তোমাকে ছেড়ে দেবেন?”
“তাহলে?”
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল ছাতুমামা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার শুরু করল, “ঘটনার তারিখটা ছিল ১৫ই অক্টোবর, ১৯৬৩। প্রদর্শনীর শেষ দিন। ঘটনার ঠিক কয়েক সপ্তাহ পরেই… আচ্ছা কী হতে পারে বল তো? এনি গেস?”
আমি মনে করতে লাগলাম ইতিহাসের পাতায় কী কী ঘটেছিল ওই বছর। ঠিক ওই বছর, না-হলে তার পরের বছর তো নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছিল। কিন্তু দিদি আর আমি দুজনেই কিছু মনে করতে পারলাম না। শেষে হার স্বীকার করতে বাধ্য হলাম। বললাম, “মনে পড়ছে না গো, তুমিই বলে দাও।”
মৃদু হেসে সাসপেন্সের ইতি টানল ছাতুমামা, “প্রেসিডেন্ট কেনেডি ওয়াজ শট ডেড। নভেম্বর ২২, ১৯৬৩।”
“ও মা, তাই তো! ১৯৬৩ সালেই তো প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডির মৃত্যু…”
“ঠিক তাই। কন্সপিরেসি থিওরিস্টরা তাই-ই বলবেন, অবশ্য যদি তাঁরা ওহাইওর ঘটনাটা জেনে থাকেন, তবেই।”
“তাঁরা জানেন না বলছ?”
“নাহ্। ঘটনার ওই ক’জন প্রত্যক্ষদর্শী আর আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আর এখন তোরা জানিস। তবে আমার ধারণা, মিশরের কিছু শীর্ষকর্তারা কেনেডির মৃত্যুর ঠিক পরে এই ঘটনার কথা জানতে পারেন।”
“কিন্তু তুমি জানলে কী করে?” শুধাল দিদি, চোখে সন্দেহের মেঘ।
“এই এই, এই এক দোষ তোদের জানিস তো, বললে বিশ্বাস করবি না। সাধে কী বলেছিলাম কালকে বলব গল্পটা!”
“কালকে বললে কী এমন হত শুনি?”
“কালকে প্রমাণটা সঙ্গে করে আনতুম। সন্দেহ প্রকাশ করলেই মুখের সামনে তুলে ধরতুম।”
আমার উত্ফুল্ল মন তখন যে কীভাবে নেচে উঠেছিল আমি তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না। আমি হলফ করে বলতে পারি আমার মামা জিনিয়াস! এর জন্য কোনো প্রমাণ দেখার দরকার পড়ে না, কারণ ছাতুমামা প্রমাণ ছাড়া কথা বলে না। মামা সেদিন যথেষ্ট তৈরি হয়েই গল্প বলছিল আমাদের। মহা আনন্দে মামার গা জড়িয়ে বললাম, “আমি কিন্তু তোমায় সন্দেহ করি না মামু।”
গদগদ হয়ে ছাতুমামা আমাকে আদর করতে করতে বলল, “আরে সোনা ছেলে আমার, বুকে আয়। জানি তো, তুই-ই তো একমাত্র বুঝিস আমায়। যাক গে। শোন তাহলে বাকিটা।
“তখন আমি সবে ফার্স্ট ইয়ার, কী একটা দরকারে কলেজ স্ট্রিটে ঘুরছি। দেখি বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিটে পুরোনো বইয়ের পসরা সাজিয়ে একজন শীর্ণকায় বৃদ্ধ লোক বসে আছেন। পাকা দোকান-টোকান নয়, একেবারে ফুটপাথে। গরমও খুব পড়েছিল সেদিন, লোকটা ওরই মাঝে ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে বই বিক্রি করছিলেন। ওই গরমের দুপুরে খদ্দেরও কম। কী জানি কী মনে করে থামলাম। এটা সেটা বই ঘেঁটে দেখছি, হঠাৎ খেয়াল করলাম ওঁর হিট স্ট্রোকের মতো হচ্ছে, শরীর অবসন্ন। আমার খুব মায়া হল। সঙ্গে সঙ্গে পাশের একটা স্টল থেকে এক গ্লাস লস্যি কিনে ওঁকে খাওয়ালাম। মুখে-চোখে ভালো করে জল ছিটিয়ে মোটামুটি ধাতস্থ করলাম। জ্ঞান আসার পরে তিনি খুব করে ধন্যবাদ দিলেন আর বই কেনার জন্য কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন। কিছুতেই ছাড়বেন না, নাকি সকাল থেকে একটাও বই বিক্রি হয়নি! এদিকে আমার পকেটে বিশেষ পয়সাকড়িও নেই। টিউশন করে নিজের পড়াশুনা চালাতাম কোনোমতে। যাই হোক, ওঁর কথা রাখলাম। ক’টা বই কিনলাম, কিছু গল্পের আর কিছু পড়াশুনার। বেশ কয়েকটা রেয়ার এডিশন খুব সস্তা দরে বেচলেন আমায়। আর তার সঙ্গে কয়েকটা বই এমনি ফ্রিতেই দিয়ে দিলেন। প্যাকেটে মুড়ে বগলদাবা করে বাড়ি ফিরলুম।”
“তারপর?”
“তারপর, বাড়ি ফিরে বইগুলো ঘাঁটছি… ও মা, একটি অদ্ভুত সবুজ মলাটের ডায়েরি হাতে পেলুম। ওই রে, সেই ফ্রি বইয়ের একটি। এক মার্কিন সাহেবের ডায়েরি। নাম জিজ্ঞেস করবি না, বলা বারণ, আগেই বলে দিয়েছি। তো সে সাহেবের পরিচয় এরকম—‘অমুক নাম তমুক পদবি, ইন্টিগ্রেটেড মেজর ইন এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি, ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি…’
“ওঁর সেই ডায়েরিতেই সেই ঘটনার জবানবন্দি লেখা আছে। আমি পড়েছি।”
“তাই?”
“তাই নয়তো কী? সাহেব ইন্ডিয়াতে এসেছিলেন এমারজেন্সির সময়, ওই ১৯৭৫-এ। কিছুদিন থেকেও ছিলেন কলকাতায়। মার্কিন চর সন্দেহে সম্ভবত বেশ কয়েকবার ধরপাকড় করা হয় ওঁকে, অন্তত বিবরণ পড়ে আমি তাই বুঝেছি। এসবের মধ্যেই বোধ হয় ওঁর ডায়েরিটি খোয়া যায়। তারপর অনেক অযত্নে এর ওর হাত পেরিয়ে আমার হাতে আসে বলেই আমার ধারণা। বিশ্বাস না হলে আমি কাল সকালেই নিয়ে আসব, দেখে নিস। নামটি চাপা দিয়ে দেখাব অবশ্যই। কারণ লেখা পড়ে যা বুঝেছি, সাহেব চাননি এ-কথা উনি বেঁচে থাকতে কেউ জানুক। আর সাহেব যে বেঁচে আছেন তার খোঁজ কিন্তু আমি পাইনি।”
“বাহ্, দারুণ মামা, দারুণ গল্প। একেবারে সত্যিকারের গল্প!”
“তবে গুবলুবাবু, তোর কথার সঙ্গে তোর দিদি কিন্তু সম্মত নয়।” দিদির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে হাসতে হাসতে বলল ছাতুমামা।
দিদির মুখের দিকে তাকালাম আমি। বুঝলাম, দিদিকে সন্তুষ্ট করার মতো প্রমাণ নেই মামার কাছে। ঠিক তক্ষুনি ছাতুমামা বলল, “যাক গে। একটা প্রমাণ আমি কিন্তু এখনই দিতে পারি। শুনবি নাকি মুনাই?”
দিদি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “শুনি।”
“হুঁ, তবে শোন। এটা একটা থিওরিও বলতে পারিস, প্রমাণও বলতে পারিস। আবু সিম্বেলের মন্দির সংস্কার পরিকল্পনার রূপকার ছিলেন তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি। সেনাতের অভিশাপের কারণে ওঁর মৃত্যুর কথা পরবর্তীকালে কানাঘুষোভাবে মিশরের কিছু শীর্ষস্থানীয় কর্তাদের কানে আসে। ফলত তাঁরা ক্ষুব্ধ হলেও আপাত নির্দোষ প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর জন্য অনুতপ্ত হন। যে মানুষটি ইউনেস্কোর হস্তক্ষেপে মিশরের ইতিহাস সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মায় তাঁদের। তারই ফলশ্রুতি, ‘দেনদুরের মন্দির’-এর হস্তান্তর।”
“দেনদুরের মন্দির? সেটা আবার কী?”
“আসওয়ান থেকে আর ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি স্থান দেনদুর, সেখানেই ছিল দেনদুরের মন্দির, রোমানদের বানানো। কেনেডির মৃত্যুর পর গোটা মন্দিরটাকে ডিসম্যান্টল করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মার্কিন মুলুকের নিউ ইয়র্কে, ‘মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্টস’-এ। ১৯৬৩ সালে মন্দিরটাকে ডিসম্যান্টল করা শুরু হয় আর ১৯৬৫-এ আমেরিকাকে উপহার হিসেবে মিশর সরকার মন্দিরটি প্রদান করে।”
“বাপ রে!”
“এবার বলো তো দেখি গুবলুবাবু মন্দিরটির শুভ উদ্বোধন কে করেন?”
“কে করেন? ধুর, আমি জানব কী করে? ও তুমিই বলে দাও।” বললাম আমি।
প্রত্যুত্তরে ছাতুমামা একটা রহস্যময় হাসি হেসে করে আমার কাছে মুখ বাড়িয়ে বলল, “কোনো প্রেসিডেন্টও নয়, কোনো আমলা-মন্ত্রীও নয়, লেডি জ্যাকলিন লি কেনেডি স্বয়ং।” হাসতে হাসতে বলল ছাতুমামা, “ইতিহাসের পাতায় এ-গল্প পাবে না মুনাই দিদিমণি, এই গল্প শুধু ছাতুমামাই জানে, হা হা হা।”
অলঙ্করণ-অংশুমান
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস