গল্প-নস্যি ভূত-মানবেশ মণ্ডল-বসন্ত ২০২১

আমার জ্যাঠার এখনো নস্যির নেশা গেল না। এখনো একটা নস্যির ডিব্বা নিয়ে ঘুরে বেড়ান। এই নস্যি নিয়ে একটা গল্প আছে। আমরা তখন খুব ছোট্ট। জ্যাঠা প্রতিদিন সন্ধে হলেই আমাদের বাড়িতে আসেন চা খেতে। মাটির রান্নাঘর বেশ বড়সড়। একদিকে মা কাঠের উনুন ধরিয়ে রান্না করেন আর আমরা খুড়তুতো ভাইবোন মিলে হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে পড়তে বসি। আমাদের গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ আসেনি। রান্নাঘরের একদিকে একটা দোলনা ঝোলানো। সেই দোলনায় বসে জ্যাঠা রোজ দোল খান আর চোখ বন্ধ করে গুনগুন করে গান করেন।

সেদিন ভর সন্ধেবেলা আকাশ গুড়গুড় করছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘ-ঢাকা আকাশে একটুও নীলের চিহ্নমাত্র নেই। খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে এল। আমরা প্রতিদিনের মতো মিটিমিটি আলোর সামনে বইপত্তর খুলে বসেছি। এমন সময় জ্যাঠা হন্তদন্ত হয়ে এসে ধপ করে বসে পড়লেন দোলায়। জ্যাঠা হাঁসফাঁস করছেন আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। মা তো ছুটে এলেন। বললেন, “কী হল দাদা, এমন করছেন কেন?”

জ্যাঠা কোনোপ্রকারে বললেন, “বলছি বলছি, দাঁড়াও। আগে একটু ঠান্ডা জল দাও বৌমা।”

জ্যাঠা কোঁত কোঁত করে এক নিমেষে জলটা খেয়ে ফেললেন। জল খেয়ে মনে হল জ্যাঠা একটু স্বস্তি পেলেন। মা আবার বললেন, “কী হল, হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছে?”

জ্যাঠা বললেন, “না না।” তারপর আমাদের দিকে গোল গোল চোখ করে বললেন, “ভূত!”

আমরা সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বললাম, “ভূত!”

আমরা একটু দূরে দূরে বসে ছিলাম, জ্যাঠার কথা শুনে সবাই প্রায় জড়সড় হয়ে গেলাম। জ্যাঠা আবার আমাদের দিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে বললেন, “ভূতে ধরেছিল আমাকে।”

মা জ্যাঠার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বলেন কী?”

জ্যাঠা একবার আমাদের দিকে, একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে আর বলছি কী?”

আমরা হ্যারিকেনের ওই মৃদু আলোয় এ-ওর দিকে তাকালাম। ঝমঝম বৃষ্টি আরো বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে হ্যারিকেনের আলোটা আরো কমে এল। একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে ধাক্কা মারছে আমাদের শরীরে। জ্যাঠা গুম হয়ে দোলায় বসে আছেন। আমরা আর সাহস করে কেউ বলতে পারলাম না, জ্যাঠা গল্পটা বলো। জ্যাঠা আমাদের দিকে স্পষ্ট করে তাকালেন। তারপর বললেন, “শুনবি নাকি গল্পটা?”

আমরা পড়ার ফাঁকে জ্যাঠার কাছে গল্প শুনি। রূপকথার গল্প, ডাকাতের গল্প, মহাভারত, রামায়ণের গল্প। ভূতের গল্পও শুনেছি অনেকবার। কিন্তু এই গল্পটা শুনতে কেমন যেন ভয় ভয় করছে। আমি একটু সাহস করে বললাম, “ঠিক আছে, বলো।”

জ্যাঠা বললেন, “ভয় পাবি না তো?”

আমরা বললাম, “না, বলো।”

আমার পাশেই ছিল বুকান। একটু দূরে ছিল মিঠি। সে মিঠিকে বলল, “মিঠি, তুই বরং ঘরে যা। তুই তো একটুতেই ভয় পাস।”

মিঠি তো গেল ক্ষেপে, “ও, তুমি বুঝি খুব সাহসী? তোর ভয় লাগছে সেটা বল।”

বুকান বলল, “ভয়! আমি? কক্ষনো না। আমি যদি ভয় পেতাম তাহলে এখানে বসে আছি কেন শুনি? ঠিক আছে, শুনবি তো শোন। আমার কী? পরে যেন বলিস না, মা, আমার ভয় করছে, রাতে খাব না, এই শুয়ে পড়লাম।”

মিঠি উত্তেজিত হয়ে বলল, “অ্যাই, তুই বেশি পাকামি করবি না। সেদিন জ্যাঠার কাছে ভূতের গল্প শুনে না খেয়ে কে শুয়ে পড়েছিল শুনি?”

বুকান লজ্জা পেল। বলল, “মোটেও না সেদিন আমার ক্ষিদে ছিল না, তাই না খেয়ে শুয়ে পড়েছি।”

আমি বুকান আর মিঠিকে থামিয়ে বললাম, “তোরা থামবি, না ঝগড়া করবি? তাহলে গল্পটা শুনব না তো।”

জ্যাঠা বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, আগে গল্পটা শোন, তারপর ভয় পেলে দেখা যাবে।”

আমি বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আগে গল্পটা বলো।”

জ্যাঠা শুরু করলেন, “প্রতিদিনের মতো উত্তরের বাগানের দিকে গেছি হাঁটতে। তখনো মেঘ করে আছে, বৃষ্টি এল বলে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বৃষ্টি এক্ষুনি নামবে। একটা শনশন হাওয়া হচ্ছে। আমার বেশ ভালো লাগছিল ফাঁকা জায়গায়। ভাবলাম, আর একটু থাকি। বৃষ্টি আসি আসি করছে বটে, তবে এক্ষুনি তো আর আসছে না, তাই আর একটু হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে তেমাথায় প্রকাণ্ড জামগাছটার নীচে দাঁড়িয়ে যেই না নস্যির ডিবেটা বের করে এক টিপ নস্যি নিয়েছি, ব্যস।”

বুকান জ্যাঠার চোখে চোখ রেখে বলল, “কী হল?”

জ্যাঠা বললেন, “কী আর হবে? দেখলাম সেই প্রকাণ্ড জামগাছ থেকে কে যেন তরতর করে নেমে এল আমার সামনে। আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কিছু বোঝার আগেই নাকি গলায় বলে উঠল, ‘কেঁ রেঁ, অঁনাথ নাকি?’ আমার সামনে লিকলিকে চেহারার একটা লোক সাদা কাপড় মুড়ি দেওয়া। সবেমাত্র অন্ধকার নেমে আসা আবছা আলোতে পরিষ্কার নয়। আমি আর কিছু বলতে পারছি না। তখনি বুঝতে পারলাম ভূতের খপ্পরে পড়েছি। এ ভূত না হয়ে যায় না।”

আমি জ্যাঠার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ও জ্যাঠা, ভূতটা তোমার নাম জানে?”

জ্যাঠা বললেন, “জানে তো। না জানলে কি আর নাম ধরে ডাকে বল।”

দূরে মা রান্না করছেন। কড়াইতে খুন্তি নাড়ার শব্দ। একটা পিলসুজের উপর কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলছে। সেই আলোতে মায়ের মুখটা এতদূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ভূতের কথা শুনে মা ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, দেখলাম মায়ের মুখে মৃদু হাসি।

বুকান বলল, “বলো বলো জ্যাঠা, তারপর?”

জ্যাঠা আবার শুরু করলেন, “তারপর আমি দেখলাম নাম ধরে যখন ডাকছে নিশ্চয়ই আমার চেনাজানা ভূত হবে। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি অনাথ। কিন্তু আপনি কে?’ সেই আবার নাকি গলায় বলল, ‘আঁমাকে চিঁনতে পাঁরছিস নাঁ বাঁবা? আঁমি তোঁর মণিকাঁকা—মণিকান্ত।’ আমি তো অবাক। এতদিন হয়ে গেল মণিকাকা মারা গেছে, কম করে দশ বছর তো হবেই। কিন্তু কতবার এইদিকে এসেছি, রাতবিরেতে এই রাস্তায় গেছি, একদিনের জন্যও তো মণিকাকাকে দেখিনি। তবে আজ হঠাৎ মণিকাকা এভাবে এল কেন?”

আমি জ্যাঠাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মণিকাকা কে?”

জ্যাঠা বললেন, “ওই যে স্কুলবাড়িটার কাছে বড়ো বাড়িটা দেখতে পাস, ওই বাড়ির বুড়ো। আমার সম্পর্কে কাকা হয়। আমার বাবার সঙ্গে ছিল দারুন খাতির। রোজ সন্ধেবেলায় ওই চণ্ডীমণ্ডপে বসে হুঁকো খেত। মণিকাকার আরো একটা নেশা ছিল, জানিস?”

আমি বললাম, “কী নেশা, জ্যাঠা?”

জ্যাঠা বললেন, “নস্যি।” বলেই জ্যাঠা নস্যির ডিবা থেকে এক টিপ নস্যি তুলে নিলেন। তারপর বললেন, “এই নস্যি নিয়েই যত ঝামেলা।”

বুকান বলল, “কেন, নস্যি নিয়ে আবার কী হল?”

জ্যাঠা বললেন, “তাহলে আর বলছি কী! ভূতটা কী বলে জানিস? বলে কিনা, ‘অঁনেকদিঁন এঁকটু নঁস্যি নিঁই নাঁ। এঁকটু নঁস্যি দেঁ না বাঁবা।”

মিঠি হাঁ করে ভূতের গল্প শুনছিল। জ্যাঠার কথা শুনে মিঠি বলল, “ভূত তোমার কাছে নস্যি চাইল?”

জ্যাঠা নস্যির টিপটা নাকে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, চাইল তো।”

আমি একবার মায়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম মা এক হাতে শাড়ির আঁচলটা মুখে দিয়ে হাসছে। জ্যাঠার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর কী হল, তুমি কি নস্যি দিলে?”

জ্যাঠা বললেন, “না দিয়ে কি উপায় আছে বল? ভূত বলে কথা। চেনাজানা ভূত। সম্পর্কে কাকা হয়। তারপর কী জানিস তো, ভূত তো ভূত, তা তো আর মানুষ নয়। কী করতে কী করে বসে তার তো ঠিক নেই। মট করে যদি ঘাড়টা মটকে দেয় তো ব্যস। তাই দিলাম। দিলাম কি আর সাধে? ওখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচি। তারপর শোন, যেই না নস্যির ডিব্বাটা বের করেছি, লিকলিকে লম্বা কালো হাতটা বের করে ডিব্বা থেকে এক টিপ নস্যি নিয়ে নাকে দিয়ে কয়েকবার হ্যাঁচ্ছো হ্যাঁচ্ছো করে বলল…”

“বুকাই বলল, “কী বলল, জ্যাঠা?”

জ্যাঠা আবার গোল গোল চোখ করে আমাদের দিকে একবার, মায়ের দিকে একবার তাকালেন। তারপর বললেন, “অঁনাথ, বাঁবা, বাঁচালি আঁমায়। কঁতদিন এই নঁস্যি নিঁইনি! উঁফ, প্রাঁণটা যেঁন ধঁড়ে এঁল।’ তারপর আমি বললাম, ‘ঠিক আছে কাকা, আজ যাই। তবে মাঝে মাঝে আসব, তোমাকে নস্যি দিয়ে যাব। তোমার চিন্তা নেই।”

জ্যাঠার গল্প শেষ হলে আমি বললাম, “তুমি আবার যাবে জ্যাঠা?”

জ্যাঠা বললেন, “দ্যাখ, এমনিতে কাকা হয়, তার ওপর সে ভূত হয়ে গেছে। বিপদে আপদে কখন কী হয় ঠিক তো বলা যায় না। তাই ভেবে দেখলাম, মাঝেমধ্যে যাওয়াই যায়।”

মা ওদিক থেকে রান্না করতে করতে চেঁচিয়ে উঠলেন, “আচ্ছা, অনেক গল্প হয়েছে। এবার এসো, খেয়েদেয়ে নাও।”

আমরা খেতে চলে গেলাম। জ্যাঠাও চলে গেলেন। বড়ো হয়ে আর জ্যাঠাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি জ্যাঠা তাঁর ভূত মণিকাকাকে সত্যি সত্যি নস্যি দিতে যেতেন কি না।

অলঙ্করণ-অংশুমান

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s