গল্প -বর্ণচোর-প্রসেনজিৎ সরকার-বর্ষা ২০২১

golpobarnachora

“আর ক’জন আছে নীলিমাদি?” ইন্টারকমের এ-প্রান্ত থেকে রিসেপশনিস্ট নীলিমাদেবীকে ধরলেন ড. সেন।

“আর মাত্র দুজন। পাঠিয়ে দিই?”

“দিন।”

সাইকিয়াট্রিস্ট ড. পার্থপ্রতিম সেনের ক্লিনিকে ইদানীং ভালোই পেশেন্ট হয়। গত দু-বছরে বেশ ভালো নামডাক হয়েছে তাঁর। সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু নামি মন্ত্রী, আমলা, শিল্পী, সাংবাদিক, খেলোয়াড়দের চিকিত্সা করেছেন তিনি। কাজেই তাঁর পসার মন্দ নয়। দিন দিন মানুষের জীবনে যেভাবে ডিপ্রেশন বাড়ছে, তাতে ড. সেনের মতো সাইকিয়াট্রিস্টদের পসার মন্দ হওয়ার কথাও নয়।

আজ শনিবার। প্রতি শনিবার সল্টলেকে নিজের বসতবাড়ির একতলার চেম্বারেই বসেন ড. সেন। রবিবার পুরো দিন ছুটি। আজ সকাল থেকে ভালোই ধকল গেছে। আর দুটো পেশেন্ট দেখা হলেই আজকের মতো ইতি। তাই নতুন পেশেন্ট দেখার আগে পাঁচ মিনিটের একটা ছোট্ট ব্রেক নিচ্ছিলেন ড. সেন। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। ‘কাম ইন’ বলতেই ঘরে প্রবেশ করলেন একজন বছর ষাটেকের বাঙালি প্রৌঢ়, পরনে সাদা অগোছালো শার্টের সঙ্গে নস্যি রঙের প্যান্ট, চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা, মুখময় একটা সঙ্কোচের ভাব।

চেম্বারটিতে একটি মাত্র বড়ো মাপের কাচের জানালা। ভদ্রলোককে চেয়ারে বসতে বলে ড. সেন জানালার দিকে পা বাড়ালেন। নকশা করা গাঢ় বেগুনি রঙের পর্দাটা টেনে দিলেন। ফলে ঘরের আলো অনেকটাই কমে গেল। ঘরের মধ্যে আলোর ব্যবস্থা বলতে কেবল একটি জ্বলন্ত নাইট বাল্ব আর ড. সেনের বসার টেবিলে একটি টেবিল ল্যাম্প। এছাড়া আর কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। ড. সেনের মতে, এরকম অল্প আলোয় চিন্তা গভীর হয়। পেশেন্টও মনোযোগ সহকারে খোলাখুলি মনের কথা বলতে পারেন।

ড. সেন নিজের টেবিলে ফিরে এসে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর প্রৌঢ় লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “বলুন।”

কিছুটা ইতস্তত ভাব কাটিয়ে প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি বলা শুরু করলেন।

“আজ্ঞে আমার নাম কালীকিঙ্কর শাসমল। আমি বেলেঘাটায় গুরুদাস পার্কের কাছে থাকি। ছত্রিশ বছর রাজ্য সরকারি দপ্তরে কাজ করে এই গতবছর রিটায়ার করেছি। যৌবনেই বিপত্নীক। একমাত্র কন্যা ব্যাঙ্গালোরে সুখে সংসার করছে। কাজেই বাড়িতে একা আমি ছাড়া আর কেউই নেই। পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশাও করি না। ক্লাবের আড্ডাতেও কোনোদিন… মানে, সেরকম ইয়ে-টিয়ে নেই। ডাক্তারবাবু, ইদানীং একটা সমস্যায় পড়ে আর কি… একদম ঘুমোতে পারছি না। সকাল বিকাল বড্ড অস্বস্তিতে আছি। কোনো কাজে শান্তি নেই। সর্বক্ষণ কেমন একটা ভয় ভয় ভাব। প্রথমে ভেবেছিলাম, মনের ভুল, এমনিই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, দিন দিন সমস্যাটা বেড়েই চলেছে।” খানিকটা দিশেহারা হয়ে বললেন ভদ্রলোক। পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে কপালে বিন্দু বিন্দু জমা ঘাম মুছলেন।

“আপনার সমস্যাটা একটু খুলে বললে আমার সুবিধা হয়।” বললেন ড. সেন।

“আমার সমস্যার শুরুটা হচ্ছে গিয়ে এই পেন…” বলেই বুক পকেট থেকে একটা সাদা রঙের সুইফটেক্সটের পেন বের করে ড. সেনের সামনে ধরলেন।

টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে হাত বাড়িয়ে পেনটা হাতে নিলেন ড. সেন। সুইফটেক্সট কোম্পানির একটা সাদা রঙের হাল ফ্যাশনের কলম। ড. সেন সেটাকে কিছুটা নাড়াচাড়া করে দেখলেন ভালো করে। অস্বাভাবিক কিছুই পেলেন না। কলমটা যথারীতি টেবিলে রেখে ফিরিয়ে দিলেন। কালীকিঙ্করবাবু কলমটা তুলে এনে ফের বুক পকেটে রাখলেন। তারপর ড. সেন জিজ্ঞাসা করলেন, “পেন থেকে আপনার কী ধরনের সমস্যা?”

“আজ্ঞে চাকরি জীবনের শেষদিনে এটা আমি গিফট পাই। কিন্তু জানেন, কী অদ্ভুত ব্যাপার, অফিস থেকে বাড়ি ফিরে গিফট খুলে যখন দেখেছিলাম, তখন এটা সোনালি রঙ দিয়ে ডিজাইন করা একটা কালো রঙের পেন ছিল। লেখাও পড়ছিল খুব সুন্দর, নীল কালির। আমার স্পষ্ট মনে আছে ডাক্তারবাবু। কিন্তু তার ঠিক পরের দিন সকালে দেখি পেনটা পুরো সাদা! লেখাও আর পড়ে না।”

“এটাই কি আপনার সমস্যা?”

“না ডাক্তারবাবু। এখান থেকেই সব সমস্যার শুরু। ওইদিনের পর আমার জীবন থেকে যেন একে একে সব রঙ হারিয়ে যাচ্ছে।”

“কীরকম?”

“ছেলেবেলায় আমার আঁকার হাত খারাপ ছিল না। রিটায়ার্ড লাইফে অঢেল সময়, কী আর করব? এখানে ওখানে মেলামেশা তো তেমন করি না, তাই ভেবেছিলাম একটু আঁকা-আঁকি করে কাটিয়ে দেব বাকিটা জীবন। প্রথম প্রথম খুব উদ্যমের সঙ্গে শুরু করলাম। সারাদিন, সারারাত শুধু ছবি আঁকতাম। কিন্তু তারপর অদ্ভুত কিছু ভূতুড়ে কাণ্ড হতে শুরু হল।”

“ভূতুড়ে কাণ্ড?”

“হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু। যতই আঁকি ছবিগুলো যেন শেষ আর হয় না। একটা পোর্ট্রেট এঁকে রঙ করা শেষ করলাম। এরপর ধরুন অন্য আঁকায় হাত দিয়েছি, হঠাৎ দেখি আগের ছবিতে কিছুটা রঙ করা বাকি থেকে গেছে! আবার সেটা রঙ করে কমপ্লিট করার পর নতুনটায় হাত দিচ্ছি, কিছুক্ষণ পড়ে দেখছি আবার সেই একই কাণ্ড! অথচ ছবির কোনো অংশ রঙ করা বাকি নেই!”

“ছবিগুলো কীরকম লাগছিল দেখতে?”

“কীভাবে বোঝাই আপনাকে… যেন রঙিন একটা আঁকা থেকে কেউ রাবার দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট রঙ মুছে দিয়ে সেই জায়গা সাদা করে দিয়েছে! সেগুলোকে রঙ করি তো পরের বার দেখি অন্য অংশের রঙ গায়েব!”

“এরকম কতবার হয়েছে?”

“অগুনতি বার! অধৈর্য হয়ে পড়তাম। পুরোনো আঁকা ছেড়ে দিয়ে একের পর এক নতুন আঁকা আঁকতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুদিন পর দেখলাম সব আঁকা থেকে অল্প অল্প করে রঙ গায়েব হয়ে যাচ্ছে!”

“ইন্টারেস্টিং! এছাড়া আর কিছু?”

“শুধু আঁকার জন্য এরকম হলে কোনো অসুবিধা ছিল না। এরপর আস্তে আস্তে জীবন থেকে অনেক রঙই হারিয়ে যেতে লাগল!”

“যেমন?”

“যেমন… যেমন ধরুন এই জামাটা। আমার এই জামাটা হালকা বাদামি রঙের ছিল। এখন ধবধবে সাদা। বাজারে যাচ্ছি, কাঁচা আনাজ কিনছি, বাড়িতে ফিরে এসে দেখছি তার মধ্যে কিছু কিছু সবজি সাদা হয়ে গেছে। আমার সাধের লাল ডায়েরি, ইতিমধ্যে সেটা সাদা। আমাদের পাড়ার সাদা-কালো কুকুরটা, কালু। ওকে প্রতিদিন খেতে দিই। হঠাৎ পরশুদিন দেখি ওর গায়ের রঙ সাদা হয়ে গেছে! অথচ ডাক্তারবাবু, আমাদের পাড়ায় কোনো সাদা কুকুর নেই। আর ওই কুকুরটাও যে কালুই, সে ব্যাপারে আমি একশো ভাগ নিশ্চিত। আর বলবেন না ডাক্তারবাবু, সেদিন তো অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলাম…”

“প্রাণে বাঁচলেন মানে?”

“আজ্ঞে রাস্তায় স্কুটার নিয়ে যাচ্ছি, ট্রাফিক সিগন্যালের রঙগুলো হঠাৎ সাদা হয়ে গেল! ডানদিক থেকে একটা গাড়ি এসে প্রায় মেরেই দিচ্ছিল! এমনিতে গত কয়েক দিন ভয়ে ভয়েই ছিলাম। চোখে যা যা দেখছিলাম, বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু সেইদিনের ঘটনার পর থেকে ভয়টা আরো জাঁকিয়ে বসেছে ডাক্তারবাবু। তারপর কোনো কিছুতেই আর মন টিকছে না। সারাক্ষণ খালি একটা আতঙ্ক আতঙ্ক ভাব। নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাচ্ছি, ছবি আঁকায় আর মন বসে না। রাস্তায় বেরোতেও ভয় লাগে। অথচ বিশ্বাস করুন, আমি জানি আমি যা দেখছি সেটা হ্যালুসিনেশন নয়! কথাগুলো কাউকে বলতেও পারছি না, পাছে সে-লোক আমায় পাগল ঠাওরায়… আমি পাগল নই ডাক্তারবাবু, বিশ্বাস করুন! অনেক সাহস করে নরেন মুখার্জীকে কথাগুলো বললাম। উনি আমার পুরোনো অফিসের কলিগ। তারপর উনিই আপনার নাম সাজেস্ট করলেন। বললেন একবার দেখিয়েই নিন না, কনসাল্ট করতে আপত্তি কীসের? প্রথম প্রথম আমি আপনার কাছে আসতে দ্বিধাবোধ করছিলাম। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, আমি ভয়ে ক্রমশ পাগল হয়ে যাচ্ছি ডাক্তারবাবু। তাই বাধ্য হলাম আপনার কাছে আসতে।”

সিগারেটটা শেষ করে অ্যাশ-ট্রেতে ফেললেন ড. সেন। এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত কেস তাঁর কাছে প্রায় দিনই আসে। কালীকিঙ্করবাবুর কেসটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। ভদ্রলোকের কথা শেষ হলে মনে মনে কিছু চিন্তাভাবনা করলেন ড. সেন। কী বলবেন ঠিক করে নিজেকে গুছিয়ে নিলেন একবার। মানসিক চিকিত্সার প্রথম শর্তই হল মানসিক রোগীর সামনে ভেবে-চিন্তে কথা বলা, তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করা। তাদের কষ্টে সহমর্মিতা দেখানো, তা সে যতই ঠগ-জোচ্চোর কিংবা খুনের আসামীই হোক না কেন।

ড. সেন বললেন, “দেখুন, আপনার সঙ্গে যা-ই ঘটুক না কেন নিজেকে পাগল মনে করার কোনো কারণ নেই। মানসিক সমস্যা যে-কোনো মানুষেরই হতে পারে। তবে ভালোই করেছেন, আমার কাছে এসেছেন। আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

“ভয়ের কিছু নেই বলছেন?”

“বলছি। আপনার চেয়ে অনেক কঠিন কঠিন অসুখ নিয়ে মানুষ বেঁচে আছেন। কাজেই চিন্তার কিছু নেই। একবার একটু কাছে আসুন তো। আপনার চোখটা একবার দেখতে চাই।”

চোখ পরীক্ষা করার টর্চটা হাতে নিয়ে কালীকিঙ্করবাবুর কাছে গেলেন ড. সেন। টেবিলে পেছন ঠেকিয়ে বসে প্রথমে ওঁর বাঁ চোখ, তারপরে ডান চোখটা ভালো করে দেখলেন।

“ছোটবেলায় মাথায় কোনো চোট পেয়েছিলেন?” জিজ্ঞেস করলেন ড. সেন।

“কই, সেরকম তো কিছু হয়নি।”

“আগে কখনো নার্ভের ওষুধ খেতেন?”

“কোনোদিন না।”

“অন্য কোনো মানসিক অবসাদে ভুগেছেন কখনো?”

“আজ্ঞে স্ত্রী গত হওয়ার পর কিছুদিন, সেই নাইনটি ফোরে। কিন্তু সেরকম অস্বাভাবিক কিছু তো ঘটেনি।”

“অফিসের কাজের চাপ কেমন ছিল?”

“কী আর বলি বলুন তো। সারাজীবন কেরানির কাজই তো করলাম। কাজের চাপ ছিল না বলব না, কিন্তু তার জন্য মানসিক চাপ কোনোদিনই ছিল না। আমার কর্মজীবন সুখেরই ছিল বলে আমার বিশ্বাস ডাক্তারবাবু।”

“এর আগে কোনোদিন ভুল দেখা বা ভুল বলা কিংবা ধরুন মৃগী রোগের মতো কিছু…”

“না, ডাক্তারবাবু।”

“বুঝলাম।”

সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ড. সেন। তাঁর ভ্রু ঈষৎ কোঁচকানো। আবার ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে।

“দেখুন, আপনার যে সমস্যাটা হয়েছে সেটা অ্যাক্রোমাটপসিয়া-র একটা বিশেষ ধরন। এরকম রোগ যাঁদের হয়, তাঁরা সাময়িকভাবে বা কখনো স্থায়ীভাবে কিছু বর্ণ চিনতে পারেন না। অনেকেই জন্ম থেকে এই সমস্যায় ভোগেন, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা বয়সজনিত কারণে। চোখের ও মস্তিষ্কের কিছু বিশেষ স্নায়ু যেগুলো একটা বর্ণের সঙ্গে আরেকটা বর্ণের তফাত করতে পারে, সেগুলো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হয়ে যায়। তখনই এই ধরনের সমস্যা ধরা পড়ে। আপনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।” বললেন ড. সেন।

“তার মানে আমি ভুল দেখছি ডাক্তারবাবু?”

“না না। ওভাবে ভাববেন না। আপনি ঠিকই দেখছেন। আপনার স্নায়ু আপনাকে যা যা দেখাচ্ছে, আপনি ঠিক তাই-ই দেখছেন। কিন্তু সমস্যাটা হল, স্নায়বিক দুর্বলতার জন্য আপনার কিছু বিশেষ কয়েকটা স্নায়ু কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে একটি বা কয়েকটি বর্ণকে চিহ্নিত করতে পারছে না।”

“তাই, না?”

“হ্যাঁ। সেই সঙ্গে কিছু অবসাদও রয়েছে আপনার।”

“অবসাদ? আমার? যেমন?”

“দেখুন, চাকরি জীবনে একটানা কাজ করলে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা যায়। যেমনটা আপনি নিজেই বললেন যে আপনার চাকরি জীবন খুবই সুখের ছিল। তার মানে আমি ধরেই নিচ্ছি আপনি নিজের কাজটা উপভোগ করতেন। ঠিক তো?”

“ঠিক।”

“কাজেই যেদিন আপনি রিটায়ার করলেন, তারপর থেকেই আপনার জীবনে উত্কট সমস্যার সৃষ্টি হতে শুরু করল। তার উপর আপনি নিঃসঙ্গ। চাকরি জীবন শেষ হওয়ার কারণে সেই পরিচিত পরিবেশটা আর পান না। আর সেই থেকেই আপনার অবসাদ। আপনি আপনার অফিসকে মিস করেন। তাই তো, নাকি?”

“হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, ভীষণ!”

“অফিস আর না থাকার জন্যই এই অবসাদ। ফলে নিজের কাজে উত্সাহ নেই। আঁকায় মন থাকে না। ফলে নিজের অজান্তেই একটা আঁকা সম্পূর্ণ না করেই অন্য আঁকায় মন দিয়ে ফেলছেন। পরে যখন দেখছেন সেই আঁকায় গলদ রয়েছে, সেটাই আপনি বার বার রঙ করে যাচ্ছেন। আবার ধরুন, স্নায়বিক সমস্যার কারণেই সবুজ সবজিকে আপনি বর্ণহীন দেখছেন। ট্রাফিক সিগন্যালের রঙ সাদা হয়ে যাচ্ছে, ইত্যাদি…”

“কিন্তু পেনটা?”

“সুইফটেক্সট কোম্পানির এই পেন সাদা রঙেরও হয়। বাজারে গেলেই পাবেন। অনেক রঙের মডেল আছে। এই দেখুন আমারটা, নীল রঙের।”

ড. সেন তাঁর টেবিলের উপর রাখা পেন স্ট্যান্ড থেকে সুইফটেক্সট কোম্পানির একটা অনুরূপ নীল রঙের মডেল তুলে এনে কালীকিঙ্করবাবুর সামনে ধরলেন। অবাক হয়ে সেটাকে দেখলেন ভদ্রলোক।

“তাই তো! কিন্তু…”

“কিন্তু?”

“আমি যে দেখলাম প্রথম দিন, প্যাকেট খুলে, ওটা কালো রঙের ছিল।”

“রিটায়ারমেন্টের দিন কতগুলো পেন পেয়েছিলেন?”

“সে অনেক। বেশিরভাগই তো পেন। গোনা হয়েছে নাকি?”

“তার মধ্যে কালো ক’টা?”

“বেশিরভাগই কালো।”

“সেটাই হয়েছে। অন্য কালো রঙের পেনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন।”

“ওহ্‌, তাই-ই হয়তো হবে। কিন্তু ডাক্তারবাবু, এখন উপায়?”

ড. সেন ড্রয়ার থেকে তাঁর প্রেসক্রিপশন লেখার প্যাডটা বের করে টেবিলে রাখলেন। তারপর নীল রঙের সেই সুইফটেক্সট কোম্পানির কলমটা দিয়েই খচখচ করে কলম চালিয়ে কীসব লিখলেন। লেখার পর কলমটা পুনরায় পেন স্ট্যান্ডে রেখে দিলেন।

“কয়েকটা ট্যাবলেট লিখে দিলাম। সঙ্গে কিছু স্ট্রেস আর ঘুমের ওষুধও আছে। আপনি বরং কোনো ভালো অপথ্যালমোলজিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করুন। আশা করি আপনার চোখের সমস্যাটা উনি সরিয়ে দিতে পারবেন। একটা চোখের ড্রপও লিখে দিচ্ছি, সাধারণ ড্রপ, চোখের আরাম হবে।” বললেন ড. সেন। লেখা হয়ে গেলে একটানে প্রেসক্রিপশনটা ছিঁড়ে কালীকিঙ্করবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

“সবই তো বুঝলাম ডাক্তারবাবু। কিন্তু…”

“কিন্তু? আর কোনো সমস্যা?”

“সমস্যা তো একটা থেকেই যাচ্ছে যে।”

“কীরকম?”

“একটা লোক।”

“কে?”

“একটা ফর্সা মতন লোক। রিটায়ারমেন্টের দিন থেকেই দেখছি।”

“ফর্সা বলতে? সেও কি সাদা চামড়ার?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।”

“সাহেব?”

“না না, সাহেব নয়। ওই কিছু লোক হয় না, ধবধবে সাদা, কী যেন বলে…”

“অ্যালবিনো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। অ্যালবিনো। অ্যালবিনো টাইপের লোক। মাঝেমধ্যেই দেখতে পাই। তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।”

“স্ট্রেঞ্জ! সে কি আপনাকে কিছু বলে?”

“সেটাই তো সমস্যা। কিচ্ছু বলে না। কেবল আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। না হাসে, না কাঁদে, অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে খালি।”

“আপনি তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেননি?”

“অনেকবার। কিন্তু যতবারই ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি, ওকে আর ধরতে পারি না, যেন হাওয়ায় গায়েব হয়ে যায়। রিটায়ারমেন্টের দিন বাড়ি ফিরছি। ই.এম. বাইপাসের সামনে দাঁড়ালাম রাস্তা পেরোবার জন্য। রাস্তার ও-পারে দেখি সেই লোকটা। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ওই-ই প্রথম। সেদিন বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। তারপর হাটে-বাজারে, পাড়ার মোড়ে, যেখানে-সেখানে দেখছি লোকটাকে। এখন বাড়ির বাইরে পা রাখলেই মনে হয় এই বুঝি লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। ডাক্তারবাবু, আমার ধারণা, যেই দিন থেকে ওই লোকটাকে দেখেছি, সেদিন থেকেই যত সমস্যার উত্পত্তি। কিন্তু ভয়ে কাউকে বলতে পারছিলাম না। শুধু মুখার্জীবাবু আর আপনিই জানেন।”

“বুঝলাম। দেখুন, সমস্যাটা সেই একই, দৃষ্টিভ্রম। চামড়ার রঙ, চুলের রঙ—এইসব সাদা দেখলে সাধারণ মানুষকে অ্যালবিনো টাইপেরই মনে হবে। কিংবা সত্যি সত্যিই হয়তো একবার কোনো অ্যালবিনো মানুষকে একবার দেখেছিলেন, সেটাই মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। এরকম ভুল তো আমারও হয়।”

“তাই হবে হয়তো। আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আমি সেরে উঠব তো?”

“অবশ্যই। চোখের চিকিত্সাটা তাড়াতাড়ি করান। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”

“কিন্তু ডাক্তারবাবু, যদি আমার চোখ ঠিক না হয়?”

“রোগের কারণটা জেনে অন্তত মানসিক যন্ত্রণা থেকে তো মুক্তি পাবেন। কোনো ভয় আপনাকে আর গ্রাস করবে না। কাজেই কিচ্ছু চিন্তা নেই। আপনি মানসিকভাবে সেরে উঠবেন। এবার আপনি আসুন। নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যান। অসুবিধা হলে বলতে দ্বিধা করবেন না। আবার আসবেন, কেমন?”

ড. সেনের আশ্বাসে কিছুটা শান্ত হলেন কালীকিঙ্করবাবু। ড. সেনকে বললেন, “ঠিক আছে। অসংখ্য ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। আপনার ফিটা?”

“বাইরে নীলিমাদি আছেন, ওখানে।”

“আজ্ঞে।”

চেয়ার ছেড়ে উঠলেন কালীকিঙ্করবাবু। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আবার নিজের টেবিলে ফিরলেন ড. সেন। ইন্টারকমে ধরলেন রিসেপশনিস্ট নীলিমা দাসকে। “পরের জনকে পাঠান।”

“হ্যাঁ স্যার, পাঠাচ্ছি।”

ড. সেন পকেট থেকে স্মার্ট ফোনটা বের করে একবার দেখলেন। কয়েকটা মেসেজ চেক করার পর হঠাৎ সময়টা খেয়াল করলেন। পাঁচটা সতেরো বেজে গেছে। ছ’টার মধ্যে বেরোতে হবে একটা জরুরি কাজে, গলফ গ্রিনে।

এদিকে বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল, কেউ আসছে না দেখে আবার ইন্টারকমে ফোন করলেন, “কই দিদি, পেশেন্টকে পাঠান। বসে আছি তো!”

“এইমাত্র পাঠালাম তো স্যার। যায়নি?”

“নাহ্‌, কেউ তো আসেনি!”

“আচ্ছা স্যার, আমি দেখছি উনি কোথায় গেলেন।”

“হ্যাঁ, একটু তাড়াতাড়ি দেখুন প্লিজ। আমাকে বেরোতে হবে ছ’টা নাগাদ।”

ফোনটা রেখে দিলেন ড. সেন। চুলে একবার হাত বুলিয়ে কনুই দুটো টেবিলে রেখে হাতজোড় করে জানালার দিকে একবার তাকালেন। বিকেলের রোদ আলাদাই আলো-আঁধারি খেলা করছে ঘরের ভেতরে। দৃশ্যটা একটু অন্যরকম লাগল কি? কে জানে।

টেবিলের দিকে চোখ ফেরালেন। চোখ দুটো আটকে গেল একজায়গায়—সেই পেন স্ট্যান্ডটায়। সুইফটেক্সটের সেই কলমটা। কিন্তু সাদা রঙের। তাজ্জব ব্যাপার! এই পেন তো তাঁর কাছে থাকার কথা নয়! ড. সেন মনে করার চেষ্টা করলেন। কালীকিঙ্করবাবুর সাদা পেন তিনি তাঁকে নিজের হাতে ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক সেই পেন তাঁর বুক পকেটের মধ্যে রাখলেনও। হ্যাঁ, এতটা ভুল হওয়ার তো কথা নয়, ঠিক মনে আছে। কিন্তু পেন স্ট্যান্ডে সাদা পেনটা এল কী করে? তৎক্ষণাৎ পেন স্ট্যান্ডটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন ড. সেন। ওঁর নিজের নীল রঙের সুইফটেক্সটের পেনটাও তো নেই! তাহলে কি ভদ্রলোক যাওয়ার আগে পেন দুটো অদলবদল করে গেলেন? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? টের পেলেন না ড. সেন? কী একটা ভেবে সন্দেহের বশে পেনটা তুলে হাতের কাছে রাখা একটা প্যাডের সাদা কাগজে খচখচ করে কলম চালালেন। কিন্তু কোনো দাগ পড়ল না।

এমন সময় দরজায় হঠাৎ টোকা পড়তেই ‘কাম ইন’ বললেন ড. সেন। দরজা খুলে ভেতরে যিনি এলেন, তিনি কোনো পেশেন্ট নন। নীলিমাদেবী।

“স্যার, সাত নম্বর আপয়েন্টমেন্টটা যাঁর ছিল, তাঁকে তো খুঁজে পাচ্ছি না।”

“মানে?”

“মানে সাত নম্বর নামটা আজ সকালেই লিখিয়েছিলেন উনি। একটু আগেও ছিলেন রিসেপশনে। ছয় নম্বরের হয়ে যেতেই ওঁকে ভেতরে যেতে বললাম। উনি আপনার চেম্বারের দিকেই তো এলেন। কিন্তু তারপর থেকেই তাঁকে আর দেখতে পাচ্ছি না।”

“দেখুন পালিয়েছে মনে হয়। ঠিক আছে, ভালো হল, আমায় এবার উঠতে হবে। আমার একটু তাড়া আছে।”

“কিন্তু স্যার, একটা অদ্ভুত কাণ্ড হয়েছে।”

“কী?”

“লিস্টে ওঁর নাম পাচ্ছি না।”

“মানে?”

“মানে সাত নম্বর নামটা গায়েব। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে ওঁর নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার আমি এন্ট্রি করেছিলাম খাতায়।”

“ধুর, এরকম হয় নাকি?”

“হ্যাঁ স্যার, বিশ্বাস করুন। ওঁকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলে যেই ফোন করতে যাব, তখনই খেয়াল করলাম খাতায় ছয়ের পর আর কোনো এন্ট্রি নেই, একদম সাদা! এরকম কোনোদিনও হয়নি।”

“লোকটার নাম মনে আছে?”

“সেটাই সমস্যা। কী যেন একটা নাম, কিছুতেই মনে করতে পারছি না, তবে হ্যাঁ…”

“তবে কী?”

“লোকটা খুব অদ্ভুত দেখতে।”

“অদ্ভুত বলতে?”

“একেবারে ফ্যাকাশে গায়ের রঙ। চুলগুলোও সব সাদা। অল্প কথা বলেন।”

“তাই নাকি? একবার রেজিস্টার খাতাটা দিন তো দেখি।”

নীলিমাদেবীর হাতেই ছিল সাদা মলাটের বাঁধানো খাতাটা। সেটা এগিয়ে দিলেন ড. সেনের দিকে। “এই যে স্যার।”

খাতাটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলেন ড. সেন। অবাক হয়ে নীলিমাদেবীর দিকে চাইলেন তিনি।

“দিদি, যতদূর মনে পড়ে রেজিস্টার খাতাটা গোলাপি রঙের ছিল, তাই না?”

“হ্যাঁ স্যার, তাই তো? কিন্তু এটাতেই তো। কী অদ্ভুত! একটু আগেও তো এটা গোলাপি…”

খাতাটা ছিনিয়ে নিয়ে টেবিলের উপর দড়াম করে রাখলেন ড. সেন। ক্ষিপ্রভাবে আঙুল চালিয়ে শেষ লেখা পাতাটা ওলটালেন। ‘বিশ্বজিৎ রায়, আনন্দ অগরওয়াল, ডলি মিত্র, সুবিমল ভট্টাচার্য়, সাগর দে আর ছয় নম্বরে কালীকিঙ্কর শাসমল’—তারপরে আর কিছু নেই। এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে খাতাটা জানালার কাছে এনে সাদা পাতাটা টান টান করে আলোয় ধরলেন ড. সেন। নীল রঙের ডট পেনে লেখা ছ’খানা নামের পর সাত নম্বর নামটা ফাঁকা। সেখানে ডট পেনের আঁচড় বোঝা গেলেও সে-লেখা পড়ে নামধাম কিছু উদ্ধার করা মুশকিল।

মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল ড. সেনের। নিজের চেয়ারে ফিরে এসে খাতাটা টেবিলে রাখলেন। পকেট থেকে সিগারেটের বাক্সটা বের করে একটা সিগারেট ধরালেন।

“আপনি এখন যান নীলিমাদি, আজকের মতো ছুটি। সোমবার দেখা হবে। খাতাটা নিয়ে যান।” বলে খাতাটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন ড. সেন।

“ঠিক আছে স্যার।” বলে নীলিমাদেবী পেছন ফিরতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন। সেই সঙ্গে ড. সেনও ফিরে তাকালেন নীলিমাদেবীর দিকে।

“কিছু বলবেন দিদি?”

“না, তেমন কিছু না। স্যার, জানালার পর্দাটা কবে চেঞ্জ করলেন? আগেরটাই তো ভালোই ছিল।”

“পর্দা? কই, না তো!”

জানালার দিকে ফিরে চাইলেন ড. সেন। মুখ থেকে সিগারেটটা পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে শরীরে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল তাঁর। কয়েক মিনিট আগেও যখন তিনি জানালার দিকে তাকিয়েছিলেন, জানালাটা তখন একটু অন্যরকম লাগলেও খেয়াল করেননি। নকশা করা বেগুনি রঙের পর্দা এখন আর বেগুনি নেই! নকশাটুকু রয়েছে, কিন্তু গোটাটাই সাদা! যেন কোন এক বর্ণচোর এসে চুরি করে নিয়ে গেছে পর্দার শেষ রঙটুকু।

“আপনি এবার আসুন দিদি, আমায় একটু একা থাকতে দিন।”

“ঠিক আছে স্যার।”

ড. সেনের মুখ-চোখ দেখে কিছুটা অবাক হয়েই নীলিমাদেবী চলে গেলেন।

টেবিল ছেড়ে জানালার কাছে ফিরে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে আরেকটা সিগারেট ধরালেন ড. সেন। বিকেলের আলো কমে এসেছে। বাইরের দিকে তাকালেন। বাগান পেরিয়ে গেটের বাইরে রাস্তার দিকে চোখ গেল। একটা দৃশ্য চোখে পড়তেই সেখানে চোখ আটকে গেল সাইকিয়াট্রিস্ট ড. পার্থপ্রতিম সেনের। একটা ধবধবে ফ্যাকাশে ফর্সা লোক, ভাবলেশহীনভাবে সোজা তাকিয়ে আছে তাঁরই দিকে। সুষুম্নাকাণ্ড বেয়ে একটা চোরা ঠান্ডা রক্তের স্রোত বয়ে গেল। ড. সেন সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির একতলার চেম্বার থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলেন রাস্তার দিকে। গেটের কাছে পৌঁছে দেখলেন কেউ নেই সেখানে। হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেল সেই বর্ণচোরটা।

অলঙ্করণ- অংশুমান

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s