মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথের আগের গল্প–ঝোলাগুড়ের হাঁড়ি, ঝিনুকনদীর চর , ছানাভূত
আচমকা উঠোনের দিকে তাকিয়ে আমরা হতভম্ব। বাকরুদ্ধ। মনোজ তখন উঠোনের মাঝখানটায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে। কী আশ্চর্য! ও ন্যাড়ামুণ্ডি। মাথাভর্তি ঝাঁকড়াচুল উধাও।
অবাক হয়ে বললাম, “কী রে! ন্যাড়া হয়ে এলি যে?”
ও নিরুত্তর।
আমি আবারও বলি, “কী ব্যাপার? কোথায় গেছিস চুল কাটাতে? তরুণ শীলের সেলুনে?”
ও নিঃশব্দ মাথা দোলাল।
“তরুণ শীল ছিল না? অন্য কেউ কেটে দিয়েছে এমন? ভুল করে?”
ও মাথা নাড়াল। অস্ফুট স্বরে বলল, “না।”
“তবে? ইচ্ছে করে ন্যাড়া হলি?”
মিনমিন করল ও, “হ্যাঁ।”
“বলিস কী! ইচ্ছে করে! কেন?”
মেজদা ততক্ষণে খাওয়ার পাত থেকে লাফিয়ে উঠেছেন। ঝড়ের গতিতে ওর সামনে ছুটে গিয়ে এঁটো হাতটি ওর নাকের ডগায় দুলিয়ে বললেন, “কেন রে! ন্যাড়া হলি! তোর কি বাবা মরেছে? না মা? বেরো। এই ঘরে জায়গা নেই তোর। মাথার চুল বড়ো হবে, তারপর ফিরবি।”
খানিক লজ্জা, খানিক ভয় মেশানো মুখ নিয়েই একটু আগে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছিল মনোজ। এখন তার চোখ ছলছল। আসামীর মতো মুখ চুন করে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে।
আমি ততক্ষণে আসরে। মেজদার সামনে গিয়ে দেয়াল হয়ে দাঁড়ালাম। ঠেলেঠুলে মনোজকে স্নানে পাঠিয়ে মেজদাকে আবার এনে খাওয়ার পাতে বসালাম।
স্নান সেরে অনেক দেরিতে ফিরল মনোজ। ঘরে ফিরলে উত্তম মধ্যম পড়ে পিঠে, সেই ভয়ে। যখন ফিরল, মেজদার পজেশন থেকে হাইজ্যাক করে নিলাম আমি ওকে। ওর খাবারের থালাটিও নিয়ে গিয়ে উঠলাম আমার পড়ার ঘরে। তারপর কিছু কথোপকথন।
“হ্যাঁ রে, হঠাৎ ন্যাড়ামুণ্ডি হয়ে এলি?”
ভাত মুখে পুরে মনোজ একচিলতে হাসল।
“তরুণ শীল তো ভুল করেনি বললি। তবে শখ করে?”
ও মাথা নাড়ল। না।
“তবে?”
“দোমরাদ থারের হাত থেকে বাঁতার দন্য।” ভাত চিবোতে চিবোতে উত্তর করল মনোজ।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। “অ্যাঁ! যমরাজ-স্যার! মানে হেড-স্যার! কী আশ্চর্য! উনি আবার কী করলেন?”
অনেকক্ষণ রোদনদেবী ওর চোখের দরজায় এসে কড়া নাড়ছিলেন। অনেক কষ্টে আটকেছে বেচারা এতক্ষণ তাকে। আর পারল না। আচমকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। দু-মিনিট বাদে কান্না থামিয়ে ওর শ্রীগৌরাঙ্গ সাজার বৃত্তান্ত শোনাল।
রগচটা, বদরাগী মাস্টার হিসেবে সুপরিচিত আমাদের বেলপুকুর জি.এস.এফ.পি. স্কুলের হেড-মাস্টারমশাই সোমরাজ সামন্ত। পান থেকে চুনটি খসার উপায় নেই। ধরেন আর পিটিয়ে তক্তা করেন কচি কচি ছানাপোনাগুলিকে। এককালে আমিও পড়েছি ওই স্কুলে। ত্রাহি ত্রাহি জীবন কাটিয়েছি পাঁচ-পাঁচটি বছর। ওঁর কিল-চড়-ঘুসি-আছাড় আর সকলের মতো আমারও ভাগ্যে জুটেছে বৈকি বার কয়েক। তাতেই হাড়ে হাড়ে বুঝেছি, লোকটি মানুষ নন। সাক্ষাৎ যমরাজই।
তবে মনের সুখে আড়ং ধোলাই করে একবার জব্বর ফ্যাসাদে পড়েছিলেন যমরাজমশাই। সেবারের আসামী ছিল শিবা। আমি তখন ক্লাস ফোরে। ও থ্রিতে। মুখোমুখি ক্লাস রুম। পড়া না পেরে সমানে তোতলাচ্ছে বেচারা শিবা। পুরোনো পড়াটি নিয়ে এই নিয়ে পর পর তিনদিন। হেড-স্যারের রাগ ক্রমে পারদ চড়ার মতো চড়ছে। তারপর নিমেষে চুল খাড়া। পেশি শক্ত। দুই চক্ষু রক্তজবা। ঘরটির কোণে পড়ে ছিল একটি নড়বড়ে বেঞ্চি। মড়াৎ করে সেটির একটি পায়া ভেঙে হাতে নিলেন। তারপর সেই কাঠের খুঁটোয় শিবা-পুজো।
সাতদিন আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি বেচারা শিবা। ডাক্তার-ওষুধ-ইঞ্জেকশন, চলেছিল সবই। সুস্থ হতে গিয়ে জাহাননগরের একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। এই স্কুলের মুখদর্শন করেনি আর।
এদিন নাকি জব্বর পেটাই করেছেন হেড-স্যার মনোজকে। ঘুপঘাপ পিঠে দিয়েছেন খান আষ্টেক। পরে এসে থেমেছেন মাথায়। তারপর ওর ঝাঁকড়া চুলের গোছা ধরে এমন টানাটানি করলেন যে, আপসে একটি গোছা চলে গিয়েছিল হেড-স্যারের হাতে। তাতে চমকে গিয়েছিলেন তিনি নিজেই। শেষে বিষম খেয়ে বললেন, “যাচ্চলে! এ কী হল? মাথায় তেল মাখাবি ভালো করে, বুঝলি? শালিমার নারকোল তেল। তোর চুলের গোড়া বড্ড নরম।”
“বুদ্ধিটা ঠিক নিয়েছি কি না তবে বলো?”
আমি মনোজের মরিয়া চাহনির দিকে তাকিয়ে বললাম, “একদম ঠিক। কিন্তু এতেও দমবেন কি উনি?”
মুচকি হেসে তাকায় মনোজ। “মাথা তো ন্যাড়া। দেখি এবার কেমন করে আমার চুল পাকড়ান!”
আমি মনোজের ন্যাড়ামুণ্ডিটায় হাত বুলিয়ে বললাম, “সে না হয় হল। কিন্তু পড়াশোনাটাও তো করতে হবে রে। লেখাপড়া না শিখে কি গাধা হয়ে থাকবি একটি, বল? এই তো তোর পড়াশোনার ছিরি। প্রতি ক্লাসে দু-বছর তিন বছর করে কাটিয়ে দিচ্ছিস। কবে যে মাধ্যমিক পাশ করবি!”
“ধুত! সে আমার দ্বারা হবে না কাকু।” বলে আমার দিকে প্যাঁচার মতো মুখ করে তাকাল মনোজ।
“চেষ্টা করলেই হয়।” আমি বলি।
“মিথ্যে কথা।”
“কেন?”
“চেষ্টা তো আমিও করি। হচ্ছে কই?”
“তোর চেষ্টায় ত্রুটি আছে।”
“ধুত! আমার ভাল্লাগে না পড়তে। অঙ্কের ওই যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের চক্করে পড়লেই মাথা গোলায়।”
“তবে কী করবি?”
“তাঁত বুনব।” বলে বত্রিশ পাটি বার করে হাসে মনোজ।
“তাঁত বুনতে কত কষ্ট, তা জানিস?”
“পড়াশোনা আরও কষ্টের।”
আমি রণে ভঙ্গ দিয়ে বলি, “তাই হোক। তাঁতই বুনবি বড়ো হয়ে। কিন্তু স্কুলের গণ্ডিটা অন্তত পার হ।”
মনোজ মাথায় হাত বোলায়। “তাই নিয়েই তো টেনশন।”
এদিন স্কুল থেকে ফিরে আর দেখা হয়নি মনোজের সঙ্গে আমার। খেলতে গিয়েছিলাম কিনা আমরা রাজাপুর লায়ন্স ক্লাবের মাঠে। ফিরেছি অনেক রাতে। কেননা, খেলাশেষে পিকনিক ছিল একটি। জিতে ফেরার দৌলতে। পুরো আয়োজন হয়েছিল আমাদের দুর্গামণ্ডপের মাঠে। মেনু ছিল জম্পেশ। মুরগির মাংস-পরোটা। গলা অবধি খেয়ে নড়তে পারছিলাম না। তবে সময়ে বাড়ি ফিরি কেমন করে?
মধ্যরাতে ঘরে ঢুকেও মনোজের ব্যাপারে কৌতূহলটা আমার গেল না। জানতে ইচ্ছে করছিল ঠিক কী ঘটল আজ স্কুলে। দারুণ চমকে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই যমরাজ-স্যার। অথবা আজ মারতে গিয়ে বেজায় ফ্যাসাদে পড়ে গেলেন। মনোজের মাথায় হাত বাড়িয়েও নিরাশ হয়েছেন। তারপর কী করলেন?
সকালে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে বাইরের খনখনে বৈশাখী রোদ্দুরের দিকে তাকিয়েই প্রথমে মনোজের কথা মনে এল। অমনি ডাকলাম ওকে। দু-তিনবার ডাকতে ঘরে এল ও। বিষণ্ণ ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি।
“আয়, বোস।” আমি বললাম। “তারপর, কী হল গতকাল? শোনা হয়নি যে।”
ও বড়ো করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। কিছু উত্তর দিল না।
আমি আবারও একই প্রশ্ন করলাম। “কী হল, বল! মারতে পারেননি নিশ্চয়ই হেড-স্যার?”
তেমনি সকরুণ দৃষ্টি ওর। তারপর একটু কাত হয়ে কান দুটি দেখাল। আমি ওর কানের দিকে তাকিয়ে থ। আশ্চর্য! কান দুটি ফুলে দশটাকা সাইজ অমৃতি ওর। তেমনি রক্তবর্ণ।
“এমন কী করে হল!” বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“ওর ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা, “দোমরাদ-থার।”
“কী করেছেন?”
ও কানমলার অভিনয় করে দেখাল।
কষ্ট লাগল আমার। হাসিও পাচ্ছিল। বললাম, “হে ভগবান! চুল নিয়ে টানাটানির ভয়ে ন্যাড়া হয়ে এলি, তবু রক্ষা নেই? তুলতুলে কান দুটিতে আক্রমণ? এবারে না কান দুটি খোয়া যায় তোর!” বলে একটু থামলাম। ভুরু কুঁচকে, কপালে ভাঁজ ফেলে ওর বিরস বদনের দিকে চেয়ে আবার বলতে থাকি, “শোন, ওই যমরাজ-স্যারের হাত থেকে বাঁচতে এখন আর দুটি পথ খোলা রইল তোর কাছে।”
আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকাল মনোজ। অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল, “কী?”
“এক, সিঁধেল চোরেরা চুরিতে বেরোনোর আগে সর্বাঙ্গে সরষের তেল মেখে বেরোয় যাতে পাকড়াওকারীর হাত থেকে সহজে ফসকানো যায়। স্কুল যাওয়ার আগে তোকেও তাই করতে হবে। দুই কানে আচ্ছাসে তেল মাখাতে হবে। তাতেও কাজ না হলে দ্বিতীয় রাস্তাটি ধরতে হবে।”
“কী সেটি?” ততোধিক উৎসুক চাহনি ওর।
“মন দিয়ে পড়াশোনাটা করা।”
শুনে মুখটিকে বাংলার পাঁচ করে তাকাল মনোজ আমার দিকে। উত্তর করল না কিছু। তবে কথাটা মনে ধরেছে বুঝি। দেখলাম গুম হয়ে বারান্দায় বসে থাকল কিছুক্ষণ। বন্ধুরা সব খেলছে, হই-হুল্লোড় করছে দেখেও মাঠের দিকে পা বাড়াল না। তারপর দারুণ অবাক করে দিয়ে পড়ার ঘরে ঢুকল। কৌতূহলী হয়ে উঁকি মেরে দেখি বই খুলে একমনে পড়ছে।
ছবি-জয়ন্ত বিশ্বাস