ডাক্তার বললেন, “অ্যাট লাস্ট কোমায় চলে গেলেন। মনে হয় এভাবেই একদিন চলে যাবেন। হাসপাতালের এখন আর কিছু করার নেই। আজকেই আমি ডিসচার্জ করে দিচ্ছি। আপনারা ওঁকে বাসায় নিয়ে যান।”
বিরাজবাবুর ছোটো ছেলে নিজেও ডাক্তার। সে হাসপাতালে এসেছিল। বলল, “বয়স তো কম হয়নি, তিরানব্বই। এই বয়সেও বেশ ভালো ছিলেন। হেঁটে চলে বেড়াচ্ছিলেন। গত তিন-চারদিনেই খুব খারাপের দিকে চলে গেলেন। বাড়িতেই হাসপাতালের মতো ব্যবস্থা করে রেখেছি। চিকিৎসার ত্রুটি হবে না।”
ছোটো ছেলেরও বয়স হয়েছে, সামনের বছরই সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ারমেন্ট। বাকি দুই ভাই বিদেশে। তারা নিজেরা আসতে পারছে না, কিন্তু অঢেল টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছে যাতে বাবার কোনও কষ্ট না হয়। বিরাজবাবু নিজেও বড়ো চাকরি করতেন। ব্যাঙ্কে নিজের নামেই টাকা রয়েছে অনেক। কাজেই হাসপাতালেই হোক আর বাড়িতেই হোক, টাকার অভাবে চিকিৎসার কোনও ত্রুটি ঘটবে না।
বিরাজবাবুকে এনে রাখা হল তাঁর নিজের ঘরে, পুবদিক খোলা ঘর। পাশেই বারান্দা, বাগান, পাখি ডাকছে। কিন্তু এসব অনুভব করার কোনও ক্ষমতা তাঁর আর নেই। চোখ বন্ধ করে অন্তহীন নিদ্রায় ডুবে আছেন। নার্স মাঝে মাঝে এসে তরল খাবার তাঁর মুখে ঢেলে দেয়। সেই খাবার ধীরে ধীরে গলা দিয়ে নেমে যায়। এইটুকু শুধু জীবনের চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে।
বিরাজবাবুর চেতনাহীন জীবনে দিন আসে, রাত্রি যায়। জানালার ধারে প্রতিদিনের শালিকের দল এসে ডাকাডাকি করে। বাইরের বাগানে কামিনী ফুলের গাছে কুঁড়ি ধরেছে। বিরাজবাবুর এইসব প্রিয় দৃশ্য একেবারে অর্থহীন এখন।
দিন তিন-চার পরে গভীর রাত্রে খুট করে একটা শব্দে বিরাজবাবু জেগে উঠলেন। প্রথমে চোখ খুলে তাঁর মনে হল কোনও অচেনা জায়গায় শুয়ে আছেন। একটু পরে আস্তে আস্তে নিজের ঘরটা চিনতে পারলেন। চারদিক ঝাপসা অন্ধকার। শব্দটা কীসের হল বোঝার জন্য বিরাজবাবু এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলেন তাঁর খাটের পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। বিরাজবাবুকে জেগে উঠতে দেখে লোকটা তাঁর খাটের পাশের ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল। বিরাজবাবু দেখলেন, ঝলমলে পোশাক পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার চেহারা একটু বেঁটে মতন, কিন্তু ঠিক বামন বলা যায় না। হাসি হাসি মুখ, পরনের পোশাকটা অনেকটা হোটেলের বাটলারদের মতো।
লোকটা পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বিরাজবাবুর হাতে তুলে দিয়ে বলল, “অধমের নাম নবীন, স্যার। এটা আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্সির কার্ড। ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলস।”
“ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলস মানে?” বিরাজবাবু প্রশ্ন করলেন।
“ওটার মানে স্যার সহজে বোঝাতে পারব না। আমরা মানুষকে নানা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাই। কিন্তু সেসব ঠিক এই বাস্তবের পৃথিবীর কোনও জায়গা নয়। একটা আধা বাস্তব আধা কল্পনার জগতে আমরা নিয়ে যাই। যে যেমন জায়গায় যেতে চায় আমরা কম্পিউটারের সাহায্যে তার একটা ত্রিমাত্রিক দৃশ্য তৈরি করি। সেটা দেখতে একেবারে সত্যিকারের মতো হয়। যে যেখানে যেতে চায় তার ফরমায়েশ অনুসারে একেবারে বাস্তবের মতো সেই দৃশ্য আমরা তৈরি করি। এবার আপনি ঘুরে বেড়ান যত খুশি।”
“তা কীভাবে সেই জগৎ, মানে কম্পিউটারে জগৎ তোমরা বানাও?”
“খুব সহজ কাজ স্যার। আপনি কম্পিউটার গেমস দেখেছেন তো? সেখানে একেবারে বাস্তবের মতো গ্রাম, শহর, মানুষ, দুর্গ, খেলার মাঠ এসব বানানো থাকে। খেলোয়াড় কম্পিউটারের পর্দায় একজন চরিত্র হয়ে সেই খেলা খেলে। আমাদের এটাও অনেকটা সেইরকম। তবে তফাত হল, এখানে সমস্ত পরিবেশটা তৈরি হবে আপনার চারপাশে। কোনও কম্পিউটারের পর্দায় নয়। গাছপালা, বাড়িঘর, মানুষ সব বাস্তবের মতো আপনাকে ঘিরে তৈরি হবে। আপনি তার ভিতরে বসে সবকিছু দেখতে পারবেন। বলুন কোথায় যেতে চান।”
“আমার ছোটবেলার কোথাও যদি যেতে চাই!”
“অবশ্যই যেতে পারবেন। আপনার স্মৃতিতে যেমন আছে ঠিক তেমন জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাব।”
“বাহ্, অদ্ভুত তো! যেতে তো লোভই লাগছে। কিন্তু অসুস্থ শরীরে আমার ছেলে যেতে দেবে না।”
“কেউ টের পাবে না স্যার!” লোকটার মুখে এক অমায়িক অথচ দুষ্টু দুষ্টু হাসি। “আপনি শুধু বলুন কোথায় যেতে চান। আমি নিয়ে যাব, আবার কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই দিয়ে যাব। আপনি স্থান আর সময়টা বলুন।”
“কবে, কখন নিয়ে যাবে?”
“আজকে বললে আজই। শুধু বলুন কোথায় যাবেন আর কোন সময়ে যেতে চান।”
“বলছি। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল, ১৯৩১ সাল, ১২ই জুলাই, বিকেল চারটে।”
“কোনও খেলা-টেলা ছিল নাকি স্যার?”
“ছিলই তো! চা বাগানের টিমের সঙ্গে আমাদের স্কুলের খেলা ছিল। আমরা হেরে যাই। আমার বিশ্বাস, শেষ গোলটা অফসাইড ছিল। রেফারি দেয়নি। খেলাটা আবার দেখতে চাই।”
“কোনও সমস্যা নেই, আমি নিয়ে যাব। আর একটা কথা, আপনি শুধু দর্শক হয়ে থাকবেন। নড়াচড়া করতে পারবেন না। রাজি তো?”
“রাজি।”
বিরাজবাবু ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন নবীনকে। লোকটা একটু বেঁটে মতন, কিন্তু কাঁধটা একটু বেশি চওড়া। পোশাকটাও অদ্ভুত রকমের নীল। তাঁর বাগানের অপরাজিতা ফুলগুলির মতো নীল। মাথায় একটা টুপি। তার উপর দুটো অ্যান্টেনার মতো তার বেরিয়ে আছে। তার বেঁটে হাত দুটো ছড়িয়ে দিয়ে লোকটা ফিসফিস করে কাকে যেন কী নির্দেশ দিল। তার মাথার উপর অ্যান্টেনাগুলি নড়তে থাকল। ঠিক মনে হল একটা প্রজাপতি শুঁড় নাড়ছে।
বিরাজবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, কোথা থেকে নীল পোশাক পরা চারজন লোক এসে তাঁকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে একটা গাড়িতে বসিয়ে দিল। গাড়িটা মারুতি ডিজায়ার, তাঁর নিজের গাড়িটার মতোই দেখতে। গাড়িটা অল্প কিছুদূর গিয়ে একটা ছোটো রাস্তা পেরিয়ে একটা মাঠের মাঝখানে দাঁড়াল। মাঠের মধ্যে একটা ছোট্ট বাড়ি, অনেকটা নয়াবস্তির প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের মতো।
“ওটাই আমাদের ভার্চুয়াল ভেহিকেল বা আমাদের কল্পনার যান।” নবীন বলল, “আসুন স্যার।”
চারজন লোক আবার তাঁকে পাঁজাকোলা করে তুলে হলের ভিতরে বসিয়ে দিল। বিরাজবাবু দেখলেন, ঘুটঘুটে অন্ধকার। নবীন তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “এখনই শুরু হবে। আপনাকে আপনার স্কুলের বড়ো আম গাছটার নীচে বেদির উপর বসিয়ে দিচ্ছি। সামনে খেলার মাঠ দেখতে পাবেন। শুধু একটাই কন্ডিশন আছে স্যার। আপনাকে যেখানে বসিয়ে দেওয়া হবে সেখান থেকে নড়তে পারবেন না কিছুতেই। আর কোনও কিছুই স্পর্শ করতে পারবেন না।”
বিরাজবাবু দেখলেন, তাঁর চারপাশে একটু একটু করে তাঁর ছোটবেলার স্কুল ফুটে উঠল। প্রথমে তাঁর পায়ের নীচে আমতলার বেদি দেখতে পেলেন। তারপর দেখলেন দৃশ্য ক্রমশ বড়ো হচ্ছে। এক মিনিটের মধ্যেই দেখলেন স্কুলের বাড়ি, বাগান, মাঠ, দূরে ধানক্ষেত, নূপুর-ঝুমুরদের বাড়ি, পাশে ভৌমিক-স্যারের বাড়ি, ওদিকে তিস্তার চর—সব ফুটে উঠছে। মাঠে অনেক লোক। বিরাজবাবু অনেককে চিনতেও পারলেন। ল্যাডলি সেন, ক্লাস টেনের ফার্স্ট বয়; অরূপকান্তি নিয়োগী, চা বাগানের মালিকের ছেলে; অমূল্য রাভা, মতিউর রহমান, পরে লিগ সরকারের সময় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিল।
ঠিক চারটেয় খেলা শুরু হল। পুলিশ লাইনের ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটে বাজল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাজবাবু সব বিস্ময় কাটিয়ে খেলায় ডুবে গেলেন।
নবীন বলল, “সব ঠিক আছে তো স্যার?”
বিজয়বাবু অভিভূত হয়ে বললেন, “অসাধারণ! ভাবা যায় না! টেকনোলজির কী উন্নতি! তবে একটুও হাঁটতে পারব না? এখানেই বসে থাকতে হবে?”
“তাই থাকতে হবে। কারণ, আপনার পরিপ্রেক্ষিতেই সমস্ত দৃশ্য নির্মাণ করা হয়েছে। আপনি নড়লে সমস্তটাই নড়ে যাবে। এখানে বসেই খেলা দেখুন।”
পঞ্চান্ন মিনিটের খেলা। চারটে আটচল্লিশে সেই বিখ্যাত গোলটি হল। চা বাগানের মদেশিয়া ফরওয়ার্ড এডওয়ার্ড ওরাওঁ জেলা স্কুলের স্টপারের পা থেকে বল টেনে নিয়ে দুরন্ত গতিতে গোল করে দিল। এবার খুব ভালো করে লক্ষ করলেন বিরাজবাবু। নাহ্, এতকাল একটা ভুল ধারণা ছিল। ওটা গোলই, অফসাইড নয়। এডওয়ার্ড ওরাওঁ দারুণ খেলোয়াড়।
বাড়িতে ফিরে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন বিরাজবাবু। নবীন পাশ থেকে বলল, “এবার ঘুমিয়ে পড়ুন স্যার। আপনার বিশ্রামের দরকার।”
নবীন বিরাজবাবুর মাথায় হাত রাখতেই তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
সকালবেলায় ছোটো ছেলে হাসপাতালে যাওয়ার আগে বাবাকে দেখে যায়। বুকে স্টেথোস্কোপ ধরে বলল, “হার্ট বিটটা যেন একটু বেড়েছে। বিকেলে একটা ই.সি.জি নেব।”
পরদিন ভোরের কিছু আগে আবার খুট করে শব্দ। বিরাজবাবু জেগে উঠলেন। নবীন বলল, “আজ কোথায় যেতে চান? বিদেশে কোথাও?”
“একেবারেই না। ছোটবেলায় ফিরে যেতে চাই। ছোটবেলার মতো আর কিছু হয় নাকি?”
“বেশ, তাহলে বলুন, কোথায় যাবেন।”
“ট্রেনে করে হলদিবাড়ি যেতে চাই। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখব দু-পাশের মাঠ, গ্রাম সরে সরে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে মাথা বের করলেই চোখে কয়লার গুঁড়ো এসে পড়ছে…”
“খুব কঠিন কাজ স্যার। দুটো মুভিং ইউনিট। একটা ট্রেনের ভিতর আপনি চলছেন, আর একটা বাইরের দৃশ্য। ঠিক আছে স্যার, হয়ে যাবে।”
বেড়ানো শেষ করে বাড়ি ফিরে আবার শুয়ে পড়লেন বিরাজবাবু। নবীনকে বললেন, “উফ্! অসাধারণ! তোমরা কী করে এরকম দৃশ্য বানাও বলো তো?”
নবীন হেসে বলল, “আজকে ঘুমিয়ে পড়ুন স্যার, অনেক এক্সাইটমেন্ট হয়েছে।”
সকালে ছোটো ছেলে বলল, “বাবার হার্ট আর লাং দুটোই খুব ভালো চলছে। মুখের চেহারাও সুস্থ মানুষের মতো। শুধু চেতনাটাই নেই। কে জানে, বাবা হয়তো আবার সুস্থ হয়ে যেতেও পারেন।”
***
তিন-চারদিন কেটে গিয়েছে। বিরাজবাবু একটু সুস্থ। চোখ খুলে তাকাচ্ছেন। কিন্তু খুব স্পষ্ট দৃষ্টি নয়। একটু যেন বিভ্রম রয়ে গিয়েছে। চোখ খুলে বিছানার পাশে যেন কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
নবীন প্রতি রাত্রের মতো আসে। বিরাজবাবু তাঁর শৈশবে ফিরে যান। আর প্রতিদিন একটু একটু করে যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন।
আরও কয়েকদিন পরে নবীন বলল, “খুব বেড়াচ্ছেন স্যার। আপনার ইচ্ছেমতো সব দৃশ্য আমরা তৈরি করে দিচ্ছি। আপনি খুশি তো?”
“আমি দারুণ খুশি।”
নবীন বলল, “স্যার, এবার আমি বিদায় নেব। আপনি তো সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আর আমাকে দরকার নেই।”
বিরাজবাবু আকুল স্বরে বললেন, “আর আসবে না?”
“উপায় নেই স্যার। আমরা ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলে শুধু তাদেরকেই নিয়ে যাই যারা অসুস্থ, চেতনাহীন। এর বাইরে যাওয়ার তো উপায় নেই স্যার।”
“তাহলে তুমি আবার কবে আসবে?”
“আসব স্যার, যেদিন সময় হবে আবার আসব। আমাকে যে আসতেই হবে।”
“বেশ, আমি কিন্তু অপেক্ষা করে থাকব।”
“আমি ঠিক আসব স্যার।” নবীন মৃদু গলায় বলল।
আরও কয়েকদিন কেটে গিয়েছে। বিরাজবাবু অনেকটাই সুস্থ। ওয়াকার নিয়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়াতে পারেন। একটা হুইল চেয়ার কেনা হয়েছে। তাতে করে বারান্দায় এসে বসেন। নীচে বাগানে ফুলবাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
একদিন বিকেলবেলা। বিরাজবাবুর বাগানের শ্বেতকরবী গাছে ফুল এসেছে। আকাশটা আশ্চর্য নীল। মেঘের ভেলা ভসে বেড়াচ্ছে। বাগান ছাড়িয়ে খুব বেশি দূরে চোখ যায় না। গেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিরাজবাবুর মনে হল তিনি যেন বাগানের অপর প্রান্তে নবীনকে দেখতে পেয়েছেন। সেই নীল রঙ, ছড়ানো পোশাক। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠৎই তাঁর মাথাটা পিছন দিকে হেলে পড়ল।
নার্স ছুটে এল। ছোটো ছেলে বাড়িতেই ছিল। সে তাড়াতাড়ি নাড়ি টিপে বলল, “আবার একটা স্ট্রোক হয়েছে। চলো, এখুনি বিছানায় শুইয়ে দিতে হবে। অক্সিজেন, স্যালাইন রেডি করো।”
বিছানায় শুইয়ে নার্স তাড়াতাড়ি অক্সিজেন আর স্যালাইনের নল লাগিয়ে দিল। বিরাজবাবু তলিয়ে গেলেন গভীর ঘুমে।
গভীর রাতে আবার সেই খুট করে শব্দ। বিরাজবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। দেখলেন বিছানার পাশে নবীন দাঁড়িয়ে আছে। সেই হাসি মুখ। সেই নীল পোশাক।
নবীন বলল, “কথা দিয়েছিলাম স্যার, তাই আবার এলাম। আজ আবার কোথাও যেতে চান কি?”
বিরাজবাবু প্রথমে ভেবেই পেলেন না কোথায় যাবেন। তারপর বললেন, “আজ আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে তার ঠিক বর্ণনা তোমাকে দিতে পারব না। সময়টাও আমার মনে নেই। আমার তখন পাঁচ বছর বয়স। আমাদের বাড়ির পিছনে একটা পুকুর ছিল। আমি আর আমার বোন, তার তখন তিন বছর মাত্র বয়স, আমরা দুজনেই জলে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার বোন ডুবে মারা যায়। আমাকে কে যেন হাত ধরে তুলে আনে। সেই দৃশ্যটা বানাতে পারবে?”
“পারব, কিন্তু খুব রিস্ক আছে। আপনার কিন্তু কিছুই করা চলবে না। চুপচাপ যা ঘটবে দেখে যাবেন।”
“মানে, আমিও তো জলে পড়ে যাব। কিন্তু কিছু করতে পারব না?”
“না, আপনি জলে পড়বেন না। আপনাকে দিয়ে কোনও অ্যাকশন করানো যাবে না। আপনি শুধু দেখবেন আপনার বোন একা একা হেঁটে পুকুরের দিকে যাচ্ছে। আপনি শুধু দেখবেন, কিছু করতে পারবেন না।”
আবার আস্তে আস্তে একটা অন্ধকার ঘরের ভিতরে বিরাজবাবুর শৈশবের দৃশ্য ফুটে উঠল। বিরাজবাবু অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর ছোটবেলার আকাশ এত ঘন নীল ছিল? গাছের পাতাগুলো এত সবুজ ছিল? বাড়ির টিনের চালে যে লাউগাছটা গজিয়ে উঠেছিল, তার ফাঁকে দুটো চড়ুই লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়ির বেড়ার মধ্যে মস্ত একটা ফাঁক। বিরাজবাবু দেখলেন, সেই ফাঁক গলে তাঁর তিন বছরের বোন বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে।
বোন বেরিয়ে যেতেই নবীন বলল, “এবার একটা দৃশ্যান্তর ঘটবে। আপনাকে পুকুরের ধারে নিয়ে যাচ্ছি।”
এক মিনিটের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল। তারপরেই দেখলেন, তিনি পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। ছোট্ট ডোবা একটা। ছোটবেলায় এটাকেই মস্ত একটা পুকুর বলে ভাবতেন। পুকুরের এক কোনায় একটা ঘাট। সেই ঘাটের ধাপে পা রেখে তাঁর বোন ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। বিরাজবাবুর মনে পড়ল, মাত্র ক’দিন আগে ভাইফোঁটায় এই বোনটাই ফোঁটা দিয়েছিল। শৈশবের এই দৃশ্য যে এত বিষণ্ণতার হবে তা তিনি আগে ভাবতে পারেননি।
নবীন আবার মনে করিয়ে দিল, “আপনি কিন্তু নড়তে পারবেন না স্যার।”
ঝুপ করে একটা শব্দ হতেই বিরাজবাবু তাকিয়ে দেখলেন পুকুরের পাড়ে বোন নেই। পুকুরের মাঝখানে একটা ছোট্ট আলোড়ন উঠছে। দুটো ছোট্ট চুড়ি পরা হাত জলের উপর জেগে উঠল। তারপর আবার ডুবে গেল।
বিরাজবাবু আর থাকতে পারলেন না। লাফিয়ে ওই জলে ঝাঁপ দিলেন। জলে পড়ার আগে শুধু নবীনের কাতর স্বর শুনতে পেলেন, “এটা আপনি কী করলেন স্যার?”
***
ছোটো ছেলে বলল, “বাবা ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন। মনে হচ্ছে মৃত্যুর সময় ব্রাহ্মমুহূর্ত। বাবা বেশ ভালো সময়েই গেলেন।”
এ-বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে দেখল, আশ্চর্য প্রশান্ত মুখ, শুধু হাত দুটো মুঠো করা। কী যেন শক্ত করে ধরে রয়েছেন।
ঘণ্টা তিনেক পরে বিরাজবাবুকে খাট থেকে নামিয়ে ‘পিস হ্যাভেন’-এর গাড়িতে তোলা হল। বিদেশ থেকে দুই ছেলে আসতে দু-দিন দেরি হবে। ছোটো মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে গিয়েছে।
ছোটো নাতি বলল, “একটু দাঁড়াও, দাদুর বালিশটা নিয়ে আসি। সে ঘরে ঢুকে গেল বালিশ আনতে।”
বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সে অবাক হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে একটা নীল রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। এমন অদ্ভুত নীল রঙের প্রজাপতি সে আগে কখনও দেখেনি। তাকে দেখে প্রজাপতিটা বারান্দার দিকে উড়ে গেল। তারপর বারান্দা ছাড়িয়ে নীল আকাশের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ছবি- মৌসুমী
Ohh! Ki sanghatik!😯
Asadharan vabna !
Ei abegtai jeeban !!
Khub nar die diechhen !
LikeLike