বিদেশি গল্প-বাজি- আন্তন চেকভ- অনু:দেবজ্যোতি বল্লভ-বসন্ত ২০২১

শরতের এক তমসাচ্ছন্ন রাত্রি। বৃদ্ধ ব্যাঙ্কার তাঁর স্টাডিতে পায়চারি করতে করতে পনেরো বছর আগে এরকমই এক শরতের সন্ধ্যায় তাঁর দেওয়া পার্টির কথাই ভাবছিলেন। অনেক বিচক্ষণ লোকের সমাগম হয়েছিল সে দিনটায়। অনেক আকর্ষণীয় বিষয়ে কথাও হচ্ছিল। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে একসময় মৃত্যুদণ্ডের প্রসঙ্গ উঠে এল। অতিথিদের একটা বড়ো অংশ—যাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীও ছিলেন—মৃত্যুদণ্ডের ঘোরতর বিরোধিতা করলেন। তাঁদের মতে এধরনের শাস্তি সেকেলে, অনৈতিক এবং খ্রিস্টান রাষ্ট্র সমূহের অনুপযুক্ত। তাঁদেরই কেউ কেউ আবার মনে করেন, সর্বত্রই মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া উচিত।

“আমি তোমার সঙ্গে একমত নই।” বললেন গৃহকর্তা ব্যাঙ্কার মহাশয়, “আমি যদিও মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দুটোর একটাও পরখ করিনি, তবুও অগ্রাধিকার বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের চেয়ে মৃত্যুদণ্ড অনেক বেশি নৈতিক ও মানবিক। মৃত্যুদণ্ড একজন মানুষকে এক মুহূর্তে মৃত্যু দেয়, কিন্তু সারাজীবন কারাবাসে তাকে তিলে তিলে মরতে হয়। কোন জল্লাদ বেশি মানবিক শুনি, যে মুহূর্তে মৃত্যু দেয়, নাকি যে বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়?”

“দুটোই সমান অনৈতিক।” বললেন একজন অতিথি, “কারণ, দুটোরই লক্ষ্য একটাই—জীবননাশ। রাষ্ট্র ভগবান নয়। তাই তার এমন কিছু কেড়ে নেওয়ার অধিকার নেই যা সে কখনোই ফিরিয়ে দিতে পারবে না।”

অতিথিদের মধ্যে ছিল একজন তরুণ উকিল। বছর পঁচিশের এক যুবক। এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হলে সে বলল, “মৃত্যুদণ্ড আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সমান অনৈতিক, কিন্তু আমাকে যদি দুটোর একটাকে বেছে নিতে বলা হত, আমি নিঃসন্দেহে দ্বিতীয়টাই বেছে নিতাম। একেবারে মরে যাওয়ার চেয়ে কোনোক্রমে বেঁচে থাকাও শ্রেয়।”

এক প্রাণবন্ত আলোচনা শুরু হয়ে গেল। তখনকার সেই তরুণ, নার্ভাস ব্যাঙ্কার মহাশয় হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে টেবিল চাপড়ে যুবকের প্রতি চিৎকার করে উঠলেন, “এটা কখনোই সত্যি নয়। আমি তোমার সঙ্গে দু-কোটির বাজি ধরতে রাজি আছি, তুমি কখনোই নির্জন কারাবাসে পাঁচবছরও থাকতে পারবে না।”

“আপনি যদি একান্তই এটা মনে করে থাকেন,” যুবকটি বলল, “তবে আমি আপনার বাজি মেনে নিলাম, কিন্তু পাঁচ নয়, পনেরো বছর ধরে থাকতে আমি রাজি আছি।”

“পনেরো? তাই হোক!” বললেন ব্যাঙ্কার, “ভদ্রমহোদয়গণ, আমি দু-কোটির পণ রাখলাম।”

“রাজি! আপনার পণ আপনার টাকা, আর আমার পণ আমার স্বাধীনতা।” বলল যুবক।

এইভাবে এক উন্মত্ত, অনর্থক বাজি ধরা হল।

ব্যাঙ্কার, যিনি তাঁর হিসেবের বাইরে অনেক টাকাই বাজে নয়ছয় করেন, তিনি বাজি ধরে যারপরনাই খুশি হলেন। নৈশাহারের সময় তিনি যুবককে নিয়ে মজা করে বললেন, “ইয়ং ম্যান, এখনো সময় আছে ভালো করে ভেবে নাও। আমার কাছে দু-কোটি নস্যি, কিন্তু তুমি তোমার জীবনের মূল্যবান তিন-চারটি বছর হারাবে। তিন-চার বছর বললাম কারণ, তুমি তার বেশি থাকতে পারবে না। এও ভুলে যেও না যে স্বেচ্ছায় কারাবাস বাধ্য হয়ে থাকার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। যে-কোনো মুহূর্তেই তুমি মুক্তি পেতে পার—এই চিন্তা জেলে তোমার সমস্ত সত্ত্বাকে বিষিয়ে তুলবে। আমি তোমার জন্য সত্যিই দুঃখিত।”

পায়চারি করতে করতে ব্যাঙ্কার মহাশয় সবকিছু মনে করতে লাগলেন। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ‘এই বাজির অর্থ কী? সেই মানুষটার পনেরোটা বছর নষ্ট করে আর আমার দু-কোটি ছুড়ে ফেলে দিয়েই-বা কী লাভ হল? এটা কি প্রমাণ করতে পারল, মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের চেয়ে ভালো না মন্দ? না! না, সবটাই আজেবাজে, অর্থহীন। আমার পক্ষ থেকে এ শুধুই জেদের আবদার আর তার ক্ষেত্রে স্রেফ টাকার লোভ…’

অতঃপর সেই সন্ধ্যায় কী ঘটেছিল তা মনে পড়ল।

এরপর ঠিক হল, সেই যুবক ব্যাঙ্কারের বাগানেরই একটি লজে কঠোর নজরদারিতে এই বছরগুলো কাটাবে। ঠিক হল যে এই পনেরো বছর সে লজের চৌকাঠ পেরোতে পারবে না। কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা করতে অথবা কথা বলতে পারবে না এবং খবরের কাগজ, চিঠি—কিছুই পাবে না। তবে সে গানবাজনা করতে, বই পড়তে পারবে এবং মদ্যপান, ধূমপান করতে ও চিঠি লিখতে পারবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তার সঙ্গে বাইরের জগতের যোগাযোগ থাকবে শুধু একটা জানালার দ্বারা যেটা এই বিশেষ উদ্দেশ্যেই তৈরি। চুক্তির ভিত্তিতে এই সকল বিশদ ও খুঁটিনাটি বাদে তার কারাবাস হবে কঠোরভাবে নির্জন। ১৫ই নভেম্বর, ১৮৭০ সালের ঠিক ১২টা থেকে পরবর্তী পনেরো বছর তাকে বন্দি থাকতে হবে। এক্ষেত্রে শর্ত ভাঙার ন্যূনতম প্রচেষ্টা করলেই ব্যাঙ্কার মহাশয় পণ-বাবদ দু-কোটি টাকা দিতে বাধ্য থাকবেন না, তা সে নির্দিষ্ট সময়ের দু-মিনিট আগে হলেও নয়।

তার (অর্থাৎ যুবকের) সংক্ষিপ্ত নোট থেকে জানা যায়, প্রথম বছরটা সে অত্যন্ত একাকিত্বে আর হতাশায় ডুবে গিয়েছিল। লজ থেকে রাত-দিন সারাক্ষণ পিয়ানো শোনা যেত। তবে তামাক আর মদ সে প্রত্যাখান করল। সে লিখেছিল, মদ আকাঙ্ক্ষাকে উত্তেজিত করে, আর এই বাসনাই একজন বন্দির সবচেয়ে বড়ো রিপু। তাছাড়া উত্তম মদ্যপানের সময় কারো সাক্ষাৎ না পাওয়ার মতো হতাশাজনক আর কিছু নেই। আর তামাকের ধোঁয়া ঘরের বাতাস বড়ো দূষিত করে।

প্রথম বছরে সে হালকা ধরনের কিছু বই চাইল—ওই জটিল প্রেমের উপন্যাস, রোমাঞ্চকর চমৎকার গল্প, এইসব।

দ্বিতীয় বছরে পিয়ানোর আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল আর কয়েদি শুধু ধ্রুপদী সাহিত্যের বই চাইল।

পঞ্চম বর্ষে আবার গান শোনা গেল, আর বন্দি মদ খেতে চাইল। যারা তার ওপর সেই জানালা দিয়ে নজর রাখত, তারা বলেছিল যে সেই বছরটা সে কেবল মদ্যপান করে, খেয়ে আর বিছানায় শুয়ে কাটাত। আর মাঝেসাঝে হুটোপাটি করে নিজের সঙ্গে রেগেমেগে কথা বলত। মাঝেমধ্যে রাত্রে সে লিখতে বসত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখেই চলত আর সকালে সে-সব লেখা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিত। একাধিকবার তাকে কাঁদতেও শোনা গেছে।

ষষ্ঠ বর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে বন্দি সোৎসাহে ভাষা, দর্শন ও ইতিহাস পড়তে শুরু করে। সে নিজেকে এইসব পড়াতে এতটাই ডুবিয়ে দিয়েছিল যে ব্যাঙ্কারকে তার প্রয়োজনমাফিক বই জোগাড় করতে বেশ বেগ পেতে হত। চার বছরে প্রায় ছ’শো ভল্যুম বই তার জন্য আনানো হয়। এই সময়েই ব্যাঙ্কার মহাশয় নিম্নলিখিত চিঠিখানি বন্দির কাছ থেকে পান—

‘প্রিয় জেলার মহাশয়,

আমি আপনাকে এই লাইনগুলো ছ’টি ভাষায় লিখছি। এটা ভাষাবিদদের দেখান। তাঁদের পড়তে বলুন। তাঁরা যদি একটিও ত্রুটি না পান তবে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনি আপনার বাগানে একবার একটি গুলি ছুড়বেন। তাহলে আমি বুঝব আমার প্রচেষ্টা বিফল হয়নি। যুগ যুগ ধরে প্রতিভাধরেরা নানা ভূখণ্ডে নানা ভাষায় কথা বলে গেছেন, কিন্তু একটাই অনির্বাণ অগ্নি তাঁদের সকলের মধ্যে প্রজ্বলিত ছিল। ওহ্‌, আপনি যদি জানতেন যে সে-সব বুঝতে পেরে আমার আত্মা কী এক অপার্থিব আনন্দ অনুভব করছে!’

কয়েদির ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। ব্যাঙ্কার বাগানে দুটো গুলি ছুড়েছিলেন।

দশম বর্ষের পর কয়েদি টেবিলে ঠায় বসে বসে শুধু দেববাণী (Gospel) পড়ে কাটাত। ব্যাঙ্কার আশ্চর্য হলেন। যে ব্যক্তি চার বছরে ছ’শো বই পড়ে আয়ত্ত করেছিল, সে এই পাতলা সহজবোধ্য বইটার পেছনে প্রায় একবছর নষ্ট করল!

দেববাণীর পরে এল ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মেতিহাস সংক্রান্ত বই।

কারাবাসের শেষ দু-বছর বন্দি বাছাবাছি না করে অজস্র বই পড়ে ফেলল। এই সে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত তো পরক্ষণেই সে বায়রন, শেক্সপিয়র চেয়ে পাঠাল। নোট করা আছে যে সেই সময় সে একই সঙ্গে রসায়নের বই, ওষুধের ম্যানুয়ালের সঙ্গে একটি উপন্যাস ও বেশ কিছু দর্শন বা ধর্মতত্ত্ব সংক্রান্ত গ্রন্থ চেয়ে পাঠিয়েছিল। তার এই পড়াশোনা যেন অতল সমুদ্রে জাহাজের ধ্বংসস্তূপে ভাসমান এক ব্যক্তির খড়কুটো ধরে বাঁচবার প্রয়াস।

এই সবকিছুই ব্যাঙ্কারের এক এক করে মনে আসছিল। তিনি ভাবলেন, কাল বারোটায় সে মুক্তি পাবে। আর শর্ত অনুযায়ী আমাকে দু-কোটি টাকা দিতে হবে। আর তা হলেই আমি নিঃশেষ হয়ে যাব, সব শেষ হয়ে যাবে।

পনেরো বছর আগে কোটি টাকা তাঁর কাছে কিছুই ছিল না, কিন্তু এখন তাঁর ধার বেশি না সঞ্চয়—এটা ভেবেই তাঁর ভয় হয়। স্টক এক্সচেঞ্জে মরিয়া হয়ে জুয়াখেলা, উন্মাদ জল্পনা আর উত্তেজনার ফলে সামনের বছরগুলোতে তাঁর অবস্থা পড়ে গেছে। একসময়ের সেই গর্বিত, নির্ভীক, আত্মবিশ্বাসী কোটিপতি এখন বিনিয়োগের প্রতিটি ওঠানামায় চঞ্চল এক সাধারণ মধ্যবিত্ত ব্যাঙ্কারে পরিণত হয়েছেন।

“অভিশপ্ত বাজি!” হতাশায় মাথা চাপড়ে বললেন বৃদ্ধ, “লোকটা মরে গেল না কেন? সে এখন সবে চল্লিশ। আমার শেষ কপর্দকও তার হস্তগত হবে, সে বিয়ে করবে, ফুর্তি করবে, জুয়া খেলবে আর আমি ভিখিরির মতো ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরব। আর সে রোজ বলবে, ‘আমার জীবনের সুখের জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, বলো কী সাহায্য করতে পারি!’ না, এ হতে পারে না। একটাই মাত্র উপায় আছে এই মর্যাদা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার থেকে বাঁচবার, সে-লোকের মৃত্যু।”

রাত তিনটে বাজল। ব্যাঙ্কার শুনল। বাড়ির সবাই ঘুমে অচেতন। বাইরের ঠান্ডায় গাছগুলোর খসখস শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কোনোরকম শব্দ না করে ফায়ার প্রুফ সিন্দুক থেকে সে একটি দরজার চাবি বের করল, যে দরজা গত পনেরো বছর ধরে একবারও খোলা হয়নি। তারপর ওভার-কোট পরে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে এল।

বাগানটা ঠান্ডা আর অন্ধকার। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। একটা স্যাঁতস্যাঁতে তীক্ষ্ণ বাতাস বাগানময় আর্তনাদ করে বেড়াচ্ছে। গাছগুলোর যেন বিরাম নেই। ব্যাঙ্কার চোখ কোঁচকালেন, কিন্তু অন্ধকারে মাটি, সাদা স্ট্যাচু, লজ, গাছ কিছুই ঠাহর করতে পারলেন না। লজ যেখানে ছিল, সেই জায়গায় গিয়ে তিনি দু-বার চৌকিদারকে ডাকলেন। কিন্তু কোনো উত্তর এল না। নিশ্চয়ই সে এই ঝঞ্ঝাতে একটা আশ্রয় খুঁজে নিয়ে রান্নাঘরে অথবা গ্রিন হাউসে—কোথাও একটা ঘুমোচ্ছে।

যদি আমার উদ্দেশ্য সফল হয়, ভাবলেন বৃদ্ধ, তবে প্রথম সন্দেহ চৌকিদারের ওপরেই এসে পড়বে। তিনি সিঁড়ি আর দরজা অন্ধকারে হাতড়ে লজে প্রবেশ করলেন। তারপর একটা ছোটো প্যাসেজ পেরিয়ে একটা দেশলাই জ্বাললেন। কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই। খাটে শয্যা পাতা হয়নি। কোণের কাছে একটা কালো কাস্ট-আয়রনের স্টোভ রয়েছে। বন্দির ঘরের দরজার সিল অটুট।

দেশলাই নিভে যাওয়ার পর দুরু দুরু বুকে কাঁপতে কাঁপতে বৃদ্ধ ছোট্ট জানালাটা দিয়ে উঁকি মারলেন। কয়েদির ঘরে একটা মোমবাতি ম্লানভাবে জ্বলছে। সে টেবিলের সামনে বসে আছে। তার হাত, মাথার চুল আর পিঠের দিকটা শুধু দেখা যাচ্ছে। টেবিলে, আরামকেদারায় আর টেবিলের সামনে কার্পেটে যত্রতত্র বই ছড়ানো।

পাঁচ মিনিট কেটে গেল, কিন্তু কয়েদি একবারও নড়ল না। পনেরো বছরের কারাবাস তাকে স্থির হয়ে বসতে শিখিয়েছে। ব্যাঙ্কার জানালায় মৃদু করাঘাত করলেন। কিন্তু উত্তরে বন্দির কোনো নড়াচড়া দেখা গেল না। অতঃপর ব্যাঙ্কার সন্তর্পণে সিল ভেঙে গর্তে চাবি ঢোকালেন। মরচে ধরা তালায় একটা কর্কশ শব্দ করে দরজাটা ক্যাঁচ করে খুলে গেল। ব্যাঙ্কার ভেবেছিলেন হয়তো কোনো পদশব্দ অথবা বিস্ময়সূচক কিছু শুনতে পাবেন, ।কিন্তু তিন মিনিট হয়ে গেল, ঘর আগের মতোই নিশ্চুপ। তিনি ভেতরে যাওয়া মনঃস্থির করলেন।

টেবিলের কাছে একটা লোক নিশ্চলভাবে বসে। সাধারণ মানুষের থেকে একেবারে আলাদা। অস্থিচর্মসার দেহ। যেন হাড়ের ওপর চামড়া লাগনো। মেয়ে মানুষের মতো লম্বা ঝাঁকড়া চুল আর এক মুখ খোঁচা খোঁচা রুক্ষ দাড়ি। তার মুখ হলদেটে মাটি-মাটিমতো, গাল তোবড়ানো, পিঠটা দীর্ঘ শীর্ণকায়। আর কেশাবৃত মাথাটা যে হাতে ঝুঁকে আছে সেটা এতটাই সরু ও পলকা যে দেখলে ভয় করে। তার চুলে এখনই পাক ধরেছে। এই কৃশ বুড়োটে মুখ দেখে কেউ বলবে না যে তার বয়স মাত্র চল্লিশ। সে ঘুমোচ্ছে। তার নুয়ে পড়া মাথার কাছে টেবিলের উপর একটা কাগজ। তাতে মুক্তোর মতো হাতের লেখায় কিছু লেখা।

বেচারা! ব্যাঙ্কার ভাবলেন, ও ঘুমোচ্ছে আর সম্ভবত কোটি টাকার স্বপ্ন দেখছে। আর আমাকে শুধু এই আধমরা লোকটাকে বিছানায় ফেলে বালিশ দিয়ে কিছুক্ষণ শ্বাসরোধ করতে হবে। ব্যস! সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ ধুরন্ধরও কোনো চিহ্ন খুঁজে পাবে না। তবে তার আগে দেখি কী লিখেছে।

ব্যাঙ্কার টেবিল থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন—

‘কাল বারোটায় আমি মুক্তি পাব, আর সবার সঙ্গে দেখা করতে পারব। তবে এই ঘর ছেড়ে সূর্যালোক দেখার আগে আমি মনে করি আপনাকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। সম্পূর্ণ সজ্ঞানে আমি আপনার ও যিনি আমায় দেখেন সেই ঈশ্বরের কাছে বলতে চাই যে এই স্বাধীনতা, জীবন, স্বাস্থ্য এসবকে আমি অবজ্ঞা করি। আর জগতের যা কিছু ভালো, সব আপনার ওই বইগুলোর মধ্যে আছে বলে মনে করি।

‘পনেরো বছর ধরে এই পার্থিব জীবন নিয়ে আমি স্বেচ্ছায় অধ্যয়ন করেছি। এটা সত্যি যে আমি এ পৃথিবী, মানুষ কিছুই দেখিনি, কিন্তু আপনার বইগুলির মধ্যে আমি সুবাসিত সুরাপান করেছি, গান গেয়েছি, জঙ্গলে হরিণ, বুনো শুয়োর শিকার করেছি, রমণীকে ভালোবেসেছি। আপনাদের কবিদের জাদুসৃষ্ট মেঘের ন্যায় গগনবিহারী সুন্দরী রাত্রে আমার কাছে এসেছে। ফিসফিসিয়ে কানে কানে গল্প বলেছে। মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলেছে। আপনার বইয়ের মধ্যে আমি এলবুর্জ, মঁব্লাঁ চড়েছি। সেখান থেকে সূর্যোদয় দেখেছি, অপরাহ্নে আকাশ, সমুদ্র, পর্বত-শিখর রক্তিম সোনালি আলোর বন্যায় ভাসতে দেখেছি। মাথার উপর মেঘভাঙা বিদ্যুতের ঝিলিক দেখেছি। কত সবুজ অরণ্য, মাঠ, নদী, হ্রদ, শহর দেখেছি। সাইরেনের আওয়াজ শুনেছি। রাখালের বাঁশি শুনেছি। আমি সুন্দরী পরিদের ডানা স্পর্শ করেছি, যারা আমার কাছে নেমে এসেছিল ঈশ্বরের কথা বলতে। বইয়ের মধ্যে আমি নিজেকে গভীর কূপে নিক্ষেপ করেছি, আলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছি, হত্যা করেছি, শহর জ্বালিয়েছি, নতুন ধর্ম প্রচার করেছি, সাম্রাজ্য জয় করেছি।

‘আপনার বইগুলি আমায় দিয়েছে প্রজ্ঞা। যুগ যুগ ধরে মানুষের অশান্ত চিন্তারাশি আমার মস্তিষ্ক কুঠুরিতে সংকুচিত হয়ে রয়েছে। আমি জানি আমি আপনাদের সবার থেকে বিজ্ঞ।

‘আর তাই আমি আপনার বইগুলিকেও অবজ্ঞা করি। অবজ্ঞা করি প্রজ্ঞা ও এ জগতের যাবতীয় আশীর্বাদকে। এগুলো সব অন্তঃসারশূন্য, মরীচিকার মতোই অলীক, ক্ষণস্থায়ী, বিভ্রান্তিকর। হতে পার তুমি উদ্ধত দম্ভী, জ্ঞানী এবং সুন্দর, কিন্তু মৃত্যু এই পৃথিবী বুক থেকে তোমায় মুছে দেবে মাটির নীচে, ইঁদুরের গর্ত ভিন্ন কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তোমার ভাবী বংশধর, তোমার ইতিহাস, তোমার অমর প্রতিভা সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে অথবা এই পার্থিব গোলকের সঙ্গে বরফে পরিণত হবে।

‘আপনি আপনার যুক্তিবোধ জলাঞ্জলি দিয়েছেন এবং ভুল পথ বেছে নিয়েছেন। সত্যের বদলে মিথ্যাকে গ্রহণ করেছেন। সৌন্দর্যের বদলে ঘৃণা। আপনি বিস্মিত হবেন যদি অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটে, আপেল ও কমলালেবু গাছে যদি ব্যাঙ-টিকটিকি ফলতে শুরু করে, গোলাপ যদি ঘেমো ঘোড়ার মতো গন্ধ ছড়ায়। তেমনি আমিও অবাক হচ্ছি আপনাকে দেখে যে স্বর্গের বদলে মর্ত্যকে বেছে নিয়েছে। আমি আপনাকে বোঝাতে চাই না।

‘তাই আপনার সকল ঐহিক সম্পদের প্রতি আমার অবজ্ঞা হাতেনাতে প্রমাণ করতে আমি আপনার দু-কোটি টাকা ত্যাগ দিলাম যা নিয়ে একসময় স্বর্গের স্বপ্ন দেখতাম এবং এখন যেগুলোকে আমি ঘৃণা করি। অর্থের অধিকার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে আমি সময়ের পাঁচ ঘণ্টা আগে শর্ত লঙ্ঘন করে বেরিয়ে যাব…’

ব্যাঙ্কার পড়া শেষ করে কাগজটা টেবিলে রেখে দিলেন। তারপর এই অদ্ভুত মানুষটির মাথায় চুম্বন করে কাঁদতে কাঁদতে লজ থেকে বেরিয়ে গেলেন। এর আগে স্টক এক্সচেঞ্জে সাংঘাতিকরকম খুইয়েও এরকম গভীর অবমাননা তিনি কখনো ভোগ করেননি। ঘরে গিয়ে তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কিন্তু আবেগে, কান্নায় তাঁর দু-চোখের পাতা এক হল না।

পরদিন সকালে চৌকিদার বিবর্ণ মুখে এসে বলল, লজের লোকটি জানালায় চড়ে বাগানে নেমে গেট দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ব্যাঙ্কার তৎক্ষণাৎ চাকরকে নিয়ে লজে গেলেন বন্দির নিরুদ্দেশ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। আর অযথা কোনো বাক্যব্যয় না করে তিনি লেখাটা তুলে নিলেন যাতে কোটি টাকা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং বাড়ি ফিরে ফায়ার প্রুফ সিন্দুকে চাবি দিয়ে সেটা রেখেদিলেন।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s