সূর্যনাথ ভট্টাচার্যের আগের গল্প- ছায়াকল্প, সেই অদ্ভুত লোকটি
জায়গার নামটা আর মনে নেই। বাকি সবকিছু মনে আছে, কিন্তু ছবির মতো। ভুলতে পারিনি।
অনেকদিন আগের কথা, প্রায় বিশ বছর হবে। দক্ষিণবঙ্গের ওই গণ্ডগ্রামটায় যেতে হয়েছিল কলকাতা পুলিশের নির্দেশে। না, কোনও অপরাধ করে নয়, সরকারি ডাক্তারের দায়িত্ব পালন করতে। গোসাবা থেকে প্রায় বাইশ মাইল বাসে যেতে হয়, ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। একটা থানা, একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটা বাজার আর প্রাথমিক স্কুলের নামে একটা ভাঙা বাড়ি নিয়ে জনা পঞ্চাশ ঘর বাসিন্দা এই প্রত্যন্ত গ্রামখানায়। কয়েকজন বর্ধিষ্ণু কৃষক অবশ্য আছেন, আর আছে কিছু পরিবার যাদের জীবিকা নির্বাহ হয় কলকাতা ও শহরতলির কারখানায় কাজ করে। তাদের বাড়িতেই শুধু বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। বাকি সবই স্থানীয় উপজাতি। কিছু বহিরাগত আদিবাসীও এসে বসে গেছে। শিক্ষা অথবা বিদ্যুৎ—কোনও আলোই সেখানে পৌঁছয়নি। শিকার, মৎস্য ও অন্যান্য বনজ উৎপাদনই তাদের উপজীবিকা।
ওখানকার থানার দারোগা জনার্দন সাহা থাকেন গোসাবায়, রোজ যাতায়াত করেন। জিপ পাঠিয়েছিলেন আমাকে বাস-স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে যেতে। ড্রাইভার ছোকরা আদিবাসী, কিন্তু টেনে টেনে বেশ বাংলা বলে এবং কথা বলতে ভালোও বাসে। তার কাছ থেকেই পথে যেতে যেতে শুনছিলাম তাদের গ্রামের কথা।
তখন সেখানে একটাই চাঞ্চল্যকর খবর। আগের সপ্তাহে গ্রামের লাগোয়া জলাজঙ্গলে পাওয়া গেছে একটা মৃতদেহ। জলজ গুল্মের মাঝে আটকে ছিল। মৃতদেহটা বেশ পুরোনো, জলে ভিজে ফুলে ঢোল, পচে-গলে চেনবার বিশেষ উপায় নেই। কিন্তু গ্রামের কেউ কেউ সন্দেহ করেছে, সেটা ওখানকারই বাসিন্দা পুস্তম সোতি নামে এক শবরের। পুস্তম প্রায় মাস ছয়েক হল নিরুদ্দেশ। পরনের মেরুন রঙের পোশাকের অবশিষ্টাংশ থেকে গ্রামবাসীরা আন্দাজ করছে সেই হয়তো পুস্তম।
পুস্তম নিরুদ্দিষ্ট হতে তার পরিচিত জনাকয়েক পুলিশে একটা রিপোর্ট দাখিল করেছিল এবং যেহেতু সেই কেসের এখনও কোনও কিনারা হয়নি, তাই এই মৃতদেহটার একটা অটোপ্সি করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেহটার অবস্থা এতই খারাপ ছিল, যে সেটা কলকাতা এমনকি গোসাবাতেও স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয়নি। জনার্দন সাহা উদ্যোগী হয়ে কলকাতার কোনও ফরেন্সিক ল্যাব মারফত এক বিশেষজ্ঞের ওখানে গিয়ে মতদান নেবার ব্যবস্থা করেন। সেই সূত্রেই আমার এখানে আসা।
থানায় যখন পৌঁছলাম তখন বেলা দশটা। আগের দিন আমার হাসপাতালে বেশ চাপ ছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়েছে। তারপর রাতের ঘুম নষ্ট করে এসেছি। বেশ ক্লান্তি লাগছিল। জনার্দন সাহা জানালেন, কাজ তো বেশিক্ষণের নয়। নেহাতই ফর্মালিটি, না করলেই নয়, তাই আমাকে কষ্ট দিতে হয়েছে। আমাকে সান্ত্বনা দিতেই যেন বললেন, “কিচ্ছু ভাববেন না স্যার, দুপুরের মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে। পুলিশ গেস্ট হাউসে বুকিং করা আছে। ওখানকার কুক ভবানীচরণ উড়িষ্যার লোক, খাসা রাঁধে। আরামে লাঞ্চ আর ডিনার করুন স্যার। রাতটা কাটিয়ে সকালের বাসেই ড্যাং ড্যাং করে ফিরে যেতে পারবেন।”
কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, সত্যিই আমার বিশেষ কিছু করার ছিল না। আমি জীবনে অনেক মড়া কেটেছি, কিন্তু এরকম বীভৎসভাবে বিকৃত দেহ কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। মানুষের দেহ বলে চেনার উপায় আর নেই বললেই চলে। অল্পসময়েই কোনও কিছুই সনাক্তকরণ সম্ভব নয় বলে রিপোর্ট তৈরি করে দিলাম।
জনার্দন সাহা আমাকে গেস্ট হাউসে নামিয়ে দিয়ে আমায়িক হেসে বললেন, “সামান্য কারণে আপনাকে এতখানি উত্যক্ত করে কী যে লজ্জা করছে। যাক, এখন রেস্ট করুন স্যার। সন্ধের সময় একটু দূরে একটা মেলা বসেছে। জিপ পাঠিয়ে দেব, দেখে আসবেন স্যার। এছাড়াও আর কিছু দরকার পড়লে দারোয়ান মুর্মু আছে, ওকে দিয়ে থানায় খবর পাঠাবেন স্যার।”
জনার্দনের আতিথেয়তার কোনও তুলনা নেই, কিন্তু প্রতি কথার আগে স্যার আর পরে স্যার শুনতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। তবে হ্যাঁ, অতিথি ভবনে ঢুকে সত্যিই যেন শরীরের অর্ধেক ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।
জঙ্গলের মাঝে ছবির মতো গেস্ট হাউস, নাম সন্ধ্যাতারা। উঁচু উঁচু ছাদের পুরোনো সাহেবি কায়দার বাড়ি। ভিতরটা শামশীতল, শরীর মন জুড়িয়ে যায়। স্নান সেরে লাঞ্চের টেবিলে এসে দেখি খাওয়ারও দিব্যি ব্যবস্থা। সরু চালের ভাত, সোনা মুগের ডাল, আলুভাজা ছাড়াও চাররকম মাছের পদ। শেষে চিনিপাতা সাদা দই আর মাখা সন্দেশ। দেখা গেল সূপকার ভবানীচরণ বেশি কথা বলে না বটে, কিন্তু তার হাত বলে। এত ভালো ভাপা ইলিশ আগে কখনও খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অনেক চেষ্টা করেও গুরুভোজন এড়ানো গেল না।
দুপুরের বাকিটা একটু বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে যখন উঠলাম, গুরুভোজন দিব্যি নেমে গিয়ে দেখি শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। ঘণ্টা কয়েক আগের সেই বীভৎস দৃশ্যের স্মৃতিও যেন ফিকে হয়ে এসেছে। বাইরে হেমন্তের দিন শেষে পড়ন্ত রোদের মরা আলো। দেখলাম দুপুরের আতপ আর নেই, হাওয়ায় বেশ একটা তরতাজা শীতের আমেজ। একটা চাদর জড়িয়ে বাগানে এসে বসলাম।
এখনও জিপ এসে পৌঁছয়নি। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতে পেলাম শুধু সবুজের সমারোহ। শহুরে যান্ত্রিকতামুক্ত মন আপনা থেকেই কাব্যিক হয়ে পড়ে। আর একটু হলেই একটা গানের কলি মুখে এসে গেছিল, হঠাৎ দেখি কোথা থেকে একটা আট-ন’বছরের ফুটফুটে মেয়ে আমার পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
গেস্ট হাউসে আরও যে অতিথি এসে থাকতে পারে প্রথমটা সেটা ধরতে পারিনি। একটু চমকেই গিয়েছিলাম। মেয়েটাকে বললাম, “তুমি কোথা থেকে এসেছ খুকি?”
মেয়েটা কথা না বলে হাতটা পিছন দিকে ঘুরিয়ে যে দিকটা নির্দেশ করল তা সম্পূর্ণ উত্তর গোলার্ধের মাঝে যে-কোনো জায়গাই হতে পারে। ভালো করে দেখলাম ওর রংটা একটু চাপা, কিন্তু মুখের গড়ন যেন পটে আঁকা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম কী খুকি?”
এবারেও কোনও উত্তর এল না। মাথা নীচু করে মেয়েটা ততক্ষণে একমনে তার ফ্রকের লাল ফিতেটা নিরীক্ষণ করছে। ভাবলাম কে জানে, কথা বলতে পারে তো? আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “তুমি কথা বলতে পার তো? তোমার সঙ্গে কে কে আছেন?”
“তুমি কি আমার বাবাকে দেখেছ?”
ওকে প্রশ্ন করেছিলাম বটে কিন্তু যেন ধরেই নিয়েছিলাম উত্তর পাব না। তাই হঠাৎ যখন ও কথা বলল… ও-ই কথা বলল কি? নিশ্চয়ই তাই, কিন্তু যেন মনে হল অনেক দূর থেকে আওয়াজ ভেসে এল!
ওর ম্লান মুখটা দেখে খুব খারাপ লাগছিল। বাবা বোধ হয় ওকে না জানিয়ে কোথাও গেছে, বেচারা তাই বাবাকে খুঁজছে। ওর প্রশ্ন শুনে আবার একটু ভালোও লাগল, যাক, রাত্তিরে তাহলে আর একলা থাকতে হবে না। মনে হয় পুরো পরিবারই এসেছে। বেশ একসঙ্গে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা মারা যাবে। কে কে এসেছে জেনে নিতে জিজ্ঞেস করলাম, “আর কে কে আছে তোমার সঙ্গে খুকি?”
“আর কেউ না, নমস্কার।”
এবার উত্তরটা এল আমার পিছন দিক থেকে। এত কাছাকাছি আরও কেউ এসে পড়েছে বুঝতেই পারিনি। চকিতে ঘুরে দেখি, পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত এক সুদর্শন যুবক আমাকে দেখে হাত জড়ো করে অভিবাদন জানাচ্ছে। শ্যামকৃষ্ণ সুঠাম চেহারা। আমার চেয়ে বয়স নিশ্চয়ই কম, তাও তাড়াতাড়ি প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললাম, “নমস্কার। মাফ করবেন, আপনাকে ঠিক খেয়াল করিনি। আপনিই কি ওর বাবা?”
ভদ্রলোক অনুমোদনসূচক মাথা নেড়ে বললেন, “আমরা দুজনই। ওর মা তো অনেকদিন হল নেই। ও হবার বছর খানেক পরেই চলে গেছে।”
মনের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগল। এই ফুলের মতো বাচ্চাটা মাতৃহারা! হঠাৎ কী বলব বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোকই বললেন, “এখন আমিই ওর বাবা, আবার আমিই ওর মা।”
“কী নাম আপনার মেয়ের?”
“কপালি।”
কপালি! এ আবার কেমন নাম? আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “কী বললেন, কপালি?”
“না না কপালি নয়, রূপালী। ওর নাম রূপালী। একসঙ্গে বাপ-বেটি বেশ আছি, খাই দাই ঘুরে বেড়াই।”
তাই বলি। এমন ফুটফুটে মেয়ের অমন অদ্ভুত নাম হয় কী করে! আমিই শুনতে ভুল করেছিলাম।
ভদ্রলোক তারপর অনেক কথা বলতে লাগলেন, সবই প্রায় নিজের কন্যার সম্বন্ধে। স্ত্রীর কথাও বললেন, কিন্তু দেখলাম মেয়েকে পেয়ে স্ত্রীবিয়োগের শোক প্রায় ভুলেই গেছেন। বলতে বলতে ওঁর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে একটা চাপা উৎকণ্ঠাও যেন অনুভব করছিলাম। তাঁর মেয়ে কী চায়, কী খেতে ভালোবাসে, কত গুণের এইসব বলতে বলতে জানালেন, “মেয়ে আমার এই বয়সেই এমন গিন্নি হয়ে উঠেছে, কী বলি। এখন আমাকে রান্না করেও খাওয়ায়।” তার পরেই মাথা বাড়িয়ে আমার পিছন দিকে দেখে হঠাৎ বলে উঠলেন, “আরে, কপালি কোথায় গেল? কপালি-ঈ-ঈ?”
ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে ছুটলেন মেয়েকে খুঁজতে। কথায় কথায় আমিও খেয়াল করিনি, পিছন ফিরে সত্যিই মেয়েটিকে আর দেখতে পেলাম না। নিশ্চয়ই কোনও গাছের আড়ালে, নয়তো গেস্ট হাউসের অন্যদিকে চলে গেছে। ভদ্রলোকের উৎকণ্ঠা একটু অতিরিক্তই বোধ হল। অবশ্য মা-হারা কন্যার প্রতি স্নেহটা অতিরিক্ত হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু আবারও কি ভুল শুনলাম? মনে হল ভদ্রলোক যেন পরিষ্কার কপালিই বললেন।
ওদিকে জিপ এসে গিয়েছিল। আমি আর ওঁর জন্য অপেক্ষা না করে জিপে গিয়ে বসলাম। জিপ ছেড়ে দেবার পরে মনে পড়ল, এত কথার মাঝে ভদ্রলোকের পরিচয়টা তো নেওয়া হল না!
মেলা দেখে যখন ফিরলাম তখন রাত প্রায় ন’টা। সন্ধ্যাতারায় বিজলী বাতি নেই, গোটা কয়েক সেজ আর হ্যারিকেন জ্বলছে। ভূতের বাড়িই মনে হত, দোরের কাছেই ভবানীচরণকে পেয়ে গিয়ে ধড়ে প্রাণ এল। একটা আলো নিয়ে ভবানীচরণ আমাকে আমার ঘরে পৌঁছে দিল। আমাকে খাইয়ে সে নিজের বাসায় ফিরে যাবে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “ওঁরা কোন ঘরে আছেন, ভবানীচরণ?”
“কাদের কতা বলচেন বাবু?” ভবানীচরণ হাতের হ্যারিকেনটা একটু তুলে জিজ্ঞেস করল।
“কেন, ওই যে বাবা আর মেয়ে, বিকেলে দেখা হল? ওরা এখানেই উঠেছে নিশ্চয়ই?”
“এখানে আপনি একাই আচেন বাবু।” ভবানীচরণ আলোটা রেখে জানাল, “আর তো কেউ নাই।”
বলে কী রে? বিকেলে স্পষ্ট দেখলাম, কত কথা হল—আর বলে কিনা কেউ নেই? অবশ্য কোথা থেকে এসেছেন সেটা জিজ্ঞেস করা হয়নি, কিন্তু ভদ্রলোককে দেখে স্থানীয় বাসিন্দা বলে তো মনে হয়নি। তাহলে এখানে ধারেকাছে বহিরাগতের বাসোপযোগী অন্য কোনও আস্তানাও আছে নাকি?
ভবানীচরণ ফিরে যাচ্ছিল, ওকে থামিয়ে বললাম, “সে কী হে? বিকেলে দেখলাম যে? ছোট্ট একটা মেয়ে আর তার বাবা…”
এই পর্যন্ত বলেছি, হঠাৎ দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল, “কপালি-ঈ-ঈ!”
সর্বনাশ, ভদ্রলোক কি এখনও তাঁর মেয়েকে খুঁজে পাননি? আওয়াজটা বেশ দূরের, কিন্তু দেখলাম ভবানীচরণও শুনেছে। নীচু হয়ে তাড়াতাড়ি আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে শুকনো গলায় বলল, “পুস্তম খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবু তার কপালিকে!”
আমার সব কেমন গুলিয়ে গেল। দেখি ভবানীচরণ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী যেন সব বলছে। আমি তাকে একটু ঠেলা দিয়ে বললাম, “কী বলছ যা-তা? পুস্তম কে?”
ডাক্তার হবার সুবাদে আমার ভূতের ভয়টা বেশ কম। এইরকম অন্ধকার রাতে এতক্ষণ আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল বটে, কিন্তু ভয় পাইনি। এবার সত্যি কথা বলতে একটু গা ছমছম করে উঠল। সেই পচা-গলা লাশটার ছবি চোখের সামনে ভেসে এল। আজ দুপুরেই যার মৃতদেহ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, সে কি সত্যিই পুস্তম? ভবানীচরণ কি সেই পুস্তমের কথাই বলছে?
“হ্যাঁ বাবু, পুস্তম মরে গেছে। কিন্তু এখনও সে তার মেয়েকে খুঁজে ফেরে। মাঝেমধ্যি তার ডাক শুনতে পাওয়া যায় বাবু!”
ভবানীচরণের ভয়ার্ত দৃষ্টি দূরে জঙ্গলের দিকে, হাতদুটো বুকের কাছে জড়ো করে থরথর করে কাঁপছে। অতিকষ্টে চেঁচিয়ে দারোয়ানকে ডাকল, “মুর্মু, তুই কোথায়?”
প্রায় তক্ষুনি আরেকটা আলো হাতে মুর্মু এসে হাজির হল। চেনা লোক পেয়ে ভবানীচরণ এবার একটু ধাতস্থ হল। তারপর আমাকে শোনাল এক মর্মান্তিক কাহিনি— পুস্তম সুখে ছিল তার আদরিনী কন্যা কপালিকে নিয়ে। পুস্তমের বউ মারা গিয়েছিল অনেকদিন আগে। কপালিই তার সব। দুপুরের খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ত পুস্তম। পায়রা, বনমুরগি, তিতির বা হাঁস শিকার করে আনত। দিনান্তে তাই দিয়ে তাদের নৈশভোজ হত। আর হত সারাদিনের জমে থাকা গল্প। দুঃখের সংসার, কিন্তু বাপ-বেটির মনে খুশির অভাব ছিল না।
সেদিন কোনও শিকার পায়নি পুস্তম। তাই রাতের আহারের সন্ধানে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। অমাবস্যার রাত ছিল বোধ হয়, তায় ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। শূন্য হাতে ফেরার পথে গ্রামের কিনারে একটা আওয়াজ পেয়ে সজাগ হয়েছিল সে। অন্ধকারেও তির নিশানায় লাগাতে পারত পুস্তম। কোনও অজানা শিকার ভেবে অন্ধকারেই তির ছোড়ে সে। একটা আর্তস্বর জানায় নিশানা তার ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু পুস্তমের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল! কপালি তার সন্ধানে জঙ্গলের এত কাছে চলে আসবে সে বেচারা কল্পনা করবে কী করে?
পরদিন গ্রামের প্রান্তে কপালির তিরবিদ্ধ দেহ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু পুস্তমকে আর দেখা যায়নি। শুধু তার ধনুকের দুটো টুকরো একটু দূরে পাওয়া যায়।
আর তারপর থেকেই অন্ধকার রাতে মাঝে মাঝে শুনতে পাওয়া যায় সেই করুণ হাহাকার, কপালি-ঈ-ঈ!
***
মুর্মুকে দিয়ে থানায় খবর পাঠিয়েছিলাম। সেই রাতেই গোসাবা থেকে আমাকে কলকাতা ফেরার বাস ধরতে হল। জনার্দন সাহা কুণ্ঠিত হয়ে বিস্তর ‘স্যার স্যার’ করল। খাতির করে রাতটা আটকাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি শুনিনি। লাগাতার দ্বিতীয় রাতেও ঘুমের দফারফা করে কলকাতার শেষ বাসটায় উঠেই পড়লাম।
রাতের ঘুম চুলোয় যাক, সন্ধ্যাতারায় একলা রাত্রিবাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
অলঙ্করণ-তথাগত চট্টোপাধ্যায়