গল্প-পভলিক আর কোটকা-রুশ ভাষায় মূল রচনা : নিকোলাই নোসোভ। ইংরেজি অনুবাদ : রোজ প্রোকোফিইয়েভা। বঙ্গানুবাদ : সুবীর কুমার পাল-শরৎ ২০২১

golpobideshi

একবার পভলিক কোটকাকে নিয়ে মাছ ধরতে গেল। সেদিন তাদের ভাগ্য ভালো ছিল না, মাছগুলো বড়শিতে গাঁথা টোপ একদমই গিলল না। সুতরাং কী করা যাবে? তারা বাড়ির পথে রওনা দিল। আসবার পথে তারা যৌথ খামারের বেড়া টপকে ভিতরে ঢুকল। বাগানে বিভিন্নরকম সবজি ছিল, এদিক ওদিক দেখে তারা পকেট ভর্তি করে শসা নিল। হঠাৎই পাহারাদার তাদের দেখতে পেয়ে বাঁশি বাজাল, কিন্তু তারা দুজনেই পালিয়ে চলে এল। যৌথ খামার থেকে সবজি নেওয়ায় পভলিক খুব ভয় পেল, সে তার সমস্ত শসা কোটকাকে দিয়ে দিল।

উত্তেজিত হয়ে কোটকা বাড়িতে দৌড়ে চলে এল। সে মাকে বলল, “মা দেখা, তোমার জন্য কত শসা এনেছি।”

তার সমস্ত পকেট শসায় ভর্তি ছিল। জামার মধ্যে ও দুই হাতেও ছিল একগাদা শসা।

“তুমি কোথায় পেলে এসব?” কঠোর স্বরে মা জিজ্ঞাসা করলেন।

“সবজির জমি থেকে।”

“সবজির জমি? কোন সবজির জমি?”

“নদীর ধারে, ওই যে যৌথ খামার, সেখান থেকে এনেছি।”

“এগুলো আনবার জন্য তোমাকে কে অনুমতি দিয়েছে?”

“কেউ দেয়নি মা। আমি নিজেই তুলে এনেছি।”

“তার মানে তুমি চুরি করেছ?”

“আমি মোটেই চুরি করিনি। পভলিক কয়েকটা তুলল দেখে আমিও নিয়েছি।” কোটকা তার পকেট থেকে শসা বার করতে আরম্ভ করল।

মা বলে উঠলেন, “এক মিনিট দাঁড়াও, তোমার পকেট খালি কোরো না।”

“কিন্তু কেন?”

“কারণ তুমি এক্ষুনি যৌথ খামারে যাবে এবং ওগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আসবে।” মা দৃঢ়তার সঙ্গে নির্দেশ দিলেন।

“কী বলছ তুমি? না না, আমি শসা ফেরত দেব না। ওগুলো সবজি বাগানে হয়েছিল এবং আমি তুলে এনেছি। এরকম আর জন্মাবে না।”

“বাজে কথা বলে লাভ নেই, তুমি ওগুলো নিয়ে অবশ্যই যৌথ খামারে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসবে।”

“আমি ওগুলো না-হয় দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসি।”

“না, একদম তা করবে না। তুমি শসা গাছগুলো লাগাওনি, ওগুলোর যত্ন করোনি, সুতরাং ফলগুলো ছুড়ে ফেলার কোনও অধিকার তোমার নেই।”

এবারে কোটকা কাঁদতে আরম্ভ করল। “ওখানে এক বুড়ো পাহারাদার আছে। আমাদের দেখে বাঁশি বাজিয়েছিল, তারপর আমরা পালাই।”

“তাহলে বোঝো, কত দুষ্টু তোমরা। যদি সে তোমাদের ধরে ফেলত?”

“সে আমাদের ধরতে পারত না। খুবই বুড়ো।”

“তোমার লজ্জা হওয়া উচিত!” মা বললেন। “ওই বৃদ্ধ লোকটির ওপর শসাগুলো রক্ষার দায়িত্ব ছিল। যখন সবাই দেখবে খামারে একটা শসাও নেই, তাকে দোষ দেবে। সেটা খুব ভালো হবে?”

শসাগুলো কোটকার পকেটে মা ঠেসে ভর্তি করতে আরম্ভ করলেন। কোটকা চিৎকার করে কেঁদে প্রতিবাদ করতে লাগল। “আমি যাব না। বুড়ো পাহারাদারের কাছে বন্দুক আছে। সে আমায় গুলি করবে।”

“যদি সে সত্যিই বন্দুক চালায়, তবে সে ঠিকই করবে। এরকম চোর ছেলে আমি চাই না।”

কোটকা আরও জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মা, তুমি আমার সঙ্গে এসো, প্লিজ মা, তুমি চলো। বাইরে অন্ধকার, আমার ভয় লাগছে।”

“শসাগুলো নেওয়ার সময় ভয় লাগেনি?” দুটো শসা এখনও মেঝেয় পড়ে ছিল, সে-দুটো কোটকার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিলেন। “শসাগুলো যদি যৌথ খামারে ফিরিয়ে না দাও, তোমার বাড়িতে ফিরে আসবার দরকার নেই।” দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে মা ঘরের মধ্যে চলে গেলেন।

এবার ধীরে ধীরে কোটকা রাস্তায় নেমে এল। সত্যিই বাইরে অন্ধকার ছিল। কোটকা মনে মনে বলল, ‘শসাগুলো নর্দমায় ফেলে দিয়ে মাকে বলব আমি খামারে ফেরত দিয়ে এসেছি।’ কিছুটা ভেবে বলল, ‘না না, তা করা ঠিক হবে না। কেউ দেখে ফেলতে পারে। তাছাড়া বুড়ো পাহারাদার আমার জন্য সমস্যায় পড়বে।”

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কোটকা কাঁদছিল।

সে বড়ো রাস্তায় এল। খুবই ভয় লাগছিল তার। সে ভাবল, পভলিক ঠিক কাজ করেছিল। ওর শসাগুলো আমায় দিয়েছিল, এখন সে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বাড়িতে বসে রয়েছে। ওর এতটুকু ভয় নেই।”

এইসব আপনমনে ভাবতে ভাবতে কোটকা গ্রামের শেষে চলে এল। এবার সে ধরল যৌথ খামারে যাওয়ার রাস্তা। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সে এত ভয় পেয়েছিল, সবজির বাগানে যাওয়ার বাকি পথটা যেন একরকম দৌড়ে গেল। সেখানে পৌঁছে পাহারাদারের থাকবার ছোট্ট ঘরের সামনে দাঁড়াল, তারপর কাঁদতে লাগল।

তার কান্না শুনে বৃদ্ধ পাহারাদার সেখানে এসে জিজ্ঞাসা করল, “ছোট্ট বাবুসোনা, তুমি কাঁদছ কেন?”

“দাদু, আমি শসাগুলো ফিরিয়ে দিতে এসেছি।”

“শসা? কোন শসা?”

“আজ আমি আর পভলিক এগুলো খামার থেকে তুলেছিলাম। মা এগুলো ফিরিয়ে দিতে বলেছে।”

এতক্ষণে বৃদ্ধ পাহারাদারের মনে পড়ল। “ও, বুঝতে পেরেছি। বিকালে আমি তাহলে যখন বাঁশি বাজিয়েছিলাম, শসার খেতে তুমি ছিলে? খুব কায়দা করে তোমরা শসাগুলো তুলে নিয়ে পালিয়েছিলে, হতচ্ছাড়া কোথাকার!”

“পভলিকের শসা নেওয়া দেখে আমিও কয়েকটা নিয়েছিলাম। পরে ওর শসাগুলো ও আমায় দিয়ে দিয়েছে।”

“পভলিক কী করেছে না করেছে ওসব ভেবে কী হবে? তোমার জানা উচিত ছিল সবজি বাগান থেকে চুরি করা ঠিক করা নয়। একটা কথা বলছি, আর যেন তোমায় না দেখি। এখন শসাগুলো আমায় দিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাও।”

একটা একটা করে পকেট থেকে শসাগুলো বার করে মাটিতে রাখল কোটকা।

“এই সব? আর নেই তো?” বৃদ্ধ পাহারাদার জিজ্ঞাসা করল।

“না না, সত্যি বলছি আর একটাও নেই।” বলেই সে থতমত খেল।

“ঠিক করে বলো!” রেগে বলে উঠল বৃদ্ধ পাহারাদার।

“আরেকটা আছে।” সভয়ে জানাল কোটকা।

“কোথায় সেটা?”

“দাদু, আমি ওটা খেয়ে ফেলেছি। আমায় মাফ করে দাও। আমি বুঝতে পারিনি, আমার অন্যায় হয়েছে।”

“সত্যিই তুমি খেয়েছ?”

মাথা নাড়ল কোটকা।

“কেমন ছিল শসাটা? ভালো, না তেতো?”

“ভালোই তো ছিল।”

“তোমার তাহলে ভালো লেগেছে শসাটা খেয়ে?”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল কোটকা।

“কিন্তু দাদু, আমি যে শসাটা খেয়ে নিয়েছি তার জন্য তোমার বিপদ হবে না তো?”

বৃদ্ধ পাহারাদার এবার গাম্ভীর্য সরিয়ে হেসে ফেলল। “তুমি কি ওই জন্য উদ্বিগ্ন ছিলে? না না, একটা শসার জন্য আমার বিপদ হবে কেন? তবে হ্যাঁ, তুমি যদি সমস্ত শসাগুলো না আনতে, তাহলে হয়তো-বা কিছু সমস্যা হতেও পারত।”

কোটকা বিদায় জানিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে দৌড় লাগাল।

হঠাৎ সে থেমে ডাকতে লাগল, “দাদু, দাদু!”

“আবার কী সমস্যা হল?”

“যে শসাটা আমি খেয়েছি ওটার কী হবে? ওরা কি বলবে আমি চুরি করেছি?” কোটকা জিজ্ঞাসা করল।

“আমার মনে হয় না সেরকম কিছু ঘটবে। তবে তুমি কথা দাও, আর কখনও চুরি করবে না।”

“আমার সত্যি অন্যায় হয়েছে।”

“ভালো কথা। আমরাও চাই তুমি আর কোনোদিন চুরি করবে না।”

“কিন্তু…”

“মনে করো ওটা আমি তোমায় উপহার হিসাবে দিয়েছি।”

“তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ দাদু। শুভরাত্রি।”

“শুভরাত্রি, ছোট্ট বাবুসোনা। সাবধানে যাও।”

কোটকা দৌড়ে আড়াআড়িভাবে মাঠটা পার হল, ছোট্ট খালটা লাফাল, এরপর এল সাঁকোর কাছে। সাঁকো পেরিয়ে যখন গ্রামের কাছে পৌঁছল, হাঁটবার গতি একটু কমাল। এবার সে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলল।কোটকার মন থেকে অপরাধ বোধ সরে গিয়ে বেশ খুশি আর সুখী লাগছিল।­

অলঙ্করণ-তথাগত চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s