অনুষ্টুপ শেঠ-এর আরো গল্পঃ… ওলটপালট, মেডেল, দোকান, যাত্রা, বিশ্বসেরা, নতুন কাজ
গলিটা একটু এঁকে-বেঁকে কোথায় চলে গেছে, শেষ দেখা যায় না। বুধবার পেঠের এই মার্কেটটায় বেশি আসে না ওরা। কিন্তু পাশের বাড়ির দেশাই-আন্টির কাছে এখানকার ‘আনবিলিভেবলি চিপ’ কুর্তার দোকান আর তার অনন্ত ভ্যারাইটির খবর পেয়ে অবধি তমন্না খেপে গেছিল, এখানে আসতেই হবে! কিন্তু আজ তমন্নার সময় হয় তো প্রতীকের মিটিং থাকে, কাল প্রতীক তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ফেলতে পারে তো তমন্নার মডিউলে প্রোডাকশন ইস্যু এসে যায়, পরশু দুজনেই যদি-বা সময়মতো বেরোতে পারে, দীপিকা-শচীন-গৌরব সবাই মিলে ধরে বসে বোলিং করতে যাবে ফুল টিম। এই করে করে আর হচ্ছিলই না, আজ অবশেষে একটু লেট হলেও গোঁ ধরে চলে এসেছে দুজনে।
কত্তা-গিন্নি দুজনে একই অফিসে কাজ করার এই এক হ্যাপা। তবে সেই কলেজ লাইফ থেকে দুজনে একসঙ্গে ঘোরা বেড়ানো, কেনাকাটা, সবকিছু করার অভ্যাস—এখন আর আলাদা কিছু ভাবতেও পারে না। অভ্যাস বলেই, এই যে এক ঝুড়ি কুর্তি আর পালাজো নিয়ে তমন্না একবার করে ট্রায়াল রুমে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে গত আধঘণ্টা ধরে, তাতে একটুও বিরক্ত হয়নি প্রতীক। তবে বোর হচ্ছিল এটা সত্যি কথা। তমন্না জানে বলেই বলল, “আমি আরও কয়েকটা দেখব বুঝলে, তুমি বরং বাইরে একপাক ঘুরে এসো। তবে সিগারেট খাবে না বলে দিচ্ছি!”
মুচকি হেসে ওকে কাঁচকলা দেখিয়ে বেরিয়ে এসেছিল প্রতীক। মেন মার্কেটের দিকটা বড্ড ভিড়, যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই ছোটো ছোটো ঘেঁষাঘেঁষি দোকানগুলোয় চোখ বোলাতে বোলাতে গলির ভিতরদিকে পা বাড়িয়েছিল ও।
এক পা দু-পা করে করে গলিটার বেশ ভিতরেই চলে এসেছে ও এখন। এতক্ষণ জামাকাপড়, ভুট্টার স্টল, শাড়ি, জুতো, ব্যাগ, চা-বড়াপ্পাও, রিয়েল এস্টেটের দালাল এসব ছাড়া আর কিছু বিশেষ চোখে পড়েনি। এই দোকানটা কেন যেন চোখ টেনে ধরল।
অন্যান্য খোলা, দৃশ্যত বাহুল্যবিহীন দোকানগুলোর পাশে এই ধূসর কাচে মোড়া, কাচের বন্ধ দরজা দোকানটা একটু আলাদাই বটে। কাচের ভিতর দিয়ে যা যা দেখতে পেয়েছিল তাতে শো-পিসের দোকান বলেই মনে হয়েছিল। এই তস্য গলির ভিতরে কে এত বাহারি জিনিস কিনতে আসে, সেই কৌতূহলেই দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল প্রতীক।
দোকানের ভিতরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে একটা টুং টাং চাইম বেজে উঠেছিল দরজায় লাগানো। সুরটা শুনেই প্রতীকের মনে হয়েছিল, ও যেন এই আওয়াজ বহুবার শুনে এসেছে। গানের কান তার চিরকাল খারাপ, শুদ্ধ রে আর কোমল রে কানে শুনে তফাত করতে পারে না। অতএব বিজ্ঞাপন বা এফ.এম.-এ শোনা কোনও পপুলার সুরের সঙ্গে মিল আছে বলেই এমন মনে হচ্ছে, এটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি ওর। ছেড়ে দেওয়ামাত্র দরজাটা আপনা-আপনি মসৃণভাবে বন্ধ হয়ে গেছিল।
কাউন্টারে কেউ নেই। বোঝাই যায় ব্যাবসাপাতি খুব ‘হ্যাপেনিং’ নয়। থরে থরে সাজানো মূর্তি, ছবি, ফুলদানি ইত্যাদির অনেকগুলোই কেমন ধুলোপড়া দেখতে। ঘরের মেঝেতে নীল কার্পেট, সে কেমন যেন রোঁয়া-ওঠা, মলিন। কিন্তু জিনিসগুলো প্রত্যেকটা খুব সুন্দর। যে কলেকশন বানিয়েছে তার চয়েস খুবই ভালো বলতে হয়।
এটা ওটা হাতে তুলে দেখছিল প্রতীক। পাথরের ছোট্ট সাদা প্যাঁচাটা হাতে তুলে নিয়ে বড্ড পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু কাকে দাম জিজ্ঞাসা করবে… জোরে একটা গলা খাঁকারি দিয়ে ‘হ্যালো’ বলল ও একবার।
ঘরের আলোটা কি কমে গেল হঠাৎ করে? হ্যাঁ। ভোল্টেজ কমে গেছে নির্ঘাত। একদিকের আলোটা প্রায় নিভে গেছে, অন্যদিকেরটা মিটমিট করে জ্বলছে।
ওদিকে কেউ আসছেও না। দূর ছাই! ফিরে যাবার জন্য ঘুরেছিল প্রতীক, পা দুটো মাটিতে গেঁথে গেল। দরজার পাশে, কোনা করে খুব হেলাফেলায় যে বস্তুটি রাখা আছে সেটার দিকে ওর এমনিতে চোখ পড়ত না। কিন্তু জিনিসটা থেকে একটা জ্বলজ্বলে আভা বেরোচ্ছে, দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
একটা ঘড়ি। হাতঘড়ি নয়, পকেট ঘড়ি। আভাটা সম্ভবত ওই ডায়াল থেকে, অন্ধকারে দেখা যাওয়ার জন্য। মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাত বাড়িয়ে ওটা তাক থেকে পেড়ে নিল প্রতীক। ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ। বেশ ভারী। পুরোনো দিনের জিনিস তো! সলিড ব্যাপার। গোল ডায়ালের চারদিকে খাঁজকাটা লতাপাতার ডিজাইন। আলতো করে হাত বোলাচ্ছিল প্রতীক।
“বোলিয়ে।”
মন্দ্রকণ্ঠে কথাটা এল পিছন থেকে। ঘরের আলোটাও আপনি আবার ভোল্টেজ বেড়ে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঘুরে দেখল প্রতীক, কাউন্টারের পিছনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক মাঝবয়সি, ভারিক্কি গম্ভীর চেহারা, মাজা রং, ঝুলো গোঁফ।
“এটার কেমন দাম হবে?” হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা দেখায় প্রতীক।
ভদ্রলোক চমকে ওঠেন কেমন যেন। “এটা ছিল নাকি ওখানে? না, ওটা সেল করার নয়।”
দুম করে গোঁ চেপে যায় প্রতীকের। ওর এটা চাই-ই!
“প্লিজ ভাইয়া! আমি নিলে এটাই নেব। আপনি দেখে দাম বলে দিন না!”
লোকটা মৃদু হেসে বলে, “বেশ তো, নেবেন। কিন্তু ওটা সত্যিই বিক্রির নয়, আপনি এক হাজার টাকার উপরে কিনলে ওই জিনিসগুলো থেকে একটা কিছু ফ্রি দিই আমি। জিনিস পছন্দ করুন, ওটাও পেয়ে যাবেন।”
পাগল, না আর কিছু! এত অ্যান্টিক জিনিস, এর নিজের দামই তো এক হাজার টাকার বেশি! যাক গে। ওর দোকান, ওর চয়েস।
প্যাঁচাটা, একটা বাহারি অ্যাশট্রে আর একটা ছিটছিট পাথরের লকেট মিলিয়ে বারোশোর কাছাকাছি বিল হল প্রতীকের। সগর্বে জিনিসগুলো এবং ঘড়িটা ব্যাগে নিয়ে ফেরার পথ ধরল প্রতীক।
ঘড়িটা আবার হাতে নেওয়ার সুযোগ এল শনিবার। তমন্না শনিবারে একটা অরফানেজে পড়াতে যায়। ও বেরিয়ে যাবার পর কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে প্রতীক ঘড়িটা বার করে এনেছিল প্যাকেট থেকে।
গরমটা খুব পড়েছে। এসি চালিয়ে, বিছানায় আয়েস করে শুয়ে লতাপাতাগুলোয় হাত বোলাচ্ছিল ও। কী নিখুঁত খাঁজকাটা পাতাগুলো! এটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে কীসে হাত লাগল কে জানে, ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চলতে শুরু করল।
উত্তেজনায় উঠে বসল প্রতীক। এইটে যদি চালু করে মাঝেমধ্যে ব্যবহার করা যায়, দারুণ হবে! ডেনিম জিন্সের সঙ্গে এইটে, ওফ! পুরো স্টাইল স্টেটমেন্ট!
আরও কিছু বোতাম গোছের ব্যাপার দেখা যাচ্ছিল কারুকার্যের ফাঁকে ফাঁকে। নাড়াচাড়া করতে করতে কট করে আরেকটা গোলমতো জিনিস ঘুরে গেল একপাক।
ধ্যাত্তোর! কারেন্টটাকে এই মুহূর্তেই চলে যেতে হল! ঘড়িটায় কী হল দেখতেই পেল না প্রতীক।
পরক্ষণেই ওর মাথা থেকে ঘড়ি-টড়ি বেরিয়ে গেল একেবারে। ঘরের মেঝে কাঁপছে! ভূমিকম্প!
বেরোতে হবে? টেবিলের নীচে ঢুকতে বলে অফিসে। কিন্তু খাবার টেবিল তো কেনাই হয়নি এখনও। তাহলে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামবে নাকি? আচ্ছা, খাটের নীচে ঢুকলেও তো হয়!
দূর আপদ! বক্স খাট তো! সব ভুলে যাচ্ছে কেন ও!
থরথর করে সব কাঁপছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না ও। মাথা ঘুরছিল। তবে বেশিক্ষণ নয়, এই ভালো। দেখতে-দেখতেই ব্যাপারটা আবার আস্তে আস্তে কমে এল। থামলও অবশেষে। কিন্তু আলো জ্বলল না।
জ্বালাতন। ফেজ গেছে হয়তো। কিন্তু ঘরে এরকম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে ওর কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। ফ্ল্যাটের চাবিটা তো পকেটেই ছিল, ঘড়িটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে এল প্রতীক।
লিফটে নামার প্রশ্নই নেই এই পরিস্থিতিতে, সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল সে। কিন্তু এ আবার কী হল? সিঁড়ি কই? হাঁ হাঁ করছে খোলা সামনে। অ্যাঁ! সিঁড়ি ভেঙে পড়ে গেছে ভূমিকম্পে! হে ঈশ্বর! এত ভয়ানক ব্যাপার হয়ে গেল এই ক’মিনিটে?
পায়ে পায়ে আবার ফ্ল্যাটের দিকে পিছিয়ে আসে প্রতীক। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তার, কী করবে! এদিকের ফ্ল্যাটের আঙ্কলকে ডাকবে একবার? বুড়ো মানুষ, কেমন আছেন এই বিপদে দেখা উচিত।
কিন্তু সামনের ফ্ল্যাটই-বা কই? আর লিফট?
প্রতীকের মাথা ঘুরছিল। নিজেদের দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে দুটো কথা মনে পড়ে ওর গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। এক, বেরোনোর সময় সে দরজা খোলেনি। খোলাই ছিল। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে তামন্না বেরোনোর পর সে নিজে বন্ধ করেছে, বারো ভূতের বাড়ি, খোলা কখনোই রাখে না ওরা। আর দুই, ওদের ফ্ল্যাটের দরজা মোটেই এরকম বিরাট, দুই পাল্লার, কাঠের কারুকাজ করা নয়।
চোখ বুজে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে প্রবলভাবে দমন করে ও আবার পিছিয়ে এল বেশ কয়েক পা।
বাড়িটার দোতলা থেকে অন্য একটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে—সেটা কস্মিনকালেও ওখানে ছিল না তা প্রতীক হলফ করে বলতে পারে—মূল দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে আপাতত ও একটা দালানের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম বিশাল বিস্তৃত পাথরের মেঝেওয়ালা উঁচু চত্বরকে দালান ছাড়া কিছু বলা যায় না। ওর সামনে, ওদের চারতলা ‘তালেজা বিহার’ অ্যাপার্টমেন্টের বদলে একটা গাম্বাট একতলা কালো অন্ধকার বাড়ি। ভীষণ পুরোনো গড়নের। শিভনেরি ফোর্ট, শনিবারওয়াড়া মনে পড়ে যায় দেখলে। দালানটা বাড়িটাকে বেড় দিয়ে ঘুরে গেছে। আশেপাশে কয়েকটা ঝুপসি গাছ ছাড়া আর কিছু নেই, ধু-ধু মাঠ।
প্রতীকের হতভম্ব ভাবটা কাটার আগেই বহুদুর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল। ভয় পাওয়া চিৎকার নয়, হাঁক। হুংকার। কী বলা যায় জানে না ও, কিন্তু শুনলে কেমন রক্ত জল হয়ে যায়।
ওগুলো কী? দূরে, মাঠের শেষপ্রান্তে?
আলো।
নড়াচড়া করছে। জুগজুগ করছে। আগুনের আলো।
মশাল?
আলোগুলো এগিয়ে আসছে এদিকেই। দু-চারটে নয়। অসংখ্য। কারা ওরা? আজকের যুগে এরকম মশাল নিয়ে কারা আসে?
ডাকাতের গল্প শুনেছে ছোটোবেলায় প্রতীক, দিদার কাছে, মায়ের কাছে। ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় পড়েছে। তারা এমন আসত। আবার পিছন ফিরে দেখে সেই অচেনা উদ্ভট কেল্লা টাইপের বাড়িটাই দাঁড়িয়ে আছে। মহা জ্বালা! এগুলো কী হচ্ছে রে ভাই!
“চলে এসো!”
প্রতীক আঁতকে উঠে পিছোতে গিয়ে দালান থেকে পড়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে। একটা বলিষ্ঠ হাত ওকে ধরে টেনে আনল। “চলো! সময় নেই!”
মাথার তেকোনা পাগড়ির ছায়া পড়েছে, মুখচোখ দেখা যায় না। কুর্তা, ধুতি পরা। কোমরে গামছার মতো একটা কিছু বাঁধা।
“আরে আমি! ভয় নেই।”
প্রতীক কিছুই বুঝছিল না, কিন্তু ‘ভয় নেই’টা শুনে ওর মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটা স্বস্তির শব্দ বেরিয়ে গেল।
“এসো, এসো! ওরা এসে পড়ার আগে আমাদের পালাতে হবে।”
লোকটার পিছু পিছু যাওয়া ছাড়া আর কিছু মাথায় এল না প্রতীকের। অন্তত ওই দূরের মশাল নিয়ে আসা লোকেদের চেয়ে এই লোকটি বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ হবে আশা করা যায়।
লোকটা যেতে যেতেই বলল, “তুমি তো জানো না এদিকের দশা। মুঘল শয়তানরা আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল… আমাদের পশ্চিম সীমান্তের সব প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি তুকাজী নায়েকও আম্বে চকের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। এই কথরাগড় জিতে নেওয়া এখন ওদের সামনে তুচ্ছ। বাকি সবাই পালিয়েছে খবর পেয়ে। আমাদেরও ওরা এসে পৌঁছনোর আগেই মহাল পেরিয়ে সারনাভির জঙ্গলে গা ঢাকা দিতে হবে।”
এদ্দিন পুনেতে থাকা, আর তমন্নার জিদ্দি ট্রেনিং – দুই মিলিয়ে মারাঠিটা বেশ ভালোই বোঝে প্রতীক। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছিল না। তবে মুখ খুলতে এখনও সাহস হচ্ছিল না ওর, হুঁ হাঁ দিয়ে যাচ্ছিল।
“তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি। বাকিরা পথ চেয়ে আছে, জলদি চলো!”
অপেক্ষা করছিল! বলে কী!
আর কথা বলার কোনও মওকা পাওয়া গেল না। এত দ্রুত দৌড়তে হল তাল রাখতে যে প্রতীক চোখে প্রায় অন্ধকার দেখছিল। অবশেষে ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে তারা যখন জঙ্গলের আড়ালে পৌঁছে হাঁফ ছাড়ছে, তখন দেখতে পেল কেল্লায় স্থানে স্থানে মশালের নড়াচড়া।
লোকটার হাত ধরে, প্রায় চোখ বুজে ভরসা করে, গাছের ডালে ঠোক্কর খেয়ে, কাঁটায় পা ছড়ে, হোঁচট খেতে খেতে প্রায় উড়ে চলছিল প্রতীক।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। এতক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে কোথা থেকে যেন শেয়াল ডেকে উঠেছে খুব কাছে। ও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে বুঝে লোকটা ওকে আশ্বস্ত করল, “আমাদের ডেরা। আমাদেরই লোকজন আছে সামনে। ডাকে সংকেত দিল। দাঁড়াও, জবাব দিই এবার।”
শেয়াল নয়, রাতপাখির তীক্ষ্ণ ডাক বেরোল তার কণ্ঠ থেকে। একবার, দু-বার, খানিকক্ষণ থেমে আবার পর পর দু-বার।
এইবার আলো দেখা গেল। সামনে, কেউ মশাল জ্বালিয়েছে।
“চলো, চলো জয়রং!”
কিছু বলার আগেই তাকে প্রায় উড়িয়ে এনে আলোকিত জায়গায় ফেলল লোকটা।
জনা আষ্টেক জোয়ান পুরুষ। কেমন সব অদ্ভুত জামাকাপড়, নাটকের দলের মতো। দুটো মশাল। তার একটা হাতে নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এল এক বিশাল লম্বাচওড়া লোক, দলপতি সম্ভবত।
“এ কাকে নিয়ে এলে বাপট?”
লোকটা এতক্ষণে ঘুরে ওর দিকে তাকিয়েছে। আঁতকে উঠে সে বলল, “হে শম্ভুজী! কে তুমি? জয়রং কোথায়!”
ঝন্নন্নন্নন করে একটা আওয়াজ হল। প্রতীক বিস্ফারিত চোখে দেখল চারটে তরোয়ালের ডগা তার গলার একদম সামনে।
জ্ঞান হারানোর আগে রিফ্লেক্সে ওর গলা থেকে কী কথা বেরিয়েছিল তা ওর নিজেরও মনে নেই। কিন্তু দেখা গেল অজ্ঞান অচেনা কাউকে মেরে ফেলা এই দলের ধাতে নেই, বিশেষ করে সে যদি অজ্ঞান হবার আগে ‘শিব্বারাও বাঁচালে!’ বলে চিক্কুর ছেড়ে থাকে। কবে যেন অফিসে এরকম একটা নাটক করেছিল প্রতীক, আপাতত সেই ডায়লগের জোরেই হয়তো-বা তার প্রাণরক্ষা হল।
***
ভোরের আলো সবে আকাশের এক প্রান্তে দেখা দিয়েছে। প্রতীক একটা ঝোপের পিছনে বাবু হয়ে বসে ছিল। ওর সামনে বাপট আর দলপতি মঙ্গেশ রাও। সারারাত তিনজনের কেউই ঘুমোয়নি, বোঝা যায়।
ওর গল্প শেষ অবধি সবাই বিশ্বাস করেছে কি না জানে না, প্রতীকের নিজেরই বিশ্বাস হতে চাইছে না, কিন্তু ওর আজব পোশাক-আশাক – অন্ধকারে তখন বাপট যা ছদ্মবেশ বলে ধরে নিয়েছিল – ওর কাতর কাকুতি মিনতি – এসব মিলিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ওকে আবার ওই কেল্লায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছে এরা দু-জন।
অপরপক্ষে প্রতীক যেটুকু বুঝেছে, জয়রং এদের গুপ্তচর – পাশের রাজ্যে রাজা ভালে রাওর সভায় এতকাল মোতায়েন ছিল। শেষ যে চিঠি পাঠাতে পেরেছিল জয়রং, তাতে দুটো খবর ছিল। এক, মুঘল-মারাঠার এই ক্রমাগত যুদ্ধে কাজে লাগার মতো এক অত্যন্ত গোপন আর গুরুত্বপূর্ণ কাগজ তার হস্তগত হয়েছে। দুই, ভালে রাওর রাজ্যের আরও কেউ কেউ উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এই কাগজটার কথা জেনে গেছে। তাদের মধ্যে একজন ওর পিছনে লেগেছেন এটা দখল করতে, তাই সে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে আসছে। তার গন্তব্য, এই কথরাগড়। দল যেন এখানেই তার প্রতীক্ষা করে।
কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতি ইতিমধ্যে পালটে যাওয়ায়, কথরাগড় খালি করে এরা সরে এসেছে এখানে। সে অবশ্য সাময়িক, দুটো দিনের ওয়াস্তা – ডাকাতগুলো গুছিয়ে মজা করুক। নতুন সৈন্যদল রওনা দিয়েছে পুনে থেকে, তারা এসে গেলেই মহাদেওজীর নাম করে ও দুর্গ আবার উদ্ধার করে নেবে মঙ্গেশরাও।
কিন্তু জয়রং যদি কথামতো ওই দুর্গে এসে থাকে সেদিন তারপরে, তাহলে সে নিশ্চয় ধরা পড়ে গেছে ওদের হাতে। যে করেই হোক ওকে উদ্ধার করে আনতে হবে। ও না হোক, ওর কাছে থাকা কাগজটা। ওটা অমূল্য। ওরা চলে আসার সময়ে দলের সবচেয়ে কৌশলী জ্ঞানী যোদ্ধা বাপট জয়রং-এর জন্যই অপেক্ষা করে থেকে গেছিল কিল্লায়, কিন্তু সব চৌপাট করে দিল প্রতীকের অমন চোরের মতো বেরিয়ে আসা, আর বাপটের ডাকে সাড়া দেওয়া। যেহেতু আর কেউ যে হতে পারে মাথাতেও আসেনি তখন, ওই অন্ধকারে ওকেই জয়রং ভেবে বাপট নিয়ে চলে এল, সব হিসাব গুলিয়ে গেল।
কাজেই ওদের আজ রাত্রে আবার যেতে হবে কাজ সমাধা করতে। এবার প্রতীক যদি ওদের সঙ্গে গিয়ে এর ফাঁকে নিজের জাদুযন্ত্র ব্যবহার করে নিজের সময়ে ফিরে যেতে পারে, যাক!
কাল সারারাত বার বার চেষ্টা করেছে ও ঘড়িটা নিয়ে, কিন্তু সেটা চলছেও না, কিছু হচ্ছেও না। অতএব, মনে হচ্ছে, ওই জায়গার সঙ্গেই ব্যাপারটার কিছু একটা যোগ আছে, তাই ওখানেই ফিরে যেতে হবে প্রতীককে।
ওরা দুজন খানিক ঘুমিয়ে নিয়েছে এর মধ্যে। প্রতীক পারেনি, খুবই নার্ভাস লাগছিল। বার বার নেড়েচেড়ে দেখে ওর মনে হচ্ছে ঘড়িটার কায়দাকানুন খানিক বুঝতে পারছেও। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখার তো উপায় নেই, যদি যা ভেবেছে তা সত্যি না হয়…
উপায় কী আর! এইভাবেই চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু এখন নয়। সূর্য ডুবলে। আঁধার না হলে ওই মাঠ পেরিয়ে কেল্লার ধারেকাছে যাওয়া অসম্ভব।
***
“এইবার।”
বাপটের গলা থেকে প্রায় নিঃশব্দে কথাটা বেরোতেই মঙ্গেশ রাও আর প্রতীক একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল।
মিশমিশে অন্ধকার। বহুদূরে আলোর নড়াচড়া দেখে কেল্লা চেনা যাচ্ছে। গুঁড়ি মেরে তিনজনে দ্রুত এগোচ্ছে সেইদিকে। উঁচুনীচু মাঠ, হোঁচট খাচ্ছে – কিন্তু আলো জ্বালানোর উপায় নেই।
এভাবেই কেল্লার যতটা কাছে আসা সম্ভব, চলে এল ওরা।
“এবার?” প্রতীক প্রশ্নটা করল আর থাকতে না পেরে।
এটা কেল্লার পিছনদিক। ওদের সামনে এক প্রহরী দেওয়াল বরাবর পায়চারি করছে। পাঁচিলের উপরে বা আড়ালে অন্ধকারে আরও প্রহরী থাকতে পারে। দেওয়ালে বাঁ পাশ ঘেঁষে একটা দরজা। তার একটা ছোটো কপাট খোলা।
“একজন মাত্র। একে ধরাশায়ী করে ফেলা কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু…”
মঙ্গেশ রাওয়ের কপালে ভ্রূকুটি।
প্রতীক বোঝেনি। বাপট বুঝিয়ে দিল।
এই দরজা এত রাত্রে খোলা কেন? এরকম একটা যুদ্ধ দখল পরিস্থিতিতে? কে আসবে বা যাবে? না জেনে এগোনো ভুল হবে।
এর উত্তর হিসাবেই যেন ঘোড়ার শব্দ ভেসে এল দূর থেকে।
একজন অশ্বারোহী। মুখ মাথা ঢাকা পাগড়ির কাপড়ে। কাছাকাছি আসতেই রক্ষী এগিয়ে গেল, অভিবাদন জানিয়ে ঘোড়ার জিন ধরল। দুজনের কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল আগন্তুক মান্যগণ্য কেউ। অথচ সবই কেমন চুপিচুপি।
প্রতীকের ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে মঙ্গেশ রাও ওর হাত ধরে টানল। প্রতীক দেখল বাপট ভোজবাজির মতো খোলা দরজার ওপাশে পৌঁছে গেছে, ওদের ইশারা করছে আসতে।
ব্যক্তিটির ঘোড়া থেকে নামায় রক্ষীর যতক্ষণ মনোযোগ ছিল, ততক্ষণে ওরা দুজনও বাপটের কাছে পৌঁছে গেছে।
ভিতরের চত্বরে নানা ছোটোবড়ো চৌবাচ্চা আকারের কীসব। তার একটার পিছনে তিনজনে দেওয়ালে প্রায় মিশে গুঁড়ি মেরে বসে ছিল। আগন্তুক দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল, গট গট করে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে দালানে উঠে একটা দরজায় প্রায় শোনা যায় না এমন আওয়াজ করল। দরজা ভিতর থেকে খুলে গেল। আগন্তুক ঢুকতে বন্ধও হয়ে গেল নিঃশব্দে।
প্রতীকের মনে হচ্ছিল নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখছে কিছু।
কী হবে এরপর?
কতক্ষণ ধরে কিছুই হল না। ধৈর্য কাকে বলে সঙ্গী দুজনকে দেখে বুঝছিল প্রতীক। ওর যেখানে হাত-পা-চোখ কিছুই স্থির থাকতে চাইছে না, সেখানে এরা দুজন ঠায় একভাবে বসে, চোখের পাতাটুকুও ফেলছে কি না সন্দেহ।
কতক্ষণ পরে লোকটা আবার বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। এবার ভাঙে চাঁদের আলোয় তাকে কিছুটা দেখা গেল। খর্বাকৃতি। মাথায় জাঁদরেল পাগড়ি একটা। পোশাক-আশাক নেহাত ফ্যালনা নয়।
সে বেরিয়ে গেল। প্রহরী বাইরে থেকে টেনে বাইরের দরজার কপাট বন্ধ করল, টের পেল তারা।
ভিতরে ঢুকবে কী করে, ভাবতে হবে এবার।
না। ভাবতে হবে না। প্রতীক ভুলেই গেছিল যাদের সঙ্গে এসেছে এটা তাদেরই দুর্গ। অন্ধিসন্ধি সব তাদের জানা আছে।
বিড়াল-পায়ে ওই দরজা পেরিয়ে আরও বামদিকে চলে এল ওরা তিনজনেই। খিলেন, গম্বুজ গোছের ব্যাপার। সেই খিলেনের সঙ্গে মিশে, প্রায় বোঝাই যায় না এমন একটা সরু, ছোটো দরজা।
সত্যি বলতে, কীভাবে যেন বাপট খুলে ধরার আগে অবধি প্রতীক ওটা দরজা বলে বুঝতেই পারেনি! একটা ওরকমই সরু সিঁড়ি উঠে গেছে খিলেন ধরে ঘুরে ঘুরে।
“আগে উপরেই চলো, এ যেখানে বলছে সেখানে ছেড়ে দিই আগে। আমাদের সময় লাগবে জয়রংকে খুঁজতে।” বাপটের গলা। মঙ্গেশ রাও মাথা হেলিয়ে সায় দিল।
তিনজনে পা টিপে টিপে দোতলায় উঠে এল। এ-প্রান্তের মুখেও অমন চোরা দরজা ছিল, বাপট একইভাবে সেটা খুলে ওদের ঢুকিয়ে এনে আবার বন্ধ করে দিল।
কিছুদূর এগিয়ে ডানদিকে ঘুরতেই প্রতীকের কেমন চেনা লাগল গড়নটা। যতই পুরোনো পাথুরে দালান হয়ে যাক, ওর আন্দাজ বলছিল এইটেই ওদের হল-ওয়ে। তা যদি হয়, তবে ডানদিকের দ্বিতীয় দরজাটাই ওদের ফ্ল্যাট বরাবর হবে। কিন্তু সেই দরজার সামনেই তিন-তিনজন মুশকো চেহারার সৈন্য দাঁড়িয়ে যে!
বাপট আর মঙ্গেশ রাও-ও সেদিকেই তাকিয়ে ছিল।
প্রতীকের মন বলছিল, ওই ঘরে বিশেষ কিছু আছে। তাই এত পাহারা। হয়তো জয়রংকেও ওখানেই পাওয়া যাবে।
কালো পোশাকে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকা ওরা দুজন এতটাই অন্ধকারে মিশে গিয়েছিল যে এমনকি পাশে দাঁড়িয়েও প্রতীকের ধাঁধা লাগছিল লোক দুটো আছে না নেই তা নিয়ে। ওর কনুইতে একটা ছোঁয়া বুঝিয়ে দিল, আছে।
কানের একদম পাশে মুখ এনে বাপট বলল, “নাকমুখ চাপা দিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়াও। আমি না বলা অবধি খুলবে না।”
কিছু ভাবার সুযোগ ছিল না। তাই করল প্রতীক।
প্রায় নিঃশব্দে একটা গোলা গড়িয়ে গেল সামনের চাতালে। প্রহরীদের সেদিকে চোখ যাবার আগেই তার থেকে হু হু করে সাদা ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল।
কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই আস্তে আস্তে, কাপড়ের পুতুলের মতো নরমভাবে তিন জোয়ান সান্ত্রীর শরীর মাটিতে ঢলে পড়ল।
তারও বেশ কিছুটা পর, প্রতীক যখন আর পারছে না অমন দম বন্ধ করে থাকতে, বাপট বলল, “চলো।”
ধোঁয়া ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু হালকা মিষ্টি ঝিমঝিমে একটা গন্ধ পেল প্রতীক প্রহরীদের কাছে যেতেই। শরীরগুলো ডিঙিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকল ওরা।
ঘরে ঢুকে চোখ সওয়াতে একটু সময় লাগল। বাইরের মশালের আলো দরজা দিয়ে বিশেষ আসছে না ভিতরে। লম্বাটে ঘরের অন্য প্রান্তে বেশ উপরে একটা জানালা, চাঁদের ম্লান আলো আসছে তা দিয়ে। এটুকুই, ঘরে অন্য কোনও আলো নেই।
ঘর ফাঁকা।
না।
দূরের এক কোণ থেকে একটা অস্ফুট শব্দ ভেসে এল। একটা নড়াচড়াও চোখে পড়ল যেন। বাপট মুখে একটা চাপা হিসহিসে শব্দ করে দৌড়ে গেল সেদিকে। ওরাও গেল সঙ্গে।
“সর্বনাশ! জয়রং…”
“রাখতে পারলাম না কাকা! নিয়ে গেল। নিয়ে গেল…”
আরও কিছু কথা হল, সে এত দ্রুত যে প্রতীকের মারাঠি জ্ঞান তাল রাখতে পারল না। বাপট শরীরটা ধরে উঠিয়ে বসাতে চেষ্টা করছিল, মঙ্গেশ রাও সেই ফাঁকে প্রতীককে অল্প কথায় বুঝিয়ে দিল, এই একটু আগে যে ব্যক্তি বেরিয়ে গেল, সে জয়রংকে নৃশংসভাবে মারধোর করে তার কাছে লুকোনো সেই কাগজ নিয়ে গেছে।
“কে সে?”
দাঁতে দাঁত ঘষে মঙ্গেশ রাও বলল, “বেইমান।”
বাপট ধরে থাকলেও জয়রং নেতিয়ে পড়েছে একদম। বোঝাই যাচ্ছে ওর শরীরে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। এবার, উপায়?
প্রতীক ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে।
“তুমি যাও। আমাদের হিসাব আমরা বুঝে নেব। তুমি ফিরে যাও তোমার জিন্দেগিতে।”
প্রতীকের তাও হাত সরছিল না। জয়রংকে তোলার চেষ্টা করতে করতে বাপট আবার ধমক লাগাল, “যাও বলছি! আর কেউ এসে পড়ার আগে চলে যাও। জলদি করো।”
প্রতীক কাঁপা হাতে পকেট থেকে ঘড়িটা বার করে আনল। কাঁটাগুলো যেন থরথর করে কাঁপছে। না, ওর হাত কাঁপছে। মন শক্ত করে সারা শরীর স্থির করল সে। চট করে মনে মনে হিসেবটা আবার করে নিয়ে, ঘড়িটায় হাত ছোঁয়াল প্রতীক।
আবার সেই ভূমিকম্পের অনুভূতি। আবার সেই সব গুলিয়ে যাওয়ার মতো টলোমলো দশা।
শরীর স্থির হলে চোখ খুলল প্রতীক।
পাথরের মেঝে। সেই তিনদিক বন্ধ, পাথরের পোক্ত দেওয়ালের ঘর। দূরে ও-পাশে চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের মশালের আলো আসছে। সেই আলোর মধ্যে মধ্যে ছায়া পড়ায় বোঝা যাচ্ছে বাইরে কেউ-বা কারা ঘোরাফেরা করছে।
তিনজন। প্রতীক জানে।
ওর সামনে একজন মানুষ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে বসে আছে। সে ওকে এখনও দেখতে পায়নি। জয়রং। মুখ না দেখেও বুঝতে পারল প্রতীক। প্রতীক পা টিপে টিপে কাছে যেতে মুখ তুলল সে, দু-চোখ ভয়ে বিস্ফারিত। মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে থাকতে বলল প্রতীক। কাছে এসে, হাঁটু মুড়ে বসল ওর পাশে। থ্রি কোয়ার্টারের পকেট থেকে শখের সুইস নাইফটা বার করে অন্ধকারেই আন্দাজে হাতের বাঁধন কাটতে শুরু করল সে।
তার আগে, জয়রংয়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে নিয়েছে সে, “ভয় নেই, আমি বাপট আর মঙ্গেশ রাওয়ের সঙ্গে এসেছি।”
ওই নাম দুটো শুনেই জয়রং শান্ত হয়ে গেছিল।
ওয়েল, কথাটা মিথ্যা তো নয়!
খানিক আগেই বুদ্ধিটা মাথায় খেলে গেছিল তার।
ঘড়ির কাঁটা ও ঠিক ততটুকুই পেছোবে, যাতে সবকিছু তাদের কেল্লায় ঢুকে পড়ার সময়ে চলে যায়। অবশ্য ও নিজে যে এই ঘরেই থেকে যাবে, সেটা ও ভাবেনি। ও ভেবেছিল, যে করে হোক তিনজনে মিলে তখন ওই লোকটার আগেই এই ঘরে এসে জয়রংকে উদ্ধার করে নেবে।
সে যাই হোক। হাতের বাঁধনটা কেটেছে অবশেষে। পায়েরটা আরও তাড়াতাড়ি হল কারণ, জয়রংও নিজের কোমর থেকে ছোট্ট একটা ছোরা বার করে হাত লাগাল।
এবার…
“এক্ষুনি লোক আসবে এই ঘরে। পালিয়ে যেতে হবে।”
জয়রং এগিয়ে গেছে ওই দূরের জানালার দিকে। উঁচু, গরাদহীন জানালা। প্রতীক মুগ্ধ হয়ে দেখল অবিকল ম্যাজিকের মতো দেওয়ালে হাতে পায়ে ভর দিয়ে জানালার ধাপি অবধি উঠে গেল লোকটা। ইংরিজি সিনেমায় এমন দেখেছে সে। কেমন গর্ব হচ্ছিল নিজের দেশের অতীতের কথা ভেবে।
“এসো! চলে এসো, আমি ধরছি।”
জয়রং ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠেছে।
প্রতীকের চোখটা একটু একটু জ্বালা করছিল। খুব ইচ্ছে করছিল ওদের দলে যোগ দিয়ে, মুঘল দস্যুদের থেকে কেল্লা বাঁচানোর লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
যদি পারত!
কিন্তু ও মাথা নাড়ল তার বদলে।
“না ভাই। আমায় এখানেই থাকতে হবে। দরকার আছে।” বলতে-বলতেই উৎকর্ণ হয়ে উঠল প্রতীক। দূরে শব্দ পাচ্ছে কিছু।
“যাও! ওরা আসছে।”
মসৃণ একটা ঝাঁপ দিয়ে জয়রং অদৃশ্য হয়ে গেল জানালা থেকে।
প্রতীক মনশ্চক্ষে দেখতে পেল, নিচের উঠোনে লুকোনো দুজন মানুষ পিছনে শব্দ পেয়ে চমকে ঘুরে তাকাল। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জড়িয়ে ধরল জয়রংকে।
যতক্ষণে লোকজন এসে এই ঘর খালি দেখে সবাইকে সতর্ক করবে, ততক্ষণে বাইরের ওই একজন মাত্র প্রহরীকে ঘায়েল করে তিন মারাঠি বীর মাঠের অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে পারবে, সে ভরসা প্রতীকের আছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই সে আবার নতুন হিসাবটা ঝালিয়ে নিয়েছিল। আগন্তুকদের পায়ের শব্দ যখন একেবারে দরজার সামনে এসে গেছে তখন সে ঘড়ির কাঁটায় প্যাঁচটা দিল।
বিশ্বাসঘাতক ভালে রাও সেবার মুঘল সুবাদারের হাতে পুনে জেলার সমস্ত দুর্গের প্রবেশ পথের নিশানা লেখা কাগজ তুলে দিতে পারেনি। কেল্লায় ফাঁকতালে ধরা পড়ে যাওয়া চরটির খবর পেয়েই ছুটে এসেছিল সে, কিন্তু খালি হাতে ভগ্নমনোরথ হয়েই কেল্লা থেকে ফিরে যেতে হয়েছিল তাকে। চরটিকে বেঁধে রাখা হয়েছিল যে ঘরে, সেখানে ঢুকেই তার কেমন যেন মাথা ঘুরে গেছিল, চোখের সামনে যেন পুরো ঘর দুলে উঠে ধোঁয়ায় ভরে গেছিল… তারপর সুস্থ হয়ে যেতে দেখেছিল তার সঙ্গের প্রহরী দুজন ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই।
সে একা নয়, ওই দুই প্রহরীরও একই দশা হয়েছিল। তাই অনুমান করা হয়েছিল, কোনোভাবে বাঁধন খুলে ফেলে এবং অজানা কোনও বিষের ধোঁয়ার সাহায্যে তাদের বিভ্রম সৃষ্টি করে লোকটা পালিয়ে যেতে পেরেছিল।
***
টলোমলো ভাবটায় ক্রমশ এমন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল প্রতীক, থেমে যেতে একটু অবাকই লাগল যেন।
আওয়াজটা কিন্তু থামেনি। কান ফুটো করে দিচ্ছে একেবারে!
“কোথায় থাকো! কলিং বেল বাজিয়ে বাজিয়ে হাত ব্যথা হয়ে গেল! এত জিনিস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কী ঘুম রে বাবা! টেনশনে পড়ে গেছিলাম তো!”
দরজা খুলে দিতেই তমন্না ঝাঁঝিয়ে উঠল। ফেরার পথে ডিমার্ট গেছিল বোঝা যাচ্ছে। ওর হাত থেকে মালপত্র নিতে নিতে গ্রাম্ভারি চালে প্রতীক বলল, “অত চিল্লিও না। কত কাজ করতে হয়েছে এর মধ্যে যদি জানতে…”
গ্রোসারির ব্যাগটা কিচেন কাউন্টারের উপর রেখে, পকেট হাতড়াল প্রতীক। পকেটের সেলাই বরাবর হাত ঘুরে চলে এল।
খালি।
প্রতীক চমকাল না। ও যেন জানতই ঘড়িটা আর থাকবে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তেল চানাচুর বিস্কুট ইত্যাদি কাবার্ডে তুলে রাখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ও।
***
গত কয়েকদিনের মতো আজও সন্ধ্যার ধূপ দেখানোর পর কাচের দরজা বন্ধ করে একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন বুধবার পেটের গলির গলি তস্য গলির মধ্যের দোকানদারটি। তারপর মৃদু হেসে ফ্রি গিফটের তাকের হাজারো টুকিটাকির মধ্যে প্রায় লুকিয়ে থাকা সবজেটে আভা বিচ্ছুরণ করা কাঠের ঘড়িটা সযত্নে তুলে নিয়ে ভিতরের ঘরে ঢুকে গেলেন। তাঁদের পুরুষানুক্রমে রক্ষা করে চলা কালচক্রাধার আবার কাজ শেষ করে ফিরে এসেছে। তাঁর আলমারিতে অতি প্রাচীন একটা কাঠের বাক্সে তুলোর বিছানায় আবার সেটা শুয়ে থাকবে, যদ্দিন না আবার প্রয়োজন বুঝে আবার নিজে-নিজেই সে আবার ওই ফ্রি আইটেমের তাকে এসে হাজির হয়।
Besh bhalo laglo. Time machine r modern life odbhut bhabey mishe gechhe
LikeLike
Besh bhalo laglo. Time machine r modern life odbhut bhabey mishe gechhe
LikeLike