প্রান্তিক বিশ্বাসের আগের গল্প- জানাজানি
॥১॥
দরজাটা একটু ফাঁক দেখে বিশ্বরূপ আর বেল টিপলেন না। ঠেলে ভেতরে ঢুকে দরজাটা লক করে দিলেন। বাড়ির অন্দরমহলের আবহাওয়া বেশ থমথমে মনে হল, কারও কোনও সাড়াশব্দ নেই। অথচ অন্যদিন সন্ধেবেলায় উত্তর কলকাতার বনেদি এই চৌধুরীবাড়ি রীতিমতো গমগম করে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা কমতে কমতে এখন ঘরের সংখ্যার অর্ধেক। তাহলেও দুই খুদে চিকু আর পিকুর দৌলতে দেড়শো বছরের দেওয়ালেও হাসিখুশি খেলে বেড়ায়।
বিশ্বরূপ দু-বছর হল রিটায়ার করে সিনিয়র সিটিজেনদের দলে নাম লিখিয়েছেন। বাড়িতে ওঁর থেকে বড়ো বলতে মেজদা আর মেজবৌদি, মানে চিকুর দাদু আর ঠাকুমা। বড়দা-বড়বৌদি অর্থাৎ পিকুর দাদু আর ঠাকুমা পাঁচ বছর আগে একটা রোড অ্যাকসিডেন্টে হঠাৎ চলে গেলেন একসঙ্গে। বিশ্বরূপ বিয়ে-থা করেননি। এছাড়া আছে একটি দু-বছরের আমেরিকান স্পিৎজ, ডায়না।
নীচে রান্নাঘরে রীতা রান্না করছে। বয়স ওঁর থেকে কম হলেও কানে শোনে না। অথচ সদর দরজাটা কিছুতেই বন্ধ করবে না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই ডায়না দৌড়ে এল। সামনে এসে জোরে জোরে লেজ নাড়তে লাগল। এতটা আহ্লাদ অন্যদিন তো দেখায় না! চিকু আর পিকুকে নিয়েই ওর পৃথিবী। বাকিরা কে এল, কে গেল ডায়নার তাতে কিছু এসে যায় না। নির্ঘাত কিছু একটা হয়েছে।
জুতো-মোজা খুলে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে বিশ্বরূপ বৈঠকখানার দিকে এগোলেন। দরজা খোলা, ভেতরে দুটো ফ্যানই চলছে। আলতো করে উঁকি দিতে যাবেন, অমনি ডায়না ঘেউ ঘেউ করে উঠল। চিকুর চোখ দিয়ে জল পড়ছে আর পিকু দাদার সামনে বসে ওর ডানহাতটা নিয়ে আঙুল মটকাচ্ছে। ডায়নার আওয়াজে দুজনেই মুখ তুলে তাকাল। তারপর পিকু দৌড়ে এল। “কচি, আজ না, দাদা মার খেয়েছে জেম্মার কাছে!”
ছোটবেলায় বিশ্বরূপকে ওঁর দুই দাদা অনেকটা ছোটো বলে ‘কচি’ নামে ডাকতেন। সেটাই টিকে গেছে কপালে। চিকু তাই ওঁকে কচিদাদু বলে, আর পিকু বলে কচি।
“সে কি! কেন? বড়দাদু, বড়ঠাম্মা, তোমার মা সবাই কোথায় ছিল?”
“সবাই ছিল, কিন্তু সবাই বলল দাদা ঠিক করেনি।”
চিকুর মায়ের একটুতেই মাথা গরম হয়ে যায়। দুরন্ত ছেলেকে মাঝেমধ্যে একটু ধোলাই দিয়ে থাকেন। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু, কারণ চিকু তো সহজে কাঁদবার পাত্র নয়। চিকুর পাশে বড়ো সোফায় বসে ওর চিবুকটা তুলে বললেন, “কী করেছ দাদাভাই?”
কান্না থামল। নাকটা দু-বার টেনে, জামার হাতায় মুছে ও বলল, “কচিদাদু, আমি কি আর ছোটো আছি?”
“কে বলে সে-কথা? দু-বছর বাদে তুমি টিন-এজার হয়ে যাবে।”
“বাবা একটা ট্রেডমিল কিনেছে আজ। ডেলিভারি সকালে হয়েছে। আমি বিকেলে চালিয়ে দেখতে গেলাম ঠিক চলছে কি না। মা দেখতে পেয়ে এখানে নিয়ে এসে সবার সামনে মারল, তারপর কান ধরে কুড়িবার ওঠবোস করাল।”
“ছোটকাকু, কিছু খাবে? ফিরতে না ফিরতেই নালিশ শুরু করে দিয়েছে!” চিকুর মা এসে দাঁড়িয়েছে।
“না না, তা কেন করবে? আমিই জিজ্ঞেস করলাম। যা খেতে দেবে অল্প করে দিও। ওরা খেয়েছে?”
“না, ওদেরকেও একসঙ্গেই দেব। চিকুর বাবা বলেছে ট্রেডমিলটা বড়োদের জন্যে। তবু চিকু-পিকু দুজনেই একবার করে উঠে দেখেছে। যে ইনস্টল করতে এসেছিল, সেও বলল, বড়োরা কেউ সঙ্গে না থাকলে ছোটোরা যেন না ওঠে। পিকু তো ড্যাশবোর্ডটা দেখতেই পাচ্ছে না, এত ওপরে। তাই দুজনকেই সকালে বারণ করেছি উঠতে। তারপর ওদের দেখাদেখি ডায়নাও চড়ে বসে থাকবে। শেষমেশ একটা অ্যাকসিডেন্ট হলে…”
“পশ্চিমের ঘরটা তাই হরিদাকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়েছে দাদা। ওখানেই ট্রেডমিলটা রেখেছে তালা দিয়ে।” পিকুর মা এসে দাঁড়িয়েছিল, সুযোগ পেয়ে যোগ দিল।
বিশ্বরূপের মনের চোখে পুরো ঘটনাটা এবার একে একে ভেসে উঠল। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
দুই বৌমা চলে যেতেই উনি বললেন, “তোমরা পাঁচ মিনিট বসো, আমি টয়লেট থেকে আসছি। খেতে খেতে একটা মজার গল্প বলব।”
“কীসের গল্প কচি?”
“ট্রেডমিলের।”
॥২॥
“দাদাভাই, ওই টর্চার ডিভাইসের দিকে না যাওয়াই ভালো, জানো।” গরম আলুর চপে একটা কামড় দিয়ে বললেন বিশ্বরূপ।
“টর্চার ডিভাইস?”
“তা নয়তো কী? তোমাদের চপগুলো মাঝখান থেকে ভেঙে দিই? বড্ড গরম।”
“কচি, ডায়নাকে এট্টু দেব?”
“না, একদম না। যতই লেজ নাড়ুক আর জুলুজুলু তাকাক। অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে ওর।”
ডায়না মনে হয় বুঝে গেল যে এখানে সুবিধে হবে না, ছুটল বড়দাদু-বড়ঠাম্মার ঘরে।
“ট্রেডমিলের ‘ট্রেড’ স্পেলিং কী?”
“টি আর ই এ ডি।” চিকু চটপট উত্তর দিল।
“ভেরি গুড। মানে কী?”
“হাঁটা।”
“পার্টলি কারেক্ট। ‘ট্রেড’ মানে কিছুর ওপরে পা দেওয়া বা হাঁটা। এবার বল ‘মিল’ মানে কী।”
“সিমিলারিটি।” এবার পিকু উত্তর দিল।
“ধুর বোকা, তুই তো বাংলায় মিলের মানে বলছিস। ইংরিজিতে মিল মানে একটা বাড়ি বা ফ্যাক্টরি যেখানে কোনও মেশিন চালিয়ে গ্রেন ভাঙা হয়।”
“এক্সেলেন্ট! তাহলে দুটো শব্দ একসঙ্গে করলে কী মানে হবে?”
“পা দিয়ে মেশিন চালিয়ে গ্রেন ভাঙা?”
“একদম তাই। অনেকদিন আগের কথা। আঠারো শতক সবে শুরু হয়েছে। ইংল্যান্ডের জেলখানাগুলো সব ক্রিমিনালে ঠাসা। খতরনাক কয়েদিদের তাই গিলোটিনে প্রাণ দিতে হয়, গুণ্ডাগুলোকে দূরদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর চোর-ছ্যাঁচড়দের ভরে দেওয়া হয় সলিটারি সেলে যেখানে আলো-বাতাস কিছুই ঢোকে না। তাদের করুণ অবস্থার কথা জানতে পেরে চার্চের পাদ্রি থেকে দেশের সব বুদ্ধিজীবী লোকেরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করে। সরকারের টনক নড়ে। তারা তখন জেলখানাগুলোয় একটু উন্নতি করার চেষ্টা প্ল্যান করে। এর আগেই নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে ইংল্যান্ডের দশা শোচনীয়। উইলিয়াম কিউবিট নামে এক নামি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে ডাকা হয়। তিনি জেলখানার কয়েদিদের দিয়ে কাজ করানোর কথা ভাবেন। শাস্তিও হবে, আবার কিছু না কিছু কাজও হবে। ১৮১৮ সালে ডিজাইন করলেন ‘ট্রেড হুইল’। একটা বিশাল লোহার সিলিন্ডার। তার গায়ে কাঠের সরু সরু পাটাতন লাগানো। একসঙ্গে চল্লিশজন কয়েদি সেখানে পাশাপাশি একটা পাটাতনে দাঁড়াবে বুকের হাইটে একটা লোহার হ্যান্ডেল ধরার জন্যে। এই সিলিন্ডার যখনই ঘুরবে, কয়েদিরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে উপরের পাটাতনে পা দেবে; সেটাও ঘুরে তলায় চলে যাচ্ছে, তাই তার ওপরেরটাতে পা দেবে। এর ফলে ওরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে আর ওদের এই চলার ফলে যে এনার্জি তৈরি হবে সেটা গিয়ারের মাধ্যমে জল তোলা, গম ভাঙা এসব করবে। একটু বড়ো ডিজাইনের ট্রেড হুইল রীতিমতো মিলের এনার্জি জোগাত। তাই সেগুলোকে ট্রেডমিল বলত।”
“কী মজা!” পিকু হাততালি দিয়ে উঠল।
“মজা একদম নয়, দিদিভাই। কয়েদিদের এক-একদিনে পাঁচ ঘণ্টা সময় ট্রেডমিলে কাটাতে হত। তার মানে কতটা হাঁটতে হত জানো? প্রায় চোদ্দ হাজার ফিট, মানে মাউন্ট এভারেস্টের হাইটের প্রায় আদ্ধেক! খুব অল্প খেয়ে রোজ এরকম হাঁটা বিশাল শাস্তি। খালি তাই নয়, শরীরের থেকে মনের কষ্ট আরও বেশি। এরকম একঘেয়ে শাস্তি সারা পৃথিবী কখনও দেখেনি। ইংল্যান্ডের এই মডেল কিছুদিন বাদে আমেরিকার জেলখানাতেও চালু হল। শেষপর্যন্ত ১৮৯৮ সালে ইংল্যান্ডে প্রিজন অ্যাক্টে বদল করে তুলে দেওয়া হল এই টর্চার ডিভাইস।”
“তাহলে এই ট্রেডমিল কী করে…”
“বলছি। ১৯১৩ সালে আমেরিকায় এক্সারসাইজের যন্ত্র হিসেবে একটা ট্রেডমিলের ডিজাইনে পেটেন্ট নেওয়া হল। তবে সেই যন্ত্র প্রথম বাজারে এল ১৯৫৮-তে। খুব একটা পপুলার হল না কিন্তু। ততদিনে মেশিন বেশিরভাগ পরিশ্রমের কাজ করে দিচ্ছে বলে মানুষের খাটনি অনেক কমে গেছে। মোটা হয়ে যাচ্ছে মানুষ, হাজারে হাজারে। ডাক্তাররা বলল দৌড়োও। তাতে ফ্যাট কমবে, হার্ট ভালো থাকবে। এরপর সাতের দশকে আমেরিকায় উঠল জগিং করার হুজুগ। ব্যস, ট্রেডমিলের পোয়া বারো, ট্রেডমিল ছাড়া জিমে কেউ ঢুকতেই চায় না।”
“আমাদের স্কুলের জিমেও আছে। আমিও করেছি।” চিকু এবার নিজের কোর্টে বল পেয়েছে।
“সেখানে কিন্তু ইন্সট্রাক্টর থাকে, আর ঠিক ওই জায়গাতেই বাড়ির বড়োদের আপত্তি।”
“হুম, বুঝলাম।” একটু থামল চিকু। “ওকে, প্রমিস করছি যে তোমরা কেউ না থাকলে আমি ট্রেডমিলে উঠব না।”
পিকু হাততালি দিয়ে উঠল। এবার দৌড়ে এল ডায়না।
শীর্ষচিত্র- ১৮২৭ সালে ব্রিক্সটন জেলখানায় ব্যবহৃত ট্রেডমিলের তৎকালীন অলঙ্করণ
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
দারুণ লেখাটা প্রান্তিক
LikeLike