এই লেখকের আগের গল্প- কুট্টুসের গিফট
শীতের সময় হলেই তিনুর মনটা পিঠে পিঠে করে। ঠাম্মা কতরকমের যে পিঠে করে—নারকেলের পিঠে, ডালের পিঠে, আলুসেদ্ধর পিঠে, বাঁধাকপির পিঠে, পাটিসাপটা, দুধপুলি—আরও কত কী। হাটে শাকপাতা, গেঁড়িগুগলি, যজ্ঞ ডুমুরের ডাল বেচে ঠাম্মা। সময়ে সময়ে কুমড়ো ফুল, বক ফুল এগুলোও নিয়ে যায়। যেদিন পিঠে হয়, সেদিন সারাদিনের বেচাকেনা সেরে শেষবেলার হাট থেকে ঠাম্মা পিঠে বানানোর জন্য ভালো চাল কিনে আনে। তিনুর মা বলে ওরা যে-চালে রোজ ভাত খায়, তাতে নাকি পিঠে ভালো হয় না। চাল নিয়ে এসে ঠাম্মা একটা বড়ো বাটিতে ভিজিয়ে রাখে সারারাত ধরে। তারপর সকাল হলেই মা ইয়াবড়ো শিল ফেলে তাতে নোড়া দিয়ে ঘসঘস করে চাল বাটে। সেই শব্দের সঙ্গে মিশে যায় মায়ের হাতের চুড়ির টুংটাং শব্দ। রোগা রোগা হাতের শিরাগুলো ফুলে ওঠে, শীতেও ঘাম জমে ওঠে কপালে। তিনুর তখন মনকেমন করে। ও পিছন থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “ও মা, তোমার কষ্ট হচ্ছে? থাক, আমি পিঠে খাব না।”
মা হেসে বলে, “ওরে, তুই পেট ভরে খেলেই আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।”
মা আর ঠাম্মা দুজনের মুখেই সবসময় এই কথা। সেই যখন ওর বাবা জঙ্গলে মধু আনতে গিয়ে কোথায় চলে গেল, আর ফিরে এল না, তখন থেকেই মা আর ঠাম্মা সবসময়ই ওই কথা বলে। ঠাম্মা ভোরবেলা উঠেই জঙ্গলে যায়, নদীর পাড়ে যায় শাকপাতা সব তুলতে, গুগলি তুলতে। তিনু কত বায়না করে ঠাম্মার সঙ্গে যাবার, কিন্তু ঠাম্মা কিছুতেই নিয়ে যায় না। বলে জঙ্গলে নাকি বাঘ-সিংহ সব আছে। মা মীন ধরতে নদীতে যায়, সেখানেও তিনুর যাবার উপায় নেই। নদীতে বড়ো বড়ো কুমির আছে। তিনুর তাই কোনও মজা নেই। সকালবেলা উঠে জল-মুড়ি খেয়েই ওকে পড়তে বসতে হয়। তারপরে নদীতে চান করে, গা-মাথা মুছে, ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সোজা ইস্কুল। ইস্কুল তো কম পথ নয়, অনেকখানি। ওর ভিজে মাথা থেকে টপটপ করে জল পড়ে পিঠের জামা ভিজে যায়, আবার হাঁটতে হাঁটতে শুকিয়েও যায়।
ইস্কুলে অবশ্য তিনুর ভালোই লাগে। দুপুরে ওদের বাড়িতে রান্না হয় না। করবে কে? কেউ তো বাড়িতেই থাকে না। তাই দুপুরের খাওয়াটা ও ইস্কুলেই খেয়ে নেয়। আর তাছাড়া নতুন মাস্টারমশাইয়ের ক্লাস ওর খুব ভালো লাগে। নতুন মাস্টারমশাই ওদের কত গল্প বলেন, ছবি দেখান। এই তো কালকেই ওদেরকে একটা সিংহের গল্প বললেন। তিনু উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ওদের জঙ্গলে অনেক সিংহ আছে। তাই শুনে নতুন মাস্টারমশাই হেসে বলেছিলেন, ওদের জঙ্গলে কেন, আশেপাশের কোনও জঙ্গলেই নাকি সিংহ থাকে না। শুনেই তিনু ফিক করে হেসে ফেলেছিল। মাস্টারমশাই তো আর জঙ্গলে যান না, ঠাম্মা যায়। ঠাম্মা ঠিক জানে। ওদের জঙ্গলে সব আছে, সব। এমনকি তেনারাও, যাদের সন্ধেবেলা নাম নিতে নেই। রাতেরবেলা মা যখন রান্না করে, তিনু ঠাম্মার কোল ঘেঁষে শুয়ে গল্প শোনে। ঠাম্মা তাকে কত গল্প বলে—বাঘের গল্প, কুমিরের গল্প, এমনকি তেনাদের গপ্পোও। শুনতে শুনতে তিনু ঘুমিয়েই পড়ে। মা তখন ওকে ঘুম থেকে তুলে বসিয়ে ওর মুখে ভাতের দলা ভরে খাইয়ে দেয়। অবশ্য যেদিন পিঠে হয় সেদিনের কথা আলাদা। সেদিন ও চুপটি করে ঠাম্মার পাশে বসে থাকে। পিঠে হলে ঠাম্মাই করে কিনা। গরম গরম পিঠে ওর থালায় তুলে দেয় ঠাম্মা, আর ও প্রাণভরে খায়। আজ ওর সেই খুশির দিন।
ঠাম্মা কোথা থেকে দুটো নারকেল পেয়েছিল, একটা হাটে বেচেছে আর একটা ঘরে নিয়ে এসেছে তিনু পিঠে খাবে বলে। মা দুধ কিনে নিয়ে এসেছে। আজ দুধপুলি হবে। বিকেল থাকতেই উনুনে আঁচ দিয়েছিল মা। বেশি রাত হলে তিনু আবার ঘুমিয়ে পড়বে এই ভয়ে। ঠাম্মাও হাট থেকে ফিরে নেয়ে ধুয়ে তৈরি হয়ে গেছে।
তিনু ঠাম্মার পাশে বসে পিঠে করা দেখছিল। অন্যদিন মা হাত লাগায় ঠাম্মার সঙ্গে, কিন্তু আজ ওদের গোরু মতির শরীরটা খারাপ তাই মা গোয়ালে গিয়ে ঢুকেছে। তিনু বসে বসে গুনছে ঠাম্মা কতগুলো পিঠে গড়ল। এক, দুই, তিন… একুশ। মোট একুশটা পিঠে হয়েছে। তিনুর মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠল। কাল ইস্কুল যাবার আগেও ও পিঠে খেয়ে যেতে পারবে। রোজ কি আর মুড়ি খেতে ভালো লাগে?
ঠাম্মা সবে পিঠে নামিয়ে ওর পাতে গরম গরম একটা তুলে দিয়েছে, গোয়ালঘর থেকে মা দৌড়ে এসে ঠাম্মাকে বলল, “ও মা, তুমি এসো দিকি ওসব রেখে, মতি কীরকম ধারা কচ্ছে, আমার একার দ্বারা হবেনি।”
ঠাম্মা সঙ্গে সঙ্গে উঠে ছুটলে। তিনুও যাচ্ছিল, কিন্তু ঠাম্মা পিছন ফিরে বলল, “তুমি এসোনি ভাই, বরং পিঠেগুলো পাহারা দাও।”
ওদের উঠোনের ও-পারে গোয়ালঘর। সেখান থেকে মতির ডাক ভেসে আসছে। আকাশে চাঁদটা আজ বেশ গোল হয়ে উঠেছে। বাইরের দিক থেকে বেশ ঠান্ডা হাওয়াও আসছে। এতক্ষণ ঠাম্মা দরজাটা লাগিয়ে রান্না করছিল বলে হাওয়াটা আসতে পারছিল না। তাড়াহুড়োয় ঠাম্মা দরজাটা আঁটকে দিয়ে যেতে ভুলে গেছে। তিনু দরজা বন্ধ করবে বলে উঠে দরজার কাছে গেল, আর ঠিক তখনই ছায়াটা পড়ল উঠোনে। তিনু থমকে গেল। মতি কি বেরিয়ে এল নাকি? একটু ভালো করে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতেই ছায়াটা সরে এল ওর দিকে। আরে! এ তো সেই কালকেই নতুন মাস্টারমশাইয়ের কাছে দেখা বাঘটা না? হুম, ঠিক। সেই গায়ে হলুদ-কালো ডোরা কাটা দাগ। যেই না ও ভয়ে ‘মা’ বলে চিৎকার করতে যাবে, অমনি বাঘটা বলে উঠল, “কী তিনুবাবু, আমায় দেখে ভয় পেলে?”
তিনু ভীষণ অবাক হল। বাঘ কি মানুষের মতন কথা বলতে পারে? এটা তো কেউ ওকে বলেনি। বাঘটা ততক্ষণে ওদের দুয়ারে উঠে পড়েছে। একদম ওর সোজাসুজি দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। তিনুও বাঘের চোখে চোখ রেখে বলল, “না না, ভয় পাব কেন?”
“ও, তা বেশ। ভয় না পাওয়াই ভালো। কিন্তু জানো তো, আমায় আবার সকলেই ভয় পায়।” একটু থেমে বাঘটা আবার বলল, “তা তিনুবাবু, কী রান্না হচ্ছে? গন্ধে যে একবারে ম ম করছে চারপাশ। আমি সেই বন থেকে চলে এলুম।”
বলতে বলতে বাঘটা একদম রান্নাঘরে ঢুকে এল। তারপর দাঁড়িয়ে জোরে জোরে গন্ধ নিল। বাধ্য হয়ে তিনুও এসে দাঁড়াল বাঘের পাশে। তিনু খেয়াল করল, এখন আর ওর তেমন ভয় লাগছে না। ঠাম্মা গোয়ালঘরে যাবার আগে ঢিমে আঁচে দুধ বসিয়ে গিয়েছিল, এলাচ দিয়ে। তারই সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে। পাশ থেকেই আসছে পিঠের গন্ধ আর নতুন গুড়ের গন্ধও তো মন্দ নয়। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই বাঘটা বলে উঠল, “অ, পিঠে হচ্ছে। তা তিনুবাবু, এই যে তুমি এখানে একা একা পিঠে খাচ্ছ আমাকে না দিয়ে, এটা তো ঠিক নয়।”
“বা রে, আমি একা কেন খাব? মা খাবে, ঠাম্মা খাবে…”
“আরে, ওই একই তো হল। তোমরা একা একা খাচ্ছ আমায় না দিয়ে, জানো আমি কে?”
তিনু আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে বলল, “বাঘ।”
“আহা, বাঘ তো বটেই, কিন্তু বাপু আমি তো শুধু বাঘ নই, আমি হলুম গিয়ে এক্কেবারে বনের রাজা। এই পুরো এলাকার রাজা, সেই আমাকে বাদ দিয়ে খাওয়াদাওয়া?”
শেষের দিকে বাঘের গলাটা ভীষণ গম্ভীর হয়ে যাওয়ায় তিনুর একটু ভয় ভয় করলেও ও কিন্তু তা দেখাল না। ঠাম্মা বলে, ‘বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।’ তাই ও বেশ হালকাভাবেই বলল, “দেওয়ার মতন জিনিস হলে নিশ্চয়ই দিতাম রাজামশাই, কিন্তু আপনি তো আবার মাংস ছাড়া কিছুই খান না।”
একটুক্ষণ চুপ থেকে বাঘটা বলল, “মিথ্যে বলোনি, বুঝলে তিনুবাবু। কিন্তু এক খাবার রোজ রোজ কার আর ভালো লাগে বলো তো? এই তোমারই কি রোজ জল-মুড়ি খেতে ভালো লাগে?”
তিনু অবাক হয়ে যায়। আশ্চর্য! বাঘমশাই কী করে জানলেন, এ-কথা তো ও কাউকে বলেনি। মা-ঠাম্মা শুনলে মনে দুঃখ পাবে তো তাই।
“কী ভাবছ? আমি কী করে জানলাম? শোনো, রাজা তো আর এমনি এমনি হইনি। রাজা হলে সব জানতে হয়। প্রজাদের মনের খবরেরও খোঁজ রাখতে হয়।”
তিনু চুপ করে রইল। বাঘ অবশ্য বলেই চলল, “তা ভুল যখন করেছ, তখন শাস্তি তো পেতেই হবে তিনুবাবু।”
তিনু বড়ো বড়ো চোখ করে বাঘের দিকে তাকাল।
“না না, ভয় নেই, তোমায় আমি বেশি শাস্তি দেব না। বাচ্চাদের আমি বেশি শাস্তি দেওয়া পছন্দ করি না। শুধু এই পিঠেগুলো তুমি আজ আর পাবে না। আমিই সব খাব।”
তিনুর চোখে জল চলে এল। নেহাত বড়ো হয়ে গেছে বলে ভ্যা করে কেঁদে দিল না। এর থেকে তো রাজামশাই যদি বলত ‘তোমায় খাব’, সে বরং ভালো ছিল।
“কী হল? আবার ভাবছ কী? দাও দেখি, ভালো ছেলের মতন পিঠেগুলো একটা থালায় করে আমায় দাও।”
তিনু মাথা গোঁজ করে বসে রইল। বাঘ এবার একটু গম্ভীর স্বরে বলল, “কী, আমার কথা কানে যাচ্ছে না? রাজার আদেশ অমান্য করতে চাও?”
“রাজা? কে রাজা শুনি?”
ঘর কাঁপানো গমগমে গলার আওয়াজ শুনে তিনু আর বাঘমশাই দুজনেই চমকে তাকাল। আরে, এ যে কেশর ফুলিয়ে স্বয়ং সিংহমশাই! ভালো করে চোখ কচলাল তিনু। কীসব হচ্ছে আজকে! সে ঠিক দেখছে তো?
“অমন হা হয়ে দেখছিস কী রে? বাচ্চা ছেলে পেয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে, আবার মিথ্যে পরিচয় দেওয়া হচ্ছে?” রাগে সিংহমশাইয়ের কেশর ক্রমেই ফুলে যাচ্ছে।
“নাহ্, এ তো ভারি জ্বালালে! বুড়ো কিছুতেই পিছু ছাড়ে না।” বলতে বলতে বাঘ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। “রাজত্ব যাবার পর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে বুঝলে। কিছুতেই মানবে না যে ও আর রাজা নেই।” তারপর সিংহমশাইয়ের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “দেখুন, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ বলে সম্মান করি, তার মানে এই নয় যে আপনি যা খুশি তাই বলবেন।”
“বটে? আমি যা খুশি তাই বলি? না তুই বলিস, শুনি? বলি কোন আক্কেলে নিজেকে এই বনের রাজা বলে পরিচয় দিচ্ছিলি? আমি কি মরে গেছি?” রাগে সিংহের শরীর থরথর করে কাঁপছে।
“দেখুন, সত্যিটা এবার মেনে নিতে শিখুন। আপনার দিন গেছে, আমিই এখন এই জঙ্গলের রাজা।”
“এত বড়ো আস্পর্দ্ধা! কে বলেছে শুনি যে তুই রাজা?”
“কেন? মানুষেরাই বলেছে। বিশ্বাস না হয় তো এই তিনুবাবুকেই জিজ্ঞেস করলে হয়। কী তিনুবাবু, আমি কি ভুল বলছি?”
তিনুর চট করে মনে পড়ে গেল, কালই তো নতুন মাস্টারমশাই বলেছিলেন, আগে সিংহ ছিল বনের রাজা, তারপর ১৯৭২-এর ১৮ই নভেম্বর বাঘকে বনের রাজা বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তিনু কিছু বলে ওঠার আগেই সিংহমশাই এমন এক হুঙ্কার দিয়ে উঠল যে তিনু তো তিনু, বাঘ পর্যন্ত চমকে উঠল।
“আরে ছোঃ ছোঃ, কী দিনকাল এল! এক পলকে যার ঘাড় মটকে দিই, সে এখন ঠিক করবে আমি রাজা কি না?”
বাঘ এবার একটু মিনমিন করে বলল, “আহা! তাতে ক্ষতি কী?”
সিংহমশাই বাঘের দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যের সুরে বললে, “তা যদি তুই বুঝতিস, তবে তো তুইই রাজা হতিস।” বলেই তিনুর দিকে ফিরে বললে, “কই তিনুবাবু, আর দেরি না করে এবার পিঠেগুলো আমায় দাও দেখি।”
বাঘ-সিংহের ঝগড়ায় এতক্ষণ পিঠেগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিল তিনু। এবার পিঠেগুলোর দিকে চোখ ফেরাতেই বাঘমশাই হুঙ্কার ছাড়ল। যথারীতি এবারেও পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল তিনু।
“খবরদার তিনু! ওই পিঠে কিন্তু একমাত্র আমার প্রাপ্য, মনে রেখো।”
তিনু বেচারা অসহায়ভাবে একবার বাঘমশাইর দিকে আরেকবার সিংহমশাইয়ের দিকে তাকাতে লাগল। তারপর বড়ো একটা শ্বাস টেনে বলল, “আপনারা একটা কাজ করুন রাজামশাইয়েরা, আপনারা বরং নিজেরাই ঠিক করুন আগে কে আপনাদের মধ্যে রাজা হবেন।” তারপর একটু থেমে বলল, “যদি অনুমতি দেন তো তার জন্য আমি আপনাদের একটা উপায় বলে দিতে পারি।”
বাঘ তাড়াতাড়ি বলল, “বেশ তো বলো, আমার আপত্তি নেই। তবে সিংহমশাই কি…”
“শুনেই দেখি।” তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল সিংহমশাই।
“আপনারা বরং দুজনে একটা লড়াই করুন। যে জিতবে সেই রাজা। সহজ সমাধান।”
“এটা মন্দ নয়।” সিংহমশাই কেশর নেড়ে বলল।
“হোক তবে।” বলে বাঘমশাই বেশ কুস্তির ভঙ্গিমায় সিংহের দিকে এগিয়ে গেল।
“বলছিলাম কী রাজামশাইয়েরা, এই রান্নাঘরে, ছোট্ট জায়গায়, আপনারা ভালো করে লড়াই করতে পারবেন না। আর বলা যায় না, লড়াই করতে গিয়ে যদি পিঠের কড়াইখানা উলটে যায়, তবে তো আরও মুশকিল হবে।” তিনু বলল।
“তা কথাটা ভুল বলোনি। রাগলে তো আবার আমার মাথার ঠিক থাকে না, হয়তো এক প্যাঁচেই বাঘকে সোজা কড়াইয়ের মধ্যে ফেলে দিলাম।” খ্যাকখ্যাক করে হাসতে হাসতে বলল সিংহ।
“বটে! আচ্ছা!” বাঘ ফোঁস করে উঠল।
“আহা, আর ঝগড়াঝাটি নয়, আসুন আমার সঙ্গে, আমি আপনাদের লড়াই করার একটা ভালো জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছি।”
উঠোনে তিনুদের একটা বড়ো ঘর আছে। তাতে মা আর ঠাম্মা মিলে কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে রাখে, ওই দিয়ে রান্না হয়। বাঘ আর সিংহকে সেই ঘরের সামনে নিয়ে এসে দাঁড়াল তিনু। রাগে গরগর করতে করতে যেই না বাঘ আর সিংহ গিয়ে ঢুকেছে সেই ঘরে, অমনি ঘরের দরজা টেনে দিয়ে তিনু প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল, “বাঘ পড়েছে! বাঘ! এসো কে কোথায় আছ, বাঘ সিংহ… সিং…”
“এই তিনু! ওঠ ওঠ! কী সিং সিং করছিস? দেখো গো মা, ছেলেটা কেমন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চেঁচাচ্ছে।”
“মা, মা!” ধড়মড়িয়ে উঠে বসল তিনু। “জ্বালন ঘরে, বাঘ আর সিংহ…”
“কী স্বপ্ন দেখছ, ভাই?” ঠাম্মা হেসে বলল।
“ঠাম্মা, বাঘ আর সিংহে লড়াই বেধেছে!” একটু কানখাড়া করে বলল তিনু, “ওই শোনো, উঠোন থেকে লাফালাফির আওয়াজ আসছে।”
মা হেসে বলল, “আরে, ও তো আমাদের মতির বাছুর লাফাচ্ছে। ভারি দুষ্টু হয়েছে।”
“মতির বাছুর!” অবাক হয়ে বলল তিনু।
“হ্যাঁ রে সোনা। কাল সকালে দেখিস।” ঠাম্মা বলল। “অ বৌমা, এবার ছেলেটাকে দুটো পিঠে দাও দিকি। এবার থেকে আর তোকে শুধু জল দিয়ে মুড়ি খেয়ে যেতে হবে না। একটু দুধ পাবি। ঘরের গোরুর দুধ।”
কিচ্ছু বুঝতে না পেরে তিনু হাঁ করে মা আর ঠাম্মার দিকে তাকিয়ে রইল। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আহা রে! বাছার ঘুম এখনও ছাড়েনি।”
গরম পিঠে খেতে খেতে তিনুর মনটা আনন্দে ভরে গেল। খুব স্বাদ হয়েছে। শুধু একটাই আক্ষেপ রয়ে গেল, বাঘ-সিংহের লড়াইয়ে কে যে জিতল, কে যে সত্যিকারের রাজা হল সেটা আর জানা হল না।
অলঙ্করণ- অংশুমান
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে
good
LikeLike