গল্প-অ্যান্টিরোবট-শেলী ভট্টাচার্য-শীত ২০২১

শেলী  ভট্টাচার্যের আগের গল্প- ট্রি-বট, উৎসর্গ

golpoantirobot

বিনুর মেজাজটাই বিগড়ে গেছে। বাবাকে এতবার করে মনে করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বাবা একটা রোবট আনতে ভুলে গেছে। অফিসের কাজের এতটাও চাপ থাকে না যে একমাত্র ছেলের আবদারটা বাবা ভুলে যাবে। শিলিগুড়ি যাতায়াতের পথে ইলেক্ট্রনিক্সের খেলনার জন্য বিখ্যাত হংকং মার্কেট পড়ে। ইচ্ছা থাকলেই সেখান থেকে একটা রোবট আনা যেত। ‘ধুর!’ বলে রাগে দেখিয়ে হাতের বলটা মাটিতে ছুড়তেই বিনু দেখল ওটা বাউন্স খেয়ে নীচের বাগানে গিয়ে পড়ল। কিচ্ছু ভালো লাগছে না ওর। জাহান্নমে যাক গে বল। আনতে যাবে না ও। খাবে না, ঘুমাবে না, স্কুলে যাবে না… কিচ্ছুটি করবে না। স্কুলে গেলেই সবাই জিজ্ঞেস করবে, ‘কী রে, তোর বাবা রোবট আনল? কী কী করতে পারে সেই রোবট?’

আগে থেকে বুক ফুলিয়ে সবাইকে বলে রেখেছিল বিনু, ওর বাবা একটা দারুণ উন্নত রোবট আনবে। ওদের বংশে সব রোবট তৈরির বিশারদ রয়েছে। বিনুর বাবার কাকা যাঁকে বিনু প্রফেসরদাদু বলে, তিনি রোবটিক্স নিয়ে গবেষণা করতেন। রোবট তৈরির প্রোগ্রামিং কোড বানাতেন। ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রদের এই বিষয় পড়াতেনও। তাঁর ছেলে রুদ্রকাকু এখন ইউ.এস.এ-তে দারুণ উন্নত সব রোবট বানানোর প্রজেক্টে আছেন। দু-বছর আগে এসে প্রফেসরদাদুকেও নিয়ে গেছেন সেখানে। এরপর বড়ো হয়ে বিনুও একদিন বিদেশ যাবে ওর রুদ্রকাকুর কাছে। তারপর ওঁর সঙ্গে বসে সারাদিন ধরে রোবট বানাবে। কত স্বপ্ন ছিল বিনুর। তাই তো এখন থেকেই এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চেয়েছিল। বিনুর ভাবনাগুলোর তাল কাটল বলাইয়ের ডাকে।

“বিনু, এই বিনু।”

প্রিয় বন্ধুর গলা পেয়ে বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বিনু মুখ বাড়িয়ে দেখল, পাপান দাঁড়িয়ে আছে বলাইয়ের সঙ্গে। বিকেলের খেলার জন্য এসেছে ওরা। এমনিতে রবিবার ছাড়া এখন আর মাঠে যাওয়াই হয় না। রোজ স্কুল, হোম টাস্ক, টিউশন… এসব করেই সময় ফুরিয়ে যায়। বাকি যেটুকু সময় বেঁচে থাকে, বাবার মোবাইলের ৬ ইঞ্চির স্ক্রিনটাই হয়ে ওঠে সে-সময় খেলার ময়দান। তাই রবিবারটাই একমাত্র ওদের ছুটোছুটি করার দিন।

বিনু কিছুক্ষণ ভেবে উঠে দাঁড়াল। হাত নেড়ে ওদের দাঁড়াতে বলল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এসে বাগানে গিয়ে বলটাকে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগল। বলাই আর পাপানও ওর বলের কথা শুনে খোঁজাখুঁজিতে লেগে পড়ল। কারণ, বিনুর বল আর পাপানের ব্যাট, এই তো খেলার সামগ্রী ওদের। বলাইদের অবস্থা তেমন ভালো নয়। ওর বাবা অটো চালায়।

তিনজনে মিলে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন বলটা পাওয়া গেল না, তখন ওরা পথের চারপাশটা ভালো করে পরখ করতে করতে মাঠের দিকে এগোল। বিনুদের বাড়ির পেছনেই ছিল কাঠা চারেক জমির একটা মাঠ। ওর দাদু আর প্রফেসরদাদু এখানে যৌথভাবে জমিটা কিনে রেখেছিলেন যাতে করে পরবর্তীকালে বাচ্চারা একটু ফাঁকা জায়গা পায় খেলার জন্য। ওঁদের দূরদর্শিতা ছিল। বিশেষ করে প্রফেসরদাদুর তো ছিলই। তিনি বলতেন, ক’বছর পর পৃথিবী অনেক বদলে যাবে। একটু ফাঁকা জায়গা আর একমুঠো খোলা হাওয়া খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হবে তখন। সঠিক কথাই ভেবেছিলেন ওঁরা সেদিন। এখন যেদিকে চোখ যায়, শুধুই উঁচু উঁচু বাড়ি। একচিলতে ফাঁকা মাঠ নেই বসার জন্য।

বল না পেয়ে তিন বন্ধু মিলে মাঠে গিয়ে বসল। বিনুর গোমড়া মুখ দেখে বাকি দুজন কারণ জিজ্ঞেস করতেই বিনুর বাবার উপর অভিমানটা আবার প্রকাশ পেল। সব শুনে পাপান বলল, “মন খারাপ করিস না। এই কলকাতা থেকেই না-হয় একটা কিনে নিস পরে।”

বিনু একটু রেগেই উত্তর দিল, “আরে কলকাতার রোবট আর ওখানের রোবট কি এক হল? ধুর, তোরা বুঝবি না এসব।”

বিনুর শেষ কথাটার পর আর কেউ মুখ খুলল না। ওরা জানে বিনু সত্যিই এই বয়সে রোবট বিষয়ে অনেক কিছুই জেনে গেছে। তারপর একঘণ্টা মতো বসে বিনুর মুখে ওরা ওদের প্রফেসরদাদুর গল্প শুনল। বিনু যখন ক্লাস ফোরে পড়ত, তখন প্রফেসরদাদু তাঁর ছেলের সঙ্গে ইউ.এস.এ-তে চলে যান। কাকুর নাকি একটা দারুণ প্রজেক্ট হাতে এসেছিল সে-সময়। তাই প্রফেসরদাদুর সহযোগিতা দরকার ছিল। হাজার হোক, এই বিষয়ে দাদুর অভিজ্ঞতা ও গভীরতা অনেক বেশি। রুদ্রকাকুর আবার চার বছর ধরে মার্কিন দেশগুলোতে থেকে আধুনিক প্রযুক্তিতে বেশ দখল হয়ে গিয়েছিল। তাই দুজনে মিলে একটা দারুণ কিছু বানিয়ে সারা বিশ্বকে চমকে দিতেই দাদুকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া।

এসব গল্প করতে করতে সন্ধে নেমে এল। বলাই আর পাপান যে-যার বাড়ির পথে হাঁটা দিল। বিনুর তখনও রাগ কমেনি। তাই ঘরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না মোটেই। এমন সময় হঠাৎই পেছন থেকে কার যেন ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে এল। পেছন ফিরে দেখল, প্রফেসরদাদুর পড়ার ঘরের জানালাটা খোলা। সম্ভবত সেখান থেকেই ডাকটা শোনা গেল। কিন্তু প্রফেসরদাদু তো প্রায় দু-বছর হল বিদেশে আছেন। তাহলে কি দুর্গাপূজার সময় বাড়িতে এলেন? মা তো এর মধ্যে এ-ব্যাপারে কিছুই বলেনি বিনুকে। তাছাড়া, এখানে আসার আগে দাদু তো একটা চিঠিতে লিখে বা কল করে বাবাকে জানাতেন। এসব ভাবতেই দ্বিতীয়বার স্পষ্ট প্রফেসরদাদুর গলায় ডাকটা শোনা গেল, “বিনু।”

বিনুর খেয়াল হল, ডাকটা ওই ঘর থেকেই যেন আসছে। সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গেল ও প্রফেসরদাদুর বাড়ির দিকে। লাল রঙ ছাওয়া পশ্চিমাকাশে তখন দিনের ঘরে ফেরার তাড়াহুড়ো চলছে। সূর্যটা অন্ধকারের ছাউনির তলে গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করছে।

বিনু প্রফেসরদাদুর বাড়ির বাইরের গেটটা খুলতেই দাদু নিজে এসে বারান্দার কোলাবসিবল গেটটা খুলে দিলেন। বিনু তো বিস্ময়ে হতবাক। কিছুক্ষণ কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিল। তারপর নিজেকে সামলে উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এসেছ? জানি না তো। কবে এলে? রুদ্রকাকুও এসেছে নাকি তোমার সঙ্গে?”

“এই তো কিছুক্ষণ আগে এলাম। না রে, আমি একাই এসেছি।”

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে চারদিকের ঝুল-ধুলোতে বিনুর গলা খুশখুশ করছিল। খুকখুক করে কেশে উঠল ও। বড়ো বড়ো মাকড়শার জালগুলো ঘরের সিলিং থেকে প্রায় তিন-সাড়ে তিন ফুট নীচে নেমে এসে ঝুলছে। দাদুর দিকে ফিরে বিনু বলল, “বাবাকে তোমার আসার খবরটা একটু আগে জানালে মা এই ঘরগুলো পরিষ্কার করে রাখত। এখন তুমি এত নোংরায় থাকবে কী করে?”

“আমি যে আসব নিজেই জানতাম না যে দাদুভাই।”

“মানে!” অবাক প্রশ্ন বিনুর।

এবার বিনুর কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে প্রশ্নের উত্তরটা দিলেন প্রফেসর রথীন আইচ। “মানে অনেক কিছু। তবে তোমাকে সব উত্তর দেওয়ার আগে আমাকে সব গুছিয়ে একটু বসতে হবে। কিছু জিনিসও দেখাতে হবে তোমাকে।”

“কী দেখাবে দাদু? আমার জন্য রোবট এনেছ? জানো তো বাবাকে কত করে বলেছিলাম, অফিস ট্যুর সেরে ফেরার পথে আমার জন্য একটা রোবট কিনে আনতে। আনলই না। তুমিই বলো দাদু, আমি ছোটোবেলা থেকে তোমার মুখে শুধু এই যন্ত্রটার গল্পই শুনে এসেছি। তোমাকে বানাতেও দেখেছি। কাকু বিদেশে গিয়ে এসব বানিয়েছে, তাও শুনেছি। তাই তো এখন থেকেই রোবট নিয়ে…”

মাঝপথে বিনুর কথা থামিয়ে দিয়ে একটু উত্তেজিত হয়েই প্রফেসর রথীন আইচ বলে উঠলেন, “না না, আর রোবট নয়, অ্যান্টিরোবট গড়বে তুমি। আমি তোমাকে শিখিয়ে যাব তার ডেভেলপমেন্টাল কোড।”

দাদুর এরকম একটা কথায় এবার কিছুটা যেন ঘাবড়ে গেল বিনু। বিনু স্কুলে কম্পিউটারের ক্লাসে জেনেছে অ্যান্টিভাইরাস শব্দটা। যে-সমস্ত দুষ্টু ভাইরাস কম্পিউটারের সিস্টেমে বিবিধ কৌশলে প্রবেশ করে তার কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়, সেই ভাইরাসকে নষ্ট করতে আর মেশিনকে সুস্থভাবে সচল রাখতেই অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অ্যান্টিরোবট কথাটা এই প্রথমবার শুনছে ও। মনে মনে ভাবছে বিনু, তবে কি এই অ্যান্টিরোবটও সেরকমই কিছু? মানে দুষ্টু রোবট ধ্বংস করার যন্ত্র?

বিনুর ভাবনায় ছেদ ফেলে বৃদ্ধ রথীনবাবু বলে উঠলেন, “বিনু, তুমি এখন ঘরে যাও। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবার এসো আমার কাছে। আমি জেগে থাকব। এর মধ্যে আমি সব জিনিস একটু গুছিয়ে নিই। তাতে করে তোমাকে সবকিছু বোঝাতে একটু সুবিধে হবে।”

বিনু মাথা নেড়ে সম্মত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই রথীনবাবু ওকে ফিসফিস করে বলেলেন, “শোনো, তোমাকে খুব দরকারি কিছু কথা আমার বলার আছে। সে-সব কথা পাঁচকান হলে বিপদ হতে পারে। সে বিপদ শুধু তোমার আমার নয়, সারা দেশ ও দশের বিপদ। তাই কাউকে আপাতত জানিও না যে আমি এখানে এসেছি। বুঝলে?”

কথাগুলোর কার্যকারণ সম্পর্ক বিনুর মাথার উপর দিয়ে টপকে বেরিয়ে গেল। তবু ও মাথাটা কাত করে ‘হ্যাঁ’ জানাল।

ঘরে এসে বিনুর মোটেই মন টিকছিল না। দাদুর কথার সঠিক অর্থ জানার ও বোঝার কৌতূহল ওকে রোবট না পাওয়ার সব রাগ অভিমান ভুলিয়ে দিয়েছে। শুধু ঘড়ির দিকে ঘন ঘন তাকিয়ে রাতে সবার শুয়ে পড়ার অপেক্ষা করছে ও। রাতের খাবার খেয়ে ও মাকে জানাল, একটু ড্রয়িং করার ইচ্ছে হয়েছে ওর। তাই স্টাডি রুমে যাচ্ছে। বিনুর মা ভাবল তাতে করে যদি ছেলে রোবট না পাওয়ার শোক ভুলে যায়, তাই ভালো।

বিনু স্টাডি রুমে ঢুকে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল সাড়ে দশটা বাজে। আর একঘণ্টার মধ্যেই সবাই ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর ও বেরোবে এখান থেকে। জানবে প্রফেসরদাদুর গুপ্তকথার ভাণ্ডার। এসব কথা ভাবতেই শিহরন খেলে গেল বিনুর সারা শরীরে। তারপর চেয়ারটা টেনে নিয়ে আঁকার খাতা আর রঙ পেন্সিলের বাক্সটা খুলে একটা রোবট আঁকতে শুরু করল ও।

কিছুক্ষণের মধ্যে ওর খেয়াল হল বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। আস্তে করে চেয়ারটাকে পেছনে সরিয়ে এক পা দু-পা ফেলে যতটা সম্ভব আওয়াজ না করে সদর গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এল বিনু। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল প্রফেসরদাদুর ঘরের সামনে। আলতো স্বরে দাদুকে ডাকতেই তিনি বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। দরজাটা খুলে দিয়ে ইশারায় ভেতরে আসতে বললেন।

বিনু দাদুর ঘরে গিয়ে দেখল রঙবেরঙের খেলা চলছে সেখানে। অদ্ভুত সব মায়াবী আলোয় ঘরটা ভেসে যাচ্ছে। টেবিলের উপর একটা ছোট্ট ল্যাপটপ টাইপের যন্ত্র রাখা আছে। কিন্তু সেটা ল্যাপটপ ঠিক নয়। কারণ, তার স্ক্রিনের দু-দিকে দুটো হাতের মতো যান্ত্রিক অংশ রয়েছে। প্রফেসরদাদু যন্ত্রটার দিকে চেয়ে বললেন, “শাট ডাউন ল্যাপি।”

বিনু অবাক হয়ে দেখল, যন্ত্রটার বাঁদিকের হাতটা কিবোর্ডের দিকে ঘুরে গিয়ে কিছু বাটান প্রেস করল। তার প্রায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ল্যাপটপটা বন্ধ হয়ে গেল। বিনু ‘শাট ডাউন’ শব্দটার মানে ভালোমতোই জানত। যে-কোনো ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ বন্ধ করার জন্য এই শব্দ লেখা অপশনটিকে কার্সার দিয়ে চুজ করতে হয়। তবেই সিস্টেম বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে সে-কাজটা যন্ত্রটার বাঁহাত করে দিচ্ছে।

প্রফেসর আইচ তারপর একটা নীল রঙের ডায়েরি টেবিলের উপর রেখে বিনুকে একটা চেয়ার টেনে বসতে বললেন। বেশ গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করলেন তিনি, “শোনো, তোমাকে ডেকেছি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য। তুমি জানো, আজ প্রায় তিন দশকের উপর হল আমি রোবটিক্স নিয়ে গবেষণা করছি। সেই সূত্রে ইলেক্ট্রনিকসের অনেক কিছুই ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। রাত জেগে প্রোগ্রামিংয়ের উন্নত ভার্শন শিখেছি। আট বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে একটা রোবটও তৈরি করেছিলাম ২০১২ সালের শেষে। তাকে আরও স্বয়ংক্রিয় করতে আমার আরও দেড় বছর লেগে গিয়েছিল। আমার ছেলে রুদ্র তখন আমারই গবেষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে সেই কাজে ব্রতী হয়েছিল। প্রথম দু-বছরেই ওর কোডিংয়ের হাত দেখে আমি বুঝেছিলাম যে, ছেলে বুদ্ধিমত্তায় আমার চেয়ে বেশ উপরে। তাতে খুব আনন্দও হয়েছিল আমার। বাবার গবেষণার হাল ছেলে ধরে এগোবে, এক বাবার কাছে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। তারপর রুদ্রর কাজের খ্যাতি ওকে বিদেশে নিয়ে গেল। ও সেখানে প্রথমে ম্যানুফ্যাকচারিং কাজে সাহায্যকারী রোবট তৈরি করেছিল ২০১৭ সালে। তারপর মহাকাশ গবেষণা ও সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য রোবট তৈরি করে ফেলেছিল ও দেড় বছরের মধ্যে। এরপর এল এক অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ, অনুভূতিশীল রোবট তৈরি করতে হবে। যে রোবট কিনা ডিজিটাল সিগনালে রেসপন্স করা ছাড়াও তার বিপরীতে বসে থাকা মানুষের বিবিধ আচরণের প্রতিও রেসপন্স করবে। মানে সুখ, দুঃখ, রাগ ইত্যাদি বুঝতে ও প্রকাশ করতে পারবে। এই কাজে সুবিধের জন্যই ও আমাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে এই কাজের মধ্যে থেকে আমি বুঝতে পেরেছি যে, মানুষের কত খারাপ দিন আসতে চলেছে ভবিষ্যতে।”

এই অবধি কথা বলে একটু থামলেন প্রফেসর আইচ।

বিনুর মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত কৌতূহলজাত কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল তখন, “কেন? কীসের খারাপ দিন?”

প্রফেসর আইচ তখন ল্যাপটপটার দিকে ফিরে বললেন, “প্লিজ ল্যাপি, অন ইওর পাওয়ার।”

বলতেই বিনু অবাক হয়ে দেখল ল্যাপটপটার ডানহাতটা কিবোর্ডের কিছু বাটন প্রেস করে মেশিন অন করে দিল। বিনু গোটা ঘটনাটা হাঁ করে তাকিয়ে দেখল। বুঝতে পারল, ওর প্রফেসরদাদু ল্যাপটপটাকে ‘ল্যাপি’ নামে ডাকেন।

প্রফেসর আইচ ল্যাপটপের স্ক্রিনের মধ্যে আরেকটা ছোটো ব্ল্যাক স্ক্রিন অন করে কীসব কোডিং লিখতে শুরু করলেন আর নরম গলায় বললেন, “বুঝলে বিনু, আমি যখন প্রথম এই রোবট তৈরি করার কথা ভেবেছিলাম, তখন চেয়েছিলাম যে রোবট সেইসব কাজ করে মানুষকে সহযোগিতা করবে, যেগুলো মানুষের ক্ষমতার বাইরে। যেমন ধরো, ম্যানুফ্যকচারিং রোবট ভারী ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করবে, মানুষের ক্ষেত্রে যা করা বিপজ্জনক সে-সব কাজ সামলাবে। স্যাটেলাইট রোবট মহাকাশের অজানা তথ্য এনে দেবে ইত্যাদি। কিন্তু কখনও এটা ভাবিনি যে মানুষ যে-কাজটা সহজেই করে ফেলতে পারে, সেইকাজগুলোও তারা করবে। আর এইভাবে একদিন বিপুল পরিমাণে রোবট তৈরি হয়ে মানুষের গাড়ি চালিয়ে দেবে, ঘরের কাজ করে দেবে, জমি চাষ করে দেবে, ডাক্তারের মতো অসুখ প্রেডিকশন করে ওষুধ লিখে দেবে, উকিলের মতো লজিকাল যুক্তি দেখাবে… আর হয়তো এভাবে এগোতে এগোতে এই রোবটের সঙ্গেই মানুষ বন্ধুত্ব করবে, খেলবে, সময় কাটাবে। সেদিন উন্নত সেন্সিটিভ রোবটগুলো হয়তো রাগ, দুঃখ, সুখ অনুভব করতে পারবে। কিন্তু মানুষ অনুভূতিহীন হয়ে পড়বে। অলরেডি ‘সোফিয়া’ নামে এক রোবটের সেন্সিটিভ রেসপন্স টেস্ট করে সৌদি আরব তাকে মানুষের মতো সিটিজেনশিপ দিয়ে দিয়েছে। কথা হল গিয়ে এভাবে মানুষের সব কাজ রোবট করে দিলে মানুষ কী কাজ করবে? খাবে কী? আর বাঁচবেই-বা কী করে?”

“এসব কী বলছ দাদু? তাহলে তো বলাইয়ের বাবা আর গাড়ি চালানোর কাজ পাবে না।” সরল প্রশ্ন বের হয়ে এল বিনুর সীমিত চিন্তাজগৎ থেকে।

“শুধু বলাইয়ের বাবাই নয়, আর দশ বছর পর তোমার বাবাও কাজ পাবে না। ফাইন্যান্স শিখে সফটওয়্যার বেসড রোবট সব অফিস চালাবে। এইসব যন্ত্ররা সারাদিন ধরে একনাগাড়ে কাজ করবে। তারপর দিন বা রাতের একটা সময়ে শুধু তাদের চার্জ দিতে হবে। ভয়াবহ দিন আসছে সামনে। বলে না, অতি মন্থনে বিষ ওঠে! তাই হতে চলেছে। সভ্যতার দণ্ডকে উন্নতির সাগরের মাঝখানে রেখে মানুষের মস্তিষ্ক ও টেকনোলজির দড়ি কষাকষিতে এবার সমাজের জন্য অমৃত নয়, শুধু বিষই উঠে আসবে।”

“এসব রোধের কি কোনও উপায় নেই দাদু?”

“সেই উপায় বের করেই তো আমি তোমার কাছে এসেছি। ওই দেশে সব বিজ্ঞানীরা, এমনকি আমার ছেলেও আমার মতের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। রুদ্র তো টাকার লোভে পাগল হয়ে গেছে। ও ঠিক করেছে যে ওই উন্নত রোবটগুলো এক এক করে ভারতীয় বাজারে আনবে। মোটা টাকার পরিবর্তে ও সেগুলোকে এখানকার বড়ো রোবটিক্স কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেবে। আমি প্রতিবাদ জানাতেই আমাকে… যাই হোক, আমি গত নয় মাস ধরে পুরো চুপ করে ছিলাম। কোনও প্রতিবাদ না করে ওদের কোডিংগুলোতে সাহায্য করার নামে সব কোডের অ্যান্টিকোড বানিয়ে ফেলেছি যেগুলো প্রোগ্রামিংয়ের সাহায্যে একটা অ্যান্টিরোবট তৈরি করতে পারবে। এই দেখো এমন দেখতে…”

বিনু অবাক হয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনে চেয়ে দেখল প্রফেসরদাদুর সৃষ্টি এক নীলাভ যন্ত্রাংশ। ঘরে ঢোকার সময় এই যন্ত্রটা থেকেই সম্ভবত ওই মায়াবী আলোটা বের হচ্ছিল। মাঝে ল্যাপটপ বন্ধ করার সময় সেটা ছিল না।

প্রফেসর আইচ বলে যাচ্ছিলেন ক্রমাগত, “এই ডায়েরিতে সব লেখা আছে ডিটেলে, স্টেপ বাই স্টেপ। আমি এখানে আসার কয়েকদিন আগে এই ডায়েরির খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল রুদ্র। তাই আমার আর এ বিশ্বে থাকা হল না। কিন্তু আমিও সব বুঝে আগে থেকে এ ডায়েরিটাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম এই বাড়ির ঠিকানায়। গতকাল বিকালে এখানে এসেছে এটা। তুমি কিন্তু সাবধানে রাখবে এই সম্পদটাকে। মনে রাখবে, আমি তোমার উপর দেশের আর দশের ভালোর জন্য এক বিশাল কাজের দায়িত্ব তুলে দিয়ে যাচ্ছি। তুমি যদি রোবটিক্স নিয়ে পড়াশোনা নাও করো, অন্য কোনও সৎ বৈজ্ঞানিকের হাতে এ-কাজের দায়িত্ব তুলে দেবে।”

“কী করবে এই অ্যান্টিরোবট?”

বিনুর প্রশ্নের উত্তরে বেশ রাগের সঙ্গে বলে উঠলেন প্রফেসর আইচ, “যে রোবট মানুষের স্থান দখল করে নিয়ে, তাকে অনাহারের পথ দেখায়, তাদের ধ্বংস করে দেবে অ্যান্টিরোবট। কিন্তু বাকি রোবটদের কোনও ক্ষতি করবে না।”

“আমি কি একবার ডায়েরিটা খুলে দেখব দাদু?”

বলতেই মায়ের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল বিনুর। টেবিল থেকে মাথা তুলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল ও। স্বপ্ন আর জেগে ওঠার মধ্যিখানের ঝাঁকুনিটা সামলে উঠতেই মায়ের কান্নাভেজা গলায় শুনল খবরটাকে। প্রফেসরদাদু নাকি আর নেই। গতকাল দুপুরেই হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেছেন উনি।

বিনুর যেন হাত-পা চলছিল না খবরটা শুনে। ও গতকাল রাতে এই স্টাডি রুমের চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর যা কিছু দেখেছিল, জেনেছিল সবটাই তাহলে স্বপ্ন ছিল? তা কী করে সম্ভব? তবে যে গতকাল বিকালে ও প্রফেসরদাদুর বাড়িতে গিয়ে ঢুকেছিল! ওর সঙ্গে কথা বলেছিলেন দাদু। ভেবেই দু-চোখ কচলে বিনু এক ছুট লাগাল প্রফেসরদাদুর বাড়ির দিকে। সেখানে বাইরের গেট খুলে বারান্দার কাছে যেতেই দেখল, একটা প্যাকেট পড়ে আছে। বিনু গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে হাতটা ভেতরে গলিয়ে কোনোরকমে নিল প্যাকেটটাকে। তারপর এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ছিঁড়েই ফেলল। অবাক হয়ে গেল দেখে, ভেতরে একটা নীল রঙয়ের ডায়েরি আছে। এ তো সেই ডায়েরি! স্বপ্নে যে-ডায়েরি প্রফেসরদাদু ওকে দিয়েছিলেন। তবে কি স্বপ্নই ছিল সবটা? নাকি সত্যি?

ভাবতেই ওর চোখ পড়ল ডায়েরির উপরের লেখাটার দিকে। প্রফেসর রথীন আইচের নামের নীচে লাল কালি দিয়ে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে ‘কনফিডেন্সিয়াল’।

অলঙ্করণ-জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s