গল্প-ম.জা.রু. এলো বঙ্গে-সোমনাথ ভট্টাচার্য-শীত ২০২১

golpomojaru

মেইলটা দেখেই খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন বাসন্তীর চিফ মেডিক্যাল অফিসার কুমুদবাবু। হাতে মাত্র পনেরো দিন সময়, কী একটা বড়সড় ঘূর্ণিঝড় নাকি আবার আসতে চলেছে; আর তার মধ্যেই গোটা এলাকার সবার র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করিয়ে ফেলতে হবে। সরকার কড়া নির্দেশ জারি করেছে, ঝড়ের সময় যে রিলিফ ক্যাম্পগুলি ব্যবহার হবে তাতে যেন কোনোভাবেই কোভিড পজিটিভ আর নেগেটিভ এক না হয়ে যায়। এদিকে গ্রাম একটা নাকি? বাসন্তী, আমঝাড়া, ভারতগড়, ফুল মালঞ্চ, ঝড়খালি আরও কত কী। একটু চিন্তা করেই তিনি মনস্থির করে ফেললেন, যেভাবেই হোক কাজটা উদ্ধার করতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি অফিসিয়াল হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে একটা গুগল মিটের লিঙ্ক পাঠিয়ে দিয়ে ১৫ মিনিট পর সবাইকে জয়েন করার অর্ডার দিলেন। এই সময়টুকু তিনি নিজে পুরো প্ল্যানটা একবার ছকে নিতে চান। ফটাং করে কম্পিউটারটা চালিয়ে দিয়ে আপাতপ্রাপ্ত ডেটাগুলোর ওপর তিনি একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন স্টকে কত কিট আছে, আর কত লাগবে সেই হিসেব করে নিয়ে জরুরি মেইলটা করে দিলেন রিকুইজিশন জানিয়ে। চটপট একটা ছক বানিয়ে ফেললেন কাকে কোন জায়গার গ্রুপ লিডার বানানো হবে তাই নিয়ে। এত কিছুর মধ্যেও ওঁর মনটা কিন্তু খুঁতখুঁত করতেই থাকল, কিছু একটা অসঙ্গতি কোথাও একটা আছে। কিছু একটা গণ্ডগোল যেন আছে, কিন্তু সেটা কী কিছুতেই ঠাওর করতে পারছেন না।

এই ক’দিন প্রচণ্ড পরিশ্রম গেছে কুমুদবাবুর। শুধু তাঁরই নয়, তার টিমের সব ক’জনের। দিনরাত এক করে তাঁরা ছুটে গেছেন, না না থুড়ি, নৌকা করে ভেসে গেছেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। কোনও ভয়কেই পশ্রয় দেননি, যদিও এখানে ডাঙায় বাঘ জলে কুমির। মাথায় একটাই সংকল্প, সুন্দরবনের নোনা জলের এই সরল, সাধাসিধে মিষ্টি লোকগুলোকে বাঁচাতে হবে কোভিডের ছোঁয়াচ থেকে। সফল হয়েছেন তাঁরা সেই সংকল্প পূরণ করতে। ঝড় আসার দু-দিন আগেই তাঁরা ওই অঞ্চলের সমস্ত লোকের টেস্ট করিয়ে পজিটিভ, নেগেটিভ আলাদা আলাদা তালিকা তৈরি করে ধরিয়ে দিয়েছেন বিডিওর কাছে, আর এক কপি মেইল করে পাঠিয়ে দিয়েছেন সদর দপ্তরে, স্বাস্থ্য ভবনে। সেই অনুযায়ী ঝড় আসার আগে আলাদা আলাদা রিলিফ ক্যাম্পে তুলে এনে রাখা হয়েছে সব লোকেদের। প্রশাসন প্রচণ্ড সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি রেখেছে যাতে কোভিড পজিটিভ আর নেগেটিভ মিশে না যায়। তাহলে গোটা সুন্দরবন জুড়ে হাহাকার পড়ে যাবে।

ঝড়ের পরদিন কুমুদবাবু নিজের ঘরে বসে মুঠোফোনে দেখছেন ঝড়ের খবরাখবর। লোডশেডিং তাই টিভি বন্ধ, কবে আসবে কোনও ঠিক নেই। ভাগ্যিস ইন্টারনেটটা অন্তত আছে। ঝড়ের এই রূপ তিনি আগেও দেখেছেন, কিন্তু এবার ভরা কোটাল থাকায় ক্ষতি অনেক বেশি। বাঁধ ভেঙেছে প্রচুর, তলিয়ে গেছে চাষের জমি, ভেসে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। খবর দেখতে দেখতেও কিছু একটা অসঙ্গতি আছে বলে মনে হল ওঁর, কিছু একটা মিলছে না যেন। কিছু একটা মিসিং, সব জায়গাতেই মিসিং। সেটা কী?

ভাবতে ভাবতেই নিজের ইজিচেয়ারে ঘুমিয়ে পড়লেন কুমুদবাবু। দেখলেন, তিনি স্পিড বোটে দ্রুত ভেসে চলেছেন নদী দিয়ে, একটা ইয়াবড়ো কুমির হাঁ করে তাড়া করেছে তাঁকে, যেন এখুনি গিলে খাবে। নদীর পাশে পাশে হেঁতালের ঘন ঝোপের পাতার আড়াল ভেদ করে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে ডোরাকাটা হলুদের আভা, ছুটে চলেছে সেটা স্পিড বোটের সঙ্গে সমান তালে আর মাঝে মাঝে হাড় হিম করা ডাকে তার খিদের জানান দিচ্ছে। বাতাসে গোল গোল রবারের বলের মতো অসংখ্য গোলা, যাদের গায়ের চারদিকে গদার মতো কাঁটা লাগানো, ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে কাঁটা বাগিয়ে। বাতাসে একটা ভ্যাপসা বোঁটকা গন্ধ। স্পিড বোটে বসে ভয়ের চোটে হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে পেটের ভিতর। হঠাৎ বোটটা এসে দুরুম করে ঠেলে উঠল একটা দ্বীপে। আর কী আশ্চর্য, কুমির-বাঘ সব থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল আর সেই বীভৎস কাঁটা লাগানো বলটা এক্কেবারে ভ্যানিশ।

ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসলেন কুমুদবাবু। কিছুতেই না মেলা অঙ্কের সমাধানের সূত্রটা যেন আবছা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মাথার ভিতর। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে জেনারেটর চালিয়ে খুলে ফেললেন কম্পিউটার। সেই সময়েই পিরিং পিরিং করে ক’বার বেজে উঠেই থেমে গেল কুমুদবাবুর ফোনখানা। অন্যমনস্ক হয়ে একবার চোখ মেলে দেখলেন স্বাস্থ্য ভবনের মিসড কল, টাওয়ার চলে গেছে ফোনে তাই হয়তো কেটে গেছে। ফোনটা পাশে রেখে তিনি একমনে কম্পিউটারে কোভিড রিপোর্টের ডেটাগুলো ভালো করে আবার দেখতে থাকলেন। দেখতে দেখতে চোখ আর ভুরু দুটি কুঁচকে উঠল কুমুদবাবুর। ভারি অবাক ব্যাপার তো! সব গ্রামেই বেশ কয়েকজন পজিটিভ পাওয়া গেছে, একমাত্র হোগোল নদীর পাড়ের সোনাখালি গ্রাম ছাড়া। তিনি আবার একবার তালিকা মেলাতে থাকলেন মন দিয়ে। চড়াৎ করে মাথায় খেলে গেল, আজ সকালের খবরেও তো এটাই ছিল। আশেপাশের সব গ্রাম বাঁধ ভেঙে জলের তোড়ে ভেসে গেলেও সোনাখালি কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ভারি অবাক ব্যাপার তো! আশেপাশের সব গ্রামে কোভিড পজিটিভ আছে, সোনাখালিতে নেই। ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সব গ্রাম, সোনাখালিতে কোনও প্রভাব পড়ল না। এমন হয় নাকি? বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন কুমুদবাবু। ভাবলেন, কাল সকালেই একবার সরেজমিনে দেখে আসতে হবে।

পরের দিন ভোর থাকতে থাকতেই বোটে চেপে রওনা দিলেন কুমুদবাবু সোনাখালির উদ্দেশ্যে। কাল রাতেই ফোনের টাওয়ার আসার পরই নিখিল আর উদয়কেও নির্দেশ দিয়েছেন সোনাখালি আসার জন্য। ওরা দুজন কুমুদবাবুর বিশ্বস্ত সহকর্মী। এবার কোভিড টেস্টের প্রোগ্রামে এই দুজনেই ছিল কো-অর্ডিনেটর। বলা যায় ওদের দুজনের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যই এবার সসম্মানে উতরে গেছেন কুমুদবাবু। বোটে যেতে যেতে চারদিকে ধ্বংসের ছবি দেখে শিউরে ওঠেন উনি। বড়ো বড়ো কত গাছ দুমড়ে পড়ে আছে যেন মাতাল হাতির দল চরম রোষে উপড়ে ফেলেছে সব। যেদিকে চোখ যায় শুধু জল আর জল, জলের নীচে চাপা পড়ে গেছে সোনার বাংলার সোনার ফসল। কত যে ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। চারদিক থেকে ভেসে আসছে শুধু হাহাকার আর কান্না।

মনটা বড়োই খারাপ হয়ে গেল কুমুদবাবুর। প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়। বাঘ-কুমিরের সঙ্গে এক ঘরেই এদের বাস, তাও এরা ঠিক মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। তারপর কোভিডের গুঁতোয় আর লক ডাউনের জ্বালায় এরা বেসামাল হয়ে পড়েছিল। তারপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো উড়ে এসে জুড়ে বসল এই সাংঘাতিক ঝড়। এত কষ্ট কেন এই সাধাসিধে গরিব-গুর্বো মানুষগুলোর? ভগবান, তোমার কি চোখ নেই? মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কুমুদবাবু। দেখতে পেলেন, একপাল শকুন গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ নেমে আসছে নীচের দিকে।

বোটটা এসে লাগল সোনাখালি গ্রামে। একটু আগেই ম্যানগ্রোভের বাড়বাড়ন্ত খেয়াল করেছিলেন কুমুদবাবু। এবার বোট থেকে নামার আগে চোখ ঘুরিয়ে ভালো করে চারদিকটা দেখলেন। অসংখ্য ম্যানগ্রোভ ঘিরে ধরে আছে গোটা দ্বীপটাকে। বুঝলেন, সোনাখালিতে বাঁধ ভেঙে জল না ঢোকার কারণ।

হোগোল নদী থেকে সোনাখালি গ্রামে ঢোকার ঘাটটাতেই নিখিল আর উদয়ের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে গেল কুমুদবাবুর। দেখা হতেই নমস্কার জানিয়ে কী যেন বলতে গেল ওরা। কুমুদবাবু বলে উঠলেন, “কথা পরে হবে। এখন আমি যা বলি মন দিয়ে শোনো। আসার সময় ফোন এসেছিল স্বাস্থ্য ভবন থেকে। ওরা আমাদের পাঠানো রিপোর্ট নিয়ে খুশি নয়। এই গ্রামে একজনও কোভিড পজিটিভ নয়, এটা ওরা মানতে পারছে না। রি-চেক করে কাল সন্ধ্যার মধ্যে ফ্রেশ রিপোর্ট পাঠাতে হবে। কয়েকজনকে এখুনি কিট নিয়ে চলে আসতে বলো এখানে।” বলতে বলতে ঘাট থেকে গ্রামে ঢুকেই থমকে গেলেন উনি। ঝড়ের লেশমাত্র নেই গ্রাম জুড়ে। চারদিকে এত সবুজের সমারোহ। পুব-আকাশের মিষ্টি আলোয় হলদে-সোনালি ধানের শীষগুলো সোনা রূপ ধারণ করে মাথা দোলাচ্ছে। একটুকরো রোদের ঝলক মাঠে ধান-কাটা মানুষগুলোকে যেন ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে; কিছু মানুষ মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে ধান কেটে আটি বেঁধে রাখছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন কুমুদবাবু। যেন কোন এক দারুণ জাদুবলে প্রবল ঝড়েও এই সোনাখালি গ্রামের সোনা একটুও খালি হয়নি। আনন্দে দু-চোখে জল এসে গেল কুমুদবাবুর। ভগবানকে ধন্যবাদ দিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন এক ঝাঁক সাদা পায়রা উড়ে বেড়াচ্ছে ঝটপট করে মাথার একটু ওপরে।

পুকুরপাড়ে গাছের ছায়ায় একটা বেঞ্চির ওপর বসে গ্রামের লোকের দেওয়া মুড়ি-নারকেল আর চা খেতে খেতে পুকুরে চরে বেড়ানো হাঁস আর মাছের দঙ্গলের ঘাই মারা দেখতে দেখতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে কুমুদবাবু বললেন, “পুকুরে মাছ, মাঠে ফসল আর বাতাসে শান্তি – একেই সোনার বাংলা বলে, বুঝলে।”

হঠাৎ নিখিল বলে উঠল, “স্যার, দিন দশেক আগেও যখন এখানে এসেছিলাম তখন কিন্তু এমন ছিল না। এখানের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যখন সবার টেস্ট হচ্ছিল তখন তো লাঠালাঠি বেঁধে গেছিল কে আগে টেস্ট করাবে তাই নিয়ে। আর এত সুন্দর সোনালি ফসল তো কই সেদিন চোখে পড়েনি।”

উদয় পকেট থেকে মোবাইল বার করে কুমুদবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “ঝড়ের যাত্রাপথের ডিজিটাল ছবি এতে ডাউনলোড করা আছে। একবার দেখুন স্যার। ঝড় কিন্তু চুনাখালি, সজনেখালি, ঝরখালি, গদখালি, সোনাখালি… এই পথ দিয়েই গেছে।”

ছবিটা মন দিয়ে দেখলেন কুমুদবাবু। উদয় একদম ঠিক কথাই বলছে। মুখে বললেন, “কিন্তু প্রকৃতির রহস্য তো এখনও আমাদের কাছে প্রায় পুরোটাই অজানা। কোন খেয়ালে প্রকৃতি তার রোষের আগুন থেকে এই গ্রামকে নিস্তার দিয়েছেন সে স্বয়ং তিনিই জানেন।”

“আমি জানতাম ঝড় হবে না।”

চমকে উঠে পিছনে তাকালেন তিনজনেই। একটা বাচ্চা ছেলে, বছর দশেক বয়স, টগরগাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়ে। ইশারায় কাছে ডেকে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন কুমুদবাবু, “তোমার নাম কী?”

“পুপুন।”

“তুমি জানতে ঝড় হবে না?”

“হ্যাঁ, জানতাম।”

“কেমন করে জানলে?”

“মজারু বলেছে।”

“মজারু কে?”

“আছে একজন।”

“তোমার বন্ধু?”

“হ্যাঁ, বন্ধু।”

“কোথায় থাকে সে?”

দূরে গ্রামের কোণে বনের দিকে ইশারা করে দেখাল পুপুন, “ওইখানে।”

কুমুদবাবু ভাবলেন, বাড়ি ফেরার যখন কোনও তাড়া নেই, তাছাড়া এত সুন্দর গ্রামে এসে মনটা যখন ভরে গেছে, একটু ঘুরেই দেখা যাক না গ্রামখানা।

“আমাদের নিয়ে যাবে তোমার বন্ধুর কাছে?”

পুপুন কোনও কথা না বলে এগিয়ে এসে কুমুদবাবুর হাত ধরে টান দিল।

নানারকম মজার কথা বলতে বলতে চারজন এগিয়ে গেল বনের দিকে। পুপুন ভারি মজার ছেলে। যেতে যেতে কত গল্পই সে শোনাল—ইউ.এফ.ও, রোবট, ভিনদেশি প্রাণী। ওর গল্প শুনতে শুনতেই বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল ওরা। একটা জায়গায় এসে হঠাৎ কুমুদবাবুর হাত ছেড়ে একটু দৌড়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল পুপুন।

“কী হল পুপুন?”

“ভ্যানিশ।”

“কী ভ্যানিশ?”

“মজারুর ঘর।”

“কারও ঘর কখনও ভ্যানিশ হয় নাকি? তুমি জায়গা গুলিয়ে ফেলেছ।”

“এখানেই ছিল। ওই দেখো।”

পুপুনের নির্দেশ করা আঙুলের দিকে তাকিয়ে কুমুদবাবুরা দেখতে পেলেন একটা ছোটো পেঁপেগাছের মতো গাছ, কিন্তু গাছের রঙটা সোনালি। কাছে গিয়ে মনে হল এটা ঠিক গাছ নয়। কিন্তু এ দুনিয়ায় তো কত গাছই আছে, ক’টা কেই-বা চেনেন ওঁরা। তাই পুপুনের কাছেই জানতে চাইলেন, “কী গাছ এটা?”

“এটা গাছ নয়।”

“তবে কী এটা?”

“প্রকৃতি শোধক।”

“সেটা আবার কী?”

“এটা প্রকৃতির দূষণ শুষে নেয়। দূষণ না থাকলে প্রকৃতি আবার আগের মতো হয়ে যাবে, জীবাণু-ভাইরাস কমে যাবে আর বছর বছর ঝড়ও হবে না।”

ওইটুকু ছেলের এত সুন্দর ব্যাখ্যায় যারপরনাই আনন্দিত হলেন কুমুদবাবু। সব বড়োরাও যদি এমন করে বুঝত তাহলে পৃথিবীটা সত্যিই কত সুন্দর হয়ে উঠত।

“স্যার, এখানে সত্যিই কিছু ছিল।” উদয় ভালো ফটোগ্রাফার, তাই অনেক কিছুই ওর চোখে ধরা দেয় যা আমরা সহজে ধরতে পারি না। এখানেও এমন কিছু নিশ্চয়ই ধরা পড়েছে ওর চোখে। এই ভেবে, কৌতূহলী হয়ে কুমুদবাবু এগোলেন উদয়ের দিকে, পিছন পিছন নিখিল।

গোল হয়ে একটা মোটা যথেষ্ট গভীর দাগ অনেক বড়ো একটা বৃত্তের মতো দেখা যাচ্ছে, ব্যাস প্রায় দশ ফুট হবে।

“এটা কীসের দাগ হতে পারে?” অনুসন্ধিৎসু গলায় বললেন কুমুদবাবু।

“নো আইডিয়া, স্যার।” ঘাড় নাড়ল নিখিল আর উদয় দুজনেই।

“ওখানে মজারুর ঘরের দেওয়াল ছিল।”

“এই, তুই তখন থেকে কীসব ভুলভাল বলছিস বল তো!” বিরক্তির স্বরে বলল নিখিল।

চুপ করে মাথা নামিয়ে নিল পুপুন। কুমুদবাবু এগিয়ে গেলেন পুপুনের দিকে। নিখিলের দিকে তাকিয়ে একবার চোখ টিপে ইশারা করে ভর্ৎসনার সুরে বললেন, “নিজে তো কিছু জানো না, যে জানে তাকে বলতেও দিচ্ছ না। একদম চুপ করে থাকো।”

তারপর পুপুনের মুখটা দু-হাতে ওপর দিকে তুলে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, “তুমি বলো তো পুপুন। যা জানো সব বলো।”

“অনেক দেরি হয়ে গেছে, এবার বাড়ি না গেলে মা বকবে।”

কুমুদবাবু বাম হাত আড় করে তুলে ঘড়িতে দেখলেন সত্যিই অনেকক্ষণ হয়ে গেছে তাঁরা গ্রামের বাইরে। “সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে আমাদেরও, নয়তো আমাদের মাও বকবে।”

পুপুনের হাত ধরে গ্রামে ফেরার পথ ধরে বললেন কুমুদবাবু।

“তোমাদের মাও বকবে?” খিলখিল করে হেসে বলল পুপুন।

“বকবেই তো।”

“বকবে কেন? তোমরা তো বড়ো হয়ে গেছ। মজারুকে তো কেউ বকে না।”

“মজারু বুঝি আমাদের মতো বড়ো?”

“তোমার থেকেও বড়ো। চুলগুলো তো সব সাদা হয়ে গেছে।”

এরপর যেতে যেতে অনেক কথাই বলল পুপুন। নিখিল আর উদয় নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগল। তাদের বাড়িতেও পুপুনের বয়সি ছেলেমেয়ে রয়েছে। তারা সারাদিন তাদের অলীক কল্পনার গল্প শোনে, তাই পুপুনের গল্পে তাদের মনোযোগ নেই। কিন্তু কুমুদবাবু মন দিয়ে পুপুনের কথা শুনে চলেছেন। তিনিও অনেক ছেলেপুলে দেখেছেন, খুব ভালোই জানেন বাচ্চারা অলীক কাহিনি ভালোবাসে, মনগড়া কাহিনি যখন তখন বলে। এখন যা বলছে খেই হারিয়ে একটু পরেই আবার অন্য কিছু বলে। কিন্তু পুপুন যে কথাগুলো বলছে সেটা একদম নির্দিষ্ট সুরে বাঁধা। কোনও একটা বিশেষ লোকের কথা সে বলছে আর সে লোকটা বিজ্ঞান নিয়ে কোনও গবেষণা করছে। মোটামুটি তার চেহারার যে বর্ণনা পেয়েছেন তা হল মাথাভর্তি সাদা চুল, একমুখ সাদা দাড়ি, চোখে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রঙের চশমা, সবসময় কম্পিউটারের সামনে বসে থাকে, খাবারদাবার খুব একটা খায় না তবে এখনকার দিনে প্রায় দুষ্প্রাপ্য কাঠি আইসক্রিম, টিকটিকি লজেন্স, কারেন্ট নুন এগুলো খুব ভালোবাসে। মনে মনে এটা ভাবছেন, পুপুন নিশ্চয়ই নিজের পছন্দের ওপর একটা রঙ চড়িয়ে একটা চরিত্র এঁকে নিয়েছে। তবে বনের ওই অত্ত বড়ো গোল বৃত্তটা আর সোনালি রঙের সেই অদ্ভুত পেঁপেগাছটা মন থেকে পুরো মুছেও দিতে পারছেন না।

হাঁটতে হাঁটতে মগ্ন হয়ে গল্প করতে করতে কখন যে তাঁরা পুপুনের বাড়ির সামনে এসে পড়েছেন খেয়ালও করেননি। হুঁশ হল পুপুনের কথায়।

“আমার বাড়ি এসে গেছে।”

“কোথায় ছিলিস রে এতক্ষণ? সেই মজারুর বাড়ি?” এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন পুপুনের বাড়ির ভিতর থেকে। এসেই অপরিচিত তিনজন শহরের মানুষ দেখে একহাত ঘোমটা টেনে নিলেন।

“আপনি নিশ্চয়ই পুপুনের মা? আপনিও চেনেন মজারুকে?” একটু মজার গলায় প্রশ্ন করলেন কুমুদবাবু।

সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ালেন ভদ্রমহিলা। বললেন, “আপনারা ভিতরে এসে বসুন।”

ভদ্রমহিলা কীসে সম্মতি জানালেন সেটা পরিষ্কার হল না কুমুদবাবুর কাছে – উনি পুপুনের মা সেটায়, না মজারুকে চেনেন সেটায়, না দুটোতেই। ঠিক করলেন দ্বন্দ্বটা পুরো কাটাতেই হবে। বিনা দ্বিধায় ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভিতর। গ্রামের মানুষের আতিথেয়তা তিনি জানেন, ঘরে আসা অতিথিকে না খাইয়ে ওঁরা ছাড়েন না, তাতে নাকি গৃহস্থের অকল্যাণ হয়।

হাত-পা ভালো করে টিউবওয়েলের কলে ধুয়ে বারান্দায় পাতা শীতলপাটিতে বসলেন কুমুদবাবুরা। ঘরে ঢোকার পর এখনও পুপুনকে একবারও দেখা যায়নি। এক গেলাস করে বাতাসার জল আর প্লেটে করে চারটে করে গুড়ের রসগোল্লা নিয়ে ভদ্রমহিলা আসতেই কুমুদবাবু এবার প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি মজারুকে চেনেন?”

এবারও ঘাড় একদিকে হেলিয়ে সম্মতি জানালেন ভদ্রমহিলা।

“আপনি কি তাকে দেখেছেন?”

আবার সম্মতিসূচক ঘাড় হেলানো।

এবার যথেষ্ট উত্তেজনায় কুমুদবাবু বললেন, “কবে, কোথায় দেখেছেন তাকে?”

এবার ঘোমটার ভিতর থেকে মৃদু আওয়াজ ভেসে এল, “পুপুনের জন্মদিনে, আমাদের বাড়িতে।”

যথেষ্ট চিন্তায় পড়ে গেলেন কুমুদবাবু। মজারু তবে পুপুনের কল্পনা নয়, বাস্তব। তবে কে সে? হঠাৎ করে হওয়া হয়ে গেল কেন? পুপুনের কোনও ক্ষতি করে দেবে না তো? এইটুকু সময়েই কুমুদবাবু যথেষ্ট ভালোবেসে ফেলেছেন পুপুনকে।

নিখিল আর উদয়ের খুব খিদে পেয়েছিল। তারা টাটকা গুড়ের রসগোল্লা বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিল। তারাও ভদ্রমহিলার শেষ কথায় খাওয়া বন্ধ করে একবার ভদ্রমহিলার দিকে আর একবার কুমুদবাবুর দিকে তাকাচ্ছে।

এরই মাঝে পুপুন হাজির হল বেশ মোটামতো একটা বই নিয়ে, বাড়িয়ে দিল কুমুদবাবুর দিকে। কুমুদবাবু পরম উৎসুক হয়ে তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে বইটা নিয়ে দেখতে চাইলেন নামটা। দেখেই তাঁর মুখটা হাসিতে ভরে গেল – ‘শঙ্কু সমগ্র’। এবার নিশ্চিন্তে তিনি মিষ্টি মুখে তুলে নিলেন। ছেলেটা তার এক বন্ধুকে নিয়ে কল্পনার রঙ চড়িয়ে তার নাম দিয়েছে মজারু। নিখিলদেরও দেখিয়ে দিলেন বইয়ের নামটা। তারাও নিশ্চিন্তে মনোযোগ দিল আধখানা মিষ্টিতে।

কুমুদবাবু তারপর ঢক ঢক করে বাতাসার জলটা খেতে খেতে পৃষ্ঠা ওলটালেন ছোটোবেলার প্রিয় সেই বইতে। আর পৃষ্ঠা উলটিয়েই চমকে গেলেন। প্রথম পৃষ্ঠায় সুন্দর পাকা হাতের লেখা – ‘পুপুনের জন্মদিনে – ভালোবাসা সহ – ম.জা.রু.’।

এ তো কোনও বাচ্চার হাতের লেখা নয়। জোর বিষম খেলেন কুমুদবাবু। ভদ্রমহিলা হাতপাখা নিয়ে এগিয়ে এলেন হাওয়া করতে। তার আগেই পুপুন শঙ্কু সমগ্র দিয়েই হাওয়া করতে গেল, আর বইয়ের ভিতর থেকে টুপ করে খসে কুমুদবাবুর কোলে এসে পড়ল একটা ভিজিটিং কার্ড যাতে ছাপানো ‘মইনুল জাস্টিন রুদ্র – প্রফেসর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি’। মুহূর্তে বিষম লাগা ঠিক হয়ে গেল কুমুদবাবুর। তাঁর হাতের কার্ডটার দিকে নজর পড়েছে নিখিল আর উদয়েরও। তারাও হাতে নিয়ে দেখেছে কার্ডটা। সবাই বিস্ময়ে হতবাক।

কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে কুমুদবাবু ফোন করলেন স্বরাষ্ট্র দফতরে।

“আমি বাসন্তীর চিফ মেডিক্যাল অফিসার বলছি। বিশেষ দরকারে এখুনি একটু স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”

একটু পরে ফোনে সাড়া এল, “হ্যাঁ বলছি, বলুন।”

“স্যার, একটা দারুণ খবর আছে। আমি সোনাখালি গ্রামে এসেছি। ম.জা.রু. মানে প্রফেসর মইনুল জাস্টিন রুদ্র এখানে এসেছিলেন।”

“হোয়াট! প্রফেসর ওখানে এসেছিলেন? কবে, কখন? এখন উনি কোথায়?” চেয়ারে লাফিয়ে উঠলেন স্বরাষ্ট্র সচিব।

“স্যার, জানি না উনি কোথায়। কিন্তু উনি এসেছিলেন তার প্রমাণ আমার হাতে আর একটা গোটা গ্রামকে উনি করোনামুক্ত আর ঝড়-রোধক করে দিয়েছেন।”

“আপনি ওখানেই থাকুন। আমি এখনই টিম নিয়ে আসছি।”

ফোনটা কেটেই স্বরাষ্ট্র সচিব খবর জানালেন মুখ্যমন্ত্রীকে আর প্রধানমন্ত্রীকে। সকলেই প্রচণ্ড বিস্মিত, তবে তার থেকেও বেশি আনন্দিত। ওই একটা লোকই পারেন দুর্দিনে এই বিশ্বকে বাঁচাতে। অতীতে অনেকবার অনেক অসাধ্যসাধন করেছেন তিনি—সুনামি-রোধক যন্ত্র, ভূমিকম্প-রোধক যন্ত্র, অগ্ন্যুৎপাত-রোধক যন্ত্র দিয়ে এই পৃথিবীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি তিনি বাঁচিয়েছেন। হঠাৎ একদিন ভারত আসার পথে প্লেন থেকে মাঝপথেই তিনি কোথায় যে গায়েব হয়ে যান কেউ জানে না। তাঁর সঙ্গে তাঁর সব আবিষ্কারও গায়েব। তাঁর ল্যাবরেটরিতে না পাওয়া যায় কোনও যন্ত্র, না কোনও কাগজপত্র। সব ভ্যানিশ। সারা বিশ্ব তোলপাড় করে সব দেশ মিলে খুঁজেছে তাঁকে বিগত দু-বছর ধরে। কিন্তু কেউ কোনও কূলকিনারা করতে পারেনি। আজ হঠাৎ অযাচিতভাবে এই খবর পেয়ে ঝড় আর কোভিডের দাপটে মুহ্যমান সরাষ্ট্র সচিবের মনটা ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে ওঁর মনে হল মেডিক্যাল অফিসার যা খবর দিল তার একটাই মানে হয়, ঝড়-রোধক আর কোভিড-রোধক যন্ত্র এবার তৈরি।

অলঙ্করণ-সায়ন মজুমদার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

2 thoughts on “গল্প-ম.জা.রু. এলো বঙ্গে-সোমনাথ ভট্টাচার্য-শীত ২০২১

  1. এত সুন্দর প্রচ্ছদের জন্য সায়ন মজুমদার কে অনেক ধন্যবাদ ও ভালোবাসা ।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s