অনুবাদ গল্প-মহাজ্ঞানীর মৃত্যু হতে পারে না-আর ডিউইট মিলার। অনু সম্রাট লস্কর-বসন্ত ২০২২

The Master shall not Die

(১)

golpomastershallnotdie

মহাজ্ঞানীর আজ হঠাৎ ইচ্ছে হল মৃত্যু কেমন হয় সেই অভিজ্ঞতাটা লাভ করতে। মৃত্যু হলে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হয়তো হারিয়ে যাবে, কিন্তু এই দীর্ঘ জীবনের পরিসমাপ্তি তো হবে। তাই-বা কম কী?

অন্ধকার দরজার ও-পারে কী এমন আছে যেখানে সময় সব মানুষকেই ঠেলে দেয়? সেই অজানা জগৎ নিয়ে তাঁর একটা হালকা কৌতূহল আছে। তবে মৃত্যুতেই যে বেঁচে থাকার ক্লান্তি থেকে মুক্তি, সেই সত্যটা তাঁকে আকর্ষণ করে বেশি।

না, এরকম ক্লান্তির অনুভব নতুন কিছু নয়। এই ঘরে বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান জটিলতর সমস্যাগুলো সমাধানে যখন নিয়োজিত থাকেন, সেই ব্যস্ত সময়ের মাঝেও কখনো-কখনো এই ক্লান্তি তাঁকে গ্রাস করে। বড়ো একা লাগে তাঁর। চিরন্তনের সামান্য কোনও অংশ সময়বদ্ধ পৃথিবীতে আটকে পড়লে যে-রকম অসহায় বোধ করে, সেইরকমই লাগে তাঁর।

মনে ভেসে আসে স্মৃতির টুকরো টুকরো অংশ—হাসি মুখ, বাড়িয়ে দেওয়া হাত, কোমল কণ্ঠস্বর। বন্ধু, সঙ্গী, সহকর্মী—পুরুষ এবং নারী, যাদের কোনও সময় তিনি ভালোবেসেছিলেন হৃদয় দিয়ে।

“এস, চলে এস।” ওরা আহ্বান করে, “আমাদের কাছে চলে এস। এখানে তো সবাইকে আসতেই হবে।”

কিন্তু না, উনি পারেননি প্রিয় মানুষদের ডাকে সাড়া দিতে। মহাজ্ঞানী অনেক কিছুই পারেন, শুধু পারেন না বৃদ্ধ হতে, মৃত্যুবরণ করতে। কোনও উপায়ই নেই তাঁর যদি না… তাঁর মনের গোপন এক কোণ থেকে উঁকি দিল দীর্ঘদিন ধরে লালিত এক পরিকল্পনা। ‘আমি যদি না মরতে পারি তাহলে আমি সকল মানুষকে অমর করে তুলব।’

বাস্তবের দিকে নিজের মনকে ফেরাতে মহাজ্ঞানী নিজের হাত দুটোর দিকে তাকালেন। হাত দুটোতে বয়সের স্পষ্ট ছাপ। তিরিশ বছর আগে এগুলো ছিল পেশিবহুল, সুডৌল, কিন্তু ‌‌‌‌‌এখন? পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চামড়ার ভাঁজ, বলিরেখা—নিশ্চিত বয়সের ছাপ।

আবার সেই প্রক্রিয়াটি শুরু করার সময় এসে গেছে। শারীরবিজ্ঞানের ঘড়ি উলটে দিতে হবে অন্যবারের মতোই, কারণ যে সর্বোত্তম মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের যাবতীয় জটিলতা বেঁধে রেখেছে এক সূত্রে, তার স্থান‌‌ কখনও বৃদ্ধের জরাগ্রস্ত শরীরে হতে পারে না। মহাজ্ঞানী বৃদ্ধ হতে পারেন না। বৃদ্ধ হলেই উনি মারা যাবেন, আর তা হলে বিগত হাজার বছর ধরে বিশ্ব জুড়ে যে কাঠামোটা গড়ে উঠেছে সেটা এক নিমেষেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে।

না, সেটা হতে দেওয়া যায় না। অন্তত এখনই নয়। মহাজ্ঞানীর মৃত্যু মানে যন্ত্রের জয় আর মানবসভ্যতার নিশ্চিত পরাজয়।

উনি বাজ়ার টিপে নিজের প্রধান সহকারীকে ডাকলেন। তারপর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে শেষ বিকেলের শহরের ব্যস্ততা। একটু নীচে তাকালেই চোখে পড়ে স্তরে স্তরে সাজানো ট্র্যাফিক লেন। সোজাসুজি তাকালে যে চক্রাকার চাতালটি দেখা যাচ্ছে সেটা ভিড়ে গিজ গিজ করছে। আরও দূরে তাকালে চোখে পড়ছে রকেট স্টেশনের উঁচু টাওয়ারগুলো। বিশাল প্রজেক্টরের ধাতব বাহুটি তাক করা অস্তগামী সূর্যের দিকে।

হ্যাঁ, মানবসভ্যতা সত্যিই অনেক উন্নতি করেছে। যন্ত্রকে বশ্যতা স্বীকার করাতে সমর্থ হয়েছে। প্রকৃতির সব রহস্যও সে সমাধান করেছে। শুধু একটা বাদে। একটা শেষ ধাপ।

“আপনি ডেকেছিলেন, মহাজ্ঞানী?”

“হ্যাঁ, হাবার্ড। ডোনার চলে এসেছে?”

“বাইরে অপেক্ষা করছে।”

“ওকে সব বুঝিয়ে বলা হয়েছে তো? ও জানে তো ওকে নিজের জীবন দিতে হবে?”

তিরিশ বছর পর পর সেই একই প্রশ্ন। অদ্ভুত লাগে। তাঁর চারপাশের লোকেরা সহকারী হোক বা টেকনিশিয়ান, বদলে গেছে বারংবার সময়ের নিয়ম মেনে। অনেকেরই নাম আজ মনে ‌‌‌‌‌নেই, অনেক মুখই ঝাপসা হয়ে এসেছে।

“হ্যাঁ, মহাজ্ঞানী। চিকিৎসকদের কমিটি যুবকটিকে বাছাই করার পরই সব জানিয়ে দিয়েছে। ছেলেটি নিজের জীবন দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।”

মহাজ্ঞানী কোনও উত্তর না দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। আবার তাঁকে দাঁড়াতে হবে সেই যুবকের সামনে যার জীবনের বিনিময়ে মহাজ্ঞানী ফিরে পাবেন নিজের হৃত যৌবন। তাঁর জীবন প্রলম্বিত হবে আরও তিরিশ বছর। মহাজ্ঞানীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এইরকম কত যুবককে আরও বলি দিতে হবে? খুবই অন্যায় এই ব্যবস্থাটা।

হাবার্ড মহাজ্ঞানীর বিষণ্ণতা লক্ষ করে নরম সুরে বলে উঠল, ”আপনি মহান কাজে ব্রতী। মানবসভ্যতাকে রক্ষা করে চলেছেন আপনিই।”

মহাজ্ঞানী মাথা নাড়লেন, “না, হাবার্ড। আমি ‌‌নই। ওরা করছে—ওই বাইরে অপেক্ষমাণ ছেলেটির মতো সাহসী যুবকের দল। আমাকে অমর করার জন্য এরা সবাই নির্দ্বিধায় নিজেদের জীবন দান করে চলেছে।”

“আপনার জন্য নয়, বিজ্ঞানের জন্য।”

“তাহলে বিজ্ঞানেরও উচিত ওদের ঋণ শোধ করার ব্যবস্থা করা।”

“কিন্তু তা যে হওয়ার নয়।”

মহাজ্ঞানী কোনও উত্তর দিলেন না। হাবার্ডকে এই ব্যাপারে কিছু বলার কোনও মানে হয় না। সমস্যা হতে পারে। অনেকক্ষণ চুপ করে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার পর মহাজ্ঞানী নিজের ডেস্কে ফিরে এলেন। “ডোনার ছেলেটাকে এই ঘরে পাঠিয়ে দাও।”

একটু বাদে এক অত্যন্ত সুপুরুষ যুবা ঘরে প্রবেশ করল। মহাজ্ঞানীর মনে হল যে প্রতিবারই ডোনার যুবক আগের থেকে শক্তিশালী ও সুঠাম হচ্ছে।

“আমি প্রস্তুত মহাজ্ঞানী।” শান্ত স্বরে যুবকটি জানাল।

মহাজ্ঞানী যুবকটিকে স্থির দৃষ্টিতে দেখছিলেন। “অপারেশন আজ রাতের আগে হবে না। তার আগে তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলার আছে।”

“আপনার যেমন ইচ্ছা মহাজ্ঞানী।” যুবকটি ঠায় দাঁড়িয়ে। চোখে কোনও চাঞ্চল্য নেই।

যুবকটি কি এখনই সব চুকিয়ে দিতে চাইছে? সেটা নিশ্চিতভাবে বোঝা মুশকিল। হাজার বছর ধরে মহাজ্ঞানীর যে-কোনো কথাই আদেশ হিসেবে গণ্য হয়। তা মেনে চলতে হয় প্রশ্নহীন হয়ে। মানুষের জীবনে ওঁর উপস্থিতি জল আর বাতাসের মতোই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

মানুষ আজ একে অপরের সঙ্গে কলহ-বিবাদ ইচ্ছেমতো করতেই পারে যতক্ষণ না তারা বিজ্ঞানের ভয়ানক অস্ত্রগুলো অপরের ধ্বংসের জন্য ব্যবহার করছে। জনগণ নিজেদের ইচ্ছামতো সরকার গঠন করতে পারে আগের মতোই। মানুষ সবকিছুতেই স্বাধীন শুধু বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ব্যাপারগুলো ছাড়া। হাজার বছর আগে মহাসভায় এটাই ঠিক হয়েছিল।

কোনও দেশের সরকার যদি যন্ত্রের অপব্যবহারের চেষ্টা করে, বিশ্বজোড়া বিজ্ঞানীদের সমিতি তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েকবার কিছু রাজনৈতিক নেতা তো খুবই দুর্বিনীত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের দমিয়ে দিতে হয়েছে কঠোরভাবে। তবে সে-সবও অনেকদিন আগের কথা। বেশ কয়েক শতক হয়ে গেল পৃথিবী জুড়ে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজ করছে।

সব বিজ্ঞানীদের ওপরে আছেন মহাবিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের যাবতীয় শাখা-প্রশাখা এসে মিশেছে ওঁর মধ্যে। বিজ্ঞানের মূল যে উদ্দেশ্য—মানবজাতির উন্নতি, সেটাই সাধিত করেছে মহাজ্ঞানীর উপস্থিতি। সমস্যা অনেক কমেছে। প্রাজ্ঞ কিছু মানুষ অনুভব করেছিলেন মহাজ্ঞানীর প্রয়োজনীয়তা। এমন এক বৌদ্ধিক কেন্দ্র যা সব ধরনের জটিল সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ।

(২)

মহাজ্ঞানীর খেয়াল হল যে তিনি অনেকক্ষণ অতীতে ডুবে ছিলেন। সেই অতীত যার কথা ভাবার এখন আর কোনও মানে হয় না। তিনি যুবকটির দিকে মন দিলেন।

“তোমার নাম?”

“ব্যারেট নরগার্ড।”

“পেশা?”

“আমি একজন বায়ো-কেমিস্ট।”

মহাজ্ঞানীর মুখের ওপর একটা অদ্ভুত আশার আলো খেলে গেল।

“তাই নাকি? ড. মার্টেলের এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে কিছু জানা আছে?”

“অবশ্যই।” নরগার্ডের স্বরে আগ্রহ, “আমি তো ওঁর সঙ্গে দু-বছর কাজও করেছি।”

মহাজ্ঞানী এই বিষয়ে আর কোনও কথা বাড়ালেন না। একটু চুপ থেকে বললেন, “আমি জানি কমিটি তোমাকে অপারেশনের ব্যাপারে সবই বলেছে। কিন্তু আমার বিষয়ে খোলসা করে কি কিছু বলেছে? মনে হয় না। আমার অস্তিত্ব আজ প্রশ্নহীন, কিন্তু অনেকেই ভুলে যায় যে আমায় মানে মহাজ্ঞানীকে সৃষ্টি করেছে মানুষই, মানবসভ্যতার মঙ্গলের জন্য।”

“আমার কর্তব্যের ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সেটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট।”

“না, তোমার পুরোটা শোনার অধিকার আছে। তোমার জানা উচিত কোন পরিস্থিতিতে আমাকে অমর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।”

নিজের মাথায় যে পরিকল্পনাটা দানা বেঁধে উঠছিল, সেটা আপাতত পিছনে ঠেলে মহাজ্ঞানী শুরু করলেন সেই পু্রোনো কথা যা তিনি প্রতি তিরিশ বছর অন্তর বলেন ডোনারদের।

“২৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিজ্ঞানীরা বুঝলেন যে যন্ত্র এতটাই জটিল হয়ে পড়েছে যে কোনও এক মানুষের পক্ষে তার সীমিত আয়ুতে সেই জটিলতার সমাধান করা সম্ভব হবে না। কোনও জটিল যন্ত্র তৈরি হয় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ দিয়ে; প্রতিটি যন্ত্রাংশ চালনা করে ভিন্ন টেকনিশিয়ানেরা যারা অন্য যন্ত্রাংশের বিষয়ে কিছুই জানে না। অথচ মানবসভ্যতা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছিল যে যন্ত্র ছাড়া মানুষের এক মুহূর্তও চলবে না। যন্ত্রহীন আদিম যুগে তো আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। একদিকে যন্ত্র জটিলতর হচ্ছে, অথচ সেই জটিলতা অনুধাবন করার মতো দক্ষ মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না—স্বভাবতই পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠছিল। তখন বিজ্ঞানীরা নড়ে চড়ে বসলেন। পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়ে সভা বসল লুসানে। সবাই বুঝলেন, মূল সমস্যাটা মানুষের স্বল্পায়ুতে লুকিয়ে আছে। মানুষের আয়ু যা হওয়া উচিত তার দশভাগের একভাগও নয়। সেই সমস্যা এখনও রয়ে গেছে।”

“বিজ্ঞান নিশ্চয়ই কোনও একদিন সমাধান খুঁজে পাবে।”

“কোনও একদিন। কোনও একদিন। কিন্তু কবে?” মহাজ্ঞানী নিজের হাত দুটোর দিকে তাকালেন। “তুমি তো বায়ো-কেমিস্ট নরগার্ড। বলো তো মানুষ বৃদ্ধ হয় কেন?”

কিছু বলার সুযোগ পেয়ে নরগার্ড আপ্লুত। কে বলবে সে মরতে চলেছে?

“সহজ ভাষায় বললে মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ অন্য অঙ্গকে বিষিয়ে দেয়। দূষিত পদার্থ মিশে যায় আমাদের রক্তে। যদিও এর অনেকটাই বর্জ্য হিসেবে বেরিয়ে যায়, তবুও কিছুটা তো থেকেই যায় রক্তে। স্বভাবতই ধীরে ধীরে রক্তের রাসয়ানিক উপাদান পরিবর্তিত হয়ে কোষের পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। পুরোনো কোষের জায়গায় নতুন কোষ তৈরি হয় না। দেহ বুড়িয়ে যায়, তারপর মৃত্যু।”

“ঠিক বলেছ। এই সমস্যার সমাধান বিজ্ঞান এতদিনেও করে উঠতে পারল না। তবে ‌‌‌‌সব মানুষের আয়ু বিজ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারেনি বটে, কিন্তু একজনকে অবশ্য অমরত্ব আর চিরযৌবন দিতে পেরেছে। যাই হোক, গোড়ার কথা বলি তোমায়।

“আমি ছিলাম এক নামকরা বায়োলজিস্ট। হাজার বছর আগের সেই মহাসভার সময় আমি যথেষ্ট বৃদ্ধ। তুমি যেমন বললে, দেহের পুরোনো রক্তের রাসায়নিক উপাদান বদল করার প্রক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছি। যখন তাতে সফল হলাম না অন্যদিক থেকে ভাবা শুরু করলাম। কোনও বৃদ্ধ মানুষের পুরোনো রক্তের পুরোটাই তার দেহ থেকে বের করে কোনও যুবকের তাজা রক্ত বৃদ্ধের শরীরে প্রবেশ করানো। কিছু জন্তুর ওপর এক্সপেরিমেন্টটা সফল হওয়ার পর বিজ্ঞানী সমিতির অনুমতি নিয়ে নিজের ওপর পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। একজন যুবক ডোনারও পাওয়া গেল এবং আমি সফল হলাম। নিজের যৌবন ফিরে পেলাম। কিন্তু ডোনার ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার পুরোনো রক্ত ওর শরীরে কোনও কাজই করল না।

“আমার এক্সপেরিমেন্টের আংশিক সাফল্যের পর বিজ্ঞানী সমিতি আরেকটি মহাসভা ডাকল। সেখানেই হল মহাজ্ঞানী সৃষ্টির সিদ্ধান্ত। এমন এক জ্ঞান কেন্দ্র যিনি যন্ত্র আর প্রযুক্তি সম্পর্কিত সব বিষয়ে হবেন সর্বেসর্বা। মানবজাতির উন্নতির জন্য তিনি কাজ করে যাবেন অনন্তকাল। বুঝতেই পারছ আমাকেই বাছা হল মহাজ্ঞানী হিসাবে। সব দেশকে জানিয়ে দেওয়া হল এই সিদ্ধান্ত। কিছু আপত্তি, প্রতিবাদ অবশ্যই হয়েছিল, কিন্তু বিজ্ঞানীরা তাঁদের ক্ষমতা দিয়ে সে-সব দমিয়ে দিতে সময় নেননি।

“এক প্রজন্ম চলে গেল, তারপর এল আরেক প্রজন্ম, তারপর আরেকটা। মানুষ ধীরে ধীরে আমাকে মানে মহাজ্ঞানীর অস্তিত্বকে মেনে নিল ধ্রুবকের মতো। শান্তি, সমৃদ্ধি, সুখে ভরে গেল এই পৃ্থিবী।”

“কিন্তু একটা কথা বুঝলাম না। আরও কিছু মানুষকে আপনার মতো অমরত্বের সুযোগ দেওয়া হল না কেন?”

“তাহলে যে সমস্যা বেড়ে যেত নরগার্ড। তাজা রক্তের জন্য পৃথিবী জুড়ে খুনোখুনি লেগে যেত। না, অমরত্ব শুধু একজনের জন্যই। শুধু তাই নয়, সেই প্রক্রিয়াটির খুঁটিনাটি সে ছাড়া আর কেউ জানবে না। আমি, শুধু আমিই জানি কী করে আমি ত্রিশ বছর পর পর যৌবনের নবীকরণ করি। কৌশলটা দ্বিতীয় কারও জানা নেই। চেষ্টা অবশ্য করেছে অনেকে, সফল হয়নি।”

“হ্যাঁ, সেটা আমি জানি। কোনও মানুষের দেহ থেকেই তার পুরোনো, দূষিত রক্ত পুরোটা বের করে দেওয়া যায় না। সেটা করতে গেলে তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু হবে। রক্ত পরিবর্তনের সময় পুরোনো রক্তের কিছুটা দেহে থেকেই যায়। তার থেকেই মৃত্যু।”

“কেন বলো তো?” মহাজ্ঞানীর কণ্ঠস্বর অন্যরকম শোনাল। “সাধারণ ব্লাড ট্রান্সফিউশনে তো এই সমস্যা হয় না।”

“তার কারণ, সেই সময়ে মানুষের নিজের রক্ত ডোনারের রক্তের থেকে অনেক বেশি থাকে। গ্রহীতার নিজের রক্ত বেশি থাকায় সেটা বহিরাগত রক্তের উপাদানকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বহিরাগত রক্ত হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় যা দেহের পক্ষে মঙ্গলদায়ক। কিন্তু যখন গ্রহীতার নিজস্ব রক্তের থেকে বহিরাগত রক্তের পরিমাণ বেশি হয় তখন পুরো উলটো ফল হয়। দেহে ভুল ব্লাড গ্রুপের রক্ত প্রবেশ করলে যেটা হয় সেটাই। মানে গ্রহীতার শরীরের সামান্য পরিমাণ পুরোনো রক্ত বহিরাগত রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে দেয়। ফলে মৃত্যু এড়ানো যায় না।”

“বাহ্, তুমি নিজের বিষয় বেশ ভালোই জানো দেখছি। খুশি হলাম। আমার ডোনারদের সঙ্গে আমি সাধারণত এত কথা বলি না। তোমার সঙ্গে এত কথা বলার অবশ্য কারণ আছে।”

“আপনি খুশি হয়েছেন জেনে আমার খুব ভালো লাগছে।”

“আরেকটা কথা বলো। একটু আগে তুমি রক্তের উপাদান বা বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের কথা বলছিলে। আর একটু পরিষ্কার করে বলবে কি?”

নরগার্ডের হাসিটা বিষণ্ণ লাগল। “সেটা বলতে পারলে ‌‌‌‌তো সবচেয়ে খুশি হতাম। রক্তের ব্যাপার খুবই জটিল। আমরা হাজারভাবে রক্তকে বিশ্লেষণ করে দেখেছি। একদম অণু-পরমাণু‌ পর্যন্ত। তবুও কিছু না কিছু অধরা থেকেই গেছে।”

“বুঝতে পেরেছি। ওই অধরার পিছনে আমিও যে কত ছুটেছি। তবে তোমাদের থেকে একটা বড়ো ফারাক হল যে অধরা কিন্তু আমায় ধরা দিয়েছে বা বলতে পারো সেটাকে খুঁজে পেয়ে আমি সেটা এড়িয়ে যেতে পেরেছি।”

নরগার্ড লাফিয়ে উঠল, “কী সেটা মহাজ্ঞানী? আমাদের সেটা জানা প্রয়োজন।”

মহাজ্ঞানী মাথা নাড়লেন। “সেই সত্য শুধু আমার মধ্যেই থাকবে। কাউকে বলা চলবে না। অনেকেই অবশ্য সেটা জানার অনেক চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ তো আমাকে হত্যা করার কথা পর্যন্ত ভেবেছিল। কিন্তু আমাকে মেরে ফেললে এই সত্যিটাও যে চিরকালের ‌‌মতো হারিয়ে যাবে।”

“মহাজ্ঞানী, এরকম চিন্তা আমার মাথায় একেবারেই আসেনি।”

“তুমি নও, আমি অন্যদের কথা ভাবছিলাম। হাজার বছর তো কিছু কম সময় নয়।”

“মহাজ্ঞানী, আপনি অভয় দিলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”

“অবশ্যই। নির্দ্বিধায় করো।”

“আপনি সত্যটা অন্য বিজ্ঞানীদের জানিয়ে দিচ্ছেন না কেন? সেটা হলে তো চিরযৌবনের সুবিধাটা সবাই পেত।”

“তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমার পদ্ধতিটা সম্পূর্ণ নয়। বৃদ্ধের দেহের পুরোনো রক্তের বদলে যুবকের তাজা রক্ত দিয়ে সেই বৃদ্ধের যৌবন ফেরাতে পারি বটে, কিন্তু পুরোনো রক্তকে শুদ্ধ, তাজা রক্তে পরিবর্তন করার কৌশল এখনও আমার অধরা।”

“আপনি ওইটুকু সত্যটাও যদি জানিয়ে দেন তাহলে বিজ্ঞানীরা একটা পথ খুঁজে পেত।”

“পৃথিবী তাহলে মানুষ ভ্যাম্পায়ারে ভরে যাবে নরগার্ড। আমি মানব-চরিত্র চিনি। চিরযৌবনের আকর্ষণ সাধারণ মানুষের কাছে চুম্বকের মতো। মানুষ আর মানুষ থাকবে না, পশুতে পরিণত হবে। অবশ্য ওরা যদি জানত যে এই মরণশীল জগতে অমর হয়ে বেঁচে থাকায় যে কতটা হতাশা আর একাকিত্ব মিশে আছে, কেউ আর অমর হতে চাইত না।”

“আমি তাহলে প্রস্তুত, মহাজ্ঞানী।” নরগার্ড উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখে দৃঢ় সংকল্প।

“ঠিক বলছ তো? মনে রেখো, পুরো এক ঘণ্টা আমার জীবন আর মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ তোমার হাতে থাকবে। তখন ভয় পেলে কিন্তু সব শেষ।”

“না, আমি ভয় পাব না। আমি পুরোপুরি প্রস্তুত।”

মহাজ্ঞানী ডেস্কের দিকে তাকালেন। এভাবেই চলে আসছে দীর্ঘকাল। তারপর মুখ না তুলেই বললেন, “আমার ল্যাবরেটরিতে ঠিক রাত দশটায় চলে আসবে।”

(৩)

নরগার্ড চলে যাওয়ার বেশ কিছুটা পর মহাজ্ঞানী ডেস্কের ওপর রাখা রিপোর্টগুলো পড়া শুরু করলেন। কয়েকটা বেশ জরুরি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলোর আশু সমাধান প্রয়োজন।

ইউরোপের রকেট পরিবহণে একটা বড়ো সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোনও অজানা শক্তি রকেটগুলোকে তাদের নির্দিষ্ট পথ থেকে টেনে বাইরে নিয়ে আসছে। মহাজ্ঞানী রকেটগুলোর ডিজাইন চেয়ে পাঠালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো তাঁর কাছে পৌঁছলে মহাজ্ঞানী মন দিয়ে ডিজাইনগুলো দেখতে লাগলেন। বোঝা গেল যে এক অকালপক্ক টেকনিশিয়ান জেনারেটরে কিছু পরিবর্তন করেছিল গতিবৃ্দ্ধির জন্য। এর ফলে এমন এক শক্তি-উৎস অজান্তেই তৈরি হয়ে গেছে যা রকেটগুলো নির্দিষ্ট পথে যাওয়ার জন্য যে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রয়োজন তাকে ব্যাহত করছে। মহাজ্ঞানী রকেটগুলোর ডায়নামোতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করার নির্দেশ দিলেন। কিছু পরেই খবর এল সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে।

আরেকটা রিপোর্ট বলছে যে দক্ষিণ এশিয়াতে বেশ কিছু মানুষের মধ্যে এক নতুন ধরনের উন্মাদনা দেখা দিচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা কিছুই বুঝতে পারছে না। কী হতে পারে? কেন হচ্ছে এরকম? প্রজনন বিদ্যার কোনও গোলমাল, নাকি ওই অঞ্চলে যে-ধরনের সিন্থেটিক খাদ্য খাওয়া হয় তার উপাদানের কোনও গণ্ডগোল? চিনের নতুন রেডিও পাওয়ার স্টেশনের থেকে যে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির তরঙ্গ বেরোচ্ছে, তা মস্তিষ্কে কোনও প্রভাব ফেলছে না তো? না, আরও তথ্য না হলে ব্যাপারটা পুরো বোঝা যাচ্ছে না। আগামীকাল এটা নিয়ে আবার বসা যাবে। মনটাও আজকে ঠিক…

আসলে আজ রাতে যে এক্সপেরিমেন্টটা উনি করতে চান, তার সামনে অন্য সবকিছুই বড়ো ফিকে লাগছে। আজকে রাতেই কি করা উচিত? নাকি… মহাজ্ঞানী ভাবতে লাগলেন বসে বসে।

***

উজ্জ্বল আলোকময় করিডর দিয়ে মহাজ্ঞানী হেঁটে চলেছেন। পাশে নরগার্ড। করিডরের একদম শেষপ্রান্তে এসে মহাজ্ঞানী থামলেন। সামনে একটা মাইডোনাইট নির্মিত বিশাল দরজা। সেই মাইডোনাইট যা কয়েক শতক আগেই ইস্পাতের জায়গা দখল করেছে।

মহাজ্ঞানী কম্বিনেশন ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, “আমি আর আমার ডোনাররা ছাড়া এই ল্যাবরেটরিতে আর কেউ প্রবেশ করতে পারে না।”

কম্বিনেশন লকের শেষ নাম্বারটা ঘোরাতেই দরজাটা খুলে গেল। করিডরের মতো ল্যাবরেটরির ভিতরটাও আলোকোজ্জ্বল। একদিকের দেওয়ালে বেশ কিছু ক্যাবিনেট সারি দিয়ে সাজানো আছে। প্রতিটির সামনে একটা পর্দা যার ওপর কিছু নাম্বার লেখা আছে।

“যা বলার অনেকটাই বিকেলে বলা হয়ে গেছে। তবে এখনও কিছু কথা তোমায় বলার আছে।” মহাজ্ঞানী একটা‌ চেয়ারে বসলেন।

নরগার্ড মহাজ্ঞানীর উলটোদিকে বসল। আলোয় তার মুখটা বড়ো বেশি ফ্যাকাসে লাগছে।

“যেটা বলছিলাম, বিজ্ঞান কিছুতেই এমন কোনও উপায় বের করতে পারছিল না যাতে কোনও মানুষের দেহ থেকে সম্পূর্ণ রক্ত বের করে নেওয়ার পরও তার মৃত্যু না হয়। আমি কিন্তু চেষ্টা ছাড়িনি। পুরোনো রক্তের উপাদান নিয়ে কাজ করার বদলে আমি অন্যরকম ভাবলাম। অবশেষে এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করলাম যাতে শেষ রক্তবিন্দু দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া আর দাতার রক্তের প্রথম ফোঁটা দেহে ঢোকার মধ্যে একধরনের সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশন তৈরি হয়। যে‌ অবস্থায় মানুষ অচেতন থাকবে, রক্ত সঞ্চালনের মতো জরুরি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো বন্ধ থাকবে, কিন্তু দেহে প্রাণ থেকে যাবে। এটাই সেই ‌‌‌‌‌‌‌গোপন সত্য যা আমাকে দিয়েছে চিরযৌবন আর অমরত্ব।”

“হা ঈশ্বর। আমরা তো পুরো উলটোদিকে এগোচ্ছিলাম।”

মহাজ্ঞানী উঠে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাবিনেটগুলোর কাছে এলেন। নরগার্ডও এল। একটা পর্দা সরাতেই দেখা গেল কাচের এক শূন্য বাক্স। মহাজ্ঞানী বাক্সের দু-দিকের দুটো ইলেকট্রোডের সঙ্গে দুটো কেবল জুড়ে দিলেন। তারপর কনডেনসর আর টিউবের তৈরি একটা অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রের কাছে এসে সুইচ অন করতেই জেনারেটর চালুর গমগমে আওয়াজে ঘর ভরে গেল।

তখনই দেখা গেল যে কাচের ক্যাবিনেটটা উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠেছে। মহাজ্ঞানী সেন্ট্রাল রিওস্ট্যাটের নবটা ঘোরাতেই ক্যাবিনেটের ভিতর শুরু হয়ে গেল নানান রঙের খেলা। গোলাপি, বেগুনি, লাল আর তারপর সব রঙ মিশে গিয়ে সুন্দর এক বর্ণচ্ছটা। যন্ত্রটা বন্ধ করার পরও সেই বর্ণচ্ছটা ক্যাবিনেটের মধ্যে ভাসতে লাগল কুয়াশার মতো।

নরগার্ডের মুখে বিস্ময় দেখে মহাজ্ঞানী বলতে শুরু করলেন, “এই ক্যাবিনেটটা এখন চার্জড হয়ে আছে যা দিয়ে, ‌‌তার নাম আমি দিয়েছি জীবন অন্তরণ। একটু পরেই এটাই তোমার কফিন হতে চলেছে।”

মহাজ্ঞানী আড়চোখে একবার ছেলেটির মুখের দিকে তাকালেন। না, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ওর মুখ একেবারে পাথরের মতো অনুভূতিহীন। উনি আবার ব্যাখ্যা শুরু করলেন, “আমি মনে করি জীবনের ‌‌‌‌‌মূল রসায়নে‌ নেই। আছে বৈদ্যুতিক বা তেজস্ক্রিয় শক্তিতেই।”

“কিন্তু তার সঙ্গে আপনার তৈরি সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশনের কী সম্পর্ক আছে?”

“সম্পর্ক আছে। প্রাণের গতিকে থমকে দিতে হলে শরীরের রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করাই যথেষ্ট নয়, তেজস্ক্রিয়তার বিষয়টাও খেয়াল রাখা উচিত। রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ না করলে দেহে জরা গ্রাস করবে, আবার তেজস্ক্রিয় শক্তিটা নিয়ন্ত্রণ না‌ করলে মানুষের অন্তর্নিহিত তেজ যাকে আগেকার দিনে আত্মা বলত অনেকে, সেটা চিরতরে হারিয়ে যাবে।”

বলতে বলতেই মহাজ্ঞানী কাচের ক্যাবিনেটে একটা হালকা করে টোকা দিলেন।

“আমার তৈরি এই জীবন অন্তরণ যন্ত্র মানুষের অন্তর্নিহিত তেজস্ক্রিয় শক্তিকে এর ভিতরেই আটকে রাখে। একই সঙ্গে এই যন্ত্র দেহের জরাও রোধ করে। তোমাকে টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি এখন বলে লাভ নেই। সহজ করে বললে, আমি মানবদেহের অন্তর্নিহিত তেজস্ক্রিয় আভাকে এই‌ ক্যাবিনেটে আটকে রাখতে ‌‌‌‌‌‌‌‌সমর্থ হয়েছি। রেডিয়ামের মতো ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌মানব শরীর থেকেও তেজস্ক্রিয় আভা বেরোয় আর তা বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে দেখা যায়—সেই আন্দাজ বিজ্ঞানীদের অনেক দিনই ছিল। কিন্তু সেই তেজস্ক্রিয়তা কীভাবে আটকে রাখা যায় সেটা আমি ছাড়া কেউই বুঝতে পারেনি।”

“কিন্তু একটা কথা তো বুঝলাম ‌‌‌‌না। সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশন তো শুধু রক্ত পরিবর্তনের সময় প্রয়োজন হয়। তাহলে তার পরও তেজস্ক্রিয় আভাকে ক্যাবিনেটে আটকে রাখার কারণ কী?”

“কারণ,” মহাজ্ঞানী মৃদু স্বরে বললেন, “যারা যারা আমার জন্য, বিজ্ঞানের জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, তাদের ফিরে আসার জন্য একটা সুযোগ রেখে দেওয়া দরকার।”

বলেই উনি পাশের ক্যাবিনেটের পর্দাটা উঠিয়ে দিলেন। সেটাতে একটা পোশাকহীন যুবার দেহ শায়িত। এই ক্যাবিনেটেও কুয়াশার বর্ণচ্ছটা।

নরগার্ড আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল দু-পা। “এটা কি আগের ডোনার?”

“একদম তাই। আর ওর পাশে রাখা ছোটো ট্যাঙ্কিতে আমার দেহ থেকে বের করা পুরোনো রক্ত।”

“কিন্তু ‌‌‌‌‌কেন? ওদের মৃত্যুর শান্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হল কেন?”

“ওকে মৃতই বলা যায়। চেতনাহীন। শুধু একটা সুযোগ খোলা আছে, যদি কোনোদিন বিজ্ঞান পুরোনো রক্ত থেকে টাটকা রক্ত তৈরির কৌশল আবিষ্কার করতে পারে।”

“কিন্তু তা তো আর বিজ্ঞান পারবে না।”

“বিজ্ঞান ‌‌‌‌কী পারবে আর কী‌ পারবে‌ না,‌” মহাজ্ঞানীর কণ্ঠস্বর কঠোর শোনাল, “তা তুমি বা অন্য কোনও মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।”

(৪)

নরগার্ড কোনও উত্তর না দিলেও মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে মহাজ্ঞানীর শেষ কথাটা ওর বিশ্বাস হয়নি। আবার মহাজ্ঞানীর কথার প্রতিবাদ করার কথাও ভাবা যায় না। ধীরে ধীরে অবশ্য ওর মুখ আবার শান্ত হয়ে এল। “অপারেশনটা কীভাবে হবে?”

“তোমার বুঝতে অসুবিধা হবে না। আমি একটা ফাঁকা ক্যাবিনেটে ঢুকব। তুমি আমার চারদিকে যেমন দেখালাম সেরকম একটা জীবন অন্তরণ ক্ষেত্র তৈরি করবে। তারপর শুরু করবে আমার দেহ থেকে রক্ত বের করার প্রক্রিয়া।

“ওটা হয়ে গেলে মেশিনের টাইমারটা এক ঘণ্টায় সেট করে তুমি পাশের ক্যাবিনেটটায় ঢুকবে। সঙ্গে নেবে আমার দেহ থেকে বেরোনো রক্তের ট্যাঙ্কিটা। তোমার একটা বাহু অবশ করে আমার দেহে যে টিউবটা লাগানো থাকবে সেটা তোমার কনুইয়ের ঠিক নীচে শিরার সঙ্গে যুক্ত করবে। তারপর তোমার ক্যাবিনেটের ঢাকনা বন্ধ করে সুইচটা চালিয়ে দিলেই দুটো কাজ হবে—তোমার দেহের তাজা রক্ত আমার দেহে প্রবেশ করা শুরু হবে, আর তোমার চারপাশে জীবন অন্তরণের ক্ষেত্রটা সৃষ্টি হয়ে যাবে।

“ঠিক এক ঘণ্টা, স্বয়ংক্রিয় টাইমার আমার ক্যাবিনেটটা খুলে দেবে। আমার চারপাশের তেজস্ক্রিয় ক্ষেত্রটা ভেঙে যাবে। আমার জীবন আর যৌবন দুটোই ফিরে আসবে। বুঝতেই পারছ, এই প্রক্রিয়াতে আমার দেহের পুরোনো রক্তের প্রতিটি কণা পরিবর্তিত হয়ে যাবে।”

তারপর মহাজ্ঞানী আরও বিস্তারে নরগার্ডকে পুরো প্রক্রিয়াটা বোঝাতে শুরু করলেন। একটা রিহার্সালমতোও হয়ে গেল। যখন দেখলেন ছেলেটা পুরো ব্যাপারটা আত্মস্থ করেছে, তখনই উনি থামলেন। তারপর বসে একটা সিগারেট ধরালেন।

ধূমপান করতে করতে মহাজ্ঞানী ভাবছিলেন। এক্সপেরিমেন্টটা করতে হলে আজ রাতেই করতে হবে। একবার যদি উনি ক্যাবিনেটে ঢুকে নরগার্ডকে অপারেশন শুরু করার ইঙ্গিত দিয়ে দেন, তাহলে ব্যাপারটা আবার পিছিয়ে যাবে। তার মানে তাঁর চারদিকে আবার মৃত্যুমিছিল চলবে আর তাঁকে অসহায়ভাবে দেখতে হবে। না, আর দ্বিধা নয়। আজকেই করতে হবে।

মহাজ্ঞানী উঠে দাঁড়ালেন। মুখে সংকল্পের দৃঢ়তা।

“নরগার্ড, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তুমি যেভাবে সাহসের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছ, তার তুলনা নেই। অনেক ডোনারই তো দেখলাম। কিন্তু তুমি আমায় মুগ্ধ করেছ। তাই এবার তোমায় আরও একটা গোপন কথা বলব।

“হাজার বছর ধরে একটা স্বপ্ন আমি লালন করে এসেছি। ভয়ানক এক স্বপ্ন যা কাউকে বলা যায় না। এই ল্যাবরেটরিতে নিভৃতে চেষ্টা চালিয়ে গেছি এত বছর। বার বার ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু হাল ছাড়িনি। মোটামুটি একশো বছর আগে প্রথম আশার আলো দেখতে পাই আর গত সপ্তাহে পরীক্ষার যা ফল পেয়েছি তাতে আজ বলতেই পারি যে সাফল্যের চাবিকাঠি আমার হাতে। আজ যদি আমার স্বপ্ন সফল হয়, তাহলে কোনও মানুষ আর বুড়ো হবে না, মারা যাবে ‌‌‌‌না।”

“আপনি… আপনি সমাধানটা খুঁজে পেয়েছেন! পুরোনো রক্ত তাজা রক্তে পরিবর্তিত করার কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছেন!” নরগার্ডের গলা উত্তেজনায় কাঁপছে।

মহাজ্ঞানীর মুখে স্মিত হাসি। “একটু পরেই তোমাকে সেই ইঁদুরটা দেখাব যার ওপরে আমি এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে সফল হয়েছি। ওর দেহের পুরোনো রক্তের বদলে এখন তাজা রক্ত বয়ে চলেছে।”

“তাহলে আমাকে আর ওইরকম ক্যাবিনেটে আটকে থাকতে হবে না?”

“আজ রাতে আমরা সফল হলে ওই ক্যাবিনেটগুলোর আর কোনও প্রয়োজন হবে না। মহাজ্ঞানী পদটিরও অবলুপ্তি ঘটবে। এ যে ‌‌‌‌কী বড়ো বোঝা!”

“কিন্তু বিজ্ঞানীদের ভুলটা কোথায় হচ্ছিল? কোন জায়গাটা ওঁরা ধরতে পারেননি?”

“বিজ্ঞানীদের কোনও ভুল হয়নি। আসলে সাধারণ মানুষের সীমিত আয়ুতে এত জটিল জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই আমার মতো দীর্ঘ আয়ু আর বিজ্ঞানের সবদিক নিয়ে সম্যক ধারণা। সাধারণ মানব মনের ফোকাল দৈর্ঘ্য খুবই কম। আমার তা নয়। তাই আমি বুঝতে পারি যে পুরোনো রক্তের রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তনের চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই; যা প্রয়োজন তা হল রক্তকে তার আণবিক লেভেলে চার্জ করা।”

“কিন্তু রক্তের রাসায়নিক উপাদান তো বয়সের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে বাধ্য।”

“হ্যাঁ, কিন্তু ওটা রক্ত দূষিত করার কারণ নয় বরং ফল। রক্তের অণু-পরমাণুগুলোকে চার্জ দিলে রাসায়নিক পরিবর্তনজনিত ক্ষয় আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে।”

“আপনি সেটা করতে পেরেছেন!” নরগার্ডের স্বরে বিস্ময় লুকোনো নেই।

“একদম। কিন্তু,” মহাজ্ঞানী একটা ছোটো দরজা খুলে নরগার্ডকে তার ভিতরে ঢোকার ইশারা করলেন। “তার জন্য এসব আমাকে বানাতে হয়েছে।”

(৫)

নরগার্ড এখন যে ছোটো ঘরটায় ঢুকেছে সেটা নানান রকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। শয়ে শয়ে যন্ত্র যাদের মধ্যে কয়েকটা মাত্র তার চেনা, তাও নামে মাত্র। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চারদিকে দেখতে লাগল।

“এসব আমার হাজার বছরের পরিশ্রমের ফল। সাধারণ মানুষের পক্ষে তার সীমিত জ্ঞান নিয়ে এগুলোর জটিলতা অনুধাবন করা সম্ভব নয়।”

মহাজ্ঞানী হাঁটতে হাঁটতে একটা খাঁচার সামনে এলেন। খাঁচাটা পর্দা-ঢাকা।

“এখানেই রয়েছে সেই প্রমাণ যে কোনও কিছুই বিজ্ঞানের আয়ত্তের বাইরে নয়। বিজ্ঞান চাইলে সমস্ত জীবের মৃত্যু আর বার্ধক্য রুখে দিতে পারে।”

উনি খাঁচাটা তুলে ধরে পাশের টেবিলে রাখলেন। তারপর ম্যাজিশিয়ানের মতো এক লহমায় পর্দাটা সরিয়ে দিলেন।

নরগার্ডের মনে হল ঘরের ভিতর ডায়নামোর শব্দটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেল অনেকটা। মনে হল চারপাশের যন্ত্রগুলো যেন ওদের দিকে চেয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে।

খাঁচার ভিতর ইঁদুরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দেহ ফোলা, নিথর, নিশ্চিতভাবে মৃত।

“না না, এ হতে পারে না!” মহাজ্ঞানী আর্তনাদ করে উঠলেন। তাঁকে দেখে এখন সত্যিই মনে হচ্ছে যে তাঁর হাজার বছর বয়স। কোথায় গেল তাঁর সৌম্য, শান্ত রূপ।

নরগার্ড প্রথমে সামলে উঠল। সে চেষ্টা করছিল ধাক্কাটা সামলে ওঠার। “অন্য কোনও কারণে মরে যায়নি তো? এক্সপেরিমেন্টের সাতদিন পরেও যখন ভালো ছিল।”

মহাজ্ঞানীর দীর্ঘ দেহ নুয়ে পড়েছে। তিনি অবসন্ন। অনেক পরে তাঁর উত্তর ভেসে এল যেন অনেক দূর থেকে, “না, প্রতিবারেই এরা এভাবেই মারা যায়। দেহ ফুলে ওঠে। অন্য কোনও কারণে মৃত্যু হতে পারে না। এবার নিশ্চিত ছিলাম সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু তবুও…”

“হয়তো…”

মহাজ্ঞানী নরগার্ডকে থামিয়ে দিলেন। “কোনও হয়তো নেই। আমি ইঁদুরটার পুরোনো রক্ত চার্জ করে তাজা করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি পরিবর্তনটা স্থায়ী হয়নি।”

“কিন্তু আপনি যখন এত কাছে এসেছেন, নিশ্চয়ই কোনও একদিন সফল হবেন।”

“উফ্‌, কোনও একদিন! এই কথাটা আর সহ্য হয় না। আমিও কতবার ভেবেছি কোনও একদিন সফল হব। কিন্তু না। প্রতিবারই ব্যর্থ।”

নরগার্ড চুপ করে রইল। কী আর বলবে সে? তাকে আবার তার মন শক্ত করতে হবে।

“আমি তাহলে প্রস্তুত মহাজ্ঞানী।”

মহাজ্ঞানী কোনও উত্তর দিলেন না। তাঁর মন এখনও মৃত ইঁদুরটার দিকে। তিনি কি পুরো ভুল দিকে এগিয়েছেন এতদিন? না, একেবারেই নয়। অনেক প্রমাণ পেয়েছেন যে তাঁর পরীক্ষা ঠিক দিকেই এগোচ্ছে। এক সপ্তাহ তো একটা ইঁদুরের জীবনে কম সময় নয়। তাহলে? একবার যদি কোনও মানুষের ওপর পরীক্ষা করার সুযোগ পেতেন…

একটাই উপায় আছে। একটাই উপায়।

মূল ল্যাবরেটরিতে ফিরে এসে মহাজ্ঞানী বললেন, “না, তোমাকে কিছুতেই ওই ক্যাবিনেটে বন্দি থাকতে হবে না। ওই নৃশংসতা বন্ধ হওয়ার দরকার।”

“তার মানে আপনি আজ রাতেই এক্সপেরিমেন্টটা করবেন?”

“হ্যাঁ, করব। ইঁদুরের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে হয়তো সফল হব। তবে টেকনিকে একটু অদলবদল করতে হবে।”

নরগার্ড মৃদু হাসল, “বেশ। কিন্তু কার রক্ত আমার দেহে ঢুকবে?” তারপর ক্যাবিনেটগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মনে হয় ওদের রক্তে কাজ হতে পারে।”

“না, তোমার ওপর নয়। এক্সপেরিমেন্টটা হবে আমার ওপর, আর সেটা করবে তুমি। আমার দেহ থেকে পুরোনো রক্ত বের করবে, সেটা আণবিক লেভেলে চার্জ করবে আর তারপর সেই চার্জড রক্তকে পুনরায় আমার দেহে প্রবেশ করাবে।”

নরগার্ড লাফিয়ে উঠল, “অসম্ভব! এক্সপেরিমেন্টটা ব্যর্থ হলে আপনার প্রাণসংশয় হতে পারে। পৃথিবীর কী হবে তাহলে?”

“ভুলে যেও না নরগার্ড, তুমি মহাজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলছ।”

“ভুলিনি বলেই আমি এভাবে কথা বলছি। মহাজ্ঞানীর নিজের জীবন নেওয়ার কোনও অধিকার নেই।”

“সে কি আর আমি জানি না? হাজার বছর ধরে অমরত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার কী জ্বালা তুমি বুঝবে কী করে? আমার মৃত্যুর অধিকার নেই। সবার আছে, শুধু আমার নেই। আমি কি যন্ত্র? সবাই ভুলে যায় যে আমিও একজন মানুষ। মহাজ্ঞানীর বিদায়ের সময় হয়েছে। মানুষ নতুন কোনও সমাধান খুঁজে নিক। এক্সপেরিমেন্টটা হবে আজ রাতেই। তোমাকে আমি সব বুঝিয়ে দেব। সব বিস্তৃত বিবরণ…”

নরগার্ড লাফিয়ে উঠল। তার শক্তিশালী হাত চেপে ধরেছে মহাজ্ঞানীর কাঁধ। “আমি আপনাকে বারণ করছি। কিছুতেই এটা করবেন না।”

মহাজ্ঞানী কঠোর স্বরে বললেন, “তুমি যদি এইরকম আচরণ চালিয়ে যাও তাহলে আমি চাঁদের বন্দি শিবিরে তোমাকে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব আর কমিটিকে বলব নতুন কোনও ডোনার পাঠাতে।”

“আমি কিছুতেই আপনাকে নিজের ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালাতে দেব না।”

এইবার মহাজ্ঞানীর ধৈর্যচ্যুতি হল। নরগার্ডকে ঠেলে দিয়ে ভিশন ফোনটা চালু করলেন। একটু পরেই হাবার্ডের মুখ ভেসে উঠল স্ক্রিনে। ল্যাবরেটরির গোপনীয়তা রক্ষার জন্য অবশ্য এখানকার কোনও দৃশ্য বা মহাজ্ঞানীকে ও দেখতে পাচ্ছে না।

“হাবার্ড, বিজ্ঞানীদের কমিটি আর শহরের মেয়রকে একটা খবর দিতে হবে। তাদের বলবে…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই মহাজ্ঞানীর দেহটা কাটা কলাগাছের মতো ধপ করে পড়ে গেল মেঝেতে।

নরগার্ড নিজের হাতের ভারী ইনসুলেটরটার দিকে তাকাল। তারপর ভালো করে মহাজ্ঞানীর নাকে-মুখে হাত দিয়ে দেখল। না, আঘাত তেমন গুরুতর নয়। কিছুক্ষণ অজ্ঞান থাকবেন এই যা। তারপর ও মহাজ্ঞানীর হাত, পা, মুখ বেঁধে ফেলল। সাবধানের মার নেই। তখনই হাবার্ডের গলা আবার শোনা গেল, “আপনি কিছু একটা বলছিলেন, মহাজ্ঞানী।”

হাতটা মুখের সামনে এনে গলাটা যথাসম্ভব ভারী করে নরগার্ড বলল, “আমারই ভুল হাবার্ড। মনে হয়েছিল যে সেন্ট্রাল পাওয়ার প্ল্যান্টে কোনও গোলোযোগ দেখা গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা নয়। কাল এটা নিয়ে আরেকবার বসব। প্রয়োজন হলে ডেকে নেব তোমায়।”

স্ক্রিনে হাবার্ডের মুখটা দ্বিধাগ্রস্ত লাগছিল। একটু চুপ করে থেকে সে অবশ্য বলল, “আচ্ছা, মহাজ্ঞানী।”

স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল।

নরগার্ড টেবিল বসে একটা সিগারেট ধরাল। তার মাথায় অনেক চিন্তা। কিছুক্ষণ পরে সিগারেটটা শেষ হতেই নরগার্ড উঠে দাঁড়াল।

(৬)

চোখের সামনে যে কালো পর্দাটা ছিল সেটা আস্তে আস্তে ধূসর হতে শুরু করল। ধূসরতা থেকে এল আলো। মহাজ্ঞানী চেতনা ফিরে পেলেন। মাথা বেদনায় টনটন করছে, কিন্তু উনি অন্য কিছু ভাবছিলেন। কী যেন একটা মনে আসছে না। জিগস পাজলের হারানো টুকরোটা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।

মহাজ্ঞানী নিজের হাত দুটোর দিকে তাকালেন। চামড়ার ভাঁজগুলো এখনই মিলিয়ে গেছে অনেকটা। সপ্তাহ খানেক পর হাত দুটো একদম কোনও যুবকের মতো হয়ে যাবে। হয়ে যাবে…

মনে পড়ে গেছে। নরগার্ড। ওর সঙ্গে শেষ কিছু উত্তেজিত কথাবার্তা। ভিশন ফোন চালানো। তারপর সব অন্ধকার।

মহাজ্ঞানী নিজের ক্যাবিনেটের ঢাকনা খুলে বেরিয়ে এলেন। কোনও এক অশনিসংকেতে হৃদয় কেঁপে উঠল তাঁর। উনি ছুটে পাশের ক্যাবিনেটটার পর্দা খুলে দিলেন।

ক্যাবিনেটের ভিতরে সেই নানা-রঙা কুয়াশার বর্ণচ্ছটা। তাঁর চোখ অবশ্য সেটা দেখছে না। দেখছে এক সুঠাম যুবকের শায়িত দেহ। ব্যারেট নরগার্ড। মুখে এক অদ্ভুত হাসি নিয়ে সে জীবন-মৃত্যুর মাঝের লিম্বোতে শুয়ে আছে।

মহাজ্ঞানী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই ছেলেটার আদর্শবাদের জন্য অমরত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগটা ফসকে গেল। নরগার্ডের মতো যুবকদের বেঁচে থাকার কথা এই পৃথিবীতে আর তার জায়গায় বেঁচে আছেন তিনি, এক হাজার বছরের অসহায় বৃদ্ধ।

নরগার্ড তাঁর কথা শোনেনি বটে, কিন্তু এখনও একটা উপায় আছে। আরও তিরিশ বছর অপেক্ষা আর সম্ভব নয়। তিনি ফাঁকা ক্যাবিনেটের ভিতরে আবার প্রবেশ করে টিউবগুলো নিজের বাহুতে লাগাবেন। তারপর কানেকশন কেটে যন্ত্রের সুইচ চালিয়ে দিলেই তাঁর দেহ থেকে রক্ত বেরিয়ে ভাসিয়ে দেবে ল্যাবরেটরির মেঝে।

ভিশন ফোন থেকে একটা কিড় কিড় শব্দ ভেসে আসছে। হাবার্ড কিছু বলছে। মহাজ্ঞানী চেঁচিয়ে বললেন, “আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো। প্রয়োজন ম‌নে‌ করলে আমিই তোমাদের ডেকে নেব।”

না, উনি কাউকেই ডাকবেন না। অবশেষে হাবার্ডদের মাইডোনাইটের দরজা ভেঙে ঢুকতে হবে। ভেতরে এসে তারা দেখবে মেঝেময় রক্ত আর ক্যাবিনেটে নানা রঙের কুয়াশার মাঝে শায়িত তাঁর দেহ।

মহাজ্ঞানী কিছুক্ষণ পাম্প আর টিউবগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। তারপর ছোটো ল্যাবরেটরিতে গিয়ে ইঁদুরটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এত বছরের পরিশ্রমের ফল একটা মৃত ইঁদুর! এখন উনি বুঝতে পারছিলেন নিজের ওপর এক্সপেরিমেন্টটা করলে একই ফল হত। এই ইঁদুরটার মতোই কষ্ট পেয়ে, দেহ ফুলে মারা যেতেন তিনি।

উনি ছোটো দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। ডেস্কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটা ছোটো কাগজের টুকরোতে তাঁর চোখ আটকে গেল। একবার থামলেন বটে, তবে পরমুহূর্তেই এগিয়ে চললেন। রিপোর্ট, আর্টিকেল, তথ্যের কচকচানি আর ভালো লাগছে না তাঁর। কিন্তু…

মহাজ্ঞানী আবার থমকে দাঁড়ালেন। নরগার্ডের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন তখন তো ডেস্ক খালি ছিল। উনি নিজের হাতে সব কাগজ আলমারির ভিতর রেখেছিলেন। তাহলে এই কাগজটা কোথা থেকে এল? মহাজ্ঞানী কাগজটা হাতে তুলে নিলেন। একটা নোট, তাতে লেখা—

‘আপনি বলেছিলেন যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনের ফোকাল দৈর্ঘ্য খুবই কম। কিন্তু ভুলে যাবেন না একই কথা আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মানুষের নিয়তির কাছে হাজার বছরও বড়ো অল্প সময়। আমাকে যেদিন এই হতচ্ছাড়া ক্যাবিনেটটা থেকে বের করে আনবেন সেদিন ড্রিঙ্কের খরচ আমিই দেব, কথা দিলাম। আরও কিছু মৃত ইঁদুরের দিব্যি।

ব্যারেট নরগার্ড’

মহাজ্ঞানী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। নোটটি তিনি আবার পড়লেন, বিশেষ করে ওই জায়গাটা, ‘মানুষের নিয়তির কাছে হাজার বছরও বড়ো অল্প সময়’। উনি নরগার্ডের ক্যাবিনেটটার সামনে এলেন। কাচের দেওয়ালে হাত বোলাতে বোলাতে ছেলেটার দিকে তাকালেন। ওর চোখ দুটো খোলা, মুখে সেই মুচকি হাসি। ও যেন মহাজ্ঞানীর মনের এই দোলাচাল খুব উপভোগ করছে।

মহাজ্ঞানী ভাবছিলেন। না, উনি মরতে পারেন না। ব্যারেট নরগার্ড তাঁকে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে সেটা তাঁকে নিতেই হবে। জানতে হবে কোথায় ভুল হয়েছিল। কেন ইঁদুরটা মারা গেল।

উনি ছুটে গিয়ে ভিশন ফোন চালু করলেন। “হাবার্ড, বিজ্ঞানী কমিটির সঙ্গে এখনই যোগাযোগ করো। বায়ো-কেমিস্ট্রি, রেডিও-অ্যাক্টিভিটি আর পাওয়ার-ফিল্ডের সব থেকে প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের লিস্ট তৈরি করে আমার কাছে দুপুরের মধ্যে জমা দাও। নতুন ল্যাবরেটরি তৈরি করার কাজও শুরু করতে হবে। অনেক কাজ এখন আমাদের সামনে।”

মহাজ্ঞানী এবার জানালার কাছে এলেন। নরম স্বরে বললেন, “তোমার কিনে দেওয়া ড্রিঙ্ক পানের জন্য আমি অপেক্ষায় থাকব নরগার্ড। তোমাদের আমি ফিরিয়ে আনবই।”

বাইরে তখন পুব আকাশ আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠছে। নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে। জেনারেটরের গুম গুম শব্দে বিল্ডিংটা জেগে উঠছে।

জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন হাজার বছর বয়স্ক সেই চির-যুবক। তিনি মরতে পারেন না। এখনও যে তাঁর আসল কাজটাই বাকি।

ছবি অংশুমান

লেখক পরিচিতি

রিচার্ড ডিউইট মিলার (১৯১০-১৯৫৮) তুলনায় স্বল্পখ্যাত এক আমেরিকান লেখক। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কল্পবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার অন্যতম কারিগর ডিউইট মিলারের নামের সঙ্গে হয়তো আজ পাঠক সমাজ তেমন পরিচিত নয়। ‘দ্য মাস্টার শ্যাল নট ডাই’ গল্পটি ১৯৩৮ সালে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরে এই গল্পটিই পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে মিলার ও অ্যানা হাঙ্গার মিলিতভাবে লেখেন পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ‘দ্য ম্যান হু লিভড ফরএভার’ যা প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। সমালোচকেরা অবশ্য মনে করেন সাহিত্য মূল্যের দিক থেকে গল্পটি উপন্যাসটির থেকে কয়েক পা এগিয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s