সুমনা সাহার আগের গল্প সম্পর্ক, রুনু আর সোনু
অঙ্কা আর বঙ্কা দুটি ভাই। জন্মে ইস্তক ওরা একটা অন্ধকার গর্তে বাস করছে। বাপ-মায়ের মুখও দেখেনি বেচারারা। তাদের মা নাকি ভারি ব্যস্ত! তবে বড়ো বড়ো দাদারা আছে, তারা ভারি ওস্তাদ। সবদিক খেয়াল রাখে। তাদের মতো আরও লাখো লাখো ভাইবোন সব কিলবিল করছে চাদ্দিকে। দাদারা পালা করে খাবার এনে খাইয়ে দেয়; মুখ মুছিয়ে দেয়; গল্প বলে ঘুম পাড়ায়, আবার মনখারাপ হলে ছোটো ছোটো ভাইবোনদের বাইরে থেকে একটু ঘুরিয়ে-টুরিয়ে হাওয়া খাইয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু অঙ্কা-বঙ্কার এখনও বাইরে যাওয়ার সুযোগ আসেনি। তবে তারা শুনেছে, সে নাকি এক মস্ত ভয়ানক ব্যাপার! সেখানে বিরাট বড়ো বড়ো সব দৈত্য-দানো আছে, অতিকায় সব জন্তু ঘরঘর শব্দ করে চলে—মেলা বিপদ আছে বাইরের দুনিয়াটায়। দাদারা ভয় দেখায় তাদের। বলে, “আর একটু বড়ো হও, তারপর যাবে। যাবে কী শুধু, কত কাজ করতে হবে! ঘুরে ঘুরে এমনই ছোটো ভাইবোনদের জন্য খাবার আনতে হবে। ভাইবোন জন্ম দিতে দিতে মা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তাকে সেবাযত্ন করতে হবে। বাইরের শত্রুও কি কম? সাপখোপ, পাখপাখালি সব্বার লোভ আমাদের ডিমে। তারা আক্রমণ করলে জান লড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের দলের কচি কেউ বাইরে আহত হয়ে পড়ে থাকলে তাকে ঘাড়ে করে তুলে আনতে হবে… কাজের কি শেষ আছে? কিন্তু খবদ্দার! এখন আমাদের অনুমতি ছাড়া বাইরে বেরোনো এক্কেবারে নৈব নৈব চ।”
এসব শুনে শুনে অঙ্কা-বঙ্কার কান পচে গেছে। দাদারা মুখে করে আনা খাবার চিবিয়ে মণ্ড করে ওদের মুখে ঢেলে দেয়; সেই সেরেল্যাকের মতো ল্যাল্লেড়ে থ্যালথেলে দ্রব্যটা খেতে মোটেই রুচিকর নয়। অঙ্কা-বঙ্কার নাক ফুটছে একটু একটু করে। মাথার উপর শুঁড়ের ডগায় যে পাঁচ-পাঁচখানা নাক, তারা সবক’টা আলাদা আলাদা গন্ধ শুঁকতে পারে। গর্তের ফাঁকফোকর থেকে যখন বাইরের দুনিয়ার গন্ধের ঝলক এক-আধবার ঢুকে পড়ে ভেতরে, প্রাণ তাদের আঁকুপাঁকু করে বাইরে বেরোবার তরে। তবে গর্তের ভেতরেও রয়েছে কড়া পাহাড়া। ঠ্যাং-ভাঙা আর শুঁড় ছেঁড়া এক দাদামশাই গর্তের ভেতরে তাদের দেখেশুনে আগলে আগলে রাখে। তার মুখেই অঙ্কা-বঙ্কা শুনেছে কত গল্প। সেসব শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়।
বুড়োদাদা বলে, “জানিস, আমরা কত যুগ ধরে আছি! বাইবেলে আমাদের কথা আছে। এই যে আমরা এত পরিশ্রম করি সারাটা বছর, অসময়ের জন্য খাবার জমিয়ে রাখি, এসব অন্য সবাই তো পারে না, সব তো কুঁড়ের বাদশা! ওরা আমাদের হিংসে করে, একবার নাকি এক বাগানে গঙ্গাফড়িং গিয়েছিল আমাদেরই এক জ্ঞাতি আত্মীয়দের পাড়ায় খাবার ভিক্ষে করতে। কী আর করবে বেচারি! সমস্ত বসন্তকালটা লতায় পাতায় হুটোপুটি নাচানাচি করল, তারপর যখন শীত এল, বরফে ঢেকে গেল চাদ্দিক, গাছের পাতা সব ঝরিয়ে দিয়ে উত্তুরে হাওয়া শনশন বইতে লাগল, তখন ন্যাড়া গাছগুলো ওকে ঢাকতেও পারল না। কোথাও ফুলের রেণুও নেই, পোকামাকড় সব ঠান্ডায় সেঁধিয়ে গেছে গর্তের ভিতরে। বেচারি না পেল খাবার, না শীতের আশ্রয়। তখন শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের জ্ঞাতিদের পাড়ায় গিয়েছিল একটু খাবার ভিক্ষে চাইতে। আর আমাদের দূরসম্পর্কের ঠাকুমা তখন নাকি গঙ্গাকে অ্যায়সা বকুনি দিয়েছে, ‘যাও না! এখন গিয়ে গান গেয়ে শীত তাড়িয়ে দাও গে। এখানে কেন? সারাবছর আলসেমি না করে এতটুকু খাবার জমিয়ে রাখতে পারো না কেন শুনি? কিচ্ছু পাবে না যাও!’ ”
অঙ্কা তাকায় বঙ্কার দিকে।—“বঙ্কা রে!”
বঙ্কা চিমটি কাটে অঙ্কার গালে। বলে, “বল রে ভাই অঙ্কা!”
অঙ্কা তার ১৫০ খানা পুঞ্জাক্ষি নাচিয়ে ইশারা করে—“সেই কথা, শুধো না!”
বঙ্কা সমঝদার হেসে পুঞ্জ চোখের ১২০ খানা টিপে সায় দেয়। তারপর বুড়ো দাদার কাছ ঘেঁষে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাসা থেকে বেরিয়ে যদি হারিয়ে যাই, পথ চিনে বাসা খুঁজে ফিরব ক্যামন করে?”
বুড়ো দাদার পুঞ্জাক্ষি ফেটে পড়ার উপক্রম বঙ্কার কথা শুনে।—“শোনো ভাইয়ের কথা! তোমরা কি বাইরে বেরোবার মতলব করছ নাকি? বেঘোরে মারা পড়বে বলে রাখলাম। আর একটু বড়ো হও, তারপর কত বাইরে যাবে’খন, তখন সব বুঝতে পারবে। আমরা যত ছোটো, আমাদের চোখের দৃষ্টি ততই দুর্বল। চোখের খোপ যত বেশি, তত ভালো দৃষ্টি। এই দেখো না, ড্রাগন মাছির চোখে ২০০০০ খোপ। সেখানে আমাদের মাত্র ১৮০ খানা। তোমরা বড়ো হওনি এখনও। তোমাদের আরও কম খোপ। দেখি, চোখ বড়ো করে তাকাও আমার দিকে… হ্যাঁ, ঠিক যা ভেবেছি তাই, অঙ্কার ১৫০ খানা আর বঙ্কা তোর ১৬০ খানা খোপ। যত বড়ো হবে, মাথা বড়ো হবে, চোখের খোপও বাড়বে। বাইরে কত বিপদ আছে, তা তো জানো না ভাই! এখন পথে বিপদ এলে তোমরা সেগুলো খুব কাছাকাছি না গেলে দেখতে পাবে না। তোমাদের দাদারা, যারা বাইরে বেরোচ্ছে, তারা তোমাদের চেয়ে অনেক আগেই বিপদ দেখতে পায়, কারণ তাদের চোখের খোপ বেশি, আর ঘুরপথ ধরে বাড়ি ফেরে। এই ঝাপসা দৃষ্টিশক্তি নিয়েও কীভাবে আমরা সব বিপদ কাটিয়ে নিরাপদে বাসায় ফিরে আসি, সেসব বাইরের মানুষ নামের দানবদের কাছে এক আশ্চয্যি বস্তু। তারা নাকি সেসব কাজে লাগিয়ে কীসব রোবোটিক ক্যামেরা-ট্যামেরা বানাবার তাল করেছে।
“আমাদেরই এক জ্ঞাতিগোষ্ঠী আছে—জ্যাক-জাম্পার, তারা তো প্রত্যেকদিন নিজের চেয়ে একশো গুণ ভারী খাবারদাবার চোয়াল দিয়ে চেপে ধরে টানতে টানতে, এমনকি দশ কিলোমিটার পথও পেছু হেঁটে সামনে তাকিয়ে চলে, অথচ ঠিক পথ চিনে বাসায় ফেরে। মানুষ দানবগুলো তো তাদের কম্ম দেখে অবাক! তারা খুব উন্নত ধরনের চালকবিহীন গাড়ি-টাড়ি বানাবে ভেবে আমাদের নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছে। জ্যাক-জাম্পাররা বাসা থেকে বেরিয়ে পথে প্রত্যেক বস্তুর এক-একটা ফটো তুলে নেয় আর সেগুলো স্মৃতিতে ধরে রাখে। অবিশ্যি আমরাও সেরকম করি। মানুষরা এসব কারিগরি তাদের ক্যামেরায় প্রয়োগ করছে। আমাদের নিয়ে ওদের বিস্ময়ের শেষ নেই। কারণ, বাসা থেকে বের হই যখন, সঙ্গে খাবার থাকে না, সামনে চেয়ে হাঁটি, আবার ফেরবার কালে মুখে খাবার, হাঁটি পেছু ফিরে। হি হি হি! এসব ওদের কাছে দুর্বোধ্য। শুনেছি মরুভূমিতে আমাদের যেসমস্ত জ্ঞাতিভাইরা থাকে, তারা খাবার খুঁজতে রাত্রে বেরোয়। তখন ওরা আকাশের তারা দেখে দেখে দিক ঠিক করে ঘরে ফেরে। তবে তোমরা কিন্তু বাইরে বেরিও না, খবদ্দার!”
অঙ্কা হাসে। বঙ্কা হাসে। গর্তের বাইরে বেরোনোর আকাঙ্ক্ষাটা বড্ড বেড়ে যায়।
একদিন দুপুরবেলায়, দাদারা সব খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছে, বুড়োদাদাও ঢুলছে ঘুমে, অঙ্কা-বঙ্কা গুটিগুটি বেরিয়ে পড়ে অজানা পৃথিবীকে জানবার রোমাঞ্চকর অভিযানে। শত হলেও ওরা পিঁপড়ের জাত। যেমন জেদ, তেমনই সাহস!
বাইরে বেরোতেই তাজা হাওয়ার ঝাপটায় ওদের গা শিউরে উঠল। কত আলো রে বাবা! আর কী শব্দ! কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়! কিন্তু বাসার বাইরে ওরা দাদাদের গায়ের চেনা গন্ধ পেল। গন্ধ শুঁকে শুঁকে খানিক দূর হেঁটেই দেখতে পেল কাছেই এক বাগানে দাদারা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ফুলের মধু, রেণু, কচি মুকুল সংগ্রহ করছে। এসব চিবিয়ে মণ্ড করেই ওদের খেতে দেওয়া হয়। ইস্, আজ ওরা ঘরের খাবার খাবেই না। বাইরে রেস্তোরাঁর খাবার খাবে। অঙ্কা-বঙ্কা বাগানের পথ ছেড়ে দিল। দাদারা দেখলেই কান ধরে সোজা গর্তে ঢুকিয়ে দেবে। বাগানের পাশ দিয়ে একটা পথ গেছে একটা বিশাল গহ্বরের মধ্যে। অঙ্কা-বঙ্কা সাবধানে এগিয়ে চলল। বঙ্কা বলল, “অঙ্কা ভাই, মনে আছে তো, আমাদের পেটের তলায়, পিছনের পায়ের গোড়ায় ছোটো ছোটো থলে আছে, সেখান থেকে একটু করে পিচকিরির মতো ছিটিয়ে ছিটিয়ে যেতে হবে। হারিয়ে গেলে কিন্তু ওই গন্ধ শুঁকে দাদারা খুঁজে নেবে আমাদের।”
অঙ্কা বুঝদার হাসি হেসে বলে, “সে আর জানি না ভেবেছ? সামনে বিপদ এলে কামড়ে দেব। আমাদের বিষ থলেতে জ্বালা ধরানো তরল রয়েছে যে!”
গহ্বর শেষ হল এক বিরাট ময়দানে। মসৃণ সেই ময়দান কেমন সুন্দর ঠান্ডা! অঙ্কা বলে, “হিমের দেশে এলাম বুঝি ভাই!”
ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সামনে পড়ল বিশাল দুটো গাছের গুঁড়ি। অঙ্কা-বঙ্কা শুঁড়ে শুঁড়ে সুড়সুড়ি দিয়ে পরামর্শ করে নিল, এটা বিপদ, নাকি নিরাপদ? দুজনেই ভাবল, ‘চড়েই দেখি না!’ গুঁড়ি বেয়ে খানিকদূর ওঠার পরেই একটা বিকট আওয়াজ হল, “উফ পিঁপড়ের জ্বালায় জ্বলে গেলাম! হাঁটুতে পিঁপড়ে বেয়ে উঠে কামড় বসিয়েছে!”
তারপরেই অঙ্কা-বঙ্কার সমস্ত শরীর কে যেন মুচড়ে দিল। চোখে অন্ধকার দেখল বেচারারা। ভাবল বুঝি মরেই গেছি। তারপর কে যেন বলল, “মানদা, বাথরুমে গিয়ে পা-টা ধুয়ে নাও না!”
এবার একটা পুকুরে ভাসতে লাগল ওরা। জলে খানিকক্ষণ হাবুডুবু খেয়ে সুস্থ হল অঙ্কা-বঙ্কা। ধীরে ধীরে লাল রঙের বড়ো জলাশয় ছেড়ে আবার নেমে এল মাটিতে। কিছু দূর গিয়ে নাকে সুন্দর সুন্দর গন্ধ আসতে লাগল। অঙ্কা বলল, “বঙ্কা রে, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। কোথা থেকে এমন গন্ধ আসছে বল দেখি?”
বঙ্কা বলল, “দেখ অঙ্কা, একটা কাঠের বিরাট পাটাতনের উপর সাদা চাঁদমামার মতো থালায় লাল হলদে কত কী রয়েছে, চল দেখি!”
অঙ্কা-বঙ্কা ডাইনিং টেবিলের উপর সাদা চিনামাটির প্লেটে রাখা লাড্ডু, জিলিপি, চমচম আর পান্তুয়ার মধ্যে আবেশে ডুবে গেল। আহা! এমন মধুর সুস্বাদ তারা জীবনে কখনও পায়নি। পিঁপড়ে জন্ম সার্থক।
“এখন যদি মরেও যাই, তাহলেও দুঃখ নেই, কী বলিস?” বঙ্কা বলল।
অঙ্কা লাড্ডুর মধ্যে ডুবিয়ে রাখা নাক উঁচিয়ে বলল, “ঠিক ঠিক!”
“মানদা, বুবুল ভালো নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করল, তুমি মিষ্টি নিয়ে যেও, টেবিলের উপর রাখা আছে।” কে যেন বলল। তারপরেই মিষ্টির মধ্যে ঠুসে ওদের একটা জায়গায় বন্দি করে ফেলা হল। মানদা নামের সেই দানবীর হাতের প্যাকেটে বন্দি হয়ে ওরা দুলতে দুলতে চলল বড়ো রাস্তা পেরিয়ে একটা ছোটো গলিতে। অঙ্কা-বঙ্কার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এবার কী হবে? এখন তো গন্ধ বের করলেও দাদারা খুঁজে পাবে না। দমবন্ধ করে অঙ্কা-বঙ্কা মন দিয়ে কেবল লাড্ডু আর জিলিপি আর পান্তুয়া চেটে চলেছে।
মানদার রাজ্যে এসে দেখল, অনেকটা তাদের গর্তের মতোই আঁধারপানা আর মাটি মাটি গন্ধ। প্যাকেটটা একটা গুহায় রেখে মানদা কলে গেল স্নান করতে। এবার ভয়ে ভয়ে অঙ্কা-বঙ্কা দেখল, কালোমতো একটা ছোট্ট জানোয়ার এসে লাড্ডু সমেত ওদের নিয়ে ছুট লাগিয়েছে। ওরা ভয়ে একেবারে চোখ বন্ধ করে সাহসী পূর্বপুরুষের নাম জপতে লেগেছে। পিছনে চিৎকার শুনতে পেল, “আ মোলো! আমার কপাল! ভাবলুম ছেলেটা টুইসান থেকে ফিরলে এট্টু মিষ্টি খেতে দেব, গা ধুইতে যেই না এয়েচি, ওমা হতভাগা পাজি ছুঁচো নে গেল লাড্ডুটা!”
অঙ্কা-বঙ্কা বুঝল, ওরা এখন হতভাগা ছুঁচোর মুখে। এরা অঙ্কাদের প্রতিবেশী। বুড়োদাদার মুখে এদের কথা শুনেছে। এরা পিঁপড়েদের শত্রু নয় বটে, তবে লাড্ডুর সঙ্গে ছুঁচোর পেটে গেলে বুড়োদাদার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না।
ছুঁচোবাবু নর্দমার ভিতর দিয়ে যেতে যেতে উপরে বিকট ভৌ ভৌ ডাক শুনে মুখের লাড্ডু ফেলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিল। আর অমনি অঙ্কা-বঙ্কা লাড্ডু ছেড়ে বেরিয়ে গুটিগুটি হাঁটা দিল।
ছুঁচোর গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়ে বাইরে এসে ওরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এত বিরাট বিরাট যন্ত্র প্যাঁ-পোঁ শব্দ করে ছুটে চলেছে। কোনদিকে যাবে দিশা পাচ্ছে না অঙ্কা-বঙ্কা। ভয়ের চোটে ওদের শরীরের রসের থলিও ঠিকমতো কাজ করছে না। দুটি ছোট্ট প্রাণ দুরুদুরু বক্ষে থোকা থোকা চোখের খোপ ১৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের পথ ঠাহর করার চেষ্টা করছে, হঠাৎ একটা শব্দ করা যন্ত্রের গোল খাঁজকাটা বিশাল নাগোরদোলার মতো চাকায় জড়িয়ে ওরা বহুদূর চলে গেল। অঙ্কা-বঙ্কা এতই ছোট্ট যে গাড়ির চাকার খাঁজের মধ্যে চুপটি করে পড়ে রইল এক্কেবারে অক্ষত দেহে।
বিকট শব্দ করা যন্ত্রদানব যখন এসে পৌঁছল, অঙ্কা-বঙ্কার দেহে আর কোনও শক্তি নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। দুজনে শুঁড়ে শুঁড়ে জড়াজড়ি করে মরার মতো পড়ে রইল। অঙ্কা বলল, “ভাই বঙ্কা, বুড়োদাদার কথা গেরাহ্যি না করে অভিযানে বেরোনোটা মোটেই উচিত কাজ হয়নি।”
বঙ্কা চোখের খোপ বুজিয়ে নাক টেনে বলল, “সব কাজেতেই বিপদ আছে। তা বলে কি মুখ বুজে গর্তে পড়ে থাকার মধ্যে কোনও বাহাদুরি আছে?”
হঠাৎ এক তীব্র জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেল দুটি ক্ষুদ্র জীব।
“রামদীন, গাড়িটা ধুয়ে দিও।”
“জী সাব।”
এই শব্দের সঙ্গে-সঙ্গেই এক প্রবল বন্যায় দুই দুঃসাহসী অভিযাত্রী অঙ্কা-বঙ্কার ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার জোগাড় হল।
এমন সময় ওদের কানে এল দাদাদের চিৎকার। ওরা মানুষ-দানবদের প্রচণ্ড গালাগাল দিচ্ছে, “মরবি, তোরা মরবি! আমাদের সঙ্গে অমানুষের মতো ব্যবহার করার মজা টের পাবি। আরে হতচ্ছাড়ারা, তোদের বাড়ি-ঘরদোরের যত মরা পচা জিনিস খেয়ে আমরাই তো সাফ করি। আমাদের মেরে ফেললে কি তোরা বাঁচবি? আমরা না থাকলে তোদের কী অবস্থা হবে জানিস? আরশোলা, টিকটিকি, উই, মাকড়সায় ভরে যাবে তোদের আস্তানা। তখন কী করবি? তোদের অনেক আগে থেকে, আজ থেকে ১৬০০ লক্ষ বছর আগে থেকে আমরা এই দুনিয়ায় ছিলাম, আছি, থাকব! তোদের একার থাকার জায়গা নাকি এটা? বন্ধুগণ, সব্বাই এসে জড়ো হও, আমাদের দুই তরুণ ভাই নিহত হয়েছে, এর বদলা নিতে হবে। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ো, আর যেখানে যত মানুষ-দানব দেখবে, আচ্ছা করে কামড় দিয়ে বুঝিয়ে দাও আমাদের সঙ্গে লাগতে আসার ফল!”
আরও কত যে শাপশাপান্ত করছে তাদের দাদারা, সেসব শুনতে শুনতে অঙ্কা-বঙ্কার বুকে বীরভাব জেগে উঠল। ধীরে ধীরে চোখের খোপ খুলে এক এক করে চেনা দৃশ্য, শব্দ আর গন্ধ চিনে চিনে ওরা এগিয়ে চলল গর্তের দিকে। অঙ্কা বলল, “ভাই বঙ্কা, ওই দেখ, আমাদের বাগান আর ওই দেখ পেয়ারা গাছের নীচে আমাদের গর্ত!”
বঙ্কা বলল, “চল রে অঙ্কা, ভালো ছেলের মতো ঘরে গিয়ে চুপটি করে বুড়োদাদার কোলে চেপে বসি। তাহলে আর দাদারা বকবে না।”
তোমরাও যেন অঙ্কা-বঙ্কার মতো বড়োদের না জানিয়ে বাড়ি থেকে কোথাও যেও না! তবে বড়ো হলে নিশ্চয় অনেক অনেক পাহাড়ে, জঙ্গলে ঘুরতে যেও, কেমন?