গল্প-গল্প বোনা-শর্মিষ্ঠা সেন-বর্ষা ২০২২

এই লেখকের আগের গল্প- স্বর্ণময়

golpogolpobona

সারাদিনের কাজের শেষে জানালার ভারী পর্দা টেনে বিছানায় গা এলিয়ে মোবাইল স্ক্রল করছিল মধুমিতা। স্কুল না থাকলে কী হবে, গুচ্ছের কাজ থাকে বাড়িতে, সব সেরে আসতে আসতে তিনটে। মোবাইলে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। খবর মানে শুধু রাজনৈতিক কচকচানি, নয়তো স্যোশাল নেটওয়ার্কের সেই তো এডিট করা ছবিছাবা, পাউট করা সেলফি, মিষ্টুনি, ফিলিং সেলফলেস উইথ পরশনাথ অ্যান্ড ফর্টি-ফাইভ আদার্স! গুচ্ছের গ্রুপ নোটিফিকেশন, অজস্র ওয়েব ম্যাগ, ফুল-ফল-সবজি চাষ… আর ভালো লাগে না দেখতে! তবুও মোবাইল নিলে ঘুমটা তাড়াতাড়ি ‌আসে, সেজন্য নিয়ে শোওয়া।

এদিকে ড্রইংরুম থেকে গুটিগুটি পায়ে ঘরে এসে মায়ের পাশে চুপটি করে‌ শুয়ে পড়ে‌ আনা। ও জানে মাকে এ-সময় বিরক্ত করলে কপালে দুঃখ আছে, তাই চোখ পিটপিট ‌করে মায়ের মুখখানা দেখে, তারপর একসময় ফিসফিসিয়ে বলে, “মা গো, একটা গল্প বলবে?”

মধুমিতা ঘুম জড়ানো গলায় বলে, “এই, তুই এতক্ষণ গল্পের বই পড়ছিলি তো, আবার গল্প কীসের?”

“মা, প্লিজ বলো না! কতদিন তোমার গল্প শুনিনি, মা গো, একটা!”

“হুম আচ্ছা, শোন তাহলে।” মধুমিতা শুরু করে।—“অনেক দূরের এক মস্ত খামারবাড়িতে একটা হাঁস ছিল।”

“মা! মানুষ নেই? হাঁসের গল্প শুনব না!”

“আরে শোন না। সবরকমই শুনতে হয়। তো, সেই হাঁসটা ছিল ধপধপে সাদা রঙের। চ্যাপটা চঞ্চু ছিল গাঢ় কমলা রঙের। কিন্তু ওর…”

“মা, চঞ্চু মানে ঠোঁট? আমি শিখেছি। স্পেলিংও জানি। বলব?”

“আনা, বার বার কথা কাটলে আমি আর বলব না। শুনতে চাস কি আর?”

“সরি মা, সরি। তারপর?”

“কিন্তু হাঁসটার স্বভাব ছিল অন্য হাঁসেদের চেয়ে একদম আলাদা। সে মোটেই পুকুরে নামতে চাইত না। সকালে এক কাঁড়ি ভেজা ভাত খাওয়ার পর সে কাদায় গিয়ে পেট ঠেসে গুগলি-শামুক খেত, কেঁচো খেত, গাঙ শালিকের পিছু ধাওয়া করত আর একা-একাই ঝোপে ঝাড়ে ঘুরত।‌ অন্য হাঁসেরা পুকুরের জলে কেমন সাঁতার কেটে কেটে নিজেদের পালক ঘষেমেজে আরও চকচকে করত, কিন্তু আমাদের হাঁসটি পাঁক মেখে কাদাখোঁচা হয়ে ফিরত। এমন বদ আর জঘন্য স্বভাব ছিল তার।”

“মা, ওর পালকে কি একটা বিড়ি গোঁজা থাকত?”

“এ কী কথা, আনা! বিড়ি-ফিরির কথা এখানে আসছে কোথা থেকে? বাচ্চাদের মুখে এসব মানায় না।”

“মা, সতুকাকারও তো বদ স্বভাব, নয়? কাকাও কানের পেছনে বিড়ি গুঁজে কেমন কাজ করেছিল আমাদের বাড়িতে?”

“উফ্! কীসের সঙ্গে কী! সতুকাকা বুড়োমানুষ। উনি কী করেন তোকে অত দেখতে কে বলেছে?”

“বা রে! ঠাম্মাই তো বলেছিল, দিদিভাই, সতুটা বদ আছে, ঘুমিয়ে পড়ে নাকি মাঝে মাঝে দেখো। তাই তো আমি খেয়াল রাখছিলাম। মা, জানো? সতুকাকা কেমন‌ কাঠবেড়ালির মতো টুইটুই করে নারকেল গাছের মাথায় চড়ে বসেছিল? সব নারকেল পেড়ে, গাছ পরিষ্কার করে নীচে এসে কানের পেছন থেকে ম্যাজিকের মতো বিড়ি এনে বসে বসে খেয়েছিল। তারপর মালতিপিসির সঙ্গে ওদের দেশের বাড়ির কত গল্প!”

“আমি বাড়ি না থাকলে তুই বুঝি সারা দুপুর এসব করিস? তাই তো সন্ধ্যাবেলা হলেই তোর ঘুম পায় রোজ!”

অমনি আনা চট করে কথা ঘুরিয়ে বলল, “আচ্ছা, তারপর কী হল বলো।”

“কার পর?”

“ওই যে, হাঁসটা? যে মোটেই পুকুরে নামতে চাইত না?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, তারপর আর কী? অন্য হাঁসেরা ওর সঙ্গে থাকতে চাইত না আর। বাকি সবাই কেমন ঝকঝকে, চকচকে হয়ে গিন্নিবান্নির মতো হেলেদুলে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়াত; তবে তারা অন্যের বাড়ির কিচ্ছুটি মুখে তুলত না। আর আমাদের কাদাখোঁচা, এলোঝেলো হাঁসটি একপেট খেয়ে ওই কাদার মধ্যেই বসে রোদ পোহাত। সন্ধেবেলা যখন বাসায় যাওয়ার সময় হত, তখন সে প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকে বাকিদের খুঁজত। কিন্তু অন্য হাঁসেরা ওকে দেখলেই সব একসঙ্গে ডেকে উঠত, পাঁক পাঁক…ফাঁক ফাঁক। আর কী করত জানিস? মাঝরাত্তিরে ওকে সবাই মিলে বাসা থেকে বাইরে বার করে দিত। হাঁসেরা তো ছিলই, নোংরা খুঁটে খাওয়া মুরগিরা পর্যন্ত ওকে পছন্দ করত না।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী? একদিন সে মনের দুঃখে কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেল। সকালবেলা যখন ওই বাড়ির মানুষেরা খেতে দিয়ে হাঁস গুনতি করছিল, তখনই দেখা গেল‌ ওই অদ্ভুত হাঁসটা কোত্থাও নেই।”

“তারপর কী হল?”

“আর কী? গল্প শেষ। এবার ঘুমো।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আনা বলল, “মা, এটা একটা খুব বাজে গল্প ছিল। আমি গল্পটা শেষ করব? তুমি শুনবে?”

মধুমিতা হেসে বলল, “বেশ তো, বল। তবে ঘুমিয়ে পড়লে কিন্তু রাগ করা চলবে না।”

“বেশ। আসলে কী হয়েছিল জানো? ওই অদ্ভুত হাঁসটাকে যখন সবাই মিলে বাইরে বার করে দিত, তখন সে আপনমনে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াত। ভয়-ডর বলে সে কিছু জানত না। এমনি করে ওই মস্ত খামারবাড়ির কোথায় কী আছে সব তার জানা হয়ে গেল। সে জানতে পারল হাঁস-মুরগি ছাড়াও আরও অনেক পশু এখানে থাকে। অল্প দিনেই সে খামারের সব ছাগল, ভেড়া, গরু, মহিষদের সঙ্গে ভাব করে নিল। তবে তার প্রিয় বন্ধু হল শূকররা, যারা সারাদিন গা এলিয়ে কাদার মধ্যে শুয়ে থাকে। আমাদের অদ্ভুত হাঁসটিও এখন নিজের বাসা ছেড়ে শূকরদের সঙ্গেই মহা আনন্দে দিন কাটায়।”

মধুমিতা শুনে বলল, “বাহ্! চমৎকার হয়েছে। আমার ছোট্ট আনা তো অনেক বড়ো হয়ে গেছে! দিব্যি গল্প বানাতে পারে দেখছি!”

আনা খুব খুশি হয়ে মায়ের কাছে ঘন হয়ে এল। মধুমিতা আনার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “ভালো হয় যদি তুই গল্পটা পরে লিখে ফেলিস। এবার একটু ঘুমো।”

কিন্তু আনার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছিল। সে তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে খাতা পেন্সিল নিয়ে এসে মায়ের পাশে উপুড় হয়ে গল্পটা লিখতে শুরু করল। গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, ‘একটি হাঁসের গল্প। লেখিকা: আনাহিতা মজুমদার।’

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s