দৃপ্ত বর্মন রায়ের আগের লেখা অদ্ভুত আঁধার(উপন্যাস), মহাবিদ্যা
এক
সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মেনগেটের পাশে গন্ধরাজ ফুলের গাছটার নীচে জিনিসটা দেখতে পেল দেবর্ষি। অবাক হয়ে সাইকেলটা পাশে স্ট্যান্ড করিয়ে গাছটার পাশে গিয়ে জিনিসটা হাতে তুলে নিল সে। কাঠের তৈরি জিনিস। লম্বায় প্রায় ছয় ইঞ্চি আর দুই-আড়াই ইঞ্চিমতো চওড়া। ওপরের আর নীচের দিকে জিনিসটার প্রস্থ বরাবর দুটো আয়তাকার স্লটে চারটে করে এক ইঞ্চি ব্যাসের পাতলা গোলাকার পিতলের চাকতি রয়েছে। মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে একটা আঙুল ঢুকে যেতে পারে এমন একটা বৃত্তাকার গর্ত। জিনিসটা নাড়ালে পিতলের সেই চাকতিগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা ধাক্কা খেয়ে ঝুনঝুনির মতো মৃদু শব্দ করে। খুব চেনা চেনা লাগলেও অনেক চেষ্টা করেও দেবর্ষি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না জিনিসটা কী। তাছাড়া এটা কার জিনিস সেটাও মাথায় এল না ওর। বাড়িতে তো ওরা থাকে দুটো মাত্র প্রাণী, ও আর ওর মা। বাবা মারা গেছেন বছর তিনেক হল। মার কাছে এরকম কোনও জিনিস সে কখনও দেখেনি। পারতপক্ষে ওদের বাড়িতে বাইরের লোকও খুব একটা কেউ আসে না। গতকাল দুজন লোক এসেছিল ঠিকই, কিন্তু এই জিনিসটা তাদের হবে বলেও তো মনে হচ্ছে না। তাহলে কার হতে পারে জিনিসটা? কেউ কি ভুল করে ফেলে গেল? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্কভাবে পরনের লম্বা পাঞ্জাবিটার ঝুল পকেটে জিনিসটা ঢুকিয়ে রাখল দেবর্ষি। আপাতত নিজের কাছেই থাক, পরে ভেবে দেখা যাবে কী করা যায় এটাকে নিয়ে। এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে তার। তাড়াতাড়ি গিয়ে দোকানটা খুলতে হবে। সাইকেলটা নিয়ে গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সে।
সবেমাত্র সাইকেলে উঠতে যাবে, এমন সময় পিছন থেকে কেউ একটা হাঁক পাড়ল, “অ্যাই দেবুদা, একটু দাঁড়াও তো। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।”
পিছনে না ফিরেই একটু ঘাবড়ে গেল দেবু ওরফে দেবর্ষি। গলাটা কার সে ভালোভাবেই চেনে। পাড়ার মস্তান সিধু, মানে সিদ্ধার্থর। বয়সে ওর থেকে বছর তিনেকের ছোটোই হবে। কিন্তু দাপট সাংঘাতিক। ডাকটা কীসের জন্যে সেটাও দেবর্ষি ভালোভাবেই অনুমান করতে পারল। তার বাবা মারা যাবার পর থেকেই এই ঝামেলাটা শুরু হয়েছে। ওদের বাড়ির পিছনের দিকে যে দেড় কাঠামতো জমিটা খালি পড়ে রয়েছে, সেটা সিধুর নেতৃত্বে পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেগুলো ক্লাবের নামে জবরদখল করে নিতে চায়। দেবর্ষির বাবা বেঁচে থাকাকালীন সুবিধা হয়নি, কারণ ওর বাবা ছিলেন খুব ব্যক্তিত্বপূর্ণ এক ভদ্রলোক। স্থানীয় হাই স্কুলের অঙ্কের টিচার। গলার আওয়াজটা ছিল বাঘের মতো। পাড়ার মানুষের সুখে দুঃখে কোনও কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি। পাড়ার লোকেরাও তাঁকে সম্মান আর শ্রদ্ধা করত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেবর্ষি হয়েছে ঠিক এর উলটো। একদম ওর মায়ের মতন। সৌম্যদর্শন, শান্তশিষ্ট, নরম প্রকৃতির, সাত চড়ে রা কাড়ে না টাইপের। কাউকে মুখের ওপর না বলতে পারে না কখনও। পড়াশোনাতেও মধ্য মেধার। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিল, কিন্তু তারপর হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় আর পড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। কয়েকদিন চাকরির চেষ্টাচরিত্র করে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে বছর খানেক হল স্টেশন রোডে একটা মোবাইল কানেকশনের দোকান খুলেছে। একটু আধটু গল্প, কবিতা-টবিতা লেখে। কাগজপত্রে পাঠায়। ছাপালে খুশি, না ছাপালে আবার পাঠায়। আবৃত্তিটা অবশ্য মন্দ করে না। একটা লোকাল থিয়েটার দলে শখের অভিনয়ও করে মাঝে মাঝে। সবসময়ই সে যেন একটা নিজস্ব ভাবজগতে বিচরণ করে। এককথায় সংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন সরল সাধাসিধে একটা ছেলে হল দেবর্ষি।
দেবর্ষির পাশে এসে দাঁড়িয়ে সিধু হাতে ধরা সিগারেটটায় একটা মস্ত টান দিয়ে বলল, “শুনলাম, কাল নাকি আগরওয়ালের লোক এসেছিল তোমার কাছে?”
মিথ্যে নয় কথাটা। আগরওয়াল হলেন কলকাতার একজন নামি প্রোমোটার। ইদানীং তাঁদের কোম্পানি কলকাতার আশেপাশে বিভিন্ন বর্ধিষ্ণু শহরতলিগুলোতেও ফ্ল্যাট বানাতে শুরু করেছেন। তাঁরা দেবর্ষিদের বাড়ি আর জমিটা কিনে নিয়ে সেখানে ফ্ল্যাট বানাতে চান। তার বদলে ওদের দুটো দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট আর নগদ বেশ কিছু টাকা দেবেন। শুধু তাই নয়, ওদের বাড়ি ভাঙার পর থেকে যতদিন না পর্যন্ত নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে, ততদিন অন্য একটা বাড়িতে নিখরচায় থাকার বন্দোবস্তও করে দেবেন বলেছেন। সব মিলিয়ে খুবই লোভনীয় প্রস্তাব। দেবর্ষি আর ওর মায়ের খুব একটা আপত্তিও নেই তাতে। কিন্তু বাগড়া দিয়ে যাচ্ছে এই সিধু আর ওর দলবল। দেবর্ষির তো একবার মনে হল মুখের ওপর সোজাসুজি বলেই দেয়, ‘তাতে তোর কী রে? যা, গিয়ে নিজের চরকায় তেল দে।’ কিন্তু তার বদলে তার মুখ থেকে মিনমিন করে বেরোল, “হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। কিন্তু কেন বল তো?”
“দ্যাখো দেবুদা, আমরা পাড়ার ছেলে, তোমার ছোটো ভাইয়ের মতো। তোমাকে তো আগেও বহুবার বলেছি যে এসব প্রোমোটারদের চক্করে পোড়ো না একদম। ওরা তোমাদের ঠকিয়ে সবকিছু একেবারে লুটেপুটে নেবে।” গলাটা যতটা সম্ভব মোলায়েম করে সিধু বলল, “এর চেয়ে আমাদের হাতে ছেড়ে দাও পুরো ব্যাপারটা। জমিটার দায়িত্ব আমরা নেব। আপাতত আমরাই জমিটার দেখভাল করব, বুঝলে? এমনি এমনি ফেলে রাখব না। রোজ সেখানে খেলাধুলো, শরীরচর্চা এইসব করব। তাছাড়া দ্যাখো, আমাদের ‘এগিয়ে চল’ ক্লাবের দুর্গাপুজোটার তো একটু-আধটু হলেও নামডাক হচ্ছে, তাই না? দেখলে না, এবার কত্ত ভিড় হল! তাই ভাবছিলাম যে পরের বার থেকে পুজোটা আর একটু বড়ো করে করতে হবে। তার জন্যেও এই জমিটা একদম পারফেক্ট হবে। তবে চিন্তা কোরো না, এর মধ্যে যদি কোনও ভালো ডিল-টিল পাই, তাহলে আমরাই জমিটা বিক্রির চেষ্টা করব। তুমি আর কাকিমা একদম চাপ নিও না, ঠিক আছে?”
শরীরচর্চা না কাঁচকলা। মনে মনে ভাবল দেবর্ষি। রোজ বিকেল থেকে রাত্রি পর্যন্ত ‘বাপে-তাড়ানো-মায়ে-খ্যাদানো’ ছেলেপুলেগুলো পাঁচিলে বসে আড্ডা মারে, বিড়ি ফোঁকে। স্ট্রিট লাইট থেকে হুকিং করে কানেকশন এনে আলো জ্বালিয়ে ক্যারম খেলে, তাস পেটায়। আর সবে বছর দুয়েকের দুর্গাপুজো, তারও আবার নামডাক। ওদের আসল মতলবটা সে ভালো করেই জানে। পাঁচিলটা ভেঙে দিচ্ছে একটু একটু করে। পুরোটা ভেঙে দিতে পারলেই আস্তে আস্তে ওদের ‘এগিয়ে চল’ ক্লাবের টিনের ঘরটা ছেড়ে এখানে পাকাপাকিভাবে ক্লাবঘর বানিয়ে জুড়ে বসবে। তখন ওদের ওখান থেকে সরানোটা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে দাবড়ে উঠল সিধু—“কী হল? উত্তর দিচ্ছ না যে? কী এত ভাবছ বলো তো?”
“না মানে, সিধু, একটু বোঝার চেষ্টা কর। আসলে কী জানিস তো, মার শরীরটা না, খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। তাছাড়া…” আমতা আমতা করে বলতে গেল দেবর্ষি।
“আরে ওসব নিয়ে তুমি একদম ভেবো না। আমি তো আছি, নাকি?” দেবর্ষির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল সিধু, “ঠিক আছে, তোমাকে আরেকটা বেটার অপশন দিচ্ছি। তুমি জমিটা বিক্রি করতে চাইছ, তাই তো? এই তো, কালই কথা হচ্ছিল চ্যাটাজ্জিদার সঙ্গে। উনি বলেছেন নতুন ক্লাবঘরের জন্যে আমাদের কিছু টাকা দেবেন। তুমি তাহলে বরং এক কাজ করো, আমাদের নামেই জমিটা লিখে দাও। ওটা আমরাই কিনে নেব।”
ও! তাহলে চ্যাটার্জিদা আছেন এদের পিছনে। উনি এখানকার স্ট্যান্ডিং এম.এল.এ। ভোটে জেতার জন্যে এই সিধুরাই ওঁর ভরসা। কিন্তু তাই বলে জমিটা এদের বিক্রি করতে হবে? অবাক হয়ে দেবর্ষি বলল, “তোরা কিনে নিবি জমিটা?”
“হ্যাঁ! আমরাই কিনে নেব। তোমাকে আমরা দশ হাজার টাকা দেব তার বদলে।” অকপট জবাব সিধুর।
যে জমির বদলে দুটো ফ্ল্যাট ছাড়াও নগদ মোটা টাকা পাওয়া যাবে সেই জমির দাম দশ হাজার! বিস্ময়ে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দেবর্ষি। শেষ পর্যন্ত কোনোরকমে দুটো শব্দ উচ্চারণ করল মুখ দিয়ে, “দশ হাজার!”
“ও, কম হয়ে যাচ্ছে? ঠিক আছে, দশ নয়, ওটা পনেরো করে দিচ্ছি। এবার খুশি তো?” জটিল সমস্যাটার সহজ সরল একটা সমাধান করে দিয়ে দাঁত বের করে হাসল সিধু—“এখনই ডিসিশন নিতে হবে না। দু-তিনদিন চিন্তাভাবনা করো। কাকিমাকেও বলো ভাবতে। আজ তো শনিবার, আমরা বরং নেক্সট বুধবার ডিলটা ফাইনাল করে ফেলি। কী বলো?”
দেবর্ষি মুখে কিছু বলতে না পেরে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। শেষ টানটা দিয়ে সিগারেটটা নীচে ফেলে পায়ের তলায় পিষে দিয়ে সিধু বলল, “তাহলে ওই কথাই রইল। আমার ফোন নাম্বারটা তো আছেই তোমার কাছে। দরকার পড়লে কল করে নিও, কেমন? এখন চলি। টা টা।” বলে পুরো ধোঁয়াটা দেবর্ষির মুখের ওপর ছেড়ে চলে গেল সিধু।
কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে সিধুর চলে যাওয়াটা দেখল দেবর্ষি। রাগে তার গা-টা রি রি করছিল। ইচ্ছে করছিল রাস্তা থেকে একটা আধলা কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে মারে সিধুর দিকে। কিন্তু সাহসে কুলোল না তার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে চেপে বসল সাইকেলে।
কী আর করবে? আসলে সে এরকমই। চোখের সামনে অন্যায় হতে দেখলেও সে মুখ ফুটে প্রতিবাদ করে উঠতে পারে না। এমনকি নিজের সঙ্গে অন্যায় হলেও না। কিছু বলতে গেলেই ভিতর থেকে কে যেন হাত দিয়ে তার মুখটা চেপে ধরে। এমন তো কতবার হয়েছে, পরে পয়সা দেবে বলে তার দোকান থেকে বিনা পয়সায় মোবাইলে রিচার্জ করিয়ে নিয়ে গেছে লোকে। কিন্তু পরে যখন দেখা হয়েছে, তখন অন্য আরও হাজারটা কথা বললেও পয়সা দেবার কথা ভুলেও মুখে আনেনি। সেও বলব বলব করে ভদ্রতার খাতিরে সেটা বলে উঠতে পারেনি। কলেজে পড়ার সময়ও ওর বন্ধুরা কোনও ক্লাস মিস করলে জেরক্স করার জন্যে ওর নোট নিয়ে রেখে দিত দিনের পর দিন। কিন্তু পরে কখনও যদি ওর কোনোদিন দরকার পড়ত ক্লাস নোটের, তখন কারও কাছ থেকে চেয়েও সে সেটা পেত না। আসলে দুনিয়াটা এরকমই। নরম মাটি পেলে সবাই-ই আঁচড়ায়।
সিধুর কথা শোনার পর থেকে দোকানে পৌঁছনো পর্যন্ত পুরো রাস্তাটা ওর মেজাজটা খিঁচড়েই রইল। দোকানের সামনে এসে সে দেখল সেখানে হইহই কাণ্ড। ওর দোকানের ঠিক উলটোদিকে ‘পতঞ্জলি জুয়েলার্স’-এর নতুন যে দোতলা শো-রুমটা তৈরি হয়েছে, আজ সেটার শুভ উদ্বোধন। প্রচুর লোকের ভিড় সেখানে। রঙিন বেলুন, ঝলমলে কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো শো-রুমটা। সেখানকার কয়েকজন কর্মচারী বেরিয়ে এসে আশেপাশের দোকানগুলোতে মিষ্টি বিতরণ করছে। মৃদু স্বরে চলতে থাকা রবীন্দ্রসংগীত চারপাশের কোলাহলটাকে ছাপিয়ে তৈরি করছে একটা মধুর আমেজ। চারদিকে যেন একটা উৎসবের মতো পরিবেশ। এসব দেখে আস্তে আস্তে মনটা ভালো হয়ে গেল দেবর্ষির। কিন্তু ভালো করে দোকান খুলে বসতে না বসতেই আবার এসে হাজির হল এক নতুন হ্যাঙ্গাম। সবে কাউন্টারে বসে এয়ারটেলের নতুন রিচার্জ প্ল্যানগুলোর একটা লিফলেট নিয়ে উলটেপালটে দেখছে সে, কানের ভিতরে একটা হেঁড়ে গলার আওয়াজ এসে ঢুকল তার—“অ্যাই দেবু। এ-মাসের টাকাটা চটপট বের কর ভাই। অনেক দোকান ঘুরতে হবে, তাড়া আছে।”
এবারও মাথা না তুলেই গলার মালিককে চিনতে পারল দেবর্ষি। ল্যাংড়া পাঁচু। ওর ভালো নাম পঞ্চানন মণ্ডল। ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছিল বলে এখনও একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। তাই সবাই ওকে আড়ালে ল্যাংড়া পাঁচু বলেই ডাকে। সে এই পুরো এলাকাটার বস, মানে দাদা আর কি। নিন্দুকেরা তাকে তোলাবাজ বলে বদনাম করার চেষ্টা করলেও আসলে সে এই স্টেশন রোডের সব মাঝারি ও ছোটো দোকানপাটগুলোর নিরাপত্তার গুরুদায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে আর এই মহান উদ্দেশ্য নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্যেই সব দোকানদারদের কাছ থেকে প্রত্যেক মাসের শুরুতে সামান্য একটা হাজার টাকা সে তার ছেলেদের মানে সাকরেদদের মিষ্টি খাওয়ানোর জন্যে ভালোবেসে গ্রহণ করে। আর সেই সূত্রেই যে আজ ওর এখানে আগমন সেটা বুঝতে খুব একটা মাথা ঘামাতে হল না দেবর্ষিকে।
মুখ তুলে তাকিয়ে সে দেখল পাঁচু হাতে একটা চিটচিটে রুমাল নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে ঘাম মুছছে। নভেম্বরের শুরুতে ঠান্ডা এখনও খুব একটা পড়েনি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে এই মনোরম আবহাওয়াতেও যে কেউ এভাবে ঘামতে পারে, পাঁচুকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারত না দেবর্ষি। গাঢ় বেগুনি রঙের একটা ফতুয়া পরায় তার গায়ের কালো রঙটা যেন আরও খোলতাই হয়ে ফেটে পড়ছে। পাঁচুর আরও দুয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গকেও সে দেখতে পেল পিছনে। একটু ঘাবড়ে গিয়েই সে বলল, “কিন্তু পাঁচুদা, আজ তো সবে দুই তারিখ। তুমি তো পাঁচ তারিখে…”
কথাটা শেষ করার আগেই পাঁচুর মুখ দেখে থমকে গেল দেবর্ষি। ঘাম মোছা থামিয়ে এমন একটা অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল পাঁচু যেন সে দিনদুপুরে হাওড়া ব্রিজে এলিয়েন দেখতে পেয়েছে। তাই দেখে পাশে দাঁড়ানো পাঁচুর এক নম্বর চামচা গবাই হড়বড় করে বলে উঠল, “দেবুদা, তুমিও না মাইরি। আরে জানো না নাকি, থানায় নতুন বড়োবাবু এসেছে। আগে যিনি ছিলেন তার সঙ্গে তো আমাদের দাদার খুব দোস্তি ছিল। দাদাকে কত্ত ভালোবাসতেন। এখন এই নতুন স্যারকেও তো ভালোভাবে ওয়েলকাম করতে হবে, তাই না? মানে একটু গিফট-টিফট দিতে হবে আমাদের সবার পক্ষ থেকে। তা না হলে কি দাদার সম্মানটা থাকবে, বলো? তাই এবার একটু আগেভাগেই নিতে হচ্ছে টাকাটা। বুঝলে?”
না বুঝে কি আর কোনও উপায় আছে দেবর্ষির? তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বাঁদিকে তাকালে দুশো মিটার দূরে থানাটা খালি চোখেই দেখা যায়। সেখানে আগের বড়োবাবুর সঙ্গে ভালোরকম সেটিং করা না থাকলে কি আর থানা থেকে এমন ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের মধ্যে এরকম জুলুমবাজি করা যায়? তবে কানাঘুষোয় এই কথাটাও কানে এসেছিল দেবর্ষির যে নতুন ওসি হিসেবে যিনি আসছেন, তিনি নাকি খুব কড়া টাইপের। তাঁর সঙ্গে নাকি অত সহজে ট্যাঁ-ফোঁ করা চলে না। তবে কথায় আছে না—যে-ই যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ। ইনিও যে পাঁচুর কাছ থেকে গিফট-টিফট পেয়ে তার ইয়ার-দোস্ত বনে যাবেন না, তার নিশ্চয়তা কই? তাই জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বেকার ঝামেলা না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
“আর শোন দেবু, এ-মাস থেকে টাকাটা একটু বেশি করে নেব, বুঝলি? মাসে বারোশো করে।” এবার মুখ খুলল পাঁচু, “এতগুলো দোকানের পোটেকসন বলে কথা। শুধু দেখলে হবে গুরু, খচ্চা তো আছে। নাকি?”
তা তো বটেই। খরচা তো আছেই। প্রোটেকশনের নামে ফালতু প্রতি মাসে এতগুলো টাকা গচ্চা দেওয়া। মামার বাড়ির আবদার যেন। কিন্তু এর প্রতিবাদ করারও তো কোনও উপায় নেই। অগত্যা জিন্সের পকেট থেকে পার্সটা বের করল দেবর্ষি। কড়কড়ে বারোশোটা টাকা বের করল ব্যাজার মুখে। আজ বাড়ি ফেরার পথে একটু ভালোমন্দ বাজার করে নিয়ে যাবে ভেবেছিল সে। তাছাড়া মার একটা ওষুধও কেনার কথা ছিল। সব পণ্ড হয়ে গেল। কার মুখ দেখে যে আজ তার ঘুমটা ভেঙেছিল কে জানে।
পাঁচুর ইশারায় দেবর্ষির হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে গুনতে শুরু করল পাঁচুর আরেক চ্যালা বিটলে। পাঁচু আর গবাই ততক্ষণে হানা দিয়েছে পাশের দোকানে। তার চোখের সামনে টাকাগুলো দু-তিনবার ভালোভাবে গুনে পকেটে পুরে একগাল হেসে বিটলে বলল, “ওহ্, ভালো কথা, দাদা একটা নতুন নাম্বার নিয়েছে, বুঝলে? সে অবশ্য আগের নাম্বারটাও চালু থাকবে। তাও, নতুন নাম্বারটাও নিয়ে নাও। দরকার পড়লে যে-কোনোটাতে ফোন করতে পারো।”
দরকার পড়বে না ছাই। যেচে কি আর খাল কেটে কেউ কুমির আনে? তাও কী আর করবে দেবর্ষি? অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিটলের বলা নাম্বারটা সেভ করে নিল নিজের স্মার্টফোনে।
“আর বাই চান্স যদি দাদাকে ফোনে না পাও, আমাদের অফিসে চলে আসবে। ওখানে আমরা সবসময়ই কেউ না কেউ থাকি। টোয়েন্টি ফোর ইনটু সেভেন।” চলে যাবার আগে দাঁত কেলিয়ে বলল বিটলে।
উহ্! অফিস। গেঞ্জির আবার বুক পকেট। সত্যি এদের নাটকের শেষ নেই। ‘পোটেকসন’-এর কাজে সুবিধে হবে বলে পাঁচু ইদানীং স্টেশন রোডেই একটা ছোটোমতো গোডাউন জবরদখল করে সেখানে একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার বসিয়ে নিজের অফিস বানিয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে সে আর তার চ্যালা-চামুণ্ডারা বসে বসে গুলতানি করে আর মাস গেলে সবার কাছ থেকে তোলা আদায় করে নিজেরা ফিস্টি করে। সেটিং করা আছে বলে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নাকের ডগায় এইসব অসামাজিক কার্যকলাপ হচ্ছে, সেটা জেনেশুনেও চোখে ঠুলি পড়ে বসে থাকে।
সকালবেলা প্রথমেই সিধু, তারপর এখন এই পাঁচু। দেবর্ষির মনে হচ্ছিল তার দিনটা আজ নির্ঘাত খুব খারাপ যাবে। মনটা কেমন যেন চিড়বিড় চিড়বিড় করছে। খালি মনে হচ্ছে এর একটা বিহিত করতে না পারলে ঠিক যেন শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। এই মস্তানগুলোকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যে কিছু একটা তাকে করতেই হবে। জবরদস্ত একটা বদলা নিতে হবে, যাতে সাপও মরে আবার লাঠিও না ভাঙে। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই মনের মধ্যে কে যেন একটা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বাধা দিল তার ভাবনায়। ছিঃ, এসব কী মাথামুণ্ডু চিন্তা করছে সে? এরকম ভাবনা তো আগে কখনও আসেনি তার মনে। অনেক সময়ই বিভিন্ন মানুষের ব্যবহার খারাপ লেগেছে তার। কিন্তু সে তখন মনে মনে গুম হয়ে গেলেও পুরো ব্যাপারটা উপেক্ষা করে নিজের কাজে মন দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আপনা থেকেই মন ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু এরকম বদলা নেবার চিন্তা তো আগে কখনও তার মাথায় আসেনি। সে জোর করে এসব চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে ফের মন দিল হাতে ধরা লিফলেটটায়।
দুই
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরেও দেবর্ষি খেয়াল করল তার মনের ভিতর থেকে সেই জ্বলুনিটা বিন্দুমাত্র কমেনি। দোকানে কেউ রিচার্জ করাতে এলে মনটা কিছুক্ষণের জন্যে বিক্ষিপ্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যেই কাস্টমার চলে যাচ্ছে আবার মনের সেই অস্বস্তিটা ফিরে আসছে। খালি মনে হচ্ছে কীভাবে এই মস্তান দুটোকে শায়েস্তা করা যায়। যেন এদের ওপর প্রতিশোধ নিতে না পারলে তার আর ঘুমই হবে না রাত্তিরে। তার ভিতরের সেই ভালোমানুষ মনটা যদিও প্রাণপণে বাধা দেবার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু আজ যেন ওর মন অন্য কোনও কথা শুনতেই আর রাজি নয়। খালি তার মাথায় এটাই ঘুরে চলেছে যে যেভাবেই হোক না কেন এই অনর্থক হেনস্তার জবাব তাকে দিতেই হবে। মনকে শান্ত করার জন্যে শেষ পর্যন্ত দোকানের বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে এল সে।
সামনে পতঞ্জলি জুয়েলার্সের শো-রুমটায় তখন প্রচুর ভিড়। প্রচুর লোক এসেছে কেনাকাটা করতে। বাইরে একটা রঙিন ফ্লেক্সে বড়ো বড়ো করে উদ্বোধনী দিনের ডিসকাউন্টের কথা লেখা। যে-কোনো গয়না কিনলেই অনেক ছাড়। শুধুমাত্র আজকের দিনের জন্যে। এছাড়াও রয়েছে লাকি ড্রতে আরও নানারকম পুরস্কার। সেসব দেখতে দেখতে হঠাৎ করে একটা বুদ্ধি এসে গেল তার মাথায়। প্রথমে সে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ভাবল এরকম একটা প্ল্যান তার মাথায় এল কী করে? তার ভালোমানুষ মনটা ততক্ষণে বার বার করে ওকে বোঝাতে শুরু করেছে, যে না, এসব করাটা একেবারে ঠিক হবে না। কিন্তু আজ কে আর শোনে ওর কথা। তড়িঘড়ি সে এসে ঢুকল নিজের দোকানে।
অনেক সময় বিভিন্ন টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডার নানাধরনের ইন্ট্রোডাক্টরি অফার দেয় উপভোক্তাদের জন্যে, যেমন সিমকার্ড ইউজ করা শুরু করলেই এক মাসের ফ্রি টকটাইম। একমাস পর নতুন রিচার্জ করার আগে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হয়। তখন ভেরিফিকেশনের জন্যে সমস্ত ডকুমেন্টস চেয়ে নেয় তারা। এসব ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে অনেক অতি বুদ্ধিমান উপভোক্তা এরকম কোনও নতুন সিম কার্ড ফোনে ভরে সেটা একমাস ফ্রিতে ইউজ করে। তারপর পরের মাসে রেজিস্ট্রেশন না করে সিম কার্ডটা ফেলে দিয়ে অন্য আরেকটা সিম কার্ড নিয়ে আবার ফ্রিতে ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে টকটাইমের পয়সাটা বেঁচে যায়। দেবর্ষি কোনোদিন এরকম না করলেও, অন্যান্য মোবাইল কানেকশনের দোকানদাররা তো এসব হামেশাই করে থাকে। কিন্তু আজ দেবর্ষি ঠিক করে নিল জীবনে প্রথম ও শেষবারের জন্যে সে এই পন্থাটাই অবলম্বন করবে। সবথেকে আগে খুঁজেপেতে সে এরকম একটা সিম কার্ড বের করল। এই নাম্বারটা কারও কাছে থাকবে না। ট্রু-কলারে বা অন্য কোনও অ্যাপে খুঁজলেও এই নাম্বারের এগেনস্টে কোনও নাম দেখা যাবে না। এবার তার নিজের ফোনের সেকেন্ড স্লটে এই নতুন সিমটা ঢুকিয়ে একবার নিজেই সে নিজের অন্য একটা নাম্বারে কল করে দেখে নিল ঠিকঠাক কল করা যাচ্ছে কি না।
ব্যস, অল সেট। এইবার টাইম ফর অ্যাকশন। অবাক হয়ে দেবর্ষি দেখল, কী করে যেন মনে সাহস এনে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে সিধুর ফোন নাম্বারটা বের করল। তারপর একটু কেশে গলাটা একবার পরিষ্কার করে নিয়ে সে কলও করে ফেলল সিধুকে। কয়েকবার রিং হতেই ও-পাশ থেকে সিধুর আওয়াজ শোনা গেল, “হ্যালো।”
সিধুর গলা শুনতেই ঘাবড়ে গিয়ে হুড়মুড় করে ফোনটা কেটে দিল দেবর্ষি। উত্তেজনায় আর ভয়ে বুকের ভিতরটা তখন তার ঢিপ ঢিপ করছিল। মনের ভিতরের সেই ভালোমানুষ মনটা ততক্ষণে রীতিমতো চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে এসব বন্ধ করার জন্যে। কিন্তু অবাক হয়ে দেবর্ষি খেয়াল করল তার মনের ভিতর থেকেই আরেকটা কে যেন দাবড়ে দিল ভালোমনটাকে। শুধু তাই নয়, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে আবার রাজিও করিয়ে ফেলল ফের সিধুকে কল করার ব্যাপারে।
দ্বিতীয়বারে বেশ একটু রুক্ষ গলাতেই সিধুর হ্যালো শোনা গেল। কিন্তু কী করে যেন অন্তর থেকে অনেকটা সাহস অনুভব করে দেবর্ষি গলাটা গম্ভীর করে উত্তর দিল, “হ্যালো! আমি কি মি. সিদ্ধার্থ দাসের সঙ্গে কথা বলছি?”
অচেনা নাম্বার থেকে কলটা আসায় সিধু গলা চিনতে না পেরে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আমি সিদ্ধার্থ দাস বলছি। আপনি কে বলছেন?”
“নমস্কার। আমি আপনাদের শহরের স্টেশন রোডে পতঞ্জলি জুয়েলার্সের যে নতুন শো-রুমটা খুলেছে, সেটার ম্যানেজার কাঞ্চন দত্ত কথা বলছি। এখন কি আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে?”
এত সাবলীলভাবে কথাগুলো বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে যে দেবর্ষি বুঝতেই পারছিল না এত আত্মবিশ্বাস ওর এল কোথা থেকে! এদিকে আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে পতঞ্জলি জুয়েলার্সের ম্যানেজারের কল পেয়ে সিধুও যেন মনে হল কেমন একটা ভেবলে গেল। কী বলবে বুঝতে না পেরে সে বলল, “অ্যাঁ, হ্যাঁ… হ্যাঁ দাদা, মানে স্যার। বলুন স্যার। বলুন স্যার।”
“আসলে আমরা আমাদের এই নতুন শো-রুমটা খোলার উপলক্ষে একটা লাকি ড্র আয়োজন করেছিলাম। সেখানে আপনার এবং আপনার মতো শহরের আরও বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ফোন নাম্বার নিয়ে সেগুলোর মধ্যে লটারি করা হয়েছিল।”
ফুটেজ খেতে বাঙালি বরাবরই খুব ভালোবাসে। সিধুও তার ব্যতিক্রম নয়। গণ্যমান্য বলায় সে আরও বিগলিত হয়ে মধুমাখা গলায় বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, তাই নাকি? হেঁ হেঁ, ভালো কথা স্যার, খুব ভালো কথা।”
এবার সবচেয়ে বড়ো টোপটা ফেলল দেবর্ষি, “মি. দাস, আপনি জেনে খুশি হবেন যে সেই লটারিতে আপনার ফোন নাম্বারটা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে।”
সিধুর পাশে ওর সাঙ্গপাঙ্গগুলোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। মনে হয় ওরা তাস বা ক্যারম খেলছিল। ওদের চিৎকার করে চুপ করতে বলে সিধু উত্তেজিতভাবে বলল, “কী বলছেন? ফার্স্ট প্রাইজ, অ্যাঁ? আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছি? বলেন কী দাদা, সরি স্যার? মানে আপনি ঠিকই বলছেন তো?”
“হাঃ হাঃ হাঃ, হ্যাঁ মিস্টার দাস। আমি ঠিকই বলছি। আপনিই সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি ফার্স্ট প্রাইজটা পেয়েছেন।”
নিজের অভিনয় ক্ষমতা দেখে দেবর্ষির বিস্ময় যেন উত্তরোত্তর বাড়ছিল। বার বার ওর মনে হচ্ছিল, ইস্, ওদের থিয়েটার গ্রুপের ডিরেক্টর বাগচীদা যদি একবার দেখতেন ওর এই পারফর্মেন্স, তাহলে পরের নাটকটায় সাইড রোলের বদলে হিরোর রোলটা ওর একদম পাক্কা ছিল। ওদিকে সিধু মনে হয় স্পিকারে রেখেছিল ফোনটাকে। ওর সঙ্গে যারা ছিল তারাও ততক্ষণে প্রাইজ পাবার কথা শুনে মহা হল্লা জুড়ে দিয়েছে। ওদের উল্লাস থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল দেবর্ষি। তারপর ফের বলল, “ওকে মি. দাস, মেনি মেনি কংগ্র্যাচুলেশনস আমাদের তরফ থেকে। এবার শুনুন আপনাকে কী করতে হবে।”
আবার ধমকে বাকিদের হট্টগোল থামাল সিধু। তারপর অতি আগ্রহের সঙ্গে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার, বলুন। বলুন আমাকে কী করতে হবে।”
“হ্যাঁ, মন দিয়ে শুনুন।” সিধুর সিরিয়াসনেস দেখে কোনোমতে হাসি চাপতে চাপতে বলল দেবর্ষি, “যে ইভেন্টে আপনি প্রাইজ পেয়েছেন সেই ইভেন্টটার নাম হল—‘লোহা আনো, সোনা নাও’। কিছু বুঝলেন?”
ভ্যাবলার মতো উত্তর দিল সিধু, “না স্যার। কিচ্ছু বুঝলাম না।”
“এই ইভেন্টের শর্ত অনুযায়ী আপনি যত কেজি ওজনের লোহা আমাদের শো-রুমে নিয়ে আসতে পারবেন, বিনিময়ে তত গ্রাম ওজনের সোনার অলংকার ফ্রি পাবেন। মানে আপনি যদি দশ কেজি ওজনের লোহা, মানে লোহার তৈরি সাধারণ জিনিসপত্র আর কী, নিয়ে আসেন, তাহলে আমাদের তরফ থেকে আপনি দশ গ্রাম ওজনের সোনার গয়না ফ্রিতে পেয়ে যাবেন। বুঝেছেন?”
“অ্যাঁ, বলেন কী! তত গ্রাম ওজনের সোনার গয়না? ফ্রিতে! আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার, বুঝেছি বুঝেছি।” উত্তেজনায় এত জোরে চিৎকার করে কথা বলছিল সিধু, যে দেবর্ষির মনে হচ্ছিল ফোনটা কেটে দিলেও দিব্যি ওর গলা এখানে তার কান অবধি পৌঁছে যাবে।
“তবে শুনুন মি. দাস, আপনার হাতে সময় কিন্তু মাত্র এক ঘণ্টা। ঘড়িতে এখন বাজে পৌনে এগারোটা। ঠিক পৌনে বারোটার মধ্যে আপনাকে লোহা সমেত আমাদের শো-রুমে পৌঁছে যেতে হবে। না-হলে কিন্তু আপনি ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যাবেন। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার, মি. দাস?”
“হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার। সব ক্লিয়ার। এক ঘণ্টা নয়, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি আপনাদের শো-রুমে।” বলেই দুম করে ফোনটা কেটে দিল সিধু।
ফোনটা রাখার পর থেকে কেমন একটা মিশ্র অনুভূতি হতে শুরু করল দেবর্ষির। খালি মনে হচ্ছিল, এরকমটা করে সে মোটেও ঠিক করেনি। যদি ধরা পড়ে যায়, কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়ে যাবে তাহলে। পাড়ায় মুখ দেখানোর আর কোনও উপায় থাকবে না। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল, সে যা করেছে, বেশ করেছে। এরকম একটা হাড় জ্বালানো মস্তানের সঙ্গে এরকমটাই করা উচিত। কিন্তু তাও ঘড়ির কাঁটাটা টিকটিক করতে করতে যত পনেরো মিনিটের দিকে এগোচ্ছিল, দেবর্ষির টেনশন ততটাই বাড়ছিল। একবার তো সে ভাবল কাজ নেই ঝামেলায় পড়ে। এর চেয়ে দোকান বন্ধ করে সোজা বাড়িই চলে যাবে। কিন্তু তাও কে যেন জোর করে তাকে আটকে রাখল সেখানে।
অপেক্ষা করতে করতে একসময় পনেরো মিনিট হয়ে গেল। কিন্তু সিধু তখনও এল না। আস্তে আস্তে ঘড়ির কাঁটা কুড়ি মিনিট, ত্রিশ মিনিট, চল্লিশ মিনিট এমনকি পঞ্চাশ মিনিটও অতিক্রম করে গেল। তাও সিধুর টিকিটারও পাত্তা পাওয়া গেল না। ভিতর ভিতর হাঁপ ছেড়ে নিজের মনকে দেবর্ষি বোঝাচ্ছিল যে, নিশ্চয়ই ক্রসচেক করার জন্যে সিধু ফোন করেছিল শো-রুমে। তখনই তার সব জারিজুরি ধরা পড়ে গেছে। যাক, ভালোই হল একদিক থেকে। অযথা ঝামেলাটা এড়ানো গেল। কিন্তু ঘড়িতে যখন ঠিক এগারোটা চল্লিশ বাজল, তখন দুজন সাকরেদকে পিছনে বসিয়ে একটা বাইকে চালিয়ে এসে হাজির হল সিধু। আর ওর বাইকের পিছন পিছন পতঞ্জলি জুয়েলার্সের শো-রুমের সামনে এসে দাঁড়াল একটা ছোটোগোছের ট্রাক। দোকানে বসা অবস্থাতেই সেই ট্রাকটা দেখে দেবর্ষির চোখ পোঁ করে কপালে উঠে গেল। কারণ, পুরো ট্রাকটায় ঠাসাঠাসি করে রাখা শয়ে শয়ে লোহার জিনিস। দড়ি-ছেঁড়া লোহার ক্যাম্প খাট, ঝুলকালিতে নীচটা কালো হয়ে যাওয়া ক্লাবের পিকনিকের জাম্বো সাইজের কড়াই, ইঞ্চি খানেক পুরু ধুলোর আস্তরণে ঢাকা আদ্যিকালের ট্রাঙ্ক, মরচে পড়া পুরোনো একটা বড়ো লোহার আলমারি, হরেক ডিজাইনের জং-ধরা জানালার গ্রিল, রঙ চটে যাওয়া ঝরঝরে পুরোনো সাইকেল—কী নেই সেই ট্রাকে। দুনিয়ায় লোহার জিনিস যেখানে যা পেয়েছে, প্রায় সমস্তটাই সিধু তুলে নিয়ে এসেছে এই ট্রাকে করে। এত দূর থেকে ঠাহর করা যাচ্ছে না বলে, না-হলে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেবর্ষির মনে কোনও সন্দেহ রইল না যে কাছে গিয়ে দেখলে সেই ট্রাকে নাট-বল্টু, তালা-চাবিও পর্যন্ত সে খুঁজে পাবে। এমনকি পেরেক-আলপিন কিংবা কানখুশকি দেখতে পেলেও সে বিন্দুমাত্র অবাক হবে না।
তবে দেবর্ষি অবাক না হলেও অবাক হল পতঞ্জলি জুয়েলার্সের দরজার বাইরে লাঠি হাতে টুলে বসে থাকা মাঝবয়সি সিকিউরিটি গার্ডটা। কিছু বুঝতে না পেরে সে গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল ট্রাকটার দিকে। সিধু আর তার সাকরেদরা অবশ্য তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে অম্লানবদনে নিজেদের কাজ শুরু করে দিল। সঙ্গী দুজনের হাঁকডাকে দুজন খালাসি ট্রাক থেকে নেমে এক এক করে সমস্ত জিনিস নামিয়ে রাখতে শুরু করল ঝাঁ-চকচকে দোতলা শো-রুমটার সামনের ফুটপাথে। আর সিধু বাইক থেকে নেমে চাবিটা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকা গার্ডটার দিকে একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে গটগট করে হেঁটে শো-রুমের কাচের স্যুইং ডোরটা ঠেলে ঢুকে গেল ভিতরে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন ব্যাপারটা কিছুই মাথায় ঢুকল না গার্ডটার, তখন সে আর থাকতে না পেরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে কিছু জিজ্ঞেস করল সিধুর দুই স্যাঙাতকে। কিন্তু তারা সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে আগের মতোই হম্বিতম্বি সহকারে মাল নামানোর তদারকিতেই ব্যস্ত রাখল নিজেদের।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শো-রুমের ভিতর থেকে আরেকজন স্যুট-বুট পরা ভারিক্কিগোছের ভদ্রলোকের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল সিধু। নিজের দোকানে বসে রগড় দেখতে থাকা দেবর্ষি স্পষ্ট বুঝতে পারছিল যে সিধু সেই ভদ্রলোককে প্রাণপণে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু উনি সেটা কিছুতেই মানছেন না, ক্রমাগত মাথা নেড়ে চলেছেন নেতিবাচক ভঙ্গিতে। ততক্ষণে ব্যাপার-স্যাপার দেখে রাস্তার কিছু আমোদগেঁড়ে জনতাও কৌতূহলী হয়ে ভিড় জমিয়েছে সেখানে। শো-রুমের আরও দুয়েকজন কর্মচারীও বেরিয়ে এসেছে বাইরে। সব মিলিয়ে ড্রামাটা যখন বেশ জমে উঠেছে তখন হঠাৎ করে পাশে ফোনের আওয়াজে চমকে উঠল দেবর্ষি। তাকিয়ে দেখল তার নতুন নাম্বারটায় কল করছে সিধু। সর্বনাশ! এই ডামাডোলে ফোনটা সাইলেন্ট করতেই সে ভুলে গিয়েছিল। ভাগ্যিস রাস্তার অন্য প্রান্তে সিধুর কান অবধি শব্দটা পৌঁছায়নি। ঝটপট ফোনটা কেটে দিয়ে আর কোনও রিস্ক না নিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিল সে। ওদিকে ফোন কেটে যাওয়ায় সিধু প্রথমে খুব অবাক হয়ে আরও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করতে থাকল কাঞ্চন দত্তকে ফোনে ধরার। কিন্তু তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। ফলে সে আরও উত্তেজিত হয়ে তর্ক করতে শুরু করল। দেবর্ষি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিল সিধুর এত মরিয়া হয়ে ওঠার মূল কারণটা। আসলে তার চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাঁচুর এলাকায় তার নিজের প্রেস্টিজের এরকম গ্যামাক্সিন হওয়াটা সে একদমই মেনে নিতে পারছিল না। আবার অন্যদিকে কলকাতার এই নামি জুয়েলার্সের কর্মচারীরাও সিধুর মতো মফস্সলের এই পাতি মস্তানকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিতে নারাজ। ফলে বিতণ্ডা ক্রমশ বাড়তেই লাগল। একটা সময় হঠাৎ সিকিউরিটি গার্ডটা তার হাতের লাঠিটা দিয়ে ট্রাঙ্কের ওপর রাখা কড়াইটায় দিল এক ধাক্কা। ফলে কড়াইটা সশব্দে পড়ে গেল ফুটপাথে। আর যায় কোথায়? ক্ষেপে উঠে সিধু সোজা এক থাপ্পড় কষিয়ে দিল বেচারা গার্ডটার গালে। গার্ডটাও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সেও এগিয়ে এল তেড়েফুঁড়ে। ব্যস, এতক্ষণ মুখে মুখে যে ঝামেলাটা হচ্ছিল, এরপর থেকে শুরু হয়ে গেল ধাক্কাধাক্কি, ধস্তাধ্বস্তি। গার্ডটাকে চেপে ধরে আরও দুয়েক ঘা কষাতে যাচ্ছিল সিধু, কিন্তু হঠাৎ করে পিছনে ধাঁই করে একটা লাঠির বাড়ি খেয়ে লাফিয়ে উঠল সে।
গণ্ডগোলের আভাস পেয়ে শো-রুমের তরফ থেকে কেউ হয়তো ফোন করেছিল থানায়। তাদের এই ছোটো শহরে সমস্ত দেশব্যাপী এত নামকরা এই জুয়েলারি শো-রুমের উদ্বোধনী দিনেই কোনও উৎপটাং ঝামেলা হোক, এটা শহরের কারোরই কাম্য নয়। ফলে কমপ্লেন পাবার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নেওয়া হয়েছিল থানা থেকে। এইটুকু দূরত্বের জন্যে গাড়ি বের না করে পায়ে হেঁটেই চার পাঁচজন পুলিশ রওয়ানা দিয়েছিল শো-রুমের দিকে। আসতে আসতে তারা দেখতে পেয়েছে সবটাই। ফলে মারমুখী সিধুকে থামানোর জন্যে লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। কিন্তু তর্কাতর্কিতে ব্যস্ত সিধু এতসব খেয়ালই করেনি। তাই আচমকা লাঠির বাড়ি খেয়ে সে আরও ক্ষেপে গিয়ে একটা কুৎসিত গালাগালি দিয়ে পিছন ফিরে সোজা সেই পুলিশটার কলার চেপে ধরল। আর সেটাই কাল হল তার। এমনিতেই তার মস্তানির কারণে সে যে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের খুব একটা সুনজরে ছিল, তা নয়। তার ওপর কর্তব্যরত অফিসারের কলার চেপে ধরার মতো গর্হিত অপরাধ। তা সে পরের মুহূর্তেই যতই ভুলটা বুঝে হাত সরিয়ে নিক না কেন, যতজন পুলিশ এসেছিল ঘটনাস্থলে, তারা আর সময় নষ্ট না করে সবাই মিলে একযোগে ধাঁইধপাধপ চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুসি মারতে শুরু করে দিল তাকে। যারা যারা এতক্ষণ মজা দেখার জন্যে ভিড় করেছিল সেখানে, পুলিশের এই রুদ্রমূর্তি দেখে ম্যাজিকের মতো সবাই হাওয়া হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে। সিধুর সঙ্গে আসা তার দুই সাকরেদও দিব্যি গা-ঢাকা দিয়ে দিল বেগতিক দেখে। একলা বেচারা সেই পড়ে রইল সেখানে মার খাবার জন্যে। পুলিশ অফিসারেরা আর বাড়তি কথাবার্তা বা জিজ্ঞাসাবাদে না গিয়ে চাক্ষুষ প্রমাণের ভিত্তিতেই বিনা প্ররোচনায় শো-রুমে এসে হুজ্জতি করার অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সেখান থেকেই তাকে থানায় নিয়ে গেল এই দুশো মিটার রাস্তা ঘাড়ে ধাক্কা, লাঠির গুঁতো দিতে দিতে।
আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি ঠান্ডা হবার পরও কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেবর্ষি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ রাখছিল কতক্ষণে সিধু ছাড়া পায়। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে তাকে বেরোতে দেখা গেল থানার গেট থেকে। তার দুই স্যাঙাত ততক্ষণে আর কোনও ঝামেলা না করে চুপচাপ কথা না বাড়িয়ে ফুটপাথে নামিয়ে রাখা সমস্ত লোহা-লক্কড় ফের ট্রাকে উঠিয়ে বিদেয় করে নিজেরা ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছিল থানার আশেপাশে। সিধু বেরোতেই তাকে বাইকের পিছনে চাপিয়ে তারাও ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ল সেই তল্লাট থেকে। অবশ্য তার দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় সিধুর হাঁড়ির মতো গোমড়া মুখখানা দেখে থানার ভিতরে তার এই স্বল্পকালীন থাকার অভিজ্ঞতাটা যে খুব একটা সুখকর হয়নি, সেটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হল না দেবর্ষির।
মনে মনে তখন আনন্দের জোয়ারে ভাসছিল দেবর্ষি। যতটুকু সে চেয়েছিল, তার কয়েকগুণ বেশি শোধ সে নিতে পেরেছিল সিধুর ওপর। কিন্তু তাও কিছুক্ষণের মধ্যেই সে টের পেল, তার মনটা যেন তখনও পুরোপুরি ঠান্ডা হয়নি। কিছুটা অতৃপ্তি যেন তখনও থেকে গেছে। একটু ভাবতেই সে বুঝতে পারল যে পাঁচুর প্রতি রাগটা এখনও তার মেটেনি। তাই ভালোমানুষ মনটার শত আপত্তি উপেক্ষা করে আবার তার দুষ্টু মনটা ছকতে শুরু করল এবার পাঁচুর ওপর প্রতিশোধটা কীভাবে নেওয়া যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও উপায় মাথায় আসছিল না তার। এদিকে বেলা প্রায় দেড়টা বেজে গেছে ততক্ষণে। বেশ খিদেও পেয়ে গেছে তার। সঙ্গের ঝোলা ব্যাগটা থেকে টিফিন বক্সটা বের করে তার থেকে পরোটা আর আলুভাজা খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত পাঁচুকে শায়েস্তা করার প্ল্যানটা মাথায় এসে গেল দেবর্ষির।
তিন
মাথার ওপর বনবন করে ঘুরছিল ফ্যানটা। তাও প্রচণ্ড গরম লাগছিল পাঁচুর। এটা ওর একটা সমস্যা। অল্পতেই ভীষণ গরম লেগে ঘাম হতে থাকে ওর। এইজন্যে ওকে যে আড়ালে সবাই ‘ঘেমো পাঁচু’ বলে ডাকে, সেটাও তার অজানা নয়। তবে এসবে সে বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দেয় না। আপাতত যেমন ফ্যানের তলায় একটা চেয়ার টেনে বসে হাতে ধরা পেপসির বোতলটা থেকে আয়েশে চুমুক দিচ্ছিল সে। গরমে একটু অস্বস্তি হলেও মনটা তার কিছুক্ষণ যাবৎ বেশ খুশি খুশি হয়ে রয়েছে। কারণটা আর কিছুই নয়, এই কিছুক্ষণ আগেই একজন চর মারফত তার কানে এসেছে যে আজ নাকি স্টেশন রোডে ওর চরম শত্রু সিধু মস্তান বেজায় অপদস্থ হয়েছে। ঝামেলা করার জন্যে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে আড়ংধোলাই দিয়েছে। আর কোনোদিন শহরে সে কোনোরকম ঝামেলায় জড়াবে না, এই মর্মে মুচলেকা লিখে দিয়ে শেষ পর্যন্ত সে ছাড়া পেয়েছে। অবশ্য এতে খুশি হবার পাশাপাশি একটু চিন্তার কারণও রয়েছে। এই যে নতুন বড়োবাবু এসেছেন থানায়, তিনি কেমন যেন একটু বেয়াড়া গোছের বলে মালুম হচ্ছিল পাঁচুর। তা সিধুকে সে যতই অপছন্দ করুক না কেন, শহরের একজন পুরোনো মস্তান হিসেবে একটু তো সম্মান তার প্রাপ্য ছিল। অবশ্য অত টেনশন করারও কিছু নেই। সে মোটেই সিধুর মতো অত কাঁচা ছেলে নয়। সব কাজ গুছিয়ে করতেই সে ভালোবাসে। দেরি না করে এই নতুন বড়োবাবুর সঙ্গেও আগেরজনের মতো ভাব জমিয়ে নিতে হবে। সকাল থেকে কাজে নেমে পড়ে ইতিমধ্যেই অনেকটা কালেকশন হয়ে গেছে। রোদটা একটু পড়লে বাদবাকি দোকানগুলো থেকেও টাকাটা নিয়ে নিতে হবে। তারপর একটা শুভদিন দেখে থানায় একটু উপহার-টুপহার নিয়ে নতুন স্যারের সঙ্গে আলাপটা সেরে আসতে পারলেই, ব্যস। তাকে আর পায় কে?
তবে আপাতত সে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে একেবারেই রাজি নয়। অলরেডি দুটো পাঁচ বেজে গেছে ঘড়িতে। এখন তার বিশ্রামের সময়। রোজই সারা সকাল হাড়ভাঙা খাটুনির পর দুটো থেকে চারটে অবধি দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয় সে। তারপর বিকেলবেলা আবার নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজে। এটাই তার রোজকার রুটিন। তার এক চ্যালা বেশ কিছুক্ষণ হল চলে গেছে বিরিয়ানি নিয়ে আসতে। এই চলে এল বলে। মনটা তাই বেশ ফুরফুরে তার। লম্বা একটা চুমুকে পেপসিটা শেষ করে বোতলটা জাস্ট সে নামিয়ে রাখতে যাবে, এমন সময় জিনসের পকেটে ফোনটা বেজে উঠল। একটা অচেনা নাম্বার ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। ফোনটা ধরার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না পাঁচুর। কিন্তু যদি কোনও ইম্পরট্যান্ট খবর-টবর থাকে, তাই অনিচ্ছা সহকারে একটু বিরক্ত গলায় কলটা রিসিভ করে সে বলল, “হ্যালো।”
নিজের অভিনয় ক্ষমতাকে ফের কাজে লাগিয়ে গলাটা একটু বদলে ফেলে ফোনের অন্যদিক থেকে দেবর্ষি বলল, “হ্যালো, পাঁচুদা। একটা সাংঘাতিক খবর আছে তোমার জন্যে। হয়েছে কী জানো, বাজারে না…”
“ভাই, কে বলছিস সেটা আগে বল।” সাংঘাতিক খবরটা দেওয়ার জন্যে দেবর্ষির উত্তেজনাতে এক বালতি জল ঢেলে নিরাসক্ত গলায় বলল পাঁচু।
এই রে! আগে থেকে তো কোনও নাম ভেবে রাখেনি দেবর্ষি। এখন কী হবে। তাড়াহুড়োয় কোনও নামও মনে আসছে না। খানিক ঘাবড়ে গিয়েই সে ম্যানেজ করার চেষ্টা করল, “আরে পাঁচুদা, তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তোমার একজন শুভচিন্তক।”
“কী বললি? শুভ! ও, তাই বল। তা তোকে চিনব না কেন শুনি? এই তো সেদিন জন্মাতে দেখলাম তোকে।” আশ্বস্ত হয়ে বলল পাঁচু, “তা বলছি, বেশ লায়েক হয়ে গেছিস দেখি আজকাল। ধারই মাড়াস না এদিকের। সিধুর দলে নাম লেখালি নাকি?”
“আরে কী যে বল তুমি, পাঁচুদা। আমি কি তোমার দল ছেড়ে আর কোথাও যেতে পারি? না-হলে এতজন থাকতে এই সাংঘাতিক খবরটা তোমাকেই প্রথমে দেব বলে কেন ফোন করছি, বলো তো?”
“সাংঘাতিক খবর! তাই নাকি? কী এমন খবর বল তো শুনি।”
“আরে সেটাই তো বলতে চাইছি তোমাকে। না শুনে বেকার ভ্যাজর ভ্যাজর করে চলেছ তখন ধরে। বলছিলাম যে, বাজারে বোম রাখা আছে। বুঝলে? যে-কোনো সময় ফাটবে।” গলাটা উচ্চগ্রামে তুলে ভীষণ অতিনাটকীয় ভঙ্গিতে বলল দেবর্ষি।
“অ্যাঁ? কী বললি? বোম! কোথায়? বাজারে?” শুনেই পরিত্রাহি চেঁচাতে শুরু করে দিল পাঁচু, “ওরে বিটলে। অ্যাই গবাই, ফটিক। কোথায় আছিস সব। পালা, পালা, শিগগির পালা। বাজারে বোম রাখা আছে। যে-কোনো সময় ফাটবে।”
দেবর্ষি দেখল মহা বিপদ। পুরো প্ল্যানটাই না ভেস্তে দেয় ভিতুর ডিমটা। তড়িঘড়ি সে বলল, “আরে পাঁচুদা। কোথায় পালাচ্ছ? তুমি চলে গেলে সবাইকে ‘পোটেকসন’টা কে দেবে শুনি? কত দায়িত্ব তোমার। না পালিয়ে তোমার এখন কী করা উচিত জানো?”
“কী করা উচিত?”
“তোমার উচিত ইমিডিয়েটলি সোজা থানায় গিয়ে খবরটা দেওয়া, বুঝলে? ভাবো তো, থানায় নতুন দারোগাবাবু যখন দেখবেন, তুমি সবার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এত বড়ো খবরটা থানায় এসে জানিয়েছ, তখন উনি তোমাকে কত্ত ভালোবাসবেন। তোমার আর আলাদা করে কিছু না করলেও চলবে। তাই না?”
এতক্ষণে কথাটা বেশ মনে ধরল পাঁচুর। বলল, “হ্যাঁ, এটা অবশ্য তুই খুব একটা মন্দ বলিসনি। তা কী বলব গিয়ে থানায়?”
“বলবে যে, নন্দী গার্মেন্টসের পিছনে যে পানাপুকুরটা আছে, সেটার পাড়ে একটা কৃষ্ণচূড়াগাছ আছে না, সেই গাছটার নীচে ঝোপেঝাড়ের আড়ালে একটা কালো ক্যারি-প্যাকের মধ্যে বোমা রাখা আছে। ওরা যাতে খুব তাড়াতাড়ি গিয়ে সেটা ডিফিউজ করার ব্যবস্থা করে। না-হলে ভয়ংকর বিপদ হবে।”
“কিন্তু, তুই… তুই কী করে এই খবরটা পেলি, অ্যাঁ?”
“সেটা জেনে তুমি কী করবে, শুনি? এখন কি এসব জিজ্ঞেস করার সময়? এতগুলো মানুষের জীবনমরণ সমস্যা, আর তুমি ফালতু টাইমপাস করছ?” এক দাবড়ানি দিয়ে পাঁচুর অতিরিক্ত কৌতূহল মেটাবার চেষ্টা করল দেবর্ষি—“দ্যাখো, খবরটা তোমার দেওয়ার হলে দাও, না-হলে আমি নিজেই গিয়ে জানিয়ে আসছি থানায়।”
কাজ হল সঙ্গে সঙ্গে। হড়বড়িয়ে বলে উঠল পাঁচু, “আরে না না, তুই যাবি কেন? আমি তো যাচ্ছিই খবরটা দিতে। তুই একদম চাপ নিস না। এই আমি বেরোলাম।” বলেই টুক করে ফোনটা কেটে দিল সে।
দেবর্ষি ভেবেছিল চুপচাপ কাজ হয়ে যাবে, বেশি লোক জানাজানি হবে না। কিন্তু বাস্তবে ঘটল ঠিক তার উলটোটা। আধঘণ্টার মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। এই কিছুক্ষণ আগেও যে চত্বরটা মানুষের ভিড়ে গমগম করছিল, দেখতে দেখতে সেটাই খাঁ খাঁ করতে লাগল। ঝুপঝাপ করে ঝাঁপ পড়ে গেল অধিকাংশ দোকানের। অনেকে দোকানদারই বোমার ভয়ে দোকান বন্ধ করে চলে গেল বাড়িতে। তবে বেশিরভাগই গিয়ে ভিড় করল নন্দী গার্মেন্টসের পিছনে পানাপুকুরটার পাড়ে স্বচক্ষে বোমা দেখবে বলে। ‘যাব কি যাব না’ করতে করতে এক সময় দেবর্ষিও গিয়ে হাজির হল অকুস্থলে। সেখানে গিয়ে ব্যাপার-স্যাপার দেখে তো তার চক্ষু চড়কগাছ। পুকুরের যে-পাড়ে কৃষ্ণচূড়াগাছটা আছে, সেটা বাদ দিয়ে বাকি তিনটে পাড়, পুকুরের পাশের গলিটা যেটা নন্দী গার্মেন্টসের পাশ দিয়ে এসে স্টেশন রোডে পড়েছে, সেই রাস্তাটা, এমনকি স্টেশন রোডের বেশ অনেকটা জায়গা গিজগিজ করছে মানুষের ভিড়ে। যেন শহরের সব মানুষ ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ মনোভাব নিয়ে ফোকটে তামাশা দেখবে বলে সেখানে এসে জুটেছে। থানা থেকে আসা অনেকজন পুলিশ মিলে সেখানে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেই অত্যুৎসাহী জনতাকে সামলানোর। দেবর্ষি দেখল পাঁচুর সবক’টা চ্যালা-চামুণ্ডা সেখানে হাজির হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে ধরে ধরে প্রত্যেকের কানে তাদের গুরুর গুণকীর্তন করে চলেছে ক্রমাগত, কীভাবে পাঁচু নিজের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে বোমার খবর পাওয়ামাত্র পুলিশকে গিয়ে জানিয়েছে। উপস্থিত পাবলিকও দিব্যি চোখ গোল গোল করে সেই রোমহর্ষক বিবরণ গিলছে। তবে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়েও পাঁচুকে সেখানে দেখতে পেল না সে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে পুকুরের পাড়ে এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল যেখান থেকে সে দূর থেকে হলেও অন্য পাড়ে কৃষ্ণচূড়াগাছটা সোজাসুজি দেখতে পাচ্ছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো পুলিশের গাড়ি এসে থামল সেই গলির মাথায়। বেশ কয়েকজন পুলিশে অফিসার খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে নামলেন প্রথম গাড়িটা থেকে। দ্বিতীয় গাড়িটা থেকে নামলেন কলকাতা লালবাজারের বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের দুজন অফিসার। তাঁদের পরনে বোম প্রতিরোধক জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট আর একজনের হাতে একটা ছোটো আকারের টুল বক্স। একই সঙ্গে ওই গাড়িটা থেকেই নামল পাঁচু। আর সবশেষে যিনি নামলেন সেই গাড়িটা থেকে, তাঁকে দেখামাত্রই দেবর্ষির কেন যেন মনে হল যে থানার নতুন বড়োবাবু তিনি না হয়ে আর কেউ হতেই পারে না। তাঁর লম্বাচওড়া দোহারা চেহারা, অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি, ব্যক্তিত্বপূর্ণ রাশভারী চলাফেরাটাই হয়তো তাঁর এই ব্যাপারে নিসঃসন্দেহ হবার কারণ। গাড়ি থেকে নেমে তিনি বম্ব স্কোয়াডের অফিসারদের সঙ্গে গটগট করে হেঁটে এলেন ওরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল সেই দিকেই। ওঁর পিছন পিছন বিগলিত চিত্তে এল পাঁচুও। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে দেবর্ষির থেকে হাত পনেরো দূরে এসে দাঁড়ালেন ওঁরা। দেবর্ষি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল পাঁচু একগাল হাসি হেসে বড়োবাবুর কানে কানে ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করে বলেই চলেছে, “এই যে সার, এদের কথাই বলছিলাম আপনাকে… হেঁ হেঁ… এরা সবাই আমার… হেঁ হেঁ… মানে রিলেটিভসদের মতো আর কি। হেব্বি মান্য করে আমাকে, বুইলেন না? তাই ওদের সুখে, দুঃখে, বিপদে, আপদে… হেঁ হেঁ… থাকতে না পেরে আমি ছুটে আসি… হেঁ হেঁ…”
বড়োবাবু অবশ্য এসবে পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর মুখে পরবর্তী কার্যকলাপ সম্বন্ধে আলোচনা করছিলেন বম্ব স্কোয়াডের অফিসারদের সঙ্গে। কথাবার্তা শেষ হলে সেই দুজন অফিসার ধীর অথচ প্রত্যয়ী পদক্ষেপে রওয়ানা দিলেন কৃষ্ণচূড়াগাছটার দিকে। সেখানে পৌঁছে সমস্ত আগ্রহী জনতার বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে তাঁরা হাতের টুল বক্স থেকে চৌকোমতো একটা যন্ত্র বের করে প্রথমে কীসব পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তারপর খুব সন্তর্পণে ঝোপের আড়াল থেকে বের করে আনলেন একটা কালো রঙের ক্যারি-প্যাক। দেবর্ষি খেয়াল করছিল তার আশেপাশের সমস্ত জনতার চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল কী হচ্ছে সেটা দেখার জন্যে। যাই হোক, আরও নানারকম যন্ত্রপাতি দিয়ে আরও হাজার রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর একজন অফিসার খুব সাবধানে সেই প্যাকেটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন চকচকে ধাতব একটা জিনিস। এতদূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না কী সেটা, তবে দুপুরের সূর্যের আলো সেটায় পড়ে প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল সব্বার। সেই ধাতব বস্তুটিকে মাটিতে রেখে সেই অফিসার দুজন এবার উবু হয়ে বসে শুরু করলেন তাঁদের পরবর্তী ধাপের কাজ। বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর উঠে দাঁড়ালেন একজন অফিসার। তাঁর মুখ দেখেই মনে হচ্ছিল তিনি যেন খুব কনফিউসড। হাতের ওয়াকিটকির মাধ্যমে তিনি থানার বড়োবাবুকে সেখানে আসতে বললেন। ডাক পেয়ে তাড়াহুড়ো করে বড়োবাবু গিয়ে যোগ দিলেন দুই অফিসারের সঙ্গে। আবার শুরু হল মাটির দিকে তাকিয়ে তিনজনের কথাবার্তা। এক মিনিটের মধ্যে এবার উলটোদিকে ফিরে বড়োবাবু থমথমে মুখে হাতের ইশারায় সেখানে ডেকে পাঠালেন পাঁচুকে। এতজন পুলিশ, এত্তজন মানুষের মধ্যে আর কাউকে না ডেকে বড়োবাবু ডেকে পাঠিয়েছেন তাকে। পাঁচুর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে তার তখন আর মাটিতে পা পড়ছে না। শুধু কায়দা মেরে কলার তোলাটাই বাকি রেখে আশেপাশের জনতার দিকে তাকিয়ে একটা কান এঁটো করা আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে সে রওনা দিল কৃষ্ণচূড়াগাছটার দিকে।
অকুস্থলে পৌঁছতেই পাঁচুকে নীচের দিকে কিছু একটা দেখালেন বড়োবাবু। এতদূর থেকে দেখলেও বুঝতে অসুবিধে হল না যে নীচের দিকে তাকানো মাত্র এক পলকে পাঁচুর মুখ থেকে সমস্ত হাসি উধাও হয়ে গেল। হতভম্ব ভাব ফুটে উঠল ঝুলে পড়া মুখটাতে। কিন্তু সেটাও মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে। তারপরই উপস্থিত সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ ভীষণ জোরে একটা শব্দ করে, না না, বোম নয়, বড়োবাবুর ডানহাতের একটা থাপ্পড় সপাটে এসে পড়ল পাঁচুর গালে। ‘বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়’—এই কথাটা এতদিন শুধু বইয়ের পাতাতেই পড়ে এসেছিল দেবর্ষি। আজকের পর থেকে তার আর কোনও সন্দেহই রইল না যে পাঁচুর গালে পড়া এই থাপ্পড়টা সেই বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় ছাড়া আর কিছুই না। সেই প্রচণ্ড চড় খেয়ে বেসামাল হয়ে পাঁচু আর একটু হলে পড়ে যাচ্ছিল পুকুরে। কোনোমতে পাশের একটা গাছের ডাল ধরে টাল সামলাল সে। তবে তাতেও যে তার নিস্তার মিলল, তা নয়। কোনও এক অজানা কারণে আচমকা ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে পাঁচুকে উপর্যুপরি কিল, চড়, থাপ্পড় মারতে শুরু করলেন বড়োবাবু। সঙ্গে অত দূর থেকেও কানে ভেসে আসছিল তাঁর ক্রুদ্ধ গর্জন, “হতভাগা, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি! কলকাতা থেকে লোক ডাকিয়ে এনে তাঁদের সামনে আমাকে অপদস্থ করা! চল থানায়। তোর ফাজলামি আমি আজ বের করেই ছাড়ব।” বলতে বলতে উপস্থিত সবার সামনেই পাঁচুকে মারতে মারতে তিনি টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসে তুললেন গাড়িতে। পিছন পিছন গম্ভীর মুখে সেই কালো ক্যারি-প্যাকটা হাতে করে নিয়ে এসে গাড়িতে উঠলেন বম্ব স্কোয়াডের সেই দুই অফিসার। গাড়ি ছাড়ার আগে বড়োবাবু আশেপাশের সবাইকে শুনিয়ে প্রচণ্ড হুংকারে থানার আরেক অফিসারকে নির্দেশ দিলেন যাতে লাঠিপেটা করে হলেও এক মিনিটের মধ্যে মজা দেখতে আসা এই পুরো জমায়েতটা খালি করে দেওয়া হয়। এর আগে থেকেই বড়োবাবুকে হঠাৎ করে এই খেপচুরিয়াস অবতারে অবতীর্ণ হতে দেখে জনতা এক পা দুই পা করে হালকা হতে শুরু করেছিল। এবার এই নির্দেশটা কানে ঢোকামাত্রই নিমেষের মধ্যে ভোজবাজির মতো ধাঁ করে পুরো এলাকাটা পুরোপুরি জনশূন্য হয়ে গেল।
বিপদের তোয়াক্কা না করে ফোকটে তামাশা দেখতে পাবার আশায় জড়ো হওয়া জনগণ অবশ্য বোম ফাটা বা নিষ্ক্রিয় করা দেখতে না পেলেও শেষ পর্যন্ত খুব একটা হতাশ হল না। কারণ পাঁচুকে এভাবে নাকাল হতে দেখে প্রকৃষ্ট বিনোদনের অভাব কারোরই হয়নি। শুধু একটা জিনিসই কেউ বুঝে উঠতে পারল না যে হঠাৎ করে বড়োবাবু এমনটা ক্ষেপে গেলেন কেন? অবশ্য বুঝতে না পারাটাই স্বাভাবিক। কারণ, সেখানে কারোরই তো আর জানার কথা নয় যে কালো প্যাকেটের মধ্যে থেকে বের হওয়া যে ধাতব জিনিসটা সূর্যের আলো পড়ে ঝকমক করে উঠেছিল, সেটা আর কিছুই নয়, দেবর্ষির স্টিলের টিফিন বক্সটা। টিফিন শেষ করার পর যাতে সেটাতে কোনও আঙুলের ছাপ না থাকে, এমনভাবে ধুয়ে, মুছে, কালো প্যাকেটটাতে ভরে যেটা সে সবার অলক্ষ্যে রেখে এসেছিল কৃষ্ণচূড়াগাছটার নীচের ঝোপঝাড়ে। ও হ্যাঁ, তার আগে কালীপুজোয় বেঁচে যাওয়া বাজির স্টক থেকে খুঁজে বের করে একটা পলতে ছাড়া বুড়িমার চকোলেট বোমও অবশ্য সেটার ভিতরে সযত্নে রেখে দিতে সে ভোলেনি।
সিধু আর পাঁচুর জুলুমবাজির যোগ্য জবাব দিতে পেরে এতক্ষণে যেন মনটা একটু ভালো লাগছিল দেবর্ষির। তবে পুরোপুরি শান্ত সেটা তখনও হয়নি। অবাক হয়ে সে অনুভব করছিল তার শরীরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটা স্বতন্ত্র সত্তা যেন রক্তের গন্ধ পাওয়া হাঙরের মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছিল যে সিধু বা পাঁচুর মতো ঝানু সমাজবিরোধীদের জন্যে পুলিশের রুলের এই সামান্য গুঁতো একটা সাময়িক দাওয়াই ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে ওরা বড়োজোর দুই-পাঁচদিন শান্ত থাকবে। তারপরই আবার স্বমূর্তি ধারণ করবে। তাই একবার যখন বাগে পাওয়া গেছে, এই সুযোগেই ওদের বিষদাঁতটা পুরোপুরি ভেঙে দিতে হবে যাতে ওরা ফের কখনও ফোঁস করে উঠতে না পারে। সমস্ত প্ল্যানটা আগে থেকেই ছকে রাখা ছিল তার। তাই সে অপেক্ষা করছিল কতক্ষণে পাঁচু ছাড়া পায় থানা থেকে তার জন্যে।
চারটে বাজার কিছুক্ষণ পর থানার চৌহদ্দি থেকে বেরোতে দেখা গেল পাঁচুকে। একেই তো সে এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত। তার ওপর এখন তার কোমর বেঁকিয়ে, দুই পায়েতেই বিকটভাবে লেংচে লেংচে হাঁটার ধরন দেখে তাকে থানায় কীরকম খাতিরদারি করা হয়েছে সেটা দিব্যি মালুম হচ্ছিল। থানা থেকে তার ডেরায় পৌঁছতে পাঁচুর খুব বেশি হলে দশ মিনিট সময় লাগার কথা। দেবর্ষি আরও পাঁচ মিনিট বাড়তি সময় দিয়ে শুরু করল তার ‘অপারেশন সিধু-পাঁচু’ পার্ট টু। নতুন সিম লাগানো ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করল সিধুকে।
দু-তিনটে রিং হতে না হতেই দেবর্ষি ফোনটা কান থেকে এক হাত দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হল। কারণ, ফোনটা রিসিভ করার সঙ্গে-সঙ্গেই তারস্বরে অকথ্য গালাগালের ফোয়ারা ছোটাতে শুরু করে দিয়েছে সিধু। দেবর্ষি অবশ্য মনে মনে মজাই পাচ্ছিল। না, সিধুর গালাগাল শুনে নয়, সেগুলো তো সে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে সোজা আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছিল। সে মজা পাচ্ছিল এটা ভেবে যে তার মানে তার তির একেবারে মোক্ষম নিশানায় গিয়ে লেগেছে। তাই সিধু এতটা ক্ষেপে গেছে। সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রইল। গালাগালির তোড় একটু কমতেই শ্লেষাত্মক সুরে বলল, “কী রে! লটারির ফার্স্ট প্রাইজটা কেমন লাগল? ওরা নাকি সেটা তোকে থানায় নিয়ে গিয়ে তারপর দিয়েছে? ভালো লেগেছে জিনিসটা?”
ব্যস, আবার শুরু হয়ে গেল গালাগালির বন্যা। যখনই সেটা একটু থামার লক্ষণ দেখা যায়, দেবর্ষি আবার একটু করে উস্কে দেয়, আর আবার সিধু নতুন উদ্যমে দেবর্ষির চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করার ইচ্ছাপ্রকাশ করতে শুরু করে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে সিধুকে আরও উত্তেজিত করে শেষ পর্যন্ত আসল চালটা চালল দেবর্ষি। কথার এক ফাঁকে বলল, “এত যে বলছিস, আমাকে সামনে পেলে হ্যান করবি, ত্যান করবি, নে বল দিকিনি, কোথায় আসতে হবে। তুই যেখানে বলবি, আমি সেখানেই এসে তোকে পিটিয়ে পাটিসাপটা বানিয়ে দেব।”
আরও চিড়বিড়িয়ে উঠল সিধু—“তাই নাকি রে ব্যাটা? তোর এত সাহস! পদ্মপুকুরটা চিনিস তো? হিম্মত থাকলে তবে চলে আয় পদ্মপুকুরের পাশের মাঠটায়। দেখি তোর কেমন ক্ষমতা। আজ যদি তোর চাঁদবদন আমি বিগড়ে না দিয়েছি, আমার নাম সিদ্ধার্থ দাস নয়।”
মোল্লার যত দৌড়, ওই মসজিদ পর্যন্তই। সিধুর দৌড়ও তাদের পাড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই পদ্মপুকুরটা তাদের পাড়াতে ঢোকার মুখটাতেই পড়ে। তার পাশে একটা মস্ত বড়ো মাঠ রয়েছে, যেখানে বিকেলবেলায় ছেলেপিলেরা খেলাধুলো করে আর ইভিনিং ওয়াক করেন বয়স্ক লোকেরা। সেখানেই তাকে আসতে বলছে সিধু। পাড়ার বাইরে বেরিয়ে মস্তানি করার দম তার নেই। মনে মনে বেশ হাসিই পেল দেবর্ষির। বলল, “নিশ্চয়ই, তোর নতুন একটা নাম রাখতে আজকেই আমি হেল্প করব, দাঁড়া। পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি আমি। তবে হ্যাঁ, দ্যাখ ভাই, এতদূর থেকে গিয়ে শুধু তোর মতো একটা ছুঁচোকে মেরে হাত গন্ধ করাটা আমার পোষাবে না। এর চেয়ে তুই একটা কাজ কর, তোর যতজন সাঙ্গপাঙ্গ আছে, সবাইকে নিয়ে আসিস, কেমন? মানে একসঙ্গে দশ-বারোজনকে না পেটালে হাতের সুখটা ঠিকঠাক হবে না, বুঝলি?”
চিৎকার করে আরও কিছু বলতে শুরু করছিল সিধু। কিন্তু তার আগেই ফোনটা কেটে দিল দেবর্ষি। এক মিনিট সময় নিয়ে তারপর ফোন করল পাঁচুকে। পাঁচু মনে হয় ওর নাম্বারটা আগে থেকে সেভ করে রাখেনি। তাই একটু যেন নিষ্প্রভ গলাতেই বলল, “হ্যালো!”
“কী রে পেঁচো? থানায় বড়োবাবু কেমন আদরযত্ন করল? সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছিস না নাকি শুনলাম?”
এবার গলাটা চিনতে পারল পাঁচু। সঙ্গে সঙ্গে এবার সে দেবর্ষির কানে সুধা ঢালতে শুরু করল। মনে মনে হাসি পেলেও দেবর্ষি অবাক হয়ে ভাবছিল, একদিনে এতটা পরিবর্তন ওর হল কী করে। আগে এর হাজারভাগের একভাগ কটুকথাও সে সহ্য করতে পারত না। চুপচাপ মুখ বুজে সরে পড়ত সেখান থেকে। গুম হয়ে থাকত সারাদিন। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হত মনটাকে। সেখানে আজ সে অম্লানবদনে এসব আজেবাজে কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মনস্থির করে নিজের প্ল্যানমাফিক কাজ করে চলেছে। সিধুর মতো পাঁচুর ক্ষেত্রেও একই কৌশল অবলম্বন করল সে। মাথা ঠান্ডা রেখে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পাঁচুকে উত্তেজিত করে তুলল। শেষ পর্যন্ত পাঁচু যখন ষাঁড়ের মতো চেঁচাতে শুরু করে দিল তখন সে বলল, “হুম, বুঝলাম। পুলিশের ডান্ডা খেয়েও এখনও তোর আশ মেটেনি। বাকি মেরামত যা করার আমাকেই করতে হবে দেখছি। এক কাজ কর, আমি পদ্মপুকুরের পাশের মাঠটায় তোর জন্যে অপেক্ষা করছি। যদি তোর মুরোদ থাকে, সাহসে যদি কুলোয়, চলে আয় এখানে। কিলিয়ে তোকে কালী পটকা বানাব আজ।”
এমনিতেই উটকো বোম-সংক্রান্ত খবর নিয়ে আজ এত ঝামেলায় পড়তে হয়েছে তাকে। বড়োবাবু মেরে মেরে চামড়া গুটিয়ে দিয়েছেন তার। কোথাও বসতে গেলেই ব্যথা করছে। কষ্ট হচ্ছে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বা চলতেও। এত কিছুর পর যার জন্যে আজ তার এই হেনস্থা হল, সেই তারই মুখে কালীপটকা শুনে আর সহ্য করতে পারল না পাঁচু। বেমালুম ভুলেই গেল যে শেষ পর্যন্ত শহরে আর কোনোদিন সে কোনও হুজ্জতি করবে না এই শর্তে মুচলেকা লিখে দেবার পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। শারীরিক যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে লাফিয়ে উঠে বলল, “হারামজাদা, তুই আমাকে দশ মিনিট সময় দে। আমি এক্ষুনি আসছি। আজ যদি ওই পদ্মপুকুরের মাটিতে তোকে পুঁতে না দিয়েছি তাহলে আমার নামে কুকুর পুষিস।”
“ফুঃ। তোর মতো একটা মশার নামে যদি কুকুর পুষি, তবে কুকুরটা লজ্জায় সুইসাইড করবে রে।” বলল দেবর্ষি, “তার চেয়ে তোকে একটা উপদেশ দিচ্ছি, মন দিয়ে শোন। এখানে আসার সময় তোর সমস্ত অকর্মণ্য সাকরেদগুলোকে সঙ্গে করে নিয়ে আসিস, বুঝলি? না-হলে খামখা হাড়গোড় ভেঙে উলটে পড়ে থাকবি মাঠের মাঝখানে। সেই আমাকেই কষ্ট করে তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে।” বলে পাঁচুর উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা রেখে দিল দেবর্ষি।
পাঁচ মিনিটও অপেক্ষা করতে হল না দেবর্ষিকে। তার দোকানের সামনে দিয়ে গোঁ গোঁ করতে করতে চার-পাঁচটা বাইক তিরবেগে বেরিয়ে গেল। হাঁড়ির মতো মুখ করে সবচেয়ে প্রথম বাইকটা চালাচ্ছিল পাঁচু। ওর পিছনে বসা বিটলে আর গবাই। এছাড়া বাকি বাইকগুলোতেও তিনজন করে বসা। প্রত্যেকেরই মুখ থমথমে, হাতে ধরা চেন, লাঠি, হকি স্টিক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সর্দারের অপমানের বদলা নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ওরা সব্বাই।
ব্যস, দেবর্ষির প্ল্যান সাকসেসফুল। শুম্ভ-নিশুম্ভকে সফলভাবে সে লেলিয়ে দিতে পেরেছে একে অপরের প্রতি। এবার ওরা মারামারি কাটাকাটি করে মরুক। ওর কাজ প্রায় শেষ। শুধু লাস্ট আর একটা ফোন তাকে করতে হবে সেই নতুন সিমটা থেকে।
পেট ফেটে বেরিয়ে আসতে চাওয়া হাসিটাকে কোনোমতে চেপে মনে একটা গাম্ভীর্য আর আতঙ্কের ভাব এনে পরিকল্পনার শেষ ধাপ অনুযায়ী ফোনের অ্যাড্রেস বুক থেকে উদ্দিষ্ট নাম্বারটা বের করে সেটায় কল করল দেবর্ষি।
চার
সাধারণত সন্ধের পরে একটু রাতের দিকেই মোবাইল রিচার্জের বা নতুন কানেকশন নেওয়ার কাস্টমারদের আনাগোনাটা বেশি হয়। তাই সেসব সামাল দিয়ে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রত্যেকদিনই দেবর্ষির রাত দশটা সাড়ে দশটা বেজে যায়। কিন্তু আজ তার মনটা বেশ হালকা লাগছিল বলে একটু আগেভাগেই সে দোকান বন্ধ করে দিয়েছিল।
ফেরার পথে বাজার থেকে মায়ের ওষুধটা আর একটু পাঁঠার মাংস কিনে সে যখন পদ্মপুকুরের পাশ দিয়ে তাদের পাড়ায় ঢুকল তখন ঘড়িতে বাজে পৌনে ন’টা। এমনিতে তাদের পাড়াটা বেশ জনবহুল। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে রাস্তায় মানুষজনের দেখা পাওয়া যায়। রিকশা, টোটো বা ছোটোখাটো গাড়িও চলাচল করে হরদম। কালীপুজোর পর থেকে ইদানীং রাস্তার ধারে লাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলাও শুরু হয়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। কিন্তু আজ দেবর্ষি লক্ষ করল রাস্তাঘাট সব যেন খুব শুনশান। গোটা পাড়াটা কেমন একটা থমথম করছে। কারণটা বুঝতে যে তার খুব একটা অসুবিধে হচ্ছিল তা নয়, তবুও খোলসা করে সেটা প্রথম তাকে বললেন তাদের প্রতিবেশী এবং তার বাবার ছোটবেলার বন্ধু সুজিতজেঠু। তাঁর কাছ থেকেই দেবর্ষি জানতে পারল যে বিকেলের একটু পর, সন্ধে নামার মুখে পাঁচু আর তার দলবল বাইকে করে এসে লাঠিসোঁটা, অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আচমকা আক্রমণ করে বসে সিধুকে। সিধুও তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে তৈরিই ছিল। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করে দুই দলে উদ্দাম মারপিট শুরু হয়ে যায়। দুমদাম পেটোও পড়ে দু-চার পিস। কিন্তু মারামারিটা ভালো করে জমে ওঠার আগেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেখানে এসে হাজির হয় দুই গাড়ি পুলিশ। এমনিতে অন্যান্য সময় হত্যে দিয়ে বার বার ডাকাডাকি করেও যাদের টিকিরও দেখা পাওয়া যায় না, সেই আইনরক্ষকদের বিনা তলবে মাত্রাতিরিক্ত তৎপরতার সঙ্গে উপস্থিত হতে দেখে ঘটনাস্থলে আতঙ্কগ্রস্ত সাধারণ মানুষেরা তো বটেই, যুযুধান দুই দলের সমস্ত দুষ্কৃতীরাও কেমন যেন ভেবলে গিয়ে পালাতে ভুলে গিয়েছিল। ফলে একরকম শূন্য আয়াসেই পুলিশ মারামারি থামিয়ে মাঠের মধ্যেই হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা সব্বাইকে আগাপাশতলা লাঠিপেটা করতে করতে সঙ্গে করে আনা প্রিজন ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যায় থানায়।
সুজিতজেঠু বুঝতে না পারলেও দেবর্ষি কিন্তু সজ্ঞানেই বেমালুম চেপে গেল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পুলিশের আগ বাড়িয়ে চলে আসার আসল কারণটা। এমনিতেই সারাদিন ধরে সিধু আর পাঁচুর নানারকম দৌরাত্ম্যে থানার সবাই তিতিবিরক্ত হয়েই ছিল। এরকম সময় দেবর্ষির ফোনে পদ্মপুকুরের মাঠে দুজনের দলবল নিয়ে মারামারির খবরটা পেয়ে তাঁরা কাজে নেমে পড়তে আর একটা মুহূর্তও সময় নষ্ট করেননি। ফোনটা রাখার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তার দোকানের সামনে দিয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে প্রিজন ভ্যান সমেত পুলিশের গাড়ি দুটোকে যেতে দেখে নিশ্চিন্ত হবার পর দেবর্ষি প্রমাণ লোপাটের জন্যে তার ফোনটা থেকে সেই নতুন সিমটা খুলে ভেঙে ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে।
তার পুরো প্ল্যানটা যে চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছে তাতে সন্দেহের আর কোনও অবকাশ ছিল না। কারণ,
দোকান বন্ধ করে ফেরার আগে কানাঘুষোয় লেটেস্ট আপডেট সে যেটুকু পেয়েছে সেটা হল থানায় নিয়ে যাবার পর দুই দলের প্রত্যেককে আরও বেশ কয়েক দফা মহাসমারোহে আদর-আপ্যায়ন করা হয়েছে। তারপর আপাতত তাদের পুরে রাখা হয়েছে লক-আপে। কাল রবিবার, কোর্টকাছারি বন্ধ। তাই পরশুদিন তাদের পেশ করা হবে আদালতে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশ তাদের ওপর যে পরিমাণ খাপ্পা হয়ে আছে, তাতে কী কী চার্জ যে চাপানো হতে পারে তাদের ওপরে তা খোদায় মালুম। ফলে পরবর্তী কয়েকমাসের জন্যে শ্রীঘরই যদি ওদের স্থায়ী ঠিকানা হয়, তাতে কেউই খুব একটা অবাক হবে না।
ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ঢুকে মায়ের সঙ্গে খানিক কথাবার্তা বলে ড্রেস চেঞ্জ করার সময় পাঞ্জাবির পকেট থেকে ঝুনঝুন করে শব্দ হওয়ায় সকালে গেটের সামনে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসটার কথা ফের খেয়াল হল দেবর্ষির। সারাদিনের তালগোলে সে একদম ভুলেই গিয়েছিল জিনিসটার কথা। তাড়াতাড়ি সে তার মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল ঠিকই, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনিও কোনও সদুত্তর দিতে পারলেন না সেটার ব্যাপারে। তবে জিনিসটা আসলে কী সেই প্রশ্নটার জবাব অবশ্য পাওয়া গেল তাঁর কাছে। তিনিই জানালেন যে জিনিসটার নাম করতাল। ওটা আসলে একটা বাদ্যযন্ত্র, গানের সঙ্গে তাল দেওয়ার জন্যে ব্যবহৃত হয়। ঠিক দেবর্ষির হাতে ধরা জিনিসটার মতোই এর আরেকটা জোড়া আছে—পার্থক্যের মধ্যে এটাতে যেমন মাঝখানে একটা গোলাকার ছিদ্র রয়েছে, সেটার গর্তটা একটু লম্বাটে। এই জিনিসটাতে হাতের বুড়ো আঙুল আর এর জোড়াটাতে হাতের বাকি চারটে আঙুল ঢুকিয়ে নাড়ালে গানের তালের সঙ্গে সঙ্গে ঝুনঝুন করে মৃদু শব্দ হয়, ফলে গানের শ্রুতিমাধুর্য বাড়ে। কিন্তু সেসব না-হয় ঠিক আছে, শেষ পর্যন্ত এই জিনিসটা কার, ওদের বাড়ির গেটের ভিতর কীভাবে এল সেই সমস্ত রহস্যের তো কোনও সুরাহা হল না। বাধ্য হয়ে জিনিসটা নিজের শোবার ঘরের খাটের পাশে রাখা টেবিলটার ওপরে রেখে বাথরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকল দেবর্ষি।
রাত্রে কচি পাঁঠার ঝোল দিয়ে ঝরঝরে সাদা ভাত ভরপেট খেতে খেতে মাকে ঘটনাবহুল সারাদিনের কাণ্ডকারখানার গল্প বলল দেবর্ষি। তার মুখে সব কথা শুনে মাও বেশ আশ্চর্য হলেন তার এই আকস্মিক পরিবর্তনে। কথাবার্তা সব শেষ করে শুতে যেতে অন্যদিনের তুলনায় বেশ একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল তার। শোবার সঙ্গে সঙ্গে দু-চোখ জুড়ে নেমে এসেছিল গভীর ঘুম। ঘুমের মধ্যে রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল সে। দেখল যে তার ঘরটা একটা নীলচে সাদা মায়াবী আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। সঙ্গে সিনেমা থিয়েটারে বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে স্মোক-বম্ব ব্যবহার করে যেমন কৃত্রিম ধোঁয়ার সৃষ্টি করা হয়, সেরকম সাদা ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারপাশ। তারই মধ্যে দুটো ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে আবির্ভূত হল শূন্য থেকে। আস্তে আস্তে সেই অপার্থিব আলোটার ঔজ্জ্বল্য আর একটু বাড়লে সেই দুই ছায়ামূর্তির মুখ দৃশ্যমান হল। দেবর্ষি দেখল তাঁদের মধ্যে একজনের বয়স তাদেরই মতো বা হয়তো অল্প কিছু বেশি। তিনি রাজা-মহারাজাদের মতো পোশাক পরা, বিভিন্নরকম মূল্যবান অলংকার তাঁর সারা গায়ে, সৌম্যদর্শন ফর্সা মুখে সরু গোঁফ, মাথার রত্নখচিত রাজমুকুটের নীচ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে কাঁধ ছাপানো কোঁকড়ানো কালো চুল। তাঁর ডান হাতে রিমোটের মতো একটা যন্ত্র, যাতে ছোটো একটা লাল আলো দপদপ করছে। অপরজন একটু বয়স্ক, দেখে কোনও মুনি-ঋষি বলে মনে হয়। পরনে তাঁর গেরুয়া রঙের ধুতি, একটা উত্তরীয় ছাড়া ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, গলায় আর মাথার লম্বা চুলে ফুলের মালা, কপালে তিলক কাটা আর হাতে একটা মস্ত বড়ো বীণা। তাঁদের দুজনের হাবভাব চালচলন দেখে মনে হচ্ছিল তাঁরা যেন একদম পৌরাণিক যুগ থেকে উঠে এসেছেন।
রাজপোশাক পরিহিত লোকটা হাতের রিমোটটা দেবর্ষির ঘরের চারদিকে ইতিউতি ঘোরাতে ঘোরাতে শেষ পর্যন্ত তার মাথার পাশের টেবিলটার দিকে স্থির করে সহাস্যে বলে উঠলেন, “এই তো! পাওয়া গেছে। এই নিন দেবর্ষি। অবশেষে আপনার সাধের জিনিসটার দেখা মিলল।”
বয়স্ক ব্যক্তিটি দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেবর্ষির টেবিল থেকে কিছু একটা জিনিস হাতে তুলে নিয়ে আনন্দিত স্বরে বললেন, “নারায়ণ! নারায়ণ! এই তো! এই তো পেয়ে গেছি। উফ্, কাল থেকে যা টেনশন হচ্ছিল। কী বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দেব বিশু। তুমি সত্যি আমাকে বাঁচালে।”
“মুনিবর, আপনাকে কতবার বলেছি প্লিজ আমাকে বিশু বলে ডাকবেন না।” একটু উষ্মা সহকারেই বললেন অপরজন, “আমার ভালো একটা নাম আছে। বিশ্বকর্মা। আপনার নামটা নারদ থেকে চেঞ্জ করে কেউ যদি নাড়ু বলে ডাকে তাহলে আপনারও নিশ্চয়ই খুব একটা ভালো লাগবে না। তাই না?”
“আহাহা, নারায়ণ! নারায়ণ! খামোখা চটো কেন ভায়া। ঠিক আছে, তাই সই, তোমাকে বিশ্বামিত্রই
বলব’খন।” তড়িঘড়ি আশ্বস্ত করলেন নারদমুনি, “যাক গে, যা বলছিলুম, এটা আমার খুব পছন্দের একটা জিনিস, বুঝলে না? আমার গেল হ্যাপি বাড্ডেতে মা-ঠাকরুন এটা আমায় উপহার দিয়েছিলেন। তা কাল ঢেঁকি চড়ে এদিক দিয়েই কোথাও একটা যাচ্ছিলুম, কখন যে ট্যাঁক থেকে টুক করে খসে পড়ে গেছে, টেরটিও পাইনি। ভাগ্যিস তোমার… ওই কী জানি নাম… হ্যাঁ, ওই জম্পেশ যন্তরখানি ছিল। তাই ফিরে পেলুম।”
“আহ্-হা! ওটা জম্পেশ নয় মুনিশ্রেষ্ঠ। ওটা জি.পি.এস। মানে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম। ওটা একটা টেকনোলজি। যন্ত্র হল এটা, বুঝলেন? এটার নাম হল জি.পি.এস ট্র্যাকার।” বিশ্বকর্মা নিজের হাতের রিমোটটা দেখিয়ে বললেন, “এর সাহায্যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে-কোনো জিনিসের লোকেশন ট্র্যাক করা যায়। এটা আমার আবিষ্কার। যদিও আজকাল মর্ত্যবাসীরা নিজেদের নামে চালাচ্ছে।”
“তা হবে’খন। অত আমি জানি নাকো। আমি তো মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ। আমি কি আর তোমার মতো ইঞ্জিন চালাতে শিখেছি নাকি?”
“আজ্ঞে না। ইঞ্জিন চালাতে আমিও শিখিনি। আমি ইঞ্জিনিয়ার। মানে প্রকৌশলী।” রাগত স্বরে জবাব দিলেন বিশ্বকর্মা, “থাক, ওসব আপনার মাথায় ঢুকবে না। তার চেয়ে নিজের কাজ করা ভালো। অনেক কাজ পেন্ডিং পড়ে আছে আমার। দেবরাজ আমাকে এত্ত বড়ো একখানা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছেন নতুন অস্ত্র বানিয়ে দেওয়ার জন্যে।”
“তাই ভালো। যা খুঁজছিলুম তা যখন পেয়েই গেছি আর তো এখানে থেকে কাজ নেই। চলো, আমি তোমাকে আমার ঢেঁকিতে করে স্বর্গলোকে ড্রপ করে দিচ্ছি।” এই বলে ধীরে ধীরে নারদ এবং বিশ্বকর্মা অন্তর্হিত হলেন। আস্তে আস্তে ঘরের সমস্ত ধোঁয়া কেটে গিয়ে সেই মায়াবী আলোটা যতক্ষণে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে, ততক্ষণে পুব দিগন্তে হালকা আলোর রেখা ফুটতে শুরু করে দিয়েছে।
আরও বেশ কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙে বিছানায় শুয়ে-শুয়েই স্বপ্নের কথাটা মনে পড়তে বেদম হাসি পেল দেবর্ষির। কী অদ্ভুত স্বপ্ন রে বাবা। নারদ, বিশ্বকর্মা… ঠিক যেন একটা ভক্তিমূলক যাত্রাপালা। রাতে খাওয়াদাওয়াটা বেশ রিচ হয়ে গেছে। তারই ফলশ্রুতি এই উদ্ভট স্বপ্ন। কিন্তু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাথার পাশের টেবিলটার দিকে চোখ যেতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল দেবর্ষির। টেবিলটা খালি, সেই করতালটা সেখানে নেই। অথচ সে হলফ করে বলতে পারবে যে রাতে শুতে যাবার আগেও ওটা ওখানে বহাল তবিয়তে ছিল। দুয়েকটা বই, একটা পেন স্ট্যান্ডে কয়েকটা পেন আর একটা অ্যালার্ম ক্লক ছাড়া টেবিলটায় আর এমন কিছু জিনিসও নেই যে ওটা অন্য কোনও কিছুর আড়ালে চলে যাবে। রাতে শোবার সময় ছিটকিনি লাগিয়ে শোওয়াটাই তার অভ্যাস। অতএব জিনিসটা মা অন্য কোথাও সরিয়ে রেখেছেন সেটার সম্ভাবনাও শূন্য। তাহলে? তার মানে কি কাল রাতে সে যেটা দেখেছিল, সেটা স্বপ্ন ছিল না? সত্যি-সত্যিই বিশ্বকর্মা আর নারদমুনির আগমন ঘটেছিল তার ঘরে? তবে কি ওটা নারদ মুনিরই করতাল?
এতক্ষণে সব পরিষ্কার হতে শুরু করল দেবর্ষির মনে। তার মানে ওই করতালটার প্রভাবেই গতকাল সারাদিনে এরকম স্বভাববিরুদ্ধ কার্যকলাপ করে গেছে সে। এখন করতালটা তার নিজের আসল মালিকের কাছে ফিরে গেছে। তার মানে কি সেই আগের গোবেচারা, ম্যাড়মেড়ে দেবর্ষিটা আবার ফিরে আসবে যে ঝামেলার ভয়ে অন্যায্য কাজ হতে দেখলেও মুখ বুজে থাকে? নিজের সঙ্গে অন্যায় হলেও প্রতিবাদ না করে মনকে মানিয়ে নিয়ে এড়িয়ে যায়? নাহ্, সেই পুরোনো দেবর্ষিটাকে আর কোনোদিন সে নিজেই সহ্য করতে পারবে না। একদিনেই তার মনের ভিতরের সেই নতুন ডাকাবুকো, চালাক-চতুর, হার-না-মানা অবতারটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সে। হতাশ হয়ে ধপ করে সে আবার বিছানাতেই বসে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ফের উঠে দাঁড়াল দেবর্ষি। জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ দুটো। মনস্থির করে ফেলেছে সে। করতালটা চলে গেছে তো কী হয়েছে? যে গুণগুলো সেটা তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে গতকাল, সেগুলো তো আর চলে যায়নি। সৎ পথে থেকে, নিজেকে বিপদের মধ্যে না ফেলে, বুদ্ধি করেও যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায়, অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া যায় অসাধু ব্যক্তিদের, সেই আত্মবিশ্বাসটা তো আর চলে যায়নি তার ভিতর থেকে। এই প্রত্যয়টা বুকের ভিতর সম্বল করেই আগামী দিনগুলোতে আর কখনও অন্যায়-অবিচারের প্রতি মাথা না নুইয়ে আপসহীন জীবন কাটাবে—এই অঙ্গীকার সে করল নিজেই নিজের সঙ্গে।
তারপর বড়ো করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে নতুন উদ্যমে সে পা বাড়াল সামনের দিকে।
অলঙ্করণ- স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
এক কথায় অনবদ্য গল্প উপস্থাপন করেছো।
LikeLike