ঋতা বসুর আরো গল্প: শিকার ও শিকারী, মিষ্টিবুড়ির কাণ্ড, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি, মৌটুসীর বাসা, বিজু যা দেখে, আলো ছায়ার খেলা , সুশোভন বাগচির এক্সপেরিমেন্ট, ডাইনীর প্রতিশোধ
কুসমি
স্কুলে টিয়াই কুসমির সবথেকে বেশি বন্ধু। এখন লকডাউনে স্কুল বন্ধ। টিয়া গিয়েছিল কালিকাপুরে মামার বাড়িতে। কাল ফিরেছে। সকালে মায়েদের সঙ্গে সংসারের কাজে সাহায্য করতে হয় তাই তারা বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না। বিকেলে সবাই জড়ো হয় চন্দন বিলের ধারে। সেখানে বসে সুখদুঃখের গল্প করে। আরও অনেকেই আসে। বিদ্যাধরপুর গ্রামের সকলেরই এই বিলের ধারটা খুব প্রিয়।
টোটো করে এতটা রাস্তা এর আগে টিয়া যায়নি কখনও। তার মামার ছেলের টোটো আছে বলে খুব সুবিধে। নয়তো এখন যাতায়াতের খুব অসুবিধে। সেই কথাই টিয়া আর সে বলাবলি করছিল। তারপর হঠাৎ টিয়া বলল, “জানিস, কালিকাপুরে কতগুলো লোক গিয়েছিল। তারা কী অদ্ভুত জিনিস কিনছে পয়সা দিয়ে।”
কুসমি বলল, “জানি, ওরা এখানেও এসেছিল।”
“তাই?”
“তোর বিশ্বাস হয়?”
“প্রথমে হয়নি। তারপর কাকিমাদের বাড়ির সবাই টাকা পেল, তখন বিশ্বাস হল।”
“সত্যি, বিশ্বাস করা খুব শক্ত। এরা এমন জিনিসের জন্য টাকা দিতে চাইছে যা মেয়েরা এমনি ফেলে দেয়। রোজ চুল আঁচড়ানোর পর ঝরে পড়া চুল জমিয়ে রাখতে বলছে। এক ব্যাগ চুলের জন্য একশো টাকা। ভাবা যায়?”
“অবশ্য এক ব্যাগ হতে অনেকদিন লাগে। আমি ইচ্ছে করে চুলে জট করে জোরে জোরে চুল আঁচড়াচ্ছি তাতে যদি ক’টা বেশি চুল ওঠে তো বেশ মজা। আমি ঠিক করেছি চুলের পয়সা জমিয়ে জমিয়ে মোবাইল ফোন কিনব।” উত্তেজনায় টিয়ার মুখ চকচক করে উঠল যেন হাতে পেয়েই গিয়েছে একটা টাচ-ফোন।
কুসমি ওসব শখের কথা ভাবতেও পারে না। এতদিন মা রোজ ভোরবেলা শহরে চলে যেত কাজে। মা খুব ভালো বাচ্চার কাজ জানে বলে কাজের অভাব হত না। সেন্টার থেকে কাজ এসেই যেত বলে তাদের খাওয়া-পরার কোনও অসুবিধে ছিল না। এখন চারদিকে একটা খুব ভয়ংকর অসুখ হচ্ছে বলে ট্রেন বন্ধ। তাই মা বাড়িতেই থাকে আর নানা দুশ্চিন্তায় সারাক্ষণ বকাবকি করছে। বাবা সাত মাইল দূরে একটা ওষুধের দোকানে কাজ করে। হাসপাতাল খোলা তাই ওষুধের দোকান চলছে। বাবা বলে, ওষুধ বিক্রি বেড়ে গিয়েছে। লোকে খেয়ে না খেয়ে ওষুধ কিনছে। ভাগ্যিস বাবার কাজটা আছে। তবে খাটুনি অনেক বেড়ে গিয়েছে। বাস নেই তাই অটো-টোটো অনেক টাকা চায়। অত টাকা বাবা দিতে পারবে না বলে রাত থাকতে উঠে হেঁটেই কাজে যাবার জন্য তৈরি হয়। বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে। ফিরে আসার পর সে রসুন তেল মালিশ করে দেয় পায়ে, তবু ব্যথা যায় না। কিন্তু না গেলেও নয়। এর মধ্যে বাবার কাজ না থাকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাকে স্কুল ছেড়ে কাজে লাগতে হবে। মা উঠতে বসতে সেই কথা বলছে। স্কুল বন্ধ হবার কথা ভাবলেই কুসমির কান্না পায়। কুসমির স্কুলে পড়ার কোনও খরচ নেই বলে এখনও নামটা আছে। কবে যে কাটা যাবে কে জানে। এদিকে সে ঠিক করেছে পড়াশুনো শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সবার মুখে হাসি ফোটাবে। তার জন্য কী কী করতে হবে তার একটা লম্বা লিস্ট সে বানিয়েছে।
কী অদ্ভুত অসুখ। চোখে দেখা যায় না, এদিকে খালি ভয় কখন কী হয়। কবে এই অসুখটা যাবে কেউ জানে না। সবার সারাক্ষণ তিরিক্ষে মেজাজ। এখনও কোনোরকমে তাদের চার ভাইবোনের দু-বেলা খাবার জুটছে। যে-কোনো সময়ে সেটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অসুখের সঙ্গে সেই ভয়টাও কিছু কম নয়।
কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলটা শক্ত করে খোঁপা বেঁধে সে উঠোন ঝাড় দিতে দিতে দূরের দিকে তাকাল। কবে আসবে লোকগুলো? কুসমি তাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। ওদের সঙ্গে তার খুব দরকার।
ডেলফি
আজও ডেলফি স্কুল থেকে ফিরল মনখারাপ নিয়ে। উইক-এন্ড বলে মা আজ স্কুল থেকে নিতে এসেছিল। ডেলফির মুখ দেখে মা কী বুঝল কে জানে, তাকে স্কুল থেকে শপিং মলে নিয়ে খুব দামি জিনস আর টপ কিনে দিল। পিৎজা আর আইসক্রিম খাওয়াল, তবুও তার মনখারাপ গেল না। তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে রেড উড ফরেস্ট। কিয়ান আর সুশিকে তাদের বাড়ি থেকে তুলে তারা সবাই মিলে সেখানে গেল। মা আর আন্ট স্টেফি কাফেতে বসে গল্প করছে। বার্লিনগেম থেকে প্রায়ই বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে এই ফরেস্টটাতে আসে। এত সুন্দর জায়গাটা যে মা আর আন্ট স্টেফিও এখানে আসতে কোনও আপত্তি করে না।
কিয়ান বলল, “আজ আমরা সবথেকে লম্বা রুটটায় হাঁটব।”
সুশি বলল, “তার চেয়ে চল ওই পাহাড়টায় উঠি।”
ডেলফি চুপ করে আছে দেখে কিয়ান বলল, “ভোট হোক।”
ডেলফি বলল, “আমি কোথাও যাব না। ইচ্ছে করছে না।”
অগত্যা তারা ক্যারামেল পপকর্ন খেতে খেতে চলে গেল। পাহাড়ে চড়বে না হাঁটবে কে জানে। ডেলফির কোনও ইন্টারেস্ট নেই জানার। প্রতিদিনই চুল ঝরছে তার। কী একটা অদ্ভুত অসুখ করেছে। মাথার সব চুল ঝরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সেই জন্য তার মন সবসময় খারাপ। আজ ক্লাসে জন একটা ফুটবলের ওপর চোখ-মুখ এঁকেছিল। সেটা যে ডেলফি, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুশিকে সে-কথা বলায় সে বলল, “জন এমনি মজা করে এঁকেছে। ওটা তুই হবি কেন?”
“গালের ওপর আমার মতো তিলটা কেন তাহলে?”
তার উত্তর অবশ্য সুশি দিতে পারেনি। ডেলফির সেই থেকে মনখারাপ। তার কী সুন্দর লম্বা লম্বা কালো চুল ছিল। মা বলেছে, তার ঠাকুমা ইন্ডিয়ান ছিলেন। ডেলফির চুল ঠিক তাঁর মতো। এখন প্রায় টাক বেরিয়ে যাওয়া মাথাটা ঢাকারও উপায় নেই। একটা মলম লাগায় বলে টুপি পরা বারণ।
সে জানে আর কিছুদিন বাদে তার মাথাটা ওই ফুটবলটার মতো হয়ে যাবে।
সু-চি
আবার কাজ শুরু হয়েছে বলে সু-চি ভারি খুশি। গতমাস পর্যন্ত কোনও প্লেন চলেনি বলে তাদের কাজ বন্ধ ছিল। মা যে টাকা পায় তাতে খাওয়া, বাড়িভাড়া, ভাইয়ের চিকিৎসা সবকিছু কুলোয় না। সু-চি স্কুল ছেড়ে কাজে যোগ দেওয়ার পর মার একটু সুবিধে হয়েছে। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধে হত। এখন কাজটা জলের মতো সোজা। সে করেও খুব মন দিয়ে। সেই জন্য কাজের জায়গায় সু-চির খুব সুনাম।
তাদের নম-কাই গ্রামটা এয়ারপোর্টের সবথেকে কাছে। সেই জন্য সবথেকে আগে তাদের কাছে কাজ আসে। তারপর মায়ানামারের আরও অন্যান্য গ্রামে ছড়িয়ে যায়। সু-চির মতো আরও অনেকেই নিশ্চয়ই ইন্ডিয়া থেকে চুলভর্তি ব্যাগের জন্য অপেক্ষা করে ছিল।
এক কেজি চুল হলেই দশ হাজার বার্মিজ কিয়াট। যদিও কুড়ি-তিরিশ হাজার কিয়াটের কমে বার্মায় কিছুই পাওয়া যায় না। তবু সারা মাস মন দিয়ে কাজ করলে খাওয়াটা জুটে যায়। যা পাওয়া যায় তাই লাভ। তাদের মতো মেয়েদের জন্য এই কাজেই সবথেকে বেশি পয়সা। তাই সু-চি যত বেশি কাজ করা যায় সেই চেষ্টাই করে।
কাজটা শুনতে যত সোজা আসলে তত সোজা নয়। এক কেজি পরিষ্কার চুল বার করতে কত যে সময় লাগে! এয়ারপোর্ট থেকে ব্যাগগুলো তাদের ফ্যাক্টরিতে পৌঁছলে পর চুলের স্তূপ থেকে একরকম চুল বেছে রাখা থেকে কাজ শুরু। তারপর ময়লা পরিষ্কার করে ধোয়া আর আঁচড়ানো—এই কাজটা বেশ কয়েকবার করলে চুলগুলোর চেহারা ফিরে যায়। লম্বা বাক্স করে এইসব চুল চলে যায় চিনে। সেখানে নানারকম উইগ মানে পরচুলা তৈরি হয়। আমেরিকা-ইউরোপে ইন্ডিয়ান চুলের উইগের খুব চাহিদা।
লকডাউন একটু আলগা হবার পর মায়নামারে দু-একটা করে প্লেন চলা যখন শুরু হল সু-চির মনটা আনন্দে ভরে উঠল। গত কয়েকমাস ভাইয়ের ওষুধ কেনা হয়নি। এবার আস্তে আস্তে আবার সব স্বাভাবিক হবে।
সু-চির কাজ ভালো বলে ম্যানেজার তাকে একটু বেশি পছন্দ করেন। এবার কাজ শুরু হবার পর তিনি ভেলভেটের একটা ছোটো ব্যাগ দিয়ে বললেন, “এটাতে খুব স্পেশাল চুল আছে। সাবধান, কারও সঙ্গে মিশে না যায়। একটুও যেন নষ্ট না হয়। এটার জন্য তুমি আলাদা করে অনেকটা টাকা পাবে।”
সু-চি এত সুন্দর চুল আগে কখনও দেখেনি। ঢেউ খেলানো কালো নরম চুল। এটা ঝরে পড়া পাঁচমিশেলি চুল নয়। যার ছিল তার নিশ্চয়ই খুব প্রিয় ছিল এই চুল। সে শুনেছে, ভারতবর্ষে কেউ কেউ চুল মানত করে। কিন্তু সেগুলোও আসে মেলানো মেশানো। এত নরম কালো চুল সে আগে কখনও দেখেনি। সু-চি চুলের মালিককে কল্পনা করার চেষ্টা করল। নিশ্চয়ই খুব সুন্দর একটি মেয়ে। চুলগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে সে ঠিক করল খুব যত্ন নিয়ে কাজ করবে যাতে একটা খুব সুন্দর উইগ হয়।
তিনকন্যা
সাইকেলের বেলের টুংটাং মিষ্টি আওয়াজে কুসমির ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা থেকে একটু মাথা তুললেই জানালা। সেখান দিয়ে দেখতে পায় বাবার সাইকেলটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এখন বাবা ঠিক সময়েই কাজে পৌঁছতে পারে। চাকরি যাবার ভয় নেই। পায়েও আর ব্যথা হয় না। কুসমি ঘুম চোখেই ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুলগুলোকে হাত বুলিয়ে আদর করে। এগুলো যে এত কাজে আসবে তা কে জানত। তারপর ফেলে আসা ঘুমটাকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে চোখ বোজে।
***
লম্বা কালো চুলের উইগটা এসে যাবার পর থেকেই ডেলফি অন্য মানুষ। একটা হলদে রঙের হেয়ার ব্যান্ড লাগিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে হাসল মিষ্টি করে। তার ইন্ডিয়ান ঠাকুমার মতো নরম কালো চুল তার মাথায়। মনে হয় বরাবরই যেন এরা ছিল তার সঙ্গে। চুলগুলোকে হাত বুলিয়ে আদর করে সে। তারপর স্কুলের ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে একাই রওনা দিল স্কুলের দিকে। কাল বেসবল ম্যাচে তার জন্যই তাদের টিম জিতেছে।
***
সু-চি ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য বাড়তি টাকাটা মার হাতে তুলে দিল। ডাক্তার বলেছে, তিনমাস চালাতে পারলেই ভাই ভালো হয়ে যাবে। মার নিশ্চিন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে তার ছোট্ট বুকটা আনন্দে ভরে উঠল। মা আর ভাইকে হাত নেড়ে সে দৌড়ল ফ্যাক্টরির দিকে।
অলঙ্করণ- জয়ন্ত বিশ্বাস
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস
জয়ঢাকপ্রকাশন থেকে প্রকাশিত ঋতা বসুর চারটি বই। ডিসকাউন্টেড দামে বিনা কুরিয়ার চার্জে দেশের সর্বত্র পেতে নীচের ছবিগুলিতে ক্লিক করুন