তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগের গল্প-তেতলার বারান্দা, ফলওয়ালা
অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি পরি চুপচাপ জানালার ধারে একটা বই কোলে বসে আছে। কাছে গিয়ে বললাম, “কী হয়েছে রে?”
একটু চমকে তাকিয়ে বলল, “কিছু না, মা।”
“এভাবে বসে আছিস? নীচে খেলতে যাসনি আজ? শরীর খারাপ করছে না তো?”
“ধুত, শরীর খারাপ হবে কেন!” উঠে পড়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। আমি একটু উদ্বিগ্নভাবে নিজের ঘরে ফ্রেশ হতে গেলাম। শরণ্যের কাজ থেকে ফিরতে এখনও দেরি আছে একটু।
আমাদের সর্বক্ষণের কাজের সহায়িকা সুশীলাদি জিজ্ঞেস করল, “তোমায় এট্টু চা করে দিই বৌদি? দাদাবাবু এলে আবার করে দেব বরং। চিঁড়েও ভেজে দেব’খন তখন, নিমকি আচে।”
চা দিতে এলে আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “পরির আজ… মানে ও ঠিক আছে? খেয়েছে ঠিকমতো?”
“ইস্কুল থেকে ফিরে দুধ-চকোলেট আর স্যান্ডউইচ করে দিইচি, খেয়েচে। তাপ্পর নীচে খেলতে গেল, একটু পরই উপরে চলে এল মুখ ভার করে।”
চায়ে চুমুক দিয়ে চুপ করে রইলাম।
“তাও বলি এখেনকার ছেলেপুলেগুলো বড্ডো ত্যাঁদোড় বাপু। ওকে নাকি ক্ষ্যাপায়, খেলায় নেয় না। ভারি চশমা পরে বলে সে নিয়ে পেচুনে লাগে, ঠেলে দেয়। এমনিতেই নিরীহ মুখচোরা মেয়েটা আমাদের। আগের পাড়াটা এমনটা ছিল না। মানী আজ পার্শে মাছ এনেছিল। ঝাল করব?”
অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। তারপর বললাম, “পরি তো মাছ খাবে না, ওর জন্যে…”
সুশীলাদি বলল, “ওর জন্যে মুরগির স্টু করিচি।” বলে চলে গেল। ও বহুদিন আছে আমাদের সঙ্গে।
পরিকে নিয়ে চিন্তা হয় খুব। ছোটো থেকে বড্ড ভুগত মেয়েটা—একটার পর একটা শারীরিক গোলমাল লেগেই থাকত। অন্য বাচ্চাদের মতো দৌড়ঝাঁপ খেলাধুলো করতে পারত না। আমরা বোধহয় একটু বেশিই আগলে রাখতাম ওকে। হয়তো সেজন্যই ঘরকুনো আর মুখচোরা হয়েছে, সবসময় বই মুখে। এই এগারো বছর বয়সেই মোটা চশমা। মিশতে পারে না বিশেষ, স্কুলেও সেরকম বন্ধু নেই। পেরেন্ট-টিচার মিটিংয়ে ওর ক্লাস-টিচার বলছিলেন, ‘মেয়ে তো আপনার খুবই ভালো পড়াশোনায় মিসেস রায়, এগিয়ে আছে অন্যদের তুলনায়। প্রাঞ্জলি চমৎকার আঁকে, প্রচুর বই পড়ে, ভদ্র ব্যবহার। তবে ওর সেরকম বন্ধুবান্ধব নেই মনে হয়। সামাজিক জীবনটাও কিন্তু প্রয়োজন। খুব একা মনে হয় ওকে। এদিকেও একটু নজর দিন।’
চায়ের কাপ শেষ করে নামিয়ে রাখলাম। পরি বারান্দা থেকে এ-ঘরে এসে নিজের ঘরে চলে গেল। আমি ডাকতে বলল, “হোম-ওয়ার্ক আছে মা।”
“মুভি দেখবি?”
“কাল দেখব মা। সেই নতুন ডিজনি মুভিটা। পরশু ছুটি তো।”
সত্যি, বড়ো একা একা মেয়েটা। কী যে করি। ও জন্মাবার সময় আমার নানারকম শারীরিক জটিলতা হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ নিরাপদ নয়। আমি ভেবেছিলাম চেষ্টা করব, কিন্তু শরণ্য কিছুতেই রাজি হয়নি। পরি প্রায়ই বায়না করত একটা কুকুর বা বেড়াল পুষবে বলে। কিন্তু আমার আবার লোমে প্রবল অ্যালার্জি। পোষ্য আছে এমন কারও বাড়িতে যাওয়ার আগে ওষুধ খেতে হয়। আগে যে-পাড়ায় ছিলাম, সেখানে সবাই পরিকে জন্ম থেকে চিনত বলে চেনাশোনা কিছু বন্ধু-সঙ্গী ছিল ওর। কিন্তু এখানে…
শরণ্য এসে পড়ল। দুটো একটা সাধারণ কথার পর পোশাক বদলে এসে বসল। আমরা চা খেতে খেতে টিভিতে খবর দেখছিলাম। একটু পরে বললাম, “মেয়েটাকে নিয়ে যে কী চিন্তা হয়!”
“কী হল পরির?”
“সেরকম বিশেষ কিছু না… ওই যেমন হয়, নীচে বোধহয় অন্যসব ছেলেমেয়েরা ওকে ঠিক অ্যাকসেপ্ট করে না, ওর স্বভাবটাই তো একাচোরা ধরনের।”
“হুম।” শরণ্য একটু ভেবে বলল, “ডাক্তার তো বলেছিলেন স্বাস্থ্যটা একটু ইমপ্রুভ করলে নিজে থেকেই সেসব বদলে যাবে, মিশতে খেলতে শিখবে। সাঁতারের ক্লাবে ভর্তি হয়ে কিছুটা ভালো হয়েছে তো।”
“তা হয়েছে। ওখানে কিছু চেনাশোনাও হয়েছে।”
“ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। পরি কিন্তু বেশ ভালো সাঁতার শিখে গেছে এর মধ্যে, বলো সুনি?”
কথাটা ঠিক। আসলে মেয়ে জল খুব ভালোবাসে। সর্দিকাশির ভয়ে ওকে সামলে রাখতাম, কিন্তু ডাক্তারই বলেছিলেন সাঁতার শেখার ক্লাসে দিতে। সত্যিই এখন চমৎকার নানারকম স্ট্রোক শিখে গেছে, পুল থেকে উঠতেই চায় না। কিন্তু রোজ তো আর নিয়ে যাওয়া যায় না।
পুলওলা বাড়ির স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখি পরি কখন গুটি গুটি এসে বাবার কাছ ঘেঁষে বসেছে। ভারি বাপ-সোহাগি মেয়ে। শরণ্য মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, “কী, মামণি?”
“বাবা, মা, আমায় জন্মদিনে একটা অ্যাকোয়ারিয়াম কিনে দেবে? মাছ পুষব।”
একটু অবাক হয়ে বললাম, “মাছ পুষবি? হঠাৎ?”
“প্লিইইইজ মা, সেই যে কুন্তীর বার্থডে পার্টিতে গেলাম না, ওদের বাড়িতে দেখেছি। কী সুন্দর!”
এমনিতে মেয়েটা বায়না-টায়না প্রায় কখনোই করে না। চুপচাপ আর বয়সের পক্ষে একটু বেশি পরিণত। এটা কি ভালো সবদিক থেকে? শরণ্য বলে ভালোই তো। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর আগ্রহ ব্যাপারটাই একটু কম। ওই বই, আর এখন সাঁতার। শরীর-স্বাস্থ্যের একটু উন্নতি হলে… নিজের চেহারা সম্বন্ধে কি ওর কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য আছে? ওর চোখমুখ মিষ্টি, ফরসা রঙ, ঘন খাটো কোঁকড়া চুল… পরির চোখের ডাক্তার বলেছেন আর একটু বড়ো হলে ওর চোখে চশমার বদলে কনট্যাক্ট লেন্স করিয়ে দেওয়া যাবে।
চমক ভেঙে শুনলাম বাবা-মেয়েতে মিলে ল্যাপটপ খুলে কী ধরনের অ্যাকোয়ারিয়াম আর মাছ কেনা হবে সেই নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
“আমার ঘরে থাকবে বাবা, ওই বুক-শেলফটা খাটের অন্য ধারে সরিয়ে দিলে হবে না?”
অলঙ্করণ- মৌসুমী রায়
জয়ঢাকের গল্পঘর