গল্প- বুদ্ধি যখন বাড়ে- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি-শরৎ ২০২২

সপ্তর্ষী চ্যাটার্জির আগের গল্প ঝন্টুর ঝঞ্ঝাট, রক্তসূত্র

golpoBuddhi Jakhon baRe

বিজ্ঞানী চন্দ্রচূড় চট্টরাজ মানুষটি যেমন প্রতিভাবান, তেমনই আপনভোলা। পদার্থবিদ্যা থেকে রসায়ন, অণুজীববিদ্যা থেকে জিনতত্ত্ব—বিজ্ঞানের বিবিধ শাখায় শ’খানেকের উপর পেটেন্ট বাগানোর পরেও তাঁর নিজেকে নিয়ে কোনও বড়াই তো নেই-ই, নিজের আরও অন্তত শ’খানেক আবিষ্কার তিনি লোকচক্ষুর সামনেই আনেননি—স্রেফ নিজের খেয়াল আর শখ মেটানোর জন্য সেসব সৃষ্টি করে গেছেন। যদি মনে হয় তার মধ্যে কোনোটা সত্যিই মানবজাতির কল্যাণে আসবে, তবেই একমাত্র তাদের প্রকাশ্যে আনার কথা ভেবেছেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী।

এবার যেমন তিনি একটা বিশেষ ওষুধ আবিষ্কার করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। না, এ কোনও রোগের ওষুধ নয়। এ-ওষুধ খেলে বুদ্ধি বাড়বে। হ্যাঁ, তাঁর দাবি এমনটাই। এই ওষুধ প্রয়োগে জীবিত সব প্রাণীদের বুদ্ধি বেড়ে যাবে। মানে সোজা কথায়, মগজের দক্ষতা বাড়বে। আর মগজ যেহেতু আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়কে চালনা করে, নির্দেশ দেয়, অতএব ইন্দ্রিয়রাও আরও বেশি প্রখর হয়ে উঠবে। শ্যেনদৃষ্টি হবে, কুকুরের মতো ঘ্রাণ আর শ্রবণশক্তি হবে, আরও কী কী হবে তা জানার জন্য ওষুধটা প্রয়োগ করে দেখতে হবে। কিন্তু প্রয়োগ এবং ওষুধের ক্ষমতা প্রমাণের জন্য তো সবার আগে প্রয়োজন একটি জীবিত প্রাণী। পরীক্ষার নিয়ম অনুসারে মানুষের আগে একটা ইঁদুর বা গিনিপিগ তো লাগবে।

চন্দ্রচূড়বাবু তাঁর অনুগত সহকারী বংশীরাম বটব্যালকে সে-কথা বলতেই পত্রপাঠ বংশী কোথা থেকে যেন একটি ইঁদুর জোগাড় করে আনল। সেই ইঁদুরকে খাঁচাবন্দি করা হল। তারপর পাউরুটিতে ওষুধটা মিশিয়ে তাকে খেতে দিলেন চন্দ্রচূড়। ইঁদুরটার বোধহয় বেশ খিদে পেয়েছিল। একটু শুঁকে-টুকেই গপগপিয়ে পাউরুটির টুকরোটা আত্মস্থ করে ফেলল পুরো। বিজ্ঞানী আর তাঁর সহকারী উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছেন এবার কী হয় দেখার জন্য। ও মা! ওষুধ খাওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই প্রবলভাবে ছটফট করতে শুরু করল ইঁদুরটা। তারপর একবার লাফিয়ে উলটে গিয়ে খাঁচার মধ্যে পড়ে এক্কেবারে স্থির হয়ে গেল। চার পা, লেজ সব স্থির। চন্দ্রচূড় চেঁচিয়ে উঠলেন, “ইশ! ইঁদুরটা মরে গেল নাকি!”

বংশী মাথা চুলকে বলল, “কী জানি স্যার, সেরকমই তো মনে হচ্ছে। বের করে দেখব?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দ্রচূড় বললেন, “বের কর। আর কী! ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি। তারপর ডোজের মাত্রাটায় গোলমাল হল কি না অঙ্ক কষে দেখতে হবে আবার। খাটনি বাড়ল।”

বংশী খাঁচা খুলতেই যেটা ঘটল সেটার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। ইঁদুরটা স্প্রিংয়ের মতো এক ঝটকায় সোজা হয়ে চোখের নিমেষে লাফিয়ে খাঁচার দরজা লক্ষ করে প্রকাণ্ড লাফ দিল একটা। বংশী ‘বাবা গো!’ বলে ছিটকে যেতে তাকেও এক লং-জাম্পে টপকে ইঁদুর বাবাজি পগারপার হলেন। ধাতস্থ হতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল চন্দ্রচূড়বাবুর। তারপরেই তড়াক করে লাফিয়ে তিনি বলে উঠলেন, “বংশী! বুঝতে পারলি ব্যাপারখানা? উফ্‌!”

বংশী বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শুধাল, “না তো স্যার। কী হল আজ্ঞে?”

“আরে ইঁদুরটা স্রেফ পালানোর ফন্দি করে ওভাবে মটকা মেরে পড়ে ছিল, আদৌ ওর কিছু হয়নি! তার মানে, তার মানে ওর বুদ্ধি বেড়েছে! ওষুধ পেটে যেতেই একেবারে তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া! আমার গবেষণা সফল!”

“সত্যি তো স্যার! ঠিক বলেছেন। তাহলে এবার?”

“এবার পরবর্তী পদক্ষেপ। হিউম্যান ট্রায়াল। একজন বোকাসোকা মানুষ লাগবে রে।”

“খুঁজতে হবে তাহলে। কিন্তু জানাজানি হলে বা কোনও গোলমাল হলে আবার থানা-পুলিশ হবে না তো স্যার?”

“সেটা একটা ভাববার বিষয় বটে। বেশি লোক জানলে হবে না। আর বাকি গোলমাল তেমন কিছু হওয়ার সুযোগ কম; এ-ওষুধের সাইড এফেক্ট নেই কোনও। তুই আমায় ভেবে বল এই পাড়ায় বা আশেপাশের অঞ্চলের মধ্যে একেবারে কম বুদ্ধির লোক কে আছে।”

“সে আছে স্যার একজন, তবে সে নেহাতই ছোটো। স্কুলে পড়ে।”

“স্কুল-ছাত্র? কী নাম?”

“ওর আসল নাম গোপীকান্ত বসু। কিন্তু লোকে ওকে গবু নামেই বেশি চেনে। ভয়ানক গবেট বলেই হয়তো। অঙ্কে গবু কোনোদিন তিনের বেশি পেয়েছে এমন অভিযোগ কেউ করতে পারবে না স্যার। অঙ্ক কষতে বললেই তার গায়ে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া—সবরকমের জ্বর চলে আসে। পাশ-ফেল নেই বলে ক্লাসে উঠে যায় ঠিকই, কিন্তু…”

“ব্যস ব্যস, ওই গবুকেই তাহলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসিস তো। দেখি তারপর।”

***

গবু গতকাল বিকেল থেকে সন্ধে অবধি ঘণ্টা খানেক সময় খেলার মাঠ বা বাড়ি কোথাও ছিল না। তবে সেটা তার বন্ধুরা বা বাড়ির লোকজন কেউই সেভাবে খেয়াল করেনি। অবশ্য তাকে নিয়ে কবেই-বা কে আর বেশি মাথা ঘামিয়েছে? তবে ঘামাতে বাধ্য হল, পরের দিন। যখন স্কুলের অঙ্ক ক্লাসে হঠাৎ করে সে এক-একটা সুদকষা আর সিঁড়িভাঙা অঙ্ক ছত্রিশরকমভাবে কষে দেখাতে আরম্ভ করল, তাও আবার চোখের পলক পড়তে না পড়তেই! অঙ্কের মাস্টারমশাই সত্যবাবু তো ব্যাপার দেখে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেলেন। আনন্দ আর বিস্ময়ের যুগপৎ অ্যাটাকে। আর ক্লাসের ফার্স্ট বয় পল্টু নার্ভাস হয়ে ক্লাস টেস্টে ফেল করে গেল! গবু অবশ্য নির্বিকার। যেন সে বরাবর এমনই ছিল। ছোটো মফস্‌সলে খবরটা চাউর হতে বেশি সময় লাগল না।

চন্দ্রচূড়বাবুর কাছেও সে-সংবাদ পৌঁছল। তিনি উৎফুল্ল হলেন। সাবধানীও হলেন। এবার কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, গবুর খোঁজখবর নিতে হবে। তাঁর গণনা অনুসারে, এই ওষুধের প্রভাব চিরস্থায়ী নয়। মোটামুটি দিন সাতেক পর থেকেই তার প্রভাব কমতে থাকবে।

বুদ্ধি তো আবার দু-রকম হয়। সুবুদ্ধি আর দুর্বুদ্ধি। যে যেমনভাবে সেটাকে কাজে লাগায়। এবার হয়েছে কী, দ্বিতীয়রকমের বুদ্ধি অল্প-স্বল্প ধরে এমন একজনের কানেও গবুর বুদ্ধির আশ্চর্য পরিবর্তনের ব্যাপারটা গেল—সে হল একজন ফ্লপ চোর, নাম ফিঙে। বার বার পরিকল্পনা করেও বড়োসড়ো চুরি করতে ব্যর্থ হয় সে প্রতিবারেই। তাই চোর-মহলে তার ফ্লপ তকমা জুটেছে। তার বাড়ির পোষা গুটি-তিনেক বিড়ালও তার চেয়ে চৌকস চোর। এ-বাড়ির মাছের মুড়ো, ও-বাড়ির দুধের বাটি সাবড়ে এসে ঠোঁট চাটে তারা। অথচ ফিঙে? সে নিজে বোঝে, বুদ্ধি একটু কম-সম হওয়াতেই বড়ো দাঁওগুলো সে মারতে পারে না। ধরা পড়ে তার কপালে বিস্তর মারধোরও জুটেছে কয়েকবার। এই বদনাম ঘোচাতে মরিয়া ফিঙে খবরটা শুনেই মনে মনে লাফিয়ে উঠল। কারণ সে দু-দিন আগে এমন একটা জিনিস খেয়াল করেছিল যা সম্ভবত আর কেউ করেনি। সেদিন সন্ধেবেলায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘাপটি মেরে ঘোরার সময় বিজ্ঞানী চন্দ্রচূড় চট্টরাজের বাড়ি থেকে গবু নামের ওই ছেলেটাকেই সে বেরোতে দেখেছিল নিশ্চিত। তারপরেই এমন খবর! দুইয়ে দুইয়ে চার কী, একেবারে চারশো চল্লিশ না হয়ে যায় না! সঙ্গে সঙ্গে ফিঙে একটা প্ল্যান ছকে ফেলল। বুদ্ধি বাড়ানোর ওষুধ বা কোনও যন্ত্রপাতি যাই হোক সেটার ফর্মুলা হাতাতেই হবে। কোনোভাবে চন্দ্রচূড়ের বাড়িতে ঢুকে ওটা চুরি করে আনতে হবে। তারপর সেটার সাহায্যে নিজের বুদ্ধি বাড়িয়ে নিয়ে দুনিয়ার সেরা চোর হয়ে যেতে আর বাধা কোথায়?

চন্দ্রচূড়বাবুর আবার নির্দিষ্ট খাতায় কোনও আবিষ্কারের ফর্মুলা লেখার অভ্যেস তেমন ছিল না। তিনি গোটা তিনেক জাবদা খাতায় বাজারের ফর্দ থেকে হঠাৎ মনে আসা কবিতা, খবরের কাগজের পাতা থেকে টুকে রাখা শব্দছক থেকে সুডোকু—সব একসঙ্গে মিশিয়ে লিখতেন। তার মধ্যেই এখানে ওখানে গুঁজে দিতেন একেকটা ফর্মুলার খুঁটিনাটি। সেসব তিনি ছাড়া সম্যক উদ্ধার করা প্রায় দুঃসাধ্য।

ফিঙে গভীর রাতে চন্দ্রচূড়বাবুর বাড়িতে চুপিচুপি ঢুকে সেই খাতাগুলোর একটা হাতের কাছে পেয়ে তাই নিয়েই চম্পট দিল। ভাগ্যক্রমে ওই খাতাতেই লেখা ছিল বুদ্ধি বাড়ানোর সেই মহৌষধের রহস্য। কিন্তু বাড়ি গিয়ে খাতা খুলে দেখে ফিঙের চক্ষু তো চড়কগাছ! এই জগাখিচুড়ি মেশানো লেখার থেকে আসল ফর্মুলার মানে সে বের করবে কী করে? তার বুদ্ধিতে তো এ-জিনিস কুলোবে না। তাহলে এবারেও অপারেশন ফেল? আবার ব্যর্থতা? ভেঙে পড়তে পড়তে আচমকাই তার মনে একটা কথা উদয় হল। আচ্ছা, সে না-হয় পারল না, তার চেয়ে বুদ্ধিমান কেউ তো পারতেও পারে! অতি বুদ্ধিমান কেউ? কিন্তু সেই চালাক লোক যে আসল মানেটা বের করে নিজেই ওই ফর্মুলায় ওষুধ বানিয়ে ফেলে তাকে ঠকিয়ে চম্পট দেবে না তার গ্যারান্টি কী? একমাত্র, একমাত্র একজনই আছে যে তাকে সাহায্য করতে পারে, সে হল গবু। ছেলেটা হাজার হোক, বাচ্চা তো! অত দুর্বুদ্ধি হবে না ওর। ওকে যদি কিডন্যাপ করে আনা যায় তবে ওকে দিয়েই কাজটা করানো যাবে। হাজার হোক, বাচ্চা তো। চকলেটের লোভ দেখিয়ে বা ভূতের ভয় দেখিয়ে ঠিক কাজ হাসিল করে নেওয়া যাবে।

                                                           ***

গবুকে বেশি ভয়-টয় দেখাতে হয়নি অবশ্য। ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার বুদ্ধির প্রশংসা করে শুধু ফিঙে বলেছিল কয়েকটা জটিল অঙ্ক সে একেবারে মেলাতে পারছে না। তা গত কয়েকদিনে যা জানা গেছে, তাতে গবুর চেয়ে বুদ্ধিমান তো এ-তল্লাটে আর কেউ নেই, তাই সে যদি ফিঙের বাড়ি গিয়ে তাকে একটু সাহায্য করে দেয় তবে খুবই উপকার হয় বেচারার। বলা বাহুল্য, অঙ্ক কষতে এখন গবুর ভীষণই ভালো লাগে।

ফিঙের বাড়িতে যাওয়ার পরেই গবুকে সে হাসি হাসি মুখ করে এক গ্লাস শরবত খেতে দিল। গবু সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে ভিতরের উত্তেজনা চেপে রেখে সে বলল, “হে হে, তুমি আমার অতিথি হয়ে এসেছ, তোমাকে আর কী দিই বলো। অঙ্ক-টঙ্ক তো হবেই, তার আগে এই শরবতটুকু খেয়ে নাও বাপু।”

শরবত খেয়েই গবু চোখ বুজে গা এলিয়ে দিয়েছিল চেয়ারে। ফিঙে সেই ফাঁকে চেয়ারের সঙ্গে তার হাত-পা কষে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। ঘণ্টা খানেক পর যখন গবু আস্তে আস্তে চোখ মেলল, ফিঙে তখন সেই হাসিটা মুখে নিয়েই জাবদা খাতাটা হাতে নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। ফিঙে বলল, “দেখো বাছা, তোমার সব খবরই আমি রাখি। জানি না তোমায় ওই বিজ্ঞানীমশাই কী খাইয়েছিলেন, তবে এই খাতাটার মধ্যেই বুদ্ধি বাড়ানোর উপায়টা লেখা আছে। এখন সুবোধ বালকের মতো সেইটা পড়ে-টড়ে নিয়ে আমাকে বাতলে দাও দেখি। আমি একেবারে সেটা বানিয়ে পরখ করে দেখে তারপর তোমায় মুক্তি দেব। চালাকির চেষ্টা কোরো না, কেমন? মনে রেখো, তোমার খালি বুদ্ধিই বেড়েছে। শক্তি কিন্তু বাড়েনি।”

গবু কোনও প্রতিবাদ করল না। শান্তভাবে খাতাটার দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, “ঠিক আছে কাকু, দেখছি। কিন্তু এত বড়ো খাতা। আমার কিন্তু একটু সময় লাগবে। তা ছাড়া আমার হাতটাও তো বাঁধা। একটা হাত যদি…”

অমনি ফিঙে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “না! ওসব চালাকি আমার সঙ্গে চলবে না। পাতা আমিই উলটে দেব। তুমি শুধু চোখ দিয়ে দেখবে আর মুখ দিয়ে বলবে। হাত যেমন বাঁধা তাই থাকবে।”

অগত্যা গবু সেই খাতা পড়তে শুরু করল, আর যা যা আবিষ্কারের ফর্মুলা চোখে পড়ছিল, সবই ফিঙেকে বলতে লাগল। ফিঙে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকল কখন অভীষ্ট ফর্মুলাটা আসে। দিন গড়াল, রাত নামল। গবুর ক্লান্তি নেই। ফিঙেরই বরং ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল। একসময় সে ঘুমিয়েই পড়ল। আর ঠিক তখনই ‘চিক’ করে একটা মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ আওয়াজ শোনা গেল ওই ঘরের কোণায়। একটি প্রাণী সেখানে ঢুকেছে। একটা ইঁদুর। যে-সে ইঁদুর নয়, প্রথম ওষুধ খাওয়া সেই বুদ্ধিমান ইঁদুরটা। কিন্তু ও এখানে কোত্থেকে এল? তার জন্য অবশ্য গবুই দায়ী। আসলে বিজ্ঞানীর ওই বুদ্ধির ওষুধ খেলে শুধু যে পঞ্চেন্দ্রিয়ই সতেজ-সজাগ হয় তাই নয়, ষষ্ঠেন্দ্রিয়টিও প্রখর হয়—মন! গবু ফিঙের দেওয়া শরবতে ঘুমের ওষুধ বা বিপদের গন্ধ পেয়েই তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় মারফত একটা বিপদসংকেত পাঠিয়ে দিয়েছিল হাওয়ায়। এ যেন অনেকটা বেতার তরঙ্গে কোনও সিগন্যাল পাঠানোর মতো। যার কাছে উপযুক্ত গ্রাহকযন্ত্র থাকবে, সে-ই শুধু এই বার্তা পাবে। সেটা একজনই পেয়েছিল আর বুঝেছিল, সেই বুদ্ধিমান ইঁদুরটি। তারা দুজন ছাড়া আর কোনও তৃতীয় প্রাণী তো তখনও ওই ওষুধটা খায়নি!

ওই এক বার্তায় ইঁদুর বুঝে নিয়েছিল আসন্ন বিপদটা। বিপদ শুধু গবুর একার নয়, আরও বড়ো একটা বিপদের আশঙ্কায় তার ছোট্ট মন শিউরে উঠেছিল। একবার যদি ফিঙে ওই ফর্মুলা হাসিল করে ওষুধটা বানিয়ে ফেলে তবে সর্বনাশ হয়ে যাবে! ফিঙের বাড়িতে ওই তিনখানা পোষা বেড়াল বড়ো হ্যাংলা। ওরা একবার ওই ওষুধ খেলেই সমগ্র ইঁদুর সমাজের সমূহ বিপদ। এত বুদ্ধিমান আর শক্তিমান শত্রুর সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না তাদের। তাই সে যা করার খুব তাড়াতাড়ি করে ফেলল। ধারালো দাঁতে নিপুণভাবে কুচিকুচি করে কেটে দিল কয়েকটা জিনিস। প্রথমে গবুর হাতে-পায়ে বাঁধা দড়ি, তারপর ওই জাবদা খাতাটা। গোটাটাই। হ্যাঁ, ওটিকে নষ্ট না করলে আগামীতেও বিপদের সম্ভাবনা রয়ে যাবে। মাথা না থাকলে মাথাব্যথাও থাকবে না। গবুও এই ব্যাপারে সম্মত হল। তবে ফিঙে যে এই গোটা সময়টা নাক ডাকিয়ে ঘুমোল, তার পিছনে অবশ্য গবুর একটা ভূমিকা ছিল। ষষ্ঠেন্দ্রিয়র জোরেই সে ফিঙের মস্তিষ্কটাকে ধীরে ধীরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।

কাজ-টাজ মিটলে ইঁদুরটা আবার কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। আর গবু চন্দ্রচূড়বাবুর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে সব খুলে বলল। ফিঙেকে সে চাইলে আরও আগেই অচেতন করতে পারত। করেনি স্রেফ জাবদা খাতাটা পুরোটা পড়ে নেওয়ার তাগিদে। এখন যখন সেই খাতা নষ্টই হয়ে গেছে, চন্দ্রচূড়বাবুর পক্ষে তো সেটা ভয়ানক সমস্যার হবে। ওই বুদ্ধির ওষুধ ছাড়াও আরও কত কী ফর্মুলাই তো সেখানে লেখা ছিল। তবে এখানেই গবুর কেরামতি আরেকবার দেখা গেল। ফটোগ্রাফিক মেমরির জোরে গোটা খাতার সবটাই সে চন্দ্রচূড়বাবুকে বলে দিতে পারল। তিনিও নিশ্চিন্ত হয়ে নতুন একটা খাতায় সেসব আবার লিখে নিলেন। শুধু বুদ্ধি বাড়ানোর ওষুধের ফর্মুলাটা তিনি ইচ্ছে করেই আর লিখলেন না। এক সপ্তাহ প্রায় হয়েই এসেছে, গবুও আবার আস্তে আস্তে আগের মতো হয়ে যাবে। তখন আর তার এসব স্মৃতিও মনে থাকবে না। তবে মনে মনে তিনি ফিঙে চোরকে একটা ধন্যবাদ দিতে ভুললেন না। সে অমন কীর্তি না করলে হয়তো আরও বড়োসড়ো কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারত পরে। একটা শিক্ষা হল বটে!

অলঙ্করণ- অংশুমান দাশ

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s