উমাকান্ত ঘোষ অধ্যাপনা শেষে শহরের উপকণ্ঠে বাড়ি বানিয়েছেন। অবসর সময়টা তিনি গাছগাছালির সান্নিধ্যে থাকবেন বলে শহরের কোলাহল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তাঁর দোতলা বাড়ির তিনদিকটাই বড়ো গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে। শুধু সামনের দিকটাই দৃশ্যমান। রাস্তা থেকে সহজেই চোখে পড়ে ছোট্ট একটি নেম-প্লেট। তাতে লেখা শ্রী উমাকান্ত ঘোষ, ‘সাহিত্যের ভূত-পূর্ব অধ্যাপক’। তবে খুব সম্প্রতি বাড়ির মূল দরজার কাছে একটি জবা ফুলের গাছ এই নেম-প্লেটটির অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। ফলে এখন শুধু ‘সাহিত্যের ভূত’ এই কথাটিই চোখে পড়ে। এই নিয়ে উমাকান্তবাবুর কাছে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীরা বেশ হাসাহাসি করে।
অঙ্কে পারদর্শী হলে যেরকমভাবে তাকে ‘অঙ্কের জাহাজ’ বলা হয়, সেভাবেই সাহিত্যের তুখোড় অধ্যাপককে ‘সাহিত্যের ভূত’ বলা চলে কি? না, মোটেই চলে না। কিন্তু উমাকান্তবাবু প্রতিটি বাংলা শব্দের উৎপত্তি তার প্রয়োগ ও বিস্তার নিয়ে এতটাই ছাত্রছাত্রীদের কাছে ব্যাখ্যা শুরু করে দেন যে ছাত্ররা দিনে-দুপুরেই ভূত দেখে। তাই স্যারের বাড়িতে ঢোকার আগে এই ‘সাহিত্যের ভূত’ লেখাটি দেখে ছাত্ররা রোজই একচোট হেসে নেয়।
উমাকান্তবাবুর চেহারাটাও বেশ সাহিত্যিক মার্কা। তাঁকে যে-কোনো সময় কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক বানিয়ে ফেলা যায়। অথচ তিনি কবি বা গল্পকার নন। তা না হলে কী হবে, তিনি গড় গড় করে একশোটা কবিতা মুখস্থ বলে দিতে পারেন। স্বরবৃত্ত ছন্দ কিংবা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ নিয়ে টানা একঘণ্টা আলোচনা করতে পারেন। একটি আদর্শ ছোটো গল্প লিখতে গেলে গল্পকারকে ঠিক কোন কোন বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে এ-সম্পর্কে তিনি দারুণভাবে আলোকপাত করতে পারেন। তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ অত্যন্ত স্পষ্ট এবং ‘র’, ‘ড়’ বা ‘ন’ কিংবা ‘ণ’ অথবা ‘শ’ ‘স’ ‘ষ’-এর উচ্চারণ তিনি এমনভাবে করেন যাতে এক হাজার লোকের মধ্যেও তাঁর কথা আলাদাভাবে চেনা যায়। তাঁর সঙ্গে একবার যে কথা বলবে সে সারাজীবন উমাকান্তবাবুর মধুর ভাষণ জমিয়ে রাখবে। অন্তত মাস খানেক উমাকান্তর সুরেলা ও ছন্দময় কথোপকথন ভুলতে পারবে না। এই হল উমাকান্তবাবুর মোটামুটি পরিচয়।
উমাকান্তবাবু যে-পাড়ায় থাকেন, তার উলটোদিকের পাড়ায় ভবতোষ তরফদারের বাড়ি। তিনি দীর্ঘদিন কলকাতার একটি সংবাদপত্রের অফিসে কাজ করেছেন। ‘রাজপথ দর্পণ’ নামের একটি পত্রিকার তিনি স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। বছর আটেক আগে কলকাতার পাট চুকিয়ে এই মফস্সল শহরে এসে বাড়ি বানান। বাড়ি বানানো হয়ে গেলে অনেক ভেবেচিন্তে বাড়ির নাম রাখেন ‘একান্তে’। আসলে ভবতোষের বাড়িটা এ-পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে হওয়ার কারণে এই নাম। আজ থেকে সাত বছর আগে তিনি ‘একান্তে’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে আসছেন। বলতে গেলে এইটিই এই মফস্সল শহরের একমাত্র সাহিত্য পত্রিকা ছিল। ভবতোষ তরফদার একান্তের পাতায় তিন পৃষ্ঠা জুড়ে প্রতি পনেরো দিন অন্তর একটি করে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
কিন্তু খুব সম্প্রতি উমাকান্তবাবুর পাড়ার ছেলেরা ‘বনানী’ নামের একটি পত্রিকা বের করতে শুরু করেছে। তাই ‘একান্তে’ আর মোটেই এই অঞ্চলের একমাত্র পত্রিকা নয়। ‘বনানী’ নামটি রেখেছেন উমাকান্তবাবু নিজে। পাড়ার কিছু পুরোনো ছাত্র একদিন উমাকান্তবাবুর বাড়িতে এসে বলে, “স্যার, আমরা একটা পাক্ষিক পত্রিকা বের করতে চাই। আপনি বেশ জুতসই একটা নাম ঠিক করে দিন। আর প্রতি পনেরো দিন অন্তর আপনার একটি করে ঠাস বুননের প্রবন্ধ আমরা নিয়ে যাব। ও-পাড়ার ‘একান্তে’ পত্রিকাকে কাত করে দিতে আপনার কলমে আজ থেকেই শান দিতে শুরু করুন।”
উমাকান্তবাবুর বাড়ির নাম ‘বনানী’। তিনি ওই নামটাই ছাত্রদের রাখতে বললেন। আর তিনিও ওই বনানীর পাতায় এক হাজার শব্দের একটি করে লেখা নিয়মিত লিখে দেবেন বলে কথা দিলেন।
সেই থেকে ‘একান্তে’ আর ‘বনানী’র মধ্যে একটা সাহিত্যের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। তবে লড়াইটা ঠান্ডা লড়াই নয় মোটেই। কেননা ‘একান্তে’ প্রকাশিত হয় প্রতি মাসের এক তারিখে, আর ‘বনানী’ বেরোয় ষোলো তারিখে। আর ঘটনা হল ‘একান্তে’র পাতায় ভবতোষ যা লেখেন, ‘বনানী’র পাতায় উমাকান্ত লেখেন ঠিক তার উলটো বিষয়ের উপর। এই লেখাকে কেন্দ্র করে দুটি পাড়ার লোক সবসময় সজাগ থাকে। তাই ‘একান্তে’র যারা পাঠক, তারা ‘বনানী’রও পাঠক। ফলে এই দুটি পাক্ষিক কাগজের বিক্রিবাটাও বেশ ভালো। আর মজার কথা হল, দুটি কাগজই প্রকাশিত হয় শহরের একমাত্র ছাপাখানা বাবা লোকনাথ প্রেস থেকে।
মহালয়ার তিনদিন আগে ভবতোষ তরফদার তিন পৃষ্ঠার জায়গায় ছয় পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে ফেললেন। প্রবন্ধের বিষয় ‘সাহিত্যে ভূত’। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে কীভাবে ভূতের গল্পের প্রবেশ ঘটল; কীভাবে সেই গল্প বাঙালির ঘরে ঘরে স্থায়ী জায়গা করে নিল আর ভূত থাকুক বা না থাকুক ভূতের গল্প যেভাবে গল্পকাররা লিখে চলেছেন তারই বিবরণ দিয়েছেন তিনি ওই দীর্ঘ লেখায়। তিনি ভীষণ আত্মবিশ্বাসী যে উমাকান্তবাবু এই ভূতুড়ে ব্যাপার-স্যাপার পড়ে নিজেই ভূত দেখবেন অথবা ভূত হয়ে যাবেন। কেননা, তিনি বেশ ভালোই জানেন যে উমাকান্তবাবুর ‘ভূত’ বিষয়ে সেরকম পাণ্ডিত্য নেই। আরে বাবা ভূত বিষয়টা মোটেই হেলাফেলার নয়। ভূত নিয়েও তো বিদেশে অনেকরকম গবেষণা চলছে। উমাকান্তবাবু কি সে-সবের খবর রাখেন? তিনি তো কেবল কবিদের কবিতা আওড়াতেই ভালোবাসেন। ভূতের পেছনে ছুটবেন কখন?
***
ভবতোষ তরফদারের ‘সাহিত্যে ভূত’ পড়ে-টড়ে নীলমাধব ছুটল স্যারের বাড়িতে। কিন্তু গিয়ে দেখল সদর দরজায় তালা ঝুলছে। নীলমাধব ফোন করল উমাকান্তবাবুর নম্বরে। ও-পাশ থেকে স্যার বললেন, “নীলমাধব, আমি এখন দার্জিলিংয়ে। ভূতের বিষয়টা আমি মাথায় রাখছি। আমাদের কাগজ বের হতে এখনও দশদিন বাকি। আমি ফিরব তেরো তারিখ রাত্রে, চৌদ্দ তারিখ সন্ধ্যার মধ্যে লেখা প্রেসে দিয়ে আসব। আশা করি তার মধ্যে কম্পোজ করে ছাপতে কোনও অসুবিধে হবে না।”
নীলমাধব বলল, “স্যার, তাই করবেন। তবে ভূতটাকে মাথা থেকে তাড়াবেন না যেন। একখানা জোরালো ভূত পুজোতে না নামাতে পারলে বনানীর প্রেস্টিজ থাকবে না।”
ভবতোষবাবুর ‘সাহিত্যে ভূত’ ইতিমধ্যেই মফস্সল শহরে সাড়া ফেলে দিয়েছে। পত্রিকা স্টলে একান্তের সব কপি নিঃশেষিত। আবার নতুন করে কিছু ছাপানো হতে পারে। উমাকান্তবাবুর কলম এবার কেমন ভেলকি দেখায় সেটার জন্যই অপেক্ষা করে আছে সবাই।
এদিকে তেরো তারিখ রাত্রে উমাকান্তবাবু ফিরলেন না দেখে নীলমাধব আবার স্যারকে ফোন করল। কিন্তু স্যারের ফোন বন্ধ। পরদিন সকালে ও বিকেলও বেশ কয়েকবার ফোন করা হল, কিন্তু বার বার সুইচড অফ পেল সে।
কিয়ানন্দ গোস্বামী বাবা লোকনাথ প্রেসের মেশিন ম্যান কাম কম্পোজিটর। লেখা কম্পোজ করা থেকে ছাপার কাজ সবই প্রায় একা হাতে করতে হয় তাকে। কাজল বলে একটি ছেলে সর্টিং-বাইন্ডিংয়ের কাজ করে দেয়।
দশ বাই দশের ছোট্ট ঘরের এক কোনায় একটি পুরোনো কম্পিউটার বসানো। সেই কম্পিউটারের কি-বোর্ডের কাছে একটি চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব ঝোলানো রয়েছে। মেশিনের কালি বাল্বের গায়ে লাগার ফলে সেটা থেকে খুব সামান্যই আলো বের হচ্ছে। সেই অল্প আলোয় মাথা ঝুঁকিয়ে কিয়ানন্দ বনানী পত্রিকার লেখা কম্পোজ করে যাচ্ছে। পুজো সামনেই, তাই এবার বনানীতে চার পাতার একটি ক্রোড়পত্র পাঠকদের উপহার দেওয়া হবে। তারই কম্পোজ করছে সে। উমাকান্তবাবুর লেখা এখনও প্রেসে এসে পৌঁছায়নি বলে প্রথম পৃষ্ঠাটি ফাঁকা পড়ে আছে।
ঘড়িতে যখন রাত এগারোটা, হঠাৎ বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টি মাথায় করে ছাপাখানার দরজায় এসে দাঁড়ালেন উমাকান্তবাবু। হাতে একটি পাণ্ডুলিপি৷ কিয়ানন্দ উমাকান্তবাবুর দিকে না তাকিয়ে কম্পোজ করতে-করতেই বলল, “ঠিক সময় এসে পড়েছেন স্যার। এবার আপনার লেখাটা আজকের মধ্যে ডি.টি.পির কাজটা না করতে পারলে কাল ছাপতে পারব না। এদিকে কাজলটাও ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। বাইন্ডিং-কাটিং সব আমাকেই করতে হবে।”
উমাকান্তবাবু লেখাটি হাত বাড়িয়ে কিয়ানন্দের হাতে তুলে দিলেন। কিয়ানন্দ এক ফাঁকে দেখল স্যারের হাত জল-কাদায় মাখামাখি। পাঞ্জাবির হাতাটা ছিঁড়ে গেছে। রক্তের দাগও দেখা যাচ্ছে পাঞ্জাবির হাতায়।
কিয়ানন্দ বলল, “এ কি স্যার, জল-কাদায় পড়ে গেলেন নাকি? গলির মোড়ের রাস্তাটা যা অন্ধকার। তার উপর খানাখন্দ…”
কথা শেষ করার আগেই উমাকান্তবাবু ছাপাখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছেন।
***
বিশেষ উৎসব সংখ্যা বনানীর প্রথম পৃষ্ঠাটি উমাকান্তবাবুর ‘ভূতের সাহিত্য’ শিরোনামে বের হয়েছে। ‘সাহিত্যে ভূত’ লিখে ভবতোষ যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন, উমাকান্তবাবুর ‘ভূতের সাহিত্য’ সেই লেখাকেও ছাপিয়ে গেছে। তিনি শুরুতেই লিখেছেন, ‘ভূতেরা কি সাহিত্য রচনা করে? না, করে না। তবে মানুষ যখন ভূত-পূর্ব হয়ে যায় এবং তার ভূত অবস্থাপ্রাপ্ত ঘটায় যদি কোনও কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেক্ষেত্রে তার অশরীরী আত্মা সেই কাজ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে।…’
***
নীলমাধব আর কিয়ানন্দ ছাপাখানার ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও উমাকান্তবাবুর পাণ্ডুলিপির কোথাও দেখতে পেল না। তবে কিয়ানন্দ বেশ জোর দিয়েই বলছে ওটা উমাকান্তবাবুর নিজের হাতে লেখা কাগজ ছিল। কিন্তু কার্যত সেটা কী করে সম্ভব? দার্জিলিংয়ে স্যার ধ্বসের মুখে পড়েন তেরো তারিখ রাত্রে। আর কিয়ানন্দ উমাকান্তবাবুর পাণ্ডুলিপি হাতে পায় চৌদ্দ তারিখ রাত এগারোটায়। স্যারের কী ভীষণ কর্তব্যবোধ! এটা ভাবতেই নীলমাধবের মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে এল। তার বার বার মনে পড়তে লাগল স্যারের সুরেলা কণ্ঠস্বর। স্যারের শেষ লেখাটায় হাত বুলিয়ে চোখের জলে পড়তে লাগল, ‘তবে মানুষ যখন ভূত-পূর্ব হয়ে যায় এবং তার ভূত অবস্থাপ্রাপ্ত ঘটায় যদি কোনও কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেক্ষেত্রে তার অশরীরী আত্মা সেই কাজ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে।’
সত্যিই স্যার তাঁর কর্তব্য থেকে সরেননি। বৃষ্টি মাথায় করে তাঁর অশরীরী আত্মা পাণ্ডুলিপি হাতে ছুটে এসেছে ছাপাখানার ঘরে। সাহিত্যে ভূত যে নিছক কথার কথা নয় এটা স্যার প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন এটা ভাবতেই নীলমাধবের গা শিহরিত হতে লাগল। সে দু-হাত তুলে সেই ‘ভূত-পূর্ব অধ্যাপক কাম ভূত-পূর্ব ভূতের লেখক’কে নমস্কার জানাল।
অলঙ্করণ-জয়ন্ত বিশ্বাস