দ্বৈতা হাজরা গোস্বামীর আগের গল্প -লিলিয়া আর চার পুতুলের গল্প , তালপাতার সেপাই, গগন চন্দ্র গড়গড়ি
লক্ষ্মীর ঠাকমা লক্ষ্মীকে ভিনদেশে পাঠানোর সময় একটা কৌটো দিয়েছিল। বলেছিল, “এই কৌটোয় ভরা আছে তোর ছোটবেলা, তোর প্রথম খিলখিল হাসি, তোর দু ফোঁটা চোখের জল, তোর জগত্সংসার। সাবধানে রাখিস বাপু।”
একটা পোঁটলায় বেঁধে দিয়েছিল নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি, খই।
আর দিয়েছিল একটা ছোট্ট বাক্স তাতে তাতে নানা ধরণের বীজ আছে। নানা দেশের নানা শস্যের বীজ। লক্ষ্মীর ঠাকমা তাকে অনেক পুথিপত্র পড়িয়ে, হাতে কলমে শিখিয়েছে সেই সব চাষবাস।
কৌটোর মধ্যে ঠং ঠং ঝুন ঝুন ঝমর ঝমর শব্দ হয়। লক্ষ্মী ভারী মজা পায়। লক্ষ্মী তার দুই বিনুনি দুলিয়ে মুড়ি চিবোতে চিবোতে হাঁটে।
সাদা পেঁচারা উড়ে উড়ে তাকে রাস্তা দেখায়। তারা সব জানে কোথায় কোথায় লক্ষ্মীর কাজ রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্মী একটা গ্রামের মধ্যে এসে হাজির হয়।
একটা ভারী মিষ্টি দেখতে ছেলে তখন পুকুরে চান করে বাড়ি ফিরছিল।
লক্ষ্মীকে দেখে জিজ্ঞেস করে তোমার ওই কৌটোয় কী আছে গো ?
-আমার জগৎসংসার।
-আর ওই পোঁটলায়।
-নারকেলের নাড়ু আছে।
-নাড়ু ? সে আবার কী?
-ওমা তুমি নাড়ু জান না? দাঁড়াও তোমায় দিচ্ছি। এমন স্বাদ যে ভুলতে পারবে না।
লক্ষ্মী তার পোঁটলা খুলে দুটো নাড়ু দেয় ছেলেটার হাতে। জিজ্ঞেস করে, “তোমার নাম কী ?”
“আমার নাম গোপাল ” বলে ছেলেটা নাড়ু খেতে খেতে ঘরের মধ্যে ঢোকে।
গ্রামের লোকজনের খুব অভাব তা গ্রামের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। লক্ষ্মী সেই ঘরের সামনে এসে দ্যাখে একটা মাটির হাঁড়িতে জল দিয়ে কিছু একটা সিদ্ধ হচ্ছে। শাক পাতা, গাছের শেকড় ।
“তোমরা ভাত খাও না, ডাল খাও না, রুটি খাও না?” লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করে।
“সে আবার কী জিনিস?”
ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। লক্ষ্মী কৌটো থেকে মুঠো করে কিছু বীজ এগিয়ে দেয়, “এগুলো মাটিতে পুঁতে, যত্ন করো একদিন ফসল ফলবে।”
“ওমা কী সুন্দর মেয়ে, কী মিষ্টি মুখখানা।”
গোপালের মা তাকে হাত ধরে চৌকিতে বসায়। বলে , “তুমি এসব আশ্চর্য বীজ কথা থেকে পেলে? এমন তো কোথাও দেখিনি!”
“এসব আমার ঠাকুমার ঠাকুমার ঠাকুমার গো। তিনি বনলক্ষ্মী দেবীর কাছে এই সব জ্ঞান পেয়েছিলেন।”
গোপালের মা বলে, “এসেছ যখন থেকে যাও না মা! আমরা তোমার অনেক যত্ন করব। তুমি আমাদের এসব চাষবাস শিখিয়ে দিও।”
লক্ষ্মী গোপালের চোখে তাকায়। তার চোখে যে কী এক মায়া আছে। লক্ষ্মীর থেকে যেতে ইচ্ছে করে।
গোপাল বীজগুলো পুঁতে দেয়। লক্ষ্মীর কথামত রোজ যত্ন করে। দেখতে দেখতে গাছ হয়। একেকটা থেকে একেকরকম। সবাই অবাক হয়ে যায়। বর্ষা,শরৎ গড়িয়ে হেমন্ত আসে। ফসল পাকে।
কিন্তু লক্ষ্মী সেই হেমন্ত পূর্ণিমার রাতগুলোয় জানলা দিয়ে দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা ধান ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকে। সারারাত সে দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। সারা পৃথিবীতে কত মানুষের খাদ্যের সংস্থান নেই। তারা চাষবাস জানে না। তাদের কাছে সেইসব আশ্চর্য শস্যবীজ নেই যা লক্ষ্মী ঠাকুমার ঠাকুমার ঠাকুমার কাছ থেকে পেয়েছে।
লক্ষ্মী ভোর হওয়ার আগেই চলে যায়।
যাওয়ার আগে গোপালকে ঘুম থেকে তুলে লক্ষ্মী বলে, “আমি চললাম গো। আমি একজায়গায় থেকে যেতে পারব না। আমার সারা বিশ্বে অনেক কাজ । তবু তোমাকে, তোমাদেরকে আমি বড় ভালোবেসে ফেলেছি। তাই আমার পিছুটান আমার জগৎসংসারের কৌটো তোমার কাছে রেখে গেলাম। এর ভেতরে যখন টুংটাং ঝমর ঝমর শব্দ হবে জানবে আমি তোমার কথাই ভাবছি।”
আকাশে যখন এরকম চাঁদ ওঠে গোল থালার মতো। গোপালের ওই চাঁদ দেখলেই লক্ষ্মীর কথা মনে পড়ে। লক্ষ্মী যখন এই পথ দিয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই এই পথ দিয়েই ফিরবে। গোপালের উদাস বাঁশির সুর আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়।
লক্ষ্মী যে কত দেশে দেশে ঘোরে! কত ফসল ফলায়! সেই শস্য চাষিবউদের রাঁধতে শেখায়। চাষিদের মুখে হাসি ফোটায়। ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দেয়। এইভাবে তার দিন কেটে যায়। তবু তার মনে পড়ে গোপালের কথা, জগৎসংসারের কথা।
কৌটোয় তখন টুংটাং ঝমর ঝামর শব্দ হয়। গোপাল ভারী খুশি হয়ে ওঠে। কিন্তু সে কখনো কৌটো খোলে না।
এরকম এক অপরূপ হেমন্ত রাতে লক্ষ্মী ফিরে আসে সেই বাড়ির দরজায়। তার দু’চোখে চাঁদের আলো ঝিকিয়ে উঠেছে। গোপালের মা দেখতে পেয়েই নাড়ুর থালা ফেলে ছুটে আসে। বলে, “ও গোপাল কে এসেছে একবারটি দেখে যা।”
লক্ষ্মী এক গাল হেসে দাঁড়িয়ে বলে, “আজ তোমাদের ঘরেই থাকবো বলে এলাম।”
জগৎসংসার আবার দুলে ওঠে গোপালের বুকের ভেতর। টুংটাং ঝমর ঝামর শব্দ হয়।
অলঙ্করণ- রাহুল মজুমদার