[সত্যিকার চরিত্র ও তথ্যের মাঝে বোনা এক কাল্পনিক কাহিনি। আবার এরকম যে হয়নি, তাও কিন্তু বলা যায় না।]
১৮০০ খ্রিস্টাব্দ, লন্ডন শহর
শেষ বিকেলের লালচে কমলা আলো টেমস নদীর বুকে ছড়িয়ে পড়েছে। নদীর ধার দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসছে এক বৃদ্ধ। বোঝা যায়, মানুষটি সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছে। হঠাৎ উলটোদিক থেকে সামনে এসে দাঁড়ায় এক উসকোখুসকো পাগলের মতো মূর্তি। হাত পেতে বাড়িয়ে ধরে অন্যমনস্ক বৃদ্ধের দিকে।
“এ কী, কী চাই?” ঈষৎ কড়া শোনায় বৃদ্ধের গলা।
“দুটি পেনি পেলে কিছু খাই, দুইদিন খাওয়া নেই।” ফ্যাসফ্যাসে গলা শোনা যায় পাগলটার। ভিনদেশি উচ্চারণ।
ভিখারি তাহলে। বিরক্তিতে কুঁচকে ওঠে বৃদ্ধের চোখ-মুখ। বুঝতে পেরেই বোধহয় তড়িঘড়ি বলে ওঠে পাগলাটে লোকটা, “মিনি-মাগনা চাইছি না, দামি জিনিস আছে আমার কাছে, নেহাত বিপদে পড়েছি তাই…”
“তাই নাকি? দেখি কেমন দামি জিনিস।” হাসি পায় বৃদ্ধের। এই পাগলের কাছে কী থাকতে পারে? ঈষৎ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখে পাগলের মুখটার দিকে। মুখ আড়াল করা ছেঁড়াখোঁড়া টুপিটার ফাঁক দিয়ে যেটুকু চোখমুখ দেখা যাচ্ছে তাতে গ্রিক ছাপ স্পষ্ট।
কাঁধে ঝোলানো শতচ্ছিন্ন হতকুচ্ছিত ঝোলায় এবার হাত ঢোকায় পাগলটা। বের করে আনে চৌকো বইয়ের মতো কী যেন। হ্যাঁ, বইই বটে। বাড়িয়ে ধরে বৃদ্ধের দিকে।—“রাজা হয়ে যাবে এটা পড়তে পারলে।”
“তাই নাকি? তা তুমি হওনি কেন?” শ্লেষের সঙ্গে বলে বৃদ্ধ।
“অত প্রাচীন লাতিন আমি পড়তে জানি না। কে পারে তাও জানি না। শুধু জানি অপার সম্পদের সন্ধান আছে এতে।”
‘পাগলের প্রলাপ।’ মনে মনে বিড়বিড় করে বৃদ্ধ। তবে হাত বাড়িয়ে বইটা নেয়। উলটেপালটে দেখে কিছু বুঝতে পারে বলে মনে হয় না। তারপর পকেট থেকে দুটো পেনি নয়, গোটা একটা শিলিং দিয়ে দেয় পাগলাটে গ্রিকটাকে। দুইজনে দুই দিকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সন্ধ্যার আবছায়ায়।
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ, বেলভেডিয়র হাউস, কলকাতা
একতলার সুবিশাল হলঘরের ঠিক মাঝখানে মেহগনি কাঠের অপূর্ব কারুকাজ করা টেবিলের তিনদিকে তিনজন বসে আলোচনায় ব্যস্ত। তিনজনই ইংরেজ। দুজনের পরনে সাধারণ ইংরেজের পোশাক হলেও তৃতীয় জনের পোশাকে স্পষ্ট যে সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বোচ্চ পদে আসীন, অর্থাৎ ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল।
“লর্ড ডালহৌসি, এই বিশাল বেলভেডিয়র এস্টেট ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেলের পক্ষেই উপযুক্ত।”
“ধন্যবাদ মি. প্রিন্সেপ, কিন্তু এই বাড়ি আপনাদের বংশে বহু বছর ধরে আছে।”
“তা আছে, কিন্তু জেমসের মৃত্যুর পর এই বাড়িতে আর ভালোও লাগে না আমাদের। এত কম বয়সে সে যে চলে যাবে…” গলা ধরে আসে চার্লস রবার্ট প্রিন্সেপের।
“বড়ো পণ্ডিত মানুষ ছিল, ভেবেছিলাম দেশে ফিরতে পারলে হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে। এ-দেশের ভাষা, সংস্কৃতির উপর অগাধ জ্ঞান ছিল। কী ভাষা যেন পাঠোদ্ধার করেছিল?” গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির গলায় সান্ত্বনার সুর।
এতক্ষণে মুখ তুলে তাকায় তৃতীয় ব্যক্তি। খুব মৃদু গলায় বলে, “ভাষা নয়, লিপি। ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করেছিল জেমস।”
হা হা করে হেসে ওঠে এবার লর্ড ডালহৌসি। হাসতে-হাসতেই বলে, “এই আরেকজন ভারতপ্রেমী জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন।”
হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বেথুনের চোখ। মৃদু স্বরে বলে, “দেশটাই যে এমন। এ দেশকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না যে।”
হঠাৎ চাপা একটা ঠকঠক আওয়াজে তিনজনেরই দৃষ্টি ফেরে হলঘরের শেষ প্রান্তে একটি দরজার দিকে। দরজার উপর দিকটা অর্ধচন্দ্রাকার। ঠকঠক আওয়াজটা আসছে দরজার ও-পার থেকে। বেথুন সাহেবের মুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। ঘরের বাইরের নকশা যতদূর তার মনে পড়ছে তাতে ওই দরজার ও-পাশে তো উঁচু দেওয়াল হওয়ার কথা। এতক্ষণ ওটাকে স্রেফ সাজানো দরজা বলে মনে হচ্ছিল তার। বেথুনের বিস্ময় দেখে চাপা হাসি ফুটে ওঠে প্রিন্সেপ ও ডালহৌসি সাহেবের মুখে। আওয়াজ পেয়ে চারজন রক্ষী ছুটে এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। কোমরে ঝোলানো পিস্তলের খাপে তাদের হাত প্রস্তুত। চাপা গলায় কথা চলে কিছুক্ষণ। এবার ঘুরে দাঁড়ায় একজন রক্ষী।—“ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ক্যাপ্টেন হলওয়েল আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী, লর্ড ডালহৌসি।”
মাথা নেড়ে সায় দেয় ডালহৌসি। বেথুনের বিস্ময় ততক্ষণে চরমে উঠেছে। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বেলভেডিয়র হাউস পর্যন্ত গুপ্ত সুড়ঙ্গের কথাটা তাহলে সত্যি! এ-পাশ থেকে দরজা খোলার ফলে ততক্ষণে সুড়ঙ্গ থেকে ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছে তরুণ কমান্ডার ক্যাপ্টেন হলওয়েল।—“আপনার হাতে একটা জিনিস তুলে দেওয়ার ছিল লর্ড, তাই সুড়ঙ্গ দিয়ে নিজেই এলাম।” সামরিক কায়দায় কুর্নিশ করে জানায় হলওয়েল। হাতে ধরা চৌকো বস্তুটা এগিয়ে ধরে সেই সঙ্গে।
“কী এটা?”
“আমার রেজিমেন্টের ড্রেক জনসনের পারিবারিক সম্পত্তি এটি। ইংল্যান্ড থেকে আসার পর থেকেই সমানে ম্যালেরিয়াতে ভুগছিল বেচারা। কাল রাতে তার মৃত্যু ঘটে। মারা যাওয়ার আগে এটা আমার হাতে তুলে দেয় সে। তার বাবা নাকি কোন এক গ্রিক ভবঘুরের কাছ থেকে পেয়েছিল। ড্রেক শুনেছিল অতুল সম্পদের সন্ধান আছে নাকি এই বইতে। কিন্তু এ-ভাষা সে পড়তে জানত না।” উত্তেজিতভাবে বলে যায় হলওয়েল।
ততক্ষণে বইটা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখতে শুরু করেছে ডালহৌসি। মুখ দেখে বোঝা যায়, সেও এই ভাষা পড়তে অক্ষম।
“জন, তুমি দেখো, এই ভাষা তুমি হয়তো পড়তে পারবে, ভাষাচর্চায় তোমার দক্ষতা আমাদের থেকে অনেক বেশি।” বইটা বেথুন সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে ডালহৌসি।
গভীর রাত। হুগলি নদীর দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে স্ট্র্যান্ড রোডে। মেটকাফ হলের এই বিশাল ঘরটিতে এসে বসলেই মনটা ভালো হয়ে যায় বেথুন সাহেবের। সামনের খোলা দরজা দিয়ে গ্রিক আদলে তৈরি পিলারগুলো দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটা পিলারের গায়ে মশাল জ্বলছে। সামনের টেবিলে সেজবাতির নীচে খুলে রাখা সেই বইটা। নাহ্, লাতিন সে ভালোই জানে, কিন্তু এত প্রাচীন লাতিন পড়া তার পক্ষেও সম্ভব নয়। কার দ্বারা সম্ভব সেটাও বুঝতে পারছে না বেথুন। বছর তিনেক আগে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরির সমস্ত বই এসপ্লানেড থেকে এই মেটকাফ হলে স্থানান্তরিত হয়েছে। অনেক পণ্ডিতের যাতায়াত আছে এখানে। তবে মুশকিল হল যার যা বই মনে হয় নিয়ে চলে যায়। কে কী নিল, ফেরত দিল কি না এসব নথিভুক্ত করার কোনও উপায়ই নেই। গতবছর এই মেটকাফ হলের লাইব্রেরির কিউরেটর হিসেবে তাকে নিযুক্ত করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই বই নেওয়া আর ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটা যদি একটু নিয়মমাফিক করা যায় তাহলে এখানে রাখা যায় বইটা, যদি কোনও ভাষাবিদ পাঠোদ্ধার করতে পারে। সম্পদের লোভ তার একেবারেই নেই, কিন্তু কী লেখা আছে জানতে বড়ো কৌতূহল হচ্ছে।
বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায় বেথুন। অনেক কাজ সামনে। মেয়েদের জন্য একটা স্কুল বানানোর প্রস্তুতি চলছে। এই দেশটা বড়ো ভালো, কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা একেবারেই নেই। আবার বিশাল ঘরটার চারদিকে তাকায় বেথুন। এই হলঘর যেন পাঠাগার হওয়ার জন্যই তৈরি। যদি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লাইব্রেরিটাও এখানে উঠিয়ে এনে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া যেত। ভাবতে ভাবতে বই হাতে বেরিয়ে যায় বেথুন। কাল মেয়েদের স্কুলের ব্যাপারে ঈশ্বরচন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা আছে। এই মানুষটিকে বড়ো ভালো লাগে বেথুনের। পণ্ডিত মানুষ, লোকে তাকে বিদ্যাসাগর বলে ডাকে।
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ, কলকাতা
অমৃতবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি সংবাদের অংশবিশেষ—
ভাইসরয় হেনরি পেটি-ফিৎসমরিস অর্থাৎ ভাইসরয় ল্যান্সডাউনের উৎসাহ ও তত্ত্বাবধানে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ আর ইস্ট ইন্ডিয়া বোর্ড অফ লন্ডনের পাঠাগারের বই একত্র করে এই ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি গঠন করা হবে। ৫, এসপ্লানেড ইস্ট অর্থাৎ ফরেন অ্যান্ড মিলিটারি সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে এই বিপুল সংখ্যক বই রাখা হবে। অবশ্যই এই পাঠাগার জনসাধারণের জন্য নয়। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাই এই পাঠাগারে প্রবেশের অধিকার পাবেন।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দ, মেটকাফ হল, কলকাতা
লম্বা করিডোর ধরে হেঁটে আসছে দুইজন। একজনের কপালে চিন্তার ভ্রূকুটি।
“এত মূল্যবান বই এখানে এইভাবে পড়ে নষ্ট হচ্ছে, আমার ধারণা ছিল না।” ঈষৎ কঠিন মুখের লোকটি বলে।
“লর্ড কার্জন, ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির পরিস্থিতি এখানের তুলনায় অনেক ভালো। এই লাইব্রেরিতে বহু যুগ কেউ আসে না, সরকারি তহবিলের আপাতত এত জোর নেই যে খাস শহরের বুকে দু-দুটো পাঠাগার বজায় রাখতে পারে। এখানের লোকজনের মাইনে দিতে না পারায় তারা স্বাভাবিকভাবেই আর কাজ করতে চায় না।” অপর ব্যক্তি সামান্য দ্বিধাভরে বলে।
“মি. ম্যাকফারলেন, এই ব্যাপারে আপনার থেকে যোগ্য লোক আর কে আছে। রাজধানীতে বিরাট একটা ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি হোক এ আমার বহুদিনের ইচ্ছা সেটা তো আপনি জানেন। ছোটো ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি আর এখানের এই পুস্তক মিলিয়ে যদি দুটো পাঠাগারকে এক করা যায়। মি. বেথুনের দেখানো পদ্ধতি অনুসারে বিভাগ ও তাক অনুযায়ী বইগুলোর নম্বর দেওয়াই আছে দেখছি। আমার বিশ্বাস, এই মেটকাফ হলই উপযুক্ত স্থান। আর আপনিই সেই গ্রন্থাগারের উপযুক্ত গ্রন্থাগারিক।”
“আমার যোগ্যতা সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নেই লর্ড কার্জন, কিন্তু আরও একজন বোধহয় আমার থেকেও উপযুক্ত।” মি. জন ম্যাকফারলেনের গলায় সামান্য দ্বিধা যেন।
দাঁড়িয়ে পড়ে লর্ড কার্জন। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রাক্তন সহ-গ্রন্থাগারিক কাকে নিজের থেকেও উপযুক্ত বলে মনে করছে?
“আছে একজন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি পড়ায়। বছর পঁচিশ বয়স হবে। কেমব্রিজে আলাপ হয়েছিল আমার সঙ্গে। তখন গ্রিক, লাতিন ও হিব্রু একসঙ্গে শিখছিল ছোকরা। ক্লাসিক্যাল ট্রাইপোস পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কখনও কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছে বলে শুনিনি। তারও আগে নাকি মিশর গিয়ে আরবি ভাষা শিখেছে। তাতেও থামেনি। জার্মানি গিয়ে সংস্কৃত, তুলনামূলক ব্যাকরণ আর ভাষা শিক্ষাদানের ব্যাপারে অনেক কিছু শিখে এসেছে নাকি। গতবছর দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢুকেছে। এ-ছেলে অনেক দূর যাবে।”
“ক্লাসিক্যাল ট্রাইপোস? সে তো খুব সম্মানের ব্যাপার। কে এই ব্যক্তি? নাম কী?” কার্জনকে উৎসাহী দেখায়।
“নাম হরিনাথ দে। শুনেছি পর্যটক ইবন বতুতার বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনি রিহলার ইংরেজিতে অনুবাদ করার কাজে হাত দিয়েছে ইদানীং।”
ছিটকে সোজা হয়ে দাঁড়ায় কার্জন। বিরক্তি ঝরে পড়ে স্বরে—“ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির ভার নেবে একজন ভারতবাসী? কী বলছেন আপনি?”
তরতর করে মেটকাফ হলের সামনের সিঁড়িগুলো বেয়ে নেমে যায় কার্জন। চাপা হাসি ফুটে ওঠে ম্যাকফারলেনের মুখে। বড়ো স্নেহ করে সে হরিনাথকে। একদিন সারা পৃথিবী হরিনাথের নাম জানবে, কেউ আটকাতে পারবে না সেটা।
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ, ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি, কলকাতা
“আরে এসো এসো হরিনাথ, তোমার লঙ্কাবতার সূত্র আনিয়ে রেখেছি। এটার অনুবাদ করলে বৌদ্ধধর্মের উপর একটা বড়ো কাজ হয়।” সহাস্যে স্বাগত জানালেন ম্যাকফারলেন।
জানুয়ারি মাসে সর্বসাধারণের জন্য ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি খুলে দিয়েছে কার্জন। এশিয়াটিক সোসাইটি বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য বই দান করেছে। শুরু থেকেই ম্যাকফারলেন গ্রন্থাগারিকের কার্যভার গ্রহণ করেছে।
ঝলমলে হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে হরিনাথ। বড়ো উজ্জ্বল চোখ দুটো তার। মাথার চুল এলোমেলো, চলাফেরা অন্যমনস্ক। যেন কাজ করতে করতে হঠাৎ উঠে এসেছে, কিন্তু মনটা সেই কাজেই পড়ে আছে।
“পালি শিখছি, তবে অত ভালো এখনও পারি না। সংস্কৃতটাও আরও একটু ভালো করে শেখা প্রয়োজন।” চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে হরিনাথ।
“ক’টা ভাষা শেখা হল হে, সব মিলিয়ে?”
“এই পালি শেখা হলে চৌত্রিশটা হবে।” সলজ্জ গলা হরিনাথের।
ম্যাকফারলেনের অট্টহাস্যে ঘর গমগম করে ওঠে—“যাও, দেখো আজ কী বই নেবে আর।”
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ, কলকাতা
অমৃতবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি সংবাদের অংশবিশেষ—
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক পদে নিযুক্ত হলেন প্রথম ভারতীয়। শ্রী হরিনাথ দে এই গ্রন্থাগারের দ্বিতীয় গ্রন্থাগারিক। তাঁর পূর্বসূরি মি. জন ম্যাকফারলেনের মৃত্যুর পর তিনি এই পদ অলংকৃত করলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হরিনাথ দে চৌত্রিশটি ভাষায় পারদর্শী। তিনি বহু গ্রন্থের টীকাকরণ ও অনুবাদের কাজ করে চলেছেন। তাঁর উৎসাহেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বৎসর ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ স্থাপিত হয়েছে।
ডিসেম্বর ১৯১০, কলকাতা
দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিভাগে আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিনাথ। কী ভালো যে লাগে এখানে। আরও কত কাজ করতে হবে, কত হারিয়ে যাওয়া ভাষা শেখা বাকি। কত হারিয়ে যাওয়া বই খুঁজে বের করতে হবে। অভিজ্ঞানম শকুন্তলমের ইংরাজি অনুবাদের কাজ শেষ। বইটা জায়গামতো রাখতে গিয়ে আরেকটা বইয়ের ফাঁক থেকে ঠুক করে কী একটা নীচে পড়ল। আরে এটা কোন বই! নামধাম কিছু তো লেখা নেই। উলটেপালটে দেখে হরিনাথ। এ তো বহু প্রাচীন লাতিন ভাষায় লেখা। জানে বৈকি পড়তে সেটা। পাতা ওলটাতে ওলটাতে টেবিলে ফিরে আসে হরিনাথ। এসব কী লেখা বইটাতে! খানিক বাদে উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে সে। এত প্রাচীন লাতিন কোনোদিন অনুবাদ করেনি, কিন্তু এ ঠিক দেখছে তো সে? একটা শব্দ যেন সব ছাপিয়ে লাফিয়ে উঠছে চোখের সামনে—পদ্মনাভস্বামী।
আগস্ট ১৯১১, মেটকাফ হল, কলকাতা
“দাদাবাবু এই অসুস্থ শরীল নিয়ে আবার কাজে বসলে, বাড়ি চলো এবার। কাল কোরো আবার।” অনুনয় করে বলে সনাতন।
“তুই বাড়ি যা, আমাকে একজায়গায় যেতে হবে। এই লেখাটা লুকিয়ে ফেলতে হবে বুঝলি।”
“কীসব বলচ দাদাবাবু, কিছু বুজতে পারিনে। নুকোবে কেন? তালে লিকচ কেন?”
ক্লিষ্ট হাসে হরিনাথ। শরীরটা সত্যি বড্ড ভেঙে গেছে। গত কয়েক মাস দিনরাত এক করে কাজ করেছে সে। তার উপর জ্বর, দুর্বলতা, পেটে অসহ্য যন্ত্রণা।
এই বইটা কেন যে সে অনুবাদ করতে গেল। এই অনুবাদ কারও হাতে পড়া চলবে না। নাহ্, যে অমূল্য সম্পদের সন্ধান দেওয়া আছে এখানে, যদি ভুল করে কারও হাতে পড়ে, সর্বনাশ হয়ে যাবে। পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের কথা সে শুনেছে। সে-মন্দির কত পুরোনো ঐতিহাসিকরা তা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না। তবে অষ্টম শতাব্দীর তামিল সাহিত্যে প্রথম এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ডায়েরির আকারে লেখা এই বই। হয়তো কোনও গ্রিক বণিকের দিনপঞ্জী। কারণ দক্ষিণ ভারতের হাতির দাঁত, মুক্তো, এলাচ, হলুদ ও সুতির কাপড়ের কথা লেখা আছে। গ্রিকদের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহুদিন ধরেই ছিল। তবে তন্নতন্ন করে খুঁজেও লেখকের নাম পায়নি সে। আর আছে সেই মন্দিরের কথা। সেখানে এক গোপন বদ্ধ কক্ষে নাকি সঞ্চিত আছে এমন সব অমূল্য সম্পদ যা কল্পনাও করা যায় না। সেই কক্ষের দরজা চিহ্নিত করা আছে দুটি সাপের মূর্তি দিয়ে। সে-দরজা খোলার উপায়ও বলা আছে পুঙ্খানপুঙ্খভাবে। আশ্চর্য সে উপায়। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও বলা আছে যে মনে লোভ নিয়ে সে-দরজা খোলার পরিণাম হবে ভয়ানক। সে-মাশুল দিতে হবে সমগ্র দেশবাসীকে। না, কিছুতেই লোভী কোনও মানুষের কারণে দেশবাসীর উপর সেই বিপদ সে আসতে দেবে না। আর এই ইংরেজদের হাতে পড়লে তো মুহূর্তে সব সম্পদ তারা নিজেদের দেশে নিয়ে চলে যাবে, কিচ্ছু করার থাকবে না। কখনোই সে তা হতে দেবে না। এই বই, এই অনুবাদের খাতা সে লুকিয়ে ফেলবে। কিন্তু যদি কখনও কোনও উপযুক্ত মানুষ আসে, যে সে সম্পদ মানুষেরই কাজে লাগবে, লোভ করবে না, তাহলে? কোথাও লিখে রাখা দরকার যে এই অনুবাদ সে করে রেখেছে। হ্যাঁ, আগে এই দুটোকে সুরক্ষিত করে নিয়ে তারপর লিখে রাখবে সে। প্রায় টলতে টলতে বেরিয়ে যায় হরিনাথ। কোথায় রাখবে সেটা সে জানে। তাকে যেতে হবে বেলভেডিয়র হাউসে। সেখানে সবাই চেনে তাকে, দ্বাররক্ষী ঢুকতে দিতে কোনও সমস্যা করবে বলে মনে হয় না।
গভীর রাত। ভুল বকছে হরিনাথ। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার শরীর। মাথার কাছে বসে অঝোরে কাঁদছে সনাতন।—“অত রাতে কেন বেরোলে দাদাবাবু! আমি কেন তোমার সঙ্গে গেলাম না!”
চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছে হরিনাথের। কত কাজ বাকি থেকে গেল। কেন যে সে ওই অভিশপ্ত বই অনুবাদ করতে গেল। সে তো কোনও লোভ করেনি, তাও নিস্তার পেল না সে। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা নিজের অসমাপ্ত লেখাগুলোর দিকে একবার তাকাতে চায় সে। পারে না। একবার বোধহয় বলে যেতে চায় তার সদ্য অনুবাদ করা বইটির কথা, পারে না। মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে শেষ হয়ে যায় এক বিরল প্রতিভা।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দ, বেলভেডিয়র হাউস
“তাহলে গভর্নমেন্ট হাউসেই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর?” সামনে বসা ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডিউককে জিজ্ঞেস করে ভাইসরয় হার্ডিঞ্জ।
“সেরকমই নির্দেশ পেয়েছি। রাজধানীও কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হচ্ছে শুনলাম।”
“ঠিকই শুনেছেন। আমার দিক থেকেও একটা নির্দেশ আছে। সুড়ঙ্গের এদিকের মুখটাও আপনি বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন।”
“সে কি, কেন? এ সুড়ঙ্গ তো বহুকাল ব্যবহার হয় না। ফোর্ট উইলিয়ামের দিকটা তো বহুদিন বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে, বোধহয় বছর পনেরো আগে।”
“তা হোক। এ-দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে উইলিয়াম। আমাকে হত্যা করার চেষ্টা চলেছিল মনে আছে নিশ্চয়ই?”
“অবশ্যই। কী যেন নাম তাদের?”
“রাসবিহারী বোস আর শচীন সান্যাল। এরা শিক্ষিত, বুদ্ধিমান। একটু চেষ্টা করলেই ফোর্ট উইলিয়ামের বাইরে সুড়ঙ্গের বুজিয়ে দেওয়া মুখ খুঁজে বের করা অসম্ভব হবে না।”
“তাই করব তবে।”
“কোনও লিখিত প্রমাণ যেন না থাকে এই বিষয়ে। আচ্ছা, বেস্ট অফ লাক।”
***
কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। দেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৫৩ সালে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি স্থানান্তরিত হয় বেলভেডিয়র হাউসে। নাম পরিবর্তন করে হয় ন্যাশনাল লাইব্রেরি। আরও অনেক বছর পর আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার নজরে আসে একতলার একটি বদ্ধ ঘর। সেখানে ঢোকার না আছে কোনও উপায়, না বোঝা যাচ্ছে এই বদ্ধ ঘর থাকার কোনও কারণ। ততদিনে বেলভেডিয়র হাউস হেরিটেজ বিল্ডিং, তাই ভাঙাভাঙি করে দেখার প্রশ্নই নেই।
কালের গভীরে হারিয়ে গেছে হরিনাথ। তার বিরল প্রতিভা মনে রাখেনি বর্তমান ইতিহাস। শুধু মাঝে মাঝে কোনো-কোনো রাতে বেলভেডিয়র হাউসের সেই বদ্ধ ঘরটার সামনে দেখা যায় একটা ছায়া। কীসের অপেক্ষায় যেন ঘুরে ঘুরে ফিরে আসছে সে। কাউকে কি কোনোদিন বোঝানো যাবে ওই বোজানো দেওয়ালটার পেছনে আছে এক বহুকালের অব্যবহৃত সুড়ঙ্গ, আর সেখানে ছোট্ট একটা পাথরের খাঁজে রাখা আছে এক অমূল্য সম্পদের সন্ধান? সবার চোখ এড়িয়ে মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো এক নির্লোভ গুণবান মানুষ রেখে এসেছিল সেই সন্ধান। সেই টানেই বুঝি ছায়া শরীর নিয়ে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে সে। অপেক্ষা করে। তবে কিনা, কিছু কিছু জিনিস মানুষের আওতার বাইরেই থেকে যাওয়া মঙ্গল।
অলঙ্করণ দেবসত্তম পাল