গল্প -সায়নীর বন্ধুরা-সহেলী চট্টোপাধ্যায়-শীত ২০২২

সহেলীর আরো গল্পঃ জন্মান্তর রহস্যভাই আর বোনের গল্পহাইজ্যাক কাণ্ড, জড়োয়া হারের রহস্য

GOLPOSAYANI01

বহুদিন কোনও গল্প লেখা হয়নি সায়নীর। যা কাজের চাপ ছিল এতদিন। এই লক ডাউনের সময় ওদের কোম্পানি ভীষণ লসে যাচ্ছিল। সায়নীর কাজটা গেল। সায়নী ট্রাভেল এজেন্সিতে জব করত। কলকাতায় পিসির বাড়িতে থেকে কাজে যেত। কাজটা চলে যেতে এমনি কোনও ঝামেলায় পড়তে হয়নি। মোটামুটি সচ্ছল ফ্যামিলির মেয়ে সে। তবে কলকাতা থেকে ফিরে যেতে হল সেই গ্রামের বাড়িতে। গাড়িতে আসতে-আসতেই ওর মনে হল মুকুন্দপুর যেন আরও অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। চারিদিক নিঝুম ফাঁকা ফাঁকা। দূরে পাহাড়ের রেখা কেমন অস্পষ্ট হয়ে আছে। অনেক দিন পর বাবা-মা ওকে দেখে খুব খুশি। সায়নীও খুব খুশি। যদিও কাজ চলে যাওয়ার কষ্ট বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে আছে। বাবার মনে হয় ওর মুখ দেখে মায়া হল। আশ্বাস দিয়ে বলল, “কাজ পেয়ে যাবি। কোনও চিন্তা নেই মামণি।”

মা বলল, “কলকাতার জল-হাওয়ায় অনেক শুকিয়ে গেছিস। এবার ভালো করে কিছুদিন রেস্ট নে।”

বাড়ির পেছনে বাঁধানো পুকুর। সায়নী বিকেলের দিকে অনেকক্ষণ বসে বসে দেখল। সন্ধ্যামণি গাছ সব ফুলে ভর্তি। চেরি গাছে ফুল এসেছে। বাবা চেরি গাছটা লাগিয়েছিল। কৃষ্ণচূড়াও লাল হয়ে আছে। পুকুরের জলে তার ছায়া পড়েছে। পুকুরে বাবা অনেক পদ্ম লাগিয়েছে। একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। বাতাবি লেবু গাছে ফুল এসেছে। তারই মনকেমন করা গন্ধ। কোকিল ডেকে উঠল। একটা দোয়েল দোল খাচ্ছে গাছের ডালে। কতদিন সায়নী বুক ভরে শ্বাস নেয়নি। ছোটো একটা রুমে আকাশ দেখা যায় না। ছাদে উঠলে শুধু বাড়ি আর বাড়ি। আর মোবাইল টাওয়ার। শহরে থাকতে গেলে অনেক কিছু মিস করতে হয়। আশেপাশের বাড়ি থেকে বেজে উঠল শাঁখ। ছোটো ভাই পলাশ এসে ওকে ডাকল। মা চা নিয়ে বসে আছে। ইচ্ছা না হলেও ওকে উঠতে হল।

ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে সায়নী মর্নিং ওয়াকে বেরোল। বাড়িতে কেউ এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। শুধু পলাশকে বলে এসেছে। আসার সময় মোবাইল নিয়ে আসতে ভোলেনি। নিজের প্রিয় জায়গাগুলো ক্যামেরাবন্দি করতে থাকে সায়নী। পাখির ডাক রেকর্ড করে। কী সুন্দর একদল ফড়িং উড়ছে! ছেলেবেলায় ফড়িং ধরা ওর প্রিয় খেলা ছিল। সায়নী মোবাইলে পটাপট কিছু ছবি তুলে নেয়। নিজের সেলফি তুলতে গিয়ে আর একটু হলেই আছাড় খাচ্ছিল। কে যেন ওকে ধরে ফেলল। সায়নী দেখল খুব সুন্দর দেখতে একটি মেয়ে। মুখে মাস্ক নেই। ওর থেকে একটু ছোটোই হবে। বলল, “ফোন নিয়ে একেবারে মশগুল দেখছি। এখনই তো আছাড় খাচ্ছিলে গোবরে!”

গ্রামের এইসব মানুষগুলো খুব সরল হয়। সায়নী মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানাল। মেয়েটি বলল, ওর নাম ফুলি।

বাড়ি ফিরে দেখল সবাই উঠে পড়েছে। বাবা বলল, “তোর বেরোনো উচিত হয়নি। বাইরে থেকে এসেছিস, তোর সাতদিন কোয়ারেন্টাইন করা উচিত।”

মাও বলল, “হ্যাঁ। আর এত ভোরে বেরোনো ঠিক নয় মা। কতরকম লোক থাকে।”

সায়নী মাথা নাড়ে। তাও ভালো ফুলি ছাড়া আর কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। সায়নীর করোনা টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ। কয়েক সপ্তাহ আগে জ্বর হওয়াতে টেস্ট করিয়েছিল। তবু সাবধানের মার নেই।

পরের দিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সায়নী বিছানায় শুয়ে ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। ভোরে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে ও অনেক ফটো তুলেছিল। ফটোগুলো সায়নী দেখতে থাকে। নানারকম ছবি। আকাশ, গাছপালা, রাস্তা, সায়নীর নিজের নিজস্বী। কোনও মাথামুণ্ডু নেই। সায়নী স্ক্রোল করতে থাকে। একইরকম ছবি অনেক হয়ে গেছে। এক ঝাঁক ফড়িং উড়ছে। খুব সুন্দর লাগছে ছবিটা। মোবাইলে জুম করে সায়নী। ফড়িংয়ের ঝাঁক খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটা ফড়িং একটু অন্যরকম লাগছে। সায়নী আবার জুম করে। এই তো ফড়িংয়ের ডানা। ওমা! ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত-পাও আছে! এটা কী ধরনের ফড়িং? মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা মানুষ, না না, মানুষ বললে ভুল হবে। ছোট্ট একটা মেয়ে, দু-দিকে ডানা মেলে দিয়েছে আকাশ। মাথার ওপর খোঁপা। যেন কোন পুঁচকে পরি আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। সায়নী অনেকবার দেখল। ইস, সত্যি কি পরি বলে কিছু আছে? সায়নীর ঘুম উধাও হয়ে যায়। দুপুরে বেরিয়ে পড়ল ওর সাইকেলে চড়ে। কাল যেখানে ফড়িংয়ের ঝাঁকের ছবি তুলেছিল, সেইখানেই ও যাবে। পথে পুরোনো চার্চের জঙ্গল। এই জায়গাটা ওর খুব প্রিয়। ওদের স্কুলের পেছনে বড়ো একটা চার্চ ছিল। সেই ব্রিটিশদের আমলের চার্চ। সবাই পুরোনো চার্চ বলে। এখন কেউ এখানে আসে না। চারদিকে বড়ো বড়ো গাছপালাতে ভর্তি। জঙ্গলের মধ্যে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। খুব কাণ্ড। এই জঙ্গলে প্রচুর গোলাপ হয়েছে! কে লাগাল, এত গোলাপ? সাইকেল থেকে নামল সায়নী। চার্চের দিকে পায়ে পায়ে এগোতে থাকে। ঘাসের বন নড়ছে। চিতা লুকিয়ে নেই তো? কিন্তু না, চিতা-টিতা কিচ্ছু নয়, ফুলি বেরিয়ে এল ঝোপ থেকে। সায়নী জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কী করছে এখানে?”

ফুলি হেসে বলল, “গোরুর জন্য ঘাস দেখতে এসেছিলাম। পেলাম না।”

কিন্তু ওর হাতে কাস্তে ঝুড়ি কিছুই ছিল না।

ফুলির মুখখানা খুব সুন্দর। পরনে শাড়ি। মাথার ওপর খোঁপা। ফুলির কাঁধে একটা ফড়িং এসে বসল। সায়নীর মাথাটা কেমন গুলিয়ে উঠল। কেউ যেন বলছে, তোমার মোবাইলে ফড়িংয়ের ঝাঁকের ছবি কাউকে দেখালে ফল ভালো হবে না। ওগুলো মোটেও ফড়িং নয়। মানুষ দেখলেই আমরা ফড়িংয়ের রূপ নিয়ে নিই। রিনরিনে মিষ্টি সুর অথচ কেমন ধমকের সুর।

“তুমি বা তোমরা আসলে কে?” সায়নী কোনোভাবে জিজ্ঞাসা করে। ওর গলা শুকিয়ে এসেছে। কপালে ঘাম।

“আমরা তোমাদের দুনিয়ার কেউ নই। আমরা পরি। তোমরা আমাদের অন্য গ্রহের প্রাণী বা এলিয়ন বলো। মাঝে মাঝে পৃথিবীতে বেড়াতে আসি আমরা।” আবার সেই মাথার মধ্যে রিনরিনে গলা।

“আর যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করি?” সায়নী জিজ্ঞাসা করে।

“কেউ বিশ্বাসই করবে না। সবাই বলবে, এটা ফেক। পৃথিবীর মানুষ এখনও আসল-নকলের পার্থক্য বোঝে না। আর তোমাকে আমরা উড়িয়ে নিয়ে যাব আমাদের রাজ্যে।”

মাথার ওপর এক ঝাঁক ফড়িং উড়ে গেল বোঁওওও করে। ফুলি ওকে একভাবে দেখতে লাগল। চোখে ঠান্ডা একটা দৃষ্টি। ফুলি দু-হাত দু-দিকে মেলে দিল। ওর দু-দিকে ঝকঝক করছে দুটো ডানা। ফুলিকে পরির মতো লাগছে। ফুলির শরীরটা ছোটো হতে হতে ফড়িংয়ের আকার নিল। আকাশে উড়ে গেল ফুলি, সেই ফড়িংয়ের ঝাঁকের মধ্যে জায়গা করে নিল। ফড়িংয়ের ঝাঁকের সবাই এক-একটা পরি। সবাই মিলে খুব সুন্দর একটা সুরে গান গাইছে। হাত ধরাধরি করে নাচছে। সায়নীকে দেখে হাত নাড়ছে পুঁচকে পরিরা। সায়নীও হাত নাড়ে।

মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল সায়নীর। সন্ধে নামতে শুরু করেছে। মা চা করে ডাকছে। তাহলে এতক্ষণ সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল! ওহ্, পরি বলে সত্যি কিছু আছে নাকি আবার? সায়নী হেসে ফেলল। পর্দা সরিয়ে ঘরে যে প্রবেশ করল তাকে দেখে সায়নী বিষম খেল। মুড়ি আর আলুর চপের বাটি হাতে ফুলি। সায়নী জিজ্ঞাসা করল, “আরে ফুলি! তুমি কোথা থেকে?”

উত্তরটা দিল মা-ই, “আরে ও ফুলি নয়। ও তো পরি। কমলার দাদার মেয়ে। গত ছ’মাস ধরে কাজ করছে। পড়াশোনাও করে। খুব ভালো মেয়ে।”

মা পরির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সায়নীর দিকে তাকিয়ে পরি মিষ্টি করে হাসে। কেউ যেন বলে উঠল, যা বলেছি মনে থাকে যেন, নইলেই বিপদ। ওর মাথার মধ্যে বলা কথাগুলো সায়নী ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না।

মোবাইলে তোলা ফড়িংয়ের ঝাঁকে এখনও ফুলিকে মানে পরিকে বেশ চেনা যাচ্ছে। ছবিটা ও কাউকে দেখাবে না। এটা ওর নিজস্ব সম্পদ। কারও সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না।

GOLPOSAYANI02

অলঙ্করণ-মৌসুমী রায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s