গল্প-নিঝুম দুপুর-শর্মিষ্ঠা সেন-শীত ২০২২

এই লেখকের আগের গল্প- স্বর্ণময়, গল্প বোনা

GOLPONIJHUM01

ঠিক সাড়ে তিনটেয় বাস থেকে নেমে ঝিনুক প্রথমে বুলুপিসিদের বাড়িতে ঢুকল। নবপল্লীর মোড়ে নেমে একটু এগিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই প্রথম বাড়িটা বুলুপিসিদের। ঝিনুকদের তার পরের বাড়িটা। সাদা রঙয়ের ছোট্ট দোতলা বাড়ি। খয়েরি গেট। গেটের ওপর আর্চ বেয়ে মাধবীলতার ঝাড়। সারাবছর কমবেশি ফুল দেয় গাছটা। ঝিনুক বুলুপিসির বাড়ি যাবে চাবি আনতে। মা-বাবা দুজনেই অফিসে আর ঠাকুমা ফুলমণিকে সঙ্গে নিয়ে দেশের বাড়ি মালদা গেছেন। তাই আপাতত এই ব্যবস্থা।

বুলুপিসিদের বেলটা বাজাতেই সুইটুর আওয়াজ পেল ঝিনুক। সুইটু ওদের কুকুরের নাম। সাদা রঙের স্পিৎজ, ঝোলা ঝোলা লোমওয়ালা। খুব বিচ্ছু। কুকুর না কাঠবেড়ালি কে জানে! সারাদিন দৌড়ঝাঁপ। ওরা বলে সুইটু একদম মানুষের মতো। সব বোঝে। আনন্দ পায়, দুঃখ পায়, অনিয়মে অসুখ করে, খাওয়াদাওয়াও মানুষের মত। ডগ ফুড নয়, সুইটু মাংস-ভাত খেতে অভ্যস্ত। রোজ আলাদা রান্না হয় তার জন্য। শুধু কথাটাই যা বলতে পারে না। ঝিনুক কুকুর-বেড়াল-পশুপাখি একদম পছন্দ করে না। সে জানে কুকুর আঁচড় দিলেও ইঞ্জেকশন নিতে হয়, আর বুলুপিসিদের বাড়ির কুকুরটা সবসময় ঝিনুকের গায়ে লাফিয়ে উঠতে চা। আজও দরজাটা খুলতেই ঝাঁপিয়ে আসতে চাইল সুইটু, ঝিনুক চট করে সরে দাঁড়াল একপাশে। বুলুপিসির মা বলেন, ‘ওরে, তোকে ভালোবাসে বলে অমন করে, খেলতে চায়।’

হুহ্! ভালোবাসা না ছাই! ঝিনুককে এমনিতেই অনেক লোক ভালোবাসে, আর ভালোবাসার দরকার নেই। ঝিনুক দিদার থেকে চাবির থোকা নিয়ে এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে যায়।

ফ্রেশ হয়ে একা-একাই খাবার বেড়ে খেয়ে নেয়। খাবার মা সকালে জলসরা করে রেখে গেছে। জলসরা মানে খাবারের পাত্রগুলো জলের মধ্যে বসানো থাকে যাতে নষ্ট না হয়। এখন ফুলমণি নেই। মা অনেক সকালে রান্না করে অফিস যায়। মায়ের অফিস নরেন্দ্রপুর। দক্ষিণ কলকাতায়। বাসে অনেকটা সময় লাগে। বাবার বরং কাছে। বাবা ঝিনুককে আটটায় বাসে তুলে বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়াদাওয়া করে বেরোয়। বাবাকে অবশ্য সব দিন অফিস যেতে হয় না। ওদের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করা যায়। যখন ক্লায়েন্টের সাইট ভিজিট থাকে বা মিটিং থাকে তখন গেলেই হল। বাবা বাড়িতে থাকলে সারাদিন ল্যাপটপ খুলে টুকুর টুকুর করে খোপ কেটে তাতে লেখে আর রঙ ভরে। আর কাজ না থাকলে পড়াশুনো করে।

ঝিনুক ঠিক করে নিয়েছে ও বড়ো হয়ে চাকরি করবে ন। ও বরং ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলবে। তাতে শুধু টয়েজ আর কমিক বুকস থাকবে। ঝিনুকের এবার ক্লাস সিক্স। এখন অনেক বড়ো হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। মা-বাবার মতো এত এত পড়াশুনো করে শেষমেশ সেই খাটুনি করা ঝিনুকের পক্ষে সম্ভব নয়। বরং বুলুপিসির জব অনেক ভালো। বুলুপিসি কলেজে পড়ায় আর মাঝে-মাঝেই দেশে-বিদেশে পেপার পড়তে যায়। সেভাবে দেখতে গেলে, এ-পাড়ায় ঝিনুকের একমাত্র বন্ধু বুলুপিসি। বাকিরা যারা আছে, যেমন সামনের বাড়ির পপিদি, ক্লাস এইট আর দুটো বাড়ি পরে সম্বুদ্ধদা, ক্লাস নাইন, ওরা ঝিনুককে খুব হেয় করে। সবাই গল্প করলেও ঝিনুককে মোটেও কাছে ডাকে না। গম্ভীর হয়ে বলে, ‘খুকি, এখন নয়, আমরা বড়োরা কথা বলছি।’ কই, বুলুপিসি তো এমন বলে না! বুলুপিসি যেমন ঝিনুকের বন্ধু তেমন মায়েরও বন্ধু। আর প্লাস পয়েন্ট হল বুলুপিসির কাছে হ্যারি পটারের সবক’টা বই আছে। প্রথম দুটো পড়া হয়ে গেছে। সেভেনে উঠলে তিন নম্বর বইটা পড়তে দেবে বলেছে।

খাবার খেয়ে, প্লেট সিঙ্কে নামিয়ে এসব নানান কথা ঝিনুক ভাবে খাটে শুয়ে। জানালার পর্দাটা সরানো। কী সুন্দর সাদা মেঘ ভেসে যায়! ভালো করে দেখলে বোঝা যায় সাদাটা আসলে ধবধবে সাদা নয়, অনেক শেডের সাদা। একটু গ্রে মেশানো, একটু ব্লু মেশানো, একটু ইয়েলো মেশানো সাদা। অনেকটা ঠাম্মার গায়ের সাদা পশমিনাটার মতো—সাদার ওপর হালকা হালকা কাজ, গতবার সিমলা থেকে কেনা হয়েছিল। ঠাম্মা থাকলে এতক্ষণে সব পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে জোর করে ঝিনুককে ঘুম পাড়াত। অবশ্য ঠাম্মার দোষ নেই। এসব হয় মায়ের জন্য। মায়ের ধারণা, ঝিনুক সময়ের মূল্য বোঝে না। তাই সব ঘড়ি ধরে। টিভি দেখাও সেই রবিবারে। শনিবার যে গান থাকে। সকাল থেকে রেওয়াজ করতে হয়। অবশ্য ঝিনুক টিভি দেখতে পছন্দও করে না। বুলুপিসির ছুটি থাকলে দুজনে মিলে ল্যাপটপে সিনেমা দেখে, গান শোনে এবং গলা ছেড়ে গানও করে। ও-বাড়িতে অনেক বেশি আনন্দ। এ-বাড়িতে শুধু শাসন আর নিয়ম। এখানে জোরে কথা বলা যায় না। বাবা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করলে তো হয়েই গেল। তখন গোটা বাড়িটাকেই প্রিন্সিপাল ম্যামের অফিস মনে হয়। ঠাম্মা আসবে সামনের সপ্তাহে। দেশের বাড়িতে জেঠু থাকে, বড়ো মা থাকে আর থাকে পলাশদাদা। সে-বাড়িতে অনেক বড়ো বড়ো গাছ আছে। আম, লিচু, কাঁঠাল, সুপুরি এসব। সবসময় কেমন ছায়া ছায়া অন্ধকার। সবসময় পাখির কিচকিচ, চ্যাঁ চ্যাঁ—একদম মিস্ট্রি স্টোরিগুলোর মতো। কে জানে ঠাম্মা এখন কী করছে! খুব গল্প করছে হয়তো। ওরা কি আর ঝিনুকের কথা ভাবছে? একবারও কি বলছে, আমাদের সোনামণিটা কেমন তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে গেল! বড়ো মা নিশ্চয় এবারও টক-মিষ্টি আমের আচার পাঠাবে, আমসত্ত্ব পাঠাবে। ঝিনুক রোজ দুপুরে শুয়ে শুয়ে আমসত্ত্ব গালে পুরে ঠাম্মার সঙ্গে গল্প-টল্প করবে।

বাবা আসবে পাঁচটায়। মা ফোন করে সব হোমওয়ার্ক করে ফেলতে বলেছে। আচ্ছা, মা তো বলতে পারত, ‘ঝিনুক, তোমার মনখারাপ করছে না তো? ঠিক আছে, আজ পড়তে হবে না, তুমি গান শোনো। আমি আইসক্রিম আনব।’ যদিও ঝিনুকের মনখারাপ করছে না, তবুও, মা আদর করলে কত্ত ভালো লাগে। মা এখন শুধু বলে, ‘ঝিনুক, যথেষ্ট বড়ো হয়েছ, এভাবে সময় নষ্ট কোরো না! ঝিনুক, ফল খেয়ে নাও। ঝিনুক, বই গুছিয়ে রাখোনি কেন?’

বড়োরা কেউ জানে না, ঝিনুক চুপচাপ শুয়ে অনেক কিছু ভাবে। যদি স্পাইডারম্যান আর সুপারম্যানের দেখা হয় কখনও, কী হবে; যদি হলিউডে প্রফেসর শঙ্কুকে নিয়ে স্পিলবার্গ মুভি বানান তাহলে কে প্রফেসর শঙ্কু হবে; বড়ো হয়ে যদি ঝিনুক একজন সুপার পাওয়ারফুল কমিক ক্যারেকটার তৈরি করে তাহলে সে ম্যান হবে না উওম্যান। ঝিনুকের নিজের পছন্দ উওম্যান। বুলুপিসির মতো। তবে এখন ও-বাড়িতে সবাই সুইটুকে নিয়ে মেতে থাকে। ঠাম্মা বলে, দাদু-দিদাকে ব্যস্ত রাখার জন্য এই ব্যবস্থা। হবেও-বা। আগে বুলুপিসি কোথাও গেলে ওদের বাড়ি থেকে কোনও আওয়াজ পাওয়া যেত না। এখন সবসময় হইচই, সুইটুর ভৌক ভৌক। ও-বাড়ির দাদু রোজ পার্কে যায়, মাঝে মাঝে ঝিনুকও থাকে, যেদিন ঠাম্মা হাঁটতে বেরোয়, সেই দিনগুলোয়।

আচ্ছা, ঝিনুক কি অঙ্কগুলো করে নেবে? না আর একটু শোবে? চারটে বেজে গেছে। একটু আগেই ঘড়ি শব্দ করে বলেছে। ঘড়িটা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাজে। রাত্তিরে আলো নেভালে ঘড়িও ঘুমিয়ে পড়ে। কী ভালো না? অবশ্য ঝিনুকের বেশি পছন্দ জেঠুর বাড়ির পেন্ডুলাম দোলা ঘড়ি। সেটা চব্বিশ ঘণ্টাই ঢং ঢং করে আওয়াজ করে। মা বলে, ও-বাড়ি গেলে প্যাঁচার মতো জেগে থাকতে হয় সারারাত। মায়ের ঘুম খুব পাতলা। ঝিনুকের দুধের গ্লাসে যেমন সর পড়ে, তেমন। ঝিনুকের তো ঘণ্টা গুনতে-গুনতেই ঘুম এসে যায়। কেমন নৌকোয় চড়ে হালকা দুলুনির মতো। সেই যে একবার মায়াপুরে যাওয়া হয়েছিল, নবদ্বীপ থেকে নৌকো চড়ে, তেমন। নবদ্বীপে ঠাম্মার বাপের বাড়ি। ঝিনুককে সবাই খুব আদর করেছিল। ঝিনুক তখন অনেক ছোটো। মন্দিরে ঢোকার আগে লাল টুকটুকে জুতো খুলতে হয়েছিল বলে ঝিনুক প্রবল আপত্তি করেছিল এটা শুধু মনে আছে। আর কী যেন হয়েছিল? ঝিনুক কোলে-কোলেই ঘুরেছিল। এখন আর কেউ কোলে তোলে না। ঝিনুক যে বড়ো হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মায়ের কোলে উঠতে। মায়ের শ্যাম্পুর গন্ধটা এত ভালো যে নাকে এলেই আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসে—কী কমফোর্টিং!

“এই যে, ঝিনিঝিনি ঝিনুকমালা, উঠে পড়ো।”

ঝিনুক শুনতে পেল কে যেন অনেক দূর থেকে ডাকছে। মাথায়, কপালে ঠান্ডা ঠান্ডা আঙুলের ছোঁয়া। ঝিনুক চোখ খুলে দেখল রোদ পড়ে গেছে কখন! মা পাশে বসে। হালকা হলুদ হাউজ-কোট গায়ে, তার মানে গা ধোয়াও হয়ে গেছে।

“মা, তুমি কখন এলে?”

“অনেকক্ষণ। বাবাও এসে গেছে। ঝিনিসোনা একা একা কী করছে দেখতে চলে এলাম।”

“মা, একটু পাশে শোবে? আর দু-মিনিট ঘুমোই?”

“না না, এবার উঠে পড়, রাতে ঘুম আসবে না।” বলেও মা ঝিনুকের পাশে একটু শুয়ে পড়েন। ঝিনুক মায়ের শরীরে ঢুকে গিয়ে মাকে আঁকড়ে ধরে।

আসলে ঝিনুক বড়ো হতেই চায় না। ছোটো থাকাই সুখের। পাশের বাড়ি থেকে প্রবল ভৌক ভৌক, কুঁ কুঁ শোনা যায়। বুলুপিসিও কলেজ থেকে ফিরে এল। এটা সুইটুর খুশির ডাক।

GOLPONIJHUM02

অলঙ্করণ-মৌসুমী রায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s